#একটি_সাঁঝরঙা_গল্প
#তানিয়া_মাহি
#পর্ব_১২
সবাই খাবার টেবিলে খেতে বসেছে। আবির আজকে ছুটি নিয়েছে আজ সে অফিসে যাবে না। জাভেদ সাহেব বিকেলের দিকে একবার গিয়ে ঘুরে আসবেন।
আবির, নিশো এবং জাভেদ সাহেব একসাথেই বসেছেন। আমিনা আজ সকাল সকাল কয়েকপদের নাশতা রেডি করেছে। রাবেয়া বেগম সেগুলো পরিবেশন করছেন। জাভেদ সাহেব কিছুক্ষণ পরপর ঘড়ি দেখছেন। ফালাক এখনো বাসায় ফিরেনি। তার আজকে কোচিং যেতে হয়েছে। গত কয়েকদিন কোচিংয়ে না যাওয়ায় কলেজ থেকে কল দিয়েছিল তাই বাধ্য হয়ে আজ যেতে হয়েছে। সকাল সকাল রেডি হয়ে বেরিয়ে গেছে সে। সাড়ে নয়টা বেজে গেছে। কোচিং আটটা থেকে নয়টা পর্যন্ত ছিল। মেয়েটা এখনো বাসায় ফিরেনি বলে জাভেদ সাহেবের একটু চিন্তা হচ্ছে।
জাবেদ সাহেবকে খেয়াল করে রাবেয়া বেগম বলে উঠলেন,“ কী হয়েছে? বারবার ঘড়ি দেখছো কেন? ”
জাবেদ সাহেব সংক্ষেপে বললেন, “মেয়ে তো সকাল সকাল বেরিয়ে গেছে। সবাই একসাথে নাশতা করতে বসেছি শুধু সে নেই।”
রাবেয়া বেগম পরিমিত হাসলেন।
“তোমার মেয়ের আজকে জন্মদিন। আমি নিশ্চিত ওর বন্ধুরা কলেজ থেকে কল করিয়েছে। কোচিং শেষ করে, বন্ধুরা মিলে হয়তো কিছু করছে চলে আসবে তাড়াতাড়ি। তুমি চিন্তা করো না। নাশতা করে নাও।”
আবির পাশ থেকে বলে উঠলো, “ফুফুর বাড়িও যেতে পারে। আজ নাকি ইয়াদ আর তোয়ার আসার কথা। হয়তো একেবারে ওদের নিয়েই বাড়ি ফিরবে।”
জাভেদ সাহেব মৃদু গলায় বলে উঠলেন,“চারপাশের যা অবস্থা, মেয়েকে বাহিরে যেতে দিতেও ভয় লাগে। ”
নিশো এতক্ষণ চুপ করে ছিল। জাভেদ সাহেবের কথার পরিপ্রেক্ষিতে সে বলল,
“চাচা, এ অঞ্চলে কারো সাহস নেই ফালাকের কিছু করার বা ফালাককে কিছু বলার। আপনি নাশতা করে নিন। আবির তুই নাহয় কল করে দেখ সে কোথায়? ”
শেষের কথাটা নিশো আবিরকে উদ্দেশ্য করে বলল। আবির নিশ্চুপভাবে নিশোকে কিছুক্ষণ দেখে বলল,
“হ্যাঁ আমি নাশতা শেষ করে দেখছি।”
হঠাৎ সদর দরজার দিকে মেঝেতে কিছু পড়ার শব্দ হতে সবাই পিছন দিকে ফিরে তাকালো। ফালাক নিচে মেঝের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টো করে কাঁদো কাঁদো ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। রাবেয়া বেগম মেয়ের দিকে দৌঁড়ে গেলেন। ফালাক তখনো চুপচাপ অন্যমনস্ক হয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। রাবেয়া বেগম মেয়ের কাছে এসে বললেন,
“কী পড়ে গেল? প্যাকেটের ভেতরে কি ছিল?”
ফালাক হতাশ চোখে নিশোর দিকে তাকালো। সুর কোমল করে বলল,
“একজন কাচের চুড়ি দিয়েছিল সেটা বারিশকে দেখানোর জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম ওটাই এখন হাত থেকে পড়ে গেল। চুড়িগুলো হয়তো ভেঙে গেছে। আমার জন্মদিনের উপহার ছিল ওগুলো।”
নিশো একবার মেঝের দিকে আরেকবার ফালাকের দিকে তাকাচ্ছে। খেয়াল করল ফালাকের চোখ টলমল করছে।
ফালাক মেঝেতে বসে পড়ল। কাগজের মোড়ানো চুড়িগুলো তুলে হাতে নিল। মোড়ক খুলে দেখলো চুড়িগুলোর বেশিরভাগ ভেঙে গিয়েছে। আবির চেয়ার ছেড়ে উঠে এলো। বলল,
“এটার জন্য মন খারাপ করতে হবে না। আমি চুড়ির ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”
ফালাক আবিরের দিকে তাকালো। বলল, “এটা উপহারের চুড়ি ছিল, ভাইয়া। ”
ফালাক আর না দাঁড়িয়ে নিজের রুমে চলে গেল। আবির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের চেয়ারে এসে বসলো। নিশোর দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাই, তুই ফ্রি আছিস না? ”
নিশো ওপর-নিচ মাথা নাড়িয়ে বলল, “হ্যাঁ, কেন বল তো?”
