একদিন নববর্ষা পর্ব-৪৩ এবং শেষ পর্ব

0
443

একদিন নববর্ষা – শেষ পর্ব (প্রথম অংশ)
অদ্রিজা আশআরী

_____________

সে ওপর ওপর রাগ দেখিয়ে
ভেতর ভেতর কাঁদে,
হাতের মুঠো আলগা করে
বুকের ভেতর বাঁধে…

ফোঁপাতে ফোপাঁতে হাটু মুড়ে মাটিতে বসে পড়ে বর্ষা। যতটা না শারিরীক যন্ত্রণায় তার চেয়ে সহস্রগুণ বেশি মানসিক বিপর্যস্ততায়।

নাব্য চলে গেছে! শূন্য ঘরে, তুষারিত বাতাসের গাঢ় প্রবহণে জানালার সফেদ পর্দার দোলাচলকে দেখায় অস্থির পাখির ডানাঝাপটানির মতো। নিরাবেগ নিচ্ছিদ্র শীতল ঝোড়ো সমীরণ, ক্ষণে ক্ষণে এসে বারি খায় বর্ষার গায়ে। বর্ষার চোখে অঝোর ধারায় অবিরত জল গড়ায়। বুকে জমে থাকা কষ্টের নোনা ঢেউ নির্গমনের পথ হারিয়ে ফেলে। শাড়ি আঁকড়ে ধরে, মুদিত নয়নে ও হঠাৎ শব্দ করে কাঁদতে শুরু করে। এমন ভয়াবহ মানসিক যাতনা….
তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তলপেটের ব্যাথাটা উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। ব্যাথায় কুঁকড়ে যেতে থাকে ওর দেহ। ব্যাথাটা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছলে পেটে হাত রেখেই একসময় মৃদু আর্তনাদ করে ওঠে।

বর্ষাকে ঘিরে যেন সত্যিই কিয়ামত নেমে আসে। যন্ত্রণায় দুচোখে ঝাপসা দেখে চারপাশ। মৃত্যু যন্ত্রণা কি এর চেয়েও কঠিন? এর চেয়ে অধিক বিভীষিকাময় যন্ত্রণার অস্তিত্বও আছে পৃথিবীতে? বর্ষার জানতে ইচ্ছে করে। ও বোঝে, আজ কালরাত্রি এসেছে ওর জীবনে। সময় আসন্ন। এবার একটা অব্যর্থ পরিণামের মুখোমুখি হবে সে।

থেকে থেকে ওর মাথার ওপর বাজপাখির মতো চক্রাকারে ঘোরে দুঃসহ সময়ের হাতছানি। বর্ষা তখনো জানেনা এটা লেবার পেইন। শুধু যেন বোঝে ও মৃত্যুর খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। দূরে, বিছানার অন্যপাশে অবহেলায় পড়ে আছে সেলফোনটা। বর্ষা অসাড় হাত জোড়া বাড়ায়, নাগাল পাওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। ব্যার্থ হয়। চিৎকার করে কাউকে ডাকতে চায়। কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ আসে না। পৃথিবীর বাকিসব কষ্ট অর্থহীন মনে হয় বর্ষার কাছে। মনে হয় এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি মিললে আর কোনো কষ্টই ওকে ছুঁতে পারবে না কখনো। বর্ষা উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। বোঝে, তখন অসহনীয় ব্যাথায় মুষড়ে পড়ে অবলীলায় মাটিতে বসে পড়াটা অনুচিত ছিল। কোনো প্রকার সাহায্য ছাড়া ভারী শরীরে এখন উঠে দাঁড়ানো অসম্ভব মনে হচ্ছে।

মধ্যরাতের নিঃসঙ্গ ঘরকোণে, আলো আঁধারির আবছায়ায়, অনিশ্চয়তার সাগরে অবগহণরত বর্ষা বারবার শুধু আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকে। তার অস্পষ্ট ফিসফিস স্বরে বারবার অনুরণিত হয়, ‘হাসবুনাল্লাহু ওয়া নি’মাল ওয়াকিল!’

___________________________

আমি চোখের জল লুকোনোর বাহানায়
বৃষ্টিতে ভিজে যাই।
বৃষ্টি আমাকে ছুঁয়ে যায়, কিন্তু কষ্ট কেন
ধুয়ে যায় না?

ঝুম বৃষ্টির সহস্র নিনাদ বর্ষিত হয় নাব্যের ঝিম ধরা গায়ের ওপর। উদ্রিত তার গতি, তীক্ষ্ণ তার ধারাবর্ষণ। বুড়িগঙ্গার তীরে মোহাবিষ্টের মতো নাব্য বসে থাকে। নদীর ওপর বৃষ্টির বুলিন্দ ঝরে অবিরাম। জলে সেই শব্দের অনুরণন ছাড়া পুরো পৃথিবীটাকে মনে হয় যেন এক নিঃসাড় মৃতগ্রহ।

নাব্যর নিমেষহারা দৃষ্টি সেদিকে স্থির। কত সময় পেরিয়ে যায়.. নিঝুম ঝোড়ো রাত্রিটাও একসময় পৃথিবীকে বিদায় জানায়। ধূসরিত ম্লান সূর্য স্থাপিত হয় পূর্বাকাশে। সে সূর্যের না আছে কুসুমরঙা আলো, না আছে তেজ বা উত্তাপ। মেঘের আড়ালে ওর সমস্ত প্রতাপ চাপা পড়ে রয়।

সকাল হয়, কোলাহল বাড়ে নদীর ঘাটে। একসময় এই জায়গাটুকুও অসহনীয় হয়ে পড়ে নাব্যের জন্য। বুকে একরাশ ক্ষোভিত কালোমেঘ আর বেদনাবহ ভাবনার অনুযোগ নিয়ে নাব্য জায়গা ছাড়ে। কিছুদূর এগিয়ে রাস্তার পাশে মসজিদটা অতিক্রম করতে গিয়ে ও আবার থামে। ওর ওপর স্থির হওয়া একজোড়া দৃষ্টি ওকে থামতে বাধ্য করে। মসজিদের সম্মানিত ইমাম দাঁড়িয়ে আছেন রাস্তার ওপারে, মার্বেল পাথরের সিড়ির ওপর। শেষরাতে এখানে ফজরের সালাত পড়েছিল নাব্য। রাত্রির শৈতময় আবহাওয়াকে পেরিয়েও ঠিক পাঁচটায় আযান ভেসে এসেছিল মসজিদ থেকে। নাব্য আর বসে থাকতে পারেনি। অরবে, ওর বিক্ষিপ্ত মন মহাপরাক্রমশালীর কাছেই আশ্রয় খুঁজছিল হয়তো। তিঁনি ছাড়া আর কে এই দুর্বহ মানবিক সংঘাতের অনুভূতি সম্পর্কে জ্ঞাত?

ইমাম তাকে দেখে মার্জিত হাসলেন। নাব্য অনুভূতিশূন্য চোখে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। ওর চোখের দৃষ্টি অকারণে ঝাপসা হয়ে এলো। সেটুকু আড়াল করতেই হঠাৎ মাথা নত করে অসাড় গলায় বলে উঠল, ‘আমি আসছি। আসসালামু আলাইকুম।’

ইমাম স্নেহভরে বললেন, ‘যাও। ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহ। কখনো মন আবার খেই হারালে ফের এখানে এসো। আল্লাহর ঘর সবার জন্য সবসময় খোলা। এ ঘরে এসে কেউ খালি হাতে ফেরে না। কখনো সালাত ছেড়ো না। যতবার মন অশান্ত হবে। সেজদায় লুটিয়ে পড়বে। পৃথিবীর কোনো দুঃখ আর তোমাকে শেকলবন্দী করতে পারবে না। মনে রেখো। যার আল্লাহ আছে, কিছু না রইলেও দিনশেষে তারই কিন্তু সব আছে। ‘

নাব্য চুপচাপ শোনে। কথা শেষ হতেই পা বাড়ায়। তখনো ওর মাথা নতই থাকে। অসম্বদ্ধ পদচারণা করতে করতে থেকে থেকে নানান বিচ্ছিন্ন ভাবনা এসে ভীড় জমায় ওর মনে। মনে হয় পৃথিবীর এই মানবীয় সম্পর্ক গুলো আসলে সব মিথ্যে। আপন স্বার্থে অনুমাত্র ঘাত লাগার সঙ্গে সঙ্গে সরূপ বদলে যায় সকলের। কারো সুখের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ানোমাত্র সে পারস্পরিক ভালোবাসার কথা ভুলে, নিজের সুখ ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। সাদা চোখে যাকে নির্দোষী মনে হয়, অমোঘ নিয়মে সবাই ধরে নেয় তার বিপরীত মানুষটিই অপরাধী। আসলে পৃথিবীর সকল নিয়ম বড় বেশি সরল। সরল বলেই তা দিয়ে কারো জীবনের জটিলতা মেটানো এতো বেশি কঠিন!

