খেরোখাতার ছেঁড়াপাতা পর্ব-০১

0
320

#খেরোখাতার_ছেঁড়াপাতা– ১
#শামীমা_সুমি

জানালার ফাঁক গলিয়ে চাঁদের আলো বিছানায় ছড়িয়ে পড়েছে, দেখতে খুব ভালো লাগছে সারা ঘর আলো হয়ে আছে। একটু পর পর হাত রাখছে আবার সরাচ্ছে অদ্ভুত খেলাটা খেলতে ভালো লাগছে বকুলের।
কত্ত কথা মনে পড়ে যায়, এমন চাঁদনী রাতে লুকোচুরি খেলাটা ভীষণ প্রিয় ছিল বকুলের, চাচাতো ভাইবোনদের সাথে খেলতে বেশ লাগতো খুশির কোন সীমানাই থাকতো না।
মায়ের একটা অদ্ভুত অভ্যাস ছিল, চাঁদনী রাতে মা ঘরের দাওয়ায় বসে ফ্যালফ্যাল করে চাঁদ দেখতো আর গুনগুন করে গান গাইতো। বাবা এসে একসময় পাশে বসতো রেডিও নিয়ে, দুজন রেডিওতে গান শুনতো, দুর্বার, অনুরোধের আসর গানের ডালি। যেদিন নাটক থাকতো রেডিওতে সেদিন আশেপাশের চাচীরাও জুটে যেতো। কত্ত মধুর ছিল দিনগুলি।

হঠাৎ করে একদিন চাঁদনী রাতটা সরে গিয়ে অমাবস্যার অন্ধকার নেমে এলো বকুলের জীবনে। বলা নেই কওয়া নেই প্রচন্ড বুক ব্যথা শুরু হয়ে কয়েকঘন্টার মধ্যে মা মরে গেলো! সপ্তাহান্তে সবাই বলাবলি করতে লাগলো,
—-এতটুকুন মাইয়া মা ছাড়া ক্যামনে মানুষ করবা বকুলের বাপ?
—- পার করতে পারমু, বাপ মেয়েতে দিনকেটে যাবে ভালোই।
— তবুও মেয়েটাকে দেখাশোনার জন্য হলেও তো একজন মানুষ দরকার?

বাবা কিছুতেই বিয়া করতে চায় নাই কিন্তু পাড়াপড়শি আত্নীয়স্বজন মিলে একপ্রকার জোর করেই বিয়া করাইয়া দিলো। আসলো নতুন মা, আমি মা পাইলাম…. কিন্তু বাবা হারাইয়ালাম জীবনের তরে….
মা মইরা ছাইড়া গেলো, আর বাবা থাইকাই নাই হইয়া গেলো।
মায়ের বড় পছন্দের ফুল আছিলো বকুল, তাই মা বড় শখ করে মেয়ের নাম রেখেছিলো বকুল।
নতুন মা পুরাতন হইলো,নতুন ভাই আসলো, বোন আসলো, আর বকুল তার সুবাস হারাতে লাগলো।

এত আদুরে বকুল যারে বাবা কোল থেকে নামাতে চাইতো না, সে ঠিকমতো খেতে পায় কিনা সে খবর বাবার অজানা, বাবার জানা কথা হলো মুরগীর কলিজাটা বকুল সোনাকে দিছি, বকুলরে ডিম সিদ্ধ করে, এক গ্লাস দুধ সহ খাইয়েছি।
বাবা ডেকে জিজ্ঞেস করে বকুল নতুন মা খুব আদর করে তাই না? ভালো ভালো খাবার খেতে দেয়, খেতে ভালো লেগেছে তো দুধ ডিম, বকুল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে বলতে পারেনা, অনেকমাস হয় একফোঁটা দুধ পাইনি, ডিম কবে খেয়েছি ভুলে গেছি। হ্যা বাবা… বলে দৌড়ে চলে যায় বকুল, পেছনে শুনতে পায় নতুন মা বলছে বড় হচ্ছে তো তাই লজ্জা পায়।
বকুল মায়ের বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে চোখের পানিতে বালিশ ভেজায়।
বাবাটা এত পর হয়ে গেছে যে কতদিন হয় বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করে না।
আগে একা ঘুমাতে ভয় পেতো খুব, এখন ভয় করে না, মায়ের বালিশটা আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে, মনে হয় মায়ের বুকে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুমাচ্ছে।

