#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ৩০)
নুসরাত জাহান লিজা
নিজেকে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা চরমভাবে ব্যর্থ হলো আফনানের।
“আরে, আফনান ভাই? অমাবস্যার চাঁদ দেখার সৌভাগ্য হলো আমার।”
নীরার গলায় মেকি উচ্ছ্বাসে কটাক্ষের বিষ মাখা। আফনানের পা থেমে গেল।
“কেমন আছিস নীরা?” আফনানের গলায় মৃদু কম্পন।
“খুব ভালো আছি। এখানে কেন এসেছ? বিয়ে টিয়ে করছ নাকি গার্লফ্রেন্ডের জন্য গিফট?”
“তোকে দেখে ভালো লাগল।” কটাক্ষ এড়িয়ে বলল আফনান।
“ডাহা মিথ্যা কথা। তোমাকে মানায় না। আমাকে দেখে তুমি ভয় পাচ্ছ, আবারও যদি তোমার ঘাড়ে চাপতে চাই। ভয় নেই, তেমন কিছু হবে না। আমি এতটাও হ্যাংলা নই।”
নীরা ভীষণ শক্ত মনের মেয়ে, আফনান সেটা জানে। তবে আজ এই মেয়ে সমস্ত জেনে-বুঝে হাসিমুখে মর্টার শেল বিঁধিয়ে দিচ্ছে আফনানের হৃদপিণ্ডে। হাসিমুখে একজন হৃদয় হন্তারক যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে আফনানের সামনে।
“তোকে আমি হ্যাংলা ভাবব? এতবড় নির্বোধ আমি নই।”
ততক্ষণে সায়মন এগিয়ে এসেছে। কুশল বিনিময় হলো দুজনের। এই মুহূর্তে আফনানের ইচ্ছে করছিল, পৃথিবীর বুক থেকে এই প্রিভিলেজড ছেলেটাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে৷ নিস্ফল, অক্ষম ইচ্ছেতে, সে নিজেই এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে যাচ্ছিল।
“তোমার নিশ্চয়ই অনেক তাড়া আফনান ভাই। তোমার দেরি করিয়ে দিলাম। আসি। চলো সায়মন। আমাদেরও অনেক কেনাকাটা বাকি।”
আফনানের ভীষণ ইচ্ছে করছিল বলতে, “আর কিছুক্ষণ থাক না নীরা। তোর সাথে একটু গল্প করি।” কিন্তু বলা হয় না, নীরা হাসিমুখে পা বাড়িয়ে চলে যাচ্ছে, সায়মনের সাথে। দু’জনের চোখেই যেন সুখ উথলে পড়ছে। “চলো, সায়মন। আমাদেরও অনেক কেনাকাটা বাকি।” কথাটা ওর মস্তিষ্কে বারংবার আলোড়ন তুলছে। কষ্টের বুদবুদ শব্দে ওর শ্রবণেন্দ্রিয় যেন বিকল হয়ে যাচ্ছে।
টলোমলো পায়ে আফনান বাইরে চলে এলো। একবার কিছু একটা পায়ের সাথে লেগে শক্ত হোঁচট খেল। সে তখন যেন পৃথিবীতে নেই। পৃথিবীর সবচাইতে বিধ্বংসী বিষ যেন ওর সমস্ত পরিপাকতন্ত্রকে গ্রাস করছে ক্রমশ। তীব্র নীল নীল যন্ত্রণায় সমস্তটা ছেঁয়ে গেল আফনানের। মনে হলো সমস্তটাই বৃথা ওর।
***
ইরা শুয়ে শুয়ে ফেসবুকের নিউজফিডটা স্ক্রল করছিল। হঠাৎ শাফিনের পেইজ থেকে একটা ছবি এলো সামনে। ভীষণ সুন্দরী এই মেয়েটার ছবি সে তুলেছে৷ অকারণ এক ঈর্ষা ভর করল ইরার মধ্যে। সাথে সাথে শাফিনকে কল দিল।
“ইরা, আমি তোমাকে দশটা মিনিট পরে কল করি?”
“দশ বছর পরেও আর দরকার নাই।” বলে কল কাটল ইরা।
হতভম্ব শাফিন সাথে সাথে কল ব্যাক করল। ইরা রিসিভ করল না। শুধু একটা মেসেজ লিখল,
“যাদের ছবি তোলো, তাদের সাথে থাকো।”
শাফিন বারবার কল দিতে থাকল, কিন্তু ব্যর্থ হলো। এরপর সেও লিখল,
“ইরা, ওদের ছবি তুলি, কারণ তারা আমাকে পে করে। তাদের জন্য আমার সাথে রেগে থাকবে?”
