#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৪৯
____________
রিকার্ডোদের দেওয়া গিফট বক্স খুলে মিতুল যারপরনাই অবাক। বক্সের ভিতর থেকে ছোট ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটা হাতে তুলে নিলো মিতুল। এই ফ্রেমে বন্দি আছে ও এবং জোহান। ছবির ভিতরের জায়গাটা লেক লুইস। লেক লুইসের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে ও আর জোহান। মিতুল মুগ্ধমনা হয়ে তাকিয়ে আছে দূরে লেক লুইস ঘেঁষে থাকা পাহাড়ের অপার সৌন্দর্যে। আর ঠিক ওর পাশে দাঁড়িয়েই জোহান মুগ্ধমনা হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ছবি এটাই বলছে। এই ছবিটা তোলা না হলে মিতুল কখনোই জানতে পারতো না জোহান এই সময় এভাবে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। এটা ওর দৃষ্টির অগোচরে থেকে যেত। মিতুল ভালো করে জোহানের চাহনিটা পরখ করলো। কী মায়া লুকিয়ে আছে ওই চাহনিতে! এমন মায়াবী চোখে কেউ কি এর আগে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল? না, আর কেউ তাকায়নি। মিতুলের ভিতরটা আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠলো। এই ছবি কখন, কীভাবে তোলা হলো জানে না ও। ও নিশ্চিত জোহানও জানে না। এটা ওদের অগোচরে তোলা হয়েছে। দারুণ একটি মুহূর্ত ক্যামেরা বন্দি করেছে রিকার্ডো। আর গিফট হিসেবেও চমৎকার একটা গিফট। এর থেকে চমৎকার গিফট আর কী হতে পারে?
মিতুল আবার গিফট বক্সটার দিকে তাকালো। শুধু ওর এবং জোহানের ছবি নয়, ভিতরে আরও একটা ফ্রেম বাঁধানো ছবি আছে। মিতুল সেটাও হাতে তুলে নিলো। এটার ভিতরে ওকে দেখা যাচ্ছে জোহানসহ জোহানের সব ফ্রেন্ডসদের সাথে। এটা কখন তোলা হয়েছে জানে ও। প্রথম যেদিন জোহান ওকে নিজের ফ্রেন্ডসদের সাথে মিট করাতে রিকার্ডোর বাসায় নিয়ে গিয়েছিল, তখনকার এটা। তখন সবাই মিলে একটা ছবি তোলা হয়েছিল। সেটাই এটা। মিতুল ছবি দুটো বিছানার উপর রাখলো। বক্সের ভিতর আরও কিছু আছে। দেখলো একটা অ্যালবাম। জোহানের গানের অ্যালবাম এটা। ‘Guilty Summer’!
অ্যালবামটার সাথে আবার একটি নেকলেস বক্স। এত কিছু দিয়েছে জোহানের ফ্রেন্ডসরা? মিতুল খুবই আবেগী হয়ে পড়ছে। বেশিক্ষণ থাকলো না ওর এই আবেগ ঘন মুহূর্ত। ধীরে ধীরে চিন্তারা এসে ভিড় জমালো মস্তিষ্কে। ওর এবং জোহানের একই সাথে থাকা ফ্রেম বন্দি ছবিটার দিকে তাকালো। এই ছবি কোথায় লুকাবে ও? এই ছবি যদি কেউ দেখে ফেলে তাহলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে! কোথায় লুকাবে এটা? কানাডা তো যেমন তেমন, কিন্তু বাংলাদেশ? মা-আব্বুর চোখে যদি একবার পড়ে তাহলে তো… মিতুল একটু থমকে গেল।
কী হবে তাহলে? মাথায় এখন সেটাও আসছে না। এখন কিছুতেই মা-আব্বুর সামনে জোহানকে ভালোবাসে সেটা প্রকাশ করা যাবে না। ধীরে ধীরে এটা তাদের বোঝাতে হবে। বাড়িতে যখন বিয়ের কথা উঠবে, তখন আস্তে আস্তে বুঝিয়ে বলবে তাদের। হুট করে এই ব্যাপারটা তারা জেনে গেলে বিরাট কেলেঙ্কারি হবে। আব্বু হয়তো রাগের মাথায় বাড়ি থেকেই বের করে দেবে ওকে। নয়তো বিয়েও দিয়ে দিতে পারে! মিতুলের কিছু সময় চিন্তায় কেটে গেল। পরে আবার মাথাটা হালকা হলো। কোনো টেনশন নেই। এই ছবি লুকানোর বুদ্ধি মেহরিনের কাছ থেকে নেবে ও। মেহরিনের মাথায় ভালো ভালো বুদ্ধিই আছে। মিতুলের চোখ আবারও ছুটে গেল ওর এবং জোহানের ছবিটার উপর। ছবিটা তুলে নিলো হাতে। জোহানকে দেখানো উচিত এটা?
মিতুল সব গিফটগুলো আবার বক্সে ভরে জোহানের রুমের দিকে চললো। প্যাসেজওয়েতে থেকে এদিক ওদিক চোখ বুলালো। কেউ নেই। জোহানের রুমের দরজায় আস্তে করে নক করলো। দরজা খুললো না। আবারও নক করলো। একটু পরই দরজা খুলে গেল।
জোহান মিতুলকে দেখে বললো,
“তুমি?”
মিতুল কোনো কথা না বলে জোহানকে ঠেলে রুমে ঢুকে গেল। তারপর দরজাটা চেপে বন্ধ করলো। জোহান বললো,
“এখানে এসেছো কেন?”
মিতুল গিফট বক্সটা জোহানের দিকে বাড়িয়ে দিলো।
“এটা আমাকে দিচ্ছ কেন?”
মিতুল বক্সটা বেডের উপর রেখে বললো,
“খুলে দেখো।”
“তোমার গিফট তুমি দেখবে। আমি দেখবো কেন?”
“খুলে দেখোই না।”
জোহান বিছানায় বসে গিফট বক্সটা খুললো। সবচেয়ে উপরে ওর এবং মিতুলের সেই ছবিটা। জোহান ছবিটা দেখে থতমত খেয়ে গেল। মিতুলের অগোচরে মিতুলকে দেখছিল, আর সেটা এভাবে ফাঁস করে দিলো রিকার্ডো? জোহান বিড়বিড় করে বললো,
“রিক আর কিছু পেল না তোলার জন্য? এটাই কেন তুলতে হলো?”