জীবন জটিল। তার সমাধানের পথও হওয়া উচিত জটিল। খোলা চোখে আমরা যা দেখি সবসময় কি শুধু তাই সত্যি হয়? কারো হৃদয় তো আমরা চোখে দেখি না। তবে কেন যেটুকু দেখি তার ওপর ভিত্তি করে আমরা হৃদয়ের বিচারকার্য সমাধান করি অনায়েসে? রায় দিয়ে দেই এর পক্ষে বিপক্ষে?

সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়ায়। নাব্য কোথাও ফেরে না। না বাড়িতে, না অফিসে। সবখানেই ওকে জব্দ করার লোক উপস্থিত। আজ তাদের কারো মুখোমুখি হবার অভিপ্রায় জাগেনা ওর। নাব্যর উদভ্রান্ত পদচারণা একসময় আবার ওকে ফিরিয়ে আনে পূর্বের স্থানে। বুড়িগঙ্গার তীরের সবচেয়ে নিকটবর্তী মসজিদটির পাশে এসে ওর নাতিদীর্ঘ ভ্রমণ শেষ হয়। মসজিদে তখন জোহরের আজান সমাপ্ত হয়েছে। মুসল্লিরা একে একে ভিরছে সালাতের জন্য। তাদেরই এককোণে নাব্য নির্বিকার নিশ্চুপ বসে থাকে। জামাত শেষ হয়। সকলে ফের বেড়িয়ে পড়ে জীবিকার তাগিদে। শুধু নাব্যেরই কোনো তাড়া নেই।

মিম্বারের অদূরে সমাচ্ছন্ন নাব্যর পাশে এসে দাঁড়ান ইমাম সাহেব। মুখে সকালের সেই বিশেষ আন্তরিক হাসি। ইমাম সাহেবের মুখপানে চেয়ে বিভ্রান্ত নাব্য ইতস্তত করে একটা প্রশ্ন করে, ‘আমি এখানে একটু শুতে পারি?’
–‘কেন নয়!’ ইমাম সাহেবের নির্মল হাসিমুখ প্রসারিত হয়।

সময় দুপুর গড়িয়ে বিকেলে, এক আযান থেকে অন্য আযানে এসে থামে। নাব্যর ঘুম ভাঙে কপালে একটা শীতল স্পর্শের অনুভবে। মাইকে শোনা যায় আযানের তেজদীপ্ত ধ্বনি। ঠিক কোন কারণ টা ওকে জাগিয়ে তুলেছে বুঝতে পারে না সে। চোখ খুলতেই ইমাম সাহেব উৎকণ্ঠিত চাপা গলায় বলেন, ‘তোমার দেখি জ্বর। সারাদিনে কিছু খেয়েছিলে? কি হয়েছে বাবা? বাড়ি ফিরছো না কেন? পরিবারের সাথে বিরোধ?’

পেছন থেকে ইমাম সাহেবের ডাক পড়ে। উত্তর দিতে হয়নি বলে নাব্য স্বস্তি পায়। জামাত শেষে আরও একবার বিদায় নেয় ইমামের কাছ থেকে। তিনি কিছু খাবার মুখে নিতে অনুরোধ করেন। নাব্য দৃঢ়ভাবে ফিরিয়ে দেয়।
যাবার বেলায় তিনি মৃদু হেসে বলেন, ‘এবার সত্যি যাচ্ছো তো? দ্রুত বাড়ি ফিরবে কেমন?’
উত্তর না দিয়ে নাব্য তাকিয়ে থাকে। হয়তো জীবনে শেষ বারের মতোন।

____________________________

নিঃসঙ্গ রাত। প্রসস্থ খোলা আকাশ। তার গায়ে কতশত নক্ষত্রের প্রলেপ মাখানো। সেই সৌন্দর্য চোখে যত গাঢ় হয়ে প্রতিভাত হয়, নিজেকে তত ক্ষুদ্র মনে হয়। মহাবিশ্বের বিশালতার কাছে কত সামান্য মানুষের অস্তিত্ব। তবুও তাদের এতো অসার দম্ভ!

কিন্তু প্রকৃতির অবস্থান্তর ঘটে খুব দ্রুত। আকাশে অতর্কিতে জমতে শুরু করে কালো মেঘ। দিকে দিকে তার গর্জন অন্তর কাঁপিয়ে দেয়। বাতাসের তোড় গাছের গায়ে আকুলি-বিকুলি ঢেউ তোলে। নাব্য অকুণ্ঠচিত্তে হেটে যায়। ওর বিক্ষিপ্ত মস্তিষ্কে কতশত দুশ্চিন্তা, হাহাকারের ঝড় বয়ে যায়….
তবে এখন আর গন্তব্যহীন নয় সে। একটা ঠিকানা স্থির করেছে। আপাতত সেখানে কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে যেতে হবে তাকে। কাল সন্ধ্যার পর থেকে নাব্য নিরাহার। অন্য সব প্রয়োজনের সাথে সাথে খিদে নামক বস্তুটির প্রেষণাও হারিয়েছে ওর দেহ থেকে।

বৃহস্পতিবার রাত। শুক্লপক্ষ। আকাশে মেঘেদের অমন মুহুর্মুহু ঘনঘটা না থাকলে চাঁদের রুপোলী আলোর ছটায় নিশ্চয়ই মুখরিত হতো আজ চারপাশ। ভাবতে ভাবতে যাত্রাবাড়ীর একটি নির্দিষ্ট গৃহের উদ্দেশ্যে হেটে চলে নাব্য।

তখনি, নাব্যর মুখোমুখি এসে গাড়িটা হঠাৎ তীব্র ব্রেক কষে থামে। হেডলাইটের হলুদাভ আলো মুখে পড়তেই নাব্যর দুচোখে ধাধা লাগে। মিনিটের পেরোনোর আগে গাড়ির দরজা খুলে যে বেরোয়, তার উপস্থিতি এখানে বড় বেশি অপ্রত্যাশিত মনে হয় ।
রাহিলের ঠোঁটের কোণে হাসিটা তখনো জীবন্ত।
–‘ হোয়াট অ্যা সারপ্রাইজ! আবার দেখা হয়ে গেল আমাদের! বর্ষার কাছেই এসছো নিশ্চয়ই? তাই না?’

নাব্যর ভাবলেশ শূন্য দৃষ্টি উপেক্ষা করে রাহিল দরাজ গলায় আবার বলে ওঠে,
–‘একটা ব্যাপার কি খেয়াল করেছো নাব্য? আমাদের যখনি দেখা হয় বিহাইন্ড দ্য সিন কোথাও না কোথাও বর্ষার উপস্থিতি থাকে।
বাই দ্য ওয়ে। এখানে কি তোমার নিয়মিত আসা হয়? ডোন্ট মাইন্ড। বর্ষাকে মিসট্রেস পদে আসীন করেছো নাকি?’

নাব্য এবারো উত্তর করে না। তবে ওর উদাস দৃষ্টি ধীরে ধীরে কঠিন হতে থাকে। রাহিল দমবার পাত্র নয়। প্রবল আত্মবিশ্বাসের জোরে নিজে থেকেই কথা বলে যেতে লাগলো অবিরত।
–‘ দেখো আমি ফ্র‍্যাঙ্কলি কথাটা বললাম দেখে তুমি রাগ কোরো না। বর্তমানে সবাই ঘরের বাইরে দু’ একজনকে রাখে। রোজকার বিরিয়ানিতে তিক্ততা এলে তখন রুচি বদলানোর প্রয়োজন পড়ে বৈকি!’

