কখনো হারিয়ে যেতে হয় পর্ব-০১

0
383

কখনো হারিয়ে যেতে হয়

পর্ব – ১

মীরার কাছে সব কিছু আগের মতই লাগছে। মনে হচ্ছে সব কিছু আগের মতই ঘটে যাচ্ছে। পার্থক্য আগের বার বাসর রাত নিয়ে ভয় ছিল, অজানা আশঙ্কায় আতংক ছিল এবং সঙ্গে ছিল লজ্জা মাখা কিছু ভালোলাগার অনুভূতি। আজকে লজ্জা লাগছে কিছুটা কিন্তু অন্য কোন অনুভূতি সে অনুভব করছে না এই মুহূর্তে।
মীরা তার জীবনের দ্বিতীয় বাসরে বসে অপেক্ষা করছে তার স্বামী রাকায়েতের জন্য। আজ দুপুরেই তার আবার বিয়ে হয়েছে রাকায়েতের সঙ্গে। হ্যা রাকায়েতের ও এটা দ্বিতীয় বিয়ে।
দেড় বছর আগে হার্ট অ্যাটাকে তার প্রথম স্ত্রী সাবিনা মারা গেছে। দুটো মেয়ে আছে রাকায়েতের। বড় মেয়েটার বয়স ষোল আর ছোটটার এগারো।
খুব মিষ্টি দুটো মেয়ে। বিশেষ করে ছোট মেয়েটা তো একেবারে পরীর মতো সুন্দর! ওদের মা ও খুব সুন্দরী ছিল।
রাকায়েত সরকারি ব্যাঙ্কের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। সাবিনার সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে হয়েছিল, তাদের খুব সুখের সংসার ছিল। সাবিনার সব কথায় সম্মতি দিতেন তিনি। রাণীর মতো রেখেছিলেন স্ত্রীকে। কোন দিন কোন কষ্ট দেন নাই। মেয়েদের খুব ভালোবাসতো দুজন। কথা গুলো আজ সন্ধ্যায় এই বাসার আসার পর তিনবার বলেছে সাবিনার মা। রাকায়েতের শ্বাশুড়ি। তিনি এই বাসায় ই থাকেন।
আগে সব সময় থাকতেন না কিন্তু মেয়ে মারা যাবার পর তিনি এখানেই থাকেন। এই যে রাকায়েত দ্বিতীয় বিয়ে করলেন এতে তার মতামত আছে তিনি মীরাকে কয়েকবার বলেছেন। কথাটা বলে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন তিনি রাকায়েত কে অনেক স্নেহ করেন। নিজের ছেলের বেলায় হলে তিনি যেমন চাইতেন তার ছেলের জীবন টা এগিয়ে যাক মেয়ের জামাইয়ের বেলায়‌ও তাই চান। এক ফাঁকে বৃদ্ধা এটাও বলেদিয়েছেন, মীরাকে পছন্দ করার একমাত্র কারণ মীরার কখনো সন্তান হবে না। কথাটা মীরার শুনতে কষ্ট হলেও মীরা তার এই জীবনে সবচেয়ে বেশি এই কথাটাই এত গুলো বছর শুনে এসেছে।
তার আর মুহিবের সংসার টা তো ভেঙেই গেল এই সন্তানহীন অপবাদ মাথায় নিয়ে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মীরা।
এই বাড়িতে এসেছে বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা তখন। বাড়ি ভর্তি লোকজন। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী বেশি ছিল। সন্ধ্যার পরেই লোকজন সব চলে গেল। যারা রয়ে গেছে সবাই যে আত্মীয়-স্বজন মীরা বুঝতে পারলো তাদের কথা শুনে।
রাকায়েতের চাচাতো ভাইয়ের বউ একজন এসে মীরাকে এই ঘরে রেখে গেছে। রাতের খাবারের পর মীরা সবার মাঝেই চুপচাপ বসে ছিল। তার এত ঘুম পাচ্ছিল তখন।
