চিরকুট পর্ব-০৮

0
106

#চিরকুট ( অষ্টম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১৫>
সেদিনের পর আরো কিছু মাস কেটে গেছে ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে। এখন সেপ্টেম্বর মাসের শুরু। এই মাসের চার তারিখ চিরকুটের জন্মদিন। যদিও ও সত্যি কবে জন্মেছে, এটা সবারই অজানা। কিন্তু যেই দিন ওকে অরফানেজ এর গেটের বাইরে ফেলে রেখে যাওয়া হয়েছিল, সেই দিনটাকেই ওর জন্মদিন বলে ধরা হয়। কথাটা অরফানেজ এর ওয়াডের্ণ বলেছিল সৃজাকে। যাইহোক, এই দিনটাকে খুব সুন্দরভাবে সেলিব্রেট করার ইচ্ছে ছিল সৃজার। কথাটা গৌরবকে বলেছিল ও। গৌরবের যদিও এতটা এক্সসাইটমেন্ট ছিল না। কিন্তু সৃজার মুখের ওপর সেইসব না বলে ও কিছু কথা সাজিয়ে বলেছিল,
———” তুমি গেস্ট লিস্ট রেডি করো। খাবার ডেকরেশনের ব্যাপারটা আমি দেখে নেব। ”
কথাটা শুনে সৃজা যেন নিশ্চিন্ত হয়েছিল। সেই মুহুর্তে হঠাৎ মনে হয়েছিল গৌরবও তার মানে মেয়ের জন্মদিন নিয়ে খুশি। তাই নিজে থেকেই এইসব দায়িত্ব নিল অনুষ্ঠানটার। কিন্তু গৌরব আসলে এইসবই সৃজার মন রাখার জন্য করেছিল। ও চায় না ওর জন্য আর কোনভাবেই সৃজা আর চিরকুট হার্ট হোক!
যাইহোক, এর মধ্যেই কটা দিন এইসব জন্মদিনের এরেঞ্জমেন্ট করতে করতেই কেটে গেল দুজনের। সৃজা এর মধ্যে চিরকুটকে কেকের দোকানে নিয়ে গিয়ে ওর পছন্দ মতন কেক অর্ডার করেছে। ওর সমস্ত কলিগদের, বন্ধু বান্ধবকে ইনভাইট করেছে। আসলে সব রকম ভাবে সৃজা চেষ্টা করেছে মেয়ের জন্মদিন কে স্পেশ্যাল করে তোলার। এর মধ্যেই দিনটা এসে হাজির হলো অবশেষে। গৌরবের সেদিন একটা ইম্পর্টেন্ট কাজ ছিল ব্যাঙ্কে, তাই সৃজার বলা সত্বেও ও ছুটি নিতে পারেনি সেইদিন। তবে প্রমিজ করেছিল যে বিকেলের মধ্যে ফিরে আসবে ঠিক। এইভাবেই ব্যাস্ততার মাঝে দিনটা এগোচ্ছিল সেইদিন, কিন্তু তাল কাটলো গৌরবের অফিসে গিয়ে। লাঞ্চ ব্রেকের সময় ও ডেস্ক থেকে উঠে একটু অন্য মনস্ক হয়েই যাচ্ছিল ওয়াশ রুমের দিকে ফ্রেশ হতে, তখনই করিডোরে কানে এলো দুজন কলিগের কথা। তারা যদিও গৌরবকে খেয়াল করেনি ঠিক। নিজেদের মধ্যেই কথা বলতে মশগুল ছিল। তাদের মধ্যে শ্রেয়া বলে মেয়েটা বলেছিল,
——–” এই সেদিন সিসিটু তে গিয়েছিলাম, তখন সৃজাদি আর ওর মেয়ের সাথে দেখা হলো। বাচ্চাটা এমনিতে খুব মিষ্টি। কিন্তু একদমই মা বাবার মতন দেখতে হয়নি! কেমন যেন আলাদা মুখের ধাঁচ পুরো। ”
কথাটায় ঐশী একটু অবাক হয়ে উত্তর দিল,
——–” ওমা, তুই জানিস না! ওটা তো সৃজাদি গৌরবদার নিজের মেয়ে না। এডপটেড.. আসলে সৃজাদির বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর তো ডিপ্রেশনে চলে গেছিল। তারপর কিছু মাস বাদে মেয়েটাকে দত্তক নেয়।”
এটা শুনে শ্রেয়া বেশ আশ্চর্য হয়ে বলেছিল,