“অত সুন্দরী মেয়েদের ছবি তুলতে তুলতে তোমার মন ঘুরে যাবে আমার দিক থেকে।”
“তোমার সাথে আমার আত্মিক সম্পর্ক। সেটা এত ঠুনকো নয়।”
“তবুও মানুষের মন, কখন কোনদিকে যায়।”
“ইরা, আমি আমার কাছে সৌন্দর্যের পারসেপশন আলাদা। আমার চোখে তুমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী। কারণ তোমার হৃদয় স্পর্শ করতে পারি। ওদেরকে কখনো আমি পড়তে যাই না।”
এবার ইরা খানিকটা শান্ত হলো। শাফিন আবার লিখল, “মাথা ঠান্ডা হয়েছে?”
“কিছুটা।”
“এইজন্য বাচ্চা মেয়ের সাথে প্রেম করতে নেই।”
“নিজে যেন প্রস্তর যুগের মানুষ!”
শাফিন শব্দ করে হেসে ভয়েস মেসেজ দিল এবার। উত্তরে ইরা লিখল,
“আগামী দুইদিন তোমার সাথে আমার কথা বন্ধ। তোমার শাস্তি এটা।”
“আমি কী করলাম?”
“বাচ্চা মেয়ে বলবে, আবার তার সাথে প্রেমও করবে তা তো হবে না।”
“আরে, আমি তো মজা করেছি।”
“কিন্তু আমি মোটেও মজা করছি না।”
বলেই ফোন বন্ধ করল ইরা। একটু আগে ভীষণ রাগ হচ্ছিল, সেটা এখন নেই। দু’দিন তো বড় গলা করে বলল, সে নিজে থাকতে পারবে তো!
***
“নীরা, চলো রেস্টুরেন্টে বসি। সেই এগারোটায় বেরিয়েছ এখন সাড়ে তিনটা বাজে৷ খেয়ে নিই।” সায়মনের দিকে ঘুরে নীরা বলল,
“আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।”
“তুমি নিজে কষ্ট পাবে, তবুও ওর সাথে এভাবে কথা বললে কেন?”
“ওর কষ্টের প্রতি ভয়াবহ অবসেশন আছে। গোলাপ দিতে চাইলে কাঁটাই নেবে। আমি চিনি আফনানকে।”
“তবুও আমাকে দেখে হয়তো ভুল ভাবছে।”
“ভাবুক, কে কী ভাবছে তার দায় আমার নয়।”
ওরা রেস্টুরেন্টে এসে বসল।
“তুমি তো আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছ৷ আফনানের সাথে সামনে এগুবে না?”
“না।”
“কেন?”
“সায়মন, আমি একেবারে অল্প বয়স থেকে আফনানকে পছন্দ করেছি। একবার কষ্ট পেয়ে সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম৷ কিন্তু অনুভূতি মিলিয়ে যায়নি। এই যে লম্বা সময় ধরে ভালোবাসা, অভিমান, অনুযোগ সব শুধু একজনকে কেন্দ্র করে ঘুরেছে। তাই আমার পক্ষে অন্য কাউকে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। স্বার্থপরের মতো অন্য একজন মানুষকে আমি বঞ্চিত করতে বা ঠকাতে পারব না। তাই তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছি। তবুও আফনানকে আমি আর গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত নই।”
“সেটাই জানতে চাইছি নীরা, এত ভালোবেসেও কেন দূরে থাকবে, সে-ও তো তোমাকে ভালোবাসে।”
নীরা ম্লান হেসে বলল, “আফনান গোটা দুনিয়া কী ভাবে সেটা চিন্তা করেছে। আমাকে ফিরিয়ে দেবার আগে সে আমার জন্য নাকি ভেবেছে। অথচ আমাকেই বুঝতে চায়নি। একবারও আমার চাওয়াকে, আমার অনুভূতিকে সে গুরুত্ব দেয়নি। বিয়েটা দ্বিপাক্ষিক বিষয়। তাই একা নিজের মতো করে একটা সিদ্ধান্ত নিতে সে পারে না। আমার ইচ্ছেকে পায়ে দলে আমাকে অপমান করার সুযোগ আমি আরেকবার ওকে দেব না। ওর এই অতিরিক্ত মহানুভবতা আমার পছন্দ নয়, যদি সেটায় নিজের ইচ্ছের মৃত্যু হয়। ও নিজের মনের সাথেই প্রতারণা করেছে।”
থেমে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীরা প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, “তুমি এখন তোমার বিয়েতে ফোকাস করো। এসব নিয়ে না ভাবলেও চলবে।”
……..