জোহান কথাটা বিড়বিড় করে বললেও মিতুলের কানে এলো। বললো,
“তুললো বলেই তো জানতে পারলাম, কেউ এতটা মায়াবী চোখেও তাকাতে পারে আমার দিকে।”
জোহান ভীষণ বিব্রত অবস্থায় পড়লো। মিতুলের দিকে তাকালো। মিতুলের মুখে হাসি। মিতুল এগিয়ে এলো ওর কাছে। বেডে বসে বললো,
“শুধু এটা নয়। আরও দিয়েছে তোমার ফ্রেন্ডসরা।”
মিতুল সব বের করে দেখালো। জোহান সেসবে আগ্রহ খুঁজে পেল না। ওর চিন্তা আটকে আছে ওর এবং মিতুলের ছবিতে। রিকার্ডো ছবিটা তুলেছিল ঠিক আছে, কিন্তু তা মিতুলকে কেন দেখাতে হবে? রিকার্ডো আসলেই বোকা! গোপন জিনিস গোপন রাখতে জানে না।
মিতুল গিফটগুলো নিয়ে কীসব যেন বলে চলছিল। জোহানের কানে সেসব ঢোকেনি। ও মিতুলের কথার মাঝেই হঠাৎ বলে উঠলো,
“আসলে এই ছবিতে যা দেখছো তা সত্যি নয়। আমি তোমাকে না। তোমার ওই পাশে থাকা ছোট একটা মেয়েকে দেখছিলাম। যেটা ক্যামেরায় এমন ভাবে এসেছে।”
মিতুল জোহানের কথা শুনে হেসে ফেললো।
“ও তাই না কি? কোন ছোট মেয়ে ছিল আমার পাশে?”
“ছিল একটা রাশিয়ান মেয়ে। গোল্ডেন হেয়ার।”
মিতুল আবারও হেসে ফেললো। বললো,
“আমাকে এতটাই বোকা ভাবো? এমন আজগুবি একটা কথা বলবে সেটাও বিশ্বাস করবো আমি? তুমি কোনো গোল্ডেন হেয়ারের রাশিয়ান মেয়েকে নয়, আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলে।”
জোহান আর কিছু বলতে পারলো না।
মিতুল সব গিফট গুটিয়ে চলে যাওয়া দিয়েও দরজার কাছে গিয়ে থামলো। বললো,
“একটা কথা বলবো।”
“কী কথা?”
“আমাকে সাইকেল করে ঘুরতে নিয়ে যাবে?”
“এখন?”
“না। যখন সবাই ঘুমিয়ে যাবে। আমরা চুপিচুপি ঘুরতে যাব। এটা হবে তোমার সাথে শেষ সাইকেল ঘোরা।”
“শেষ বলছো কেন? আমরা তো আরও অনেক বার সাইকেলে ঘুরবো।”
“সেটা কবে ঘোরা হবে তার তো ঠিক নেই, এবারের মতো তো এটাই শেষ।”
এসব বলতে মিতুলের ভিতরটা ক্ষয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাইরে তা ধরা দিলো না। মুখে একটু হাসি ফুঁটিয়ে চলে গেল।
জোহান অপলক তাকিয়ে রইল শূন্য দরজায়।
পুরো বাড়ি যখন ঘুমে তলিয়ে গেল, তখন গ্যারেজে এলো জোহান আর মিতুল।
সাইকেলে উঠে বসলো দুজন। জোহান সাইকেল চালাতে শুরু করার আগে মিতুল বললো,
“আস্তে চালাবে না। খুব দ্রুত চালাবে। যাতে তোমাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে হয়।”
“আঁকড়ে ধরার জন্য দ্রুত সাইকেল চালাতে হবে না আমার, এমনিতেই ধরতে পারো তুমি।”
জোহান আর কথা না বাড়িয়ে সাইকেল চালাতে শুরু করলো।
মিতুলও কিছু বললো না। শুধু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো জোহানকে। জোহানের পিঠে মাথা ঠেকালো পরম আবেশে। জোহানের সাথে এরকম করে আর কবে সাইকেলে ঘোরা হবে তা জানে না ও। কোনো ঠিক নেই তার! মিতুল চোখ বন্ধ করলো। চোখের পাতা ভিজে উঠলো অশ্রুতে। একটু পরে মিতুল চোখ খুললো। জোহানকে ডাকলো,
“জোহান!”
“বলো।”
“আমি ছাড়া আর কোনো মেয়েকে জীবনে সাইকেলে উঠাবে না। এ জায়গাটা শুধু আমার। আমিই কেবল তোমার সাইকেলে উঠে তোমাকে এভাবে আঁকড়ে ধরবো। আর কেউ পারবে না।”
জোহানের সাইকেলের গতি ধীরই ছিল। প্রথমে জোরে চালালেও পরে ধীর করে ফেলে গতি। মিতুলের কথা যেন ধীর গতিটাকে আরও ধীর করে দিলো।
মিতুল আবারও ডেকে উঠলো জোহানকে,
“শোনো…”
জোহানের সাড়া দিতে হলো না। মিতুল তার আগেই বলতে লাগলো,
“আর কখনো কোনো মেয়েকে জড়িয়ে ধরবে না তুমি। যদি কেউ জড়িয়ে ধরতে আসে তবে দূরে সরে যাবে। তোমার উষ্ণ আলিঙ্গন অন্য কারো জন্য নয়। ওটা শুধু আমার প্রাপ্তি হবে।”
থামলো মিতুল।
জোহান কিছু বললো না। শুধু নীরবে শুনে গেল। হয়তো অন্যসময় হলে মিতুলের কথা নিয়ে অনেক মজা করতো। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। হৃদয়টা ছটফট করেই চলছে!
জোহান আবারও পিছন থেকে মিতুলের কণ্ঠ শুনতে পেল,
“আরও একটা কথা, তোমার যে বাংলা শেখার তিনটা বই আছে, ওগুলো আর কখনো স্পর্শ করবে না। একদমই বাংলা শিখবে না তুমি। আমি রেগে গেলে বাংলাতে বকবো তোমায়। আমার বকুনিগুলো তোমার কাছে বোধগম্য না থাক। তুমি শুধু, ‘চু চু’ করবে, কখনও যেন ‘চুবিয়ে’ না বলতে পারো।”
জোহান চুপচাপ মিতুলের উপদেশ শুনতে লাগলো। মিতুলের বলা এখনও শেষ হয়নি। ও আবার বলতে শুরু করলো,
“আর হ্যাঁ, মদ! জীবনে আর একবারও মদ জাতীয় কিছু স্পর্শ করবে না। যদি করো, তবে সত্যি সত্যিই আর কানাডা আসবো না আমি। আমাকে আর দেখতে পাবে না কোনোদিন। সুতরাং ওগুলো একদম ছুঁয়ে দেখবে না। তোমার বন্ধুরা ড্রিঙ্কস করলে, তুমি তাদের সাথে জুস দিয়ে চিয়ার্স করবে।”
জোহান নীরব থাকলো। ড্রিঙ্কস করা আগেই ছেড়ে দিয়েছে ও। আগে বেশিই মমের জন্য কষ্ট হতো বলে ড্রিংকস করতো। কিন্তু মিতুল আসার পর কমে গেছে সেটা। ধীরে ধীরে একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছে।
মিতুল নিশ্চুপ। জোহান মিতুলকে নিশ্চুপ দেখে বললো,
“আর কিছু বলবে না?”
“হুম, বলবো।”
“বলো তাহলে।”
“তুমি লেনির প্রোপোজ একসেপ্ট না করে একেবারে ঠিক কাজ করেছিলে।”
জোহান মিতুলের কথা শুনে হেসে দিলো।
“লেনি?”
