চৈত্রিকা পর্ব-৫০+৫১

0
533

#চৈত্রিকা (৫০)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________

৩২.
সময় বহমান। দেখতে দেখতে কেটে গেছে প্রায় ৩ টা মাস। নীরার প্র্যাগনেন্সির বয়স আপাতত ৫ মাস। পেট ফুলেছে কিছুটা। বাড়ির সবাই তার যত্নআত্তিতে কম রাখছে নাহ। নীরাও খুশি। অর্থি এখনো জমিদার বাড়িতে আছে। শহরে টিকে থাকা তো কম কথা নয়। তাই ওখানে সবকিছু পাকাপোক্ত করে এমাসেই এসে নিয়ে যাবে নিবিড়। অর্থির মন খারাপ হয় খুব। মাষ্টারমশাইকে ভেবে তার মনে ঝড় বয়ে যায়। চিত্র, অর্পিতা আপাতত শহরে আছে। যান্ত্রিক শহরে নিজেদের পড়ালেখার সাথে সাথে ছোট্ট একটা সংসারও সাজিয়েছে। চৈত্রিকা আর প্রহরের মাঝের সম্পর্ক আগের চেয়ে সহজ হয়েছে। ভালোবাসা বেড়েছে দ্বিগুণ। গরমের দিন হওয়ায় দুপুর বেলায় খেয়ে ভাতঘুম দিয়েছে প্রহর। পল্লবী বোনের বাড়ি গেছে। চয়ন আর সাদিক নিজেদের কাজে গেছে। শিমুল আর শায়লাও শহরে। নীরা আর অর্থিও নিজেদের ঘরে ঘুমাচ্ছে। চৈত্রিকা বিছানার ওপর পা তুলে খানিকক্ষণ বসে থেকে প্রহরকে দেখে৷ এরপর কি মনে করে ঘর থেকে বের হয়। পুরো বাড়ি ফাঁকা। বাড়ির সব মেইডরাও নিজেদের কক্ষে। চৈত্রিকা একবার নীরার ঘরে উঁকি দিয়ে দরজা ভালো মতো ভিড়িয়ে দিয়ে নাসিমার ঘরের দিকে পা বাড়ায়। নাসিমার ইদানীং মানসিক অবস্থা খুবই খারাপ। সারাদিন ঘর বন্ধী হয়ে থাকে। চৈত্রিকা শান্ত মুখশ্রী নিয়ে নাসিমার ঘরের দরজা খোলে। নাসিমা তখন দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে লেপ্টে রয়েছে। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে ভীতু দৃষ্টিতে তাকায় চৈত্রিকার দিকে। চৈত্রিকার মুখ দেখেই বার বার বিড়বিড় করতে থাকে। নিজেকে গুটিয়ে নেয়। চৈত্রিকা নিজেকে শান্ত, স্বাভাবিক করে বলে,

‘নিজের পা’পের শা’স্তি এভাবে পাবেন তা আমি কখনোই ভাবিনি। তবে আপনার এতোটুকু শা’স্তিতে আমি খুশিও হতে পারছি নাহ আবার বেজারও হতে পারছি নাহ। আপনি যা যা করেছেন সেগুলোর তুলনায় শা’স্তিটা কি একটু কমই হয়ে গেলো না!’

নাসিমা শা’স্তির কথা শুনেই বিছানার চাদর আঁকড়ে ধরে ভয়ে। মনে পড়ে যায় সে একদিন ভোরে স্বপ্ন দেখেছিলো চৈত্রিকা তার বুকে ত’লো’য়া’র ঢু’কিয়ে দিয়েছে। ভয়ে বার বার চোখের পলক ঝাপটাতে ঝাপটাতে ঠোঁট নাড়িয়ে বলতে থাকে,

‘তুই এতো পা’ষাণ না। হতে পারিস নাহ। চৈত্র তো কোমল, নরম ছিলো। আমাকে মা’রবি না চৈত্র। আমি তোর মা।’

চৈত্রিকা তাচ্ছিল্য করে হাসে। বুকের ওপর হাত আড়াআড়ি ভাবে রেখে কন্ঠে একরাশ ঘৃ’ণা ঢেলে বলে, ‘আমার মা অনেক দিন আগেই মা’রা গেছে। আপনি তো এক ঘৃ’ণ্য মহিলা যে কিনা নিজের স্বা’র্থে সবই করতে পারে। এমন মানুষকে না মা’রার কি আছে?’