——–” ওহ! সৃজাদির বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেছিল! এইসব তো জানতামই না! তাই ওই বাচ্চাটাকে দেখে ভাবি মা বাবার সাথে মুখের কোন মিল নেই কেন! আজ বুঝলাম।”
কথাগুলো সেদিন ওরা নিজের মনে বললেও দূর থেকে শুনছিল গৌরব, আর নিজের মধ্যে কেমন অসহ্য লাগছিল ওর! তার মানে এই মিথ্যে সন্তান সুখটা আজকাল সবারই চোখে পড়ে। চিরকুট যে ওদের কেউ না, এটা যে কেউ মুখ দেখেই বলতে পারে। আর হয়তো চেনা পরিচিতরা ওদের নিয়ে আড়ালে এইভাবে কথা বলে, আলোচনা করে। কথাগুলো ভেবে কেমন অস্থির লাগলো ওর। জোর করেও যেন নিজেকে শান্ত করতে পারলো না গৌরব। এরপর বাকি অফিসে থাকা সময়টুকু ও কিরকম অশান্তি নিয়েই থাকলো মনে। এর মধ্যে সৃজা বেশ কিছু বার ফোন করেছিল গৌরবকে। কিন্তু গৌরবের আর জোর করেও কথা আসছে না এই মুহূর্তে। তাই ফোনটা আর রিসিভ করলো না সৃজার।
যাইহোক, এরপর বিকেলের দিকে অফিস থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকেই যাচ্ছিল ও। যদিও মনের মধ্যে ওই মেয়ে দুটোর কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিল কেমন না চাইতেও। এর মধ্যে আরেকটা ঘটনা ঘটলো। গৌরবের সেদিন হঠাৎ হাওড়া স্টেশনে মা বাবার সাথে দেখা! সমীরণবাবু আর অনন্যা দিল্লী যাচ্ছে আসলে, একজন আত্মীয়র বাড়ি। কিন্তু স্টেশনে যে এভাবে গৌরবের সাথে দেখা হয়ে যাবে ওরা ভাবেনি। তবে ছেলের সাথে আজকাল এমন একটা শক্ত কাঁচের দেয়াল তৈরি হয়ে গেছে দুজনের যে ওরা গৌরবকে দেখে এক পা ও এগোয়নি আজ। কিন্তু গৌরব এতদিন বাদে মা বাবাকে দেখে আর স্থির থাকতে পারেনি। ও কিছু না ভেবেই এগিয়ে গিয়েছিল ওদের দিকে, তারপর একটু এলোমেলো হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল,
——–” কেমন আছো তোমরা? কোথায় যাচ্ছো? হঠাৎ স্টেশন এসেছ কেন!”
প্রশ্নগুলো শুনে অনন্যা এবার খুব অবাক হয়েই বললো,
——–” বাবা! চিনতে পেরেছিস আমাদের! আমি তো ভাবলাম ভুলেই গেছিস। ”
কথাটায় গৌরব এবার ক্লান্ত স্বরেই বললো,
———” মা প্লিজ! এইভাবে কেন বলছো? ”
এই প্রশ্নে সমীরণবাবু ভীষণ কঠিন গলায় বললো,
——–” তো আর কিভাবে বলবে! আমাদের কোন অস্তিত্ব আছে তোর জীবনে? দুদিনের আসা মেয়েটাই তো সব হলো। আমাদের ইচ্ছে অনিচ্ছে ভালো খারাপ লাগা, কিছু নিয়ে কি আর ভাবিস এখন? ”
কথাটায় অনন্যা এবার সমীরণবাবুকে থামিয়ে বললো,
——-” তুমি কেন কথা বাড়াচ্ছ ওর সাথে? যে আমাদের কোন দাম দেয় না তার সাথে কথা বলে কি কোন লাভ আছে! চলো, যেই প্ল্যাটফর্মে ট্রেন দেবে; সেখানে চলো। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কোন লাভ নেই। ”
কথাগুলো গৌরবকে অদেখা করে বললো অনন্যা। তবে এই মুহূর্তে গৌরব আর চুপ না থেকে কিছুটা অসহায় গলায় বললো,