রাহিলের কথাগুলো ক্রমে নাব্যর মস্তিষ্ককে উত্তেজিত করে তুলছিল। এবার বিস্ফোরক স্বরে সে বলে বসে,
–‘ সবাই তোমার মতো নয় রাহিল। রক্ষিতা পোষার মতো পর্যায়ে এখনো বোধহয় যাইনি। আমি প্রয়োজনে ওর কাছে এসেছি। কিন্তু সবকিছু শেষ হবার পর তুমি কেন আজ এখানে এলে? ‘

–‘ দেখো, আমাকে যতটা খারাপ ভাবো তুমি ততটা কিন্তু আমি নই। আমিও প্রয়োজনেই এসেছিলাম। আমাদের সেপারেশন রিলেটেড ইস্যুতে।
কিন্তু…
যদি তোমার কথাই সত্যি ধরে নিই। অপ্রয়োজনে তুমি এখানে আসোনি। তবে বলবো ভুল সময়ে এসেছো নিশ্চিত। তোমার ফিরে যাওয়া উচিত! আড়ালে থাকা পাপাচার সম্পর্কে জেনে তিক্ত মনোভাব ধারণের চেয়ে পুরোপুরি অবিদিত থাকা ঢের ভালো। ‘

–‘কি বলতে চাইছো সরাসরি বলো।’

রাহিল জহুরি চোখে নাব্যকে দেখে নিল একবার। তারপর মুখে গম্ভীরতার প্রলেপ ফেলে বলল,
–‘ নাব্য তোমার অবস্থা বড় বেহাল মনে হচ্ছে। ঠিকঠাক সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছো না। এসব এখন তোমার না শোনাই উচিত… ‘

–‘বাজে কথা বন্ধ করো। আমি শুনতে চাই।’

কিছু বলবার আগে রাহিল সময় নেয়।
-‘ সত্যি আমার বলতে খারাপ লাগছে। কিন্তু… ইউ হ্যাভ টু বি আন্ডারস্ট্যান্ড। টাইম হিলস এভরিথিং। ইট অলসো চেঞ্জেস এট দ্য সেম টাইম!

বর্ষা আর সেই গরানবনের অপরিণত মেয়েটি নেই। সময় ওকে বদলে দিয়েছে। বর্ষার এখন চোখ ফুটেছে, দুপাশে মজবুত দুটো ডানা গজিয়েছে। আজ এখানে এসে আবারও আমি উপলব্ধি করেছি। সেপারেশনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ভুল করিনি আমি।
একটা ব্যাপার কি জানো তো? চিরকাল বড় সাদামাটা জীবনে অভস্ত্য থাকে যারা, হঠাৎ রঙিন দুনিয়ায় এলে ওদের পদস্থলনই আগে ঘটে। স্কুল কলেজে দেখোনি? গ্রাম থেকে আসা ছেলেমেয়েরাই বিপথগামী হতো বেশি?

এখনকার বর্ষা এমন অনেক কিছু ধারণ করে, গরানবনের বর্ষার ক্ষেত্রে যা হয়তো কল্পনা করাও অসম্ভব ছিল!

নাব্য, চুড়ান্ত কথাটা বলবার আগে আমি আরও একটা ব্যাপার বলে নিতে চাই। তুমি আমাকে যাই ভাবো না কেন। আমি শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে তোমাকে সাবধান করছি আসন্ন বিপদ থেকে। বিলিভ মি। আজ, অন্তত এখানে দাঁড়িয়ে আমি যা বলছি তার একটি শব্দও মিথ্যে নয়।

জানি তোমার জন্য একসাথে এতগুলো আকস্মিক আঘাত সহ্য করা কঠিন। ডোজটা বেশি পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু আজ আমি বলবো বলে স্থির করেছি। এমন সুযোগ পরে নাও আসতে পারে..
তোমার অপাপবিদ্ধ কানে কথাটা বিশ্রী শোনাতে পারে কিন্তু..
রাহিলের গলার স্বর খাদে নেমে এলো।
‘বর্ষা কখনো এক পুরুষে সন্তুষ্ট থাকার মতো মেয়ে নয়। বিকৃত মনস্ক এবং বাজে ধরনের মেয়েদের বৈশিষ্ট্য ওর মধ্যে প্রবল। আই নো। বিকজ আই স্ট্যেইড উইথ হার ফর অ্যা লং টাইম।

তোমার জন্য আরও একটা দুঃসংবাদ হলো বর্ষার এই বিকৃত অসুস্থতার প্রথম এবং প্রধান ভিক্টিম ছিলে তুমি। আমার সঙ্গে থাকার দিনগুলোতে বর্ষা শুধু তোমার জন্য হাসফাস করতো, অধীর হতো। আর অবশ্যই সেটা কোনো মনঘটিত ব্যাপার ছিল না। একটা কথা তো স্বীকার করতে হয়। তুমি আমাদের চেয়ে বেশি সুপুরুষ। শি ওয়াজ অবসেসড উইথ ইউ। এন্ড স্টিল নাও…..
হাস্যকর শোনাচ্ছে তবে সুযোগ পেলে ও সত্যি তোমাকে হ্যারেজড করতে ছাড়বে না।

আমাদের ডিভোর্সের পেছনের কারণটা বর্ষা কি বলেছে তোমাকে জানি না। তবে যাই বলে থাকুক সেটা একপাক্ষিক। এবার আমার দিকটাও শোনো। বর্ষার এসব নোংরা গায়ে পড়া স্বভাব আমি বিয়ের অল্পদিনেই টের পেয়েছিলাম। ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাবার মতলব আটছিল ও। আমার অগোচরে আমার ক্লায়েন্টের সঙ্গেই সদ্ভাব গড়েছিল। অন্তরঙ্গতা বাড়াচ্ছিল। ব্যাপারটা বেশিদূর গড়াবার আগেই আমি জানতে পারি। বর্ষা ক্ষমা চায়। তারপর আমিও সব ভুলে গেছিলাম। কিন্তু এরপর আরও দুবার একই ভুল করেছে সে। দিন দিন বর্ষা ভীষণ উগ্র হয়ে উঠছিল। সারাক্ষণ শপিং, ফোনকলস, পার্টি..। আমার জীবন টা জাহান্নামে পরিণত করল কয়েক মাসেই। আমার বাচ্চাদের আর বৃদ্ধ মায়ের বিন্দুমাত্র পরোয়া ছিল না ওর। একটা সময় আমি বাধ্য হলাম সেপারেশনের সিদ্ধান্ত নিতে।

এ তো গেল আমার কথা। নাব্য তোমাকে মেনে নিতেই হবে। বর্ষা এখন নষ্ট মেয়েদের কাতারে পড়ে। আজ ওর বাড়ির দোরগোড়ায় গিয়ে ফিরে এসেছি আমি। কেন জানো?
সামনের পার্কিংএর জায়গাটা ইতোমধ্যে ব্লক। ওখানে অম্লান বদনে দাঁড়িয়ে আছে তোমার সেই বন্ধুর গাড়ি। যার বুটিক হাউজে অনুকম্পা দেখিয়ে বর্ষাকে চাকরি জুটিয়ে দিয়েছিলে তুমি!’

