চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা পর্ব-৩৩+৩৪

0
444

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৩৩
____________

জোহানের মুখ থেকে নির্গত ফিসফিসানি সুরের, ‘ভালোবাসা’ শব্দটি মিতুলের মনে দমকা হাওয়া বইয়ে দেওয়ার সাথে সাথে কিছু একটা এলোমেলো করে দিলো। দমকা হাওয়ায় হৃদয় ছুটে যাচ্ছে বহুদূর। আর সেই সাথে কিছু একটা খুব করে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। হৃদয়ের শান্ত চলন হঠাৎ ঢিপঢিপ শুরু করে দ্রুত থেকে অধিক দ্রুততর হলো। মিতুল নিজের নিশ্চল চোখ জোড়া জোহানের মুখে ফেললো।
জোহান মিতুলের কানের কাছ থেকে মুখ সরিয়ে নিলো। মিতুল বিমূঢ়তা স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইল জোহানের দিকে।
জোহানের দৃষ্টি গেল এবার মিতুলের বাম হাতের উপর। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলো চারিদিকে বিস্তার ঘটিয়ে পরিবেশ মোটামুটি ভালোই আলোকিত করেছে। ল্যাম্পপোস্টের নিস্তেজ আলো, আর রাতের কালো ঘোলাটে আঁধার মিলে এখানের পরিবেশে কেমন একটা আবছা আবছা ভাব। জোহান মিতুলের হাতে চিকন হেয়ার রাবারের উপস্থিতি লক্ষ্য করলো। ব্রেকফাস্টের সময় এই হেয়ার রাবারটি মিতুলের হাতে দেখেছিল। কার্লের দেওয়া হেয়ার রাবার এটি।
কার্লকে আর দেখবে না বললেও, কার্লের দেওয়া হেয়ার রাবারটি এখনও যত্ন করে হাতে পরে রেখেছে মিতুল।
জোহান মিতুলের হাত উঠিয়ে মিতুলের হাত থেকে হেয়ার রাবারটি খুলে ছুঁড়ে মারলো লেকের পানিতে।
মিতুল আঁতকে উঠলো। হৃদয় যেন ছ‍্যাত করে উঠলো ওর। মিতুল দৃষ্টি ফেললো লেকের পানির পানে। হেয়ার রাবারটি লেকের পানির সাথে কোথায় গিয়ে মিলিত হয়েছে তা ওর দৃষ্টি অগোচর। মিতুল বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে লেক থেকে চোখ এনে জোহানের দিকে তাকালো।
জোহান নিজের শার্টের পকেট থেকে একটা কালো হেয়ার রাবার বের করলো। আর সেটা পরিয়ে দিলো মিতুলের বাম হাতে। একদৃষ্টিতে হেয়ার রাবারটির দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
“এবার তোমার নিজের মনের আসল চাওয়ার অনুসন্ধান করা উচিত মিতুল।”

মিতুল নির্বাক, বিহ্বল। ওর দু চোখ ঘোর বিমোহিত। হৃদয়ের কোনো একটা জায়গা ক্রমশ উল্টে যাচ্ছে ওর। পাল্টে যাচ্ছে অনুভূতি। একেকটা নিঃশ্বাসের সাথে সাথে যেন মনে অধরা, অস্পষ্ট অনুভূতি ক্রমশ তাদের তীক্ষ্ণতা ছড়াচ্ছে।

জোহান ডাকলো মিতুলকে,
“মিতুল।”

মিতুল সম্বিৎ ফিরে পেল,
“হ্যাঁ?”

জোহান দূর আকাশে অঙ্গুলি করে বললো,
“ওখানে তাকাও।”

মিতুল জোহানের অঙ্গুলি অনুসরণ করে তাকালো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বিকট একটা শব্দ হলো। আর এর পরপরই আকাশে দেখা গেল আতশবাজির ঝলকানি। মিতুলের মুখ হা হয়ে গেল। দু চোখে আচমকা মুগ্ধতার ঝলক সৃষ্টি হলো। মিতুল আতশবাজির অতল মুগ্ধতায় হারিয়ে গেল।
জোহান মুগ্ধমনা মিতুলকে দেখে শান্তি অনুভব করলো মনে। আতশবাজির ঝলকানি তখনও শেষ হয়নি। জোহান এর মাঝে বললো,
“আর হ্যাঁ তুলতুল, তুমি যে আমাকে বলো আমার এত এত গার্লফ্রেন্ড আছে, সেগুলো কিন্তু ভুল। মিথ্যা। আমার কিন্তু একটা গার্লফ্রেন্ডও নেই।”

মিতুল জোহানের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো।

জোহানের প্রতি রাগ, অভিমান, ঘৃণা কোথায় যে হারিয়ে গেল তার হদিস জানা নেই মিতুলের। জোহানের প্রতি এখন না আছে ওর রাগ, আর না আছে অভিমান। ও স্পষ্ট টের পাচ্ছে ওর অনুভূতি পাল্টে যাচ্ছে। ভিন্ন ধরণের এক অনুভূতি টের পাচ্ছে ও। একেবারে ভিন্ন নতুন এই অনুভূতি। কার্লকে প্রথম দেখে যে অনুভূতি হয়েছিল, তেমন নয় এই অনুভূতি। এই অনুভূতিকে কোনো কিছুর সাথে তুলনা করে বোঝাতে পারবে না ও।

