#চৈত্রিকা (৩৭)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________
১০০.
বৈশাখ মাস পেড়িয়ে জৈষ্ঠ্যের আগমন ঘটে গেছে। গ্রীষ্মকালের ভ্যাপসা গরম। এই রোদ তো আবার এই আকাশে মেঘ জমে আছে। অর্থির মাধ্যমিক পরীক্ষার আজই শেষ দিন। আকাশের অবস্থা গুমোট হয়ে থাকলেও ভ্যাপসা গরমে মানুষের অবস্থা খারাপ। কোনো রকমে শেষ পরীক্ষা দিয়ে বাহিরে এসে আশে পাশে তাকায় অর্থি। নির্দিষ্ট মানুষটাকে চারদিকের কোথাও দেখতে না পেয়ে মনটা খারাপ হয়ে যায়। সেদিনের পর থেকে অর্থি পড়ায় ফাঁকি দেয়নি কিন্তু নিবিড়ের কঠোর আচরণে ছোট্ট মনে ভীষণ আ’ঘাত পেয়েছে। নিবিড় এ ক’দিনের সবগুলো পরীক্ষাতেই এসেছিলো কিন্তু আজ আসেনি দেখে ভীষণ মন খারাপ হলো। স্কুল থেকে বের হয়ে গুটিগুটি পায়ে সামনে এগোতে শুরু করে অর্থি। হুট করেই পেছন থেকে ডাকে নিবিড়। অর্থি চমকে পেছনে তাকায়। ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে চমৎকার হাসি। নিবিড় সে হাসি দেখেও না দেখার ভান করে। গরমে ঘেমে একাকার হয়ে গেছে। দ্রুত পায়ে অর্থির কাছে এগিয়ে এসে বলে,
‘শেষ হয়ে গেছে? কেমন হলো পরীক্ষা?’
‘ভালো হয়েছে মাষ্টারমশাই।’
‘আচ্ছা চলো!’
অর্থি মাথা নাড়িয়ে নিবিড়ের পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে থাকে। অর্থির মন খচখচ করে কথা বলার জন্য কিন্তু নিবিড়ের সাথে কথা বললে আবার নিবিড় রেগে যায় যদি! ভয়েই চুপ থাকে। নিবিড় নিজেই ফের জিজ্ঞেস করে,
‘পাশ করতে পারবে তো!’
অর্থি গাল ফুলিয়ে বলে, ‘পারবো।’
এরপর অনেকটা সময় দুজনের মাঝে নীরবতা। গ্রামের অর্ধেক রাস্তাতে এসে অর্থি মুখ খোলে, ‘আপনি কি আর আমাকে পড়াবেন না মাষ্টারমশাই?’
নিবিড় ভ্রু কুঁচকায়। এমন বোকার মতো প্রশ্ন করার কোনো মানে আছে! পরক্ষণেই ভাবে এই মেয়ে তো এমনেই আস্ত গা’ধা। সবসময় বোকা বোকা প্রশ্ন করাাটা ওর জন্মগত অভ্যাস। তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
‘তোমাকে আর পড়াতে যাবো কেনো? তোমার তো মাধ্যমিক শেষ।’
অর্থি দাঁড়িয়ে যায়। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে, ‘তবে কি আর আপনার সাথে দেখা হবে না মাষ্টারমশাই?’
নিবিড় নিজেও দাঁড়িয়ে যায়। শান্ত দৃষ্টিতে অর্থির কাঁদো কাঁদো মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটা অবুঝ ভীষণ। তবে তার প্রতি যে এই মেয়েটার অনুভূতি প্রখর হচ্ছে তা বুঝতে বাকি রয় না। শীতল কন্ঠে তবে কঠোর হয়ে বলে,
‘তোমার সাথে আমার দেখা হওয়া লাগতেছে কেনো অর্থি? তোমাকে পড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছিলাম তা শেষ হয়ে গেছে। তাই তোমার সাথে আমার দেখা হওয়ার তো কোনো প্রয়োজন নেই।’
নিবিড় কথাগুলো বলেই পিছু ফিরে দাঁড়ায়। অর্থি নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। অবাক চোখেই তাকিয়ে থাকে। নিবিড় অর্থির দিকে না তাকিয়েই বলে,
‘তুমি এখনো অনেক ছোট। অনেক অবুঝ৷ নিজের মনকে অযথাই অন্যদিকে না নিয়ে নিজের পড়ালেখায় ভালো ভাবে মন দাও। আর তুমি কোনো রকম উল্টা পাল্টা ব্যবহার করলে আমি তোমার বাড়িতে জানিয়ে দেবো।’
অর্থি কোনো কিছু ভাবে না। নিবিড়ের কথার পিঠে সে হুট করেই জাপ্টে ধরে নিবিড়কে। নিবিড় চমকে ওঠে। অর্থি নিবিড়ের পিঠে মুখ গুজে দিয়ে কান্নারত স্বরে বলে, ‘আমার সাথে এতো কঠিন হচ্ছেন কেনো মাষ্টারমশাই? আপনি তো এমন ছিলেন না। আপনি তো আমাকে ভালোবাসেন বলেন!’
