#চিরকুট ( নবম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১৭>
সেই রাতে এরপর সৃজা ব্যাগ প্যাক করেছিল নিজের আর চিরকুটের। এইভাবে কারোর জীবনে আর কম্প্রোমাইজের কারণ হবে না ওরা। তাই মেয়েকে নিয়ে ফ্ল্যাটটা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল সেদিন। মায়ের কাছে যাবে ও। যেই মা একদিন রাস্তা থেকে তুলে এনে আশ্রয় দিয়েছিল, তার কাছেই ফিরে যাবে আরেকবার।
তবে গৌরব সেই রাতে ঘুমের মধ্যেই আচ্ছন্ন ছিল সারাক্ষণ। তাই সৃজা আর চিরকুটের চলে যাওয়াটা একেবারেই বোঝেনি ও। কিন্তু পরেরদিন যখন ঘুম ভেঙেছিল তখন প্রচন্ড মাথার যন্ত্রণা নিয়ে উঠে বসেছিল গৌরব। সেই মুহুর্তে আবছা চোখে যখন মোবাইল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েছিল, তখন সময় সকাল সাড়ে এগারোটা। তার মানে এতক্ষণ ধরে ঘুমাচ্ছিল ও! আর সৃজা কোথায়! ওকে ডাকেনি কেন! কথাটা মনে হতেই হঠাৎ কালকে রাতের ঘটনাটা মনে পড়ে গেল গৌরবের। কাল তো চিরকুটের জন্মদিন ছিল! ওর তো সন্ধ্যের মধ্যে ফেরার কথা ছিল বাড়িতে। কত লোক ইনভাইটেড ছিল কাল! কিন্তু ও সব ভুলে কাল বারে গিয়ে রাত অব্দি ড্রিঙ্ক করলো! তারপর বাড়ি ফিরে কি ও নেশার মধ্যে সৃজার সাথে মিসবিহেভ করেছে! ও কি খুব বাজে ভাবে রিয়্যাক্ট করেছে সৃজার ওপর! কথাটা মনে হতেই গৌরব কিছুটা জোর করেই কাল রাতের ঘটনাগুলো মনে করার চেষ্টা করলো। আর তখনই কানে বেজে উঠলো নিজের বলা কথাগুলো। কাল গৌরব নিজের সমস্ত সত্যিগুলো বলে ফেলেছে সৃজার সামনে! বলে ফেলেছে ও চিরকুটকে কোনদিন সন্তান হিসেবে একসেপ্টই করতে পারেনি! ও কোনদিন চায়নি এই এডপশন। গৌরব নিজেকে চিরকুটের বাবা ভাবেই না কখনো। আরো কত কি বলেছে নেশার ঘোরে! কথাগুলো ভেবে কেমন এলোমেলো লাগলো যেন গৌরবের। এটা কি করলো ও! এইসব কথা এত স্পষ্টভাবে কি করে বলে ফেললো সৃজাকে মুখের ওপর! আর কাল ওই ছোট্ট মেয়েটার প্রথম জন্মদিন ছিল এই বাড়িতে। সেই জন্য সৃজা কত খুশি ছিল কাল! কতবার ওকে বলেছিল সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে আসতে। কিন্তু কালই গৌরব এরকম করলো! এত গেস্টদের মাঝে নিজেই এলো না! কথাগুলো ভেবে ও তাড়াতাড়ি উঠলো বিছানা থেকে। সৃজাকে এখনি সরি বলতে হবে! জানেও না কালকে রাতের পর সৃজা আর ওর সাথে কথা বলবে কি না! কথাগুলো ভেবে গৌরব পাশের ঘরে গেল, ড্রইং রুম দেখলো, কিচেনে গেল। কিন্তু প্রত্যেকটা ঘর খালি এই মুহূর্তে। গৌরব ছাড়া এই ফ্ল্যাটে আর কেউ নেই এখন। কথাগুলো ভেবে কেমন ছন্নছাড়া লাগলো নিজেকে হঠাৎ। সৃজা চিরকুট কোথায় গেল আজ! আজ তো রবিবার, ছুটির দিন। ওদের তো বাড়িতে থাকারই কথা। কথাটা ভেবে ও তাড়াতাড়ি সৃজার নাম্বার ডায়েল করলো ফোনে। সৃজার সাথে কথা হওয়াটা এখন খুব দরকার ওর। কিন্তু এই মুহূর্তে সৃজার ফোনটা একবার দুবার বার বার রিং হতে হতে কেটে গেল হঠাৎ। কিন্তু গৌরব এরপরও দু তিনবার ট্রাই করলো ওকে ফোনে। তবে প্রত্যেকবারই কথাহীন হয়েই শেষ হয়ে গেল কলটা।
তবে এই সময়ে গৌরবের ধৈর্য্য যেন শেষ হয়ে গেছে। কোথায় গেল সৃজা আর চিরকুট! ওরা কি বাড়ি ছেড়ে চলে গেল না কি! কথাটা ভেবেই কেমন দৌড়ে গিয়ে সৃজার আলমারিটা খুললো ও, আর ভীষণ স্থির হয়ে গেল হঠাৎ। শুন্য আলমারি ওর দিকে নিস্পলক ভাবে তাকিয়ে এখন। সৃজার শাড়ি, জামা কাপড় কিছুই নেই আর। দৃশ্যটা দেখে ও এবার ভীষণ জোর পায়ে চিরকুটের ঘরে গেল। তারপর ওই বাচ্চা মেয়েটার আলমারি খুলেও দেখলো সব ফাঁকা। গৌরবের এবার একেবারেই বুঝতে অসুবিধা হলো না সৃজা চিরকুটকে নিয়ে এই বাড়িটা ছেড়ে, গৌরবকে ছেড়ে চলে গেছে। পুরোপুরিভাবে একা করে চলে গেছে গৌরবকে।
সেদিন এরপর গৌরবের হাত পা ছেড়ে দিয়েছিল হঠাৎ। শরীরটা কেমন অসার হয়ে এসেছিল যেন। ও কিছুক্ষণের জন্য তাই বসে পড়েছিল মাটিতে। তাহলে কি কাল এতটা কষ্ট দিয়েছে ও সৃজাকে যে বাড়ি ছাড়ার মতন এত বড় একটা ডিসিশন নিতে হলো! কথাটা ভেবেই গৌরব কেমন অস্থির হয়ে উঠলো নিজে। ও আর অপেক্ষা করলো না এরপর। কোনভাবে নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ালো, সৃজার কাছে যাবে বলে। সৃজা নিশ্চয়ই ওর মায়ের কাছেই গেছে! গৌরব কথাটা ভেবেই গাড়িতে স্টার্ট দিল।
এরপর আর কিছু সময়ের ভিড়ে ও পৌঁছেছিল সৃজার মায়ের বাড়ি। জানে না সৃজা ওর সাথে কথা বলবেও কি না! তাও ভীষণ অস্থির মনেই গৌরব কলিং বেলটা বাজালো এই মুহূর্তে।
<১৮>
এরপর কিছু সময়ের ভিড়ে সৃজার মা এসে দরজা খুলেছিল। আজ গৌরবকে দেখে ওনার মুখটা ভীষণ কঠিন। গৌরব বুঝেছিল কালকে রাতের ঘটনাটা সবই ওনার জানা, তাই আর কথা না বাড়িয়ে ভিতরে ঢুকে ও খুব আস্তে গলায় জিজ্ঞেস করেছিল,
——– ” সৃজা কোথায়? ”
কথাটায় উনি খুব অল্প শব্দে উত্তর দিয়েছিলেন,
——–” ঘরে আছে নিজের। ”
এটা শুনে গৌরব সেই আস্তে স্বরেই বলেছিল,
———” আমি আসছি। ”
কথাটা বলেই ও আর দাঁড়ায়নি। সৃজার ঘরে গিয়েছিল ভীষণ এলোমেলো ভাবে।
সেই মুহুর্তে সৃজা কিরকম থমকে ছিল যেন। তবে গৌরবকে হঠাৎ দেখে ও আজ একটা কথাও বলেনি। আসলে গৌরবের সাথে আর কিছুই বলার মতন নেই! সব কথাই যেন শেষ। তবে গৌরব আজ একদম দিশেহারার মতন এসেছিল ওর কাছে, তারপর খুব অসহায় গলায় বলেছিল,