মিতুল সারাদিন কিছু খায়নি, তাই রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে অনেক কিছু খাওয়ালো জোহান। মিতুল খেতে পারছিল না ঠিকঠাক ভাবে। ওর চোখ বার বার চলে যাচ্ছিল জোহানের উপর। জোহান ওর মন ভালো করার জন্য আতশবাজির ব্যবস্থা করেছিল, সেটা ভাবতেই অন্যরকম প্রশান্তি অনুভব হয় ওর।
ওরা যখন বাড়ি ফিরলো তখন রাত একটু গাঢ় হয়েছে। বাড়ি ফিরেই প্রথমে রেশমী আন্টির সম্মুখীন হতে হলো ওদের। যেন ওদের জন্যই এতক্ষণ ওঁৎ পেতে হলরুমে বসে ছিলেন সে। মিতুলের কেন যেন ভয় লাগছে। রেশমী আন্টির মুখটা কেমন কঠিন দেখাচ্ছে।

রেশমী ছেলের দিকে এবং মিতুলের দিকে তাকিয়ে খুব গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করে বললো,
“কোথায় গিয়েছিলে তোমরা?”

জোহান বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
“মম, এই সামান্য একটা প্রশ্ন করার জন্য এখানে দাঁড় করিয়েছ তুমি?”

রেশমীর মুখে এবার গাঢ় রাগের প্রতিফলন ঘটলো। রেশমী কঠিন গলায় বললেন,
“জোহান, যেটা জিজ্ঞেস করছি সেটার সহজ ভাবে উত্তর দাও। কোথায় গিয়েছিলে তোমরা?”

রেশমী আন্টি আবারও একই প্রশ্ন করায় ভয়ে কেঁপে উঠলো মিতুল। ওর বুক ধুকপুক করছে ভয়ে। ও চায় না রেশমী আন্টি জানুক ও জোহানের সাথে ছিল। এটা সহজ একটা ব্যাপার হলেও, রেশমী আন্টিকে জানাতে পারবে না ও। রেশমী আন্টির সামনে জায়িনের সাথে দিব্যি ঘুরে বেড়াতে পারলেও, জোহানের সাথে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলতেও ওর কেমন অস্বস্তি হয়, সংশয় হয়, ভয় হয়। না কিছুতেই বলতে পারবে না ও জোহানের সাথে ছিল।
জোহান মমের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য কেবল মুখ খুলতে নিয়েছিল। মিতুল সেটা টের পেয়েই জোহানকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,
“আসলে আন্টি! আমি আজকে সন্ধ্যায় রাস্তায় একটু হাওয়া খেতে বের হয়েছিলাম। তো সেই সময় আমার হঠাৎ ওই ফারজানার সাথে দেখা হয়। সে আমাকে ঘুরতে যাওয়ার অফার দিলো। আমি তার অফার গ্রহণ করি। এবং এতক্ষণ তার সাথে ঘুরেছি আমি। ঘোরাঘুরি শেষ হলে যখন বাসায় ফিরে আসছিলাম, তখন হঠাৎ পথে জোহানের সাথে দেখা হয়। তারপর জোহানের সাথে চলে আসি আমি।”
মিতুল একনাগাড়ে কথা গুলো বলে তো দিলো। এখন রেশমী আন্টি বিশ্বাস করলেই হয়। মিতুল নিজেও জানে না ও মুহূর্তেই কী করে এত সুন্দর মিথ্যা কাহিনী বানিয়ে ফেললো! তাও আবার ফারজানাকে টেনে! ফারজানা হলো রেশমী আন্টির একজন প্রতিবেশী। বাংলাদেশি সে। সে এবং তার হাসব্যান্ড কানাডার সিটিজেনশিপ। বারবিকিউ পার্টিতে ওর পরিচয় হয়েছিল ফারজানা এবং তার হাসব্যান্ডের সাথে।

রেশমী মিতুলের সব কথা শুনে বললেন,
“তাই?”

মিতুল জানে না রেশমী আন্টি ওর কথা বিশ্বাস করেছে কি না। তারপরেও দৃঢ়তার সাথে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো।

জোহান অবাক হয়ে দেখছে মিতুলকে। এভাবে মিথ্যা বললো মিতুল? মিথ্যা বলার কী দরকার ছিল? মিতুলকে এমন মিথ্যা বলতে দেখে ও আর কিছু বললো না।

রেশমী আন্টি কী যেন ভাবলেন মনে মনে। তারপর বললেন,
“ঠিক আছে, রুমে যাও।”

মমের মুখ থেকে কথাটি বের হতে না হতেই জোহান রুমের দিকে হাঁটা দিলো।
মিতুল এমন একটা স্বস্তি অনুভব করলো, যেন বড়ো বাঁচা বেঁচে গেছে। মিতুলও চলে এলো রুমে। ওর হুট করেই আবার জোহানকে মনে পড়ে গেল। জোহানের ফিসফিস করে বলা ‘ভালোবাসা’ শব্দটি বেজে উঠলো কানে। ভালোবাসা! হ্যাঁ, শুধু এই ভালোবাসা জিনিসটিই পায়নি কানাডা আসার পর। মিতুল মনে মনে একবার আওড়ালো,
“ভালোবাসা!”
তারপর নিজে নিজেই হেসে ফেললো। আর এই সময়েই ওর টনক নড়লো। চক্ষু দাঁড়িয়ে গেল ওর। ভালোবাসা?
জোহান যে বাংলায় ‘ভালোবাসা’ বলেছে সেটা একদম খেয়াল করেনি ও।
ভালোবাসা? বাংলা বলেছে জোহান?