নিবিড় ছাড়িয়ে দেয় অর্থিকে। সোজা করে দাঁড় করিয়ে কাঠকাঠ গলায় বলে, ‘গায়ে পড়া স্বভাব আমার একদম পছন্দ না। আর কখনো এমন করলে আমি কিন্তু দেখবো না তুমি জমিদার বাড়ির মেয়ে! আর আমি কখনো তোমাকে বলেছি আমি তোমাকে ভালোবাসি! ভালোবাসার কি বুঝো তুমি! তুমি আর কখনো আমার সাথে কথাও বলবে না অর্থি। আমার থেকে সম্পূর্ণ দূরত্ব রাখবে।’
অর্থি দু পা পিছিয়ে দাঁড়ায়। ভাঙা ভাঙা স্বরে বলে, ‘আপনি বদলে গেছেন মাষ্টারমশাই। আপনি হারিয়ে গিয়ে সত্যিই হারিয়ে গেছেন। আপনি আমার সেই মাষ্টারমশাই নাহ। আপনি অন্য কেউ। আমার ছোট্ট মনে অনুভূতির জন্ম দিয়ে এখন সেগুলোকে নিজেই গলা টিপে মে’রে ফেলার চেষ্টা করছেন! যদি আমার থেকে দুরে সরে যাওয়ারই হয় তবে মনে এভাবে আশার প্রদীপ কেনো জ্বালিয়েছিলেন মাষ্টারমশাই? আপনি ভীষণ খা’রাপ মাষ্টারমশাই। ভীষণ খা’রাপ!’
অর্থি ছুটে চলে যায়। নিবিড় হাত মুষ্টিবদ্ধ করে চোখ নিচে নামিয়ে রাখে। সে অবস্থাতেই চোখের কোণ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। বুকের ভেতরটা যেনো হু হু করে কেঁদে ওঠে। কোনো রকমে এলোমেলো পা চালিয়ে হাঁটতে থাকে। বিড়বিড় করে বলে,
‘আমি সত্যিই ভীষণ খা’রাপ অর্থি। তোমাকে ভালোবেসেও তোমাকে ভালোবাসা বারণ আমার। তোমার বিরহে যে দিনের পর দিন আমার মৃ’ত্যু হচ্ছে। এ তোমায় কি করে বোঝায়?’
১.
অর্পিতা আর চিত্রর বিয়ের দিন করা হয়েছে শুক্রবার। হাতে আছে কেবল ৪ দিন। এর মাঝেই বিয়ের কেনাকাটা থেকে শুরু করে সবকিছু সেড়ে নিতে হবে। বাড়িতে একটা রমরমা পরিবেশ। মেহমান দাওয়াত করাা হয়ে গেছে। পল্লবীর, শায়লার বাবার বাড়ির লোকজন এখনই আসতে শুরু করেছে। বাড়ির বউরা ব্যস্ত অন্দরমহলের সবকিছু সামলাতে আর পুরুষরা বাহিরের সব কিছু ঠিকঠাক করে নিচ্ছে। সারাদিনে নীরা, চৈত্রিকা, সাথী, পল্লবী, শায়লা, নাসিমা কারোই একটুও বিশ্রাম নেওয়ার সময় হচ্ছে নাহ। সবাই এখন থেকেই কাজের ওপরে রয়েছে। বাড়িতে তো আরো মেইডরা রয়েছেই। সারাদিনে প্রহর চৈত্রিকার দেখা পায় কেবল খাওয়ার টেবিলে। আর রাতে ঘুমানোর সময়। এর মাঝের সময়টুকু সে হাওয়া। প্রহর নিজেও ছোট ভাইয়ের বিয়ের সবকিছুর জন্য প্রচুর ব্যস্ততার মাঝে কাটাচ্ছে। আজ সবাই মিলে শহরে যাবে কেনাকাটা করতে। সবাই সেজন্যই তৈরী হতে ব্যস্ত। যদিও অন্যান্য সময় বাড়িতেই শাড়ি দিয়ে যায় ব্যবসায়ীরা কিন্তু এবার সবাই মিলে আবদার করেছে শহরে গিয়ে নিজেরা কেনাকাটা করবে। সবার আবদারের কাছে হেরে গিয়ে প্রহর রাজি হয়েছে। চৈত্রিকা একটা লাল পাড়ের কালো শাড়ি পড়েছে। পায়ে আলতা, নুপুর, কানে দুল, চুলগুলো খোপা করা আর তাতে গুজে দেওয়া বেলী ফুল, হাতে চুড়ি।৷ প্রহর ঘরে এসে চৈত্রিকার সাজ দেখে থমকায়। মুখে কৃত্রিম কিছু বলতে কেবলই ঠোঁটের লাল রঙ আর চোখে কাজল। চৈত্রিকা তাড়াহুড়ো করে তৈরী হতে হতেই খেয়াল করে প্রহর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। চৈত্রিকা ব্যস্ত গলায় বলে,
‘সবাই তৈরী হয়ে গেছে জমিদার সাহেব? ইশশ আমি দেড়ি করে ফেললাম। আমারও হয়ে গেছে। একটু দাঁড়ান!’
প্রহর কোনো জবাব দেয় না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে নিজের বউয়ের সৌন্দর্য। বিড়বিড় করে আওড়ায় ‘মাশাল্লাহ’। চৈত্রিকা প্রহরকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কয়েকবার ডাকে। প্রহর এবারও জবাব না দিয়ে এগিয়ে আসে চৈত্রিকার কাছে। চৈত্রিকা পায়ের নুপুর ঠিকমতো পড়ে পিছে ঘুরতেই বারি খায় প্রহরের প্রশস্ত বুকে। প্রহর সরে যেতে না দিয়ে আরো প্যাচিয়ে নেয় নিজের সাথে। চৈত্রিকা ব্যস্ত গলায় বলে,
‘ছাড়ুন ছাড়ুন! সবাই অপেক্ষা করছে তো!’