নাসিমা হুট করেই কাঁপতে শুরু করে। এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা ফুলদানি ছুড়ে মা’রে চৈত্রিকার দিকে। ঘটনার আকস্মিকতায় চৈত্রিকা সরার আগেই ফুলদানি এসে তার পায়ের ওপর পড়ে। ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাথা সহ্য করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে মেঝেতে বসে। নিজের পা আঁকড়ে ধরে চোখ তুলে তাকাতেই নাসিমা দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। চৈত্রিকা ব্যাথা সহ্য করার চেষ্টা করে ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় নাসিমার যাওয়ার দিকে। চৈত্রিকাও উঠে পড়ে। পা টেনে টেনে এসে রেলিং এর সামনে দাঁড়ায়। নাসিমা ততক্ষণে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেছে। চৈত্রিকা বুঝে না হঠাৎ নাসিমা কোথায় গেলো! তাই ওভাবে পা টেনে টেনেই নিজেও সিড়ি দিয়ে নামার চেষ্টা করে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরো একবার পায়ের দিকে তাকাতেই দেখে পায়ের আঙুলের কোণার দিকে তাকিয়ে দেখে সেখানটা কেটে ফোটা ফোটা রক্ত বের হচ্ছে। তবুও নিজের কথা না ভেবে সদর দরজা দিয়ে বাহিরে আসে। আশে পাশে তাকিয়ে কোথাও নাসিমাকে দেখে নাহ। দুরে বাড়ির গেইটও লাগানো তার পাশেই দাড়োয়ান বসে আছে। চৈত্রিকা ঠোঁট কামড়ে ভাবতে থাকে নাসিমা কোন দিকে যেতে পারে! একটু খানি ভেবেই সে এগোয় পুকুর পাড়ের দিকে। পুকুরের সীমানায়য় পা রাখতেই সেখানে এক ধ্যানে নাসিমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। চৈত্রিকা তার কাছাকাছি এগোনোর আগেই পুকুরে লাফ দেয় সে। মস্তিষ্কের কাজ ঠিকমতো না হওয়ায় নাসিমা সাঁতার কা’টতে পারে নাহ। শুধু তলিয়ে যায় গভীরে। ছটফট করতে থাকে পানি থেকে উঠার জন্য। কিন্তু পারে নাহ। জমিদার বাড়ির রা’ক্ষুসে পুকুরটা গি’লে নেয় তাকে। চৈত্রিকা একটুও নড়ে না। যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো ঠিক সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। চোখের সামনে নিজের মা’কে ডু’বে যেতে দেখেও সে সামান্যও সাহায্য করে নাহ। কাউকে ডাকেও নাহ। শুধু এক ধ্যানে তাকিয়ে দেখে মায়ের মৃ’ত্যুবরণ করা, তলিয়ে যাওয়া! সেদিকে তাকিয়ে থেকেই চৈত্রিকা কাঁপা স্বরে আওড়ায়,

‘হয়তো প্রকৃতি চায়নি নিজের মেয়ের হাতে মায়ের শা’স্তি হোক! হয়তো প্রকৃতি চায়নি একজন গর্ভধারিণী মা তার মেয়ের হাতে খু’ন হোক!’

৩৩.
সন্ধ্যা থেকে বাড়িতে চেচামেচির সৃষ্টি হয়েছে। সাদিক, চয়ন কাজ থেকে ফিরে নাসিমাকে না দেখে হুলুস্থুল কান্ড বাধিয়ে দিয়েছে। সাদিক বার বার চৈত্রিকার নাম নিয়েই চেচামেচি করছে। দু তলার রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে শুধু দেখলো চৈত্রিকা। একটা আওয়াজও করলো না। যেভাবে দেখার জন্য এসে দাঁড়িয়েছিলো ঠিক সেভাবেই নিজ স্থান প্রস্থান করে। পায়ের ব্যাথাটা টনটন করে বাড়ছে। ধাপ রাখাটাই কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। কোনো রকম ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে নিজের বিছানায় বসে। পায়ের দিকে তাকিয়ে হাসে। বিড়বিড় করে বলে,

‘মৃ’ত্যুর আগেও আমাকে ব্যাথা দিয়ে গেলে মা!’

হাসতে থাকে৷ চোখ বেয়ে অজান্তেই পানি গড়ায়। একজন স্বা’র্থ’প’র মায়ের জন্য তার চোখে পানি! কাঁদছে চৈত্রিকা! নিজের প্রশ্নের উত্তর সে নিজেই পেলো৷ তার ভেতরকার হাহাকার গুলো স্পষ্ট ভাবে বলছে,

‘যতই তিনি স্বা’র্থ’প’র, খু”নী, অ’প’রা’ধী হোক! তবুও সে তোমার মা। সেই মা যে ছোট্ট বেলায় তোমাকে বুকে আগলে বড় করেছে। সেই মা যে তোমার ব্যাথায় কোনো একসময় ভীষণ কেঁদেছে! তুমি যতই ঘৃ’ণা করো তাকে! তবুও তোমার মনের কোণ থেকে সেই স্মৃতি গুলো মুছবে কেমন করে?’

চৈত্রিকার ভীষণ রাগ হলো৷ নিজের ওপর তার অনেক বেশি রাগ হলো। যে মহিলা তার বাবার সাথে বি’শ্বা’সঘা’তকতা করে তাকে মে’রে ফেললো! সেই মহিলার জন্য সে কষ্ট পাচ্ছে! রাগে নিজের চুল আঁকড়ে ধরে। ব্যাথা পায়ে রাগে জোড়ে খাটে লা’থি দেয়। নিজেই ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকে৷ এর মাঝেই ঘরে প্রবেশ করে প্রহর। বিকেলে ঘুম থেকে উঠেই সে কোনো এক কাজে গেছিলো! চৈত্রিকাকে অদ্ভুত ভাবে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে নেয়। শান্ত গলায় বলে,

‘আজ আমার বউজানের তেজ কই? তাকে যে নিচে এতো কথা বলা হচ্ছে সে সব হজম করছে কিভাবে?’

প্রহরের কন্ঠ কানে আসতেই চৈত্রিকা চট করে মাথা তুলে তাকায়। ইচ্ছে করে এক ছুটে প্রহরের বুকের গভীরে লুকিয়ে যেতে। যেখানে কোনো বিপদ, মন খারাপ, অসহ্য অনুভূতি ঘিরে ধরবে না! ভীষণ কান্না পায়। ভেজা চোখে শুধু পলকহীন তাকিয়ে রয় প্রহরের দিকে। প্রহর নিজের পড়নের শার্ট খুলে অন্য একটা শার্ট গায়ে জড়িয়ে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চৈত্রিকার দিকে। কতটা সময় পার হয়ে গেলো অথচ চৈত্রিকা জবাব দিলো না কেনো তা দেখার জন্যই তাকিয়েছিলো। কিন্তু চৈত্রিকার উদ্ভ্রান্ত, এলোমেলো, ভেজা দৃষ্টি দেখে তার চোখ মুখ শান্ত, গম্ভীর হয়ে যায়। এগিয়ে আসে চৈত্রিকার সামনে। সরাসরি চৈত্রিকার চোখে চোখ রেখে শুধায়,

‘কি হয়েছে চৈত্র? চোখ মুখ এমন লাগছে কেনো? আব্বাজান বা সাদিক চাচা কিছু বলেছে?’

চৈত্রিকা উত্তর দিলো নাহ। দৃষ্টিও ফেরালো নাহ। ততক্ষণে প্রহর চঞ্চল হলো। চৈত্রিকার এমন করুণ রুপ দেখে তার বুকের ভেতর ঝড় বয়তে শুরু করে। সে ঝড়কে বাড়িয়ে দিয়ে চৈত্রিকা চোখ বন্ধ করে নেয়। সাথে সাথেই চোখের কোণ বেয়ে জল গড়াতে শুরু করে। প্রহর আলগোছে একটা হাতে চোখ মুছিয়ে দেয়। চৈত্রিকা ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে। প্রহর আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করে,

‘কি হয়েছে চৈত্র? কান্না করছো কেনো? কেউ কিছু বলেছে? আচ্ছা আমাকে বলো কি হয়ছে! আমি আছি তো!’

ব্যাস! সাথে সাথেই প্রহরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে চৈত্রিকা। প্রহর অবাক হয় নাহ। শক্ত করে নিজের বুকের বাম পাশটায় নিজের প্রিয় বউয়ের মাথাটা চেপে রাখে। অন্য হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। চৈত্রিকা কান্নারত স্বরে বলে,

‘আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে জমিদার সাহেব। আমি চাইনি মা শা’স্তি থেকে বেঁচে যাক! আবার তাকে নিজের চোখে মৃ’ত্যুর কোলে ঢলে পড়ার পরও আমার কষ্ট হচ্ছে। কেনো?’

প্রহর অবাক হলো। তবে প্রশ্ন করলো নাহ। শুধু যত্ন করে আঁকড়ে ধরে রইলো। চৈত্রিকা কাঁদলো! ভীষণ কাঁদলেো! হাউমাউ করে কাঁদলো। প্রহর শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলো। ভীষণ কষ্ট করেও বলতে পারলো না কোনো শব্দ। শুধু বুকের চিনচিনে ব্যাথাটা সহ্য করে নিলো। চৈত্রিকা একটু থামতেই প্রহর শান্ত কন্ঠে বললো,

‘এতো অ’ন্যায়ের পরও সে তোমার মা ছিলো৷ কিন্তু উনি যা করেছেন তা খুবই খারাপ। খুবই জ’ঘ’ন্য।’

চৈত্রিকা চুপ করে পড়ে রইলো। প্রহরও চুপচাপ চৈত্রিকার মাথায় হাত বুলাতে থাকে। সময় কাটে। দুজনেই নিশ্চুপ হয়ে বসে রয়৷ নিচ থেকে চেঁচামেচির আওয়াজটা ক্ষীণ বাড়তেই দুজনে ছিটকে সরে বসে। প্রহর এক পলক চৈত্রিকার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে বলে,

‘নিচে চলো!’

