#ঝরা_বকুলের_গল্প
#পর্ব_০১
#মেহা_মেহনাজ
গা থেকে টেনে সম্পূর্ণ শাড়িটা খুলে ছুঁড়ে ফেলা হলো মাটিতে। তারপর ঘরের ঝাঁপ আঁটকে প্রহার করা হয় মনের আঁশ না মেটা পর্যন্ত। এক সময় রক্তাক্ত পাখির মতো শরীরটার দিকে তাকিয়ে ওঁর বুকের ভেতর শান্তি মিলে। কপালের ঘাম মুছে হাত থেকে শলার ঝাড়ুটা ছুঁড়ে ফেলে সে বাইরে বেরিয়ে এলো। ঘরের উঠোনে উৎসুক জনতা।
একজন প্রশ্ন করল, “শরীরের জ্বালা মিটছে?”
আরেকজন বলল, “একদম উচিত কাম করছোস মোরশেদ। মেয়া মানুষ থাকব নম্র ভদ্র, সংসারে মন দিবো। এডা কেমন অলক্ষী জুটলো তোর কপালে..”
মাঝখান দিয়ে রুনু বেগম হা-হুতাশ করে উঠলেন,
“হায়রে! আমার সোনার পোলার কপালডা এমুন পুড়ার পুড়া! জুটলো তো জুটলো, এরম একটা বে*শ্যা জুটলো!”
মোরশেদ তখন ঘনঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে সবাইকে বোঝাচ্ছেন, বউ পে*টানোর মতো মহৎ কাজ দুনিয়াতে আর একটিও নেই। বকুলকে তার যোগ্য শাস্তি দেওয়া হয়েছে। আশা করা যায়, এরপর থেকে অলক্ষী মেয়েটা লক্ষী হওয়ার চেষ্টা করবে।
এই নিয়ে বাহিরে বড় সমাবেশ চলল আধঘণ্টা যাবত। সবাই ভুলেই গেল, ভেতর ঘরে অর্ধ চেতন অবস্থায় ছোট্ট একটা শরীর পড়ে রয়েছে। যার গলা,বুক,পিঠ,মুখ,হাত এবং রানের কিছু অংশ- কোত্থাও বাদ দেয়নি স্বামী নামক নরপিশাচটি। মনের আঁশ মেটাতে গিয়ে বিভিন্ন জায়গা জখম এবং র*ক্তাক্ত করে তুলেছেন তিনি। অনেকক্ষণ পর বকুল সামান্য নড়ে উঠল।
সবাইকে বিদায় দিয়ে পান চিবাতে চিবাতে রুনু বেগম ঘরের ভেতর ঢুকলেন। শাড়ি পরা হয়নি। ছায়া-ব্লাউজ পরিহিতা আহত বকুলকে দেখে তাঁর বোধকরি সামান্য মায়া হলো। তিনি এগিয়ে গিয়ে বকুলের হাত চেঁপে ধরে উঠার ইশারা করলেন।
“উঠ! কইছিলাম, টইটই বাদ দিয়া সংসারে থিতু হ। মাইয়া মাইনষের জীবনে সংসার ছাড়া আর আছেই বা কি? আমার কতা তো হুনবি না। চলবি নিজের মন ইচ্ছামতো। আর দুইদিন পর পর এরম মাইরডি খাবি। তুই তো জানোস মোরশেদ চেতলে আগে-পিছে দেহে না। ইচ্ছামতো মা*ইরা থুইয়া হাইট্টা যায়। সব জাইনাও ওরে চেতাস ক্যান? উঠ,উঠ,আইয়া যদি দেহে এহনো এরম পইড়া রইছোস, আবার ছেঁচবো।”
বকুল চুপচাপ বাধ্য মেয়ের মতো উঠে দাঁড়াল। শরীর টলমল করছে। মাথা চক্কর দিচ্ছে বিশ্রীভাবে। ওর হুট করে দুই চোখ বেয়ে মেঘেদের দল গড়িয়ে পড়ে। রুনু বেগম দেখার আগেই ও চোখ মুছে শাড়িটা কোনোরকমে শরীরে জড়িয়ে চলে যায় পুকুর পাড়ের উদ্দেশ্যে।