“হুম।”
জোহান সাইকেল থামালো। মিতুল সাথে সাথে জোহানকে ছেড়ে দিলো। জোহান মিতুলের দিকে ফিরে বললো,
“তুমি চলে গেলে তোমাকে কতটা মিস করবো সেই পরিমাণটা আমি হিসেব করতে পারছি না তুলতুল!”
মিতুলের এমনিতেই কান্না উদ্বেল ভাব। জোহানের এই কথায় চোখ ফেঁটে অশ্রু গড়িয়ে পড়ার মতো অবস্থা। মিতুল খুব কষ্টে নিজের কান্না চেপে রাখলো।
________________
এই রুমে আর থাকা হবে না মিতুলের। উইন্ডোর কাছে দাঁড়ালে চেরি গাছগুলো দেখতে পাবে না আর। আজকে শেষ দিন ওর। কানাডাতে শুধু আজ একটা দিন অবশিষ্ট আছে। কাল সকালেই বিদায় নিতে হবে কানাডার বুক থেকে। মিতুলের জানা ছিল না জোহান কালকে টরন্টো যাচ্ছে। ওর মন খারাপ হবে দেখে জোহান জানায়নি আগে। কিন্তু কালকে রাতে বলেছে। সাইকেল ভ্রমণ শেষে যখন বাড়ি ফিরেছিল তখন বলেছে কথাটা। সত্যিই, কথাটা শুনে মিতুলের খুব বেশি মন খারাপ হয়েছে। শেষ মুহূর্তে জোহানকে দেখতে পাবে না! জোহানের ফ্লাইট ওর আগে। ওর ফ্লাইট সকাল নয়টায়, আর জোহানের সকাল ছয়টায়। তিন ঘণ্টার ব্যবধান। ভাবা যায়? এই তিন ঘণ্টা কানাডা থাকলেও ও জোহানকে দেখতে পাবে না! এই তিন ঘণ্টা সময় তো খুব কম নয়! এই তিন ঘণ্টা সময়ে জোহানকে আরও ভালো করে দেখে নেওয়া যেত। মিতুল দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
আজ অনেক কাজ ওর হাতে। দুপুরে রান্না করবে ও। মূলত জোহানের জন্য। কিন্তু বাড়ির সবাইকেই খাওয়াবে। মিতুল কী কী রান্না করবে সব ঠিক করে রেখেছে। ভাত, মাছ আর মুরগি। এই তিন আইটেম ও রান্না করবে। এর থেকে বেশি কিছু রান্না করার প্রয়োজন হলে ক্যামিলা করবে।
দুপুরে রান্না করতে সুবিধাই হলো মিতুলের। কেউ বাড়িতে ছিল না। রেশমী আন্টিও শপে গেছেন আজকে। তবে যেকোনো সময় চলে আসতে পারেন। তার আসা যাওয়ার ধরা বাধা নিয়ম নেই। যখন খুশি তখন যেতে পারেন, আবার আসতে পারেন।
রান্না শেষে মিতুল গোসলটা সেরে নিলো। জোহানকে সকালে একবার দেখেছিল। যখন জিম থেকে ফিরেছিল জোহান। এরপর আর একবারও দেখেনি। জিম থেকে ফিরে ঘুম দিয়েছে। জোহান বড্ড বেশি ঘুমায়। মিতুল এই জিনিসটা ঠাহর করতে পেরেছে। ঘুমকাতুরে একটা!
মিতুল খয়েরি রঙের থ্রি পিস পরেছে। কানাডা আসার পর যে থ্রি পিসটা প্রথম পরেছিল। মিতুল এর আগে জানতো জোহান থ্রি পিস খুব অপছন্দ করে। কিন্তু তা না। আসলে জোহানের থ্রি পিস পছন্দ। কালকে বললো, থ্রি পিসে না কি ওকে খুব সুন্দর লাগে। জোহানই আজকে এই থ্রি পিসটা পরতে বলেছে। জোহান আসলে খুব কঠিন একটা মানুষ। সহজে বোঝা যায় না ওকে। কালকে বললো ওকে থ্রি পিসে খুব সুন্দর লাগে। অথচ প্রথম যেদিন ওকে থ্রি পিস পরা দেখেছিল, সেদিন কত কী বলেই না অপমান করেছিল। উহ! সেসব আর মনে করতে চায় না ও। পুরোনো অপমানগুলোর কথা মনে পড়লে মাঝে মধ্যে এখনও খুব রাগ হয় জোহানের প্রতি। তবে আজকে কোনো রাগ নয়। আজকে কানাডাতে শেষ দিন, জোহানের সাথেও শেষ দিন। সুতরাং রাগের ধার কাছ দিয়েও যাবে না আজ। মিতুল ঠিক করেছে আজকে নিজ হাতে খাইয়ে দেবে জোহানকে। বাড়িতে বসে এই রিস্ক নেওয়া যায় না। রেশমী আন্টি ফেরেননি এখনও। তবে কখন ফিরবে তার কোনো ঠিক নেই। যখন তখন চলে আসতে পারে। জোহানের খাবার নিয়ে টাইম হাউজে যাবে ও।
যেমন ভাবনা তেমন কাজ। মিতুল জোহানের খাবার নিয়ে টাইম হাউজে এসেছে। দরজা লক। চাবি তো নেই ওর কাছে। মিতুল হাতের ট্রে সিঁড়িতে নামিয়ে রেখে জোহানকে কল দিলো। ঘুমকাতুরে উঠেছে কি না সেটাই সন্দেহ। কল রিসিভ হলো। ও প্রান্ত থেকে ঘুম ঘুম কণ্ঠ শোনা গেল,
“ইট’স জোহান। হু স্পিকিং?”
“তোমার ঘুম এখনও ভাঙেনি?”
“এটা কি তুলতুল?”
“হ্যাঁ, আমি। তোমার টাইম হাউজের সামনে বসে আছি লাঞ্চ নিয়ে। দ্রুত আসো।”
কল কেটে দেওয়ার দশ, পনেরো মিনিট পরই জোহানকে দেখা গেল। কোনো ঘুম ঘুম ভাব নেই জোহানের মাঝে। বাদামি চুল, পোশাক-আশাক সবই পরিপাটি। হঠাৎ করে গোছানো স্বভাবের হয়ে গেল না কি জোহান?
জোহান কিছু না বলেই দরজা খুললো। তারপর বললো,
“স্যরি এত সময় ঘুমানোর জন্য।”
“তোমার ঘুম তুমি ঘুমাবে, এখানে আমাকে স্যরি বলার কী আছে?”
“আছে অনেক কিছু, সেটা উল্লেখ করতে চাই না। ভিতরে এসো।”
মিতুল ট্রে নিয়ে টাইম হাউজে প্রবেশ করলো। ফ্রিসিয়াস ফুলের মিষ্টি সুবাস এসে নাকে লাগলো। মিতুলের হঠাৎ কৌতূহল হলো, জোহানের প্রিয় ফুল কী? একদিন বারান্দা থেকে লাল রঙা একটা ফুল কানে গুঁজেছিল, সেদিন জোহান বলেছিল, এটা ওর প্রিয় ফুল নয়। ওর ব্রাদারের প্রিয়। জোহানের প্রিয় ফুল কী? এই ফ্রিসিয়াস না কি?
