বুক পিঞ্জরায় পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব

0
75

#বুক_পিঞ্জরায় (১১) শেষ
ফাতেমা তুজ জোহরা

এগারো.

প্রভাতের সূর্যকিরণে আলোকিত চারপাশ। মেহের ভেজা চুল মেলে জানালার পাশে বসে চায়ে ঠোঁট পোড়াচ্ছিলো। চা-টা রাবাব এসে দিয়ে গিয়েছিলো। মেহরাব এখনো শুয়ে আছে। মেহের চেষ্টা করেছিল ফজরের নামাজটা আদায় করাতে। কিন্তু সে ব্যর্থ হলো। একাই ফজরের নামাজ আদায় করে দু’হাত তুলে স্বামীর জন্য সুস্থতা ও হেদায়েত চেয়ে দু’হাতের আঁজলায় নয়নের অশ্রুতে ডুবিয়েছে। রাবাব চা দিয়ে যাওয়ায় বাহিরে আর গেলো না মেহের। জানালা দিয়ে সবে ফুটে ওঠা সকালটাকে উপভোগ করছে সে। কতইনা নমনীয়তা সকালের ফুটে ওঠা এই আলোয়।

মেহরাব আড়মোড়া দিয়ে ঘুমঘুম নেত্রপল্লব খুলে তাকাতেই দৃষ্টি পড়ে মেহেরের দিকে। স্নিগ্ধ এক সকালে শুভ্র এক রমনীর ঠিকরে পড়া সৌন্দর্য চোখ আটকালো মেহরাবের। টুলের উপর বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছে মেহের। এদিকে তার খোলা চুলগুলো বসা অবস্থায় ফ্লোর ছুঁইছুঁই করছে। ফ্যানের বাতাসে কিছু শুকনো চুল এলোমেলো হয়ে নাচানাচি করছে। মেহরাব আটকে গেলো এখানে। এভাবেই একটু একটু করে মেহেরের প্রেমে পিছলে পড়ছে সে। ভবিষ্যতে নাকানিচুবানিও খেতে হতে পারে।

মেহরাব সদ্য জেগে ওঠা ঘুমো কণ্ঠে বলল, “শুভ সকাল।”

মেহের পাশ ফিরে তাকিয়ে এক ফাঁলি চাঁদের ন্যায় হাসি দিয়ে বলল, “শুভ সকাল। আপনার দিনটি রহমতপূর্ণ হোক।”

মেহরাব আর কিছু বলল না। উঠে বসে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে তাকিয়ে আছে মেহেরের দিকে। কি বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। মেহের চায়ে শেষ চুমুক বসিয়ে তাকালো মেহরাবের দিকে। মেহরাবের চাহনী দেখে ধক করে উঠলো বুকের ভেতর। অচেনা এক চাহনী। ঘোর লাগানো এক মুহুর্ত। স্বামী-স্ত্রী’র মাঝে এভাবেই বুঝি রহমতের প্রেম আসে। মেহের চোখ ফিরিয়ে ঢোক গিলে বলল, “কিছু কী বলবেন ?”

মেহরাবের যেন হুঁশ এলো। সেও চোখ নামিয়ে নিলো। এভাবে বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকবে এটা সে ভাবতেও পারেনি। বিয়ে এক অদ্ভুত জিনিস। সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দুনিয়ার মতো। ভালো-মন্দ দুটোই বসবাস করো। এটা নির্ভর করে আমাদের নিজেদের উপর। মেহরাব দ্রুত বিছানা থেকে উঠে লাগোয়া বাথরুমে চলে গেলো। মেহেরের সামনে থাকলে বোকার মতো আর কী করে বসবে তার ইয়াত্তা নেই। নিজের এটিটিউড বিয়ের পর ধুপধাপ করে পালটে যাচ্ছে। একদিনেই এতসব। নিজের প্রতিই নিজের এখন বিশ্বাস নেই মেহরাবের।

সকালের নাস্তার পর মেহের তৈরি হয়ে নিলো। সাথে মাইশাও তৈরি হলো। আজ যে বাবালয়ে নায়রী যাবে। মেহরাবও তৈরি হলো। একটা টেক্সি ভাড়া নেয়া হলো। যাতে ভালোভাবে যাতায়াত করা যায়। কিছু উপহার সামগ্রী রেদোয়ান আর সাফিয়া মিলে তৈরি রেখেছিলেন। যাওয়ার সময় মেহেরের হাতে ভালো করে বুঝিয়ে দিলো সাফিয়া। বন্ধুত্বের সাথে এখন বেয়াই সম্পর্কতে পরিণত হয়েছে। এখনতো আরেকটু বাড়তি খাতির যত্ন করতেই হয়। সম্পর্কের যত্ন না করলে সেটা ভালো থাকে না। ভালো থাকার জন্য সবদিকেই খেয়াল রাখা প্রয়োজন।

