গোধূলি রাঙা আলোয় পর্ব-১০

0
321

#গোধূলি_রাঙা_আলোয়
#পর্ব_১০

“আতিয়া, বয় তোর সাথে দুই মিনিট কথা আছে।”

“আম্মা, ডিউটির সময় হইছে। কী বলবা? বাজারের টাকা রাতে এসে দিব।”

“তোর খালি মনে হয় আমি তোকে টাকার জন্য আওয়াজ দেই শুধু! এইখানেই আসলে মহিলা আর পুরুষের পার্থক্য। পুরুষ কামাই করে রাজা হয়, আর দুই হাতে খরচ করে। পয়সার হিসাব নেয় না। আর মহিলা কামাই করলে হয় *শ্যা। পাই পয়সার হিসাব চায়। কদ্দূর দিলো, কদ্দূর পাইলো!”

“ছিঃ! কথার ছিরি দেখ তোমার। আমারে বে** বল্লা!”

“তোরে বললাম কই! এটা তো কথার কথা।।
তোর গায়ে টানোস ক্যান! কিন্তু এটা তো সত্য যে তুই সংসারে দুইটা টাকা দিয়া এমন ভাব নেস যেন তোর দয়ায় চলি। আমার চার ছেলেমেয়ের মাঝে সবচেয়ে বেশি খরচ তোর জন্য করছি। পড়াইছি, বিয়া দিছি, বিধবা হইয়া আসার পর চার বছর বসে বসে খাওয়াইছি। তোর এই চাকরিও তোর বাপের জন্য পাইছস। সে হয়তো ভাবছে সে মরে গেলে তুই সবাইরে দেখবি। তোর বাপ বেঁচে থাকতে আমার দিন আলাদা ছিল। তখন বুঝি নাই কোনদিন এমন সময়ও আসবো। এইজন্য মানুষ মাইয়ার কামাই খাইতে চায় না। আমার কপাল খারাপ যে তোর জন্মের পর দুইটা পোলা হইয়া মারা গেল। আশিকটার বয়স কম। বাকি সবারই তোর থেকে বয়স কম। আইজ তুই বড়ো না হইয়া আশিক বড়ো হইলে আমার এসব কথা বলা লাগতো না। সে নিজেই বুঝতো। বোনদের বিয়া দেওয়ার আগে, একটা ছোটো ভাই থাকলে তার গতি করার আগে নিজের কথা ভাবতো না। এই সংসারে বহু পুরুষ আছে যারা ভাইবোন, বাপ মারে দেখতে গিয়া আর বিয়াশাদী করে নাই। তারা দুঃখী না। ভাইবোন, মা বাপের জন্য করতে পাইরা তারা সুখী। এই সুখ আল্লাহ সবার কপালে দেয় না। দিলেও সবাই কদর করতে জানে না। খালি নিজেরটা ভাবে।”

আতিয়া বাসে ওঠার জন্য কাঁটাবন সিগন্যালে দাঁড়িয়ে আছে। বাস এগিয়ে আসছে। আজ শনিবার ভীড় কম। ধাক্কাধাক্কি নেই। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় আতিয়া তাবিজটা বাইরে ছুঁড়ে মারে। যেই তাবিজটা জমিলা সিস্টার দিয়েছিল, আতিয়ার বিয়ে না হওয়ার ফাঁড়া কেটে যাওয়ার জন্য!

আলোর মনটা ফুরফুরে। রাতুলের সাথে ভালোই মজা করেছে। রাতুলের এক হাজার টাকা ফিরিয়ে দেওয়ায় যে রাতুল খুশি হয়েছে তা বোঝে আলো। যদিও শুরুতে নিতে চায়নি, ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল। পরে নিয়ে পকেটে ঢুকায় রাতুল। সনি সিনেমা হলে একটা সিনেমাও দেখেছে তারা। অন্ধকার হলের সুযোগ নিয়ে রাতুল একটু দুষ্টুমিও করেছে। আলো লজ্জা পেলেও মানা করেনি। প্রেম করতে গেলে এসব নাকি চলে। ওর বান্ধবীরাই বলেছে। তাছাড়া আজ নয়তো কাল ওদের বিয়ে হবেই। তাই সংকোচ থাকলেও রাতুলকে মানা করতে পারেনি।