__________

মায়ের কলে ঘুম ভেঙ্গে গেল মিতুলের। মিতুল কল রিসিভ করে ঘুম ঘুম কণ্ঠে বললো,
“হ্যালো মা! বলো।”

ওপাশে মায়ের তিরিক্ষি মেজাজ শুনতে পেল,
“নিষেধ করেছিলাম এদিক ওদিক এত ঘুরে বেড়াবে না। কিন্তু তুমি তো কোনো কথাই শোনো না। সারাদিন এত ঘোরাঘুরি করার কী দরকার? শোনো, ওখানে বসে অভদ্রতা করার একদম চেষ্টা করো না। এর ফল কিন্তু খুব খারাপ হবে তোমার সাথে।”

মায়ের ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বরে ঘুম উবে গেছে মিতুলের। হঠাৎ, ফোন করে এসব কী বলছে মা?
মিতুল বললো,
“মা, কীসব বলছো তুমি? কে বলেছে তোমায় যে আমি সারাদিন ঘুরে বেড়াই?”

“শোনো, ওখানে বসে তুমি কী করো, না করো সব খবরই কিন্তু আসে আমার কানে। এরপর যদি এমন কিছু শুনতে পাই তবে বুঝতেই পারছো বাংলাদেশ ফেরার পর কী অবস্থা হবে তোমার।”

মায়ের কথা শুনে আর কিছু বুঝতে বাকি থাকে না মিতুলের। তার মানে রেশমী আন্টি কমপ্লেইন করেছে মায়ের কাছে? মিতুলের মনে হলো রেশমী আন্টি খুবই খারাপ একজন মানুষ। এই এতটুকু বিষয়ও মায়ের কাছে এভাবে নালিশ জানালো? না, না আগে যে রেশমী আন্টিকে দেখেছিল, এই রেশমী আন্টি তার ধারে কাছেও নেই। প্রথম প্রথম সবাই-ই ভালো সেজে থাকতে পারে। কিন্তু তাদের সাথে বেশি দিন থাকলেই বুঝতে পারা যায় তাদের আসল রূপ। রেশমী আন্টির আসল রূপও ধরা পড়েছে। মিতুলের এসব ভাবনার মাঝেই ওর মা আরও কত শত নীতি কথা শুনিয়ে যাচ্ছিল। সেসব কিছুই শুনলো না ও। দ্রুত মায়ের কল কেটে দেওয়ার জন্য বললো,
“মা, আমি এখন ফ্রেশ হবো। ব্রেকফাস্ট করার ডাক পড়েছে আমার। আমি রাখছি। লাভ ইউ, মা!”
মাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লাইন কেটে দিলো মিতুল। ওর ভাবনা এখন রেশমী আন্টিকে নিয়ে। এই রেশমী আন্টি কী কী কথা লাগিয়েছে ওর মায়ের কানে? সারাদিন কোথায় বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায় ও? কী আজব মিথ্যাবাজ রেশমী আন্টি! অবিশ্বাস্য!
মিতুল গায়ের উপর থেকে কম্বলটা এক টানে সরিয়ে দিয়ে নেমে গেল বেড থেকে। হাই তুলতে তুলতে উইন্ডোর কাছে এসে দাঁড়ালো। পর্দা সরালো এক পাশ দিয়ে। কুয়াশা কুয়াশা ভাব বাইরে। মিতুল উইন্ডো খুললো না। জানে বাইরে এখন প্রচুর শীত। মিতুল আরও কিছুটা পর্দা ঘুটিয়ে রাখলো। হঠাৎ করে হাতের হেয়ার রাবারটির দিকে নজর পড়লো। মনে আবারও সেই অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে ওর। মিতুল হাতের হেয়ার রাবারটি স্পর্শ করলো। জোহানের ভাবনা ওর মন গহীনের অতল গহ্বরে অনুভূতির গাঢ়তা এঁকে দিচ্ছে।

___________

ব্রেকফাস্ট করে প্যাসেজ ওয়ে ধরে যাওয়ার সময় জোহানের ডাক এলো পিছন থেকে,
“হেই তুলতুল!”

মিতুল দাঁড়ালো।
জোহান মিতুলের কাছে এসে বললো,
“তুমি কালকে মিথ্যা বললে কেন মমকে? তুমি তো আমার সাথে ছিলে। তাহলে মমকে কেন বললে তুমি ফারজানার সাথে ঘুরতে গিয়েছিলে?”
জোহান ভ্রু নাচালো।

জোহানের প্রশ্নে মিতুল থতমত খেয়ে গেল। মিতুল জোহানকে বলতে পারলো না যে জোহানের ব্যাপারে রেশমী আন্টির সাথে কিছু বলতে গেলেই ওর অস্বস্তি হয়, সংশয়ে ঘিরে ধরে ও কে। মিতুল ইতস্তত করে বললো,
“আ-আসলে কালকে ক্লান্ত ছিলাম আমি। ক্লান্তিতে কী বলতে কী বলেছি নিজেরই খেয়াল নেই। আর তুমি সেটা নিয়ে এখনও পড়ে আছো?”

জোহান নিজের হাসি চেপে বললো,
“ক্লান্তিতে? ক্লান্ত ছিলে তুমি?”

মিতুল হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। ও যা যুক্তি দেখিয়েছে তা ওর নিজের কাছেই গাঁজাখুরি লাগছে। তবে উপায় নেই। এছাড়া কী ই বা বলবে আর?