বজ্রাঘাতে পাথর হয়ে যাওয়া মানুষের মতো থমকে দাড়িয়ে রইল নাব্য। ওর ঠোঁট কথা হারিয়েছে, দৃষ্টিরা হয়েছে উদভ্রান্ত, নিশ্বাসের গতি স্লথ হতে হতে শূন্যে এসে পৌঁছেছে। আকাশে বজ্রনিনাদ ক্রমে বাড়ছে। জোর হাওয়া দিতে আরম্ভ করেছে। প্রকৃতির অঘোষিত বিদ্রোহ পরখ করে রাহিল অস্থির গলায় বলল,’ রাত বাড়ছে। বাড়ি ফিরতে হবে।
তুমিও ফিরে চলো। ও…..শিট! বলতে ভুলেই গেছিলাম। ‘
রাহিল থামল কয়েক মুহুর্তের জন্য, -‘আ……ব……তোমার ওয়াইফের কন্ডিশন কিন্তু ক্রিটিকাল। আজ সকালে হসপিটালে এডমিট করা হয়েছে ওকে। সবাই তোমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। আমার সৌভাগ্য। সে সময় কিছুটা সাহায্য করতে পেরেছিলাম। হসপিটালে ড্রপ করে দিয়েছিলাম তোমার ফ্যামিলিকে। অবশ্য তোমারই গাড়িতে।
বাড়িতে কিছু ঝামেলা বাধিয়েছো নিশ্চয়ই? অসময়ে ড্রাইভারকে ছুটি দিয়ে ওর বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছ। এদিকে রাত থেকে নাকি তুমি নিজেও উধাও। ফোন সুইচডঅফ। সকালে ওরা মহা বিপাকে পড়ে গেল হসপিটালে যাওয়া নিয়ে। ভাগ্যিস আমিও তখন ধানমন্ডিতে ছিলাম। তোমার ছোট বোন। আ…কি যেন নাম…। নিতিন! সাচ অ্যা প্রিটি গার্ল! ভীষণ বুদ্ধিমতিও বটে!
ও একা হাতে সব সামলেছে। তোমার এখন দ্রুত ফেরা উচিত। তুমি চাইলে আমি তোমাকে হসপিটালে পৌঁছে দিতে পারি। ‘

একের পর এক মানসিক আঘাত। শিহরণ জাগানিয়া খবর কিংকর্তব্যবিমুঢ় করে দিয়েছিল নাব্যকে।
তবে শেষ খবর টা অন্যসব কিছুকে ছাপিয়ে মস্তিষ্কে তীব্র বেগে আঘাত হান’লো। বর্ষা! বর্ষা বেচে আছে তো এখনো? ওর কিছু হলে নিজের সাথে সকল লড়া’ইয়ে হেরে গিয়ে নাব্য হয়তো সত্যি আত্মঘা’তী হয়ে পড়বে! এই মুহুর্ত পর্যন্ত যত আঘাত এসেছে ওর জীবনে। তা যত তীব্রই হোক। সব সয়ে নেবে নাব্য। শুধু বর্ষা এ যাত্রায় বেচে উঠুক!

–‘নাব্য। ঠিক আছো তুমি? হসপিটালে ড্রপ করে দেব তোমাকে?’

নাব্য জরাগ্রস্ত চোখে চাইল রাহিলের পানে।
–‘ হ্যাঁ। নি..নিয়ে চলো আমাকে।’ ওর ঠোঁট কাঁপছিল।

রাত্রির প্রথম প্রহর পেরিয়েছে বহু আগে। আসু বৃষ্টির সম্ভাবনায় রাস্তাঘাট ইতোমধ্যে ফাঁকা হয়ে গেছে। ঝোড়ো রাত্রির নির্জন হাইওয়েতে গাড়ি চলছে নব্বই কি.মি ঘন্টাবেগে। রাহিলের দৃষ্টি পাশের প্রাণশূন্য স্তম্ভিত মুখটির ওপর নিবদ্ধ। নাব্য এতটা ভেঙে পড়তে পারে তা ভাবনার অতীত। ওর দৃষ্টির অসংলগ্নতা, নিষ্প্রভ বিচরণ ঠিক ভাষায় প্রকাশ করার মতোন নয়। কিছু একটা যেন ওকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এলোমেলো করে দিয়েছে স্নায়ুর গতিবিধি।
–‘ এসে গেছে। নাব্য তুমি যাও। এতোটা ভেঙে পড়ছো কেন? এভরিথিং উইল বি ফাইন। আর ওই প্রস্টি…যাই হোক। ওর কথা ভুলে যাও। এখন ফুল টাইম তোমার ওয়াইফের পাশে থাকা দরকার। বাই।’

রিসিপশনে খোঁজ নিয়ে নাব্য ছুটে গেল লিফটের দিকে। ওর পা কাঁপছে। হৃদপিণ্ডটা তড়পাচ্ছে পাগলা ঘোড়ার মতো। বদ্ধ লিফটে একবার ওপরে তাকিয়ে চোখ মুদলো। মনে মনে একান্ত কিছু অনুরোধ পেশ করল রবের কাছে। আজ অনেক দিন পর পাঁচ ওয়াক্তে নিয়ম করে পাঁচবার আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়েছিল সে। ইমাম সাহেবের কথা রেখেছিল। বিনিময়ে অন্তরে পেয়েছিলেন অবর্ণিত প্রশান্তি।
নাব্য করজোড়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে লাগল। আজ আর কিচ্ছু নয়। শুধু বর্ষার জীবিত থাকাটা নিশ্চিত করতে চায় সে। নবীন যে প্রাণটি পৃথিবীতে আসার জন্য দুর্নিবার বিদ্রো হে সমাসীন হয়েছে, তার প্রতিও বিশেষ কোনো টান অনুভব করছে না নাব্য। শুধু বর্ষা আবার আগের মতো হাটুক, চলুক, কথা বলুক….

অতর্কিতে আরও একটি একান্ত গোপন দুঃখবোধ নাব্যকে ঘিরে ধরল। ওদের অনাহুত বা হয়তো ইতোমধ্যে আগত সন্তানটি ছেলে নাকি মেয়ে তা সে জানে না। বর্ষা কখনো ওকে বলেনি। বলার প্রয়োজন মনে করেনি বোধহয়। নাব্যর সদাসর্বদা নিস্ক্রিয় অভিব্যক্তি বর্ষার সেই জানানোর ইচ্ছেটাই কেড়ে নিয়েছিল হয়তো।

একদিন নববর্ষা – শেষ পর্ব (শেষ অংশ)
অদ্রিজা আশআরী

________________

আইসিইউ’র সামনে দাঁড়িয়ে নিতিন প্রহর গোণে। সকাল থেকে সে তাই গুণছে। কিন্তু সময় ফুরোচ্ছে না। অধৈর্য হবার ধৈর্যটুকুও আর অবশিষ্ট নেই। ভোরে ওরা যখন প্রথম বর্ষার অবস্থা জানল, তখনো বিলম্বটা টের পায়নি। অনেক হৈচৈ, চিৎকার, রোনাজারি হলো। দিকে দিকে খোঁজ চলল নাব্যের। এমনকি ড্রাইভারের অভাবে বর্ষাকে হাসপাতালে নেয়ার সময়কাল পেছালো।

তার পরের দৃশ্য গুলো ভয়ংকর বাজে দুঃস্বপনের মতোন একে একে আঘা ত হানলো। পৃথিবীতে আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া মানুষ যে কতো অসহায় নিতিন উপলব্ধি করতে পারছিল তীব্র ভাবে।

অতিরিক্ত র’ক্তক্ষরণের ফলে বর্ষার মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছিল। অন্যদিকে বাচ্চাটির নাজুক প্রাণ নিয়েও শংকা দেখা দিচ্ছিল। অবস্থাটা প্রায় এমন হতে চলেছিল যে মা সন্তান দুজনকে একসঙ্গে বাচানো সম্ভব হবে না।

মা দাদির হাউমাউ কান্না, নিতিনের থমকে যাওয়া। এসব কিছুর মাঝেই একসময় একটা তোয়ালে মোড়ানো পুতুল পুতুল বাচ্চাকে নার্স তুলে দিয়ে গেল ওদের হাতে। বর্ষাকে মৃতপ্রায় করে প্রাণটি পৃথিবীর আলো দেখেছিল। সেই আনকোরা প্রাণটিকে হাতে পেয়ে জন্য ওরা সব কষ্ট ভুলে গেল। বর্ষার চিন্তাও মাথা থেকে বেরিয়ে গেল কিছু সময়ের জন্য। তারপর হঠাৎ ওদের সামনে দিয়ে স্ট্র‍্যাচারে করে বর্ষাকে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হলো। বাচ্চাটা ভূমিষ্ঠ হবার পর দ্রুত অবস্থার অবনতি হচ্ছিল বর্ষার। কয়েক ব্যাগ রক্ত ইতোমধ্যে ওর দেহে চালান করা হয়েছে। নার্স বলেছে আরও এক ব্যাগ হাতের কাছে রাখতে।
সকলের জুরতে শুরু করা মনোবল আবারও ভেঙে গুড়িয়ে গেল।

নিতিন ভাতিজাকে কোলে নিয়ে বসে রইল পাথর হয়ে। দুপুরের দিকে সুস্থসবল বাচ্চাটির নিশ্বাসে টান পড়ল আকস্মিক। নিতিন ‘আম্মা’ বলে চিৎকার করে উঠল। বাচ্চাটিকে নিয়ে আবার ছুটল নার্সরা। দু’দিকে দুজনকে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা ল’ড়তে দিয়ে নিতিন মা দাদিকে নিয়ে স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল মাঝখানে। ওর মনে হলো ঘোরতর এক দুঃস্বপ্নে ডুবে আছে সে। ঘুম ভাঙলেই নিশ্চিত সব দুঃখ কেটে যাবে।

————–

কত রাত পেরিয়েছে কে জানে! সময়ের হিসেব ওরা কেউ রাখেনি। হাসপাতালের করিডোরে বেঞ্চিতে বসে আছেন রাফিয়া। আর দাদির পাশে গা-ঘেঁষে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিতিন। মাত্র একটি দিনের বিপর্যস্ততা ওকে অনেক শক্ত করে দিয়েছে। আজ প্রথমবারের মতো নিতিন জেনেছে, কাউকে একইসঙ্গে ভালোবাসা আর ঘৃণার অনুভুতি কেমন হতে পারে!

