#এসো_রূপকথায় (৯)
চাইলেই দূরে থাকা যায় না। রিসান শত চেষ্টা করেও মেয়েটির থেকে মন সরাতে পারল না। এক ভোর বেলা উন্মাদের মতন উপস্থিত হলো। রিয়া তখন বাগানে বসে এক মনে সূর্য ওঠা দেখছে। গাড়ির হর্ন পেয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে নিল। এই সময়ে গাড়ি তো আসার কথা নয়। অবচেতনেই মেয়েটির হৃদয় লাফিয়ে ওঠল। তড়িঘড়ি বের হলো ও। দেখল ফর্সা ত্বকের পুরুষটি দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটার অত্যধিক সৌন্দর্য চোখে এসে লাগছে। একবার নিজের ত্বকের দিকে তাকাল ও। রিসান তার থেকে কয়েক সেড ফর্সা। ভেতরে কেমন একটা মন খারাপের সুর নেমে এল।
“এই সময়ে এখানে কেন এসেছেন?”
“অস্থির হয়ে ছিলাম।”
“তেমনটা হলে এত দিন ঠিক ই আসতেন। কল করতেন।”
“চেয়েছিলাম দূরে থাকতে। ভুলে যাওয়ার জন্য।”
“তবে আজ কেন এলেন?”
“ব্যর্থ হয়ে এসেছি। আমি তোমায় ভুলতে পারছি না।”
কথাটি বলেই মাথা চেপে ধরল রিসান। এই কয়েকটা দিন মেয়েটির অস্তিত্ব হাতড়ে বেরিয়েছে সে। বুকের ভেতর নীল রঙা য ন্ত্র ণার রেখা ওঠেছে। অথচ, দিন শেষে ফল কী না শূন্য। রিয়া চলে যেতে নিলেই পথ আটকে দাঁড়াল রিসান। আকুতি তার কণ্ঠে।
“আমি কথা দিচ্ছি, সম্পর্কের সকল দায়িত্ব আমার। আমি সবটা ঠিক করে দিব।”
“আপনি পারবেন না রিসান। মিছে আশায় বাঁধবেন না আমায়।”
এই বাক্য শেষ করে যে রিয়া পালাল তারপর আর এল না। মেয়েটির সাথে আরো এক মাস দেখা হলো না। কথা হলো না। রিসান তখন ডুবতে লাগল অন্য নেশায়। মদের গ্লাসে ঠোঁট ছোঁয়াতে লাগল। বোকা প্রেমিক জানে না, প্রেম যদি শুদ্ধ হয় তবে পৃথিবীর কোনো তরলের ই সেটিকে ভোলানো সাধ্য নেই। ছেলেটার শরীরের গঠনে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। রাত করে বাড়ি ফিরছে। কখনো বা মদ খেয়ে মাতাল হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে। বন্ধুরা এসে টেনে তুলে। এভাবেই জীবন চলতে থাকে। এর ই মধ্যে একদিন খবর আসে মেহনূরের শরীরে আরেকটি প্রাণ আসতে চলেছে। দু পরিবারই ভীষণ খুশি। বাবা মা সমেত উপস্থিত হয় রিয়া। কারীব দেশে নেই। তবে ফোন করে বোনের খোঁজ খবর নিয়েছে। মেহনূর নিজের মেয়ে না হলেও কখনো মা বাবার অভাব বুঝতে দেন নি ফাহমিদা আর ইব্রাহিম। কখনো মনে হয় নি কন্যাটি তাদের নয়। ভেতরকার খবর ওনারা ও জানতেন না। যদি জানতেন মেহনূর এর সাথে এত বড়ো অন্যায় হচ্ছে তবে কখনোই বিয়েটা হতে দিতেন না তারা। আগলে রাখতেন সবটা দিয়ে। ফাহমিদা সেটি ভেবেই চোখেল জল মুছে নিচ্ছেন। মেহনূর জড়িয়ে ধরল ওনাকে।
“কেঁদো না মা।”
“যদি জানতাম,তবে কখনোই বিয়েটা হতে দিতাম না মা। আমাদের ক্ষমা করে দিস।”
মেহনূরের চোখ ভে ঙে কান্না আসে। বাবা মা কে জড়িয়ে কেঁদে ফেলে ও। জাহিদ ঘরে প্রবেশ করতে গিয়েও থেমে যায়। কিছু সময় পর ওনারা বেরিয়ে পড়ে। মৃদু শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় মেহনূর। জাহিদ এসেছে।
“কিছু খাবে?”
“না।”
মেহনূর আর জাহিদ দুজনেই চুপ হয়ে যায়। একটু বাদে পুনরায় জাহিদ বলে,”আমাকে এখনো ক্ষমা করতে পারো নি। অথচ বাচ্চাটা নিয়ে নিলে না জানিয়েই। এর কারণ জানতে পারি?”
