কাঞ্চাসোনা_২ পর্ব-১৬

0
170

#কাঞ্চাসোনা_২
#পর্ব_১৬
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর

ধ্রুবর এমন লাগামছাড়া কথায় সকাল আরো নুয়ে পড়ে।কই ভেবেছিলো সন্ধ্যায় ঢাকা কেমন লাগে সে পরিবেশটা উপভোগ করবে তা না করে ধ্রুবর দেয়া লজ্জায় চোখ খুলে তাকানোই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।ধ্রুব সকালের লজ্জামাখা মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।বাচ্চা বউটা কাছে থাকলে এতো সুখ সুখ লাগে কেনো?অফিস থেকে ফিরার পথে শরীর থাকে ক্লান্ত,তখন মোটেই কথা বলতে ইচ্ছে করেনা,চারিপাশের সবকিছু বিরক্ত লাগে কিন্তু আজকে ধ্রুবর কাছে কিছুই বিরক্ত লাগছে না,আজকের সন্ধ্যাটা যেনো কোন রঙের আদলে সাজানো যা দেখলে বিরক্তি না এসে মুগ্ধতা আসে।শরীর মন কোনো কিছুই আজ ক্লান্ত না বরং মাত্রাতিরিক্ত ফুরফুরে।আচানক সবকিছু বদলে যাবার মূলে আছে সকাল।সকাল আছে বলেই তো সব এতো সুন্দর।আচ্ছা প্রিয় মানুষ কাছে থাকলে সবারই কি এমন মনে হয়?ধ্রুব শক্ত করে সকালের নরম হাতটা ধরে রাখে।তার বলিষ্ঠ আঙুলের ভাজে সকালের চিকন আঙুলগুলোর অবস্থান দেখে মিটিমিটি হাসে,দুষ্ট ধ্রুব মনে মনে ছক কষে চলে যায় অনেক দূরে,তারপর নিজের কল্পনায় নিজেই হোচট খায়,চোখ তুলে সকালের দিকে তাকায়,এই বাচ্চার সাথে উল্টাপাল্টা কিছু অসম্ভব।দেখা যাবে ধ্রুব কোনো পদক্ষেপ নিলে সকাল মিতুর রুমে গিয়ে বসে থাকবে কিংবা রান্নাঘরে শাশুড়ির পাশে বসে থাকবে।এরচেয়ে আগে বন্ধুত্ব হোক,পাখি উড়তে শিখুক,বাসার খুঁজে ডানা ঝাপটে নিজের অস্থিরতা প্রকাশ করুক তখন না হয় সে বাসার খুঁজ দেবে,পরম যত্নে নিজেই একাকিত্ব ঘুচাবে।ধ্রুব নিজের ভাবনায় নিজেই হাসে।
সকাল ধ্রুবর মুখের হাসি দেখে নিজেও হাসে।রেস্টুরেন্টের সামনে গিয়ে রিক্সা থামে।ধ্রুব সকালকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে।পরিপাটি সাজানো রেস্টুরেন্ট দেখে সকাল মুগ্ধ হয়ে চারপাশে তাকায়।কর্ণারের একটা টেবিলে সকাল আর ধ্রুব বসে।ধ্রুব সকালকে বললো,
“কি খাবে?”

সকাল আমতা আমতা করে ধ্রুবর দিকে তাকায়।ধ্রুব সকালের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমিই অর্ডার দেই?”

সকাল যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচে।ধ্রুব নিজের ইচ্ছামতো অর্ডার দেয়।খাবার আসার আগে ধ্রুব সকালকে প্রশ্ন করে,
“আমাকে তোমার কেমন লাগে সকাল? ”

হঠাৎ এমন প্রশ্নে সকাল থমকে যায়।চঞ্চল চোখে ধ্রুবর দিকে তাকায়।ধ্রুব ভ্রু নাচিয়ে তাকায়।
সকাল আস্তে করে বললো,
“ভালো।”

“কতোটুকু ভালো?”

সকাল দুষ্টু হেসে বললো,
“ঘুরতে আসার মতো ভালো।”

সকালের কথা শুনে ধ্রুব হাসে।হাত দিয়ে ঘাড় ম্যাসাজ করে বললো,
“প্রেম করার মতো ভালো না?”

ধ্রুবর দুষ্টু কথায় সকাল হাওয়ায় ভেসে যায়।দেহ-মন অজানা শিহরণে দুলে উঠে।মিষ্টি হেসে বললো,
“তা তো ভেবে দেখিনি।”

“একবার ভেবে দেখোনা।এই অবুজ বালকটা একটু প্রেমের রঙে রাঙুক,তোমার প্রেমে পড়ে নাবালক থেকে সাবালক হোক।চান্স দাও না বউ।”

সকাল অবাক হয়ে ধ্রুবর দিকে তাকায়।আশ্চর্যের সুরে বললো,
“আপনি অবুজ,নাবালক?”