চৈত্রিকা চোখ মুখ ভালো ভাবে মুছে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বেখেয়ালি ভাবে পা ফেলতে গেলে ব্যাথায় আর্তনাদ করে ওঠে। প্রহর চমকায়। দ্রুত এগিয়ে এসে বলে,

‘কি হলো? ব্যাথা পাইছো? দেখি!’

চৈত্রিকার উত্তরের অপেক্ষা না করেই পা টেনে নিজের হাঁটুতে নেয়। চৈত্রিকা ইতস্তত করে বলে, ‘কি করছেন জমিদার সাহেব?’

‘কোথায় ব্যাথা পেয়েছো? পা এতো ফুলেছে কেনো? কে’টেছেই বা কেমন করে?’

চৈত্রিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নত করে বলে, ‘মা ফুলদানি ছু’ড়ে মে’রেছিলো। ওটা এসে পায়ের ওপর পড়েছে!’

প্রহর চোখ মুখ শক্ত করে তাকায়। চৈত্রিকা ঠোঁট চেপে অবুঝের মতো তাকিয়ে থাকে। প্রহর রাগ দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে বলে, ‘বিছানা থেকে খবরদার পা নামাবে নাহ। নয়তো তোমার পা কে’টে তোমার হাতে ধরিয়ে দেবো।’

‘আমি নিচে যাবো না?’

‘নাহ যাবে নাহ।’

চৈত্রিকা কিছু বললো নাহ। বলতে ইচ্ছেও করলো নাহ। শুধু প্রহরের কথা অনুযায়ী পা বিছানার ওপর তুলে শুয়ে পড়ে। প্রহর ঘর থেকে হনহন করে বেড়িয়ে যায়। চৈত্রিকা কপালে ভাজ ফেলে তাকিয়ে থাকে। কি হলো হঠাৎ? কার ওপর রাগ করে চলে গেলো? তার ওপর নাকি নাসিমার ওপর!

৩৪.
গতকাল রাতেই নিবিড় এসেছে। বিনাবাক্যে তাকে বাড়িতে ঢুকতেও দেওয়া হয়েছে। চয়নের আপত্তি থাকলেও প্রহরের কাছে হার মানতে হয়েছে তাকে। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে চয়ন চুপচাপ মেনে নিয়েছে নিবিড়ের বিষয়টা। তবে সে নিজ মনে পণ করে রেখেছে কিছুতেই নিজের মেয়েকে নিয়ে যেতে দেবেন নাহ। এসবের মাঝেই ছুটতে ছুটতে এসেছেন এক মেইড। ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে হাঁপাতে থাকলেন তিনি। পল্লবী ভ্রু কুঁচকে বললেন,

‘এমন ভাবে হাঁপাচ্ছো কেনো? তোমাকে যে বললাম পুকুরপাড়টা পরিষ্কার করানোর জন্য দেখিয়ে দিতে! দেখিয়েছো?’

মহিলাটি ভয়ে কথা ই বলতে পারছেন নাহ। শুধু কোনো রকমে বললেন,
‘গিন্নিমা! পুকুরের মাঝখানটায় ২ ডা লা’শ ভাইসা উঠছে। দুর থেকে বোঝা যায়তেছে নাহ ওগুলো কারা! কিন্তু..’

সবাই বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকায়। কি বলবে তা খুঁজে পায় না। চৈত্রিকা অবাক হয়ে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। কাল তো কেবল নাসিমা ই পুকুরে লা’ফ দিয়ে নিজের প্রাণ নিলো! তবে ২য় লা’শ কার?

চলবে..

#চৈত্রিকা (৫১)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________

৩৫.
জমিদার বাড়ির পুকুরপাড়ে লা’শ দুইটি তোলা হয়েছে। লা’শ দুইটা দেখেই সবার মুখের কথা হারিয়ে গেছে। একটি লাা’শ নাসিমার আরেকটা সা’দিকের। সাদিকের গায়ে অসংখ্য মা’রের দাগ। সাথে কা’টা ছেড়া আছেই৷ লা’শটা সম্ভবত সারারাত পানিতে থাকায় ফুলে উঠেছে। নাসিমার গায়ে কোনো রকম চিহ্ন নেই। শুধু ফুলে উঠেছে লা’শ। অনেকক্ষণ এক নাগাড়ে পানিতে ডুবে থাকায় দুজনের মুখটাই ফ্যাকাশে হয়ে গেছে৷ চয়ন গম্ভীর হয়ে বসে আছে পুকুরপাড়ের শান বাঁধানো উচু জায়গায়। প্রহর চোখ মুখ শক্ত করে হাত দুটো পেছনে রেখে টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিখুঁত ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে নাসিমা আর সাদিককে। চৈত্রিকা কতক্ষণ সাদিকের লা’শের দিকে তাকিয়ে থেকে প্রহরের মুখপানে চেয়ে রইলো। সে জানে না সাদিককে কে এবং কেনো মা’রলো! তবে তার দৃঢ় বিশ্বাস এর পেছনে প্রহরের গভীর সম্পর্ক আছেই। চৈত্রিকা শুধু তাকিয়েই রইলো। প্রহর একবারও তার দিকে তাকালো নাহ। নিজ মনে লা’শ দুটিকে দেখতে থাকলো। পল্লবী শান্ত হয়ে তাকিয়ে আছে। অর্থি সাদিককে দেখে ভয় পেয়েছে। তাই তাদের থেকে খানিকটা দুরে নিবিড়ের সাথে দাঁড়িয়ে আছে সে। নিবিড় স্বাভাবিক। যেনো সে জানতো সবই। অর্থি খিঁচে দাঁড়িয়ে নিবিড়ের টি-শার্ট আঁকড়ে ধরে। আতঙ্কিত কন্ঠে বলে,

‘কাকার চোখ মুখ এতো ভ’য়ং’কর হলো কেমন করে মাষ্টারমশাই? পানিতে ডু’বে মা’রা গেলে কি চোখ মুখ এমন হয়? উনাকে কি কেউ খুব মে’রেছে?’

নিবিড় শান্ত দৃষ্টিতে তাকায়। অর্থির চোখে চোখ রেখে শীতল কন্ঠে বলে, ‘তুমি তাকিও না ওদিকে। কিছু সময় পা’পের সাজা এমনই হয়।’

অর্থি বুঝতে পারলো নাহ। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। পল্লবী নীরাকে এই অবস্থায় পুকুরপাড়ে আসতে দেয়নি তাই সে আপাতত বাড়ির হল রুমেই আছে। নিবিড় একবার বাড়ির সদর দরজার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে বলে,

‘মেজো ভাবী একা না? উনার এই সময় এই অবস্থায় একা রাখাটা ঠিক হবে নাহ। তুমি ভেতরে যাও অর্থি! এখানে থাকলে ভয় পাবে।’

অর্থি একবার দ্বিমত করতে চাইলেও করে নাহ। নিবিড়ের টি-শার্টের কোণা ছেড়ে দিয়ে আস্তে করে পা বাড়ায় সদর দরজার দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ঘাড় ফিরিয়ে একপলক দুরের সাদিক নাসিমাকে দেখে বিড়বিড় করে বলে,

‘জমিদার বাড়িতে শুধু মৃ’ত্যুর গন্ধ। একের পর এক মৃ’ত্যুতে বাড়িটা মৃ’ত্যুপুরী হয়ে গেছে যেনো!’

চলে যায় অর্থি। নিবিড় ঘাড় বাঁকিয়ে সেদিকে তাকিয়ে প্যান্টের পকেটে হাত গুজে এগিয়ে যায় প্রহরের দিকে। প্রহরের থেকে সামান্য দূরত্ব রেখে দাঁড়াতেই প্রহর চোখ তুলে তাকায়। চোখে চোখে দুজনে হাসে। চৈত্রিকা দেখে, অবাক হয়। নিবিড়! ফ্যালফ্যাল করে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়। পরক্ষণেই দৃষ্টি নামিয়ে সত্যটা গিলে নেয়। এর মাঝেই তার গালে ক’ষে থা’প্প’ড় পড়ে। থা’প্প’ড়ের শব্দে সবাই অবাক হয়। প্রহর হাত মুষ্টিবদ্ধ করে তাকায়। চয়ন থা’প্পড় মে’রেছে তাকে। চৈত্রিকা অবাক হয়ে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই চয়ন রাগী স্বরে বলে,

‘তোমার কি লাজ, লজ্জা, দয়া, মায়া কিচ্ছুই নাই? নিজের মা’কে নিজ হাতে মা’রতে পারলে? তোমার হাত কাঁপলো না?’

চৈত্রিকা চোখ মুখ শক্ত করে। ভেবে নেয় কঠিন জবাব দেবে। কিন্তু তার আগেই পল্লবী অবাক হওয়ার ভান করে বলে, ‘ওর মা মানে? কি বলতেছেন এগুলা? ওর মা কে?’

চয়ন হকচকিয়ে যায়। চৈত্রিকার দৃষ্টিও শীতল হয়ে যায়। পল্লবী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। নিবিড় শ্বাশুড়ির কথায় কথা মিলিয়ে নিজেও বলে, ‘আসলেই তো! বড় ভাবীজানের মা কে আব্বাজান?’

চয়ন গ্যারাকলে পড়ে যায়। সে ভাবে সত্যিটা বলে দিতে দোষ নেই। এখন তো সাদিক আর নাসিমা মা’রা গেছেই। কিন্তু পরক্ষণেই নিজ মনের সাথে মস্তিষ্কের দ্বন্দ লেগে যায়। সত্যটা সবার সামনে প্রকাশ করে দেওয়াটা বোকামো মনে হয়৷ তাছাড়া প্রহর নিজেই এখানে উপস্থিত। প্রহরের ধূূর্ততা সম্পর্কে সে অবগত। সাদিক, নাসিমার সত্য সামনে আসলে চয়নের নিজের সত্যটাও যে আড়ালে থাকবে না তা সে হাড়ে হাড়ে বুঝে যায়। পল্লবী জবাব না পেয়ে ফের শুধায়,

‘কি হলো? কিছু বলতেছেন না কেনো? বড় বউয়ের মা কে?’

চয়ন আমতা আমতা করতে থাকে। চৈত্রিকা শীতল কন্ঠে বলে, ‘চুপ করে আছেন যে আব্বাজান! বলুন সবাইকে আমার মা কে?’

চয়ন ধমকে ওঠে। আমতা আমতা ছেড়ে কোনো রকমে বলে, “মা না হোক। মায়ের মতো তো নাকি! নাসিম তো তোমার মায়ের মতোই ছিলো তাহলে তুমি ওরে মা’রলা কেমনে? আর সাদিকরে কেমনে মা’রলে? তোমার এতো সাহস বাড়ছে!’

এ পর্যায়ে মুখ খোলে প্রহর। যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো ঠিক সেভাবেই দাঁড়িয়ে রয়। কন্ঠ মাত্রাতিরিক্ত শীতল করে বলে, ‘প্রমাণ আছে আব্বাজান? কাল চৈত্রিকা পায়ে আ’ঘাত পেয়ে ঘরেই ছিলো। ‘ও’ যে কাকা, কাকিকে মে’রেছে এটা কি কেউ দেখেছে? নাকি কোনো প্রমাণ আছে?’

চয়ন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। প্রহর শান্ত, স্বাভাবিক। ছেলের এতো শান্ত স্বভাব চয়নের হজম হলো নাহ। তার মতো করে তো এই ছেলেকে কেউ চেনে না। নিজের গম্ভীর দৃষ্টি দ্বারা প্রহরের পা থেকে মাথাা অব্দি পর্যবেক্ষণ করে নেয়। নিজেও দু হাত পেছনে নিয়ে টান টান হয়ে দাঁড়ায়। কন্ঠের তেজ ধরে রেখে বলে,

‘তুমি কবে থেকে বউয়ের আঁচল ধরে কথা বলতে শিখলে প্রহর? আর চয়ন রেনওয়াজের যে কোনো প্রমাণ লাগে না এটা তুমি ভালো করেই জানো। তোমার বউ পায়ে ব্যাথা পেয়েছে কিভাবে? কাল যখন আমরা কেউ ছিলাম না তখন সে কেথায় ছিলো?’

প্রহরের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। তবে নিজের পিতার দিকে চোখ তুলে তাকায় নাহ। চৈত্রিকা বুকের ওপর হাত আড়াআড়ি করে দাঁড়ায়। নিজের কন্ঠের শীতলতা ধরে রেখে সহজ গলায় বলে,

‘পায়ের ওপর ফুলদানি পড়ে পা কে’টে গিয়েছিলো এজন্যই ব্যাথা ছিলো আব্বাজান। আর যদি বলেন কাকিকে মা’রার কথা! তাহলে আমার যদি কাউকে মা’রতেই হয় নিশ্চয় এভাবে সুন্দর করে মা’রবো নাহ। কাকির গায়ে একটা দাগও নেই মা’রের। আমি উনাকে মা’রিনি। তাছাড়া উনার যা মানসিক অবস্থা ছিলো তাতে উনি যে নিজেই পুকুরে ঝা’প দিয়ে নিজের প্রাণ নেননি তার কি কোনো মানে আছে? বিকেল বেলাতেও যখন সাদিক কাকা বেঁচে ছিলেন তখন আমার সাাথে উনাার দেখাও হয়নি৷ সারারাত আমি ঘরেই ছিলাম। আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করে দেখেন! সব কিছুর দো’ষ আমার ওপর চাপাবেন না আব্বাজান।’

চয়ন কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। মিনিট খানেক চুপ থেকে কিছু ভাবে। এরপর অবাক চোখে প্রহরের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘প্রহর! তুই!’

প্রহর একটুও বিচলিত হয় নাহ। নিজের আব্বাজানের চিন্তাধারা ধরতে পেরে স্বাভাবিক গলায় বলে, ‘আমি নিজের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করি না তা আমার চেয়েও আপনি বেশ ভালো করেই জানেন আব্বাজান।’

প্রহর দাড়ায় নাহ। নিজের জায়গা প্রস্থান করে। চৈত্রিকা একবার ঘাড় ফিরিয়ে সেদিকে তাকায়। ভ্রু কুঁচকে মনে মনে হাসে। তবে প্রশ্ন রয়েই যায় কিসের প্রতিজ্ঞা! কিসের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করার কথা বলছে প্রহর? চৈত্রিকা চয়নের দিকে তাকায়। পল্লবী এগিয়ে এসে বলে,

‘অন্তত নিজের ছেলেরে সন্দেহ করা বন্ধ করেন। যতক্ষণ না শিমুল, শায়লা, অর্পিতা, চিত্র ওরা আসছে ততক্ষণ দাফন কাফনের কাজ তো হবে না অন্তত উঠানে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন।’

পল্লবী চলে যায়। পিছু পিছু নিবিড়ও চলে যায়। চয়ন বুঝে ওঠে না কি করবে! তার চতুর মস্তিষ্ক তাকে বার বার বলছে ‘এই কাজ একমাত্র চৈত্রিকা আর প্রহর ছাড়া কারোর দ্বারা সম্ভব নয়। ওরা আ’গুন। ওরাই পারবে একমাত্র পাপকে ঝ’লসে দিতে কিন্তু সত্যটা সবার সামনে আসবে কি করে?’ তার ভাবনার মাঝেই চৈত্রিকা গলা পরিষ্কার করে শান্ত ভাবে বলে,

‘এতো কিছু না ভেবে নিজেকে নিয়ে ভাবেন শ্বশুরআব্বা! আপনার সব অ’পক’র্মের সঙ্গীরা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। এরপর বেঁচে আছেন আপনি একা। পা’পের মাথা! বাঁচেন কতক্ষণ এটা আগে দেখেন!’

৩৬.
নাসিমা আর সাদিকের মৃ’ত্যুর খবর শুনে বাড়িতে সবাই এসেছে। নীরার বাবা-মাও আরো একবার এসেছে নিজের মেয়েকে বোঝাতে। নীরা ভেবেছিলো তাকে এবার তার বাবা মা বুঝবে কিন্তু তাকে মি’থ্যা প্রমাণিত করে ফের একই কথা তুলেছেন। এতো কিছু মেনে নিতে পারে নাহ সে। তাই চুপচাপ সবাইকে ফেলে নিজের ঘরের দরজা আটকে বসে আছে। এক হাত নিজের পেটে রেখে মন দিয়ে নিজের সন্তানকে অনুভব করছে। অর্পিতা, অর্থি, পল্লবী, শায়লা সবাই একসাথে আছে। অর্পিতা ছোট ভাই অয়নও এসেছে। এতোকিছুর মাঝে সে ভয় পাবে বলে চিত্র তাকে নিয়ে দুরে রেখেছে। চয়ন, শিমুল নিজের ভাইয়ের কবর খননের ব্যবস্থা করছে। নিবিড় আর চিত্র এক পাশে বসে সব দেখছে। তাদের কোনো আগ্রহ নেই এসবে। চিত্র যথেষ্ট জানে তার কাকা কেমন ছিলো! কিন্তু নাসিমার মৃ’ত্যু রহস্যটা সে বুঝে ওঠে নাহ। প্রহরকে বাহির থেকে ঘরে যেতে দেখে চৈত্রিকাও পিছু পিছু যায়। ঘরের দরজা আটকে সরাসরি দাঁড়ায় প্রহরের সামনে। প্রহর শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

‘তোমার পায়ের ব্যাথা কমেছে? এভাবে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছো কেনো?’

চৈত্রিকা কপালে ভাজ ফেলে তাকায়। মাথা উচু করে প্রহরের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করে,

‘আপনি সাদিক কাকাকে মে’রেছেন তাই না? মা নিজেই পুকুরে লা’ফ দিয়েছিলেন কিন্তু সাদিক কাকা! উনাকে তো আমি বিকেলের পর দুচোখেও দেখিনি মা’রা অনেক দুরের ব্যাপার। আপনি করেছেন এসব তাই না?’

প্রহরের মুখভঙ্গি স্বাভাবিক। চৈত্রিকার কপালের ওপর পড়ে থাকা চুলে ফু দেয়। চৈত্রিকা চোখ বন্ধ করে নেয়। প্রহর চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে, ‘কিছু সত্য জানতে হয় না বউজান। কিছু সত্য গোপনে যত্ন করে রেখে দিতে হয়।’

‘সত্য কখনো গোপনে থাকে না জমিদার সাহেব।’

প্রহর বাঁকা হাসে। চৈত্রিকার কথার পিঠে কোনো জবাব দেয় নাহ। হামি তুলে বসে বিছানায়। শার্টের কলার টেনে বিরক্তির গলায় বলে, ‘চৈত্র ফ্যানের পাওয়ারটা বাড়াও তো! একটু বেশিই গরম লাগতেছে যেনো!’