কিন্তু এই ঘরে আসা পর আর ঘুমটা পাচ্ছে না। অনেকক্ষণ হয়েছে সে এখানে বসে আছে কিন্তু রাকায়েতের দেখা নেই।
মীরার পায়ে দুইবার ঝিঁ ঝিঁ ধরেছে, এত দীর্ঘ সময় পা ভাঁজ করে বসে থাকলে তার এমন হয়। সে উঠে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়ালো।
দোতলা একটা বাড়ি। শহরের এক পাশে রাকায়েতের এইটা পৈত্রিক বাড়ি। বাড়ির আশেপাশে সবাই কোন না কোন সম্পর্কে আত্মীয়-স্বজন ওদের। রাকায়েতের বাবা মা মারা গেছেন অনেক আগেই। বড় তিন বোন আছে। তারা রাকায়েতের চেয়ে বয়সে যথেষ্ট বড়। বোনরাই এক রকম জোর করে রাকায়েতের আবার বিয়ে দিয়েছে।
মীরা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে তাকিয়ে আছে।
মুহিবের সঙ্গে তার প্রেমের বিয়ে ছিল না কিন্তু বিয়ের আগে কথা হয়েছে অনেক বার আর তিন বার নিজেরা আলাদা করে দেখা করেছিল। মীরা তখন আনন্দমোহন কলেজে ম্যাথমেটিক্সে অনার্স পড়তো। একটা ভাড়া বাড়িতে অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে থাকতো।
মুহিব ছিল সেই বাড়ির মালিকের ভাগ্নে। বেড়াতে এসেছিল মামার বাসায় সেখানে মীরার সঙ্গে দেখা। মীরা এক গাদা কাপড় ধুয়ে বালতি নিয়ে ছাদে উঠছে। সিঁড়িতে মুহিব কে সাইড দিতে গিয়ে হাত থেকে বালতি ছুটে উল্টে পড়ে যায় সব কাপড় । সেই দূর্ঘটনা থেকে পরিচয়।
মীরা বাড়ির মালিকের মেয়েকে পড়াত । এবং মীরাকে দেখার উদ্দেশ্যে মুহিব প্রায় দিনই চলে আসতো সেই বাসায়। বাসার কেউ না বুঝলেও মীরা দ্বিতীয় দিনেই বুঝে গিয়েছিলো। তাই ছাত্রীকে পড়ানোর সময় টা পরিবর্তন করে ফেলল। মুহিব আসতো কিন্তু মীরাকে পেত না।
এর কয়দিন পর মীরা দেখে মুহিব কলেজ থেকে আসার পথে দাঁড়িয়ে আছে।
মীরা প্রথম প্রথম দেখেও না দেখার ভান করে চলে যেত। এভাবে কিছুদিন যাবার পর মীরা একদিন রিক্সা থেকে নেমে মুহিবের কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
‘আপনি কিছু বলতে চান?’
মুহিব থতমত খেয়ে বলল, না।
‘তাহলে এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে কি প্রমাণ করতে চান?’
‘তোমার সঙ্গে আমার কথা ছিল মীরা।’
‘এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বললে, এই পাড়ায় আমার থাকা সম্ভব হবে না। আপনি আপনার মামা মামিকে তো চিনেন এই যে আপনি অকারণে উনাদের বাসায় এসে উপস্থিত হচ্ছেন একবার টের পেলে আমাকে দুই দিনের মধ্যে বাসা ছাড়তে নোটিশ দিবে।’
মুহিব আর কিছু বলল না চুপ করে রইলো।
মীরা চলে এসেছিল।
তিনদিন পর রাতে হঠাৎ মীরার ফোনে মুহিবের ফোন।
মীরা এত অবাক হয়েছিল যে বলার বাহিরে। ওর নাম্বার তো মুহিবের পাওয়ার কথা নয় !