ধ্রুব ঠোঁট কামড়ে হাসে।
“তা নয়তো কি?সাবালক হলে তো বউ আদর করতো।আমার বউ তো আদর করে না।”

সকাল কিছু বলার আগে ওয়েটার খাবার নিয়ে আসে।সকাল লজ্জায় চুপ করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।ইশ ধ্রুবটা এতো দুষ্টু,এতো বেশরম!
ধ্রুব সকালের ফর্সা মুখের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় লাল আভাযুক্ত গাল দেখে আর কিছু বলেনা।ধ্রুব আর সকাল খাবার খাওয়া শুরু করে।খেতে খেতে সকাল কয়েকবার ধ্রুবর দিকে তাকায়।ধ্রুব সেদিকে তাকিয়ে বললো,
“একবার চান্স দিয়ে দেখো।তোমার পাগল প্রেমিক হবো।কথা দিচ্ছি!”

সামির বিগত কয়েকমাস যাবত নাদিয়াকে পড়াচ্ছে।সামির খেয়াল করেছে নাদিয়ার হাবভাব ভালো না।পড়াতে যাওয়ার পরে সারাটা সময় তার দিকে তাকিয়ে থাকে,আজকাল সেজেগুজে সামিরের সামনে আসে।সামির ভুল করে যদি নাদিয়ার দিকে তাকায় তাহলেই হলো নাদিয়া মুচকি হেসে অন্য প্রসঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে।এই কারণেই সামির মেয়ে ছাত্রী পড়াতে চায় না,কিন্তু টাকার অভাবে না পড়িয়েও পারে না।আজকে নাদিয়া বেশ ছটফট করছে,কিছু বলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে কিন্তু সামির পাত্তা দিচ্ছে না বলে বলা হচ্ছে না।তারপরও নাদিয়া আস্তে করে ডাকে,
“স্যার!”

সামির নাদিয়ার পদার্থবিজ্ঞান বই ঘাটতে ঘাটতে বললো,
“বলো।”

“আমাকে কেমন লাগছে?”

সামির নাদিয়ার দিকে তাকায়।নাদিয়া শাড়ি পরেছে আর সেজেছেও,এটা অনেকক্ষন আগেই খেয়াল করেছে।সামির স্বাভাবিক ভাবেই বললো,
“সবসময় যেমন লাগে।”

নাদিয়া সামিরের ভুলটা ধরিয়ে দেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে বললো,
“সেটা না।আমি শাড়ী পড়েছি এটা।”

সামির পকেট থেকে মোবাইল বের করে টাইম দেখে।আর মাত্র পনেরো মিনিট।তারপর নাদিয়ার সামনে বইটা রেখে বললো,
“এই সূত্রগুলো পারো?”

সামিরের এমন প্রশ্নে নাদিয়া মনক্ষুন্ন হয়।সে সামিরের থেকে প্রশংসা আশা করেছিলো।তার মতো রূপবতী তরুণীর সাজগোছ এভাবে অগ্রাহ্য করার সাহস কি করে হলো?অন্য কেউ হলে তার দিকে মুগ্ধ চোখে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতো,কিন্তু সামির!সামির তো ফিরেও তাকাচ্ছে না।নাদিয়ার নিজেকে বড়ো তুচ্ছ মনে হলো।সামির কি বুঝে না?নাদিয়া সামিরের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়।
“আপনাকে কিছু বলতে চাই।”

সামির নাদিয়ার চোখে চোখ রাখে।কিশোরীর মনের সুপ্ত বাসনা বুঝতে বেশী সময় লাগে না।মাথাটা নিচু করে কিছু ভাবে।
“তুমি যা ভাবছো তা কখনো সম্ভব না।আর এই প্রসঙ্গে কিছু বলতে চাইলে আমি আর তোমাকে পড়াতে আসবো না।”

সামির দ্রুত পায়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে যায়।নাদিয়ার চোখে য়খন পানি টলমল করছে।নাদিয়া কখনোই জানতে পারবে না সামিরের জন্য অন্য কেউ সেই কবে থেকে পথ চেয়ে বসে আছে কবে সামির হাত বাড়িয়ে ইশারা করবে।নাদিয়া ভাবে সে হাল ছাড়বে না,দরকার হলে বাবা মাকে হু/মকি দিয়ে হলেও সামিরকে নিজের করে নিবে।বাবা মায়ের জেদি মেয়ে বলে কথা।