“আমার এখন বাজারে যেতে ইচ্ছে করছে না। তুই একটু যাবি প্লিজ! কিছু চুড়ি এনে দে ফালাককে না হলে আজ সারাদিন মন খারাপ করে থাকবে। আজকের দিনে আমি ওর মন খারাপ দেখতে পারবো না। আমি টাকা দিচ্ছি তুই একটু এনে দে। ”
নিশো নাশতা শেষ করল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমার কাছে টাকা আছে। এটার জন্য তোকে টাকা দিতে হবে না। তাছাড়া বাজারের দিকে একটু আমার কাজও ছিল। আমি ফেরার পথে ফালাকের জন্য চুড়ি নিয়ে আসবো। টেনশন নট।”
ফালাকের মন খারাপ দেখতে নিশোরও ভালো লাগে না তাই সে নাশতা শেষ করেই মার্কেটের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। যে দোকান থেকে আগে চুড়ি কিনেছিল সেখানেই আবার গেল পুনরায় চুড়ি কিনতে। ভেঙে যাওয়া চুড়িগুলোর মতোই আরেক ডজন নিলো সে। ঝুলিয়ে রাখা পায়েল দেখে মনে পড়ল একবার ফালাক জোর করেই তার থেকে পায়েল কিনে নিয়েছিল। পায়েলগুলো দেখে মৃদু হাসলো সে। ভাবলো, ফালাকের পায়ে গোল্ডেন রঙের পায়েল বেশ মানাবে। দাম জিজ্ঞেস করতেই দোকানী জানালো পায়েলের দাম আড়াইশো টাকা। পকেট থেকে পাঁচশো টাকার নোট বের করে চুড়িগুলো আর পায়েলটা নিল সে। হাসিমুখে বাড়ির দিলে রওয়ানা দিল।
বাড়িতে আজ ভালো ভালো রান্নাবান্না হচ্ছে। রাবেয়া বেগম আমিনার সাথে রান্নাঘরে ব্যস্ত। জাভেদ সাহেব আর আবিরকে দেখতে পেল না নিশো। রান্নাঘরের সামনে গিয়ে রাবেয়া বেগমকে ডেকে বলল,
“চাচি, ফালাক কোথায়? ওর জন্য চুড়ি আনতে বলল আবির৷ ওগুলো নিয়ে এসেছি।”
রাবেয়া বেগম রান্নার ব্যস্ততায় বললেন,“ফালাক রুমেই আছে। বাবা তুই ওকে গিয়ে এগুলো দিয়ে আয় একটু। আমি ব্যস্ত আছি। আমি এখন যেতে পারছি না। ”
নিশো আর কিছু বলল না। ফালাকের রুমের দিকে অগ্রসর হলো৷ কাল পর্যন্ত ফালাকের রুমে যেতে তার কোনকিছু মনে হয়নি কিন্তু এখন তার অন্যরকম লাগছে। ধীরপায়ে ফালাকের রুমের দরজায় গিয়ে নক করল সে। ফালাক ভেতর থেকে ভারি গলায় বলে উঠল,
“কে?”
“আমি নিশো।”
ফালাক বিছানা থেকে নেমে এসে দরজা খুলে দিল। নিশোর দিকে তাকিয়ে বলল,“বলুন।”
নিশো হাতের প্যাকেটটা দেখিয়ে বলল,“এখানে তোমার চুড়ি ছিল।”
“আমার চুড়ি?”
“হ্যাঁ। ”
“ভেতরে আসুন।”
ফালাকের পিছু পিছু নিশো ভেতরে প্রবেশ করল। ফালাক চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“বসুন।”
“বসতে চাচ্ছি না এখন আর।”
“কেন? ভালো লাগছে না আমার এখানে?”
“আমি এগুলো তোমাকে দিতে এসেছিলাম। আমার কাজ আছে তাই বসার সময় হবে না।”
“আমি তো আপনাকে এগুলো আনতে বলিনি। ভাইয়ার প্রয়োজন হলে সে নিজেই আনতো। আপনাকে বলল আর আপনি চলে গেলেন?”
“তোমার মন খারাপ দেখতে ইচ্ছে করছিল না। আজকের দিনটা তোমার। জীবন থেকে আরও একটা বছর চলে গেল। তোমার উচিৎ মন খারাপ না করে বাকিটা জীবন উপভোগ করা।”
ফালাক কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,“আপনার উচিৎ আমার জন্য অন্তত মন দিয়ে পড়াশোনা করা।”
নিশো ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,“তোমার জন্য কেন?”