বছর তিনেক আগে, শীতের এক ম*রা বিকেলে অনাড়ম্বর ভাবে বিয়েটা হয়েছিল ওর। বয়স তখন বারো মাত্র। পুতুল খেলার বয়সটায় সত্যিকারের সংসারের জ্বাল ওকে আঁটকে ফেললেও ও এখনো বোঝে না, স্বামী কি, সংসার কি, দাম্পত্য জীবন কি! মোরশেদ গুণে গুণে একুশ বছরের বড় পুরুষের সঙ্গে দিনের আলোয় সংসার সংসার খেলা খেললেও রাতের প্রহর যেন নির্মম যন্ত্রণায় কা*টে।প্রথম প্রথম হাঁটতে কষ্ট হতো। পাড়াপড়শি মেয়েরা ঠোঁট টিপে হাসতো তাই দেখে। লজ্জায়, সংকোচে কাউকে বলতে পারতো না, ওর ঠিক কোন কোন জায়গায় দুঃসহ শূল কা*টার মতো বিঁধে আছে। ছোট্ট মাথায় পৃথিবীর অনেক হিসেব না মিললেও এইটুকু বুঝতে বাকী রইলো না, আর যাই হোক, নিজের যন্ত্রণার কথা কাউকে বলা যাবে না। বিশেষ করে সংসারের জীবনের কোনো কষ্টের কথা। সব বুকের সাগরে বিসর্জন দিয়ে মুখ বুঁজে মাথানিচু করে চলতে হবে আজীবন। তবেই দিন শেষে তুমি লক্ষী, ভালো, স্বামীর আদর্শবান বউ!
বকুল পারেনি। ওর ছোট্ট কিশোরী মন অনেক চেষ্টা করেও মোরশেদের মন মতো হয়ে উঠতে পারেনি। পুকুরের পানি ওর ভালো লাগে। বৃষ্টি ভালো লাগে। আকাশ ভালো লাগে। মেঘের দিকে নির্নিমেষ চেয়ে থাকতে ভালো লাগে। ভালো লাগে পাখিদের কথা শুনতে। ভালো লাগে নিজেকে বাতাসে উড়িয়ে দিতে। আরও ভালো লাগে প্রকৃতির নিস্তব্ধতায় গল্প বুনতে। শিশির মাড়িয়ে ছুটতেও অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে মনের ভেতর। শিউলির তলা কুড়োতে ভালো লাগে। বকুলের মালা গাঁথতে ভালো লাগে। মাঝে মাঝে চড়া রোদটাও ভালো লাগে। তখন ঘূর্ণির মতো যে ঝড়ের বাতাসটা এসে ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নেয়, ওর মনে হয় সেই হাওয়ায় উড়ে দূর গগণে মিলিয়ে যেতে….
ওর কিশোরী মনটায় সবকিছুই ভালো লাগে। এই ভালো লাগা গুলোয় ওর জীবনে সবচেয়ে বড় ঝড় তুলে নিয়ে এসেছে। আসছে। ওর ছোট্ট চঞ্চল প্রাণকে মৃ*ত করার জন্য মোরশেদের কত আয়োজন! বকুল বোঝে। দুঃখ হয়। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে কোনো একদিক চলে যায়…
তারপর আর যেতে পারে না। কই যাবে? ওর তো একটা শান্তির ঘর নেই!
_________
আজ পুকুরের পানি বড্ড ঠান্ডা। এখন শীতের শেষ বেলা। পানিতে নামতেই ওর সমস্ত শরীর শিউরে উঠল। বকুল দ্রুত দুইটা ডুব দিয়ে উঠে পড়ে। শরীর কাঁপছে থরথর করে। ব্যথা জায়গা গুলো অবশ হয়ে গেছে। ওর ভয় হয়। হাড় কাঁপানো জ্বর আসবে না তো?
রুনু বেগম মোরগ-মুরগিগুলো কে খোঁপের ভেতর ঢোকাচ্ছেন। কাপড় পালটে চুল খোঁপা করে এলোমেলো পদক্ষেপে বকুল এসে তাঁর সামনে দাঁড়াল। রুনু বেগম তাকালেন। বকুলের ঠোঁটের এক পাশ ছঁড়ে গেছে।
“কত কইছি ইট্টু স্থির হ। ঘরের কাম-কাজে মন দে। সারাদিন বনে-বাদাড়ে ঘুইরা বেড়াস। আর একখান বউ দেহা যারা তোর মতো টইটই কইরা বেড়ায়!”
বকুল মাথা নিচু করে রয়। ওর কপাল কুঁচকে আছে। সবকিছু বড় বিরক্ত লাগছে।
“যা, রাইতের ভাত রাইন্ধা ফেল। চুলার পাশে আমি বেগুন বাইর কইরা রাখছি। দুইটা বেগুন ভাজ। মোরশেদের বড় পছন্দ।”
বকুল জবাব দিলো না। চুপচাপ গিয়ে নিজের কাজে মন দিলো। ক্ষণকাল পর দুই জোড়া পায়ের আগমন ঘটে উঠানে, রান্নাঘরের ঠিক পাশে। রুনু বেগম বসে বসে মুড়ি চিবাচ্ছেন। আগত দুইজন ওদের পাশের বাড়ির আলিফের নানী এবং রুমিজা মা। দুইজন এসেছে গোপন সংবাদ নিয়ে।
আলিফের নানী ফিসফিস করে বললেন,
“তোমার বউ কই?”
রুনু বেগম দায়সারাভাবে জবাব দেন,
“ভিত্রে আছে।”
“খবর হুনছো?”
“কীয়ের খবর?”
রুমিজার মা অবাক হলেন,
“তোমার পোলা এতবড় কামডা করল, আর তুমি অখনো কিছু জানো না?”
রুনু বেগম কপাল কুঁচকে তাকালেন,
“নাটুক না কইরা কি হইছে তাই কও। মোরশেদ কি করছে?”
“তোমার পোলা তলে তলে আরেক বিয়া কইরা অন্যখানে বউ রাখছিল এতদিন। হেই খবর তো ফাঁস হইয়া গেছে। সারা গেরাম ছড়ায় গেছে। হেই বউ আইয়া নিজের অধিকার দাবী করছে। ইট্টুর মধ্যে বাড়ি আইলো বইলা।”
“কি!”
রুনু বেগম তাজ্জব বনে যান। আলিফের নানী মাথা ঝাঁকালেন, যা বলা হয়েছে সব সত্যি! রুমিজার মা টিপ্পনী কে*টে বললেন,
“ঠিকই আছে। যেই না বউ তোমার! না আছে রঙ, না আছে ঢং। মন পইড়া রয় বাইরের ছেড়াগো দিকে। তোমার পোলাডারে জ্বালাইয়া শেষ কইরা দিছে। এরম বউ ঘরে রাইখা কোন সোয়াবের কাম করবো ওয় শুনি? এর চাইতে আরেক বিয়া কইরা নিয়া আইছে, ভালো হইছে। তুমি কিন্তু বাঁধা দিও না। নতুন বউ আইলে ঘরে তুইলা নিও। তোমার পোলার খুশিতেই তো তোমার খুশি নাকি?”
রুনু বেগম মাথা দোলালেও স্থির হতে পারেন না। হুট করে আসা দুইজন এমন সব কথাবার্তা বলতে লাগলো এরপর, সবকিছু উনার মাথার উপর দিয়ে গেল। উনি একটু পর পর বাহিরের উঠানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। এখনো কেন কেউ আসছে না?
____________
কোথাও কি বজ্রপাত হলো? বকুল স্পষ্ট শুনলো একটা গাছ মড়মড় করে ভেঙে পড়েছে। সে কাঠের জানলা দিয়ে উঁকি দেয়। নাহ, কোত্থাও বাতাসের লেশমাত্র নেই। ঝড় উঠা তো দূরের কথা। তাহলে কোথায় কি ভেঙে পড়ল? নাকি তার মনের বাড়িতে যে ঝড় উঠেছে, তাই এসে কানে বাজছে?
বকুলের পুরো শরীরটা জমে গেছে। বুকের ভেতর অসহনীয় দহন, সেই দহনের কাছে শারীরিক ব্যথা কিচ্ছু না। কিন্তু কেন? মানুষটাকে সে কোনোদিন নিজের করতে পারেনি। তার কাছ থেকে ভালো ব্যবহারের চেয়ে খারাপ ব্যবহারটাই সবসময় পেয়ে এসেছে। ভালোবাসা চেয়ে পেয়েছে অবহেলা, কটাক্ষ, রূঢ় আচরণ, আর শরীরের উপর দিয়ে চালানো পাশবিক নির্যাতন। তারপরও কেন সেই মানুষটা অন্য কারো শোনার পর এমন লাগছে? ছোট্ট বকুলের আরও একটি হিসেব মেলে না। সে বুক চিঁড়ে বড় দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বুকের ভার বাইরে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করলেও বুকের ভার কমলো না। বরং চোখের কার্নিশ ঘেঁষে আবারও মেঘেদের দল গড়ায়।
মাগরিবের আজানের অনেকক্ষণ পর মোরশেদ ঘরের ভেতর ঢুকলেন। ততক্ষণে পুরো উঠোনে আশপাশের ঘর থেকে জমায়েত মানুষের ঢল। যথারীতি মোরশেদের সঙ্গে সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন নারী, গায়ে মাথায় নতুন লাল শাড়ি জড়ানো, ঠোঁটে সস্তা লিপস্টিক, কপালে লাল একখানা টিপও লাগানো। হাতে কিছু কাঁচের চুড়ি টুংটাং শব্দ তুলছে। গায়ে গতরে ভালো। শরীরের রংটা সামান্য ময়লা, এছাড়া প্রায় সবদিক থেকে বকুলের চেয়ে সুন্দর। মোরশেদের পাশে মানাচ্ছে। এসেই রুনু বেগমের পায়ের উপর ‘আম্মা’ বলে পড়ে গেছে। রুনু বেগম না চাইতেও তাকে টেনে তুললে সে জড়িয়ে ধরে ‘আম্মা’ বলে ডেকেছে। রুনু বেগমের ভালোই লাগল। বকুল কেমন চুপচাপ, ঘরকুনো স্বভাবের। অথচ বাইরে গেলে ঠিকই হৈহৈ করতে পারে।
নতুন বউয়ের নাম শাহজাদি। বাবা-মায়ের বড় শখের মেয়ে। পরিবারে সবার ছোট। বড় বড় চারটে ভাইয়ের পর তার জন্ম। শাহজাদির বাবা-মা মেনে নিয়েছে সবকিছু। তারা আগামীকাল হয়তোবা আসবেন। এসে পুনরায় বিবাহের ব্যবস্থা করবেন। শাহজাদি বারবার আশ্বস্ত করল, আপনার ছেলেরে ঘরভর্তি জিনিসপত্র দেওয়া হবে। আপনি চিন্তা করবেন না আম্মা!
তাই শুনে রুনু বেগমের যেটুকু গাইগুই ছিল, সব শেষ হয়ে গেল। একেক জনে একেক কথা বলল, কেউ মজা নিলো, কেউ উপদেশ দিলো, কেউবা বকুলকে কি করা যায়- তার ব্যাপারে ও একটা বিশদ আলোচনা করে ফেলল। অথচ কেউ একটা বার বকুলকে জিজ্ঞেস করার সময়টুকু পেল না, সে কেমন আছে? তার কেমন লাগছে? চোখের সামনে সতীন দেখতে পেরে সে কি আনন্দিত? নাকি তার ম*রে যেতে ইচ্ছে করছে?
চায়ের আবেদন করা হলো। বকুল নিজের হাতে স্বামী এবং সতীনের জন্য চা বানিয়ে দিয়ে আসলো। চায়ের কাপ রেখে বেরিয়ে আসার মুহূর্তে মোরশেদ খসখসে কণ্ঠস্বরে বললেন,
“আইতনায় আর নাইলে মাচার ঘরে ঘুমাইতে হইবো।”
বকুল বুঝলো, ইঙ্গিতে তাকে এ ঘর খালি করতে বলা হয়েছে। ও ঘরে সেরকম জিনিসপত্র ও নেই তার। কিছু জামাকাপড়, সেসব পরে আনা যাবে। বকুল চুপ করে মাথা দুলিয়ে বেরিয়ে এলো। সে বেরোতেই নতুন বউয়ের খিলখিল হাসির শব্দ কানে ভেসে আসে। মোরশেদও হাসছেন। দু’জনেই ভীষণ খুশি। বকুলের কেমন দমবন্ধ লাগে। ইশ! কোথাও যদি ছুটে পালিয়ে যাওয়া যেতো!