‘করুক!’
‘করুক মানে?’
প্রহর বাম হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে চৈত্রিকার ঠোঁটের লাল রঙ মুছে দেয়। চৈত্রিকা কিছু বলতে গেলেও সে থামিয়ে দেয়। নিজেই বলে, ‘এইসব দিতে হবে নাহ।’
চৈত্রিকা ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘দিলে কি হবে?’
‘আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবো।’
চৈত্রিকা চোখ বড় বড় করে তাকায়। প্রহরের সরাসরি বলা কথা বুঝতে তার দেড়ি হয় না। হাত দিয়ে ছুটার চেষ্টা করতে করতে বলে, ‘জলদি ছাড়ুন আমাকে। দিন দিন নিজের মুখের লাগাম হারিয়ে ফেলতেছেন।’
‘উহু ছাড়বো নাহ।’
চৈত্রিকা এবার ছোটাছুটি বন্ধ করে দেয়। বড় একটা শ্বাস নিয়ে পা একটু উচু করে প্রহরের শার্টের কলার টেনে নিয়ে নিজের ঠোঁট মুছে ভালো করে। প্রহর চৈত্রিকার কান্ডে ঠোঁট চেপে হাসে। চৈত্রিকা প্রহরের শার্ট ছেড়ে বলে,
‘আর নেই। এবার ছাড়ুন!’
প্রহর হাত আলগা করে দেয়। চৈত্রিকা বের হয়ে চলে যেতে নিলে পেছন থেকে প্রহর ফের বলে, ‘আমি যদি এখন এই শার্টেই বাহিরে যাই তাহলে কেমন হবে চৈত্র?’
চৈত্রিকার পা থেমে যায়। চোখ বড় বড় করে দৌড়ে আসে প্রহরের কাছে। শার্টের এক কোণা চেপে ধরে বলে, ‘পা’গল হলেন নাকি! সবাই কি ভাববে?’
‘আমি কি জানি! তুমি মুছলে কেনো আমার শার্টে?’
প্রহরের কন্ঠে দুষ্টুমি। কিন্তু চৈত্রিকা আতঙ্কিত। প্রহর যদি সত্যি সত্যিই এই শার্ট পড়েই বের হয় তাহলে লজ্জায় মাথা কা’টা পড়বে। এটুকু ভাবতেই তার কান গরম হয়ে যাচ্ছে৷ মাথা দুদিকে নাড়িয়ে বলে,
‘আপনি মুছতে বলেছেন তাই মুছেছি। কিন্তু এখন আপনি জলদি শার্ট পাল্টে নেন।’
‘যদি না পাল্টাই?’
‘জমিদার সাহেব!’
প্রহর শব্দ করে হেঁসে ওঠে। চৈত্রিকা ফ্যালফ্যাল করে মুগ্ধ হয়ে সে হাসির দিকে চেয়ে থাকে। প্রহরের শার্ট আরো শক্ত করে ধরে মুগ্ধ কন্ঠেই বলে, ‘আপনি হাসলে আপনাকে ভীষণ সুন্দর দেখায় জমিদার সাহেব। আমার হৃদপিণ্ডের গতি থেমে যায়।’
প্রহর হাসি থামিয়ে অবাক হয়ে তাকায়। এই প্রথম হয়তো চৈত্রিকা প্রহরের প্রশংসা করেছে নিজ মুখে। চৈত্রিকা চট করে সরে যায়। লজ্জায় লাল হওয়া মুখটা ঢাকতে ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুট লাগায়। ছুটতে ছুটতেই জোড়ে বলে,
‘শার্টটা কিন্তু বদলে আসবেন জমিদার সাহেব!’
চৈত্রিকার যাওয়ার পানে তাকিয়ে মুচকি হাসে প্রহর। নিজের শার্টের কলার টেনে তা দেখে শার্ট খুলতে শুরু করে। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের প্রতিবিম্বকে নিজেই বলে,
‘তুমি শেষ প্রহর রেনওয়াজ। এই চৈত্রের সৌন্দর্য, লজ্জায় রাঙা মুখ, খোলা চুল, নুপুর আর চুড়ির শব্দ সাথে তার বিখ্যাত ‘জমিদার সাহেব’ বলা সবকিছুতেই তুমি শেষ। শেষ পর্যন্ত এক সপ্তদশী কন্যা তোমার প্রাণ নিয়ে চলে গেলো!’
২.
গ্রাম ছেড়ে সুদুর শহরে এসেছে সবাই কেনাকাটা করতে। প্রহর যদিও অনিমকে পছন্দ করে না তবুও আগেই খবর পাঠিয়েছিলো যেনো সে তার সবকিছু গুছিয়ে সোজা দোকানে চলে আসে। ঠিকানাও আগেই দেওয়া ছিলো তাই অনিম আগে ভাগেই এসে দাঁড়িয়েছিলো। চৈত্রিকারা এসে নামতেই অনিম এসে গাল ফুলিয়ে বলে,
‘এতোক্ষণ লাগে! সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি বল তো! বাবাগো আমার পা শেষ।’
অর্থি চৈত্রিকার পেছন থেকে মাথা বের করে বলে, ‘পেট মোটা অনিম ভাই! এখন কি পা ছাড়া অনিম ভাই বলে ডাকবো!’