জোহান মিতুলের অভিব্যক্তি দেখে আর নিজের হাসি থামিয়ে রাখতে পারল না। ফিক করে হেসে ফেললো।
“ওহ মিতুল, ভালো গল্পই বানাতে পারো তুমি। এত ভালো মিথ্যা গল্প বানাতে কবে শিখলে তুমি? মানুষ এত সুন্দর মিথ্যা কখন বলে জানো তা?”

“কখন?”

জোহান যা বলতে চেয়েছিল তা বললো না। একটু সময় নিয়ে বললো,
“যখন মানুষ ক্ষুধার্ত থাকে। পেটে ক্ষুধা থাকার কারণে মানুষ বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলায় পারদর্শী হয়ে ওঠে। কিন্তু তোমার তো ক্ষুধার্ত থাকার কথা না। আমি তো তোমাকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে অনেক কিছু খাইয়েছি। তাহলে? তুমি কি একজন বিশ্ব সেরা পেটুক না কি? যে এত কিছু খাওয়ার পরও তোমার ক্ষুধা মেটেনি!”

মিতুলের মেজাজ বিগড়ে গেল। বললো,
“আমি যদি একজন বিশ্ব সেরা পেটুক হই, তাহলে তুমি কী? তোমার নামের পাশে কোন পদবি লাগানো উচিত? বিশ্ব সেরা একজন বদমাইশ?”

জোহান বললো,
“নো তুলতুল, এটা করতে পারো না তুমি। আমার আত্মসম্মানে এভাবে আঘাত হানা উচিত নয় তোমার। আই অ্যাম অ্যা সিঙ্গার। অবশ্যই তোমার সিঙ্গার পদবি লাগানো উচিত।”

মিতুল অতিষ্ট হয়ে উঠলো। জোহানের সাথে আর কথা বাড়াতে ইচ্ছা করছে না ওর। ও ঘুরে হাঁটা শুরু করলো।

জোহান দেখলো মিতুলের চুল হেয়ার রাবার দিয়ে বাঁধা। এই রাবারটি যে ওর দেওয়া সেই রাবার, সেটা নিশ্চিত ও। জোহান আনমনে বলে উঠলো,
“আই নো তুলতুল। আমার দেওয়া হেয়ার রাবার তোমার কাছে খুব সযত্নেই থাকবে। কার্লের দেওয়া রাবারের থেকে অনেক অনেক বেশি যত্নে রাখবে তুমি এটা।”

মিতুল বারান্দায় চলে এলো। এসেই দেখলো জায়িন ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে আর্ম চেয়ারে। জায়িনকে দেখে অবাক হলো মিতুল। জায়িন বারান্দায়? অফিসে যায়নি? এতক্ষণে তো ওর অফিসে চলে যাওয়ার কথা। মিতুল বারান্দা থেকে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। অমনি পিছন থেকে শুনতে পেল,
“কী ব্যাপার? তুমি চলে যাচ্ছ কেন?”

জায়িনের কণ্ঠ মিতুলের চলন রোধ করলো। মিতুল পিছন ফিরে বললো,
“না মানে, তুমি কাজ করছিলে ভাবলাম এখানে না থাকাই ভালো আমার।”

জায়িন ল্যাপটপ বন্ধ করতে করতে বললো,
“না তেমন কোনো কাজ নেই। এসো কথা বলি তোমার সাথে।”

মিতুলের অস্বস্তি হচ্ছে। এই মুহূর্তে ঠিক কথা বলতে ইচ্ছা করছে না জায়িনের সাথে। কিন্তু জায়িন বলার পরও কথা না বলে এখান থেকে চলে যাওয়া অভদ্রতা হবে। মিতুল এগিয়ে এলো।
জায়িন ওর পাশের চেয়ারে বসতে বললো মিতুলকে। মিতুল বসলো। জায়িন বললো,
“কালকে ফারজানার সাথে ঘুরতে গিয়েছিলে, তাই না? তা কোথায় কোথায় ঘুরেছো?”

জায়িনের প্রশ্নে থমকে গেল মিতুল। জায়িন কীভাবে জানলো ও কালকে রেশমী আন্টিকে এই কথা বলেছে?

মিতুল কিছু বলছে না দেখে জায়িন বললো,
“কী হলো? বলছো না কেন? কোথায় কোথায় ঘুরলে ফারজানার সাথে?”

জায়িনের প্রশ্নে ঘাবড়ে গেল মিতুল। এই টপিক এখনও ওর পিছু ছাড়েনি! কী বলবে এখন? কোথায় ঘুরেছে বলবে? মিতুল একটু ভেবে বললো,
“উম, লেক ঘুরেছি। তারপর একটি মুভি থিয়েটারে গিয়েছিলাম। এছাড়া একটু এলাকাটা ঘুরে দেখেছি।”

জায়িন তাকিয়ে আছে মিতুলের দিকে। মিতুলের ঘাবড়ে যাওয়া চেহারা কৌতুকপূর্ণ লাগছে ওর কাছে। জায়িন মনে মনে হাসলো। তারপর ফরাসি ভাষায় বললো,
“তুমি মিথ্যা বলছো। তুমি আসলে উগ্রটার সাথে ঘুরেছো। জোহানের সাথে ছিলে তুমি।”

জায়িনকে ফরাসি ভাষা বলতে দেখে হা হয়ে রইল মিতুল। কিছুই ওর বোধগম্য হলো না। মিতুলের মনে হচ্ছে জায়িন ও কে ফরাসি ভাষায় গালি দিয়েছে। অপমান ঘিরে ধরলো মিতুলকে। মিতুল স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করলো,
“কী বলছো তুমি?”