“বিসিএসটা দিন। ভালো কিছু করুন। আমার জীবনের আর একটা বছরও আপনাকে ছাড়া কাটাতে চাইছি না। বাঁচবো আর কয়দিন? বর- বাচ্চা নিয়ে কয়েকটা দিন বেঁচে থাকি। আপনার উচিৎ বেশি বেশি পরিশ্রম করা।”
“পাগল তুমি! রাতে বললে এসব নিয়ে আর কোন কথা হবে না।”
“ভেবেছিলাম হবে না কিন্তু পরে দেখলাম এসব বিষয়ে ছাড় দিতে নেই। পরিবার মানবে নইলে দুজন রোমিও জুলিয়েট হয়ে যাব। পারবেন না আমার জন্য ম*রতে? আমি কিন্তু পারব।”
“থামো। বেশি কথা বলছো ইদানীং। কথাবার্তা এরকম হলে বাসায় আসা বন্ধ করে দেব আমি।”
ফালাক নিশোর কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল,“ কী এনেছেন বউয়ের জন্য? দেন তাড়াতাড়ি। ”
নিশো অবাক চোখে ফালাকের দিকে তাকিয়ে রইল। ফালাক নিশোর হাত থেকে প্যাকেট নিয়ে দেখল ভেতরে চুড়ি আর পায়েল রয়েছে।
ফালাকে হাসিখুশি মুখটা হঠাৎ আবার অন্ধকারের মতো মলিন হলো। নিশোর দিকে তাকিয়ে বলল,
“বিরক্ত হচ্ছেন?”
“না, অবাক হচ্ছি। তোমার এই আচরণ তোমার সাথে যাচ্ছে না। তুমি আমার সাথে এত সহজ হবার চেষ্টা করো না। তোমাকে মানায় না।”
“আচ্ছা। আপনি চান আমার মুখ থেকে খুশিটা চলে যাক?”
“না, আমি চাই তুমি সবসময় ভালো থাকো। তুমি শুধু আমাকে চেয়ো না।”
“আপনাকে নতুন করে আর কখন চাইলাম!”
“পুরোনো চাওয়া ভুলে যাও। আমি কখনোই যে পাতিলে খাচ্ছি সেই পাতিল ফুটো করব না৷ লোকে বলবে আমি এ বাড়িতে থেকে এ বাড়ির মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছি। তোমার চরিত্রে আঙুল তুলবে। আমি সেটা সহ্য করতে পারব না।”
ফালাক মেকি হেসে বলল,“আমার চরিত্র নিয়ে ভাবছেন অথচ আমি কষ্ট পাচ্ছি এটা বুঝতে পারছেন না?”
“তোমাকে একটা কথা জানানোর ছিল।”
ফালাক নিশোর দিকে চোখ তুলে তাকালো। বলল,“বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথা অন্তত বলবেন না, প্লিজ। আপনি আমার না হলেন, চোখের সামনে অন্তত থাকুন। আমি আপনার সামনে এভাবে নিজেকে কোনদিন উপস্থাপন করব না। কথা দিচ্ছি।”
নিশো মুচকি হেসে ফালাকের মাতায় হাত দিয়ে বলল,“তুমি আমার অপছন্দের নও। সময়টা আমার ভীষণ অপছন্দের৷ আমার পছন্দের মানুষটা অপছন্দের সময়ে এসেছে। তাকে নিজের করে নেওয়ার সাধ্য আমার নেই। তবে ভাগ্য বলে কিছু একটা আছে। আমি তোমার ভাগ্যে থাকলে আমি তোমার হতে চাইবো।”
ফালাক নিশোর চোখে চোখ রেখে বলল,“সান্ত্বনা দিচ্ছেন?”
“একটা পরিবার কখনো মেয়ের জন্য আমার মতো ছেলেকে চাইবে না।”
“আপনি আদৌ চান তো?”
“ কী?”
“আমাকে?”
“না। আমি আমাকে ঘৃণা করি৷ এমন ব্যক্তি তোমার সঙ্গী না হোক।”
“তাহলে আর কী!”
“আমি কালকে এখান থেকে চলে যাচ্ছি।”
ফালাক নিশ্চুপ নিশোর দিকে তাকিয়ে রইল। শুধালো,“আসলেই চলে যাচ্ছেন?”
“হ্যাঁ, আমার কাছে থেকে তোমাকে বাঁচাতে। আমি নামক গোলকধাঁধায় আটকে গেলে দমবন্ধ হয়ে মা*রা যাবে। সেটা আমি কখনো চাই না। তুমি বেঁচে থাকো। আমার থেকে তোমার দূরত্ব বাড়ুক।”
ফালাক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,“তবে তাই হোক। আমিও দেখি ভাগ্য আমার সাথে কোন খেলায় মেতে ওঠে। হারানোর নাকি পাওয়ার!”
#চলবে……