মেহনূর হয়ত উত্তর দিত না। তবে মন মস্তিষ্কের দ্বন্দ্ব চলায় উত্তর করল। একদম ওঠে এসে ছেলেটার বরাবর দাঁড়াল।
“কতটা অভিনয় করেছ, আর কতটা ভালোবেসেছ সেটা জানি না। তবে শুনে রাখো, পৃথিবী উল্টে গেলেও আমি তোমায় ছাড়ব না। বিয়ের আগে সুযোগ ছিল। তোমরাই ধরে বেঁধে নিয়ে এসেছ। ভয় দেখিয়েছ। এখন আর সেই সুযোগটি নেই। তোমায় ছাড়ছি না আমি। কোনো ভাবেই না।”
কথাটি বলতে বলতে কেঁদে ফেলল মেহনূর। জাহিদ তখন ও এক মনে তাকিয়ে আছে। অভিনয়ের বিপরীতে যেই ভালোবাসাটা তৈরি হয়েছে সেটা অস্বীকার করার উপায় কী আছে? উহু নেই। এই পৃথিবী আর তার নিয়ম দুটোই ভীষণ অদ্ভুত। একটা নির্দিষ্ট সময় পর আমরা মেনে নিতে শিখি। আর তারপর হুট করেই মেনে নেওয়া জিনিসটা আমাদের চাওয়াতে পরিনত হয়। যেমনটি এই মুহূর্তে অনুভব করতে পারে জাহিদ। মেহনূরকে মেনে নিতে নিতে এখন খুব করেই চেয়ে ফেলেছে। এই মেয়েটি হয়ত কখনো জানবে না, তাদের সম্পর্কের শুরুটা মিথ্যে হলেও শেষটা কখনোই মিথ্যে হবে না। কখনোই না।
দুই মাস পর। বিয়ের দিন কনের মুখে হাসি নেই। এই দৃশ্যটি ভীষণ করুণ ই বলা চলে। সানা অনুভূতিহীন হয়ে বসে আছে। তার হৃদয়ে তপ্ততা। অথচ বাইরেটা সজীব। কখন থেকে কবুল বলতে বলা হচ্ছে। তবে মেয়েটির মুখ থেকে শব্দ আসছে না। ওর ঠিক পাশটায় বসল রিসান। আপুর হাতটা আগলে নিল।
“আপু,কবুল বল।”
বাক্যটি শুনতে পেয়ে ভাইয়ের দিকে চাইল সানা। তার দুঃখটি মেলে দিতে চাইল। তবে রিসান যেন চুপ। কারণ সে নিরুপায়, নিস্ব। তিন কবুল উচ্চারণ করল সানা। বিয়ে সম্পূর্ণ হলো। চারপাশ থেকে ভেসে এল আলহামদুলিল্লাহ জনরব। মিষ্টি মুখ করানোর উৎসব। এদিকে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটির মুখে নীরব হাসি। কোথাও একটা ব্যথা হয়, হচ্ছে। তবে যা ধরার সাধ্য নেই,তাতে মায়া ও রাখতে নেই। জায়গাটি থেকে সরে গেল জাহিদ। মেহনূর নিজ ঘরে বসে আছে। ক্লান্ত লাগছিল বিধায় ভীড়ে যায় নি সে। দরজা খোলার শব্দ ফিরে তাকাল।
“এসেছ, বিয়ে কী হয়ে গেছে?”
“হুম।”
কথাটি বলেই মেহনূরের সম্মুখে বসল জাহিদ। কিছু সময় তাকিয়ে রইল। মেহনূর ও তাই। তারপর আচমকাই জাপটে ধরল মেয়েটিকে। মেহনূর কিছুটা ভরকাল বটে। তবে সামলে নিয়ে ভরসার হাতটি পিঠে ঠেকাল।
“মেহনূর, আমি অতীত ভুলতে চাই। সবটা ভুলতে চাই। প্লিজ, পাশে থেকো। প্লিজ জান।”
মেহনূরের দু চোখ ভে ঙে কান্না এল। ও মুখে কিছু না বললেও জাহিদ বুঝে নিল পুরো সম্মতি জানিয়েছে তার প্রিয়তমা স্ত্রী।
বোনের বিদায় দিয়ে ছাদে এল রিসান। নীল রঙের শাড়ি পরিহিত কন্যাটিকে পেছন থেকে জাপটে ধরল। পুরুষালি স্পর্শে কম্পন হলো রিয়ার সমস্ত দেহ। মৃদু স্বরে বলল, “এভাবে ছুঁবেন না প্লিজ। অস্বস্তি হয়।”
রিসান হাসল। তারপর কানের কাছে এগিয়ে বলল,”কীভাবে ছুঁবো।”
“ধ্যাত।”
“আচ্ছা শোনো।”
“হুম?”
“চোখ বন্ধ করো।”
“কেন?”
“করো না বাবা। এত কথা কেন?”
“আচ্ছা।”
রিয়া চোখ বন্ধ করল। রিসান আলগোছে মেয়েটির মাথায় ঘোমটা টেনে দিল। এতে এক চিলতে হাসির উদয় হলো কন্যাটির অধরে। রিসান ও হাসল। পকেট থেকে রিং টা বের করে হাঁটু গেড়ে বসল। রিয়া চোখ বন্ধ করেও যেন সব কিছু বুঝতে পারছে। ওর লজ্জা লাগছে বেশ।
“চোখ খোলো।”
চোখ মেলতেই পুরুষটির মুখখানি দেখতে পায় ও। ভেতর থেকে অস্পষ্ট সব সম্মোহন আসে। কাছে আসার ইচ্ছে জাগে। তবে নিজেদের লাগাম টেনে নিয়ে প্রণয়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দুজনেই। রিসান বেশ কিছু সময় পর মহামূল্যবান সেই বাক্যটি উচ্চারণ করে। ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে বলে ওঠে,”ভালোবাসি প্রিয়তমা। অনেক বেশি। ঐ চাঁদ যতদিন থাকবে ততদিন ভালোবাসব তোমায়। নিজের সবটুকু দিয়ে আপন করে নিব প্রিয়তমা।”
চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি