#চৈত্রিকা (৪০)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________
সাথীর কথার পিঠে কোনো কথা বলে না চৈত্রিকা। তবে হুট করেই যেনো মনে অশান্তির ঝড় বয়তে থাকে। পরপর কয়েকবার শুকনো ঢোক গিলে নিজেও সিলিং এর দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রহর তাকে নিজ স্বা’র্থে ব্যবহার করছে বিষয়টা মানতে পারে না সে। নিজেকে প্রথমে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে সাথীর দিকে তাকায়। শান্ত গলায় বলে,
‘তোকে কে বললো উনি আমাকে নিজ স্বা’র্থে ব্যবহার করছে শুধু? উনার কি লাভ এতে?’
সাথী হেঁসে ওঠে। শোয়া থেকে উঠে বসে চৈত্রিকার দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে। যেনো সাথীর হাসি তাকে তাচ্ছিল্য করছে। চৈত্রিকা শুধু তাকিয়ে থাকে। কিছু বলে নাহ। সাথী হাসি থামিয়ে বলে,
‘তুই এতো বোকা কবে হলি? ভালোবেসে বোকা হয়ে গেলি নাকি আগে থেকেই বোকা ছিলি?’
চৈত্রিকা এবারও কিছু বলে নাহ। শান্ত দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়েই থাকে। সাথী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘তুই এ বাড়িতে কেনো এসেছিলি এটা কি ভুলে গেছিস চৈত্র? প্রহর রেনওয়াজ যদি দো’ষী হয় তাহলে তোকে ভালোবাসায় জড়িয়ে তার কোন স্বা’র্থ হাসিল হবে এটাও কি বুঝতেছিস না! তুই তো এতোটাও অবুঝ না!’
চৈত্রিকা থম মে’রে থাকে। তার মস্তিষ্ক ঠিকই ধরতে পেরেছে বিষয়টা কিন্তু মানতে পারছে না। সাথী চুপ করে যায়। চৈত্রিকা কোনোমতে বলে, ‘জমিদার সাহেব ওমন না সাথী। উনি নিজেও বি’শ্বাস’ঘা’তকতা ঘৃ’ণা করে সেখানে আমার সাথে বি’শ্বাস”ঘা’তকতা কেনো করবে? তোর কোথাও ভুল হচ্ছে!’
‘ভালোবাসায় অ’ন্ধ হয়ে গেছিস। তোকে কিছু বলেও লাভ নেই। যেদিন মন ভা’ঙবে ওইদিনই তুই সবটা বুঝতে পারবি।’
‘তুই কিভাবে জানলি উনি আমাকে ঠ’কাচ্ছে!’
সাথী অদ্ভুত ভাবে হাসে। অদ্ভুত কন্ঠেই বলে, ‘বিয়ের দিন পিয়াস রেনওয়াজ বলেছিলো সবটাই৷ ওরা ওপরে ওপরে যা দেখায় ভেতরে ভেতরে তেমন না। আমরা যতটুকু জানি ওরা তার চেয়েও বেশি রহস্যময়। ওরা বাহিরে যতটা অমিল দেখায় ভেতরে ভেতরে ভাই ভাইয়ে ততটাই মিল। ওরা সব একসাথে মিলে আছে চৈত্র।’
চৈত্রিকা চট করে উঠে বসে। ক্ষ্রি’প্ত গলায় বলে, ‘তুই ওই জা’নো’য়া’রটাকে বিশ্বাস করছিস কেমন করে? তোর কান ভা’ঙিয়েছে আমাদের মাঝে ঝা’মেলা বাধানোর জন্য।’
‘এটা আমিও ভেবেছিলাম। কিন্তু! সময় এলে হয়তো তুই নিজেও সবটা বুঝে যাবি।’
চৈত্রিকা বুঝে ওঠে না কিছু। কে সত্যি আর কে মি’থ্যা এটাই মাথাার মধ্যে জট পাকিয়ে দেয়। সাথী বিছানা ছেড়ে উঠে নিজের শাড়ি ঠিক করে বের হয়ে যায় ঘর থেকে। চৈত্রিকা যেভাবে ছিলো সেভাবেই বসে থাকে। বেশ অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। প্রহর আসে ঘরে। ঘামে ভিজে একাকার হয়ে গেছে। চৈত্রিকাকে বিছানার ওপর এভাবে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকায়। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েই বলে,
‘এভাবে বসে আছো কেনো? গরম লাগছে না! শাড়ি বদলাবে না!’
চৈত্রিকা জবাব দেয় না। অন্য সময় হলে ঘামে ভেজা গা নিয়ে শোয়ার জন্য চৈত্রিকা নাক ফুলিয়ে গোসলখানায় পাঠিয়ে দিতো প্রহরকে। কিন্তু এই সময় কিছুই বললো না। থম মে’রে তাকিয়ে থাকলো শুধু। চৈত্রিকার হঠাৎ এমন ব্যবহারের কারণ সহজেই ধরতে পারে না প্রহর। ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কি হয়েছে?’
চৈত্রিকা নিঃশব্দে হুট করেই প্রহরের বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। আকস্মিক ঘটনায় প্রহর হতভম্ব হয়ে যায়। হঠাৎ কি হলো চৈত্রিকার! প্রহর কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলো নাহ। এক হাত চৈত্রিকার চুলের ভাজে দিয়ে নরম গলায় জিজ্ঞেস করে,
‘কিছু হয়েছে চৈত্র? কেউ কিছু বলেছে? তোমার মন খারাপ? বাবাকে মিস করছো?’
চৈত্রিকা এবারও জবাব দেয় না। চুপচাপ নাক মুখ গুজে রাখে প্রহরের বুকে। শুষে নেয় প্রহরের গায়ের গন্ধ। অদ্ভুত টান অনুভব করে। প্রহরের বুকে মুখ গুজেই রেখেই বলে,
‘আপনাকে ভালোবাসার আগে কখনোই ভাবিনি আমি আপনাকে ভালোবাসবো! এটা কেমন করে, কখন, কিভাবে হয়ে গেলো আমি জানি নাহ। আমি শুধু জানি আমি আপনাকে ভালোবাসি। মানুষ বলে না বিয়েতে আল্লাহর একটা রহমত থাকে! ভালোবাসাটা আপনা আপনিই চলে আসে! এখন এটা আমি মানি। যে আপনাকে আমি ঘৃ’ণা করে গেছি সবসময় সেই আমিই আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আমি জানি না আপনি আমাকে এই মায়ায় জড়িয়েছেন কেমন করে! আদৌও আমাকে ভালোবাসেন কি না আমার সত্যিই জানা নেই। আমি শুধু জানি আমি আপনাকে ভালোবাসি। আপনি কখনো কোনোরকম ভাবে আমার সাথে একটুও বি’শ্বাস’ঘা’তকতা করলে এই ভালোবাসা হয়তো ফের ঘৃ’ণায় রুপ নেবে। আবার আমাদের মাঝে আকাশ পাতাল দূরত্ব হবে। যা কখনোই আপনি মিটাতে পারবেন না৷ হারিয়ে ফেলবেন একটা আস্ত ভালোবাসার চৈত্রিকা। চৈত্রিকা কঠোর মনে ভালোবাসার জন্ম দিতে পারলে সেই ভালোবাসকে মাটি চাপা দিয়ে আবার কঠোর হতেও পারবে।’
প্রহর ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রয়। চৈত্রিকার চোখ বন্ধ। শেষের লাইন গুলো বলার সময় চৈত্রিকার কন্ঠের তেজ বোঝা যায়। প্রহর অবাক হলেও পরক্ষণেই হাসে। নিঃশব্দে জাপ্টে ধরে চৈত্রিকাকে। চৈত্রিকার মাথায় চুমু একে ছোট্ট করে বলে,
‘প্রহর রেনওয়াজ প্রয়োজনে বি’শ্বাস’ঘা’তকতা করতে পারে তবে চৈত্রিকার জমিদার সাহেব কখনোই তার চৈত্রিকার সাথে প্র’তা’রণা কিংবা বি’শ্বাস’ঘা’তকতা করতে পারে না।’
৯.
চিত্রর ঘর সাজানো হয়েছে সুন্দর করে। অর্পিতাকে সে ঘরে বসিয়ে দিলেও কাজিনমহল চিত্রকে ঘরে ঢুকতে দিতে নারাজ। তারা চিত্রর থেকে প্রথমে টাকা নিবে তারপর ঘরে ঢুকতে দেবে। রাত প্রায় ১২ টার ওপরে বাজে অথচ চিত্রকে ছাড়ার নাম গন্ধ নেই। চিত্র বেচারা বউ পেয়েও বউহীন থেকে কাঁদো কাঁদো হয়ে গেছে। চিত্র গলা ঝেড়ে সবার উদ্দেশ্যে বলে,
‘দেখ আমার কাছে টাকা নাই। আটকে রেখে লাভও নাই।’
পাশ থেকে চিত্রর এক কাজিন বলে, ‘জমিদারের ছোট পুত্র হইয়াও তুমি টাকা নাই বলো! আমাদের সাথে ফাজলামি না!’
পাশ থেকে অপরজন বলে, ‘ভাই একে তো তুই আমাদের ছোট। তারওপর আমাদের আগেই বিয়ে করে নিলি। এখন টাকা না নিয়ে তোরে ঘরে কেমনে পাঠাই বল!’
চিত্র চোখ মুখ কুঁচকে বলে, ‘ছোট ভাইয়ের থেকে টাকা চাচ্ছো তোমাদের লজ্জা লাগে না?’
‘তুই যে আমাদের আগে বিয়ে করে নিলি তোর কি লজ্জা লাগছে?’
‘নাহ লাগে নাই। তোমরাও বিয়ে করো। কে নিষেধ করছে!’
‘হাহ আমরা কি আর তোর মতো রাজ কপাল নিয়া জন্মাইছি ভাই! এতো কথা বাদ দিয়া টাকা বের কর!’
বেচারা চিত্র সবার চাপাচাপিতে নিজের পার্স বের করে দিয়েই দৌড় লাগায়। এক দৌড়ে ঘরে এসে দরজা আটকে বড় করে শ্বাস নেয়। মনে মনে বিশাল বকা দেয় সবাইকে। দম নিয়ে পিছে ঘুরে দেখে অর্পিতা ঘুমিয়ে পড়েছে। চিত্র অর্পিতার ঘুমন্ত মুখ দেখে হেঁসে দেয়। কাছে গিয়ে ঘুমন্ত মুখেই আলতো করে হাত ছুঁয়ে দেয়। নড়ে চড়ে উঠে আবার ঘুমিয়ে পড়ে অর্পিতা। চিত্র কয়েক পল অর্পিতার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কপালে চুম্বন করে। পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। যেনো কতদিন পর তার মনে প্রশান্তিরা হানা দিয়েছে। যেনো কত যুগ পর মেয়েটি শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। কত যুগ পরই তো! এতো গুলো দিনে কি তাদের ওপর কম ঝড় ঝাপ্টা গেছে! উহু নাহ। দুজন দুজনকে পাওয়ার ০% চান্স থেকেও আজ তারা বিবাহিত দম্পতি। সুখটা এতো কিছুর পরই এসেছে। তবুও শুকরিয়া যে সবকিছুর পর দুজন দুজনকে পেয়েছে। চিত্র দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নিজের শেরওয়ানি বদলায়। হাত মুখ ধুয়ে এসে আলগোছে ডাকে অর্পিতাকে। দু একটা ডাকেই অর্পিতা লাফিয়ে ওঠে। মস্তিষ্কের চলাচল হুট করেই বন্ধ হয়ে যায়। চিত্র ব্যস্ত কন্ঠে বলে,
‘আস্তে আস্তে! কি করছিস!’
অর্পিতা কিছুক্ষণ থম মে’রে বসে থেকে ছোট করে বলে, ‘তুমি কখন এসেছো? সরি আসলে আমি বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’
চিত্র হেঁসে বলে, ‘ভালো করেছিস! এতো ভারী শাড়ি গহণা নিয়ে ঘুমানোর চেয়ে আগে এগুলো পাল্টে নিতি!’
‘উহু নাহ। সবাই বলেছে বিয়ের সাজ বর ভালো মতো দেখার পরই যেনো তুলি তার আগে না। কিন্তু আমি কি আর জানতাম যে তুমি আসার আগেই আমি ঘুমিয়ে পড়বো!’
‘হয়েছে! বর সাজ দেখেছে মন মতো। এবার এগুলো চেঞ্জ করে আয়!’
অর্পিতা ঠোঁট কামড়ে বলে, ‘তুমি সত্যিই দেখেছো?’
চিত্র ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘মি’থ্যা বলছি নাকি আমি! জলদি এগুলো চেঞ্জ করে এসে নামাজ পড়ে ঘুমা।’
অর্পিতা মাথা নাড়ায়। ভদ্র মেয়ের মতো সব কিছু চেঞ্জ করে বাসন্তী রঙের একটা শাড়ি পড়ে। তারপর দুজনে মিলে নামাজ পড়ে নেয়। চিত্র অর্পিতাকে ঘুমাতে বলে নিজে বারান্দায় যায়। বাহিরে বাতাস বয়ছে। সেই বাতাস শুষে নিয়ে চেয়ে থাকে দুর পানে। খানিক বাদেই অর্পিতাও পাশে এসে দাঁড়ায়। চিত্র গম্ভীর স্বরে বলে,
‘তুই ঘুমাসনি!’
অর্পিতা বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে নেয়। চিত্রর হাত রেলিং থেকে সরিয়ে নিজে চিত্রর সামনে দাঁড়ায়। দু হাতে চিত্রর গলা জড়িয়ে বলে, ‘প্রথমত আমার সাথে একদম গম্ভীর হয়ে কথা বলবে না আর দ্বিতীয়ত আজকে ঘুমাবো না।’
‘ঘুমাবি না কেনো?’
‘দুজনে চন্দ্রবিলাস করবো।’
চিত্র কিছু বলে না। অর্পিতা চিত্র গলা ছেড়ে দিয়ে সামনে ফিরে দাঁড়ায়। নিজের মাথা চিত্রর বুকে ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে সময়টা অনুভব করতে থাকে। চিত্র নিজেও থুতনী অর্পিতার কাঁধে রেখে দু’হাতে জাপ্টে ধরে থাকে। দুজনেই দুরে তাকিয়ে থাকে নিঃশব্দে। নীরবতাকে কাটিয়ে অর্পিতা জিজ্ঞেস করে,
‘আচ্ছা চিত্র ভাই! তুমি সেদিন হারিয়ে গেছিলে কেনো? আর এভাবে ফিরে এসেছিলে কোথা থেকে?’
চিত্র শান্ত গলায় জবাব দেয়, ‘তোর ওপর অভিমান করে সরে আসলেও আমি নিজে থেকে হারাইনি। আমাদের দেখার পিঠেও অনেক দেখা থাকে। সেদিন আমি বাড়ি থেকে বের হতেই কেউ আমার মাথায় আ’ঘাত করেছিলো। তারপর কোথায় ছিলাম জানি নাহ। একটা তালাবদ্ধ অন্ধকার ঘর। কিভাবে ছিলাম নিজেও জানি নাহ! আর সেদিন এখানে কিভাবে বা কেনো এসেছিলাম তাও জানি না আমি।’
অর্পিতাকে ধরে রাখা হাত দুটো আরো শক্ত হয়। অতীতের কালো একটা অধ্যায় যে চিত্রকে কাঁপিয়ে তুলেছে তা টের পেতে খুব একটা দেড়ি হলো না অর্পিতার। চট করেই চিত্রর হাত নিজেও শক্ত করে ধরে রাখলো। যেনো বলছে ‘ভয় পেও নাহ। অতীত অতীতেই থাকুক। আমি আছি তোমার পাশে।’ কিছুটা সময় এভাবেই একে অপরের ভরসা হয়ে কেটে গেলো৷ চিত্র খানিকটা স্বাভাবিক হতেই অর্পিতা চিত্রর দিকে ঘুরে তাকিয়ে পা উঁচু করে কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। একে অন্যের সাথে খুনশুটিতে মেতে ওঠে। এই খুনশুটি থেকেই ফের শুরু হয় নতুন সকাল হওয়ার অপেক্ষা। একে অপরে মিশে রয় রাত সাক্ষী করে।
১০.
চিত্র আর অর্পিতার বউ ভাতের অনুষ্ঠান আজ। সকাল সকাল গোসল করে চৈত্রিকা চুল এলোমেলো করেই বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলো। নিচের সব কাজ পর্যবেক্ষণ করছিলো। হালকা রোদের ছিটে এসে লাগছিলো সরাসরি মুখের ওপর। নিচ থেকে সেই সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিলো চিত্রর কাজিন তামিম। পাশেই তার আরেকটা কাজিন সবুজ দাঁড়িয়ে। চৈত্রিকার দিকে তাকিয়েই তামিম আফসোসের সুরে বলে,
‘এবারের বড় ভাবীজান একটু বেশিই সুন্দর না সবুজ? হায়! আমি যদি পাইতাম রে ভাই!’
সবুজ ঠা’স করে গা’ট্টা বসিয়ে দেয় তামিমের মাথায়। সতর্কিত কন্ঠে বলে, ‘জীবনে মেয়ের অভাব নাকি যে বড় ভাবীজানের দিকে তাকাচ্ছিস!’
‘ভাই মেয়ের অভাব তো নেই তবে এই ‘চৈত্রিকা’ নামক বড় ভাবীজানের অভাব।’
সবুজ শব্দ করে হেঁসে ওঠে। পরক্ষণেই বলে, ‘যত যায় হোক! পৃথিবীর সব মেয়ের দিকে নজর দিয়ে বসে থাক কিন্তু প্রহর ভাইজানের বউয়ের দিকে ভুল করেও নজর দিস না ভাই। উনি জানলে তোর মাথা থেকে দে’হ আ’লাদা করতে দুবারও ভাববে নাহ।’
তামিম পাত্তা দেয় না সে কথায়। যেনো তার কিছু যায় আসে না এমন একটা ভাব নিয়ে বলে, ‘প্রহর ভাই কিছুই করতে পারবে না। সে জমিদারের বড় ছেলে হলেও আমার বাবার ক্ষমতাও কোনো দিকে কম না। মন চাইলে হাজার বার তার বউয়ের দিকে তাকাবো। নজর দেবো। কি করবে!’
শুধু এগুলোতেই থেমে থাকেনি। বি’শ্রী কিছু কথা জুড়ে দেয় সাথে। কথাগুলো শেষ করতে দেড়ি হলেও তামিমের পিঠে লা’থি পড়তে দেড়ি হয়নি। সবুজ আতঙ্কে পিছু তাকিয়ে দেখে ভ’য়ং’কর দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রহর। সবুজ জানে এখন কি হতে পারে তাই ভয়েই আগে দু পা পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়ায়। প্রহর কোনো কথা ছাড়াই তামিমকে তুলেই পরপর থা’প্প’ড় বসিয়ে দেয়। তামিম বুঝে ওঠার আগেই তার গালে ৫ আঙুলের ছাপ বসে গেছে। প্রহর পর পর থা’প্রা’তেই থাকে। নিবিড়, চিত্র, অনিম এসে জলদি থামায়। বাকিরা কেউ এগোনোর সাহসই পায় না। প্রহর হিং’স্র প্রাণীর মতো ফুঁসতে থাকে। চিত্র ব্যস্ত গলায় বলে,
‘কি করছো ভাইজান! মা’রছো কেনো ওকে? কি হয়ছে?’
প্রহর কিছু না বলে শুধু ফুঁ’সতে থাকে৷ এর মাঝেই তামিমের বাবা মা ছুটে আসে। তামিমের বাবা প্রহরের দিকে তাকিয়ে কড়া কন্ঠে বলে, ‘তুমি আমার ছেলেরে মা’রলে কেনো প্রহর?’
প্রহর ফোঁস করে ওঠে। কন্ঠের জোড় বাড়িয়ে খ্যাক করে বলে, ‘এক্ষুণি এটাকে নিয়ে বের হন এই বাড়ির সীমানা থেকে। এখন শুধু থা’প্প’ড় দিয়েছি আর ১ মিনিটও এটাকে নিয়ে দাঁড়ালে আমি ওকে এখানেই কু’র’বা’নী দিবো। দুর হন চোখের সামনে থেকে!’
সবাই অবাক হয়। তামিমের বাবা মা প্রহরকে বে’য়া’দব বলে কথা শোনাতে শোনাতে আ’হত ছেলেকে নিয়ে জমিদার বাড়ি থেকে বের হয়। প্রহর কাউকে কিছু না বলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গটগট করে বের হয়ে যায়। বিয়ে বাড়ির আমেজ ঝা’মেলার জন্য হুট করেই খানিকটা কমে গেলো। প্রহর সরাসরি ঘরে আসে। চৈত্রিকা ব্যস্ত গলায় শুধায়,
‘নিচে কি হয়ছে? ঝামেলা হলো কেনো জমিদার সাহেব? ওই ছেলেটাকে মা’রলেন কেনো?’
প্রহর যেনো এ কথার পিঠে দ্বিগুণ ক্ষে’পে উঠলো। চৈত্রিকার বাহু চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘কে বলেছে তোমাকে বারান্দায় দাঁড়াতে! ঘরের ভেতর চুপ করে বসে থাকতে পারো না? মানুষকে নিজের রুপ দেখিয়ে বেড়াতে মজা লাগে!’
চৈত্রিকা হতভম্ব হয়ে বলে, ‘কি বলছেন এসব?’
প্রহর চট করে ছেড়ে দেয় চৈত্রিকার হাত। ফুঁসতে ফুঁসতে বলে, ‘দুরে যাও আমার থেকে। আমার মাথা ঠিক নেই। তোমাকে কি থেকে কি বলবো জানি না! এখান থেকে যাও তুমি!’
প্রহর মাথা চেপে দাঁড়িয়ে থাকে। চৈত্রিকা শান্ত হয়ে প্রহরের দিকে তাকিয়ে থাকে৷ প্রহর রাগে কাঁপতে থাকে। রাগ সামলাতে না পেরে হাতের কাছে যা পায় তাই ছুড়ে মা’রে। চৈত্রিকা চোখের পলকে কিছু না ভেবেই প্রহরকে জড়িয়ে ধরে। প্রহর নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে। মুহূর্তেই চৈত্রিকা করে বসে আরেকটা অনাঙ্ক্ষিত কান্ড!
চলবে..
#চৈত্রিকা (৪১)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________
১১.
বউ ভাতের জন্য সুন্দর করে সাজানো হয়েছে অর্পিতাকে। পুরো বাড়িতে আজও মেহমানের কমতি নেই। সকালের পর লজ্জায় আর চৈত্রিকা প্রহরের আশে পাশেও ঘেষেনি। প্রহর সকালের অবাকতাটা এখনো বোধহয় কাটিয়েই উঠতে পারেনি। কি থেকে কি হয়ে গেলো ভাবতেই মাথা ঘুরে যাচ্ছে। চারপাশের হট্টগোলের মাঝে বিরক্ত হচ্ছিলো সাথী। তাই চুপচাপ নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। খানিক বাদেই দরজার বাহির থেকে চৈত্রিকা ডাকে। সাথী অলস পায়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। চৈত্রিকা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে,
‘একা একা কি করছিস? খাবি না তুই? জলদি চল!’
সাথী কোনো কথা না বলেই জড়িয়ে ধরে চৈত্রিকাকে। চৈত্রিকাা একটু চমকায়। এক হাত সাথীর পিঠে রেখে নরম স্বরে বলে, ‘কি হয়েছে সাথী? মন খারাপ তোর!’
সাথী কোনো রকমে কান্না আটকে বলে, ‘আমি তোকে সত্যিই ভীষণ ভালোবাসি চৈত্র। তোকে বরাবরই নিজের বোন মেনে এসেছি। তোর সকল সিদ্ধান্তে আমি তোর পাশে থেকেছি। আমি সত্যিই চাই না তোর জীবনটা আরো এলোমেলো হোক! তুই এখান থেকে পালিয়ে যা বোন!’
সাথীকে সোজা করে দাঁড় করায় চৈত্রিকা। দু হাতে মুখ আগলে নিয়ে ভরসার স্বরে বলে, ‘ভয় পাচ্ছিস কেনো তুই? আমাকে চিনিস না? বুঝিস না? আমার যদি চলে যাওয়ার হতো তবে কি এখানে আসতাম? তোর হঠাৎ কি হয়েছে? পিয়াস রেনওয়াজ কিছু বলেছে তোকে? আবার কোনো ভয় দেখিয়েছে?’
সাথী জবাব দেয় না। মনে মনে ভীষণ আক্ষেপে ফেটে পড়ে৷ চৈত্রিকা বোঝে এতো সহজে কিছু বলার মেয়ে সাথী নাহ। অথচ এই সাথীই তাকে সবকিছু বলে শান্তি পেতো। ক’দিনের মাঝেই কি এমন হয়ে গেলো যে মেয়েটা তার থেকে কথা লুকাচ্ছে! চৈত্রিকা সাথীকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজেও পাশে বসে। অনেকক্ষণ নীরবতার পর বলে,
‘আমি জানি না কি কারণে তুই আমাকে নিয়ে এতোটা ভয় পাচ্ছিস! তোকে এর আগেও অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি পিয়াসকে বিয়ে করার কারণ কি! তুই কিছু বলিস নি। চুপ ছিলি পুরোটা সময়ই। তোর আমাকে নিয়ে ভয়ের কারণেই কি এই বিয়ে?’
সাথী নিঃশব্দে হাসে। ছোট্ট করে বলে, ‘সময় এলে তুই নিজেই সবটা জেনে যাবি।’
চৈত্রিকা হতাশার শ্বাস ফেলে। এ বিষয়ে যে এই মেয়েটা আর কিছুই বলবে না তা বুঝতে বাকি নেই। অগত্যা কথা না বাড়িয়েই সাথীকে টেনে নিচে নিয়ে যায় খাওয়ার জন্য। নিচে এসে সাথীকে খেতে বসিয়ে চৈত্রিকা চিত্র আর অর্পিতার কাছে যেতে নেয়। রাস্তায় পথ আগলে দাঁড়ায় পিয়াস। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চৈত্রিকা পিয়াসের দিকে তাকিয়ে থাকে৷ পিয়াস বি’শ্রী রকম হেঁসে বলে,
‘কোথায় যাচ্ছেন ভাবীজান? অনেক তাড়া মনে হচ্ছে!’
চৈত্রিকা চোখ মুখ শক্ত রেখে জবাব দেয়, ‘হ্যাঁ। পথ ছাড়ুন!’
‘ছেড়ে দেবো তো। আগলে রাখার জন্য বসে নেই অবশ্য আমি। তো ২ বোনের একই বাড়িতে সময় কেমন কাটছে? বোন+বান্ধবী এখন তো জা হয়ে গেছেন। মজা হচ্ছে না?’
‘মজা হতো তো! কিন্তু আমার বোনটার বিয়ে হয়ে গেছে একটা কু’কুরের সাথে তাই মজা বাদ দিয়ে একটু রেগেই আছি।’
চৈত্রিকা সূক্ষ্ম খোঁচা পিয়াসকে জ্ব’লিয়ে তোলে। ফোঁস করে উঠে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘আপনি আমাকে কু’কুর বললেন!’
চৈত্রিকা না জানার মতো ভান করে বলে, ‘ছিঃ ছিঃ কি বলেন! আপনাকে কু’কুর বলার সাহস আছে নাকি আমার? কু’কুররাও তো লজ্জা পেয়ে যাবে!’
চৈত্রিকার একেকটা খোঁচা পিয়াসের মনে গেথে রইলো। দাঁতে দাঁত চেপে হজম করার চেষ্টা করে গেলো অনবরত। চৈত্রিকার ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি। চৈত্রিকা পিয়াসকে এড়িয়ে চলে যেতে নিলে পিয়াস আরো একবার ডাকে। ঠোঁটের কোণে কু’টিল হাসি ঝুলিয়ে বলে,
‘সব অ’পমান আজকের মতো গিলে নিলাম ভাবীজান। এগুলোর শোধ এক চালে দেবো। একটু সাবধানে থাকবেন!’
১২.
আত্মীয় স্বজন ধীরে ধীরে কমে গেছে বিকেলেই। পল্লবী সারাদিনের ধকল সামলে কেবলই রুমে ঢুকেছে। পেছন পেছন চৈত্রিকাও এসেছে। পল্লবী এসময় চৈত্রিকাকে দেখে খানিকটা চমকালেও তা বুঝতে দেয় না। হাসার চেষ্টা করে বলে,
‘তুমি এই সময় বড় বউ! কিছু বলবা?’
চৈত্রিকা নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো। মনে মনে সকল প্রশ্ন পর পর সাজিয়ে মুখ ভঙ্গি কঠিন করে৷ গম্ভীর স্বরে বলে, ‘আপনার সাথে কথা আছে আম্মাজান!’
‘হ্যাঁ বলো!’
চৈত্রিকা মিনিট দুয়েক ঝিম মে’রে দাঁড়িয়ে থাকে। পল্লবী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে আছে কিছু শোনার উদ্দেশ্যে! চৈত্রিকা চোখে চোখ রেখে সরাসরি বলে,
‘আমি আপনাকে যা জিজ্ঞেস করছি তার সরাসরি উত্তর দিবেন আম্মাজান। কোনো কিছু প্যাচাবেন নাহ। আমার এই বাড়িতে বউ হয়ে আসার উদ্দেশ্য আপনি জানতেন প্রথম থেকেই? আমাকে নিজের প্রতি’শো’ধের হাতিয়ার বানালেন কেমন করে?’
পল্লবী এই দুটো প্রশ্নেই হকচকিয়ে যায়। কি উত্তর দেবে কিংবা মুখভঙ্গি কেমন করে তা বুঝেই উঠতে পারে নাহ। চৈত্রিকার এই হঠাৎ প্রশ্নগুলো যেনো তাার কাছে ধরা পড়ে যাওয়া চো’রের মতো। তবুও না দমে কন্ঠ শক্ত করে বলে,
‘আমি কিভাবে তোমার উদ্দেশ্য জানবো? কিসের উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছো তুমি? আর আমার কিসের প্রতিশো’ধ!’
চৈত্রিকা ঠোঁট বাকিয়ে হাসে। হাত বগলদাবা করে শীতল কন্ঠে বলে, ‘আমি শুনেছি সবটা কাল। তবুও আপনি যদি অস্বীকার করতে থাকেন তবে ঠিক আছে! আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি কোনো রকম প্রতিশো’ধ ছাড়াই এ বাড়ির বউ হয়ে কাটিয়ে দেবো। এমনিতেও এখন জমিদার সাহেবকে ভালোবেসে ফেলেছি।’
পল্লবী আরো একবার চমকায়। শেষের বাক্য যে সত্য তা সে জানে। কিন্তু এই কঠিন মেয়েটি কি সত্যি প্রতিশো’ধ নেওয়ার খেলাটা ছেড়ে দেবে? পল্লবীর ভাবনার মাঝেই চৈত্রিকা উল্টো ঘুরে ঘর থেকে বের হতে নেয়। যত কদম এগোয় ঠিক ততোটাই অপেক্ষা করে আশাকৃত ডাকের। এবং তাকে সফল করে দিয়েই পল্লবী পিছু ডাকে। চৈত্রিকার হাসি প্রসারিত হয়। তবে মুহুর্তের মাঝেই তা বিলীন হয়েও যায়। পল্লবী গম্ভীর মুখে এগিয়ে এসে বলে,
‘বিছানায় বসো!’
চৈত্রিকা মাথা নাড়িয়ে তাই করে। পল্লবী ঠিকমতো বাহিরটা পর্যবেক্ষণ করে ঘরের দরজা লাগিয়ে দেয়। চৈত্রিকার মুখোমুখি একটা চেয়ার টেনে বসে কিছুক্ষণ ঝিম মে’রে থাকে। চৈত্রিকা সময় দেয়। পল্লবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
‘তুমি এ বাড়ির বউ হওয়ার আগে থেকেই আমি তোমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত ছিলাম। তোমাকে এবাড়ির বউ হওয়ার সুযোগটাও আমিই করে দিয়েছি। চয়ন রেনওয়াজকে রাজি করিয়েছি আর বিয়ের প্রস্তাবটা তোমার মামিকে দিয়েছি।’
চৈত্রিকা শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘সকল প্রশ্নের উত্তর দিন! আপনি কেমন করে জানলেন আমার প্রতিশো’ধ সম্পর্কে? নিজেরটার সাথেই বা কেনো গোলালেন আমাকে? আপনার সাথেই বা অতীতে কি হয়েছিলো? আর আপনি ছাড়া এসব কে কে জানে? আর আমার কেনো যেনো মনে হয় আমাকে দেওয়া পূর্বের সব চিরকুট, সব সাহায্য আপনার ছিলো! এটা কি সত্যি?’
