গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে পর্ব-২১+২২

0
286

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২১

রায়ান বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অভিরূপের পাগলামি আচরণ তাকে অবাক করে তুলেছে। সে যতদূর জানে কোনো ফেমাস পারসনের এটিটিউড, স্টাইল হয় সবার থেকে আলাদা। কিন্তু এখানে তো পুরোপুরি উল্টো। ছেলেটাকে তো উন্মাদ লাগছে। এই জন্যই বুঝি তার দেশের লোকজন তাকে এতো পছন্দ করে?

গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন দুজন গার্ড। কথাবার্তা চলছে দুজনের মাঝেই। এর মাঝে দুজনের সামনে এসে দাঁড়াল এক নারী। মুখটা কেমন যেন ওড়না দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করছে। যেন অস্বস্তি বোধ করছে পুরুষের সামনে। তার এক হাতে থাকা হরেক রকম গোলাপের তোড়া এগিয়ে দিয়ে খুব করুণ সুরে বলল,
“ফুল নিবেন? একদম তরতাজা।”

মেয়েটির নিখুঁত চোখ লাল টকটকে। চোখের নিচে কালো। মুখে ওড়না ধরে রেখেছে। কপাল বিন্দু বিন্দু ঘামে ভেজা। গার্ড দুজন ভ্রু কুঁচকে তাকায় একে অপরের দিকে। অতঃপর তাদের একজন বলে ওঠে,
“এটা কি ফুল বিক্রি করার জায়গা? এটা এয়ারপোর্টের বাহিরের সাইড। এখনি গায়ক অভিরূপ চৌধুরী আসবে। আপনি অন্য কোথাও গিয়ে চেষ্টা করুন।”

“আমিও শুনছি তার আসার খবর ভাইজান। আমি গরীব হলে কী হইব? আমার কি শখ আহ্লাদ নাই? আমিও একটু দেখার জন্যই আসছি। উনি কি এই গাড়ি কইরা যাবেন?”

“আপনার এতো কৌতূহল না দেখালেও হবে। দূরে দাঁড়ান এতো দেখার ইচ্ছা হলে এখানে ভীর করবেন না।”

মেয়েটার মনটা যেন এবার খারাপ হলো। চোখ ছোট ছোট করে গাড়ির দিকে পর্যবেক্ষণ করে স্থান ত্যাগ করল দ্রুত পায়ে। প্রথমজন দ্বিতীয়জনের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“সব ঠিকঠাক দেখে নিয়েছিস তো? মনে রাখিস এই গাড়িতেই কিন্তু অভিরূপ চৌধুরী যাবেন। তাই গাড়িতে কোনো সমস্যা থাকা যাবে না।”

“সব ঠিকঠাক আছে। কোনো সমস্যা নেই। অভিরূপ চৌধুরী কোনো অভিযোগ সুযোগই পাবে না।”
অপরজন কথা বলতেই দুজনই আশ্বস্ত। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল আগের মতোই।

বেশ কিছুদূর ফুলের তোড়াগুলো নিয়ে হেঁটে মেইন রোডের ফুটপাতে থাকা এক গাছের তলায় এসে দাঁড়াল সেই বিক্রেতা নারী। আশেপাশে তাকিয়ে দেখল একবার। তারপর গাছের একদম নিচে থাকা একটা দশ থেকে বারো বছর বয়সী ছেলের দিকে ফুলগুলো এগিয়ে দিয়ে হাজার টাকার নোটও বের করে দিয়ে বলল,
“ধর। এখন বিদায় হ। অনেক সাহায্য করেছিস ফুলগুলো দিয়ে তার বখশিশ। এখন যা।”

ছেলেটার মুখে যেন রাজ্য জয়ের হাসি টাকার চেহারা দেখতে পেয়ে। ঠিক এই কারণেই তো না চেনা সত্ত্বেও নিজের বিক্রি করার কথা ছিল যেসব ফুল সেসব দিয়েছিল অচেনা এই মেয়ে মানুষকে। টাকা আর ফুল তড়িঘড়ি করে হাতে নিয়ে রাস্তার বিপরীতে পা বাড়াল ছোট বয়সী ছেলেটা। সে বেশ কিছুদূর যাওয়ার সাথে সাথে সেই অচেনা নারী তার থেকে কিছু মিটার দূরে থাকা দুটো লোকের মধ্যে একজনকে ইশারা করে ছেলেটির পিছু নিতে বলল। বয়সে অনেকটা বড় সেই লোকটা হাঁটা ধরল ছোট ছেলেটির পিছু পিছু। তারা আড়াল হতেই কোথা থেকে যেন বাটন ফোন বের করল মেয়েটি। কাউকে বেশ দ্রুত কল লাগালো। কল রিসিভ হলেই আস্তে করে বলে উঠল,
“ছেলেটা আমাদের জন্য সেফ নয়। বরং আলাদা একটা ঝামেলা। ওকে বাঁচিয়ে রাখার দরকার নেই। দশ মিনিটের ব্যবধানে ওকে শে’ষ করে ফেলো।”

কথাগুলো মুখ দিয়ে বের হওয়া মাত্র কল কেটে দিল মেয়েটি। আবারও তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দ্বারা আশপাশ পর্যবেক্ষণ করে নিল। তারপর ফোনের পেছনের অংশ খুলে সিম কার্ড বের করে সেটা পায়ের নিচে ফেলল। পিষতে থাকল অনবরত সিম। তারপর তার থেকে কিছু দূরত্বে থাকা লোকটিকে হাত দিয়ে ইশারায় কাছে ডাকতেই লোকটি কাছে এসে অনুনয়ের সাথে বলে,
“আপনি চাইলে কাজটা আমি করে দিই বস?”