পাশের বাড়ির নতুন চাচী কত্ত ভাল ছিলো, খুব আদর করতো মায়ের অভাব বুঝতেই দিতো না, কিন্তু দুর্ভাগ্য নতুন মা দেখে ফেলে একদিন, এরপর সেই চাচীকে অভিযুক্ত করা হলো আমাকে কুপরামর্শ দেয়। কিন্তু কসম!! চাচী আমারে কোনদিন খারাপ বুদ্ধি দেয় নাই,চাচী আমায় লুকাইয়া ডিম, দুধ, ফল কতকিছু খাওয়াতো, আমার ক্ষুধার্ত পেট ভরাইতো।
বকুলের জন্য কত্ত খারাপ কথা শুনতে হলো চাচীকে, এরপর থেকে আর চাচী কোনদিন ডাকেনি। ঘরে ভালোমতো খাবার জুটতো না, সবার খাওয়া শেষে পাতিলের তলানিতে যা থাকতো তাই হলো বকুলে আহার, আর না থাকলে সেদিন উপবাস এই ছিলো তার ভাগ্যে। বাবাকে যা বলা হতো তাই তিনি বিশ্বাস করতেন, কোনদিন নিজ থেকে যাচাই করতেন না। বকুলের কষ্টের জায়গাটা ছিলো এখানে, যে মেয়েকে নিজ হাতে তুলে খাবার খাওয়াতেন, তাকে এখন পাশে বসার জন্যও ডাকেন না, এতোটা কি পর হয়ে যেতে হয়? একটুও কি মায়া থাকবে না?

চিন্তায় ছেদ পড়লো… বাইরে কে যেনো হালকা কাশি দিলো নাকি ভুল শুনল বকুল।
ধড়মড় করে উঠে বসলো…. চুপচাপ শুনছে!
কিছুক্ষণ পর আবার কে যেনো কাশি দিলো??
— কে বাইরে? কে কথা কয় না ক্যান??
আমি?
–আমি কে?

নামাজ সেরে দাওয়ায় এসে বসলেন তবারুক মিয়া। কাঁচাপাকা দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে কী যেন ভাবছেন গভীর মনোযোগ দিয়ে, একসময় চেহারায় ক্রুর চিকন হাসি ফুটলো। আপন মনে জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে হাসছেন.. হাক মারলেন —
–ওই তমিজ কই গেলি ইইই??
পড়িমরি করে ছুটে আসলেন মাঝবয়সী তমিজ সর্দার,
জ্বে মিয়া সাব..
— ল গ্রামটা একটা চক্কর দিয়া আহি।
— জ্বে চলেন, আমার টর্চলাইট লইয়া আইতাছি।
—তাড়াতাড়ি আইস।
–জ্বে মিয়া সাব।
তমিজ সর্দার বৈঠকখানার কোনের দিকের ছাপড়া ঘরটাতে থাকে। মিয়া সাবের অনেক ভাল মন্দের সাক্ষী তমিজ।

মিয়া সাব ঘরের দিকে মুখ বাড়িয়ে কাউকে উদ্দেশ্য করে বললেন কই আছো শুনো
—-জরুরী কাজে বাইরে গেলাম। আইতে দেরি অইব শুইয়া পইড়ো।
ভেতর থেকে উত্তর এলো— আইচ্ছা যান।

টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে আছে তমিজ
আয় বলে উঠানের বাইরে পা বাড়ালেন মিয়া সাবের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে ধূর্ত শিয়ালের মত!
মনে মনে একটা কথায় বাজছে… আহা কি টসটসে পাকা ডালিমের মতো গতর, ইশ!! বউ একখান আনছে সবুজ বিয়া কইরা। দেখলেই মাথা চক্কর দেয়, রূপ না য্যান আগুন জ্বলতাছে।

চোরাই পথে মালয়েশিয়া পাঠাইয়া দিছি সবুজ্জারে, হুনছি ধরা খাইছে জঙ্গলে, বাঁচুক মরুক আমার কাম শেষ! যেদিন প্রথম দেখলাম বউটারে আমার মনে ধইরা গেছে। হাতের মুঠোয় না আনতে পারলে শান্তি নাই, তাই কৌশলে বাড়িটা কিননা নিয়া টাকা দিছি, সবুজ্জা যাইতে চায় নাই বিদেশে অনেক টাকা ইনকামের লোভ দেহাইয়া পাঠাইয়া দিলাম।
ওইতো বাড়িটা দেখা যাইতাছে মনে ঘুমাইয়া গেছে বউটা, বাড়িটাতে থাকতে দিলাম বউটারে, সবুজ্জারে কইলাম কোন চিন্তা করিস না আমি আছি না।
আরে বলদ সবুজ্জা….
আপন মনে হাসতে লাগলেন মিয়া সাব, তমিজ দৌড়ে আসলো
— কি হইছে মিয়া সাব হাসেন ক্যা..?
–কিছুনা… পাও চালা জলদি।

*
বাইরে কাশির আওয়াজ শুনে জানালার কাছে খুঁজতে লাগলো বকুল, না কাউকে তো দেখা যায় না। বিছানা থেকে নামতে গিয়ে চুরিগুলো রিনিঝিনি বেজে উঠলো। মালয়েশিয়া যাবার আগে রথের মেলা থেকে কগাছি চুরি, পাউডার, স্নো আর স্যাকরার কাছ থেকে একজোড়া রূপার নূপুর গড়ে দিয়ে গেছে সবুজ, বলে গেছে,
—–এগুলি পরে থাকিস বকুল, যখন তুই হাটার সময় নূপুর বেজে উঠবে, কাজের সময় হাতের চুড়ি বেজে উঠবে বুঝিস আমি তোরে মনে করছি।
— তুমি একটা পাগল!!
— হ তোরে ভালোবাইসা পাগল হইয়াই বাঁচতে চাই।
শোন বকুল,, মিয়া সাবের দয়ার শরীর, আপন মানুষও এত উপকার করে না বাড়ি কিন্না নিয়াও থাকতে দিতাছে। তুই কিন্ত কোন বেয়াদবি করবি না হেগো পরিবারের লগে। বিদেশে গিয়া একটু সুবিধা করতে পারলেই তোরে আমি রাণীর মতো রাখুম।