(ক্রমশ)
#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ৩১.১)
নুসরাত জাহান লিজা
আফনানদের বাসা থেকে ফিরে নীরা কিছুদিন গুম হয়ে ছিল। নিজেকে অপমানিত, অবহেলিত বলে মনে হচ্ছিল। তখন সায়মনের আনাগোনা এই বাড়িতে আবার শুরু হয়েছিল। ছুটির দিনে সে নীরার বাড়িতে এসে দেখা করে যেত। রোকেয়ার সাথে গল্প করত, ইলার সাথেও।
মঈনুল সাহেবের সাথেও খানিকটা সখ্যতা গড়ে উঠছিল। কিন্তু নীরা ওর সামনে যেত না। বকুল ফুপু তখন এই বাড়িতে এসে থাকা শুরু করেন। নীরাকে এটা-সেটা বোঝান।
নীরা আফনানের উপরে রাগে ক্ষোভে বকুল ফুপুর কাছে সম্মতি দিয়ে ফেলে যে সে সায়মনকে নিয়ে আগে ভেবে দেখবে। ওই ঘটনার মাসখানেক পরে একদিন রোকেয়া এসে বললেন,
“আজ সায়মন আসবে। ওর সাথে একটা কথা বলিস ভালো করে।”
নীরা উত্তর দেয়নি। ওর এই মৌনতাকে সম্মতির লক্ষ্মণ ধরে নিয়ে তিনি তোড়জোড় শুরু করেন। একটা শাড়ি এনে নীরাকে দিয়ে বলেন,
“এই শাড়িটা পরিস।”
তিনি শাড়ি রেখে চলে গেলে নীরা ওটার দিকে আলোকপাত করে থমকে গিয়েছিল ক্ষণকালের জন্য। এটা সেই শাড়ি, যেটা সে প্রথমবার আফনানের জন্য গায়ে জড়িয়েছিল। শাড়ি হাতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে সে দেখছিল। একসময় বুকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলল।
ওর চোখে ভেসে উঠেছিল সেই প্রত্যাখ্যানের দিনটা। আনাড়ি হাতে শাড়িটা পরেছিল সে, কিন্তু মনে ছিল এক পৃথিবী স্বপ্ন। চোখে এলোমেলো কাজল দিয়ে ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়েছিল। আর কপালে ছোট্ট একটা কালো টিপ। নিজেকে বারবার আয়নায় দেখেছিল সেদিন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। ওতটা উদগ্রীব হয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে দেখেছিল সে। বুকে আটলান্টিকের উত্তাল উদ্দামতা খেলে যাচ্ছিল।
দুরুদুরু বুকে যখন বাইরে এসেছিল দমকা বাতাস ওর চুলে ঢেউ খেলছিল। একরাশ ভয়ের স্রোত আছড়ে পড়ছিল নীরার সমস্ত হৃদয়ে।
দৃষ্টিসীমায় যখন আফনানকে সে দেখতে পাচ্ছিল তখন নীরার হৃদপিণ্ডে দামামা বাজছিল। একবার মনে হয়েছিল, না থাক। সে কিছুতেই বলতে পারবে না। কিন্তু নিলয় আর তার অন্য বন্ধুরা আড্ডায় নিজেদের প্রেমের গল্প, কোন মেয়েকে ভালো লাগল তার গল্পে মাতত তখন ওর ভারি ভয় করত। আফনান যদি ওরকম করে কাউকে পছন্দ করে ফেলে!
নীরার সাহস বরাবরই বেশি, সে সংকোচকে পাত্তা দিল না। স্থলিত পদক্ষেপে সে এগিয়ে গেল আফনানের কাছে। আফনান তখন বড়শিতে মাছ গাঁথায় মগ্ন। ওর দিকে না তাকিয়েই বলল,
“আয়, বোস। আজ তোকে ছিপ ফেলা ভালো মতো শেখাই।”
নীরা বলল, “আমাকে দেখতে কেমন লাগছে?”
আফনান একবার চোখ তুলে তাকিয়ে আবারও পুকুরে দৃষ্টি নিবন্ধ করে উত্তর দিয়েছিল, “শাড়ি পরেছিস নাকি! সর্বনাশ, বড় হয়ে গেছিস।”
“আমি বড় হয়েছি সেটা আমি জানি। আমাকে দেখতে কেমন লাগছে? সুন্দরী?”