পল্লবী সহসাই জবাব দেয় নাহ। ফের কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজের উত্তরগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে নিলো। হাতে হাত চেপে চৈত্রিকার চোখে চোখ রেখে প্রথম থেকে বলতে শুরু করে,
‘আমার বিয়ের আগে আমি সদ্য মাধ্যমিক দেওয়া ছাত্রী ছিলাম। পড়ালেখায় ভালো হওয়ায় বাবা-মা এখনই বিয়ে দেবেন না বলে ঠিক করলেন। কিন্তু আমাদের গ্রামে একদিন চয়নের চোখে পড়ি আমি। চয়ন জমিদারের বড় ছেলে হওয়ায় বাবার মৃ’ত্যুর পর সেই জমিদারি কার্য পায়। তার চরিত্র সম্পর্কে এই গ্রামসহ পাশের আরো প্রায় কয়েকটা গ্রামেও জানাশোনা ছিলো। জমিদারের ছেলে হওয়ায় কেউ কিছু বলতে নাা পারলেও নিজের মেয়েদের রাখে সাবধানে। আমি কিভাবে হুট করে যেনো ওর সামনে পড়ে যাই। এরপর আমার পিছে লাগে উঠে পড়ে। বাবা মা বিয়ে দিতে নারাজ হলে চয়ন সরাসরি মে’রে ফেলার হুমকি দেয়। বাবা মা এসবে অতিষ্ঠ হয়ে আমাদের নিয়ে গ্রাম ছাড়ে। কিন্তু পিছু পিছু সেখানেও চয়ন হাজির। আমাদের বাড়িতে বয়ে এসে বাবাকে ফের কড়া গলায় বিয়ের প্রস্তাব দিলে বাবা রেগে থা’প্প’ড় বসিয়ে যা তা বলে দেয়। চয়ন ক্ষে’পে ওঠে। চারপাশের কিছু না দেখেই সেদিন রাতে আমার বাবা-মা’কে সেই বাড়ির মাঝেই পু’তে দেয়! চোখের সামনে নিজের বাবা-মা’কে মা’রতে দেখে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। যখন আমার জ্ঞান ফিরে তখন নিজেকে বি-বিবস্ত্র পাই। আমি চমকায়। চয়ন সেদিন শেষ চালে বাজিমাত করেছিলো। আমার সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে বাধ্য করেছিলো বিয়ে করতে। আমি তখন কাঠের পুতুল! অনুভূতিহীনের মতো বিয়েও করলাম। তবে সেদিনই প্রতিজ্ঞা করলাম হয় ওকে মা’রবো নয়তো নিজে ম’রবো। ভাগ্যের পরিহাসে ওকে মা’রতে পারিনি আর না নিজে ম’রতে পেরেছি। আ’ত্মহ’ত্যা করার কথা ভাবলেও করতে পারিনি। বিয়ের পর হাজার বার হাজার ভাবে চয়নকে মা’রার চেষ্টা করেছি কিন্তু ‘ও’ এতোটাই চালাক, চতুর আর বিচক্ষণ ছিলো যে সবসময় আমাকে ধরে ফেলতো। আর এসবের জন্য আমার শা’স্তি ছিলো ভ’য়ং’কর। একেকটা শা’স্তির কথা মনে পড়লে আমার এখনো শরীর কাঁপে। কখনো পিঠে চা’বুক দিয়ে মে’রে কেটে তাতে আবার লবণ, মরিচ লাগিয়ে দিতো, কখনো অন্ধকার ঘরে আটকে রেখে দিতো, কখনো চা’মড়া ছি’লে নিতো! একেকটা শা’স্তির সময়ের আমার হাহাকার পুরো জমিদার বাড়ি কাঁপাতো কিন্তু ভয়ে কেউ এগোতো নাহ। কতোবার ওকে বলেছি আমাকে মে’রে ফেলতে কিন্তু মা’রেনি। জা’নো’য়া’রটা বাঁচিয়ে রেখে তিলে তিলে কষ্ট দিতে থাকে। এর মাঝেই জানতে পারি আমি অন্তঃসত্ত্বা। মাথায় পুরো আকাশ ভেঙে পড়েছিলো। তখন আমি কিছু করলে যে আমার সন্তানটাও শেষ হয়ে যাবে এই ভেবে আর কিছু করতে পারলাম না। চয়ন নিজের সন্তান আসার খবরে খুশিই হয়েছিলো। তবে গোপনে এসে বলেছিলো আমি কিছু করলে এবার সবকিছুর শা’স্তি আমার সন্তান পাবে। মনে ঘৃ’ণা থাকলেও মাতৃত্ব আমাকে আর এগোতে দিলো নাহ। সেদিন চিৎকার করে কেঁদেছি আমি। নিজের পরাজয়ের আক্ষেপে কেঁদেছি। প্রহর হওয়ার পর আর কিছু করতে পারিনি। ছেলেটার কিছু করুক বা না করুক আমার যদি কিছু হয়ে যায় তখন আমার ছেলেটাকে একদম নিজের মতো অ’মানুষ বানিয়ে ফেলবে তা বুঝতে বাকি ছিলো নাহ। নতুন করে আরেক যু’দ্ধ শুরু হলো। চয়ন অ’ন্যায় করা শিখাতো আর আমি ছেলেকে ন্যায় শিখাতাম। ওরই অন্যায়কে কে’টে কুটে ন্যায়ে বদলে দিতাম। ছেলেটা হয়েওছিলো! ওর বুঝ হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে পা’থর বানিয়ে দিলো চয়ন তবে মন থেকে ন্যায়, অ’ন্যায় মুছতে পারলো নাহ। প্রহরকে আমি মানুষ করতে পারলেও পিয়াসটাকে পারলাম না। একদম জাতের মতো হয়েছে। অ’মানুষ! চিত্রকে সবকিছু থেকে যথেষ্ট আগলে রেখেছে প্রহর। এতো বছরে সবকিছুর থেকে দুরে সরে এসেছিলাম শুধু মনে আক্ষেপের দলা গুলো টিকে ছিলো। এর মাঝেই সাদিক আর নাসিমার বিয়ে হয়। কৌশলে ওদের সব ঘটনায় জানতে পারি আমি। তোমাকে দেখেছি আমি মহুয়ার মৃ’ত্যুর পর। জানতে পেরেছিলাম তুমি নাসিমার মেয়ে। তোমার সাথে কি হয়েছে সবটাই জেনেছিলাম। মনে হয়েছিলো এবার তোমার অ’ন্যায়ের সাথে সাথে নিজের সাথে হওয়া অ’ন্যায়ের শা’স্তিও হবে। তুমি বেঁচে আছো দেখে চয়ন প্রথমেই ভাবে তোমাকে মে’রে ফেলবে যেকোনো মূল্যে। ততদিনে আমি তোমার তেজ, সাহস সবটা সম্পর্কেই অবগত হয়ে গেছি। চয়নকে অনেক বুঝিয়ে প্রহরের সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করলাম। কথা ছিলো বিয়ের পর প্রহর তোমাকে ধীরে ধীরে শা’স্তি দেবে। কিন্তু চয়ন আমার মূল উদ্দেশ্য জানতে পারেনি। ওর বিচক্ষণ বুদ্ধিও আমার কাছে হেরে গেছে। তোমাকে সব ধরনের চিরকুট, সাবধান বাণী সব আমিই দিতাম। অনেক সাবধানেই দিতাম।’
চৈত্রিকা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘জমিদার সাহেবকে নিয়ে যা বলতেন ওগুলো? নিজের ছেলেকে মা’রার জন্য উ’স্কে দিতেন আমাকে!’
‘নাহ নাহ। ওটা শুধুমাত্র তোমাকে দেখানোর জন্য ছিলো। আমি জানতাম বিয়ের পর তোমার ধারণা পাল্টাবে। আমি তোমার জীবন শেষ করে দেইনি। বরং তোমাকে তোমার যোগ্য জীবনসঙ্গী দিয়ে অ’ন্যায়ের শা’স্তি দেওয়ার সহজ রাস্তা দেখিয়েছি। আমি চাইলেই পিয়াস কিংবা চিত্রর সাথেও তোমার বিয়ে পাঁকা করতে পারতাম কিন্তু আমার উদ্দেশ্য ছিলো তোমাকে শক্ত হাত দেওয়া।’
‘জমিদার সাহেব জানতেন সব? আমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে উনি প্রথম থেকেই অবগত ছিলেন?’
‘প্রহর এক বছর আগের ঘটনা সবটাই জেনেছিলো। পরে এটাও জানতো তুমিই নাসিমার মেয়ে। তোমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বুঝতে ওর দেড়ি হয়নি। নিজের স্বা’র্থে না, তোমার আর আমার স্বার্থেই বিয়ে করেছিলো তোমাকে।’
চৈত্রিকা অবাক হয়। ভীষণ রকম অবাক হয়। জমিদার সাহেব তার মানে সত্যিই সব জানতেন! সত্যিই কি চৈত্রিকাকে তার স্বা’র্থে বিয়ে করেছিলো নাকি এটার পেছনে জমিদার সাহেবের নিজেরও স্বা’র্থ আছে! ভেবে পেলো না। পল্লবী মাথা নিচু করে বসে আছে। চৈত্রিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পল্লবীর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নেয়। আশ্বাস দিয়ে বলে,
‘আপনার সাথে যা হয়েছে তা প্রচন্ড রকমের বা’জে হয়েছে। আপনার, আমার আরো যত মেয়ের সাথে অ’ন্যায় করেছে এরা! তার সবটুকু শা’স্তি আমি দেবোই। কথা দিলাম!’
পল্লবী অবাক চোখে তাকায়। চৈত্রিকা মুচকি হেঁসে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। ভাবতে থাকে নিজের সাথে ঘটে যাওয়া ১ বছর আগের ঘটনা। সেদিন সত্যি সত্যিই চৈত্রিকা যখন ঘরে বই পড়ছিলো তখন বাড়িতে হৈ চৈ এর শব্দ হয়। চৈত্রিকা ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দরজা ঘেষে দাঁড়িয়ে ছিলো। নিজের চোখে দেখেছিলো চয়ন, নাসিমা, সাদিককে! কি নি’ষ্ঠুর ভাবে চৈত্রিকার বাবাকে মে’রেছে! একের পর এক আ’ঘাত করেই গেছে। চৈত্রিকা তখন গগনবিদারী চিৎকার করে ছুটে গেছিলো বাবার কাছে। কিন্তু নাসিমা তাকে পৌঁছাতে দেয়নি। চৈত্রিকা নিজের হাতটা শাড়ি ভেদ করে কোমড়ে রাখে৷ সেখানে এখনো একটা দাগ জ্বলজ্বল করছে। এই দাগটা তার মায়ের দেওয়া। নিজে হাতে তাকে ছু’ড়ির আ’ঘাতটা এই মা-ই দিয়েছিলো। জন্মও সে দিয়েছিলো আর মৃ’ত্যুও সেই দিতে চেয়েছিলো। ভাগ্য ভালো থাকায় শুধু আঁচড় পড়েছিলো জায়গাটাই। তবে আঁচড়টাও ছিলো ভীষণ গভীর। তখন বার বার চৈত্রিকার বাবা বলছিলো, ‘আমার চৈত্রকে ছেড়ে দাও! ওর তো কোনো দোষ নেই। ওকে মে’রো না! চৈত্র মা আসিস না কাছে। চলে যা মা!’
নাসিমার মন গলেনি। চৈত্রিকার শত আহাজারিতেও তার বাবার কাছে পৌঁছাতে দেয়নি। ধাক্কা মে’রে ঘরে আটকে পুরো বাড়িতে আ’গুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলো। চৈত্রিকার আহাজারি, হাহাকার কেউ শোনেনি। নি’ষ্ঠুর গুলোর একটুও মায়া হয়নি। ভেবেছিলো চৈত্রিকা আর তার বাবা পু’ড়ে ছাই হয়ে যাবে। কিন্তু বাড়িতে আ’গুন লাগার কয়েক মিনিটের মাথাতেই র’ক্তাক্ত শরীর নিয়েই মেয়েকে বাঁচিয়ে ছিলেন চৈত্রিকার বাবা। আজও বাবার কথাগুলো চৈত্রিকার কানে বাজে। নিজের বাবাকে সে চোখের সামনে নিঃশ্বেষ হতে দেখেও কিছু করতে পারেনি। শেষ বারের মতো প্রিয় বাবার মুখটাও দেখার মতো ছিলো নাহ। সব পু’ড়ে ছাই হয়ে গেছিলো। চৈত্রিকার আক্ষেপ সে তার বাবাকে বাঁচাতে পারেনি! ভেতরের আক্ষেপ গুলোই হিং’স্র হলো। প্রতিশো’ধের নেশায় বুদ হয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে প্রতিজ্ঞা করলো! কঠিন প্রতিজ্ঞা! ছোট্ট মেয়েটি নিজের বাবাকে চোখের সামনে ছটফট করে মা’রা যেতে দেখে, বাবার আহাজারি দেখে, তাকে বাঁচানোর সর্বস্ব চেষ্টা দেখে আর নিজের মায়ের বিশ্বাসঘা’তকতা দেখে হুট করেই বড় হয়ে গেলো। সব কিছু থেকে অনুভূতিহীন হয়ে হুট করেই সাহসী, তেজী হয়ে উঠলো।
চলবে..