সেই রাতে কথা বলবে না বলবে না করেও দশ মিনিট মুহিবের সঙ্গে কথা হলো।
তখনই প্রথম জানতে পারলো মুহিব উকালতি পাশ করে সবে মাত্র তার বাবার সঙ্গে প্রেকটিশ শুরু করেছে। তার বাবা ময়মনসিংহ শহরে একজন নামকরা উকিল। তার দাদা ছিল মোক্তার।
মুহিব তার বাবার একমাত্র ছেলে। ওর ছোট একটা বোন আছে।
সেদিনের পর থেকে মুহিব প্রায় রাতেই ফোন দিত মীরাকে। মীরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও কথা বলতো কিন্তু একটা সময় ওর কথা বলতে ভালো লাগতো।
একদিন মুহিব বলল, ‘মীরা আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই আসবে?’
মীরা চুপ করে ছিল।
‘কালকে কলেজ রোডের মোড়ে আমি থাকব।’
পরদিন দুজন মুহিবের মটরসাইকেলে চড়ে কৃষি ইউনিভার্সিটির পাশে ব্রক্ষপুত্র নদীর পাড়ে গিয়ে বসেছিল।
মুহিব সেদিন মীরাকে তার মনের ইচ্ছার কথা খুলে বলেছিল।
মীরা চুপচাপ শুনে মুহিবের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার দুই ভাই আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। আমার বাবা নেই ভাইদের সিদ্ধান্ত ই আমাদের পরিবারের শেষ কথা। আমি আপনার কথা শুনে এটাই বলতে পারি আপনি আপনার পরিবারের লোকজন নিয়ে আমার ভাইদের সঙ্গে কথা বলুন।’
মুহিব আনন্দে মীরার হাত ধরে ফেলেছিল।
‘আমি আমার মা কে তোমার কথা বলেছি মীরা। মা তোমাকে দেখার জন্য আসবে।’
পরদিন দুইজন মধ্য বয়সী মহিলা মীরার মেসের রুমে এলেন সঙ্গে বাড়ি‌ওয়ালী আন্টি।
মহিলা মীরাকে অনেক প্রশ্ন করলেন।
বাড়িওয়ালী আন্টি যখন বললেন আমার ননাস তখনই মীরা বুঝেছিল মহিলা মুহিবের মা।
মীরার মুখে মীরার পরিবারের সব কথা শুনে মহিলা চলে গেলেন।
পরের সপ্তাহেই মুহিবের আত্মীয়-স্বজন ওদের মফস্বলের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিল। তার আগেই বাড়িওয়ালা আঙ্কেল ওর ভাইদের সঙ্গে মুহিবের সম্পর্কে কথা বলেছিলেন। ওর বড় ভাইজান তার চালের আড়তের ম্যানেজার ফয়জু চাচা কে পাঠিয়ে ময়মনসিংহ থেকে বাড়ি নিয়ে আসে তাকে।
পরদিন শুক্রবার প্রায় পঞ্চাশ ষাট জন আত্মীয়-স্বজন নিয়ে মুহিবদের বাড়ির লোকজন আসে। এবং খুব সহজেই মুহিবের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে যায়।
ওর মায়ের খুব ইচ্ছা ছিল একমাত্র মেয়েকে অনেক আয়োজন করে তুলে দিবেন কিন্তু মুহিবের বাবা বলেন আমি বড় আয়োজন করব ,এখন খুশি মনে আপনারা আমার ছেলের ব‌উকে তুলে দেন।
তিনদিন পর বিশাল বড় আয়োজন করে বৌভাত করা হয়েছিল।
স্বামী হিসেবে মুহিব খারাপ ছিল না কখনো, বলতে গেলে অনেক ভালোই ছিল। ওর বাবা মা ও ওকে আদর স্নেহ করতেন।
ওদের পরিবারে সব কিছু মুহিবের বাবার অনুমতি ছাড়া কখনও হয় না। বিয়ের পর অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা টা দিয়ে আর পড়াশোনা করতে পারেনি মীরা। মহিবের বাবা বললেন, ‘এখন সংসার করো মন দিয়ে। অংকের মত রসকসহীন বিষয় পড়ে আর কি করবা।’
মীরা মন দিয়ে সংসার‌ই করছিল। বিয়ের এক বছর হবার আগেই শ্বাশুড়ি আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয়া শুরু করলেন তাদের এখন নাতি নাতনি নিয়ে খেলার সময়।
মীরা একদিন কথাটা হাসতে হাসতে বলল মুহিবকে। মুহিব বলল, ‘তুমি এসব কথা যে বুঝতে পারছো সেটা প্রকাশ করো না কখনো, একটা বছর ই পার হয়নি এখন‌ই কিসের বাচ্চাকাচ্চা! যত্তসব সেকেলে কথাবার্তা।’
মুহিব যত‌ই সেকেলে কথাবার্তা বলে কথাটা উড়িয়ে দিক ওর মা মীরার কানের কাছে কথাটা সরাসরি বলা শুরু করলেন দেড় বছরের মধ্যে।
মীরা লজ্জায় মাথা নিচু করে থেকেছে।
একটা সময় তিনি জোর দিয়েই বলা শুরু করলেন।
এবং তখন মীরাও মুহিবকে বলল, ‘চলো প্রায় দুই বছর তো হয়েই গেছে তাই না আমাদের বিয়ের এখন তো বাচ্চার কথা চিন্তা করাই যায় ?’