“কেন? কাউকে প্রপোজ করতে যাবি নাকি?”
“হ্যাঁ।”
“মার খাবি। কাকে?”
“তোমাকে।”
আফনান তখনো নীরার কথাকে সিরিয়াস ভাবেনি। তাই বলল, “ফাজলামো করিস না। পাকামো খালি। দেখ, এবার মাছ উঠবেই।”
“তুমি পড়াশোনা শেষ করে চাকরি পেলে আমাকে বিয়ে করবে?”
ছিপে টান পড়ল, কিন্তু আফনান যেন স্থানুবৎ বসে রইল। অত্যন্ত রূঢ় গলায় বলল,
“এটা কী ধরনের তামাশা নীরা! আমি তোর ভাইয়ের বন্ধু।”
“তুমি আমার ভাই নও। কী হয়েছে তাতে?”
“তোর বয়স কত?”
“আমি তো এখনই বলছি না, আমি অপেক্ষা করব।”
“ঘরে যা। তোকে আমি সেভাবে কখনো দেখিনি।”
“এখন থেকে দেখবে।”
“আবার বলছি, ঘরে যা।”
“যাব না।”
“তোর মাথায় এসব ঘুরে আগে জানলে তোর সাথে কথাই বলতাম না। ছিঃ!”
আফনানের ধিক্কার আর ভর্ৎসনায় নীরা ভেতরে ভেতরে মুষড়ে পড়ল।
“নীরা, শোন, তোকে আমি অন্যরকম ভেবেছিলাম। আমি ভাবতেও পারছি না, তুই এমন আজেবাজে বিশ্রী ভাবনা মনে পুষে রাখিস।”
“কাউকে ভালোবাসা বিশ্রী?”
“আমার প্রতি তোর এমন দুর্বলতা বিশ্রী আর নোংরা। এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। আর কোনোদিন আমার সামনে আসিস না৷ যা ভেতরে যা।”
সেদিন আফনানের সেই ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে নিজের উপরেই যেন ঘেন্না ধরে গিয়েছিল নীরার। আরও কী সব তিক্ত কথা যেন বলেছিল আফনান, সেসব ওর কানেও ঢুকেনি যেন। তবে ওর আবেগের মৃত্যু ঘটেছিল অঙ্কুরেই।
আফনানের সেদিনের সেই ঘৃণার ভাষা তখন দুর্বোধ্য হলেও এখন সে বুঝতে পারে। সব ঘৃণায় আদতে ঘৃণিত হয় না, ভালোবাসার মুখোশও হয়।
শাড়িটা আজ মা ওকে দিয়ে নিজের অজান্তেই ওর পুরনো এক দগদগে বিষাদী ক্ষতকে তরতাজা করে দিয়েছেন।
এই ক্ষত নিয়ে সে নিজেকে অন্যের কাছে সমর্পণ করতে পারবে না! কিছুতেই না। সেদিনই সায়মন এলে ওর সমস্তই খুলে বলেছিল।
………
ক্রমশ
#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ৩১.২)
নুসরাত জাহান লিজা
প্রথমবার সব শুনে সায়মন ভীষণ মুষড়ে পড়েছিল। তবে সে বুদ্ধিমান ছেলে। সামলে নিয়েছিল দ্রুতই। তবুও ভালোবাসা কি আর এত সহজে মুছে যায়! কিছুদিন সে অপেক্ষাও করেছিল। নীরাকে বলেছিল,
“তোমার যদি কখনো মন পরিবর্তন হয় আমাকে ডেকো নীরা। আমি অপেক্ষা করব।”
“আমি সেটা চাই না। আশা নেই জেনেও আমার জন্য কেউ আজীবন করবে সেটা ভাবতে আমার অস্বস্তি হবে সায়মন। গিল্টি ফিলিং নিয়ে আমি থাকতে পারব না।”
“তোমাকে দূর থেকে ভালোবাসার অধিকারও আমার নেই?”
“আপনি কাকে ভালোবাসবেন সেটা একান্তই আপনার ব্যাপার। তাতে আমার কোনো দায় নেই৷ তবে সেটায় যখন আমি জড়িয়ে, তাই একটা সৎ পরামর্শ দিলাম। আমি আমার নিজের মনকে চিনি৷ আমার অনুভূতি আমার কাছে স্বচ্ছ কাচের মতো স্পষ্ট। তাই জানি আপনার কোনো সম্ভাবনা নেই৷ বৃথা কেন নিজের অনুভূতির অপচয় করবেন?”