দূরে অস্থির ভাবে পায়চারি করছে রশু। আপাতত ওদের মা, মেয়ে আর দাদির চেয়ে রশুর মানসিক চাপটাই বেশি। কারণ একমাত্র রশুই বর্ষা ও তার ছেলের পাশাপাশি নাব্যর জন্যর ভাবছে। একসময় সে সিড়ি ভেঙে নিচে চলে গেল।

হাসপাতালের এই সরু করিডর জুড়ে নিদারুণ এক নিস্তব্ধতা। পুরো করিডরে ওরা ছাড়া আর কেউ নেই। সকলেই সমাচ্ছন্ন হয়ে যে যার মতো আল্লাহকে ডাকছে। অপেক্ষা করছে নার্সের জন্য। কখন এসে একটু স্বস্তিদায়ক কিছু শোনাবে। করিডরের শেষ প্রান্তে তখন লিফটটা থামে। সঙ্গে সঙ্গে কেউ একজন বেরিয়ে ছুটে আসে ওদের কাছে। বিঘ্ন করে করিডর জুড়ে বিস্তার করা নিচ্ছিদ্র নিরবতা। নিতিন মুখ তুলে তাকানোর আগেই নাব্য ওদের সামনে এসে দাঁড়ায়। তার বিধস্ত কম্পিত স্বর শুধায়, ‘কেমন আছে বর্ষা ?’

রাফিয়া বা দাদি কেউ উত্তর দিলেন না। নাব্য স্থিতিহীন হয়ে ওদের প্রত্যেককে বারবার বর্ষার কথা জিগ্যেস করতে থাকে। নিতিন নিঃশব্দে নাব্যকে পরখ করে। ওর চোখের জল শুকিয়েছে অনেকক্ষণ। শুধু কোলাজে তার দাগ টুকু রয়ে গেছে এখনো। নিতিনের নিশ্বাস দ্রুত হয়। শরীরে দানা বাধতে থাকে একটা অপ্রতিরোধ্য অমর্ষণ। নাব্য মুখোমুখি হতেই প্রবল আক্রো শে ফেটে পড়ে সে,
–‘তুমি কেন এসেছো? চলে যাও। বেরিয়ে যাও এখান থেকে। তোমার মুখ দেখতে চাইনা আমরা।’

নাব্য তখন আর কোনো কিছুরই পরোয়া করছে না। বারবার বলে চলেছে,
–‘ নিতু বর্ষার খবরটা আমায় বল। আমার বর্ষাকে কোথায় রেখেছে ওরা? ও ভালো আছে তো? ‘

–‘জেনে কি করবে হ্যাঁ? কেন নাটক করছো? ভাবি ম’রেছে কিনা নিশ্চিত হতে এসেছ তো? যাতে রক্ষিতাকে দ্রুত ঘরে তুলতে পারো। তাহলে আর ওর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা কেন? তুমি চাইলে এখনি ওই নষ্ট মেয়ের কাছে চিরতরে চলে যেতে পারো। আমরা কেউ কিছু মনে করবো না।’

–‘নিতিন কি বলছিস তুই এসব? আম্মা তোমার মেয়ে….’

–‘ যা বলছি ঠিক বলছি। আমাদের কিছু জানতে বাকি নেই। তোমাকে নিজের ভাই ভাবতেও লজ্জা হয় আমার… ছিহ!’

–‘নিতু চুপ কর তুই!’ রাফিয়া গুমরে কেঁদে উঠলেন।

–‘আমাকে চুপ করতে বলো না আম্মা। এতসব কিছু জানার পরও যদি আমি মুখ বুজে থাকি তাহলে নিজের কাছেই মস্ত অপ রাধী সাব্যস্ত হবো। ওকে বলো এখান থেকে বেরিয়ে যেতে। ওকে ছাড়া যখন এতদূর সামলেছি। বাকি টুকুও আমিই পারবো।’

–‘ দাদি..দাদি তুমি অন্তত বলো? কি হয়েছে বর্ষার? নিতিন কেন এমন করছে?’ নাব্য হাটু মুড়ে দাদির পায়ের কাছে বসে পড়ে। কিন্তু তিনিও মুখ ফিরিয়ে নেন। নাব্য আবারও থমকায়। আহত স্থির চোখে ওদেরকে প্রত্যেককে দেখে। কেন এমন বিভীষিকাময় সময়ের মুখোমুখি হয়েছে সে আজ? যখন ওর নিজের সবকটি আপন মানুষও ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ওর থেকে?

গুরুতর অভিব্যক্তি নিয়ে একজন নার্স তখনি বেরিয়ে আসে আইসিইউ থেকে। নিতিন দৌড়ে কাছে যায়। নাব্যর পা টলছিল। মাথায় নিদারুণ যন্ত্রণা। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল সে। নার্স এসেছে টের পায়নি। নিতিন সেদিকে ছুটতেই ওর সম্বিত ফেরে। সেও ছোটে।

নার্স প্রথমে একটি স্বস্তিদায়ক সংবাদ দেয়। বাচ্চাটা এখন ভালো আছে। গা গরম রাখার জন্য তাকে উষ্ণতা দেয়া হচ্ছে। দ্বিতীয় কথাটি বলবার আগে নার্স কিয়ৎকালের জন্য থামে। মুখে পড়ে গম্ভীর্যের ছায়া। জানায় বর্ষার একলাম্পশিয়া ধরা পড়েছে। তবে অবস্থা এখনো নিয়ন্ত্রণে আছে। এটুকু বলে নার্স আবার হারিয়ে যায় কাঁচের দরজাটা ওপাশে। সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ করে দেয়া হয় ভেতর থেকে।

নাব্য দৌড়ে গিয়ে দরজার ওপর প্রায় হুম ড়ি খেয়ে পড়ে। কাঁচে মুখ ঠেকিয়ে ওর মরিয়া চোখদয় ভেতরে বর্ষাকে খুঁজতে থাকে। একসময় চোখ আটকে যায় একটি সিটে। কাঁদতে গিয়েও নাব্য থমকে যায়। ওর চোখ নিমেষহারা চেয়ে থাকে দরজার ওপাশে। বিছানার সঙ্গে মিশে থাকা বর্ষার নিথর দেহের পানে। তাকে ঘিরে অজস্র মেশিন, যন্ত্রের ছড়াছড়ি। হঠাৎ হঠাৎ ভয়ানক ভাবে কেঁপে উঠছে বর্ষার শরীর। ইলেক্ট্রিক শক খাবার মতো থরথরিয়ে কাঁপছে সে। বর্ষার খিচনি উঠছে। নাব্য কাঁচে থা বা মা’রে। টেনে খুলে ফেলতে চায় দরজা।
‘বর্ষা… বর্ষা…..’ ওর গলার স্বর ক্রমে লীন হয়ে আসে।

তবুও নাব্য নতুন উদ্যমে চিৎকার করে ডাকতে শুরু করে। একবার দুইবার বহুবার….। কিন্তু ভেতর পর্যন্ত পৌছানোর আগেই কাঁচে বাড়ি খেয়ে সেই ডাক বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে। ডাক্তার নার্সরা নিজেদের কাজ করে যেতে থাকেন। তাকিয়ে থাকতে থাকতে নাব্যর চোখ মুদে আসে। দৃশ্যটা সহ্য হয়না আর। অক্ষম আক্রোশে আপনাতেই চোখ বন্ধ হয়ে যায়। কাঁচের গায়ে হেলে পড়ে সে। ওর বন্ধচোখ বেয়ে উষ্ণ জলের স্রোত নামে। সে দরজায় ধা-ক্কায় অনবরত। মনে হয় কেউ কলিজা নিংড়ে জীবনসুধা আস্বাদন করাচ্ছে ওকে। নাব্য ভাবে এমন একটা সময় কেন এল ওর জীবনে? বর্ষাকে কেন আজ জীবন মৃত্যুর মাঝখানে পড়ে পিষ্ট হতে হচ্ছে? চিরকাল তো নাব্য অপরাধ করেছে। শাস্তি তারই হওয়া উচিত। তবে কেন বর্ষা আজ এতো কষ্ট পাচ্ছে?