মুহিব মীরাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বলল, ‘তুমিও তাই চাও?’
‘হুম সারাদিন বাসায় তো তেমন কিছু করার থাকে না আমার, মন্দ হয় না একটা বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে থাকলে।’
‘ঠিক আছে তোমার যখন ইচ্ছা তবে তাই হোক।’
সেই থেকে ওরা একটা সন্তানের জন্য চেষ্টা করা শুরু করেছিল।
কিন্তু আল্লাহ তাদের প্রতি সদয় হয়নি।
মীরা নিজেকে নিয়ে চিন্তায় অস্থির হ‌ওয়া শুরু করলো ছয় মাস চেষ্টার পর যখন কোন ফলাফল পায়নি তখন থেকে।
মুহিব কে জোর করে সঙ্গে নিয়ে ডাক্তারের কাছে এলো।
ডাক্তার ওর নানান রকম টেস্ট করলেন সব টেস্ট ই ভালো ছিল।
তবুও কেন সন্তান ধারণ করতে পারছে না মীরা! মীরা চিন্তায় চিন্তায় অস্থির।
ডাক্তার বদল করলো তাতেও কোন কাজ হয়নি।
ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় এসে ডাক্তার দেখালো মীরা। এবার ডাক্তার মুহিবের অনেক গুলো টেস্ট করালেন দেখা গেল সব ঠিক আছে।
মুহিব মীরাকে স্বান্তনা দিয়ে বলল, ‘তুমি এত অস্থির হচ্ছো কেন? তোমার কোন সমস্যা নেই আমার কোন সমস্যা নেই একটু সময় লাগছে এত তাড়াতাড়ি নিরাশ হয়ো না।’
মীরা মুহিবের কথায় মন শান্ত করে। কিন্তু তার শ্বশুর শাশুড়ি যখন শুনলেন দুজনের কারো সমস্যা নেই তবুও বাচ্চা হচ্ছে না তারা একেবারে চুপসে গেলেন। শ্বশুর সারাক্ষণ মন খারাপ করে থাকেন।
শ্বাশুড়ি এবার তাকে নিয়ে বিভিন্ন কবিরাজ, হুজুরের কাছে যাওয়া আসা শুরু করলেন।
মীরার গলায়, হাতের বাজুতে,কমড়ে তাবিজে তাবিজে ভরে গেল। ওর শ্বাশুড়ি খুব পরহেজগার মহিলা এখন নামাজ দান সদকা আরো বেড়ে গেল। কোন কিছুতেই কিছু হলো না।
দেখতে দেখতে বিয়ের পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে। মীরা এক রকম ডিপ্রেশনে ভোগা শুরু করলো। কারণ উঠতে বসতে এখন তার শ্বাশুড়ি তাকে কথা শোনানো শুরু করলো বাচ্চা হয় না বলে।
মীরা মন খারাপ করে থাকে। সারাক্ষণ তজবি হাতে নিয়ে আল্লাহর নাম জিকির করে। রাতভর জায়নামাজে বসে থাকে।
মুহিব ওকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ওর মায়ের আচরণে আগে প্রতিবাদ করলেও এখন আর তেমন কিছু বলে না।
আগের মতো মুহিব ও হাসিখুশি থাকে না। কেমন জানি চুপচাপ থাকে।