মিসবাহ, হামিদ, হাসান তিন ভাই। বোন মোনা, হাসানের বড়ো আর হেলেন সবার ছোটো। মেজোভাই হামিদ নিজের চাকরিবাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। হাসানকে চাকরিতে ঢোকানোর চেষ্টা করছে মিসবাহ। আপাততঃ হাসান মুক্ত পাখি। সংসারের দায়িত্ব, কর্মের চাপ কিছুই নেই। মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে। ফাঁকে ফাঁকে বড়ো ভাইয়ের দোকানে বসে। অন্য সময় ক্লাস আর বন্ধুদের আড্ডায় সময় কাটে। মা জাহানারার সাথে হৃদ্যতা, সখ্যতা থাকলেও হাসান বা হামিদ কেউ মিসবাহ আর ছোটো বোন হেলেনের মতো নয়। মানে সবকাজে মায়ের অনুমতি নেওয়া, মাকে জানিয়ে সব কাজ করার মতো ছেলেমেয়ে তারা নয়। মায়ের কাছে বেশি আদরের ছেলে তাই মিসবাহ আর ছোটো মেয়ে হেলেন। হাসান আর হামিদের মতো বোন মোনাও নিজের মতো থাকে। আজ তাই জাহানারা হাসানকে জরুরি তলব করায় হাসান অবাকই হয়। বাইরে থেকে ফিরে হাতমুখ ধুয়েই মায়ের রুমে যায় না হাসান। বরং ভাইজি, ভাতিজার সাথে খেলে। তারপর আস্তে ধীরে গিয়ে কিছুক্ষণ গল্প করে। আজও তাই করছিল। তখন হামিদের স্ত্রী রত্না আসে ছোটো মেয়ে পরীকে কোলে নিয়ে।

“হাসান, আম্মা তোমারে সেই সন্ধ্যা থেইক্কা খোঁজ করে। ফোন ধরো না ক্যান বাইরে থাকলে?”

“ফোনে সমস্যা করতেছে। হাত থেকে পড়ে গিয়ে ডিসপ্লে গেল। ফোন রিসিভ হয় না। কী হয়েছে ভাবী? কোন সমস্যা?”

“কী হয়েছে সেটা কী আমাকে বলবে আম্মা! আমি তো মোনা আপা বা হেলেন না। আমি হলাম তার অপছন্দের ছেলের অপছন্দের বৌ।”

ভাবীর কথায় অবাক হয় না হাসান। রত্না ভাবী সহজ করে কোন উত্তর দিতে পারেন না। কথার ভাষা মুহুর্তে পরিবর্তন করেন। এই এখানে এমন কথা বললেন। আবার শাশুড়ির সামনে গেলে আরেক রকম হবে। স্বামীর সামনে আরেক রকম। ভাবীকে না ঘাটানোই উত্তম। ভাতিজা পরশ আর ভাতিজি পলিনকে বলে,
“চাচ্চু, তোমরা কিন্তু গুটি পাল্টাবে না। আমি এসে আবার খেলবো ছক্কা।”