“নো নিড। তোকে বলেছি কয়েকদিনের জন্য গা ঢাকা দিতে সেই কাজটাই কর কবীর। নয়ত ম’রবি আমার হাতে। দেখি ব্যাগটা দে।”

“কাজটা বেশি রিস্কি হয়ে যাচ্ছে না, বস?”

লেডি বস কাঠকাঠ গলায় জবাব দেয়,
“এই কাজটা আমি নিজহাতে করতে চাই। কোনো ভুল হওয়া যাবে না। আর বাকিদেরও রেডি থাকতে বল। যদিও কোনোভাবে প্ল্যান ফেল করে তোদের এ’কশন শুরু করতে হবে। আজ যে করেই হক দ্যা গ্রেট সিঙ্গার অভিরূপ চৌধুরীর লা’শ এখান থেকে যেন ইন্ডিয়ায় তার ফ্যামিলির কাছে ফিরে যায়। আজ এয়ারপোর্টে ধামাকা হবে। দরকার পড়লে লেডি বস সেখানে মৃ’ত্যুখেলা সৃষ্টি করবে।”

নারীর চোখমুখে কাঠিন্যতা দেখেই কবীরের হাত-পা কাঁপে। সে শুনেছে, নারীর হৃদয় কোমলতার শীর্ষে বিরাজ করে। কিন্তু সেই নারীর মনে যখন নৃশং’সতার বাসনা জাগে তখন যে কতটা ভয়ংকরী হয়ে উঠতে পারে সেটা কবীর আগেও দেখেছে এখনো দেখছে। সে আর কথা বাড়ানোর সাহস জুগিয়ে উঠতে পারে না। ব্যাগটা হাতে দিয়ে মাথার ক্যাপ ঠিকঠাক করে বিদায় নেয়।

এয়ারপোর্টের বাহিরের স্পেসে দাঁড়িয়ে আছে লেডিস শার্ট আর স্কার্ট পরিহিত এক মেয়ে। চুলগুলো আহামরি বড় নয়। সেসব ঝুটি করে রাখলেও সামনের চুলগুলো বাঁধা সম্ভব হয়নি। গোলগাল গাল দুটো আরো বেশি ফুলে উঠেছে। গরমের চোটে চোখমুখ লাল হয়ে এসেছে। দরদর করে ঘামছে। কিছুটা সামনে থাকা গ্যারেজ স্পেসের কাছে জমেছে বেশ ভীর। মূল কারণ হচ্ছে অভিরূপ চৌধুরী। মেয়েদের এতো ভীড়ে বিরক্তির শ্বাস ফেলে সামনের চুলগুলো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে মেয়েটি বলল,
“নয়ন, আজকে আর তোর স্বপ্ন পূরণ হবে না। যেই কারণে তুই এয়ারপোর্টে এসেও তিন ঘন্টা ধরে বসে আছিস সেটা বৃথা যাবে। একটাও সেল্ফি তুলতে পারবি না অভিরূপের সাথে। লাইন ইজ ফুল ওফ পেইন।”

মেয়েটি নয়নতাঁরা। তার দেশে ফেরার কথা ছিল আরো আগে। কিন্তু সেদিন সে ফ্লাইট মিস করে এতো কিছুর মাঝে। হোটেলে অবস্থান নিয়েছিল সে লন্ডনে। তাই আজকের ফ্লাইটে দেশে ল্যান্ড করতে হলো তাকে। তারপর থেকে শুনছে আজকে নাকি অভিরূপ চৌধুরী আসবে। একমাত্র তার কন্ঠের গান শুনেই নয়নতাঁরা প্রসন্ন হয়। তার গানের মাধ্যমে সে নিজেকে এবং তার বহুকালের ক্রাশ রায়ানকে একসাথে কল্পনা করতে পারে। তাই এই মহান গায়কের সাথে একটা ছবি তোলা বা অটোগ্রাফ না নিলেই নয়। সেই আশায় ভোর থেকে এখানেই বসে ছিল সে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। এই ভীরের মধ্যে পড়লে সে নির্ঘাত এই লম্বা লম্বা হাতির মতো মেয়েগুলোর পায়ের নিচে পড়ে আ’হত হয়ে যাবে। নয়ত মুখমন্ডলই বদলে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। এমনিতেই সে আহামরি দেখতে ভালো না। ছোটখাটো অ্যাপেলের মতো। নয়নতাঁরা নিজের দুটো গালে হাত রেখে বলে,
“এমনিতেই আমি দেখতে ভালো না। মুখমন্ডল পাল্টে গেলে ইন্সপেক্টর রায়ান একটুও পছন্দ করবেন না আমায়।”

কথাটুকু আফসোসের সুরে বলল নয়নতাঁরা। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মাথা নিচু করতেই চোখের সামনে এসে পড়ল একঝাঁক চুলের মেলা। চোখমুখ কুঁচকে হাত দিয়ে চুল সরাতেই সামনের এয়ারপোর্টের সাথে যেই গ্যারেজ স্পেস আছে সেখান দিয়ে কংক্রিটের ছোট রাস্তায় চোখ পড়তেই মুখটা না চাইতেও হা হয়ে গেল তার। চোখমুখের রঙটায় বদলে গেল এক নিমিষে। ফ্যাকাশে হয়ে এলো মুখশ্রী। সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল একবার ভয়ে। চোখের পাতা ঘনঘন ফেলতে লাগল। অস্পষ্ট সুরে বলে উঠল,
“বিগ ব্রাদার!”

এবার কেঁদে উঠতে মন চাইলো নয়নতাঁরার। গলার ছোট্ট স্টাইল করে বেঁধে রাখা স্কার্ফটা তড়িঘড়ি করে খুলে মাথায় দিয়ে নিজেকে আড়াল করতে লাগল। আবারও চোরের মতো উঁকি দিয়ে সেই রাস্তার দিকে চাইলো। পুরুষটির মুখে মাস্ক। বেশ বড় বড় পায়ের ধাপ ফেলে তড়িঘড়ি করে নয়নতাঁরা যেখানে আছে সেদিকেই এগিয়ে আসছে অন্য একজনের সাথে ব্যস্ত ভাবে কথা বলতে বলতে। মুখে মাস্ক, মুখশ এমনকি চেহারা পাল্টে ফেললেও নিজের বিগ ব্রাদারকে চিনতে বিন্দুমাত্র ভুল করবে না নয়নতাঁরা। তার হাঁটার ভঙ্গি, মাঝে মাঝে হাত নাড়ানো সবই নয়নতাঁরা চিনে রেখেছে। র’ক্তের টান বলেও তো একটা বিষয় আছে। নয়নতাঁরা চোখ বড় বড় করে নিজমনে বলে উঠল,
“আমি ম’রার আগ অবধি এই ছেলেটা আমাকে জ্বালিয়ে যাবে। বাঁচতে চাইলে পালা নয়নতাঁরা।”

বলেই ফের এয়ারপোর্টে প্রবেশ করার গেট ধরে দৌড় দিল নয়নতাঁরা। তাকে আর পাওয়ায় যাবে না। কিছুতেই না।

সকাল সকালেও যে এতোটা ট্র্যাফিক জ্যামে আটকা পড়বে সেটা ভাবেনি রাগিনী। আজ উর্মিলার সাথে তার দেখা করার কথা। সেকারণেই সে বেরিয়েছে। ইতিমধ্যে দুবার কল দিয়ে ফেলেছে উর্মিলা। রাগিনীর জানা নেই আর কতবার কল রিসিভ করতে হবে। তার স্কাই ব্লু কালার ওড়না ঠিক করে বেঁধে রাখা চুলগুলো পেছনে সরিয়ে দিয়ে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে,
“সামনে কি কিছু হয়েছে চাচা? এতোক্ষণ লাগছে কেন?”

“মনে হইতেছে এক্সিডেন্ট হইছে কোনো।”

কিছুটা আঁতকে উঠল রাগিনী। আর বলল,
“কী? কোনো বড়সড় সমস্যা?”

“মনে তো হয় সমস্যাই হইছে কিছু একটা।”

রাগিনী নিরব হয়ে বসে রইল বেশ খানিকক্ষণ। মনটা টিকতে চাইলো না আর। তবুও যেন জোর করেই বসে রয়েছে। হঠাৎ করেই পাশের লাইনের ফুটপাতে চেনা পরিচিত কাউকে চোখে পড়ল রাগিনীর। তাড়াহুড়ো করে গাড়ির জানালার কাঁচ নামিয়ে হাত নাড়িয়ে একটু জোরে ডেকে ওঠে,
“ফাহমিদ!”

ফুটপাতের ভীরের মাঝে হেঁটে যাওয়া চশমা পড়া ছেলেটি মাথা উঁচিয়ে রাস্তায় থাকা রাগিনীর গাড়ির দিকে তাকালো। রাগিনীকে হাত নাড়াতে দেখে আশেপাশে তাকালো ফাহমিদ। বোঝার চেষ্টা করল রাগিনী কি তাকেই ডাকছে? আশেপাশে অন্যকাউকে থামতে না দেখে ফাহমিদ বোকাসোকা চাহনি নিয়ে রাগিনীর দিকে তাকিয়ে নিজের বুকে আঙ্গুল ঠেকিয়ে বলল,
“আমি?”

রাগিনী দ্রুত মাথা নাড়াতেই ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ফাহমিদ। রাগিনী তাকে দেখেই বেশ উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ভালো হয়েছে তোমার দেখা মিলল। সামনে থেকে আসছো? কী হয়েছে কিছু জানো?”

ফাহমিদ মাথা চুলকে আমতা আমতা করে বলল,
“আ…আমি..”

“ওহ হো ফাহমিদ! কথার স্পিড বাড়াও। এমন করছো যেন নিজেই ভয় পেয়ে গেছো।”

“ভয় তো পেয়েছিই। তুমি তো জানো আমার এসব দেখলে কতটা ভয় করে। কী ভয়ানক কান্ড! একটা গাড়ি ব্রেকফেল করে এক্সিডেন্ট করেছে। আর সেই গাড়ির ধা’ক্কা খেয়েছে একটা ছোট ছেলে। ছেলেটা অনেক গরীব। তাকে নিয়ে মাথাব্যথা নেই জানো তো! সবাই পড়েছে গাড়ির মধ্যে থাকা দুইটা বড়লোক ছেলেকে নিয়ে। এদিকে ছোট ছেলেটার মাথা ফে’টে র’ক্ত বেরিয়ে যা-তা অবস্থা।”

রাগিনীর চোখেমুখে উদ্বিগ্নের ছাপ দেখা গেল। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে তাড়াতাড়ি করে বলল,
“কোথায় ওই বাচ্চা ছেলেটা?”

ফাহমিদ কিছু বলার আগেই কোথা থেকে একটা ছেলে টলমল করতে করতে এসে ফুটপাতে পড়ে যেতে দেখতে পেল রাগিনী। নিজেকে থামাতে পারল না সে আর। ফুটপাত লাল হয়ে উঠছে ক্রমশ র’ক্তে। লোকজন জমা হয়েছে। সরব করতে শুরু করেছে কিন্তু কাজের কাজ করার বেলায় একেবারেই শূন্য। গাড়ি থেকে নামতেই ড্রাইভার রাগিনীকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,
“তুমি কোথায় যাইতেছো? তোমার তো র’ক্ত দেখে ভয় করে। ওইদিকে যেয়ো না মামনী!”