অনিম ফুঁসে উঠে বলে, ‘এই মেয়ে তুমি সামনে আসো খালি!’
অর্থি ভেংচি কে’টে দৌড় দেয়। চৈত্রিকা হেঁসে বলে, ‘তোমরা দুজন এমন সা’প আর নেউলের মতো করো কেনো? চলো ওদিকে!’
অনিম মনে মনে অর্থিকে বকতে শুরু করে। চৈত্রিকা আর অনিমকে আগে আগে যেতে দেখে প্রহর ভ্রু কুঁচকায়। তাকে না নিয়ে চৈত্রিকা এই ছেলের সাথে আগে আগে কেনো যাবে! বিষয়টা এমন যে প্রহরের বউ শুধু প্রহরের আশে পাশেই থাকা লাগবে। অন্য কারো ধারে কাছেও ঘেষা যাবে না। যাবে না মানে একদমই যাবে না। প্রহর ফোঁস করে শ্বাস নিয়ে হাঁটা লাগায়। সবাই নিজেদের পছন্দ মতো শাড়ি, গহণা নিয়েছে। চৈত্রিকার ওপর দায়িত্ব পড়েছে অর্পিতার বিয়ের শাড়ির আর গহণার। চৈত্রিকা নিজেরটা না দেখে আগে অর্পিতার জন্য সব নিলো। যদিও অর্পিতার পছন্দমতোই সব নিয়েছে। প্রহর, চিত্র, অনিম আর নিবিড় মিলে চিত্রর জন্য পাঞ্জাবি, পাজামা, জুতো নিয়ে নিজেদের জন্যও নিয়েছে। ওহ হ্যাঁ! প্রহর নিজেই নিবিড়কে এসবের মাঝে এনেছে এবং বিয়েতেও থাকতে বলেছে। নিবিড় প্রথমে অনেক বাহানা করলেও প্রহরের কাছে পেরে ওঠেনি। ছেলেদের সব কেনা শেষ হলেও মেয়েদের এখনো অনেক বাকি। অর্থি একবার এটা নিচ্ছে তো আরেকবার অন্যটা। কোনোটাই পছন্দ করতে না পেরে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বসে আছে। অনিম এগিয়ে এসে গলা পরিষ্কার করে বলে,
‘কি ব্যাপার বোকা বাচ্চা! কোনোটা পছন্দ হচ্ছে না নাকি!’
অর্থি ফোঁস করে উঠে বলে, ‘বোকা বাচ্চা কাকে বললেন?’
‘তুমি ছাড়া আর কার সাথে কথা বলতেছি আমি?’
‘তার মানে কি আমাকে বলছেন!’
‘এখনো বোঝোনি!’
অর্থি ছ্যাত করে উঠলেও কিছু না বলে চুপ করে শাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। অনিম অর্থির হঠাৎ চুপ থাকার বিষয়টা হজম করতে পারে না। তাই ফের বলে, ‘কি হয়ছে?’
‘আমার মন ভালো নেই তাই আপনার সাথে ঝগড়া করবো না আমি।’
‘মনের কি হয়ছে?’
‘আপনাকে বলবো কেনো?’
‘বলবে না কেনো?’
‘আপনি দুরে যান আমার থেকে!’
অর্থি ছুটে চৈত্রিকার কাছে যায়। চৈত্রিকার আঁচল ধরতেই চৈত্রিকা জিজ্ঞেস করে, ‘কি হয়েছে অর্থি?’
‘ভাবীজান আমাকে শাড়ি পছন্দ করে দেন। আমি কোনোটাই পছন্দ করতে পারতেছি না।’
চৈত্রিকা মাথা নাড়িয়ে অর্থিকে শাড়ি পছন্দ করে দেয়। অর্থি খুশিতে গদগদ হয়ে বলে, ‘আমার বিয়েতেও আপনাকে শাড়ি পছন্দ করতে দেবো তখন আপনি অন্নেএএএকক সুন্দর একটা শাড়ি পছন্দ করে দেবেন৷ কেমন!’
চৈত্রিকা আর অর্পিতা হেঁসে ওঠে। অর্পিতা অর্থির মাথায় গাট্টা মে’রে বলে, ‘বয়স হয় নাই তোর বিয়ের। আরো ৫/৭ বছরের আগে তোর বিয়ে টিয়ে দেবো না।’
অর্থি ভেংচি কাটে। সবার কেনাকাটার মাঝেই প্রহর একটা প্যাকেট হাতে এগিয়ে আসে। সবার সামনেই চৈত্রিকার দিকে এগিয়ে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে, ‘এটা দেখো!’
চৈত্রিকা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে প্রহর চোখ দিয়ে ঈশারা করে। চৈত্রিকা প্যাকেট খুলতেই বের হয়ে আসে সুন্দর ৩টা শাড়ি আর ৩ রকমের গহণা। শাড়ি ৩ টা দেখেই চোখ ধাঁধিয়ে যায়। অর্পিতা আর অর্থি একসাথে বলে, ‘কত্তো সুন্দর শাড়ি!’