——-” কতদিন বাদে দেখলাম তোমাদের! এইভাবে কেন কথা বলছো? তোমরা কোন প্ল্যাটফর্মে যাবে বলো? আমি যাচ্ছি সাথে। এতগুলো লাগেজ নিয়ে বাবা একা কিভাবে যাবে! ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বললো গৌরব। কিন্তু ওর মা এবার সেই কঠিন হয়েই উত্তর দিল,
——–” তোর বাবার একলা চলার অভ্যাস হয়ে গেছে। তুই তো এমনিতেও মাঝ রাস্তায় একলা ছেড়েই দিয়েছিস আমাদের, কিছু বাইরের লোকের জন্য! তাই আর ভাবিস না এই বুড়ো বুড়ি দুটোকে নিয়ে। ”
কথাটা বলেই অনন্যা আর সমীরণ বাবু আর দাঁড়ালো না। লাগেজ গুলো নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল ভিড় স্টেশনের মধ্যে। কিন্তু গৌরব যেন কেমন নির্বাক মানুষের মতন স্থির হয়ে রইলো এক জায়গায়। চোখ গুলো ছলছল করে উঠলো ওর জলে। মা বাবা আজ ওর থেকে এত দূরে সরে গেছে! গৌরব কি সত্যিই সৃজার কথা ভাবতে গিয়ে এই মানুষ দুটোর কথা ভাবতে ভুলে গেছে একেবারে! ও কি খুব খারাপ সন্তান আসলে! প্রশ্নগুলো যেন এই জলে ভেজা আবছা স্টেশনের মাঝে উঁকি দিল হঠাৎ। আর গৌরবের সমস্তটা এলোমেলো হয়ে গেলো কেমন! ঝড় উঠলো একটা বড়ো মনে।
<১৬>
সেদিন এরপর গৌরব আর বাড়ির দিকে যায়নি। আসলে নিজের জীবনের সবটাই কেমন অগোছালো লাগছিল ওর। ক্লান্ত লাগছিল ভীষণ এই মিথ্যে ভালো থাকায়! গৌরব তো আসলেই ভালো নেই। বাড়ি গেলে সারাক্ষণ একটা মিথ্যে অভিনয় করতে হয় সৃজার সামনে। চিরকুট এর বাবা হওয়ার অভিনয়। কিন্তু গৌরব তো কোনদিন মন থেকে ওকে একসেপ্ট করতে পারেনি সন্তান হিসেবে। সেই টান, সেই ভালোবাসা কখনো ফিল করেনি চিরকুটের জন্য। আর এই একটা মিথ্যেকে টিকিয়ে রাখতে গিয়ে নিজের বাবা মার সাথে অব্দি যোগাযোগটা শেষ হয়ে গেল ওর! মা বাবারও তো বয়স হয়েছে। সৃজার মতন ওদের প্রতিও তো কিছু দায়িত্ব আছে গৌরবের। সৃজাকে যেমন গৌরব ভালোবাসে, সেরকম তো মা বাবাকেও ভালোবাসে ভীষণ। কিন্তু আজ ওরা গৌরবের সাথে কথা বলে না, একই রাস্তায় দেখা হলে গৌরবের দিকে এগিয়ে অব্দি আসে না! সম্পর্কটা এতটা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। সত্যি, এইভাবে আর পারছে ও। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সেদিন এই সমস্ত কষ্টগুলো থেকে মুক্তির জন্য ও নেশার আশ্রয়ে গেছিল। পার্ক স্ট্রিটের একটা বারে ঢুকে প্রচণ্ড ভাবে ড্রিঙ্ক করেছিল গৌরব। মদের ঘোরে এতটাই বেহুঁশ ছিল ও সেই সময়ে যে চিরকুটের জন্মদিনের কথা আর মাথাতেও আসেনি ওর। একবারও মনে পড়েনি বাড়িতে অতো লোকের ভিড়ে সৃজা আর ওই বাচ্চা মেয়েটা অপেক্ষা করছে আজ ওর জন্য।
তবে সেদিন সৃজা বহুবার ফোন করেছিল গৌরবকে। বাড়িতে সেই সময় অনেক গেস্ট চলে এসেছিল। প্রত্যেকে গৌরবের কথাই জিজ্ঞেস করছিল। কিন্তু সৃজার কাছে কোন উত্তর ছিল না বলার মতন! আসলে গৌরব শুধু একবারই ফোন ধরে নেশার ঘোরে ওকে বলেছিল,
——-” পারবো না আমি আসতে! প্লিজ ডোন্ট ডিস্টার্ব মি এনিমোর..”