——–” এম রিয়ালি সরি সৃজা। আমি সত্যি বলছি। কাল আসলে মা বাবার সাথে দেখা হয়েছিল, তারপর আমার মাথার ঠিক ছিল না! সেই জন্য আমি ড্রিঙ্ক করে ফেলেছিলাম অনেক। এরকম আর কোনদিন হবে না। আমি কখনো তোমাকে আর চিরকুট কে এইভাবে হার্ট করবো না! প্লিজ এই শেষ বার আমাকে বিশ্বাস করো। প্লিজ বাড়ি চলো সৃজা। চিরকুট কে নিয়ে ফিরে চলো। ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল গৌরব। কিন্তু সৃজা আজ সব সময় কিছুক্ষণ চুপ ছিল নিজের মনে। তারপর হিমশীতল গলায় বলেছিল গৌরবকে,
———” আমি তোমাকে খুব আলাদা ভাবতাম। সবার থেকে আলাদা! কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। তুমিও সবার মতনই। কাল সেটা খুব স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছো আমাকে। তুমি কোনদিন চিরকুট কে একসেপ্ট করতে পারোনি। আমি সেটা অনেকবার দেখে বুঝেছি; কিন্তু বিশ্বাস করিনি। তবে কাল তুমি আমার ভুল টা ভেঙে দিলে। আমি আর ওই বাড়ি ফিরবো না গৌরব। তোমাকে জোর করে চিরকুটের বাবা হওয়ার অভিনয় করতে হবে না আর। ওর জন্য ওর মা ই যথেষ্ট। ”
কথাগুলো খুব দৃরভাবে বললো সৃজা। কিন্তু এইসব শুনে গৌরব কিছুক্ষণ উত্তর হীন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ওর সামনে। তারপর আবার বলে উঠলো,
———” এইসব বোলো না প্লিজ! আমি জানি কালকের কথাগুলো তোমাকে খুব হার্ট করেছে। কিন্তু আই প্রমিজ এরকম আর কোনদিন হবে না! আমরা আবার সব কিছু নতুন করে শুরু করবো। আর একবার ট্রাস্ট করো শুধু আমাকে! ”
কথাগুলো খুব অসহায় ভাবে বললো গৌরব। কিন্তু সৃজা আজ ভীষণ কঠিন হয়েই উত্তর দিল,
———” জোর করে কিছু হয় না গৌরব। জোর করে কাউকে সন্তানের ভালোবাসা দেয়া যায় না। সেটা মন থেকে আসে। আর সত্যিই তো, চিরকুট কে এডপ্ট করার জন্য তুমি তোমার মা বাবার সাথে অব্দি যোগাযোগ রাখতে পারো না! আমি বুঝতে পেরেছি তোমার কষ্টটা। তাই আমি নিজেই সরে আসার ডিসিশনটা নিয়েছি আমার মেয়েকে নিয়ে। আর এটা আমি বদলাবো না। তুমি প্লিজ এসো। ”
কথাগুলো বলে সৃজা আর কিছু শোনার অপেক্ষা করলো না সেই মুহূর্তে। নিজেই ঘরটা খালি করে গৌরবের সামনে থেকে চলে গেল। কিন্তু গৌরব আজ এক পা ও এগোতে পারলো না এরপর! কেমন সব কিছু অন্ধকার হয়ে এলো যেন ওর চারিদিকে হঠাৎ! কালো মেঘ এসে ভিড় করলো শহরে। বৃষ্টি জমা গভীর কালো মেঘ।