মিতুল প্রশ্নটা করেই বসলো জোহানকে,
“ফ্রিসিয়াস কি তোমার প্রিয় ফুল?”
জোহান উত্তর দিলো,
“কোনো ফুলই আমার প্রিয় নয়। তবে ফ্রিসিয়াস ফুল একটু একটু পছন্দ করি। স্মেলটা ভালো লাগে আমার।”
জোহানের কথা শুনে মিতুল অবাক। বললো,
“তুমিই বোধহয় প্রথম ব্যক্তি যার কি না ফুল পছন্দ নয়।”
জোহান একটু হাসলো।
মিতুল বললো,
“আমার কিন্তু ফুল ভীষণ প্রিয়। পরের বার যখন আসবো তখন তোমার টাইম হাউজ আমি ফুলে ফুলে ভরিয়ে দেবো। আপত্তি করতে পারবে না।”
“ফুলে ফুলে ভরিয়ে দিয়ো সমস্যা নেই। তবে এত ফুলের মাঝে আমার জন্যও একটু জায়গা রেখো।”
মিতুল হাসলো। কাউচের সামনের টি টেবিলে ট্রে রাখলো। এটা নতুন টি টেবিল। কিছুদিন আগে জোহান কিনেছে। মিতুল হেয়ার রাবার দিয়ে চুলগুলো বেঁধে নিলো। জোহানের দেওয়া হেয়ার রাবার এটা। সাথে সাথেই রাখে।
জোহান বললো,
“নিজে রান্না করেছো?”
“হুম। ভাত, মাছ, মুরগি।”
বলতে বলতে কিচেনের দিকে গেল। পানি নিয়ে এলো এবং হাত ধুয়ে এসেছে।
মিতুলের পরনে যে থ্রি পিস সেটা আগে খেয়াল করেনি জোহান। খেয়াল হতেই বললো,
“বিয়ের পর বেশিই থ্রি পিস পরবে তুলতুল। খুব সুন্দর লাগে তোমাকে।”
মিতুল লজ্জা পেল জোহানের থেকে প্রশংসা শুনে। মানুষ শাড়ি পরলে প্রশংসা করে। আর জোহান ওকে থ্রি পিসে প্রশংসা করছে। ভালো লাগলো মিতুলের। মিতুল লজ্জা মাখা মুখ নিয়ে জোহানের পাশে বসলো। লজ্জাটা কোনো রকমে চেপে রেখে বললো,
“আজকে আমি খাইয়ে দেবো তোমায়।”
বলে খাবারের উপর থেকে ঢাকনা সরালো।
“মাছ দিয়ে খাবে আগে? না কি মুরগি দিয়ে?”
“মুরগি দিয়ে। মাছ তেমন পছন্দ নয় আমার। শেষে এক লোকমা খাবো মাছ দিয়ে। আমি বাংলাদেশি মাছ পছন্দ করি। ফুটি(পুঁটি), টেংরা(ট্যাংরা), শি…শিং আরও আছে অনেক। যেগুলোর নাম মনে নেই আমার। বাংলাদেশে গিয়ে আমার গ্র্যান্ডমাদারের কাছ থেকে জেনে বলবো তোমায়।”
জোহানের উচ্চারিত মাছের নামগুলো শুনে মুখ টিপে হাসলো মিতুল। ফুটি! টেংরা! মিতুল জোহানের মতো করে বললো,
“ফুটি, টেংরা মাছ পছন্দ তোমার? কী করে এগুলো পছন্দ হয়ে গেল তোমার?”
“বাংলাদেশে যখন গিয়েছিলাম, তখন এই মাছ খেয়েছি। ফুটি মাছগুলো ছিল খুবই ছোট ছোট। পান্তা ভাতের সাথে খেতে দিয়েছিল আমার গ্র্যান্ডমাদার।”
মিতুল অবাক হয়ে বললো,
“তুমি পান্তা ভাতও খাও?”
“খাই তো।”
মিতুল হেসে ফেললো। বললো,
“ঠিক আছে, তুমি যখন বাংলাদেশ যাবে তখন আমি পুঁটি মাছ দিয়ে তোমাকে পান্তা ভাত খেতে দেবো।”
“আমি ফুটি মাছের থেকে টেংরা মাছ বেশি পছন্দ করি।”
“ঠিক আছে, আমি তোমাকে ট্যাংরা মাছও রেঁধে খাওয়াবো।”
“শুধু ফুটি, টেংরা না তো। আমার তো আরও অনেক মাছ পছন্দ। সেগুলো খাওয়াবে না?”
“সবই খাওয়াবো। আগে তো বাংলাদেশ যাও।”
মিতুল জোহানের কথা মতো মুরগি দিয়ে খাইয়ে দিতে লাগলো জোহানকে।
জোহান একসময় বললো,
“বিয়ের পর আমাকে প্রতিদিন এভাবে খাইয়ে দিতে হবে। দেবে তো?”
মিতুল আবার লজ্জায় পড়ে গেল। বিয়ের কথা শুনলেই ওর লজ্জা লাগে। মিতুল ঠোঁটের কোণে একটু হাসি ফুঁটিয়ে বললো,
“হুম দেবো।”
(চলবে)
#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৫০
____________
ডাইনিংএ সবার শেষে এলো জোহান। আজকে সবাই একসাথে ডিনার করবে। টেবিলের এক পাশে মিতুল এবং সাদাত আঙ্কল। অন্য পাশে জায়িন, রেশমী আন্টি। রেশমী আন্টির থেকে এক চেয়ার পরে বসেছে জোহান। ক্যামিলা খাবার সার্ফ করছে। রাবার্তা সন্ধ্যা নাগাদ নিজ বাড়িতে চলে যেত। কিন্তু আজকে সেও আছে। মিতুল একবার সবার পরিচিত মুখগুলো দেখে নিলো। কালকে এমন সময় ও এই মানুষগুলোর সাথে থাকবে না। বিমানের অপরিচিত মানুষজনের মাঝে থাকতে হবে। মিতুল একেবারে কর্ণারের চেয়ারের দিকে তাকালো। জোহানের মুখটা কেমন পাথুরে লাগছে। আসার পর একই ভাবেই বসে আছে। না একবার ওর দিকে তাকিয়েছে, না অন্য কোনো দিকে। মিতুলের মাঝে একটা দ্বিগিদিক কষ্টের অনুভব হচ্ছে। জোহানের মুখের দিকে তাকালেই মন বলে উঠছে, ‘কানাডা থেকে যাওয়ার দরকার নেই তোমার। জোহানের সাথে থাকো।’
মিতুলের মনে হলো ওর মনটা বড়ো আজিব। কতদিন হয়েছে মা, আব্বু এবং ভাইদের দেখেনি! কোথায় তাদের দেখার জন্য আরও উচ্ছ্বসিত মনে বাংলাদেশ ফেরা উচিত ওর। কিন্তু তা না, জোহানের জন্য ওর এই কানাডা ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করছে না। ভালোবাসা হয়তো এমনই হয়! মিতুল সকলের অগোচরে ছোট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে মিতুল জোহানকে দেখছে। জোহান সামনে খাবার নিয়ে বসে রয়েছে, কিন্তু মুখে কিছু তুলছে না। মিতুল বেশ বুঝতে পারছে ও যাবে বলে জোহান এরকম করছে। জোহানের মন খারাপ। রেশমী আন্টি আজকে মিতুলকে যত্নআত্তি করে খাওয়াচ্ছে। কিছু না নিতে চাইলেও জোর করে প্লেটে তুলে দিচ্ছে। রেশমী আন্টি ওকে যত্ন করছে, কিন্তু ওদিকে যে জোহান কিছু খাচ্ছে না, সেদিকে তার খেয়াল নেই। অনেক সময় পর জোহানের দিকে খেয়াল হলো তার। বললেন,
“তুমি এভাবে বসে আছো কেন? খাচ্ছ না কেন?”