জায়িন মুখে হাসি ফুঁটিয়ে বললো,
“বললাম, ফারজানার সাথে থাকাকালীন সময়টা নিশ্চয়ই খুব ভালো কেটেছে তোমার।”

মিতুলের মনে হলো না যে জায়িন এটা বলেছে ফরাসিতে। ও শিওর জায়িন ফরাসি ভাষাতে অপমান করেছে ও কে। একটা না জানা ভাষায় অপমান করলো জায়িন? শেষ পর্যন্ত অপমান করার জন্য এ পথ বেছে নিলো? মিতুল কিছু না বলে সোজা বারান্দা থেকে চলে গেল।

জায়িন তাকিয়ে রইল মিতুলের যাওয়ার পথে। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে উঠছে ওর।
যত দিন যাচ্ছে তত জোহান আর মিতুলের একসাথে চলাফেরা আরও বেশি বিরক্ত এবং অসহ্যকর হয়ে উঠছে ওর কাছে।
জায়িন মনে মনে ঠিক করলো, কালকে মিতুলকে নিয়ে ঘুরতে যাবে ও।

(চলবে)

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৩৪
____________

মিতুলের মন ভালো না। প্রায় পঁচিশ মিনিট ধরে বসে আছে গার্ডেনের দোলনায়। ঘরে ঢুকবে তার কোনো উপায় নেই। কারণ ফ্রেডি এসেছে বাড়িতে। ও বিকাল বেলা গার্ডেনে এসেছিল একটু গার্ডেনের ফুলগুলোর সাথে সাক্ষাৎ করতে। সাক্ষাৎ শেষে ঘরে ঢুকে দেখলো ফ্রেডি হাজির হয়েছে। ফ্রেডিকে দেখেই আবার গার্ডেনে ব্যাক করেছে ও। পরে ঘরে ঢুকবে ঢুকবে করেও আর ঢুকতে পারলো না। কারণ জায়িন এবং ফ্রেডি আড্ডা পাতলো ঠিক হলরুমে। এত জায়গা থাকতে হলরুমেই কেন আড্ডা পাততে হবে তাদের? মিতুল কিছুতেই ফ্রেডির মুখোমুখি হতে চায় না। তাই হলরুম পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমে যাওয়ার কথা দুরস্বপ্নেও ভাববে না। মিতুল ঠিক করলো যতক্ষণে না ফ্রেডি বাড়ি থেকে যাচ্ছে, ততক্ষণে ঘরে যাবে না ও। এই গার্ডেনেই থাকবে। রাত হয়ে গেলেও এখানে বসে থাকবে। কিন্তু এখানে বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না ওর। মিতুল দোলনা থেকে নেমে গার্ডেনে পায়চারি করলো কিছুক্ষণ। তারপর আবার এসে দোলনায় বসলো। ভালোই লাগছে না কিছু। মিতুল জোহানকে ভাবার চেষ্টা করলো। কারণে অকারণে এখন শুধু জোহানকে ভাবতে ইচ্ছা করে ওর। কেন এই রোগ ওর মাঝে উদয় হলো জানে না। কালকে রাতে কতক্ষণ যে লুকিয়ে লুকিয়ে জোহানকে দেখেছে তার হিসেব নেই। কালকে রাতে জোহান লনের ইজি চেয়ারে বসে নিজের গিটার নিয়ে টুংটাং করছিল। আর ও বারান্দায় দাঁড়িয়ে জোহানকে দেখেছে চুপি চুপি। ভাবা যায় জোহানকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছে ও? ভাবা যায় কি না জানে না। ও ভাবতে পারছে না।

হঠাৎ কিচেনের জানালায় চোখ পড়তে ক্যামিলাকে দেখতে পেল মিতুল। দৌঁড়ে জানালার কাছে এলো ও। বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ফ্রেডি চলে গেছে?”

ক্যামিলা বললো,
“হুম, ও তো চলে গেছে। ফ্রেডির কথা এত ভাবছো কেন তুমি?”

“কে ভাবে ওই অসভ্যটার কথা? আমি? ওর কথা মনে পড়লেও আমার গা জ্বলে যায়।”
বলে জানালা থেকে সরে এসে ঘরে ঢুকলো মিতুল। তারপর কিচেনে চলে এলো। কিচেনে ঢুকতেই ওর পা থমকে গেল। জায়িনকে দেখে বড়ো সড়ো রকমের একটা ধাক্কা খেলো। জায়িন কিচেনে? ফ্রেডিকে নিয়ে ক্যামিলার সাথে যা বললো তা কি শুনে ফেলেছে জায়িন? ইশ! ক্যামিলাকে অমন কথা বলার আগে, পুরো কিচেনে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া উচিত ছিল।

মিতুলের মুখে ফ্রেডির সম্পর্কে ওই রকম কথা শুনে রাগ হলো জায়িনের। নিজের বন্ধুর সম্পর্কে অমন কথা শুনতে কারোরই ভালো লাগার কথা না। জায়িন মিতুলের কাছে এগিয়ে এসে বললো,
“লিসন মিতুল, ফ্রেডি অসভ্য নয়। আর ও কারো গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেওয়ার মতো ব্যক্তি নয়। তুমি শুধু শুধুই ওর সম্পর্কে এরকম কথা ভাবো। এটা অতিরিক্ত। তোমার এই অতিরিক্ত চিন্তা ধারায় চেঞ্জ আনা দরকার।”

মিতুলের পাশ কাটিয়ে কিচেন থেকে চলে গেল জায়িন। ভেবেছিল মিতুলকে নিয়ে ঘুরতে বের হবে আজকে। কিন্তু মিতুল ফ্রেডিকে নিয়ে যা বললো, তাতে মুড পাল্টে গেছে ওর। যাবে না আজ মিতুলকে নিয়ে ঘুরতে। ওর ফ্রেন্ডের সম্পর্কে এই রকম কথা বলার সাহস হয় কী করে মিতুলের?