চৈত্রিকা প্রহরের দিকে তাকাতেই প্রহর কোনো কথা না বলে চলে যায়। সবার বোঝা হয়ে যায় এগুলো চৈত্রিকার জন্যই কেনা। অর্পিতা, নীরা, সাথী চৈত্রিকাকে খোঁচাতে থাকে। চৈত্রিকা লজ্জা পায়। সবার কেনাকাটা শেষে নিজেদের গাড়ির কাছে এগিয়ে যায়। সবাই আগে চলে গেলে প্রহর হাত টেনে ধরে চৈত্রিকার। হাত ধরেই এগোতে এগোতে বলে,
‘শাড়ি পছন্দ হয়েছে?’
চৈত্রিকা ঠোঁট চেপে বলে, ‘জমিদার সাহেব পছন্দ করে দিয়েছে তাহলে আমার পছন্দ না হয় কেমন করে!’
প্রহর আর কিছু বলে না। একসাথে এসেই গাড়িতে ওঠে। সবার বসার পর শুধু জায়গা থাকে একটা সিট। তাও অর্থির পাশে। নিবিড় এসে জায়গা পায় ওই একটাই। দুজন দুজনের দিকেই এক পলক তাকায়৷ কিছু না বলেই বসে পড়ে অর্থির পাশে। পুরো রাস্তাতেই দুজন দুজনের সাথে কোনো কথা বলে নাহ। বেচারী অর্থির নিবিড়কে দেখলেই কান্না পায়। কোনো রকমে কান্না গিলে হাতে হাত চেপে বসে থাকে। যেতে যেতে রাস্তাতেই সন্ধ্যা হয়ে যায়। অর্থি গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের ঘোরে মাথা রাখে নিবিড়ের কাঁধে। নিবিড়ের হার্টবিটের গতি দ্রুত হয়। হাতে হাত ঘষতে ঘষতে চোখ পিটপিট করে বন্ধ করে নেয়। মনে মনে আওড়ায়,
‘এভাবে আমার কাছে এসো না অর্থি। আমি আর তোমার মায়া বাড়াতে চাই নাহ। আমার হৃদয়ের ক্ষ’ত আর বাড়াতে চাই নাহ।’
অর্থি আর নিবিড়ের ইতস্তত থেকে শুরু করে নিবিড়ের অস্বাভাবিক আচরণ পুরোটা কেউ খেয়াল না করলেও চৈত্রিকার চোখ ঠিকই পড়ে। প্রথমে ভ্রু কুঁচকে থাকলেও পরে যখন আন্দাজ করতে পারে তখন নিজ মনেই বলে ওঠে, ‘স’র্ব’না’শ!’
চলবে..
#চৈত্রিকা (৩৮)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_________________
৩.
রাতের বেলায় চিত্র বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিশুদ্ধ বাতাস নিচ্ছিলো। সে সময় বারান্দায় পদার্পণ ঘটে অর্পিতার। চিত্র কারো উপস্থিতি টের পেয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখে অর্পিতা। আলগোছে মাথাটা ঘুরিয়ে নিয়ে সামনে তাকিয়ে থাকে। অর্পিতা এসে চিত্রর পাশেই দাঁড়ায়। দুজনের মাঝেই পিনপতন নীরবতা। রাতের আঁধারের সাথে দুজনের নীরবতায় পরিবেশ ভারী হয়ে আছে। কতক্ষণ দুজন এভাবেই চুপ করে ছিলো তা জানা নেই৷ একটা সময় পর নীরবতা ভেঙে অর্পিতাই জিজ্ঞেস করে,
‘তোমার শরীর কেমন এখন?’
চিত্র আড়চোখে তাকায় অর্পিতার দিকে। অর্পিতার চোখে মুখে ইতস্ততর ছাপ স্পষ্ট। চিত্র অদ্ভুত ভাবে হাসে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্পিতার প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই বলে,
‘তুই সত্যিই মন থেকে বিয়েটা করতে চাইছিস! ‘
অর্পিতা ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘মন থেকে না চাইলে রাজি কেনো হতাম!’
‘তাহলে আমার সাথে কথা বলতে তোর এতো ইতস্তততা কেনো?’
অর্পিতা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। এতোগুলো দিন দুজন দুজনের থেকে দুরে থাকায় যে দূরত্ব তৈরী হয়েছে সেটা থেকেই এতো ইতস্তত ভাব। চিত্র অর্পিতার মুখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বলে,
‘আমি জানি অতীতে যা করেছি তা ভীষণ নিচু মনের পরিচয়। তবে আমি কেনো করেছিলাম তা তুইও জানিস আমিও জানি। আমি আমার অন্যায়ের জন্য তোর কাছে ক্ষমাও চেয়েছি আর শা’স্তিও পেয়েছি। তবে তোর প্রতি ভালোবাসা আমার বিন্দু মাত্রও কমেনি কখনো। আগেও তোকে ভীষণ ভালোবেসেছি এখনো বাসি আর ভবিষ্যতেও বাসবো। যত কিছু হয়েছে তুই ভুলে গিয়ে, আমাদের মাঝের দুরত্বটুকু মিটিয়ে সম্পূর্ণ আমার হতে পারিস না অর্পি? আমি জানি তুইও ভীষণ ভালোবাসিস আমায় কিন্তু আমাদের মাঝের এই দ্বিধার দেয়াল ভেঙে কি তুই আবার আমার হতে পারিস না অর্পি?’