কে শোনো কার কথা! কথা গুলো বলার আগেই ভীর ঠেলে ছেলেটির নিকট চলে গিয়েছে রাগিনী। ড্রাইভার নামতে চাইলে ফাহমিদ তাকে মানা করে বিচলিত সুরে বলে,
“আমি দেখছি। আপনাকে নামতে হবে না।”

ছেলেটির কাছে হাঁটু গেঁড়ে বসেছে রাগিনী। র’ক্তের স্রোত বইছে যেন ছেলেটির মাথার কা’টা অংশ থেকে। তা দেখে ইতিমধ্যে রাগিনীর অবস্থা অন্যরকম হতে শুরু করেছে। হাত-পা কাঁপা শুরু করেছে। সে কিছু বলতে চেয়েও পারল না। উপায়ন্তর না পেয়ে নিজের ওড়নার কিছু অংশ ছেলেটার মাথায় চেপে ধরে বলল,
“কে…কেউ সাহায্য করো পি…প্লিজ! আমার গাড়ি অবধি রেখে আসুন।”

“তুমি উঠে দাঁড়াও। আমি ওকে কোলে নিচ্ছি।”

নির্লিপ্তভাবে বলা ফাহমিদের কন্ঠস্বরে আশ্বস্ত হলো রাগিনী। ফাহমিদ ছেলেটা বোকাসোকা। তবে অন্যদের মতো নয়। সাহায্য করতে তার কোনো দ্বিধা নেই। কিন্তু ঝামেলা একটু ভয় পায় এই আরকি। রাগিনী উঠে দাঁড়াতেই ছেলেটিকে দুহাতে তুলে নিল ফাহমিদ। তার শরীরও একটু ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল বটে। র’ক্তে মাখামাখি অবস্থা ছেলেটির। দুজন মিলে আস্তে করে ধরে নিয়ে গাড়ি অবধি গেল তারা। রাগিনী গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে বলল,
“ড্রাইভার চাচা! সিটি হসপিটাল যেতে হবে। তাড়াতাড়ি গাড়িটা চালাবে। বাচ্চা ছেলেটার অনেক ব্লি’ডিং হচ্ছে।”

ছেলেটাকে গাড়িতে আধো শোয়া করে রেখে রাগিনী উঠে বসল। ছেলেটার অন্যপাশে বসল ফাহমিদ। সে জানে রাগিনী একা এসব সামলে উঠতে পারবে না। তার সাহায্যের প্রয়োজন।

প্রায় আধঘন্টা হয়ে গিয়েছে। অভিরূপের আশপাশ থেকে লোকজনের সরগরম কমছে না। বাড়ছে তো বাড়ছেই। এবার গার্ড ডাকা হয়েছে। ভীড় কমানো হচ্ছে। অভিরূপ যেন এক গভীর সমুদ্রের মধ্যে পড়েছিল। নিশ্বাস নিতে পারছিল না এই ভীড়ে। এতো মানুষের মাঝ থেকে বেরিয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ল অভিরূপ। নোমান তড়তড় করে বলে উঠল,
“বেঁচে আছিস? আরো যা নিজ থেকে এগিয়ে ফ্যান ফলোয়ারস্ দের আশা মিটিয়ে দিতে। আর একটু হলে তোকেই হসপিটালাইজড করতে হতো।”

“এমনভাবে বলছিস কেন? ওরা এতো আশা নিয়ে এসেছে। পূরণ না করলে লেডিস্ দের ক্রাশ কীভাবে থাকব?”

অভিরূপের নির্লিপ্ত বানী শুনে নোমানের আর কিছু বলতে ইচ্ছে করল না। রায়ানের সাথে সাথে হাঁটা ধরল সে। গাড়ির কাছাকাছি যেতেই একটা সাদা রঙের দামী ব্র্যান্ডের গাড়ির দরজা খুলে দেওয়া হলো। অভিরূপকে রায়ান ইশারা করে গাড়িতে বসতে বলল। অভিরূপ গাড়ির মধ্যে ঢুকতে যাবে সেই মূহুর্তেই বিকট এক শব্দ হলো। আশেপাশের সবটা যেন নড়ে উঠল। সকলের অনুভূত হলো গরম একটা বাতাস। দাউদাউ করে জ্বলে ছারখার হয়ে গেল একটা কালো রঙের গাড়ি। তাপের চোটে মুখ ঢেকে নিল অভিরূপ। আশপাশে সকলের মধ্যে ছেয়ে গেল আতংক। কী করে এমন হলো? রায়ান নিজেকে সামলে পরিস্থিতি সামলাতে বলে উঠল,
“সবাই সতর্ক হও। আর মি. চৌধুরী! আই এম সরি ফর দ্যাট। আমাদের দেশে এসেই আপনার এমন বাজে এক্সপেরিয়েন্স হবে আমরা ভাবতে পারিনি। আসলে আপনি হয়ত জানেন যে আমাদের ঢাকায় একটা টে’রোরিস্ট টিমের আগমন হয়েছে। হতে পারে এটা তাদেরই কাজ। আমি জানি এটা আপনার মনে হতেই পারে যে আমরা এখানকার কেমন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছি তাহলে! হয়ত আমাদের আরো সতর্ক থাকা উচিত ছিল। উই আর সরি। আমরা কী যেতে পারি?”

অভিরূপ দাঁড়িয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। তৎক্ষনাৎ স্মিত হাসি দিয়ে বলল,
“এতো রচনা ভালো লাগে না আমার শুনতে। যা হয়েছে হয়ে গেছে। চোখের সামনে প্রথম ব্লা’স্ট দেখলাম। বেশ ইন্টারেস্টিং!”

রায়ান অবাক হলো আরো। ছেলেটার মনে বিন্দুমাত্র ভয় নেই? আশ্চর্য তো! রায়ান বিপরীতে একটা হাসি দিতেই এবার আরো বিকট শব্দ শোনা গেল। লোকজন ভয়ে ছোটাছুটি শুরু করল এবার। রায়ানের বুঝতে সময় লাগল না টে’রোরিস্ট টিমের উদ্দেশ্য আজ পুরো এয়ারপোর্ট ধ্বংস করার। সেই সঙ্গে অভিরূপকে শে’ষ করার প্ল্যানিং নিয়েই এরা আজকের কাজটা শুরু করেছে। তাড়াহুড়ো করে রায়ান অভিরূপ আর তার টিমের বাকিদের উদ্দেশ্যে বলল,
“গাড়িতে বসো। আর ড্রাইভার তুমি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাও এয়ারপোর্ট থেকে। কুইক!”