“যদি বলি ভালো লাগে আমার!”
“এই ভালো লাগা নিছকই পাগলামি।”
“যদি বলি আমি কষ্ট পেতেই ভালোবাসি?”
“তাহলে কষ্ট পান৷ আমাকে বলতে আসবেন না।”
“তুমি ভীষণ নিষ্ঠুর নীরা।”
“আমি জানি।”
সায়মন সেদিন বকুল আর রোকেয়ার সাথে কথা বলে বিয়েটা ভেঙে দেয়।
বকুল রেগে গিয়ে নীরাকে বলেন, “তুই এমন কেন করছিস নীরা? ছেলেটা তোকে কত ভালোবাসে। কষ্ট পাচ্ছে খুব।”
“ফুপু, কেউ যদি এক তরফা ভালোবাসে তার জন্য কি আমাকে দায়ী করা যায়?”
“তুই নিজে এভাবে থাকবি? একদিন না একদিন তো কাউকে বিয়ে করবি। তাহলে সেটা সায়মন নয় কেন?”
“সেটা আমি তাকেই বলেছি ফুপু। আরও অনেকেই আমাকে হয়তো ভালোবাসার কথা বলেছে, আমি কি জনে জনে তাদের সবাইকে গিয়ে বিয়ে করব?”
বকুল রেগে শ্বশুরালয়ে চলে গেছেন, এরপর আর একদিনও নীরার সাথে কথা বলেননি। নীরা বাড়িতে থাকলে তিনি এই বাড়িমুখো হন না।
রোকেয়া নীরাকে হুমকি ধামকি দিতে থাকেন।
সে উত্তরে মা’কে বলে, “মা, প্লিজ, তুমি এই ব্যাপারে আমার সাথে অন্তত কথা বলো না।”
“আমি তোর মা, নীরা।”
“সেজন্যই তোমার সাথে বেয়াদবি করতে চাই না।”
“নীরা, আমি তোর ভালো চাই।”
“সেজন্য আফনানের বাড়ি গিয়েছিলে?”
“কী বলতে চাস?”
“মা, আমি সেসব বলতে চাইনি। কিন্তু তুমি জানো তুমি কী করেছ।”
এবার রোকেয়া রেগে গিয়ে বলেন, “ওই ছেলে তোকে উস্কেছে?”
“ও উস্কালে তো ভালোই হতো মা। সে মহান হতে চেয়েছে।” তাচ্ছিল্য ভরে বলল নীরা।
“তুই কী করে জানলি তাহলে?”
“দুইয়ে দুইয়ে যে চার হয়, সেটা না বোঝার মতো গবেট আমি নই মা। তুমি হুট করে ওদের বাড়িতে যে সান্ত্বনা দিতে বা সহানুভূতি দেখাতে যাওনি তা আমার চাইতে ভালো আর কে জানবে?”
“বেশ করেছি, আমি যা করেছি তোর সুখের জন্য করেছি।”
নীরা পাগলের মতো হেসেছিল, হাসতে হাসতে চোখের কোল বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়েছিল। সে মোছার চেষ্টা করেনি।
“সুখ? আমার সুখ দেখতে চাও? সবাই আমার সুখের জন্য এত ভাবো? তুমি, আফনান? আমার সুখের এত দায় তোমাদের? ঠিক আছে, তুমি চোখের সামনে আমাকে সারাজীবন এভাবেই দেখবে। আমি কাউকে বিয়ে করব না। আফনানকেও নয়। তোমাদের এটাই পাওনা।”
রোকেয়া অনেক চেষ্টা করেছেন, কিন্তু নীরাকে টলাতে পারেননি। মঈদুল সব জেনে দুজনকেই কথা শুনিয়েছেন বাড়াবাড়ি করার জন্য। তবে দু’জনেই অনড়।
নিলয় একবার নীরাকে এসে বলেছিল, “আমি আফনানের সাথে কথা বলি একবার?”