অর্পিতা ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। চিত্র উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মন উত্তর জানলেও ভীষণ ভাবে আগ্রহ হচ্ছে অর্পিতার মুখে শোনার। কিন্তু অর্পিতা একটা শব্দও করলো নাহ। নিঃশব্দ জাপ্টে ধরে চিত্রকে। চিত্রর বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থাকে। চিত্র বাকরুদ্ধ, হতভম্ব। চাওয়ার থেকেও বেশি কিছু পেয়ে গিয়ে কি বলবে তা আর বুঝে ওঠে নাহ। শুধু বাকরুদ্ধ হয়ে নিষ্পলক দুরে তাকিয়ে থাকে। অর্পিতা যখন বোঝে চিত্র তাকে দুহাতে জাপ্টে ধরেনি তখন সে নিজেই চিত্রর হাত টেনে এনে নিজের পিঠে রাখে। চিত্রর মস্তিষ্ক যখন বিষয়টা ধরতে পারে তখন সে নিজেও শক্ত করে ধরে রাখে অর্পিতাকে। অর্পিতার ঠোঁটের কোণে অনেকদিন পর ফিরে পাওয়ার সুখের হাসি।
৪.
সকাল থেকে জমিদার বাড়িতে হৈ চৈ শুরু হয়ে গেছে। পুরো বাড়ি সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। বাড়ির হলরুমেই বড় করে সাজানো হয়েছে চিত্র আর অর্পিতার গায়ে হলুদের স্টেজ। গায়ে হলুদের সব দায়িত্ব বাড়ির বউরা পালন করছে। সেই কাজেই একটুও দম নেই চৈত্রিকা, নীরা আর সাথীর। একবার এটা করছে তো আরেকবার ওটা। অর্থি সকাল থেকেই নিজের মতো ছুটে বেড়াচ্ছে আর বাচ্চাদের জ্বালাচ্ছে। কতবার কত মহিলা এসে পল্লবীর কাছে ভয়ে ভয়ে বলে গেলো,
‘জমিদার গিন্নি আপনার মেয়েটা আমার ছোট মেয়েকে শুধু শুধু কান্না করাচ্ছে!’
এর ছেলেকে তো ওর মেয়েকে কান্না করাবেই। রেগে পল্লবী একবার বকে গেছে। তবুও অর্থির কোনো হেলদোল নেই। মূলত এই বিয়েতে সেই সবচেয়ে বেশি খুশি। অর্থির আজাইরা কাজগুলো নিবিড়, অনিম দুজনেই দেখে। নিবিড় দেখবো না দেখবো না করেও না দেখে থাকতে পারছে না ওদিকে অনিম নিজ ইচ্ছাতেই সবটা দেখছে। নিবিড় চোখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজের কাজ করতে থাকে। অনিম এগিয়ে আসে অর্থির কাছে। অর্থির খোপা করে চুল ধরে টান দিয়ে পুরো চুল খুলে দেয়। অর্থির চোখ মুখ চুল দিয়ে ঢেকে যায়। কোনো রকমে নিজের চুল গুলো মুখের ওপর থেকে সরিয়ে ফুঁসে উঠে পেছনে তাকায়। অনিমকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘এই পেট মো’টা অনিম ভাই! আমার চুল খুলে দিলেন কেনো?’
অনিম নিজেও ফুঁসে ওঠে। দু কদম অর্থির দিকে এগিয়ে এসে বলে, ‘তুমি সবসময় আমাকে পেট মো’টা বলো কেনো হ্যাঁ? আমি তোমার বড় না! সম্মান দিতে পারো না!’
‘সম্মান দেই তো!’
‘কিভাবে দেও?’
অর্থি কোমড়ে হাত রেখে বলে, ‘বাহ রে! পেট মো’টার সাথে সাথে যে ‘অনিম ভাই’ বলি ওটা বুঝি শুনতে পান না! সম্মান না করলে কি ‘অনিম ভাই’ বলতাম! বলেন বলেন!’
অনিম ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে। মনে মনে নিজেকে একশো টা বকা দেয়। কেনো সে এই বোকা মেয়ের সাথে তর্ক করতে যায়! দীর্ঘশ্বাস ফেলে অসহায় ফেস নিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
‘এটা সম্মান হলে জীবনে আর সম্মান বলতে কিছুই থাকলো না।’
অর্থি ঠোঁট চেপে হেঁসে এক আঙুল দিয়ে বরাবরের মতো অনিমের পেটে গু’তো দিয়ে বলে, ‘পেট মো’টা অনিম ভাই।’
বলেই ছুটে পালিয়ে যায়। অনিম তেড়ে গিয়ে বলে, ‘এই মেয়ে একবার শুধু দাঁড়াও!’
অর্থি দাঁড়ায় নাহ। উল্টো ঘুরে মুখ জিভ দেখিয়ে উল্টো ভাবেই দৌড়াতে থাকে। সাথে সাথেই ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায় নিচে। খোলা চুলে টান পড়ে। কোমড়েও ভালোই ব্যাথা পায়। আর্তনাদ করে চোখ মুখ কুঁচকে নেয়। কাঁদো কাঁদো মুখ করে উপরে তাকাতেই চোখে পড়ে নিবিড়ের মুখ। দুদিন আগেও কি হয়েছিলো সম্পূর্ণ ভুলে ব্যাথার চোটে খ্যাক করে উঠে বলে,
‘এই মাষ্টারমশাই! আমাকে ফেলে দিলেন কেনো?’