কথা শেষ হতে না হতেই রায়ানের পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে গেল একটা গু’লি। নিচু হলো রায়ান। গু’লি গিয়ে লাগল গাড়ির কাঁচে। ভেঙ্গে গেল গাড়ির কাঁচ। রায়ান ‘শিট’ বলতেই নিজের পেছনের পকেট থেকে রি’ভলবার বের করে তার টিমের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“বি রেডি!”

আত’ঙ্কবাদীর সবাই আড়াল থেকে গু’লি ছুঁড়ছে। রায়ান এবং সবাই মিলে একটা গাড়ির পেছনে গিয়ে লুকালো। অভিরূপকে বসানো হলো গাড়িতে। ড্রাইভার গাড়ি চালাতে শুরু করল। নোমানও এবার ভয় পেয়ে গেছে। অভিরূপের উদ্দেশ্যে শক্ত গলায় বলে উঠল,
“এইজন্যই! ঠিক এই কারণে আমি তোকে এখানে আসতে মানা করেছিলাম। দেখ এখন কী হচ্ছে!”

অভিরূপ গাড়ির সিটে ঠেস দিয়ে বেশ উত্তেজনার সাথে বলো উঠল,
“আরে চিল! দেখ না কেমন অ্যাডভেঞ্চার ফিলিং আসছে। আমার তো দারুণ লাগছে। গানও গাইতো ইচ্ছে করছে। তোর ইচ্ছে করছে না।”

এবার রেগেমেগে নোমান অভিরূপের গালে এক চাপড় দিয়ে বলল,
“নিকুচি করেছে তোর গানের। প্রাণে বেঁচে ফিরতে পারলে হয়।”

আচমকা গাড়ি থামালো ড্রাইভার। অতিরিক্ত ব্রেক নেওয়ার কারণে গাড়ির পেছনের সিটে বসে থাকা নোমান এবং অভিরূপ দুজনেই ভড়কে গেল। নোমান সোজা হয়ে বসে বলল,
“এখন কী সমস্যা ভাই! গাড়ি থামালে কেন?”

ড্রাইভার ভয়ে ভয়ে জবাব দিল,
“সামনে একটা বাচ্চা।”

অভিরূপ গাড়ি থেকে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করল। সামনে একটা বাচ্চা দাঁড়িয়ে কাঁদছে অনবরত। গোলা’গু’লিতে ভয় পেয়েছে বেশ। অভিরূপ বলল,
“আরে ওকে তো বাঁচানো দরকার।”

অভিরূপ তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে নামতে যায়। কিন্তু তার আগেই গাড়ির দিকে তাক করে গু’লি ছুঁড়তে এগিয়ে আসে হাতে রি’ভলবার ধরা কয়েকজন। অভিরূপের হাত টেনে ধরে নোমান। কড়া গলায় বলে,
“অভিরূপ, তুই নামবি না। তুই নামলে বেঁচে কিন্তু ফিরতে পারবি না।”

অভিরূপ হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। আর কঠিন সুরে বলে,
“বাচ্চাটার জীবনেরও তো দাম আছে।”

নোমান হাত ছাড়ে না তবুও। অভিরূপ খেয়াল করে একটা অল্পবয়সী মেয়েকে। যেই মেয়ে বাচ্চাটিকে আগলে ধরল বেশ সাহসের সাথে। তার সাহস দেখে অবাক হলো অভিরূপ। চোখমুখ ছলকে উঠল তার। মাথাটা জানালার বাহিরে বের করে আরো মনোযোগের সহিত চেয়ে দেখতে লাগল মেয়েটির অঙ্গিভঙ্গি। তার মুখের অর্ধেকাংশে কাপড় জড়িয়ে রাখা। তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরতে চেয়ে কাপড়টা মুখ থেকে নিচে নেমে যায়। দৃশ্যমান হয় এক মায়াবী মুখের। অস্থিরতা ছড়ানো সেই মুখে। ভয়ে ভয়ে আশেপাশে তাকিয়ে অন্যহাতে আবারও মুখে কাপড় জড়াতে চাওয়ার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অভিরূপের অপলক দৃষ্টি সরতেই চাইছে না আর। আঁটকে গেছে সেই অস্থির মুখে।

চলবে…

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২২

অভিরূপ শুনেছিল অধিকাংশ মানুষ নাকি রূপ থেকে প্রেমের পড়ে। কিন্তু সে তো গাড়ির সামনে থাকা সেই নারীটির সাহসের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। সেই টান টান চেহারায় অভিরূপের চোখে পড়ল না কোনোরকম ভয়। সেই চোখে ছিল না কোনো ভয়মাখা দৃষ্টি। তবে ছিল এক ধরনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেই দৃষ্টিতে অভিরূপ হারিয়ে গেছিল এক অতল গভীরে। অতিরিক্ত সরব, চেঁচামেচি, গো’লাগু’লিতে এবার চকিতে তাকায় অভিরূপ। এক নতুন টিমের আবির্ভাব হয়েছে। তারা একনাগাড়ে নিজের রিভ’লবার চালিয়ে প্রতিহত করতে ব্যস্ত। হয়তবা পুলিশেরই কোনো লোক হবে। আচমকায় অভিরূপের কানের ঠিক উপরে অনেকটা নিকট দিয়ে চলে গেল একটা তীব্র গু’লি। একটুর জন্য তা এসে লাগল না অভিরূপের কপালে। তৎক্ষনাৎ নোমান তার হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে ভেতরে নিয়ে এলো। রাগে কটমট করে বলে উঠল,
“তুই দিনকে দিন এমন জ্ঞান হয়ে যাচ্ছিস কেন অভিরূপ! এক্ষুনি কী হতো জানিস? পাগল হয়ে গিয়েছিস নাকি?”