–‘ ওখান থেকে সরে আয় নবু। আর কষ্ট বাড়াস না মেয়েটার।’ রাফিয়া মুষড়ে পড়া গলায় বলেন।

–‘শুধু ওখান থেকে না। ওকে এই হসপিটাল ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বলো। ভাবির যেটুকু বাচার সম্ভাবনা আছে। ও থাকলে সেটুকুও শেষ হয়ে যাবে।’ ক্রোধাগ্নি গলায় নিতিন বলে।

নাব্যর স্বাভাবিক বোধবুদ্ধি লোপ পাচ্ছিল ধীরে ধীরে। কারো কথাই পুরোপুরি কানে যাচ্ছিল না ওর। আইসিইউর সামনে পা ছড়িয়ে বসে থাকে সে। ওকে অপ্রকৃতস্থের মতো দেখায়। একসময় রাফিয়া উঠে আসেন। হাটুতে ভর দিয়ে আধবসা হয়ে ছেলের পিঠে হাত রাখেন।
–‘কেন এতো কষ্ট দিয়েছিলি ওকে?’
প্রশ্নটা করে তিনি হঠাৎ খুব বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর ফের অস্থির গলায় বলেন,
বর্ষার এই অবস্থা, তোর খোঁজ নেই। কতটা ভেঙে পড়েছিলাম আমরা ভেবেছিস একবারো? তোর ছোট বোনটা একাহাতে সবদিক সামলেছে। ভাগ্যিস তখন রাহিল এল। সাহায্য করল আমাদের। কিছু তিক্ত সত্যিও শোনাল তোকে নিয়ে। আমরা তো এসবের কিছুই জানতাম না! আমার ছেলে হয়ে তুই এমন জঘন্য একটা কাজ কিভাবে করলি!
তুই নাকি আবারও ওই বাজে মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিস? তোর এই পদস্থলনের কথা আমাদের জানতে হলো একটা বাইরের লোকের মুখ থেকে? ভালোই হয়েছে তোর বাবা আজ বেচে নেই। নয়তো তোর মতো কুলাঙ্গার কে জন্ম দিয়েছিল বলে আফসোসের সীমা থাকতো না তার!’

মায়ের কথাবার্তা নাব্যর ঠিক বুঝে আসছিল না। গত চব্বিশ ঘন্টার খাদ্য-বিশ্রামহীন, মানসিক চাপে ক্লিষ্ট মস্তিষ্ক কার্যক্ষমতা প্রায় হারাতে বসেছে। স্বাভাবিক চিন্তা ভাবনার শক্তি ক্রমে লোপ পাচ্ছিল। তাই মায়ের কথার নাব্যর শুধু একটাই মানে খুঁজে পায়, বোঝে পুরো দুনিয়ার কাঠগড়ায় আজ সে একক আসামি। আজ যার কাছেই সে যাবে, সবাই তাকে মুহুর্মুহু অভিযোগে ক্লেশিত করে ফাঁসির মঞ্চের দিকে ঠেলে দেবে।

নাব্য অনেকক্ষণ কি যেন ভাবে। তারপর হঠাৎ টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায়। মাতালের মতো এলোমেলো পা ফেলে এগোয়। নিতিনের সামনে এসে আবারও থামে। আরক্ত জুলজুল চোখে ছোট বোনের মুখপানে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে। নিতিন ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয়।
–‘ এই বুড়ি। একটু এদিকে তাকা। শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর দে।
দাভাইকে ভালোবাসিস আগের মতোন? নাকি তার স্থান ঘৃণা দখল করে নিয়েছে? ‘

নিতিনের মুখের শিরা ফুলে ওঠে। পরিস্থিতি আর নাব্যর সম্পর্কে কিছু বেফাঁস কথা ওকে ভয়ানক নিষ্ঠুর করে তোলে। দাঁত চেপে বলে, ‘ঘৃণা করি। আমি শুধু ঘৃণা করি তোমাকে।’ নিতিনের আওয়াজে আজ কোনো আবেগ নেই। বড়বেশি বাস্তববাদী হয়ে উঠেছে সে।

নাব্যর ঠোঁটে কোণে হাসি মিলিয়ে যায়। পেছন ফিরে একই প্রশ্ন করে মা আর দাদিকে। সময় পেরোতে থাকে। তারা কেউ উত্তর দেন না। কিন্তু তাদের নিরবতা ও অভিব্যক্তি অনেক কিছু বলে দেয়।

নাব্য আর থামে না। এলোমেলো পদক্ষেপে সামনে এগিয়ে যায়। নাব্যর কোনো অনুভূতি কাজ করে না। নিজেকে তার হঠাৎ বড় বেশি হালকা মনে হয়। মনে হয় সে হাওয়ায় উড়ছে। নাব্যর ধারণা হয় আবেগ অনুভূতিকে কবর দিয়ে, এসব ছাপিয়ে অনেক ঊর্ধ্বে উঠে গেছে সে। পৌঁছে গেছে এমন স্থানে যেখানে গেলে কেউ আর ফিরতে পারে না কখনো…… ।

____________________

দেড় ঘন্টা কেটেছে। এর মধ্যে দুবার নার্স এসে আপডেট জানিয়ে গেছে। বর্ষার অবস্থা কিছুটা ভালো। সবার চোখেমুখে খানিক স্বস্থির রেশ। নিতিনের গলা শুকিয়ে কাঠ। মিনারেল ওয়াটারের ছিপি খুলে বিসমিল্লাহ বলে সবে গলায় ঢালতে নিচ্ছিল সে। হঠাৎ নিচ থেকে একটা বিভীষণ হই হই- রই রই হট্টগোলের শব্দ ভেসে এলো। দোতলা বলে শোরগোলটা বেশ স্পষ্ট কানে আসছিল। দু একজন স্টাফ নিচে ছুটল ঘটনা কি দেখবার জন্য। নিতিন করিডোরের জানালায় উঁকি দিয়ে দেখতে চেষ্টা করেও ব্যার্থ হলো। দাদির চোখ লেগে এসেছিল। তিনি সোজা হয়ে বসে কি হয়েছে জানতে চাইলেন। বোতলে ছিপি এঁটে নিতিন সিড়ির দিকে পা বাড়াল।
‘ কে জানে মাঝরাতে এতো কিসের চেচামেচি! দাঁড়াও দেখে আসছি আমি। ‘ নিতিনের তৃষ্ণা নিবারণ আর হলো না। বোতল হাতে নিয়েই সিড়ি ভেঙে নিচে নেমে গেল সে।

হাসপাতালের সামনেই মেইনরোড। দিনের বেলা যানবাহন আর মানুষের জন্য রাস্তাটাকে ঠিক বাজার বলে মনে হয়। তবে এখন রাস্তায় গাড়ির ভীর নেই। মাঝেমধ্যে অবশ্য দু-একটি বাস-ট্রাক সাই সাই করে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। তবে দিনের বেলার মতো চোখে ক্লান্তিকর নয় দৃশ্যটা।

নিচে এসে নিতিন দারুণ অবাক হয়। এই অর্ধরাতেও মাঝরাস্তায় জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা একদল মানুষ দেখে। তাদের মধ্যে কয়েকজন মেয়েকে পেয়ে সেও সাহস করে পা বাড়ায়। যেতে যেতে কানে আসে লোকেদের বিচ্ছিন্ন কথাবার্তা।

–‘ মনে হয় আত্মহ’ত্যাই করেছে। নয়তো এই মাঝরাতে গাড়ির ভীর কোথায় যে সামনে পড়ে এক্সিডেন্ট করবে?’