নিবিড় ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘আমি তোমাকে ফেলে দিবো কেনো? তুমি নিজেই তো উল্টো হয়ে দৌড়াতে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলে!’
‘তো আপনি আমাকে ধরতে পারেননি!’
‘নাহ পারিনি। বাচ্চাদের মতো এতো দৌড়াও কেনো? এতো দৌড়াদৌড়ি করো, লাফাও বলেই তোমার মাথায় সমস্যা হয়ে গেছে।’
অর্থি ফোঁস করে ওঠে। কিছু বলার আগেই ছুটে আসে অনিম। অর্থিকে নিচ থেকে তুলতে তুলতে ব্যস্ত গলায় বলে, ‘আরে পড়ে গেলে কেমন করে? এভাবে কেউ দৌড়ায়! অনেক ব্যাথা পাইছো? আগে উঠো!’
অর্থি কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে অনিমের সাহায্যেই বসা থেকে উঠে। এর মাঝেই চিত্রও ছুটে আসে। অর্থিকে আগলে নিয়ে বলে, ‘কি হয়ছে বোনু? পড়ে গেছিস! ব্যাথা পাইছিস অনেক!’
অর্থি দু পাশে মাথা নাড়ায়। সন্তুষ্ট চিত্তে হাসে৷ ভাইদের এই ভালোবাসা দেখলেই তার আর পৃথিবীর অন্য কিছু মাথায় থাকে নাহ। মেজো ভাইজান তাকে যতটা অপছন্দ করে, দুর দুর করে তার থেকেও কয়েকগুণ বেশি ভালোবাসে বড় ভাইজান আর ছোট ভাইজান। এই ভালোবাসা দেখলেই শান্তি শান্তি লাগে। মনে হয় আর কি চাই জীবনে! চিত্র অর্থির দুগালে হাত রেখে শান্ত গলায় বলে,
‘এতো লাফালাফি করিস কেনো বোনু? আর এমন করবি নাহ। চুপচাপ ঘরে যা নয়তো তোর অর্পি আপুর কাছে যা।’
অর্থি মাথা নাড়ায়। বাহির থেকে চিত্রর ডাক পড়ে। অনিম পাশ থেকে বলে, ‘চিত্র তুমি ওদিকে যাও। আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি।’
চিত্র মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। অনিম অর্থিকে নিয়ে সিড়ির দিকে যায়। অনিমের হাতের মুঠোয় শক্ত করে অর্থির হাত ধরা। অর্থি আস্তে আস্তে হাঁটছে বলে অনিম নিজেও একদম আস্তে হাঁটছে আর অর্থির সাথে কথা বলছে। নিবিড় পুরোটাই দেখে৷ অনিমের অস্থির হয়ে ছুটে আসা থেকে শুরু করে অর্থির হাত ধরে রাখা সম্পূর্ণটাই দেখে। ঠোঁটের কোণে হাসি থাকলেও বুকের বাম পাশের চিনচিনে ব্যাথাটা বাড়ে। বার কয়েক ঢোক গিলে দৃষ্টি এদিক ওদিক করে। এলোমেলো পায়ে সরে যায়। জমিদার বাড়ির পুকুরের সামনে এসে থম মে’রে দাঁড়িয়ে থাকে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে বারংবার।
‘আপনি অর্থিকে ভালোবাসেন নিবিড় ভাইজান?’
হঠাৎ এহেন কথায় লাফিয়ে ওঠে নিবিড়। চমকে তাকায় পেছনে। চৈত্রিকাকে দেখে নিবিড় দৃষ্টি এদিক ওদিক করে। হাসফাস করতে থাকে। চৈত্রিকা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। নিবিড়ের জবাব না পেয়ে চৈত্রিকা ফের বলে,
‘আপনি অর্থিকে ভালোবাসেন?’
নিবিড় এবারও জবাব দেয় না। অদ্ভুত ভাবেই চৈত্রিকাকে মিথ্যাও বলতে পারে নাহ। মাথা নিচু করে চুপ করে থাকে। চৈত্রিকা অবাক চোখে তাকায়। আন্দাজ করলেও এভাবে যে সে আন্দাজ সত্য হয়ে যাবে বুঝতে পারেনি। নিবিড় আর অর্থির ভবিষ্যতের কথা ভেবেই চৈত্রিকার বুক ধ্বক করে ওঠে। অবাক হয়ে বলে,
‘অর্থিও আপনাকে…!’
নিবিড় চোখ তুলে তাকায়৷ শ্বাস আটকে বলে, ‘বড় ভাবীজান এসব কথা এগোবেন নাহ। অর্থি ছোট! আমাদের মাঝে কিছু নেই।’
নিবিড় আর কিছু না বলেই ছুটে চলে যায়। চৈত্রিকার মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে যায়৷ নিবিড় যে কত বড় ভুল করে বসেছে তা আর বুঝতে বাকি নেই।
৫.