অভিরূপের মধ্যে কোনো রকম হেলদোল দেখা গেল না। ডোন্ট কেয়ার ভাবটা জারি রেখে বলল,
“হতে গিয়েছিল। হয়নি তো। জাস্ট চিল! আমাকে যদি সৃষ্টিকর্তা বাঁচিয়ে রাখতে চায় তাহলে আমি বাঘের খাদ্য হয়েও বাঘের পেটের মধ্যে গিয়েও বেঁচে ফিরে আসব সুইটহার্ট!”

বলেই অভিরূপ নোমানের দাড়ি ভর্তি গালে হাত দিয়ে টানতে গেল। নোমান হাতটা সরিয়ে রাগের ভাবটা নিয়েই বলল,
“ডোন্ট কল মি সুইটহার্ট। গালে হাতও দিবি না খবরদার। এতো কিছুর মাঝে তুই এখনো শান্ত আছিস কীভাবে? তোর চিন্তা হচ্ছে না যে বেঁচে ফিরতে পারব কিনা?”

“তোর দাড়িওয়ালা গালে আমার এমনিতেও হাত দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না। অতি আবেগে হাত দিয়ে ফেলেছি। বাই দ্যা ওয়ে, ওই মেয়েটা…”

কথা অসম্পূর্ণ রেখে সামনের কাঁচ দিয়ে বাহিরের দিকে দেখার চেষ্টা করল অভিরূপ। তার উৎসুক চোখ খুঁজে বেরোলো যেই সাহসে ভরা নেত্রপল্লবকে। পেল না। সামনে মেয়েটির কোনো চিহ্ন নেই। আর না আছে সেই বাচ্চাটি। অভিরূপ কিছুটা বিস্মিত হলো। এটা মেয়ে নাকি ম্যাজিশিয়ান? এতো দ্রুত কীভাবে গায়েব হতে পারে? তখনি নোমান ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলল,
“গাড়ি স্টার্ট করুন। তাড়াতাড়ি এখান থেকে বের হতে চাই আমরা।”

ড্রাইভার নোমানের কথা অনুযায়ী গাড়ি স্টার্ট দেয়। কিন্তু গাড়ি একটুও এগোয় না। কেমন যেন নড়েচড়ে ওঠে। নোমান বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“হলো টা কী?”

“মনে হয় ওরা গাড়ির চাকায় গু’লি করেছে। তাহলে গাড়ি তো চলবে না।”

নোমানের রাগ হয়। এ কোথায় ফেঁসে গেল? আদেও এখান থেকে বের হতে পারবে? নাকি এখানেই প্রা’ণত্যাগ করতে হবে? সব দোষ তার সঙ্গে থাকা এই অভিরূপের। নোমানের এই মূহুর্তে খুব ঝাড়তে ইচ্ছে করছে তাকে। কিন্তু নিজের রাগ দমিয়ে নিরবই থাকল সে। বাহিরের আওয়াজ কিছুটা কমেছে। হয়ত পুলিশ টিম ধীরে ধীরে সব সামলে নিচ্ছে। একটুখানি হলেও নিশ্চিন্ত হয় নোমান।

রায়ানের টিমের বাকি সকলে ব্যস্ত টেরো’রিস্ট টিমকে প্রতিহত করতে। রায়ান এক লাল গাড়ির আড়ালে বসে কাতরাচ্ছে। প্যান্ট ছেদ করে একটা গু’লি ঘেঁষে বেরিয়ে গেছে। ডান পা র’ক্তে ভিজে গেছে। নিচেও ছড়িয়ে পড়েছে র’ক্ত। নিজের পা নিয়ে নড়তেও পারছে না সে। চোখ বন্ধ করে গাড়ির সাথে ঠেস লাগিয়ে বসল সে। কেমন যেন নিস্তেজ লাগছে নিজেকে। হঠাৎ করে নিজের পাশে অন্য অস্তিত্বের উপস্থিতি পেলো রায়ান। টের পেলো কেউ তার কাছেই এসেছে। অন্যরকম সুভাস ছড়ালো হাওয়ায়। আবার কোনো আত’ঙ্কবাদী দলের লোক নয় তো? হতেই পারে। এছাড়া কেউ তো আসার সম্ভবনা নেই। চোখ বুঁজেই নিজের কাছে থাকা রি’ভলবার হাতালো রায়ান। হাত দিয়ে ধরতেই চোখ মেলে তাকিয়ে সোজা হয়ে বসে রি’ভলবার তাক করল ঠিক তার ডানপাশে। দৃশ্যমান হয় এক মেয়ের শুঁকনো চোখমুখ। রি’ভলবার তার দিকে তাক করতে দেখে চেহারার রঙ আরো পাল্টে যায় মেয়েটির। সেকেন্ডে সেকেন্ডে একবার এই ভয়া’নক অ’স্ত্রের দিকে তাকায় তো একবার রায়ানের দিকে। তারপর আর কোনো কিছু না ভেবে চোখমুখ খিঁচে একটা চিৎকার লাগায় সে। রায়ান ধড়ফড়িয়ে ওঠে। বুঝতে পারে মেয়েটা কোনো ষড়যন্ত্রকারী নয়। হয়ত লুকানোর উদ্দেশ্যে এই জায়গায় বেছে নিয়েছে। কিন্তু তাকে এই মূহুর্তে থামানো দরকার। সে হম্বিতম্বি করে বলে ওঠে,
“স্টপ প্লিজ, স্টপ। চিৎকার করবেন না।”