সামির দ্রুত পায়ে নাদিয়াদের বাসার ত্রিসীমানা পেরিয়ে যায়।তার চেহারায় খুবই বিরক্তি মেখে আছে।হাতে টাকা নেই,নাদিয়াকে পড়িয়ে বেশ ভালো একটা অংক হাতে আসে,মাসের মধ্যে দিয়ে এই টিউশনটা হাতছাড়া করার কোনো মানে নেই।সামির মোবাইল বের করে নিজের চেহারা দেখে।মেয়েদের আকর্ষণ করার জন্য তার চেহারাটা যথেষ্ট।ফর্সা গড়নে,শক্ত সামর্থ্য শরীর,চেহারায় ব্যক্তিত্বের ছোঁয়া বিদ্যমান।যে কেউ দেখলেই সামিরকে পছন্দ করে,অথচ সামিরের সবকিছুতেই বিতৃষ্ণা।হাতের ফোনটা কড়কড় শব্দে বেজে উঠে।সামির মোবাইলটা কানে ধরে বললো,
“হ্যালো।”

সামিরের কাছে থেকে মিতু নিজেকে দূরে রাখতে পারেনি,এতো কথার পরেও বেহায়া মিতু নিজেকে আটকাতে পারেনি।ফের সামিরের নাম্বারে ফোন করে।সামিরের গম্ভীর গলার স্বর শুনে অন্তরআত্মা কেঁপে ওঠে।করুন গলায় বললো,
“সামির ভাই।”

সামির ভাবলেশহীন ভাবে বললো,
“কি?”

“কই আপনি?”

“টিউশনে এসেছি।”

মিতু থেমে বললো,
“কি করেন?”

মিতুর কথায় সামিরের চোয়াল শক্ত হয়,নাদিয়ার রাগ মিতুর উপরে ঝাড়তে ইচ্ছে করছে।ক্যাটক্যাট গলায় বললো,
“হা ডু ডু খেলি।খেলবা?”

মিতু অসহায় গলায় বললো,
“এভাবে বলেন কেনো?”

সামির প্রতিউত্তর করেনা।সামনের বেঞ্চে বসে মিতুকে বললো,
“গোয়েন্দার মতো পেছনে পেছনে ঘুরবে না।কাছে আসো।”

ধরা পড়ে মিতু চুপসে যায়।গাড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে।সে সামিরের পিছনেই ছিলো তার ধারনা ছিলো সামির বুঝি বুঝতে পারবে না।কিন্তু কথায় আছেনা সিং/হের চোখ ফাঁকি দেয়া অসম্ভব।মিতু ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে যথেষ্ট দুরূত্ব রেখে সামিরের পাশে বসে।সামির বললো,
“এখানে কি করো?”

মিতু আস্তে করে বললো,
“বান্ধুবীর বাসায় এসেছিলাম।”

মিতুর কথায় সামির মুচকি হাসে।মিতুর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আজকে আমার স্টুডেন্ট আমাকে প্রপোজ করেছে।”

সামিরের এইটুকু কথায় মিতু থমকে যায়,চোখের পলক হয় স্থির।সামির মিতুর মুখের ভাব লক্ষ করে বললো,
“বড়োলোকের মেয়ে,দেখতে সুন্দরী।আর কি চাই?ভাবছি রাজি হয়ে যাবো।শশুড়ের টাকায় বসে খেতে পারলে মন্দ হয় না।কি বলো মিতু?ছোটবোন হিসেবে একটা পরামর্শ দাও।”

মিতুর চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে।ঠোঁটের কাঁপন হয়।সামিরের প্রতিটা কথা কানে প্রতিধ্বনি তুলছে।অবিশ্বাস্য চোখে সামিরের দিকে তাকিয়ে থাকে।সামির মিতুকে ফুসলাতে বললো,
“নাদিয়া প্রতিদিন আমার জন্য সেজে থাকে।দেখতে যা লাগে।উফ!”

মিতুর বুকে কেউ হাতুড়ি পেটায়।দম আটকে আসতে চায়।স্বাভাবিক গলায় বললো,
“রাজি হয়ে যান,ক্ষতি কি?”
সে আর কিছু না বলে চুপচাপ উঠে দাঁড়ায়।আর একবারো সামিরের দিকে না তাকিয়ে সামনে এগিয়ে যায়।

সামির অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে।তার ধারণা ছিলো মিতু চিৎকার চেচামেচি করবে,সামিরকে বোঝাতে চাইবে কিন্তু এই মেয়ে তো চুপ হয়ে গেলো।সে ঠিকই মিতুর দহন টের পেলো।গালে হাত দিয়ে মিতুর যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলো।এই দহন কি শেষ হবার নয়?কি করলে এই মেয়ের নেশা কাটবে?

চলবে…..