“আমার খিদে নেই।” বলেই উঠে চলে গেল জোহান।
ওর এই আচরণে সবাই অবাক হলো। মিতুল অনুভব করলো আরও তিক্ত কষ্ট।
জায়িন ধরতে পারলো ব্যাপারটা। বললো,
“ওর আবার কী হলো?”
তারপর মিতুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুমি কিছু জানো?”
মিতুল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। জায়িনের এমন প্রশ্নে উত্তর দিতে গিয়ে গলা কিছুটা কাঁপলো।
“আমি জা-জানি না কিছু। ওর সাথে আমার কথাই হয়নি আজকে।”
মিতুল মিথ্যা বললো। আজকে দুপুরে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছে জোহানকে। বিকেলে আবার জোহানের সাথে চার্চিল স্কয়ারও ঘুরতে গিয়েছিল। কথা তো অবশ্যই হয়েছে। একটু আধটু নয়। অনেক কথাই হয়েছে। তবে চার্চিল স্কয়ার থেকে ফিরে আর জোহানের সাথে দেখা হয়নি। ডিনারে হলো এই।
সবার খাওয়া আগেই হয়ে গেল। মিতুলের হলো দেরিতে। খুব কষ্টে গলা দিয়ে খাবার নামিয়েছে। খাওয়া শেষ হলে রুমে না গিয়ে জোহানের রুমে এলো প্রথমে। জোহান টরন্টো যাবে বলে নিজের ব্যাগ প্যাক করছে। ও এসেছে টের পেয়েও তাকালো না। মিতুল বললো,
“ডিনারে কিছু খেলে না কেন?”
জোহান মিতুলের দিকে তাকালো না। নিজের কাজ অব্যাহত রেখে বললো,
“এমনি।”
“সত্যিই এমনি?”
“হুম।”
মিতুল আর কিছু বলতে পারলো না। বুকের মাঝে চিনচিনে একটা ব্যথা হচ্ছে। কিছু না বলেই চলে এলো।
রাতের ঘুমটা আড়ি করে বসলো। চোখে ধরা দেবে না বলে জেদ ধরেছে। মিতুল বিছানায় শুয়ে থাকতে পারলো না বেশি সময়। পনেরো মিনিটের মাথায় উঠে গেল। জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো। এডমন্টন রাতের অন্ধকারে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। এই নিঃশ্বাস যেন মর্মান্তিক। হৃদয় চৌচির হয়। মিতুল বাইরে তাকিয়ে থাকতে পারলো না। চোখ ফিরিয়ে আনলো। দৃষ্টি পড়লো বাম হাতে। কালো হেয়ার রাবারটা হাতে বন্দি। মিতুল আলতো করে পরশ বুলালো হেয়ার রাবারের গায়ে।
মোবাইলে ম্যাসেজ আসার শব্দে মিতুলের চোখ বিছানায় গেল। ওর মন বলছে জোহান ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। মিতুল দৌঁড়ে এলো।
হ্যাঁ, জোহানের ম্যাসেজ। মিতুলের কষ্ট মনে একটু আনন্দ অনুভব হলো। ম্যাসেজ সিন করে দেখলো,
‘তুমি কি ঘুমিয়েছো? বোধহয় ঘুমাওনি। লনে এসো। বসে আছি। দুই মগ কফিতে শেষ রাত্রি কাটুক তোমার সাথে।’
‘শেষ রাত্রি’ লেখাটা দেখে মিতুলের বুক হু হু করে উঠলো। কী ছিল এই কথাতে? হৃদয়ে লাগলো খুব!
মিতুল একটা সোয়েটার পরে রুম থেকে বের হলো।
বাড়ি নিস্তব্ধ, ঘুমন্তপুরী। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে সবাই এখন ঘুমে বিভোর। শুধু দুজন জাগ্রত মানুষের অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে। মিতুল এবং জোহানের। প্রবেশ দরজা খুলতে একটু চাপা শব্দ হলো। নিস্তব্ধ পরিবেশে চাপা শব্দটাও যেন একটু জোরে শোনালো। মিতুল ঘর থেকে বের হয়ে দরজাটা আবার চেপে রাখলো। আকাশের গায়ে বাঁকা একটা চাঁদ দেখা যাচ্ছে। সে চাঁদ আলো ছড়াচ্ছে না তেমন। এই আবছা চাঁদের আলো আর রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের ক্ষীণ আলোতে দেখতে পেল জোহান বাম পাশের ইজি চেয়ারটায় বসে আছে।
মিতুল এগিয়ে এলো। নিশ্চুপ জোহানের পাশের চেয়ারটায় বসলো। জোহানও শব্দহীন কফির মগটা এগিয়ে দিলো ওর দিকে। মিতুল নিলো। কোনো কথা আসছে না ওর মাঝে। মস্তিষ্ক বলার জন্য শব্দ সাজিয়ে একটা বাক্য তৈরি করতে অক্ষম এই মুহূর্তে।
দুই তিন মিনিট নীরবে কেটে গেল। প্রথম কথা বললো জোহান,
“জানো মিতুল, আমার আগে বাড়িতে থাকতে ভালো লাগতো না। আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম না বাড়িতে থাকতে। একাকীত্ব লাগতো। বেশিরভাগ সময় বাইরে কাটাতাম। কিন্তু যেই থেকে তুমি এসেছো, সেই থেকে আমার বেশিরভাগ সময় বাড়িতেই কেটেছে। এখন বাড়িতে থাকতেই ভালো লাগে আমার। একাকিত্ব বোধটা আর হয় না।”
জোহানের কণ্ঠ ধীর এবং শান্ত।
জোহানের এই ধীর, শান্ত কথাগুলো গাঢ় দাগ কেটে দিলো মিতুলের মনে।
জোহান আবার বলতে লাগলো,
“যেদিন তোমায় প্রথম দেখেছিলাম, সেদিন তোমার উপর খুব বিরক্ত লেগেছিল আমার। কতটা বিরক্ত লেগেছিল সেটা বলতে পারব না আমি। ক্যামিলার কাছে গিয়েও অনেক কিছু বলেছিলাম বিরক্তি নিয়ে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘ওই সিক গার্লটা কে?’