মেয়েটির চিৎকার থামে না। কোনোদিক না তাকিয়ে নিজের চিৎকারে যেন গভীর মনোযোগ দিয়েছে সে। আর কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে সে জোরে বলে ওঠে,
“আপনি চুপ না করলে হা করে চিৎকার করার জন্য মুখের ভেতরে রি’ভলবারের যে কয়টা গু’লি অবশিষ্ট রয়েছে সব ঢুকিয়ে দেব। ফর গড সেক, চুপ করুন।”

মেয়েটি হেঁচকি তুলে পরক্ষণেই থেমে যায়। সে ভেবেছিল রায়ান তাকে আ’তঙ্কবাদীর দলের লোক ভেবে আজকে উপরে পাঠিয়েই ছাড়বে। সে মিনতি করে বলে উঠল,
“আমি কিছু করিনি। আমি তো শুধু লুকিয়েছিলাম। আচ্ছা আপনি তো ইন্সপেক্টর রায়ান! তাই না?”

বলেই মেয়েটি খুব উৎসুকের সাথে তাকিয়ে রয় রায়ানের মুখের দিকে। রায়ানের অস্বস্তি বোধ হয় মেয়েটির এমন চাহনিতে। ছোট ছোট চোখে নিষ্পলক ভঙ্গিতে তাকিয়ে রয়েছে সে। সে নড়েচড়ে বলে,
“হ্যাঁ কিন্তু আপনি আমাকে কীভাবে চিনলেন?”

মেয়েটি এক ঝলক হেঁসে আগ্রহের সাথে বলে ওঠে,
“আ…আমি নয়ন। মানে নয়নতাঁরা। আমি নয়নতাঁরা। আমাকে চিনতে পেরেছেন?”

রায়ান ভ্রু কুঁচকালো এবার। চেনার চেষ্টা করল। মুখশ্রী তো অচেনা। সে ভেবেও পাচ্ছে না এই সিচুয়েশনে একটা মেয়ে কীভাবে নিজেকে ইন্ট্রডিউস করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে? নয়নতাঁরার মুখটা এবার ভার হয়। লোকটা কী এতো ভাবছে? সে কী তাকে চিনতে পারেনি? নয়নতাঁরার খেয়ালে আসে রায়ানের র’ক্তাক্ত পা। তড়িঘড়ি করে সে বলে ওঠে,
“আরে আপনার পায়ে কী হয়েছে? দেখি!”

এবার গু’লির শব্দে রায়ান ও নয়নতাঁরা দুজনেই চমকে ওঠে। নয়নতাঁরা চিৎকার দিয়ে উঠে নিজের কান চেপে ধরে। রায়ান এবার কোনোরকমে উঠে দাঁড়ায়। হাতে রি’ভলবার নিয়ে তাক করে বেশ কয়েকটা গু’লি ছুঁড়তে থাকে একাধারে। তা দেখে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে নয়নতাঁরা। তার হাতে টান পড়ে। রায়ান তার হাত ধরে বলে,
“এখানে এভাবে ভয়ে জড়ো হয়ে থাকলে ওরাই আপনার চিৎকারে গু’লি একাধারে আপনার মুখে পুড়ে দেবে মিস। আমার সাথে চলুন বাঁচতে চাইলে।”

নয়নতাঁরা উঠে দাঁড়াতেই আবারও বিকট শব্দ হয়। দুজনে দ্রুত মাথা নিচু করে চলে আসে। দুজন অন্য গাড়ির আড়ালে দাঁড়ায়। আঙ্গুল উঁচিয়ে রায়ান আর উদ্দেশ্যে বলে,
“লিসেন, যতই শব্দ হক মুখে তালা দিয়ে রাখবেন। আর এখান থেকে বের হওয়ার চিন্তাও মাথাতে আনবেন না।”

কথাটুকু শেষ করে আর দেরি করে না রায়ান। নয়নতাঁরা কিছু বলার আগেই সে সেখান থেকে প্রস্থান করে। নয়নতাঁরা ভার মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। সেও বাহিরে যেতে চায়। কিন্তু রায়ান তো তাকে মানা করে দিয়েছে। দুটো হাত মুঠো করে বলে,
“ধুর! ভালো করে কথাও বলতে পারলাম না। উনার কতটা লেগেছে। র’ক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। তবুও থামার নাম নেই। ইশশ…!”

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে নিজের রি’ভলবার তাক করে দুইজনকে মে’রেছে রায়ান। তার রি’ভলবারে অবশিষ্ট নেই কোনো গু’লি। তাই সেটা ছুঁড়ে মারল একজনের মাথায়। পেছন থেকে অন্যজন তেড়ে এলো ধারা’লো ছুরি নিয়ে। রায়ান ঘুরে তার সঙ্গে হাতাহাতি করতে গিয়ে পড়ে গেল। এই পা নিয়ে আর উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পেলো না। সেই ছুরি দ্বারা রায়ানকে প্র’তিহত করার চেষ্টায় ধেয়ে আসে টে’রোরিস্ট টিমের একজন। রায়ানের মনে হয় এটাই কী তার শেষ? তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। রায়ান দেখে কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই ছুরিটার ধা’রালো অংশ শক্ত করে হাতের মুঠোয় ধরে আছে। হাত বেয়ে টুপটুপ করে পড়ে যাচ্ছে তাজা র’ক্ত। ডার্ক ব্লু কোট পরিহিত লোকটি রি’ভলবার তাক করে একে একে দুইবার ট্রিগারে চাপ দিতেই নিস্তেজ হয়ে পড়ল সামনে থাকা সেই লোকটি। ঘাড় ঘুরিয়ে রায়ানের দিকে দৃষ্টিপাত করল সে। স্মিত হেঁসে বলল,
“ইন্সপেক্টর রায়ান! আমি বলেছিলাম আপনি একা পারবেন না।”

রায়ান ওঠার চেষ্টা করে। আর বলে,
“অফিসার নির্জন! আপনি এখানে?”