হাসান বের হয়ে যেতেই পরশকে ধমকে নিয়ে যায় রত্না। পলিনের সাথে পরশ বা পরীর বেশি মাখামাখি তার ভালো লাগে না। মা ভালো না যে মেয়ের, তার সাথে নিজের বাচ্চাদের বেশি মিশতে দিতে নেই। তাছাড়া পলিন, পরশ আর পরীর আদরে ভাগ বসাচ্ছে। পলিনের মায়ের সাথে পলিনকে পাঠিয়ে দিলে কী হতো! উল্টো সবাই যেন বেশি বেশি আহ্লাদ করে। ভাসুর মিসবাহ তো পারলে বাসাকেই খেলনার দোকান বানিয়ে ফেলেন। অথচ যত দিচ্ছে মেয়ে তত ত্যাড়া হচ্ছে। রোজ নতুন নতুন আব্দার। শাশুড়িও মানা করে না। বরং পরশ আর পরীর জন্য খেলনা না কিনে পলিনের পুরনোগুলোই দিতে বলেন।
কেন! তার ছেলেমেয়ে কি রাস্তার ছেলেমেয়ে যে অন্য বাচ্চা যেগুলো আর খেলবে না সেসব দিয়ে খেলতে হবে! পলিনের কোন খেলনা তাই ছেলেমেয়েকে ছুঁতে দেয় না রত্না। কিন্তু রোজ সন্ধ্যায় হাসান এসে সব বাচ্চাদের নিয়ে হইচই বসায়। দেবরকে কিছু বলতেও পারে না। ছোটো মেয়েকে তাও খাওয়ানোর বাহানা দিয়ে মাঝেমাঝে নিয়ে যান। ছেলেকে তো নিতে পারে না। ভাবছে এই সময় পরশের জন্য একজন মাস্টার রেখে দেবে। পড়ানোর বাহানায় এই রোজকার মাতামাতি বন্ধ হবে। যদিও পাঁচ বছরের ছেলের জন্য মাস্টার রাখতে দিতে শাশুড়ি রাজি হবেন কিনা কে জানে। স্বামী হামিদকে বলেই ম্যানেজ করতে হবে।

সবাই চলে গেলে একা বসে থাকে পলিন। চাচী যে ইচ্ছে করে পরশকে নিয়ে গেল বোঝে পলিন। ওর রাগ লাগে চাচীর উপর। কিন্তু পরশ মায়ের উপর রাগ করে না। এই যে এখন ওকে নিয়ে গেল, ওর মন খারাপ হলো ঠিকই। কিন্তু ওর মা ওকে রুমে নিয়ে এত আদর করবে যে পরশ মন খারাপ ভুলেই যাবে। পলিন কেন ভুলতে পারে না! সবাই ভাবে ও শুধু শুধু জিদ করে, রাগ করে। কিন্তু রাগ ভাঙাতে তো কেউ জানে না! ছোটো চাচ্চু একটু আদর করেন ঠিক। কিন্তু সারাদিন বাসায় থাকেন না। বাবাকে পলিন পায় খুবই অল্প সময়। সেসময়ও বাবা শুধু ভারী ভারী কথা বলে। পড়তে বলে। ক্লাসের রেজাল্ট খারাপ কেন তাই জন্য বকে। এখন তো টিচারও রেখেছে। দাদী বাসার কাজ কর্ম নিয়ে চাচীর সাথে ব্যস্ত থাকে। স্কুলেও পলিনের বন্ধু কেউ নেই। ওর আম্মু নাকি খারাপ। তাই অন্য মেয়েদের আম্মুরা ওর সাথে মিশতে মানা করে দিয়েছে। সবাই বলে ওর আম্মু খারাপ। পলিন এই আটবছরে ওর আম্মুকে কখনো দেখেনি। তবে জানে ওর আম্মু আসলেই খারাপ। না হলে এতদিনেও ওকে কখনো দেখতে আসেনি! পলিনের আবার রাগ ওঠে। লুডু খেলার বোর্ডটা ছিঁড়ে কুচিকুচি করে ফেলে পলিন।

“আম্মা, ডাকছেন?”

“হ। তোরে ফোনেও পাই না। বাসায় আসলেও মায়ের রুমে একটা উঁকি মারোস না। একটা তো বিয়া কইরা বৌ আইনা মারে ভুইল্লা গেছে। তুই তো বিয়ার আগেই ভুলছস। যা বড়োছেলেটা আমার ছিল। সেটারও মাথা খারাপ করার ফন্দি করছস।”

“আম্মা, কোন সমস্যা? কী হইছে?”

“তুই তোর কোন বন্ধুর বিধবা বইনের সাথে মিসবাহর বিয়া দিতে চাস? তোর এত বড়ো সাহস? আমি থাকতে তুই ভাইয়ের বিয়া দিবি? আমি কি মইরা গেছি!”