মিতুল পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। জায়িন ওকে এত্ত বড়ো কথা বললো? বলে কি না ওর অতিরিক্ত চিন্তা ধারায় চেঞ্জ আনা দরকার! অতিরিক্ত চিন্তা করে ও?

ক্যামিলা মিতুলের অবস্থা বুঝতে পেরে বললো,
“জায়িনের কথায় কিছু মনে করো না মিতুল।”

“জায়িন আমাকে অপমান করেছে ক্যামিলা। ও অপমান করেছে আমায়।”
বলেই কিচেন থেকে বেরিয়ে এলো মিতুল। এক নম্বরের একটা অহংকারী জায়িন। সেই প্রথম থেকে অহংকারীর পরিচয়ই দিয়ে যাচ্ছে শুধু। মিতুল জায়িনকে মনে মনে কথা শোনাতে শোনাতে রুমের দিকে আসছিল। জোহানের রুমের সামনে আসতেই হঠাৎ থেমে যেতে হলো ওকে। বন্ধ দরজার আড়াল থেকে জোহানের হাসির শব্দ ভেসে আসছে। মিতুল কান পাতলো। কার সাথে হাসাহাসি করছে জোহান? কোনো মেয়ের সাথে? কোনো মেয়ের সাথে মোবাইলে হেসে হেসে কথা বলছে জোহান? ব্যাপারটা বোঝার জন্য মিতুল একেবারে দরজার সাথে মিশে কান পাতলো।
না কোনো কথা শুনতে পাচ্ছে না। কেবল হাসির শব্দই শুনতে পাচ্ছে। দুই তিন মিনিট টানা হাসির শব্দ শোনা গেল। এরপর হঠাৎ থেমে গেল রুমের ভিতরের হাসি। কী হলো ব্যাপারটা? হঠাৎ হাসি থেমে গেল কেন জোহানের? মিতুল আরও মনোযোগ সহকারে কান পাতলো। একেবারে দরজার সাথে কান মিলিয়ে রাখলো। বিশ-ত্রিশ সেকেন্ড একেবারে নীরব কেটে গেল। এরপর শব্দ হলো একটা। আর সেই শব্দের সাথেই খুলে গেল জোহানের রুমের দরজা। মিতুল আতঙ্কে দুই পা ছিটকে গেল দরজার কাছ থেকে।

জোহানও অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। মিতুল? মিতুল ওর দরজায় শব্দ করেছে? মিতুল দাঁড়িয়ে ছিল ওর দরজার সামনে? জোহান জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি এখানে কী করছো? আমার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলে কেন?”

মিতুল বুঝতে পারছে না জোহান কী করে টের পেল ও এখানে দাঁড়িয়ে আছে। ও তো কোনো শব্দ করেনি। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিল। তাহলে? দরজার সাথে একদম মিশে দাঁড়ানোর জন্য কোনো শব্দ হয়েছিল না কি?

“হেই, কিছু বলছো না কেন? তুমি কী করছিলে আমার রুমের সামনে?”

মিতুল কী বলবে বুঝতে পারছে না। কী বলবে জোহানকে? তুমি কোনো মেয়ের সাথে পিরিতের আলাপ পারছিলে কি না, সেটা জানার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। সেটা বলবে? না না। এমন কিছু বলা তো একেবারেই সম্ভব না।
মিতুল কিছুই বললো না। কিছু না বলে একরকম পালিয়ে এলো ওখান থেকে।

জোহান অবাক চোখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল।

______________

সন্ধ্যা নাগাদ রেডি হয়ে রুম থেকে বের হলো জোহান। আজকে বন্ধুরা মিলে পার্টি করবে ক্লাবে। জোহান যাওয়ার আগে মিতুলের কাছে এলো একবার। রুমে পেল না মিতুলকে। বারান্দায় এসে পেল।
মিতুল আর্ম চেয়ারে বসে লনে চেরি ব্লসমের দিকে তাকিয়ে আছে। জোহান মুখ দিয়ে শিষ বাজিয়ে মিতুলের মনোযোগ আকর্ষণ করলো। মিতুল তাকালো জোহানের দিকে। জোহানের গায়ে কালো লেদার জ্যাকেট। চোখে কালো সানগ্লাস। বাদামি চুল গুলো যথারীতি এক নিয়মে কপাল জুড়ে পড়ে আছে।

“আমাকে কেমন লাগছে তুলতুল?”

মিতুল একটু হেসে বললো,
“চমৎকার লাগছে তোমাকে।”

জোহানের মুখে হাসি ফুঁটলো। এসে মিতুলের পাশের চেয়ারে বসে পড়লো। বললো,
“ইউ নো, আজকে ক্লাবে যাচ্ছি আমি।”

“তো যাও, আমাকে কেন বলছো?”

জোহান হঠাৎ গলায় চিন্তিত ভাব এনে বললো,
“আমি নিজেকে নিয়ে খুব টেনশনে আছি তুলতুল।”

মিতুল অবাক হয়ে বললো,
“কেন?”