________

দুই মাস কেটে গিয়েছে ইতোমধ্যে। মেহরাব এখন বেশ ভালো করেই হাঁটাচলা করতে পারে। কোনো অসুবিধাই হয় না। মেহের তার জীবনে ম্যাজিকের মতো। নতুন এক পালটে দেয়া ভোরের মতো। যেকারণে নিজেকে এতটা গুছিয়ে নিতে পেরেছে। এখন সে তার বাবার সাথে ব্যবসা সামলায়। ছেলের এই পরিবর্তনে রেদোয়ান বেজায় খুশি। মেহেরকে ছেলের বউ করে আনার সিদ্ধান্তটা শতভাগ সাফল্য অর্জন করেছে।

মেহের তারাতাড়ি করে গোসলের পানি বালতি ভরে রাখছে। মেহরাবের কাজ থেকে ফেরার সময় হয়ে এসেছে। মেহরাব ফেরার পূর্বেই তার প্রয়োজনীয় সবকিছু প্রস্তুত রাখে মেহের। মেহেরের এমনতর কাজ মেহরাবকে আরো কাজের শক্তি জোগায়। সারাদিনের কাজ শেষে বাড়িতে ফিরে আসার পর ক্লান্তি তাকে ছুঁতে পারে না মেহেরের জন্য। মেয়েটা মেহরাবের জন্য সর্বেসর্বা হয়ে গিয়েছে। মেহরাবের হৃদয় জুড়ে যে মেহের এত দ্রুত গতিতে জায়গা দখল করবে তা মেহরাব কল্পনাও করেনি।

মেহের রাবাবের ঘরের পাশ দিয়ে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিলো। মেহরাবের জন্য শরবত তৈরি করতে। কিন্তু মেহের দাঁড়িয়ে পড়লো। রাবাব সম্ভবত কারো সঙ্গে গভীরতা নিয়ে ফোনালাপ করছে। গভীরতা বলতে প্রেমিক যুগলের মাঝে যেমন আলাপ হয় আরকি। মেহের অপেক্ষা করলো রাবাবের কথা শেষ হওয়ার। প্রায় পনেরো মিনিট শেষে রাবাবের কথা শেষ হলো। এত সময় মেহের ধৈর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ঠাঁয়। কথা শেষ হওয়ার পর মেহের দরজায় টোকা দিলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই রাবাব হাসি মুখে দরজা খুলে দিলো।

মেহের রাবাবের সামনে মুখোমুখি হয়ে বসে আছে। “কার সাথে কথা বলছিলে ?” মেহেরের এই প্রশ্নের জবাবে রাবাব বেশ ইতস্ত করে শেষ পর্যন্ত বান্ধবীর সাথে কথা বলছিল বলে দিলো। রাবাবের জবাবে যে সত্যতা নেই তা মেহের তার বাচনভঙ্গিতেই বুঝতে পারলো। রাবাব হয়তো কোনো কারণ থেকে বলতে চাইছে না। মেহের জোর করলো না। তবে হাল ছাড়লো না। কোনো না কোনোভাবে তাকে বুঝালে সে বুঝবে এই আশা করছে মেহের।

মেহের বলল, “আচ্ছা রাবাব তোমাকে একটা প্রশ্ন করি ?”

রাবাব হেসেই বলল, “আহ ভাবি, তা আবার জিজ্ঞেস করতে হয় নাকি ? বলো যা আছে প্রশ্ন।”

মেহের বলল, “ধরো, তোমাকে আমি দু’টো রসগোল্লা দিলাম। একটা খুব যত্ন সহকারে প্যাকেটিং করে রাখা হয়েছিল, আর অপরটি খোলা অযত্নে ছিল। তুমি কোনটা গ্রহণ করবে ?”

রাবাব সাথে সাথেই উত্তর দিলো, “অবশ্যই পরিষ্কার পরিছন্ন পরিবেশ যেটা ছিল সেটা নেবো।”

মেহের বলল, “খোলা অবস্থায় রাখাটা কেন নেবে না ?”