–‘একেবারে স্পট ডে’ড। কিছুক্ষণ আগেও ওই পিলারের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। তখনি ঘাপলা লেগেছিল আমার। কেমন মাতালের মতো টাল খাচ্ছিল বারবার। ‘

নিতিন বোঝে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। বরাবর সাহসী মেয়ে সে। কাছে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শনের লোভটা সামলাতে পারে না। গোল হয়ে বাঁধা জটলাটার একেবারে কাছে গিয়ে রশুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় ওর। রশুকে যেন রোলারকোস্টার থেকে সদ্য টেনে বের করে আনা হয়েছে। ওকে একেবারে অন্যরকম দেখায়। নিতিনকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে হাত ধরে উল্টো পথে নিয়ে যেতে থাকে সে।
–‘ ত তু তুমি… ও ওদিকে যাবেনা। খবরদার যাবে না। ‘

নিতিন অবাক বিস্ময়ে রশুর কথা শোনে। ততক্ষণে নিতিনের ভেতরও কিছু একটা ঘটে গেছে। রশুর হাত ছাড়িয়ে হঠাৎ তীব্র বেগে ধেয়ে যায় সে ভীরের দিকে। ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সবাইকে ঠেলে একেবারে ভেতর ঢুকে পড়ে। কয়েক মিনিট একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে রাস্তায় পড়ে থাকা, র ক্তে রঞ্জিত মৃতদেহটির দিকে।
তারপর বোতল ফেলে হঠাৎ ডাকিনীর মতো নিজের মুখ খা’মছে ধরে। চিলের মতো তীক্ষ্ণ চিৎকার বেরিয়ে আসে ওর গলা দিয়ে। আশেপাশের মানুষজন ভয় পেয়ে দূরে সরে যায়। নিতিন চিৎকার করতে করতে লাশের ওপর হুমরি খেয়ে পড়ে।

রাস্তা ভেঙে মানুষের ঢল নামে। হাসপাতালের প্রায় সব মানুষ বেরিয়ে আসে। কৌতুহল নিবৃত্ত করতে না পেরে একসময় রাফিয়াও শাশুড়ীর হাত ধরে নেমে আসেন। তাছাড়া নিতিনও এখনো ফেরেনি। কয়েক পা সামনে এগিয়ে রাফিয়ার পা আর সামনে বাড়তে চায় না। তার মাতৃমন ইতোমধ্যে কিছু একটা আঁচ করে ফেলেছে। দাদি তাড়া দেন। রাফিয়া থমকে দাঁড়িয়ে থাকেন। তারপর শাশুড়ীকে ফেলেই হঠাৎ সেদিকে দৌড়ান। একেবারে সামনে গিয়ে র ক্তাক্ত দেহটি দেখে ধুপ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এসে জায়গাটা ঘিরে ফেলে। মৃতদেহ সরিয়ে নেয়া হয়। অভিযুক্ত গাড়ির মালিক বারবার বলতে থাকেন তার গাড়ির নিচে চাপা পড়বার আগেই লোকটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ছিল। যথাসময়ে ব্রেক করতে চেয়েও তিনি এক্সিডেন্ট এড়াতে পারেননি ঠিকই কিন্তু মৃত্যুর পেছনে এই দু’র্ঘটনা পুরোপুরি দায়ী নয়। প্রত্যক্ষ দর্শীরাও প্রায় একই কথা বলে যে লোকটাকে আগে থেকেই অসুস্থ মনে হচ্ছিল। কিচ্ছুক্ষণ আগেই রাস্তা পাড়ি দিয়ে ওপারে গেছিল সে। তখনো তার হাটার গতি মন্থর ছিল। ফেরার পথে মাঝরাস্তায় হঠাৎ ধুপ করে পড়ে যায়। তারা কেউ কেউ এই দৃশ্য দেখে ছুটে যান। কিন্তু তার নাগাল পাবার আগেই গাড়িটি এসে ওকে চাপা দেয়।

__________________

নাব্যর মৃত্যুর সাত দিন কেটে গেছে। আজ হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে বর্ষাকে। নাব্যর মৃত্যুটা আত্মহ ত্যা নাকি দু’র্ঘটনা এনিয়ে বিস্তর জল ঘোলা হয়েছে। জটিলতা দেখা দিয়েছে। তারপর ময়নাতদন্তে বেরিয়ে এসেছে কিছুটা অবাক করা তথ্য। গাড়িটি নাব্যকে চাপা দেবার আগেই মারা গেছিল সে।

এসব তথ্য নাব্যর পরিবারের কাছে কোনো বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ জায়গায় নিষ্প্রাণ চিন্তাশূন্য মানুষ এখন। বাস্তবে ফিরতে পারছে না কেউ।

বর্ষার অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। সে পুরোপুরি বোবা হয়ে গেছে। হয়তো আনুষ্ঠানিক ভাবে কথা বলার ক্ষমতা ওর দেহ ছেড়ে যায়নি। তবে বর্ষা নিজে থেকেই জবানে লাগাম টেনেছে। কখনো কথা বলেনা। কখনো কাঁদেও না। সারাক্ষণ ভীষণ অভিমানে গুমড়ে থাকে। কার ওপর অভিমান কেউ জানে না। ওর রোষাগ্ন গম্ভীর মুখ দেখলে কেউ কিছু বলবার সাহস পায়না। সারাক্ষণ ফুলে থাকা নাকের পাটা, ক্রোধান্ধ মুখ দেখলে মনে হয় যেন কারো ওপর ভীষণ অভিমানে ক্লিষ্ট হয়ে আছে সে। এক্ষুনি সেই মানুষটি এসে ওর রাগ ভাঙাবে। মুহুর্তে বর্ষার সমস্ত রাগ গলে জল হয়ে যাবে। বর্ষা আবারও হেসে ফেলবে। কিন্তু কেউ আসে না। কাউকে বুঝতে না বর্ষা সেই মানুষটিকে সারাক্ষণ খোঁজে। খুঁজতে খুঁজতে ওর রাগ ম’রে যেতে চায়। চোখে অশ্রুর ভরাডুবি হয়। তবুও সে আসে না। নাব্য আসে না। ফেরার সব পথ রুদ্ধ করেই যে ওপাড়ে পারি জমিয়েছে সে…।

আজকাল সময়ের হিসেব রাখতে পারে না বর্ষা। সকাল বিকেল আলাদা করতে ওকে বেগ পেতে হয়। শেষ বিকেলকে দুপুর ভেবে, অসময়ে গোসল করেছে সে আজ। খোলা চুল পিঠের ওপর ছড়িয়ে, ঘিয়ে রঙা শাড়িটা গায়ে এলোমেলো ভাবে জড়িয়ে নাব্যর রেখে যাওয়া ঘরে অনর্থ বিচরণ করে বর্ষা। বিছানায় শুয়ে ছোট বাচ্চাটি ট্যাঁ ট্যাঁ করে সুর তুলে কাঁদে। বর্ষার সেদিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল থাকে না।

অকারণ ঘুরতে ঘুরতে আয়নার পাশে ওয়ারড্রবের সামনে এসে সে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে তুলে নেয় র’ক্তাক্ত কাপড়ের পুটুলিটা। বুঝতে সময় লাগে এটা নাব্যর পাঞ্জাবি। শেষ সময়ে ওর গায়ে এই কাপড়াটিই ছিল। নাব্যর ময়নাতদন্ত করা হয়েছিল যখন। তখন নিশ্চয়ই এটা ফেরত দিয়েছে ওরা। তারপর এবাড়িরই কেউ হয়তো এখানে রেখে গেছে। ওটা তুলে নিতেই বর্ষার হাতে কিছু একটা ঠেকে। পাঞ্জাবি মেলে ঝারা দেয় সে। পকেট থেকে গড়িয়ে পড়ে একটি ভাঁজ করা কাগজের ফালি। কাগজটা মেলবার আগেই ওপরে একটি লেখা বর্ষার নজরে আসে।
” এই চিঠিটা শুধু আমার স্ত্রী বর্ষার জন্য। আর কেউ পড়বে না। আমি জীবিত থাকলে বর্ষাও নয়”