কথাটা বলেই ফোনটা কেটে দিয়েছিল গৌরব। কিন্তু সৃজা যেন স্তব্ধ হয়ে গেছিল সেই মুহূর্তে! মনে হচ্ছিল আজকে মেয়েটার প্রথম জন্মদিনেও গৌরব এলো না এইভাবে! সবার সামনে এতটা ছোট করলো সৃজা আর চিরকুটকে! তাহলে কি সত্যিই চিরকুটের কোন দাম নেই গৌরবের কাছে! কথাগুলো ভেবে চোখটা ভিজে আসছিল বার বার। তবে চিরকুট বহুক্ষণ অপেক্ষা করেছিল ওর বাবার জন্য। আসলে সব বন্ধুদের বলে রেখেছিল আজ জন্মদিনের পার্টিতে ওর বাবা আর ও একসাথে কেক কাটবে। সেই জন্য গৌরব না আসা অব্দি কিছুতেই কেক কাটতে চাইছিল না চিরকুট। তবে ঘড়ির কাঁটা একটু একটু করে এগিয়ে যেতে সৃজার মতন চিরকুটও বুঝেছিল ওর বাবা আসবে না আর! তাই হঠাৎ মা কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিল মেয়েটা। সেই সময় সৃজার কষ্টটাও যেন বেড়ে গেছিল ভীষণ। ও চিরকুটকে অনেক বুঝিয়ে শান্ত করেছিল এরপর। তবে কেক কেটে আনন্দ করার মন আর ছিল না চিরকুটের।
তাও মায়ের কথায় অন্ধকার মুখেই সবার সামনে একা জন্মদিনের কেক কেটেছিল চিরকুট। তারপর গৌরবকে ছাড়াই খাওয়া দাওয়ার পর্ব মিটিয়ে ধীরে ধীরে চলে গেছিল গেস্টরা। এরপর ওই ফাঁকা নিঃসঙ্গ ফ্ল্যাটে কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছিল সৃজার। চিরকুটও হঠাৎ কেমন চুপ করে গেছিল আজ। গৌরবের না আসাটা ওকে খুব কষ্ট দিয়েছিল আসলে। এইভাবেই সময়টা এগিয়ে এগিয়ে ঘড়ির কাঁটা যখন সাড়ে এগারোটার ঘরে পৌঁছলো ফ্ল্যাটের কলিং বেলটা বেজে উঠলো সেই মুহূর্তে। সৃজা এরপর কিছু সময়ের ভিড়ে দরজা খুলে দেখলো গৌরব ভীষণ এলোমেলো চেহারায় ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সৃজা এটা দেখে কিছু না বলে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো, আর খেয়াল করলো গৌরব টলতে টলতে বাড়ির ভিতরে ঢুকছে। এর মানে গৌরব ড্রিঙ্ক করেছে আবার! প্রশ্নটা মনে আসতেই ধৈর্য্যের সব সীমা যেন শেষ হয়ে গেল সৃজার! ও আর চুপ না থেকে বেডরুমে এসে গৌরবের রাস্তা আটকে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
——-” তুমি আসোনি কেন আজকে? কেন সবার সামনে আমাকে এতটা ছোট করলে? আর ওই ছোট্ট মেয়েটা কি দোষ করেছিল! সারাটা সন্ধ্যে ও অন্ধকার মুখে নিজের বাবার জন্য অপেক্ষাই করে গেল! আর তুমি এতটা ইন্সেন্সিটিভ যে একবারও ওই বাচ্চা মেয়েটার কথা ভাবলে না? আজকের দিনেও ড্রিঙ্ক করে বাড়ি ফিরলে? তুমি কখনো চিরকুটের সাথে সহজ হওয়ার চেষ্টাই করোনি। সব সময় ওর থেকে একটা ডিসটেন্স মেনটেন করে চলেছো। ওর স্কুলে ভর্তি, ওর স্কুলের প্রথম প্রোগ্রাম কোন কিছুতে তুমি আসোনি। কিন্তু এত কিছুর পরও আমি কখনো কিছু বলিনি। আসলে আমার মনে হয়েছে আর একটু সময় দিলে হয়তো সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আজকে! আজকেও তুমি এলে না? একবারও ভাবলে না আজ মেয়েটার জন্মদিন। আজকের দিনে ও ওর বাবাকে কতটা এক্সপেক্ট করেছিল! ”
কথাগুলো কেমন এক নিঃশ্বাসে বলে যাচ্ছিল সৃজা। কিন্তু এই মুহূর্তে গৌরব ওকে থামিয়ে ভীষণ চিৎকার করে বলে উঠলো,
——–” আমি চিরকুটের বাবা নোই! কোনদিনও ছিলাম না। আর হতেও চাই না। এতগুলো দিন ধরে নিজেকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু আর সম্ভব না! আর আমি পারছি না এইভাবে! আমি নিঃসন্তান। এটাই সত্যি। ”