একদিন রাতে চেম্বার থেকে এসে তার শ্বশুর মীরা আর মুহিবকে নিজের রুমে ডাকলেন।
তারপর গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘সব কিছুর তো একটা শেষ বলে কিছু আছে তাই না। আমি শেষ চেষ্টা না করে হাল ছেড়ে দেয়া পছন্দ করি না। আমার এক মক্কেল কলকাতা থেকে চিকিৎসা করিয়ে এসে অনেক উপকার পেয়েছে এখন তাদের দুটো বাচ্চা। তাই আমি তোমাদের কলকাতা পাঠাব। দেখো গিয়ে কি আছে তোমাদের ভাগ্যে।’
সেদিন রাতে মীরা আনন্দে অনেক কান্নাকাটি করলো। তার কাছে মনে হলো এবার হয়তো তার ভাগ্য পরিবর্তন হবে। এই বাড়ির আনন্দ ফিরে আসবে। তার জীবন টা বদলে যাবে।
কলকাতা গিয়ে ডাক্তার দেখিয়েও কোন লাভ হলো না। আরো দুটো বছর অনেক দীর্ঘশ্বাস আর অনেক কটু কথা শোনানোর পর একদিন ওর শ্বাশুড়ি মুখ ফুটে বলেই ফেললেন,’ মীরা সাত বছর তো কম সময় না তাই না? কি বুঝলা?’
‘কিসের কি বুঝব মা?’
‘এত সহজ কথা বুঝতে পারতেছো না তুমি না অংকের ছাত্রী এই মাথা নিয়া অংক করতা কেমনে?’
মীরা বুঝলো তার শ্বাশুড়ি কি বলছে! সে বরাবরের মতই চুপ করে রইলো।
‘শোনো আমি কথা সব পরিস্কার ক‌ইরা বলতে পছন্দ করি। অনেক ডাক্তার,কবিরাজ, হুজুর, তাবিজ তো করলা। বিদেশ পর্যন্ত পাঠাইলো তোমার শ্বশুর। কিছুতেই তো কিছু হ‌ইলো না। আমরা আর কয়দিন বাচমু ক‌ও। একটা মাত্র পোলা আমার আমরা কি বংশ আগাইতে দেখমু না?’
‘আল্লাহ না দিলে আমি কি করব মা?’
‘তুমি কিছু করতে পারো না পারো এবার আমি আমার মুহিবরে আবার বিয়া করামু।’
মীরা প্রথমে ভেবেছিলো তার শ্বাশুড়ি অনেক আবোল তাবোল কথা বলে এটাও সেরকম কিছু। কিন্তু না কয়দিন পরেই বাসায় ঘটক আসা যাওয়া শুরু হলো।
মীরা সারাদিন নিজের ঘরে চুপচাপ শুয়ে থাকে। ঘর থেকে বের হয় না। মুহিব আগের চেয়েও বেশি চুপচাপ। ওর সঙেও হাতে গোনা কয়েকটা কথা বলে।
মীরা চিন্তা করে আচ্ছা মুহিব কি জানে বাসায় ঘটক আসে যে?
এক রাতে মীরা বারান্দায় বসে ছিল হঠাৎ করেই অনেক বৃষ্টি শুরু হলো ওর উঠে যেতে ইচ্ছা করল না সে বসে রইল বৃষ্টিতে।
একটা সময় মুহিব এসে পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ঘরে আসো ভিজে যাচ্ছো তো!’
মীরা চুপচাপ বসেই র‌ইলো।
মুহিব ওর হাত ধরে বলল, ‘ঠান্ডা লাগবে আসো।’
‘তুমি কি জানো বাসায় ঘটক আসে?’
মুহিব চুপ করে রইলো।
‘ও আমি ভেবেছিলাম তুমি জানো না!’