চোখের কোলাজে জল জমতে শুরু করলে জোর করে ভেতরে টেনে নেয় বর্ষা। ঢোক গেলে। কিছু মুহুর্ত সময় নেয় নিজেকে গুছিয়ে নেবার জন্য। অতঃপর চিঠিটা খোলে।

—————————————–

” বর্ষা, কারো মৃত্যু এলে কেউ কি আগে থেকে তা আঁচ করতে পারে? এমন শুনেছো কখনো? তবে আমি কেন পারছি? আমি বুঝতে পারছি মালাকুল মউত আর আমার মাঝে খুব বেশি দূরত্ব নেই। খুব শীগ্রই কিছু একটা বদলে যাবে। আমি সম্পুর্ন অচেনা কোথাও নৌকা ভিরাবো।

মানুষ যখন বেঁচে থাকার সমস্ত ইচ্ছে হারায়, তাদের মৃত্যুর আয়োজন সম্পন্ন না হলেও কি তখন মৃত্যু তাদের দুয়ারে উপস্থিত হতে পারে? হয়তো! নাহয় এই মধ্য যৌবনে কেন আমি প্রৌঢ়ের মতো সমস্ত বেচে থাকার আকাঙ্ক্ষা হারিয়ে মৃত্যুর জন্য প্রহর গুণবো? আর মৃত্যুও এসে আমার অপেক্ষার অবসান ঘটাবে?
কিংবা হয়তো এসব কিছুই না। আমার হায়াত এ পর্যন্তই ছিল।

আচ্ছা, এবার অন্য কথা বলি। বড় নির্দয় শোনাচ্ছে এইসব কথা। বর্ষা, তুমি নিশ্চয়ই কাঁদছো? এখন বোধহয় সবসময়ই আমার জন্য খুব কাঁদো। তাইনা? আমি জানতাম তুমি কাঁদবে। ভালোবেসেছিলে তো কোনো এককালে।

কেন এতো ভালোবেসে ছিলে বর্ষা? ভালোবাসার অযোগ্য জেনেও কেন ভালোবেসেছিলে? তোমাকে যে কখনো আমি তোমার মতো করে ভালোবাসতে পারিনি, সেই কষ্ট আমার কোনোদিনও শেষ না। অথচ আমি চেয়েছিলাম। তোমার মনের মতো হতে। বারংবার অনুরাগের আসঞ্জনে রঙিন পসরা সাজিয়েও আমি পিছু হটেছি। হয়তো তুমি পর্যন্ত পৌছাতে অক্ষম ছিল আমার সেই ঠুনকো ভালোবাসা। তুমি ছিলে আমার জীবনের আয়না। যত তোমার নৈকট্যে গেছি, তত নিজের ব্যার্থ জীবনের ছবি সহজ হয়েছে আমার চোখে। আমি কত ক্ষুদ্র তা উপলব্ধি করতে পেরেছি। তাই কখনো ভালোবাসি বলতে পারিনি। তুমিও বোঝোনি। সেজন্যই অনাসেয়ে আমার সব আবেগকে নাম দিয়েছিলে অভিনয়।

তোমার গোপন ডায়েরিতে পড়েছিলাম, তোমার নাকি খুব শখ ছিল বিয়ের রাতে রুপকথার গল্পের মতো ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে আকাশে হাজার ফানুস ওড়াবার। আমাকে ক্ষমা করো। বাকি সবকিছুর মতো তোমার এই ইচ্ছেটাও পূরণ করতে পারিনি আমি।

সুখ কেন মরীচিকার মতো? ছুঁয়ে ফেলবো ফেলবো মনে হলেও শেষমেশ ছোঁয়া আর হয়ে ওঠে না। ©
বলতে পারো? আমি শুধু একটু সুখী মানুষ হতে চেয়েছিলাম। একটা নির্ঝঞ্ঝাট ক্লেষহীন জীবন। সেটুকু পাওয়া কেন এতো কঠিন! এই সুখের মরীচিকাই শেষ পর্যন্ত আমাকে কোথায় নিয়ে চলল দেখলে?

বর্ষা, আমাদের সন্তান নিয়ে শেষ কিছু কথা বলি চলো এবার। খুব সুন্দর একটা ফুটফুটে ছেলে নাকি আমাদের হয়েছে। আমি ওকে দেখিনি। ভয় হচ্ছিল। আমার সামান্যতম সংস্পর্শেও না ওর দুর্বার ক্ষতি হয়ে যায়।
আমি একটা নাম ঠিক করে ছিলাম আমাদের ছেলের জন্য। কখনো কখনো তুমি ওকে এই নামে ডাকবে বলে।
ওর নাম রেখো__ নাহ! ওর ভার আমি সম্পূর্ণ তোমার ওপরেই ন্যাস্ত করে গেলাম। নামটাও নাহয় তোমার দেয়াই থাক।

আমার ছেলেকে নিয়ে আমার কোনো দুশ্চিন্তা নেই। আমি জানি। ও তোমার কাছে খুব ভালো থাকবে। তোমাদের সঙ্গে আমিও যদি থাকতাম তবে ও যতটা ভালো থাকতো, আমাকে ছাড়া তার চেয়ে বেশি ভালো থাকবে।
আমি একজন দূষিত মানুষ। দূষিত মানুষেরা অন্যকে দূষিত করে ফেলা ছাড়া আর কিছু জানে না। আমার ভয় হয়। আমি পাশে থাকলেই বোধহয় ওর বিপথে যাবার সম্ভবনা বাড়ত। এরচেয়ে তুমি একাই ওর মা বাবা দুজনের ভূমিকা পালন করো। আর তোমার ইচ্ছানুরূপ ওকে বড় একজন আলেমে দ্বীন বানিয়ো।

কত কিছু বলার ছিল। অথচ আমার হাতে মনে হচ্ছে সময় বেশি নেই। মৃত্যু যেন আমাকে ডাকছে। আমি সেই আহবান শুনতে পাচ্ছি। নাকি এসবই আমার ভ্রম! হতে পারে। মৃত্যুর খবর তো কারো আগে থেকে টের পাবার কথা নয়। নাকি কেউ কেউ পেয়ে যায়? যদি সত্যি মরে যাই, তুমি আমাকে ক্ষমা করবে তো বর্ষা?

তুমি কি জানো কিসে আমি বরবাদ হয়েছি? ভালোবাসা আমাকে বরবাদ করেছে। ভুল সময়ে এসে, ভুল মানুষের হাতে পড়ে আমার সাজানো ভালোবাসার শিশমহল ভেঙেচূড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। তখন থেকেই আমি ভাঙতে শুরু করেছি। ভালোবাসা আমার কাছে এখন শুধু একটা বিষাক্ত অনুভব।
আমি ভুলে যেতে চাই আমার প্রিয় ফুল কি ছিল, কি ছিল তোমার প্রিয় রঙ!
©

তুমি ভালো থেকো বর্ষা। ভালোবাসা নিয়ে এতো বিশদ সমালোচনার পরও একটা অদ্ভুত কথা বলি। আমি জীবনে একবার মাত্র কাউকে সত্যিকার ভালোবাসতে পেরেছিলাম। জন্মলগ্ন থেকে যাদের আমরা ভালোবাসতে শিখি তাদের বাইরে সেই একজনকেই আমি ভালোবেসেছি। সে ভালোবাসা নিয়ে আমার দর্পের সীমা নেই।কখনো শেষও হবে না।
অথচ পুরো দিন পেরিয়ে, শেষ সময়ে রাত্রির আঁধারে হারিয়ে যেতে যেতে সে ভালোবাসার প্রথম উপলব্ধি হলো আমার। কি দুঃখের কথা ভাবতে পারো? জীবনের শেষ লগ্নে বুঝতে পারলাম। ভালোবাসি বুঝতে মস্ত দেরি হয়ে গেল। সেই ভালোবাসা আর কেউ ছিল না। তোমাকেই ভালোবেসেছিলাম আমি।
সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে গিয়ে হয়তো এখনো ভালবাসি। ভালো থেকো আমার ভালোবাসা। আমার জীবনের নবীনতম বর্ষা।”