ক্যামিলা বলেছিল, বাংলাদেশ থেকে এসেছো তুমি। তিন মাসের ভিসা নিয়ে। আমাদের বাড়িতে থাকবে।
কথাটা শুনে খুব মেজাজ খারাপ হয়েছিল।
পরের দিন যখন শুনলাম তুমি ক্যামিলার কাছে গিয়ে আমার কথা জিজ্ঞেস করেছো এবং আমাকে উদ্ভট, মদখোর বলেছো, তখন অনেক রাগ হলো আমার। এই রাগটা তোমার উপর কীভাবে মেটাবো সেটাই ভাবছিলাম আমি মনে মনে। সুযোগটা মম করে দিয়েছিল। তোমাকে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যেতে বলেছিল মম। আমার মনে হয়েছিল এটাই মোক্ষম সুযোগ তোমার উপর রাগ মেটানোর। তাই কোনো কথা ছাড়াই রাজি হয়ে গিয়েছিলাম তোমাকে ঘুরতে নিয়ে যেতে।
পিছনে না বসে সামনে এসে বসতে বলেছিলাম বলে তুমি রাগ করে আমার গাড়িতে উঠলে। ফুলো নাক নিয়ে বসলে আমার পাশে।
তোমার ওই রাগে ফুলো নাকটাই আসলে সব শেষ করে দিয়েছিল। আমার এত এত জমানো রাগ তোমার ওই রাগী ফুলো নাকটার জন্য শেষ হয়ে যায়। আমি ধারণা করেছিলাম তোমার রাগ খুব বেশি। এই বেশির পরিমাণটা ঠিক কত সেটা যাচাই করতে হঠাৎ ইচ্ছা হয়েছিল আমার। তাই যখন তুমি তোমার নাম বলেছিলে, আমি ইচ্ছা করে তোমার নামকে ‘তুলতুল’ বলেছিলাম। পরে মনে হলো তুলতুল নামটা তোমার সাথে খুব ভালো খাপ খেয়েছে। তোমাকে নাক ফুলো তুলতুল বললে মন্দ হবে না।”
জোহান এইটুকু বলে থামলো।
মিতুলের হলো একটু চিন্তাবোধ, ওর রাগ কি আসলেই বেশি?
“তুলতুল নামটা শুনে যে তুমি বেশ রেগে গিয়েছিলে, সেটা বুঝতে পেরেছিলাম। যদিও তুমি তোমার রাগটা প্রকাশ করোনি আমার কাছে। আমার হঠাৎ মনে হলো তোমাকে কেন যেন রাগাতে ভালো লাগছে আমার। আরও অনেক কিছু বললাম তাই তোমাকে রাগানোর জন্য। আর তুমি কেমন করে রেগে গেলে সেটা তো…”
কথা শেষ না করে হাসলো জোহান।
“তোমাকে রাগানোটা আমি দৈনন্দিন রুটিনের ভিতর রেখেছিলাম। তোমার ওই রাগে ফুলো নাকটা সবসময় দেখতে ইচ্ছে করতো আমার। আর তুমি রেগেও যে যাও সহজে, সে জন্য আরও বেশি সুবিধা। ইচ্ছাটা অপূর্ণ থাকে না।”
মিতুল চুপচাপ শুনতে লাগলো জোহানের কথা। দুজনের একজনেরও কফির মগে চুমুক দেওয়া হচ্ছে না।
জোহান অন্য প্রসঙ্গে আসলো।
“কার্লের সাথে প্রথম মিটের দিন তোমার খুশি মাখা মুখ, তোমার কথা বলার ধরণ দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম কার্লের প্রতি তোমার একটা অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে! তখন আমার খুব রাগ হয়েছিল, হিংসা হয়েছিল। মোটেই সহ্য করতে পারিনি আমি ওটা। তাই তোমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে এসেছিলাম। তোমার সাথে রাগারাগি হলো গাড়িতে বসে। রাগের মাথায় তোমাকে নামিয়ে দিলাম গাড়ি থেকে। বাড়িতে এসে খুব অস্থিরতায় পড়ে গেলাম। শুধু ভাবতে লাগলাম কার্লের ব্যাপারটা। এমন কেন লেগেছিল আমার? কেন একদমই সহ্য করতে পারছিলাম না কার্লকে? সারা রাত ধরেই শুধু এটা ভেবে গেলাম।
তখন তোমার প্রতি আমার ভালোলাগা ছিল শুধু। তখনও বুঝে উঠতে পারিনি তোমার প্রতি আমার ভালোলাগাটা ঠিক অন্যরকমের। এটা বুঝতে পেরেছিলাম সেকেন্ড টাইম যখন কার্লের সাথে দেখেছিলাম তোমাকে। সেদিন কার্লের সাথে দেখে আরও বেশি রাগ হয়েছিল। ইচ্ছা করছিল কফি শপ থেকে টেনে নিয়ে আসি তোমাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি আমার ইচ্ছাটা দমিয়ে রাখলাম। সেদিন বাড়িতে এসে আবার অস্থিরতা শুরু হলো আমার। আমার মোটেই সহ্য হয় না কার্লের সাথে তোমাকে। কেন এমন হচ্ছিল? ভাবলাম। খুব গভীর ভাবে ভাবলাম। তখন আমার মনে হয়েছে তোমার প্রতি আমার ভালোলাগাটা আস্তে আস্তে ভালোবাসার দিকে ধাবিত হচ্ছে। তারপরেই আমি কার্লের ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছিলাম। জানতে পেরেছিলাম ওর গার্লফ্রেন্ড আছে এবং তার সাথে ওর এনগেজড হয়ে গেছে। তবুও ওর সাথে তোমার দেখা সাক্ষাৎ আমার সহ্য হতো না।”
মিতুল বিস্ময়ের ঘোরে বলে উঠলো,
“তুমি এত আগে থেকে জানতে কার্লের গার্লফ্রেন্ড আছে? তুমি খোঁজ নিয়েছিলে ওর ব্যাপারে? কিন্তু আমাকে যে বললে একটা মেয়ের সাথে কার্লকে ঘুরতে দেখে তুমি ধারণা করেছো ওটা কার্লের গার্লফ্রেন্ড? যদি এত আগে থেকেই জানতে তাহলে আমাকে বলোনি কেন?”