মীরা ঘরে ঢুকে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে অনেকক্ষণ কাঁদল।
পরদিন দুপুরে বাসায় হঠাৎ অনেক মেহমানের আনাগোনা।
নিজের ঘর থেকে কাজের মানুষদের ফিসফাস শুনে বুঝতে পারলো মীরা পাত্রী পক্ষের লোকজন এসেছে।
সেদিন রাতে মীরা সরাসরি মুহিবকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কি সত্যিই বিয়েটা করতে চাও?’
মুহিব চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে রইল।
‘এভাবে চুপ করে থেকে কি বোঝাতে চাইছো ? বিয়েতো আর রাখঢাক রেখে করা যাবে না তাই না। সত্যি টা খুলাখুলি করে বলো আমাকে।’
মুহিব উঠে মীরার পায়ের কাছে এসে বসলো মীরার হাতটা ধরে বলল, ‘আমি পারলাম না মীরা । আমি হেরে গেছি। জানো আমি বাবা মা কে নিরাশ করতে পারছি না। আমি তোমাকে কোন সুখ দিতে পারছি না। আমি নিজে শান্তি পাচ্ছি না। আমার কখনো কখনো মনে হয় আমি আত্মহত্যা করি।’ মুহিবের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।
মীরা কি বলবে বুঝতে পারছে না। তার কাছে মনে হচ্ছে তার পায়ের নিচে মাটি সরে যাচ্ছে।
পরদিন সবাই ঘুম থেকে উঠার আগেই সে তার ব্যাগ গুছিয়ে বাবার বাড়িতে চলে গিয়েছিল। মুহিব কয়েকবার ফোন দিয়েছিল মীরা ফোনটা বন্ধ করে দিয়েছিল।
বাবার বাড়িতে সবাই মীরার অবস্থা টা যে এমন হবে আগেই আঁচ করতে পেরেছিল।
ভাইয়েরা মুখে কিছু না বললেও ভাবিরা ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কথাই বলতো।
মীরার মা অনেক কান্নাকাটি করতেন প্রথম প্রথম। মাস খানেক এর মধ্যে মীরাই ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিল। অন্তত তাকে কেউ ত্যাগ করেছে জীবন থেকে সেই কাগজ পাঠানোর আগেই সেই পাঠিয়ে দিয়েছিল। দেড় মাসের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেল মুহিবের। ডিভোর্স লেটার পেয়ে ছুটে এসেছিল মুহিব।
মীরা ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে ছিল খুলে নাই।
প্রথম ছয় মাস ঘর থেকেই বের হত না মীরা। তার মায়ের কান্নাকাটি, ভাবিদের আঁকাবাঁকা কথা কোন কিছুই তাকে স্পর্শ করতো না। তারপর ধীরে ধীরে একটু একটু করে মানুষজনের সঙ্গে মিশতে শুরু করলো।
বাসার কাজ করা। ভাইয়ের বাচ্চাদের অংক করানো এসব নিজ দায়িত্বেই করতো।
হঠাৎ করেই কয়েকটা টিউশনিও পেয়ে গেল। যদিও টিউশনি করতে বাড়ির বাহিরে যাবে তার জন্য ভাইদের অনুমতি আদায় করতে কষ্ট হয়েছে। কিন্তু নিজের হাত খরচের টাকা জোগাড় করতে তার টিউশনির দরকার ছিল।
এই টিউশনি করতে বাড়ির বাহিরে গিয়ে বুঝতে পারলো ডিভোর্সী একটা মেয়ে যেন সবার কাছে খুব সহজলভ্য। যা কিছু বলা যায় তাকে কিংবা যা কিছু চেয়ে ফেলা যায়। পরিচিত ভদ্রলোকের মুখোশ পড়া মানুষ গুলো যে এত নোংরা হাত বাড়িয়ে দেয় সে আজকাল দেখে আর আবাক হয়।
এর মধ্যে তার কলেজের বান্ধবী রোজীর সঙ্গে অনেক বছর পর দেখা।
সে একটা বিদেশী এনজিও তে বড় চাকরি করে।
মীরার কে বলেছিল,’ তুই চাকরি করবি মীরা?’