“একদম না ভাইয়া। যে একা একা সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার অনুভূতিকে খাটো করতে পারে, তার সাথে আমার কোনো লেনাদেনা নেই।”
এরপর আর এই বাড়িতে এসব নিয়ে আলোচনা হয়নি।
একসময় সায়মনের সাথে নীরার বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। সত্যিকার অর্থেই ছেলেটা ওর শুভাকাঙ্ক্ষী। ওকে সাপোর্ট দিয়েছে সেসময়। আর কখনো কোনো দাবী নিয়ে ওর মুখোমুখি দাঁড়ায়নি। নির্জলা বন্ধুতার হাত চিনতে ওর ভুল হয়নি। তাই বন্ধু হতে অস্বীকার করতে পারেনি নীরা।
মা অবশ্য সায়মনের মতো ছেলে হাতছাড়া হবার জন্য দুঃখ করেছেন। মনে মনে এখনো ভালো ছেলের সন্ধানে আছেন। আভাস পেলেই নীরাকে চাপ দিতে চেষ্টা করতেন। সেজন্য সে বাড়ি আসা কমিয়ে দিয়েছে।
সায়মন ওর ক্যাম্পাসে আসত। একটা মেয়ে একদিন হুট করে নীরা আর সায়মনের কাছে আসে দেখা করতে।
“আমি টুম্পা। আমি আপনাকে পছন্দ করি সায়মন। আপনার উত্তর জানতে চাই।”
সায়মন প্রথমে ফিরিয়ে দিয়েছিল। নীরা হেসে বলেছিল,
“তোমার ছেলেবেলায় ছ্যাকা খেয়ে প্রপোজে ভয়! মেয়েটা তোমার কাজ সহজ করে দিল। রাজি হয়ে যাও।”
এরপর মেয়েটা প্রায়ই নীরার কাছে আসত। টুম্পার সাথে ওর সখ্যতা তৈরি হয়৷ বেশ ইন্টারেস্টিং একটা মেয়ে। ভীষণ অকপট, প্রাণখোলা মানুষ। সায়মনকে দেখে ভালো লেগে গিয়েছিল। পরে নীরাকে ওর সাথে দেখে গার্লফ্রেন্ড ভেবেছিল। খোঁজ নিয়ে জানতে পারে তেমন কিছু নয়। তাই সে মনের কথা জানিয়ে দেয়।
সায়মন বেশ কয়েকবার ফিরিয়ে দিলেও একসময় ওই প্রাণচাঞ্চল্যে ডুবে যায়। এখন তাদের বিয়ে হবে এক সপ্তাহ পরেই। টুম্পার সাথে নীরারও ভীষণ ভালো বন্ধুত্ব, তাই ওদের বিয়ের কেনাকাটা বিশেষ করে শাড়ি পছন্দ করার দায়িত্ব মেয়েটা নীরাকেই দিয়েছে। আজ সেজন্যই এসেছিল কেনাকাটা করতে। তখনই আফনানের সাথে দেখা।
***
ইরা পরের দিন ক্লাস থেকে আসতেই ক্যাম্পাসে হাস্যোজ্জ্বল শাফিনকে দেখতে পেল। ভেতরে ভেতরে উচ্ছ্বসিত হলেও প্রকাশ করল না।
“তুমি? বাচ্চা মেয়ের কাছে কেন এসেছ?”
“মা ভাঙাতে।”
বলে একটা ঘাসফুল এগিয়ে দিল শাফিন।
“আমি হলে যাব এখন।”
“তুমি পারবে না।”
“কেন? জবরদস্তি নাকি?”
“তোমার মন তোমাকে বাঁধা দেবে।”
“এত কনফিডেন্স?”
“আমার ভালোবাসার উপরে আমার বিশ্বাস আছে গো মেয়ে।”
ইরা সত্যি সত্যি যেতে পারে না। সে-ও মনে মনে শাফিনকে দেখতে চাইছিল সামনা-সামনি। কিন্তু মুখে বলতে পারছিল না৷ তাই ফোন বন্ধ করে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। সে জানত শাফিনকে শাস্তি দিতে গিয়ে নিজের উপরেই জুলুম করছে। তবুও আজকের মুহূর্তটার জন্য সে এটা করেছিল। আজ সে ভীষণ আনন্দিত। সব অভিমান যেন গলে জল হয়ে গেল নিমিষেই।
ওর অভিমানী মুখের কয়েকটা ছবি তুলল শাফিন।
“তুমি আমাকে এত বুঝো কেন?”
“ভালোবাসি, তাই।”
এটা কোন ঋতু ইরা মনে করতে পারল না, তবে একরাশ বসন্ত বাতাস এক পৃথিবী ভালো লাগা নিয়ে হু হু করে যেন প্রবেশ করল ওর সুখী হৃদয় কোণে।
…………
(ক্রমশ)