সন্ধ্যায় চিত্র আর অর্পিতার গায়ে হলুদ। সারাদিনের সব কাজ শেষে চৈত্রিকা গোসল করেছে মাত্র। নীরা আর সাথীও নিজেদের ঘরে গোসল করতে গেছে। চৈত্রিকা কোনো রকমে গোসল করে এসে বাসন্তী রঙের শাড়ি পড়ে। এর মাঝেই কয়েকবার এসে অর্থি ডেকে যায়। চৈত্রিকা যত দ্রুত সম্ভব তৈরী হয়ে ঘর থেকে বের হয়। চুল খোলাই আছে। দ্রুত আগে অর্পিতার ঘরে যায়। অর্পিতা তখন শুধু শাড়ি পড়ে বসে আছে। চৈত্রিকা কোমড়ে শাড়ি গুজে ব্যস্ত গলায় বলে,
‘অর্পি আপু জলদি আসেন। আগে সাজিয়ে দেই।’
অর্থি হা করে তাকিয়ে থাকে চৈত্রিকার দিকে। অবাক কন্ঠে বলে, ‘বড় ভাবীজান আপনাকে অনেক সুন্দর লাগতেছে।’
চৈত্রিকা হতাশার শ্বাস নিয়ে বলে, ‘আমারে তোমার যেদিন অসুন্দর লাগবে এখন থেকে ওইদিন গুলোতে বইলো। কেমন!’
অর্থি ৩২ টা দাঁত বের করে হাসে। অর্পিতা নিজেও হেঁসে বলে, ‘আপনাকে কখনো অসুন্দর লাগে না ভাবীজান।’
চৈত্রিকা হাসে। অর্পিতাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দেয়। গায়ে সব ফুলের গহণা। কৃত্রিম সাজ। চৈত্রিকা সাজিয়ে দিয়ে নিজেই বলে, ‘মাশাল্লাহ। কারো নজর না লাগুক!’
অর্থি শুরু করে দেয় অর্পিতার প্রশংসা। নীরা ঘরে আসলে চৈত্রিকা নীরা আর অর্থির সাথে অর্পিতাকে নিচে পাঠায়। নিজে কোনো রকমে চুল হাত খোপা করে নিজের ঘরের দিকে এগোয়। ঘরের ভেতরে আসতেই দেখতে পায় প্রহরকে। হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে গম্ভীর হয়ে বসে আছে। চৈত্রিকা দরজা থেকেই চোখ ভরে প্রহরকে দেখে। প্রহরের দিকে এগোতে এগোতে বলে,
‘জমিদার সাহেব হঠাৎ ঘরে!’
প্রহর চোখ তুলে তাকায় চৈত্রিকার দিকে। সাথে সাথেই শীতল হাওয়া বয়ে যায় মন প্রাণ জুড়ে। ঠোঁট কামড়ে চৈত্রিকার এলোমেলো রুপ দেখে বলে, ‘তুমি তৈরী হওনি!’
‘হয়েছি তো৷ শুধু চুলগুলো ঠিকমতো বাঁধবো আর গহণা গুলো ঠিক মতো পড়বো। ব্যাস শেষ!’
‘গায়ে হলুদ শুরু হয়ে যাবে তো। জলদি করো!’
চৈত্রিকা নিজের হাতের চুড়ি খুলে রেখে আয়নায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ায়। হেয়ালী করে বলে, ‘জমিদার সাহেবের এতো তাড়া কেনো?’
প্রহর ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে নিজের জায়গা থেকে উঠে দাঁড়ায়। চৈত্রিকার কাছাকাছি এসে বলে, ‘আবারও চিত্রর সাথে সাথে আমিও বিয়ে করবো। তাই ওর সাথে একসাথে গায়ে হলুদটাও সেড়ে ফেলার জন্যই তাড়া দিচ্ছি বউজান।’
চৈত্রিকা দু হাতে প্রহরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে হাসে। চুল গুলো খোপা করে বেঁধে নিয়ে চুলে বেলীফুলের মালা গুজে নেয়। সব গহণা পড়ে সুন্দর করে শাড়ির আঁচল মাথায় টেনে নেয়। প্রহর চোখ ফিরিয়ে নিয়ে উল্টো ঘুরে বের হতে হতে বলে,
‘ভ’য়ং’কর!’
চৈত্রিকা হুট করে প্রহরের চলে যাওয়া দেখে কিছুই বুঝে ওঠে নাহ। ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসে। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকায়। একদম জমিদার গিন্নি!
গায়ে হলুদ শুরু হওয়ার আগে আগে চৈত্রিকাকে রেখে সাথী ফের একবার নিজের ঘরে আসে। প্রয়োজনীয় কাজ সেড়ে নিজের নাকের নথ ঠিক করে। ঘর ছেড়ে বের হতেই সামনে পড়ে যায় পিয়াস। সাথী দু কদম পিছিয়ে যায়। পিয়াস বাঁকা হেঁসে বলে,
‘বাহ ছোট বউ! তোমাকে তো বেশ সুন্দর লাগছে!’
সাথী আতঙ্কে দৃষ্টি এদিক ওদিক করতে থাকে। পিয়াস এগিয়ে এসে একদম কাছ ঘেঁষে দাঁড়ায়। সাথীর গালে স্লাইড করতে করতে বলে, ‘আমার থেকে দুরে দুরে থাকো কেন ছোট বউ? তোমাকে… ‘
এটুকু বলতেই সাথী হাতের নিচ থেকে দৌড় দেয়। পিয়াস সাথীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হেঁসে বলে,
‘আর ক’টা দিন সবাই শান্তিতে বাঁচো! তারপর তো রাতের ঘুমও উড়ে যাবে আর শান্তিতে বাঁচার কথা অনেক দুর!’
চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)