“দেখতে চেয়েছিলাম ঠিক কী হয়। কারণ আমার মনে হয়েছিল কার্লের প্রতি তোমার যে অনুভূতি আছে ওটা প্রকৃত অনুভূতি নয়। ওটা কেবল ভালো লাগার মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, শুধু আমার নয়, তোমারও একটা অনুভূতি তৈরি হচ্ছে আমার প্রতি। যেটা কি না আসল।”
মিতুল কী বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না।
জোহান শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বললো,
“তোমার প্রতি আমার অনুভূতি আছে সেটা আমি সহজে বুঝতে পারলেও, তুমি পারোনি। আমার প্রতি যে তোমার অনুভূতি আছে সেটা বুঝতে পারোনি তুমি। মনে মনে আমার জন্য অনুভূতি থাকলেও তুমি সেটা বোঝার চেষ্টা করোনি। তুমি ছুটেছো কার্লের পিছনে। তোমার আসল অনুভূতি তুমি বুঝতে না পারার মাঝে কার্লই ছিল প্রতিবন্ধকতা। কার্ল ছিল বলেই তুমি আমার প্রতি নিজের অনুভূতি বুঝতে পারোনি। হয়তো ভাবতেই চাওনি এটা নিয়ে।”
মিতুলের হঠাৎ নিজেকে গাধা মনে হলো। জোহান এত সহজে এই ব্যাপারটা বুঝতে পারলো, আর ও কি না এত কিছুর পরও বুঝতে পারেনি। জোহান কত বার, কত ভাবে, কত কী বললো তাও বুঝতে পারেনি। কিন্তু এখন বুঝতে পারে। এখন এগুলো পানির মতো পরিষ্কার ওর কাছে। তবে দোষ তো শুধু নিজের দিলেই চলবে না। জোহানেরও দোষ ছিল। জোহান যখন কথাগুলো বলতো, তখনই ভাবনায় ডুবে যেত ও। যখন একটু ভাবনার গভীরে পৌঁছাতো, ঠিক তখনই জোহান নিজে এসে ওর ভাবনায় ছেদ ফেলতো। সবসময় ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলতো, সহজ ভাবে তো বলতো না কখনো।
জোহানের কণ্ঠ কানে এলো আবার।
“ও আরও একটা কথা। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, যেদিন আমরা রিকার্ডোর বাসায় পার্টি শেষে বাড়ি ফিরছিলাম তখন আমাকে মেরেছিল ওই চারজন?”
“হুম মনে আছে।”
“ওইদিন কিন্তু আমি ইচ্ছাকৃত ভাবে মার খেয়েছি।”
জোহানের কথা শুনে মিতুল বিস্মিত হলো।
“ইচ্ছাকৃতভাবে মানে?”
“হ্যাঁ। আমি তো ওইদিন গাড়ি না থামিয়ে সোজা চালিয়েই আসতে পারতাম। ওরা ভয় পেয়ে উল্টো রাস্তা থেকে পালাতো। কিন্তু আমি তা করিনি। তুমি সাথে না থাকলে গাড়ি না থামিয়ে সোজা চালিয়েই আসতাম। তুমি সাথে ছিলে বলে করিনি ওটা। কারণ আমি চাইছিলাম তুমি আমাকে মার খেতে দেখো…”
মিতুল কিছুই বুঝতে পারছে না। জোহান কেন ওকে দেখানোর জন্য মার খেলো?
“আমি দেখতে চাইছিলাম তুমি ঠিক আমাকে মার খেতে দেখে কতটা উতলা হও। আমি দেখেছি সেটা। আমি মার খাওয়ার পর আমার মম কখনও আমার জন্য এতটা উতলা হয়নি। তিনি বিরক্তবোধ করতেন। কিন্তু তোমার মাঝে আমি সেটা দেখেছি, যেটা আমি দেখতে চেয়েছিলাম।”
মিতুলের হৃদয়ে শুভ্র অনুভূতি ছুঁয়ে গেল।
“আমার মম আগের মতো অতটা উদাসীন আচরণ করে না আমার সাথে। যখন ছোট ছিলাম তখন একটু বেশিই কেয়ারলেস ছিল সে আমার প্রতি। কিন্তু বড়ো হওয়ার পর তিনি যেন কিছুটা কেয়ারিং হয়েছে আমার প্রতি।”
মিতুল বললো,
“তোমার মম কিছুটা নয় জোহান, একসময় অনেকটা কেয়ার করবে তোমার।”
“এটা কি সান্ত্বনা?”
“না, এটা আমার মনের কথা। আমার মন বলছে তোমার আর তোমার মমের মাঝের দূরত্বটা ঘুচে যাবে। তোমার ব্রাদারের মতোই ভালোবাসবে সে তোমায়।”
জোহান কিছু বললো না। শুধু নিঝুম হাসির রেখা দেখা গেল ঠোঁটের কোণে।
ক্ষণিকের জন্য নীরবতা নামলো।
প্রথমে নীরবতা ভাঙলো মিতুল। ভীত কণ্ঠে বললো,
“কারো যদি এখন ঘুম ভেঙে যায়, আর আমাদের এখানে একসাথে দেখে ফেলে, তাহলে কী হবে?”
“দেখে ফেললে ভালোই হতো। কিন্তু আফসোস কেউ দেখবে না।”
“দেখে ফেললে ভালো হতো কেন?”
“বলে দিতে সুবিধা হতো।”
মিতুল প্রথমে বুঝতে পারলো না জোহান কী বলে দেওয়ার কথা বলছে। যখন কথাটা বুঝতে পারলো তখন বলে উঠলো,
“এই না না, আমাদের ব্যাপারে এখন কাউকে কিছু বলবে না। আমার আব্বু খুব কঠোর। যদি এটা এভাবে জানতে পারে তাহলে বিশাল কেলেঙ্কারি হবে।”
“কী কেলেঙ্কারি হবে?”
“কী কেলেঙ্কারি হবে সেটা ঠিক আমি জানি না। তবে ধারণা করতে পারছি। হয় আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে, নয়তো অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দেবে!”
মিতুলের কথা শুনে জোহান হেসে উঠলো।
“কী ব্যাপার হাসছো কেন? আমার কথাকে মজা মনে হচ্ছে?”
“উহ মিতুল, কাউকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া এবং অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দেওয়া কি এতই সহজ? ঠিক আছে, তোমায় যদি বাড়ি থেকে বের করে দেয়, তাহলে আমি কানাডা নিয়ে আসবো তোমায়। আর যদি অন্য কোথাও বিয়ে দিতে চায়, তাহলে সেই ছেলের নাক ঘুষি মেরে ফাটিয়ে দেবো। মারামারিতে ভালোই পারদর্শী আমি।”
“এটা মজা নয় জোহান, সিরিয়াস। এই ব্যাপারটা এভাবে জানানো যাবে না কাউকে। ধীরে ধীরে বোঝাতে হবে।”
“কতটা ধীর?”
“যতটা সম্ভব।”
“আমি কিন্তু এত ধীর স্বভাবের নই। খুবই ফাস্ট।”
“এর মানে কী? তুমি দ্রুত বলে দেবে?”
“দেখি।”
“হুম, দেখতে গিয়ে আমাকে ফুটপাতে নামিয়ে দাও।”
জোহান একটু হাসলো। তারপর ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো।
আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
“সময়টা কি দ্রুত কেটে গেছে? আমার কেন মনে হচ্ছে যে তোমার কানাডাতে এখনও তিন মাস পূরণ হয়নি? এটা কি আমার ভুল? না কি সময়ের?”
মিতুল যে কষ্টটা একটু ভুলে গিয়েছিল সেই কষ্ট আবারও হৃদয় ছেয়ে ফেললো।
মিতুল আনমনে বলে ফেললো,
“এটা হৃদয়ের ভুল!”