গৌরব আর সৃজার মধ্যে এরপর থেকে একটা নিঃস্তব্ধতার দেয়াল উঠে গেছিল যেন। সৃজা আসলে গৌরবের সেদিনের বলা কথাগুলো ভুলতে পারছিল না কোনভাবেই, তাই চুপ হয়ে গেছিল হঠাৎ। গৌরবেরও এই সময় নিজের হয়ে আর বলার মতন কিছুই ছিল না! তবে ওই ফাঁকা ফ্ল্যাটটায় এসে ও রোজ বুঝতে পারছিল কি ভুল করেছে! চিরকুট ওদের জীবনে এসে সত্যি একটা আনন্দ ছড়িয়ে দিয়েছিল হঠাৎ। সারা ফ্ল্যাট জুড়ে ওর আধো আধো গলার আওয়াজ, ছোট ছোট দুষ্টুমি, সৃজার সঙ্গে নাচ প্র্যাকটিস, পুতুল নিয়ে খেলা, সব খুব মনে পড়ছিল গৌরবের। মনে হচ্ছিল সত্যিই তো ওই ছোট্ট শিশুটা তো ওকেই নিজের বাবা ভাবতো এতদিন! কিন্তু গৌরব কখনো ওই বাচ্চাটাকে সময় দেয়ার চেষ্টাই করেনি। শুরু থেকে চিরকুটকে নিজের থেকে এতটা দূরের করে রেখেছিল যে কখনো কোন ভালো লাগার মুহূর্ত তৈরি করতে পারেনি বাচ্চাটার জন্য। সৃজা সেই সময় কতবার ওকে বলেছিল চিরকুট কে সময় দিতে, একটু চেষ্টা করতে ওর সাথে একটা কনেকশন তৈরি করার! কিন্তু গৌরব সেইসব কথায় কোন গুরুত্ব দেয়নি। ও তো আসলে নিজের মধ্যেই হারিয়ে ছিল সেই সময়। নিজের না পাওয়া গুলোর মধ্যেই হাঁতরে বেড়াতো দিন রাত্রি। কিন্তু কখনো এটা ভাবেনি ঈশ্বর ওর কাছ থেকে একবার বাবা হওয়ার সুখ কেড়ে নেয়ার পরেও আবার সেটা ফিরিয়ে দিয়েছে চিরকুটকে পাঠিয়ে ওর কাছে! মেয়েটা ওকে সত্যিই ভালোবাসতো। সেইবার যখন গৌরব চিরকুটের স্কুল ফাংশনে যায়নি, তখন কতটা কষ্ট পেয়েছিল ওইটুকু বাচ্চা। তবে গৌরব একটা ছোট্ট চকলেট হাতে দিতেই নিজের কষ্টগুলোকে ভুলে গৌরবকে জড়িয়ে ধরেছিল মেয়েটা। তারপর কতদিন সকাল বেলা ওকে আধো স্বরে বাবা বাবা বলে ডেকে ঘুম থেকে তুলতো চিরকুট। ওর ছোট্ট দুটো হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরতো গৌরবকে। কথাগুলো আজকাল ভীষণ এলোমেলো ভাবে মনে হয় গৌরবের। আর কেমন শুন্য লাগে যেন জীবনটা। মনে হয় নিজের অযত্নে সব কিছু হারিয়েছে আজ। তাই এতটা একা হয়ে গেছে হঠাৎ। এর মধ্যে একদিন চিরকুটের ঘর থেকে ওর ড্রইং বুকটা খুঁজে পেয়েছিল গৌরব। সেখানে নানান আঁকিবুকি কেটে রেখেছে মেয়েটা। তার মধ্যে বেশ কয়েকটা পাতায় ‘ মাই ফ্যামিলির ‘ ছবি আঁকা, যেখানে চিরকুট ওর মা বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। অগোছালো হাতে আঁকা এইসব ছবি দেখে সেদিন সত্যিই গৌরব কেঁদে ফেলেছিল কেমন। ওই ছোট্ট শিশুটা ওকে এত ভালোবাসতো যে নিজের আঁকার খাতাতেও বাবার ছবি এঁকেছে! আর গৌরব তার বদলে মেয়েটাকে সামান্যতমও ভালোবাসতে পারেনি। এমনকি ওর জন্মদিনটায় অব্দি আসেনি! কথাগুলো ভেবে নিজের ওপরই রাগ হলো কেমন। এতটা কঠিন হয়ে ও এতদিন থাকলো কি করে! এত কি হিসেব করলো মনে মনে যে একটা নিষ্পাপ শিশুকে ভালোবাসতে পারলো না! তাকে সেই যত্ন সেই আদর দিতে পারলো না!
( চলবে)