“কী বলেন এসব! আমি খালি জিজ্ঞেস করছি ভাইয়ার ইচ্ছে আছে নাকি। থাকলে আপনাকে জানাতাম। তারপর তো সব সিদ্ধান্ত আপনার।”

“আমার সিদ্ধান্ত এখনি শোন। না না না। আমি কোন দুইবার জামাই খাওয়া অপয়া মেয়ের সাথে মিসবাহর বিয়া দিমু না। আমি সব খোঁজ নিছি। পেটের বাচ্চা, জামাই সব খাইছে। আরেক পোলার লগে বিয়া ঠিক হইছিল সে পোলাও হুদাই মরছে। সুস্থ বাপটাও মরছে ধুম কইরা। এখন মাইয়া করে নার্সের চাকরি। বয়সও হইছে মেলা। তুই দুনিয়াতে আর মাইয়া পাস নাই? শোন মিসবাহর বিয়া আমি দিমু। দেখেশুনে দিমু। মরলে না হলে তোর বাপরে কী জবাব দিমু! সে আমারে কইবো না, জাহানারা আমার পোলা মাইয়াগো বিয়া তুমি দেখে দিতে পারলা না!”

“এই প্রশ্ন আব্বা এমনিও করবে আম্মা। কারণ সবার বিয়েই দিয়েছেন। ভালো কোনটা হয়েছে? মিসবাহ ভাইয়ের প্রথম বিয়ে আপনি দেন নাই? রত্না ভাবীকে নিজে পছন্দ করে আনছেন। এখন ভাবীর বেয়াদবি আর তর্কের জন্য হামিদ ভাইয়ের উপর রাগ দেখান। বেচারা নিরীহ লোক। না বৌকে শাসন করতে পারে, না মাকে। মাঝে নিজে যাঁতাকলে পিষে। মোনা আপা কেন আপনার উপর রাগ? এত করে পড়তে চাইলো শুনলেন না। এইচএসসি পাশ না করতে এত ভালো ছাত্রীর বিয়ে দিয়ে দিলেন। শ্বশুর বাড়ির চৌদ্দগুষ্ঠী সামলে আপার আর লেখাপড়া হলো না। হেলেনটা ভালো আছে কারণ হেলেন এই ছেলে নিজে পছন্দ করছে। বুদ্ধিমান মেয়ে, বুঝেছে লেখাপড়া ওর ঘিলুতে ঢুকবে না। আর আপনার ভরসায় থাকলে বিয়ে হবে মার্কামারা। সুন্দরী হওয়ায় কাজের কাজ এটাই হয়েছে যে ভালে পরিবারের একটা ছেলে পটাতে পারছে। সেই জামাই নিয়ে আপনারই কী আদিখ্যেতা।”

“হাসান তুই একটা বেয়াদব হইতেছস দিনকে দিন। প্রেম করতাছস না? মাইয়া কে? তোর বন্ধুর আরেকটা বইন নাকি? পট্টি পড়াইতেছে তোরে। হাভাইত্তা বন্ধুর আর তার বইনেরা তোরে জাদু করছে।”

“আশিকের বড়ো বোনকে আমি জীবনে একবার দেখছি। ছোটো বোনকে আজ পর্যন্ত দেখি নাই তবে বাচ্চা মেয়ে। মেজো বোনের বিয়েও হয়ে গিয়েছে। ওদের অবস্থা একসময় ভালো ছিল আম্মা। বাবা মারা যাওয়ায় এখন একটু খারাপ আছে ঠিক। কিন্তু বোনদের দিয়ে খারাপ পট্টি পড়ানোর দরকার নাই। নার্সের চাকরি খারাপ পেশা তো না। আর পয়া অপয়া এসব কুসংস্কার। বয়সেও মিসবাহ ভাইয়ের চেয়ে পাঁচ বছরের ছোটো আছে। আর আশিকও ভালো ছেলে।।আজ না হয় কাল তার ভালো চাকরি হবে। কারও কাছে হাত পাতার চেয়ে ভাইয়ার দোকানে কাজ করে কামাই করে। এরা সম্মান পাওয়ার যোগ্য। অসম্মান না।”

হাসান রুম থেকে বের হয়ে গেলেও জাহানারা শান্ত হোন না। হাসান যাই বলুক। এমন মেয়ের সাথে তিনি মিসবাহর বিয়ে দিবেন না মানে দিবেন না।

(চলবে)