কথাগুলো কেমন ঘোরের মধ্যে বললো গৌরব। কিন্তু সৃজা হঠাৎ এইসব শুনে কিরকম স্থির হয়ে গেল যেন! ও নিস্পলক ভাবেই বললো,
———” কি বলছো তুমি এইসব! চিরকুট আমাদের মেয়ে। তুমি এত বড় কথাটা বললে কিভাবে? ”
প্রশ্নটা শুনে গৌরব সেই আগের মতন চিৎকার করেই বললো,
——–” না। চিরকুট আমার মেয়ে না। আমার নেই এত বড় মন তোমার মতন যে একটা অনাথ আশ্রম থেকে নিয়ে আসা বাচ্চাকে নিজের ভেবে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেব! ও তোমার মেয়ে হতে পারে, কিন্তু আমার কেউ না। আসলে কখনো কোন টান তৈরিই হয়নি আমার ওর জন্য। আর এই একটা লোক দেখানো সম্পর্কের জন্য আজ আমার নিজের মা বাবা পর্যন্ত আমার থেকে কতটা দূরে সরে গেছে! ওরা আমার সাথে কথা বলে না, যোগাযোগ রাখে না! আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি ঠিকই। তোমার ডিপ্রেসন কাটানোর জন্যই আমি ওই মেয়েটাকে এডপ্ট করার ডিসিশন নিয়েছিলাম। কিন্তু এর মানে এই না যে আমি ওকে নিজের মেয়ে ভাবি! আসলে আমার জীবনে এখন আর কোন শান্তিই নেই! প্রত্যেকটা জায়গায়, প্রত্যেকটা সময় শুধু প্রিটেন্ট করতে হয় আমি খুব ভালো আছি। ব্যাস, শুধুই প্রিটেনশন। ”
কথাগুলো কেমন একসাথে উগড়ে দিয়েছিল সেইদিন গৌরব সৃজার সামনে। তারপর আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে খুব ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পরেছিল বিছানায়। নেশার ঘোরে চোখ দুটো বুঁজে আসছিল ওর। নিস্তেজ হয়ে পড়ছিল শরীর। তারপর ধীরে ধীরে ঘুমের দেশে চলে গিয়েছিল গৌরব।
কিন্তু এই সমস্ত কথা সৃজার সাথে আরেকজনও শুনেছিল সেদিন দরজার পাশে দাঁড়িয়ে। গৌরব নিস্তেজ হয়ে শুয়ে পড়ার পর সৃজা ভেজা চোখে খেয়াল করেছিল চিরকুট কিরকম থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। সৃজা সেই মুহূর্তে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল চিরকুটকে। কিন্তু মেয়েটা কোন কথা বলছিল না ওর সামনে। সৃজা এবার ওকে কোলে তুলে অন্য ঘরে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু চিরকুট কেমন জল ভর্তি চোখে ওকে জড়িয়ে ছিল চুপ করে। সৃজা এবার ওর মাথায় হাত বুলিয়ে খুব আলতো স্বরে বলেছিল,
——–” কি হয়েছে মা? তুমি ভয় পেয়ে গেছো? তুমি চুপ করে কেন আছো মা? কি হয়েছে বলো আমাকে! ”
কথাগুলো বলতে বলতে ওর নিজের গলায়ও কান্না জমা হয়েছিল সেই মুহূর্তে। তাও কোনভাবে নিজেকে সামলে আগলে রেখেছিল মেয়েকে। কিন্তু তখনই চিরকুট কেমন থমকে বললো,
——–” তোমরা আমার নিজের মা বাবা নও? আমি কোথা থেকে এসছি? তাহলে আমি ড্রিমে রোজ যেই বাড়িটা দেখি, সেটাই কি আমার আসল বাড়ি? যেখানে আমি অনেক গুলো বাচ্চার সঙ্গে একসাথে থাকি! ”
কথাগুলো কেমন থমথমে দৃষ্টিতে বললো চিরকুট। কিন্তু সৃজা এই মুহূর্তে ওকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো,
———” না সোনা। এইসব কি বলছো তুমি! আমি তোমার মা। আমি তোমার নিজের মা। তুমি একদম আর কিছু ভেবো না। আর কিছু চিন্তা কোরো না। ”
কথাটা শেষ করে সৃজা চিরকুটকে ভীষণ ভাবে আঁকড়ে ধরলো। নিজের সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে ওকে জড়িয়ে রাখলো নিজের মধ্যে। তবে গৌরবের কথাগুলো এখনও কানে বাজছিল যেন সৃজার। হঠাৎ মনে হচ্ছিল এতদিনের সাজানো পৃথিবীটা আসলে মিথ্যে ছিল। গৌরব আজ সেটা খুব স্বচ্ছ ভাবে বুঝিয়ে দিল যেন।
( চলবে)