রাবাব বলল, “খোলা অবস্থায় থাকা মানেতো তুমি নিজেও জানো ভাবি। কত ধুলোবালি, রোগজীবাণু ছড়ায় এতে। কত রকমের পোকামাকড় হানা দিতে পারে বিনা অনুমতিতে। অবশ্যই এটা স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ। একটা সাধারণ ফল তার খোসার ভেতর থাকাকালীন যতদিন সতেজ থাকে, একটা খোসা ছাড়ানো ফল তার অর্ধেক সময়ও সতেজ থাকে না। প্যাকেটিং অবস্থা এইজন্যই বেটার।”

মেহের হাসলো রাবাবের কথা শুনে। তারপর বলল, “আমরা মেয়েরাও এই রসগোল্লার মতো, ফলের মতো। নিজেদেরকে আমরা যত যত্নে রাখি আমরা ততোই ভালো থাকি। আল্লাহ তা’আলা আমাদের জন্য সবকিছুর সুন্দর নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন। সেই অনুযায়ী চললে অবশ্যই আমরা ভালো থাকবো। এই ধরো কোনো রিলেশনশিপ করা। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক আল্লাহ হারাম করেছেন। তার মানে অবশ্যই এতে বান্দার কল্যান নেই। কেমন কল্যান নেই জানো ? শোনো একটা বাস্তব ঘটনা বলি। আমার মাধ্যমিক স্কুলের এক বান্ধবী ছিল। আমাদের ক্লাসেরই এক সহপাঠীর সাথে তার সম্পর্ক হয়। ছেলেটা শেষ পর্যন্ত তাকে বিয়ে করেনি। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যা ঘটে তা ওই ছেলে-মেয়ের মধ্যে ঘটে গিয়েছিল। মেয়েটা প্রেগন্যান্টও হয়ে গিয়েছিল। সমাজে তাকে এখন পর্যন্ত নিচু চোখে দেখে। ছেলেটা মৌমাছির মতো মধু খেয়ে উড়ে গেলো। তাকে ধরা গেলো না। সমাজ তাকে ধরাছোঁয়ার বাহিরে রাখলো। আমি এখানে মেয়েটাকেই দোষ দেবো। তার উচিৎ ছিল বিয়ে করা। এতে তার ইজ্জত খোয়াবার ভয় থাকতো না। মেয়েটা ছেলেটাকে পাত্তা না দিলে ঘটনাটা এতদূর এগোতো না। মেয়েরা হচ্ছে সবচেয়ে দামী জিনিস। নিজেদের গোপন সৌন্দর্য সম্পর্কে জানা বা দেখার অধিকার একমাত্র স্বামীর অধিকার আছে। অন্যহাতে পড়লে তা নষ্ট হবার সম্ভাবনা আছে। ঠিক আমার ওই বান্ধবীটার মতো। এইজন্য যারতার হাতে সপে দিতে নেই।”

রাবাব চুপ করে সব শুনলো। মেহেরের বলা কথাগুলো তার মস্তিষ্কে গভীর ভাবে বসে যাচ্ছে। নিজেকে এখন ছোট মনে হচ্ছে। নিজের ভুলগুলো যেন চোখের সামনে সব ভেসে উঠছে। মেহের আবার বলল, “তোমার বিয়ে এখন দেয়াই যায়। নিজের পছন্দ থাকলে জানাতে পারো। মনে রেখো রাবাব, আল্লাহ সব দেখছেন। ওনার নজর থেকে নিরাকার কোনো প্রাণীও বাদ যায় না।”

মেহের আর কথা বাড়ালো না। বাহির দরজায় শোনা গেলো “আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহ হালাল বাইত”। মেহরাব চলে এসেছে। মেহের ছুটলো স্বামীর খেদমতে। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে সালাম গ্রহণ করলো। মেহরাব চট করে মেহেরকে জড়িয়ে ধরলো। বাসায় শুধু রাবাব ছিল। মেহের লজ্জা মুখে বলে উঠলো, “করছো কী ? বাসায় এখন রাবাব আছে।”

মেহরাব বলল, “থাকুক, সে বের হবে না এখন। তাকে অনেক আগে থেকেই আদেশ দিয়ে রেখেছি। এখন একটু বুক পিঞ্জরায় চুপটি করে থাকো। সারাদিন কতটা খালি খালি লাগে আমার পাখিটার জন্য।”

মেহের স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে হাসলো। এই শান্তি আল্লাহ প্রদত্ত। অন্য কোথাও তা পাওয়া সম্ভব না। দুটো ভিন্ন মানসিকতার মানুষ আজ এক রঙে রঙিন হয়ে গিয়েছে। এভাবেই রঙিন হোক প্রতিটা সম্পর্ক।

সমাপ্তি