“কী বলবো তোমায়? আগেও তো বলেছিলাম তোমাকে। ক্লাবে গেলেই তো দুর্দশায় পড়তে হয় আমাকে। পাগল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয় আমার। ক্লাবের সব মেয়েরা এসে ঘিরে ধরতে চায় আমাকে। আমায় পটানোর চেষ্টায় থাকে সব মেয়েরা।”

জোহানের কথা শুনে মিতুলের মুখ আঁধারে ছেয়ে গেল। সব মেয়েরা এসে ঘিরে ধরে জোহানকে? মিতুলের খুব খারাপ লাগলো ব্যাপারটা।

জোহান বললো,
“থাক, বাদ দিই আমার ওসব হৃদয়বিদারক কাহিনী। এবার তুমি বলো, তুমি তখন কী করছিলে আমার রুমের সামনে?”

“তোমার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে কী করা যাবে আর? খেয়ে ফেলা যাবে তোমার রুমটাকে? রুমের ভিতরে তোমার হাসাহাসি শুনে কেবল দাঁড়িয়ে ছিলাম ওখানে। আর কিছুই না।”

“ওহ, তাই? আচ্ছা, বলো তো কেন হাসছিলাম আমি?”

“কেন হাসছিলে সেটা আমি কী করে বলবো? সেটা কি আমার জানার কথা?”

“হঠাৎ করে একটা ঘটনা মনে পড়ে গিয়েছিল, সে জন্য হেসেছিলাম। ঘটনাটা আমার এক ফ্রেন্ড এবং ক্লাবকে কেন্দ্র করে। দুই মাস আগের ঘটনা। সব বন্ধুরা মিলে ক্লাবে গিয়েছিলাম। আমার যে বন্ধুকে কেন্দ্র করে কাহিনী, ওই বন্ধুর থেকে ট্রিট ছিল। যে যার পছন্দের ড্রিংকস করতে পারবে, তার বিল মিটাবে ও। অবশ্য ও কোনো খুশিতে ট্রিট দেয়নি। ও ট্রিট দিয়েছিল দুঃখে। ব্রেকআপের দুঃখে। তিন চার মাসের প্রেম ছিল ওদের। ওর গার্লফ্রেন্ড ওর সাথে ব্রেকআপ করে চলে যায়। সেই দুঃখে ট্রিট দিয়েছিল সেই রাতে। মানুষ খুশিতে ট্রিট দেয়, আর আমার বন্ধু দিয়েছিল দুঃখে। আহারে আমার বন্ধু!” বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো জোহানের।

মিতুলেরও খুব কষ্ট লাগলো জোহানের বন্ধুর জন্য। চোখ মুখ করুণ করে বললো,
“আহারে! তারপর? তারপর কী হলো তোমার বন্ধুর?”

জোহান হঠাৎ হেসে উঠলো।
“তারপর? তারপর আমরা ক্লাবে গেলাম। ক্লাবে ঢুকতে না ঢুকতেই এক রমণীর চোখ পড়লো আমার শোকাহত বন্ধুর উপর। ও দেখতে অনেক হ্যান্ডসাম কি না। রমণী নানা ভাবে চেষ্টা করে গেল আমার বন্ধুর আকর্ষণ পাওয়ার জন্য। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। আমার বন্ধু ওই রমণীর দিকে ফিরেও তাকালো না। তাকাবে কী, আমার বন্ধু তো তার সদ্য প্রাক্তনের খাতায় নাম লেখানো গার্লফ্রেন্ডের শোকে কাতর ছিল। রমণী খানিক বিরতি নিলো। কিন্তু হাল ছাড়লো না। এদিকে আমার বন্ধু ড্রিংক করতে করতে অর্ধ মাতাল হলো। ওকে সামলাতে সামলাতে আর কেউ ড্রিংকসই করতে পারলো না। সবার ড্রিংকসের বারোটা বাজলো। ওদিকে হাল না ছাড়া রমণীটি হাঁটি হাঁটি পা পা করতে করতে চলে এলো আমার বন্ধুর নিকট। তখন আমার বন্ধু অর্ধ মাতাল থেকে পুরোপুরি মাতাল। রমণী বোধহয় এই সুযোগটিই কাজে লাগাতে চেয়েছিল। এতক্ষণ দূরে থেকে আকর্ষণ পাওয়ার চেষ্টা করছিল, কিন্তু এবার একেবারে কাছে চলে এলো। রমণীটি এসে ওর কাছে বসতে না বসতেই ও সেই রমণীর উপর বমি করে দিলো!”
এ পর্যন্ত বলেই হো হো করে হেসে উঠলো জোহান। ওর অশান্ত হাসির ঝংকার উঠলো বারান্দায়। বেশ কিছুটা সময় লাগলো ওর সেই হাসি থামতে।
হাসি থামার পর বললো,
“বুঝলে, মেয়েটির মুখ তখন দেখার মতো ছিল। আমি শিওর, মেয়েটি জীবনে আর কখনও এমন অপমানের স্বীকার হয়নি।”
জোহান একটু থেমে আবারও বলে উঠলো,
“ও এরপর আরও কাহিনী আছে। মেয়েটির ড্রেস নষ্ট হয়ে যাওয়ায়, আমার প্রিয় রিকার্ডো মায়া করে মেয়েটিকে টিসু এগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু রিকার্ডোর মায়া মেয়েটি বুঝলো না। টিসু না নিয়ে মেয়েটি ওকে ‘রাবিশ’ বলে চলে গিয়েছিল।”
জোহান এবার আর হাসলো না। রিকার্ডোর সাথে মেয়েটি অমন করায় মেয়েটির উপর যেন ও বিরক্ত তেমন একটা ছাপ পড়লো ওর মুখে।