কেটে গেল অনেকটা সময়। জোহান এক সময় বললো,
“তোমার ঘুমানো উচিত। কানাডা থেকে বাংলাদেশ কম জার্নি নয়।”
“আরও কিছুটা সময় থাকি না। কাল থেকে তো আর একসাথে থাকা হবে না। দুজন থাকবো পৃথিবীর দু প্রান্তে। দীর্ঘ একটা ব্যবধান! এই দীর্ঘ ব্যবধানের সমাপ্তি কবে ঘটবে সেটা তো কেউই জানি না।”
মিতুলের কথা জোহানের গলা থেকে স্বর কেড়ে নিলো। হৃদয়ে জন্ম দিলো একটা ব্যথার উপস্থিতি। থাকা হলো এখানে কিছুটা সময়। তবে খুব নীরব। পরিবেশ নীরব হলেও, ভিতরে ঝড় বইছে। কিন্তু সেই ঝড় গোপনীয়। ভিতরে বয়ে চলা এই ঝড় যদি বাইরে প্রকাশ পেতো, তবে পরিবেশ আর তার নীরবতা ধরে রাখতে পারতো না।
____________
আজকে সকালটাই শুরু হলো ভীষণ তিক্ততা নিয়ে। জীবনে এত তিক্ত সকাল আর আসেনি মিতুলের। কালকে সারারাত চোখে ঘুম ছিল না। যা ছিল তা হলো কেবল আকুলতা!
আজকে কানাডা থেকে বিদায়ের দিন। ওর বিদায়ের আগে জোহান বিদায় জানাবে ওকে। আজ শেষ বারের মতো দেখতে পাবে জোহানকে। মিতুলের হৃদয় চৌচির হয়ে যাচ্ছে। এতটা কষ্ট জীবনে আর কবে পেয়েছিল? মিতুলের ভাবনায় এমন কষ্টের কোনো সময় ধরা দিচ্ছে না!
ঘড়িতে এখন সকাল পাঁচটা চলছে। এখনই হয়তো জোহান বেরিয়ে পড়বে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। মিতুল শেষ ক্ষণটি গুনছে। সময়টা না ফুরালেই ভালো হতো!
দরজা নকের শব্দে মিতুলের হৃদয় কেঁপে ওঠে। জোহান এসেছে?
শেষ দেখা করতে এসেছে জোহান ওর সাথে? মিতুলের কান্না উগড়ে উঠতে চাইছে। মিতুল কষ্ট হলেও অশ্রু চেপে রাখলো। দরজা আনলক করেই রেখেছে জোহানের জন্য। এখান থেকে জোহানকে বলবে দরজা আনলক করা, বা নিজে ভেজানো দরজাটা খুলবে গিয়ে, সেসব কিছুই করতে পারলো না মিতুল। উইন্ডোর কাছে দাঁড়িয়ে শুধু ভেজানো দরজার দিকে তাকিয়ে রইল।
জোহান বোধহয় বুঝতে পারলো দরজা লক করা নয়। দরজা খুললো ও।
জোহানের মুখ দেখে মিতুলের কষ্ট আরও বেড়ে গেল। এটাই সামনা-সামনি জোহানকে শেষ দেখা!
জোহান ভিতরে ঢুকে দরজাটা আবার ভিজিয়ে রাখলো। ধীর পায়ে এগিয়ে এলো মিতুলের দিকে।
মিতুল জোহানের মুখখানিতে তাকিয়ে রইল। জোহানের চোখ কেমন লাল! রাতে ঘুমায়নি জোহান। এতটুকুও ঘুমায়নি। মিতুলের বুঝতে সমস্যা হলো না সেটা।
জোহান সামনে এসে দাঁড়িয়েই হাত বাড়ালো মিতুলের গলার দিকে। মিতুলের কালো চুলের নিচ ডিঙিয়ে ঘাড়ের পিছনে হাত নিয়ে ছোট একটা নেকলেস পরিয়ে দিতে দিতে বললো,
“ড্যাডের ডলারে কিনিনি, নিজের জমানো ডলারে কিনেছি এটা।”
নেকলেস পরানো হলে জোহান হাত দিয়ে মিতুলের চুল কিছুটা ছড়িয়ে দিয়ে, হাত সরিয়ে আনলো। মিতুলের গলার দিকে তাকালো। ফর্সা গলায় একটা ছোট ডায়মন্ড চকচক করছে।
মিতুল এখনও অভিভূত। বিবশমনে হাত বাড়িয়ে গলার নেকলেসটা স্পর্শ করলো।
চোখ তুলে তাকালো। নিজের জমানো ডলারে জোহান ওর জন্য নেকলেস কিনেছে?
মিতুলের ভিতরটা আরও আবেগী হয়ে উঠলো।
জোহান বললো,
“টরন্টো যাচ্ছি, দোয়া করো। গানের ব্যাপারটার যেন ভালো কিছু হয়। ফেমাস হয়ে তোমাকে প্রথম অটোগ্রাফ দেওয়ার সৌভাগ্য যেন দ্রুতই আসে।”
জোহান একটু সময়ের জন্য থামলো। তারপর আবার বলতে শুরু করলো,
“শুভ হোক তোমার যাত্রা। বাংলাদেশে ল্যান্ড করে জানিয়ো আমায়। আর হ্যাঁ, তোমার রাগটা মানুষের সাথে একটু কম দেখিয়ো। জমিয়ে রেখো আমার জন্য। যখন আমাদের আবার দেখা হবে তখন আমরা ঝগড়া করবো। তখন সব রাগ আমার উপর ঝেড়ো।”
জোহান কথাটা কেবল শেষ করলো।
এর মধ্যেই মিতুল জোহানের বুকের কাছের গেঞ্জির কিছু অংশ টেনে জোহানকে নুইয়ে ফেললো। খুব সযতনে একটা চুমু এঁকে দিলো জোহানের গালে। সাথে সাথে চোখের কোল ছাপিয়ে অশ্রু ধারা গড়িয়ে পড়লো। মিতুল জোহানের দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বললো,
“মনে রেখো আমায়!”
জোহান কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সবকিছু অগোছালো হয়ে পড়ছে। ওর জীবনের সবচেয়ে কঠিন একটা মুহূর্ত হিসেবে এটাকে উল্লেখ করলে ভুল হবে না। বুকের ভিতরের অশান্ত ঢিপ ঢিপ শব্দটা দ্রুত থেকে আরও দ্রুত হচ্ছে। জোহান একটা শুকনো ঢোক গিললো। দুই হাতে মিতুলের গাল আলতো করে ধরে বললো,
“ভালোবাসি! আবার দেখা হবে আমাদের।”
আর দাঁড়ালো না জোহান। দ্রুত পায়ে দরজার দিকে এগোতে লাগলো।
মিতুল তাকিয়ে রইল পিছন থেকে। দু চোখ থেকে টুপটাপ করে জলের ধারা নামতে লাগলো। কারো বিদায় এতটা হৃদয়বিদারক হয় জানা ছিল না ওর। আগে কখনও এমন নির্মম বিদায়ের সাথে পরিচয় ছিল না।
মিতুলের কান্না সমাপ্তি পেল না আর। রুমের দরজা আটকে ভিতরে বসে কতটা কাঁদলো সেটা বাইরের কেউ জানলো না। চাপা একটা ক্রন্দন শব্দ শুধু এই রুমের ভিতরেই গোপন রইল।
(চলবে)