সত্যি তো মা মারা যাবার পর সবুজের মত করে কেউ ভালবাসেনি বকুল কে। বাবার দোকানের কর্মচারীর সাথে পালাইয়া যাওয়ার অপরাধে বাবা আর মুখ দেখতে চায় নাই। অথচ কেউ জানেনা সৎমা মনেপ্রাণে চাইতেছিল বকুল ঘর থেকে বেরিয়ে কোথাও চলে যাক। এই উদ্দেশ্যেই মা রাতের আঁধারে বাড়ি থাইক্কা জোর কইরা বাইর কইরা দিছিলো। বাবা দোকানে মাল আনতে গেছিলো শহরে, এই সুযোগে মা তা উদ্দেশ্য সাধন করছে। মা যখন শাসিয়াচ্ছিলো সবুজ তখন বাড়ি এসেছিলো দোকানের চাবি জমা দিতে। চাবি নিয়ে মা মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়, বকুল ঘুটঘুটে আঁধারে একা বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকে। মায়ের এই অত্যাচার দেখে সবুজ হাত বাড়িয়েছিলো, —
— বকুল… যাবা আমার লগে?
— কই যামু?
– আমাগো গেরামে, এইখানে থাইক্কা আর কত মাইর খাবা, আর কিছু না পারি দুইডা ডাইল ভাত ঠিকই দিতে পারমু।
— কি পরিচয়ে যামু?
— আমারে বিয়া করবা…. বকুল? আমি জানি আমি তোমার যোগ্য না।
— হ করমু,…. যামু আপনের লগে। সবুজের হাত ধরে বের হবার পর ও বাড়িকে আর ফিরে দেখা হয় নাই, বিয়ের আয়োজনের সবকিছু করছে মিয়া সাব, আসলেই অনেক ভালো মানুষ এমন মানুষ হয় না।

চিন্তায় ছেদ পড়ে এবার কে যেন দরজা নক করে..ঠকঠক।
—- কে??
—- আমি দরজা খোল বকুল।
—- আসিইইই..
এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে চমকে যায় বকুল।
—মিয়া সাব আপনে এত রাইতে! কোন দরকার আছে নাকি? আমারে খবর দিতেন আমি সকালে দেখা করতাম?
—- আরে নাহ!! কেমন আছো? কেমনে চলতাছো? খবর নিতে আইলাম।
—ভিতরে বইতে দিবানা বকুল??
—-ওহ! আসেন চাচা…
—- আহারে! চাচা কইও না তো নিজেরে অনেক বুড়া বুড়া লাগে।
ওই তমিজ বাইরে খাড়া দেখিস কেউ য্যান এদিকে না আসে।
অজানা আশংকায় বুক ধড়াস করে উঠে! মনের মধ্যে কু ডাকতে থাকে, হঠাৎ করে বাইরে দিকে হাঁটা দেয় বকুল।

খপ করে হাতটা ধরে ফেলে মিয়াসাব।
— কই যাও বকুল??
— আপনে বসেন চাচা, আমার একটু কাজ আছে বাইরে শেষ কইরা আসি।
— পরে কইরো এখন বসো আমার কাছে দুইডা সুখদুঃখের কথা কই।
–আমার কোন সুখদুখের কতা নাই। হাত ছাড়াতে চেষ্টা করে বকুল,কিন্তু শক্তিতে হার মানে।
হেচকা টানে বিছানায় পড়ে যায় বকুল। দ্রুত হাতে দরজার খিল দিয়ে ফেলে মিয়াসাব, বকুল পায়ে ধরে কান্নাকাটি জুড়ে দেয় কিন্তু মিয়া সাবের দয়ার শরীরে একফোঁটাও দয়া হয় না। হামলে পড়ে অবশিষ্ট দয়া দান করতে, বকুলের আর্তচিৎকার মিশে যেতে থাকে বাতাসে।

বাইরে তমিজ সর্দার কান চেপে ধরে কিছুই শুনতে চায় না, ঘরের চিৎকার থেমে যায় একসময়, তমিজ সর্দার গামছার খুটে চোখের পানিটুকু মুছে নেয় তার পোড়াচোখের।

নীরব আলুথালু দেহে বকুল কেঁদে চলছে মিয়া সাবের দয়ার দানে, বকুলের সাধের চুড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সারা ঘরময়, একটা নুপুর পায়ে আছে আরেকটা নুপুর পড়ে আছে একটু দুরে সবুজের অস্তিত্ব জানান দেয়া শেষ…….

চলবে