মিতুল খুব মনোযোগ দিয়ে জোহানের কথা শুনলো। প্রথম দিকে জোহানের বন্ধুর জন্য ওর খারাপ লেগেছিল। কিন্তু এবার লাগলো মেয়েটির জন্য। মেয়েটি এত চেষ্টা করেও মন আকর্ষণ করতে পারলো না? শেষ পর্যন্ত অপমান নিয়ে ফিরতে হলো তাকে? কথাটা ভেবে মিতুলের বেশ খারাপ লাগছে।

মিতুল সেটা জোহানকে বুঝতে না দিয়ে বললো,
“আচ্ছা, এটা তোমার কোন ফ্রেন্ড ছিল? নাম কী তার? তাকে দেখেছি আমি? একদিন যে আমাকে তোমার বন্ধুদের পার্টিতে নিয়ে গিয়েছিলে, সেই পার্টিতে ছিল সে?”

“অবশ্যই ছিল। ওর নাম হেনরি।”

মিতুল বললো,
“ও…সে?”

জোহান মাথা নাড়লো।

মিতুল বললো,
“কিন্তু তাকে দেখে তো মনে হয়নি তার ব্রেকআপ হয়েছে!”

“আরে মিতুল, একটা মানুষকে দেখে কি বোঝার উপায় আছে তার ব্রেকআপ হয়েছে, কি হয়নি? আমার ব্রাদারের দিকেই দেখো। আমার ব্রাদারকে দেখলে কি বোঝা যায়, তার দুই দুই বার ব্রেকআপ হয়েছে?”

মিতুলের মুখ হা হয়ে গেল।
“কী? তোমার ব্রাদারের প্রেম ছিল?”

“ওহ তুলতুল! প্রেম না থাকলে ব্রেকআপ হয় কীভাবে? এই সামান্য ব্যাপারটুকু জানো না তুমি?”

মিতুলের মানতে কষ্ট হচ্ছে অহংকারী জায়িনেরও দুই দুইটা রিলেশন ছিল! দুই দুইটা গার্লফ্রেন্ড ছিল। অহংকারীটার তো অহংকারেই মাটিতে পা পড়ে না, প্রেম করেছে কীভাবে? অহংকারের দাপটে ঠিক ভাবে প্রেম করতে পারেনি বলেই বোধহয় ব্রেকআপ হয়ে গেছে।
ধুর, কীসব ভাবছে! প্রেম করলে ব্রেকআপ হতেই পারে। এ তো স্বাভাবিক! হোক সেটা কোনো অহংকারীর স্যাড লাভ স্টোরি।

মিতুল হঠাৎ করে বললো,
“আচ্ছা, তুমি তো ক্লাবে শুধু তোমার বন্ধুর কাহিনীই শোনালে। তোমার কাহিনীর কী হবে? আমাকে যে বলে বেড়াও ক্লাবে গেলে সব মেয়েরা তোমাকে ঘিরে ধরে। তুমি পাগল হয়ে যাও মেয়েদের যন্ত্রণায়। তাহলে ওই দিন মেয়েরা ঘিরে ধরেনি তোমায়? আর ওই মেয়েটা তোমার মতো একজন ওয়ার্ল্ড হ্যান্ডসাম রেখে, তোমার বন্ধুর পিছনে পড়লো কেন? সব মেয়েদের তো তোমার পিছনেই লাইন দেওয়ার কথা।”

জোহান সময় নিলো না। বেশ দ্রুতই বললো,
“লাইন দেবে কী করে? আমি কি লাইন দেওয়ার কোনো রাস্তা রেখেছি। মাস্ক এবং ক্যাপ। এই দুটো জিনিসকে আমি আমার সেফটি হিসেবে কাজে লাগিয়েছি। মাস্ক, ক্যাপ পরে মুখ ঢেকে রেখেছিলাম আমি। যার কারণে কোনো মেয়ে চিনে উঠতে পারেনি আমাকে। নয়তো আমার বন্ধুর কাহিনী দেখার সময় থাকতো না আমার। নিজের কাহিনী রচনা করতে হতো। বুঝলে?”

“না, বুঝলাম না।”

“উহ, তুলতুল তুমি আসলেই অবুঝ! আমি এখন কথা বাড়াতে চাই না তোমার সাথে। আমি ক্লাবের পিক পাঠাবো তোমার কাছে। তাতেই দেখে নিয়ো।”
বলে জোহান চেয়ার ছেড়ে উঠে, বারান্দা থেকে যাওয়া দিলো।
মিতুল পিছন থেকে ডাকলো,
“শোনো।”

জোহান পিছন ফিরে বললো,
“হোয়াট?”

মিতুল কঠিন গলায় বললো,
“যদি কোনো মেয়ের সাথে ছবি পাঠাও তবে খবর আছে তোমার।”

জোহান মিতুলের ওয়ার্নিং শুনে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল মিতুলের দিকে। তারপর বললো,
“তুমি ধীরে ধীরে বুঝদার হয়ে উঠছো মিতুল।”
বলে হেসে চলে গেল জোহান।

মিতুলের হার্টবিট বাড়তে শুরু করলো। ও জোহানকে কী বলে ফেললো এটা?

(চলবে)