চৈত্রিকা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। প্রহরের কথা শুনলোও না, জবাবও দিলো নাহ। কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ঘরের মাঝ বরাবর। প্রহর বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকে। খানিকটা বাদেই বুঝতে পারে চৈত্রিকা তার কথা শোনেনি। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই ঠোঁট কামড়ে হাসে প্রহর। কতক্ষণ ওভাবে থেকে কন্ঠের শীতলতা ফিরিয়ে আনে। অত্যাধিক শীতল কন্ঠে ছোট্ট করে আওড়ায়,

‘এতো শতো পা’পের শা’স্তি প্রাপ্যের খাতায় রেখেও আমার বউজানকে কেউ গা’লি দেওয়ার মতো সাহস দেখালে তাকে বেঁচে থাকতে দেই কেমন করে? তার একেক সেকেন্ডের নিঃশ্বাসের গতি আর আমার শিরায় শিরায় বি’ষ ঢালার অনুভূতি একই।’

চৈত্রিকা থমকায়। অবাক হয়। নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে রয় প্রহরের দিকে। চোখে মুখে কাঠিন্যতা স্পষ্ট। তবুও শান্ত হয়ে শুয়ে আছে। চোখ জোড়া তার এখনো বন্ধ। হয়তো চোখ মেললেই দেখতে পেতো তার বউজানের স্তব্ধ হওয়া দৃষ্টি। নাকি চোখ বন্ধ করেই অনুভব করছে? কি জানি! চৈত্রিকা দৃষ্টি এদিক ওদিক করে। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় প্রহরের কাছে। প্রহরের পায়ের কাছটাই বসে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। নিজেকে স্বাভাবিক করতে বড় বড় শ্বাস নেয়। মিনিট তিনেক বাদে বলে,

‘আপনি কখন করলেন এসব? আর..আর আমাকে একবারও জানালেন না কেনো?’

‘তুমি কিছু করার আগে আমাকে জানাও চৈত্র? তাছাড়া কাকার পা’পটা দিন দিন একটু বেশিই বেড়ে যাচ্ছিলো। ভাবলাম বউজানেরও সাহায্য হবে আর দুনিয়া থেকে আরেকটা পা’প কমবে। তোমার শ’ত্রু পক্ষ এবার ১ এর কোঠায়! যার পা’পের রাজ্য বিশাল বড়। এবারে নিজের শেষ শ’ত্রুর মোকাবেলা তোমার নিজের করতে হবে।’

প্রহরের সহজ জবাব। চৈত্রিকা ফের জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কোন প্রতিজ্ঞায় সীমাবদ্ধ জমিদার সাহেব?’

প্রহর চোখ মেলে তাকায়। সরাসরি চৈত্রিকার দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে বলে, ‘আমরা জমিদার বংশের পুত্র চৈত্র। আমাদের অ’ন্যায়, জু’লুম শিক্ষার সাথে সাথে প্রতিজ্ঞা করানো হয় যেনো আমরা নিজেরা নিজেদের প্রাণ কে’ড়ে না নিই। জমিদার বংশের কেউ কাউকে মা’রার দুঃসাহস করতে পারবে নাহ। ভাই ভাইকে, ছেলে বাবাকে, ভাতিজা কাকাকে কিংবা ভাই বোনকে আ’ঘাত করবে নাহ। আর প্রহর রেনওয়াজ নিজের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে পারে নাহ। তার কাছে নিজের প্রতিজ্ঞা মানে বিশাল এক দায়ভার।’

‘তাহলে কাল?’

প্রহর মাথার নিচে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে আবারও। ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বলে, ‘আ’ঘাত করা যাবে না তবে বুদ্ধি দিয়ে মা’রা যাবে না বিষয়টা এমন না বউজান। যদিও নিজেদের ওপর বুদ্ধি খাটানোর নিয়ম নেই আমাদের তবুও মাঝে মাঝে নিয়ম ভঙ্গ করতেও মজা। আমি তো কাকাকে ছুঁয়েই দেখিনি। ইশশশ! নিজের হাতে কাকার জিভ কে’টে নিতে পারলে শান্তি পেতাম। প্রশান্তিতে মন, প্রাণ, শিরায় শিরায় ভরে উঠতো।’

চৈত্রিকা অবাক হয়৷ প্রহরের একের পর এক কথাতে যেনো তার মাথা ভন ভন করে ঘুরছিলো। পরক্ষণেই কিছু একটা ভেবে ব্যস্ত গলায় বলে, ‘আপনাকে সাহায্য করেছে কে জমিদার সাহেব?’

প্রহর এ প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে আগের মতোই হাসে। স্বাভাবিক কন্ঠে বলে, ‘নিজের বুদ্ধি, বিচক্ষণতা কাজে লাগাও বউজান!’

চৈত্রিকা মাথায় চাপ দিয়ে ভাবতে থাকে। সব কিছু মিলিয়ে তার মাথায় একটাই নাম আসে। চোখ পিটপিট করে বলে ওঠে, ‘নিবিড় ভাইজান!’

চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)