নির্জন হাত বাড়িয়ে দেয় রায়ানের দিকে। রায়ান না চেয়েও হাতটা ধরে উঠে দাঁড়ায়। নির্জন রি’ভলবার নিজের পকেটে ঢুকিয়ে জবাব দেয়,
“আমি না এলে আপনাকে প্রাণে কে বাঁচাতো বলুন তো? আপনার আমাকে থ্যাংকস বলা উচিত।”

বলে থামে নির্জন। নিচে তাকিয়ে রায়ানের পা পর্যবেক্ষণ করে বলে,
“সিচুয়েশনে অনেকটা কন্ট্রোলে এসেছে। আপনি আমার সঙ্গে হসপিটাল চলুন কুইক! ব্লিডিং হচ্ছে। এজ অ্যা অফিসার, আমার দায়িত্ব আমার অন্য টিমের সদস্যকে সাহায্য করা।”

রায়ান প্রথমে রাজি হয় না। কিন্তু পায়ের অবস্থা বেগতিক হওয়ায় নির্জন মেহরাজকে ডেকে এম্বুলেন্সের সাহায্যে রায়ানকে সিটি হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়। আড়াল থেকে সবটা দেখে নয়নতাঁরা নিজে। কিন্তু আফসোস একটাই! সে বের হতে পারে না। যেতে চেয়েও যেতে পারে না।

সবটা শান্ত হবার পর নির্জন মেহরাজের উদ্দেশ্যে বলে,
“মেহরাজ, আরো যারা যারা আহত হয়েছে আমাদের টিমের সবাইকে হসপিটালাইজড করার ব্যবস্থা করো। আর যারা আটকা পড়েছে তাদেরকে কাস্টারিতে রাখার ব্যবস্থা করো। দেখো দেখো কে কে বেঁচে আছে। আর অভিরূপ চৌধুরী কী এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পেরেছে?”

মেহরাজ দ্রুত মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,
“ইয়েস স্যার। অভিরূপ চৌধুরী সহ তার বন্ধু সেফলি অন্য গাড়ি নিয়ে হোটেলের দিলে রওনা দিয়েছে।”

“তাহলে আমাদের গাড়িও বের করো। আমিও সিটি হসপিটাল যেতে চাই।”

“ইন্সপেক্টর রায়ানকে দেখতে?”

উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করে মেহরাজ। নির্জন অটল থেকে বলে,
“গো ফাস্ট, মেহরাজ।”

মেহরাম তবুও যায় না। আবারও জিজ্ঞেস করে,
“স্যার, যার সঙ্গে আপনার এতো রেষারেষি। যার সাথে আপনার একটুও বনে না। তাকে নিয়ে আপনি টেনশনও করেন কেন স্যার? কাল যখন ইন্সপেক্টর রায়ানের গাড়ির ব্লা’স্ট হওয়ার খবরটা পেলেন সব ছেড়ে আপনি রায়ানের কাছে উপস্থিত হলেন। আপনাকে বোঝা খুব মুশকিল।”

“তাহলে বোঝার চেষ্টা করে নিজের মস্তিষ্ক আরো খারাপ কেন করছো। যাও আর গাড়ি বের করো।”

এবার দাঁতে দাঁত চেপে বলল নির্জন। মেহরাজ থতমত খেয়ে বলল,
“ই…ইয়েস স্যার।”

হসপিটালের রিসেপশনে অস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে রাগিনী। চোখেমুখে উদ্বিগ্নতা। মাথায় আ’ঘাত পাওয়া বাচ্চা ছেলেটির জন্য মনে এক রাশ বিষণ্ণতা। সবকিছু মিলিয়ে সে হসপিটালের ফর্মালিটি পূরণ করতে এসেছে। রিসেপশনিস্ট তাকে জিজ্ঞেস করে,
“ম্যাম, পেশেন্টের নাম?”

রাগিনীর মুখটা আরো চুপসে যায়। সে কী করে বলবে ছেলেটির নাম? সে তো তাকে রাস্তায় অজ্ঞান অবস্থায় পেয়েছে। তবুও নিজেকে ধাতস্থ করে উত্তর দিল,
“আমি তো জানি না ঠিক। আসলে তাকে আমি এক্সিডেন্টলি পেয়েছি। আই মিন রাস্তায় সেন্সলেস অবস্থায়।”

“আচ্ছা পেশেন্টে এজ কত?”

রাগিনী একটু ভেবে উত্তর দেয়,
“দশ বছর মতো!”

রিসেপশনিস্ট মাথা নাড়িয়ে তা কাগজে লিখে। রাগিনী বলে,
“যত টাকা লাগবে আমায় বলবেন। আমি ব্যবস্থা করব। কিন্তু ছেলেটির টেক কেয়ারের কোনো কমতি রাখবেন না প্লিজ!”

“ডোন্ট ওয়ারি ম্যাম।”

রাগিনী আরো কিছু বলতে যাবে তার আগে তার কানে এক পরিচিত কন্ঠস্বর পৌঁছালো। থমকে গেল সে। এই গম্ভীর গলা তার অতি পরিচিত। তার পাশ কাটিয়ে এক লম্বাটে পুরুষ হেঁটে চলে গেল। সে বলছিল,
“ইন্সপেক্টর রায়ানের সব ফর্মালিটিস্ পূরণ হয়েছে? কেমন আছেন উনি এখন?”

রাগিনী তড়িঘড়ি করে পেছন ফিরে তাকায়। বেশ কয়েকজন লোককে লিফটে উঠতে দেখল। কিন্তু মুখটা দেখতে পেল না রাগিনী। বিরবির করে বলে উঠল,
“মনে হলো কোহিনূর আমার পাশ কাটিয়ে গেলেন!”

চলবে…