‘চাকরি!’
‘আমাদের এনজিওর একটা স্কুল আছে টেকনাফে। রোহিঙ্গা বাচ্চাদের পড়াশোনা করাবি। থাকার ব্যবস্থা আমি করে দিব!’
মীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘এতদূর যাবার অনুমতি পাব না রে!’
মীরার মা মারা যাওয়ার পর বাবার বাড়ির পরিবেশটা অনেক কঠিন হয়ে গিয়েছিল ওর জন্য।
মীরা কখনো ভাবিদের কোন বিষয়ে কথা বলতো না তবুও কেন জানি ভাবিরা মীরার আবার বাবার বাড়িতে ফিরে আসা টা মেনে নিতে পারলো না। কারণে অকারণে তাকে সংসার বিতাড়িত একজন মানুষ হিসেবে খোঁচা দিয়ে কথা বলা শুরু করলো। কিন্তু এই ভাবিদের সঙ্গেই তার কত সুন্দর সম্পর্ক ছিল। গল্পে খুনসুটিতে মেতে থাকতো ওরা।
ওকে মুখের উপর অপয়া,বাজা মেয়ে মানুষ বলতেও দ্বিধা করে না এখন।
একদিন বড় ভাইয়ের ছেলেটা পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে ভাবি এসে বলল ওকে, ‘মীরা মাসুক পরীক্ষা দিতে বের হবার সময় তুমি সামনে থেকো না। আমি চাই ও ভালো একটা রেজাল্ট করুক। তুমি চাও না?’
মীরার চোখে পানি এসে গিয়েছিল সেদিন। এই ভাইয়ের বাচ্চাদের পড়ায় সে। পরীক্ষার খুঁটিনাটি সব সে বুঝিয়ে দেয়।
সেদিন দরজা বন্ধ করে অনেক কেঁদেছিলো মীরা।
রাতে তার ছোট ভাবির ভাই এসে হঠাৎ ই মীরার জন্য রাকায়েতের বিয়ের প্রস্তাব দিল। এবং ভাইয়েরা কোন সিদ্ধান্ত দেয়ার আগেই সে মনে মনে ঠিক করে ফেলল সে আবার বিয়ে করে সংসারী হবে। এবং তার জন্য রাকায়েতের মেয়েদের মা হয়ে উঠাই হয়তো সবচেয়ে বেশি সন্মানজনক হবে সবার কাছে।

খুট করে দরজায় শব্দ হতেই মীরা সম্বিত ফিরে পেলো। চোখের কোনের পানি টা মুছে ফেলল।
রাত প্রায় একটা বাজে রাকায়েত ঘরে ঢুকলো।
মীরা জানালার পাশ থেকে সরে এসে ঘরের মাঝখানে দাঁড়াল।
রাকায়েত হাতের ঘড়িটা খুলতে খুলতে বলল, ‘সরি অনেক রাত হয়ে গেল। আম্মা মানে ঐশী মৌশীর নানু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন।’
মীরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,’সে কি আমার সঙ্গে এই ঘরে আসার আগে কত সুন্দর কথা বললেন! এখন কি অবস্থা আমি যাই গিয়ে দেখে আসি?’
‘না না এখন যেতে হবে না আপনার মানে তোমার! আমি ওষুধ খাইয়ে ঘুমানোর পর আসলাম।’
‘ও। ‘ মীরা চুপ করে রইলো।
‘তোমার সাথে ঐশী মৌশির কথা হয়েছে? ওরা বলল, তোমাকে ওদের পছন্দ হয়েছে।’
‘জ্বি ঐ সামান্য‌ই কথা হয়েছে তেমন কিছু না।’
‘সমস্যা নেই সারাজীবন পরে আছে কথা বলার জন্য এখন যাও ফ্রেশ হয়ে নাও তুমি হয়তো অনেক ক্লান্ত মীরা।’
মীরা নিজের শাড়ি বের করে নিয়ে ওয়াসরুমে ঢুকে গেল।

( চলবে )