বকুল দোতলায় ঘুমাতে চাইলো। রুনু বেগম কেন যেন সম্মতি দিলেন না। জোর কণ্ঠে তার সঙ্গে ঘুমানোর আদেশ দিলেন। বকুল চুপচাপ মেনে নিলো। এ বাড়িতে ওর কোনো জোর নেই। যে যা বলে, ও তাই শোনে। আগে থেকেও শুনতো। তবে আগে একটু খারাপ লাগত, জেদ আসতো, এখন সেটাও আসছে না। মনে হচ্ছে, ওর কোনো অনুভূতিই নেই। সব ম*রে গেছে। একটা মানুষ কি করে পুতুল খেলা খেলতে পারে? আর গোটা গ্রাম তাকেই সায় দিলো! শুধুমাত্র বকুল চঞ্চল বলে, কারো আদর্শবান স্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা নেই?
কুপি বাতি নিভিয়ে রুনু বেগম বিছানায় এসে শুয়ে পড়লেন। রাত অনেক হয়েছে। গল্পে গল্পে অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। এতক্ষণে গভীর ঘুমে তলিয়ে থাকার কথা। এ বাড়িতে ওরা তিনজন মানুষই ছিল এতদিন, আজ থেকে আরেকজন সদস্য হলো। হুট করে রুনু বেগম কেন যেন বলে উঠলেন,
“সময় থাকতে বাচ্চা নিতে কইছিলাম। বয়সের দোহাই দিয়া নিলি না। এখন বোঝ..”
বকুল জবাব দিলো না। রুনু বেগম বলে চললেন আপন মনে,
“বাচ্চা হইলো বেডাগো আঁটকানোর সুতা। যতডি বাচ্চা, বেডারা অতই আঁটকাই থাকবো বউয়ের আঁচলে। সারাদিন টইটই করোস, সংসারে দেস না মন, আমার পোলাডার লগেও তোর সম্পর্ক ভালো না, আমি সব বুঝি। তার উপরে নেস নাই একটা বাচ্চা। এখন গেছে তো হাত ছাড়া হইয়া! পাশের ঘরে তোর জামাই আরেক মাইয়া নিয়া শুইয়া আছে। এডি সহ্য হইতাছে? আমি কথা কইলে কখনো তো হুনবি না। এখন বোঝ..”
বকুলের দু’চোখের বাঁধ ভাঙে। বাচ্চা নেওয়া না নেওয়া তো উপর ওয়ালার হাতে। তিনি দেননি, সেখানে ওর কি দোষ? আর কে বলেছে বাচ্চার অযুহাতে পুরুষ মানুষকে আঁটকে রাখা যায়? শালু আপার স্বামী তো চারটা বাচ্চা থাকা সত্ত্বেও শালু আপাকে তালাক দিয়ে ফেলে চলে গেছে। এখন বাবার বাড়িতে কি নরক যন্ত্রণাই না সহ্য করতে হচ্ছে উনাকে!
রুনু বেগম ক্ষণকাল বিরতি নিয়ে ফের বলতে শুরু করলেন,
“তুই কি চাস? সতীনের সংসার করবি? নাকি যাইবি গা বাপের বাড়ি? আমি কমু, মাটি কামড়াইয়া হইলেও এইহানে পইড়া থাক। ভালো মতো সংসারটা কর। মোরশেদ তো আমার ছেড়া। ওর মনে এত্ত পাত্থর নাই। দেখবি, ওয় তোরেও আবার সোহাগ করব। এক লগে দুই বউ নিয়া থাকে না কত পোলারা, ওমনে আর কি.. কি থাকবি? নাকি যাইবি গা?”
বকুল উঠে বসে। কোনো কথারই জবাব দিতে ইচ্ছে করে না। পেটের ভেতর পাঁক দিচ্ছে। কেমন যেন অস্থির লাগছে। সে নিচে নামে। রুনু বেগম ডাকলেন,
“কীরে, কই যাস?”
এবার বকুল একটুখানি উত্তর করল,
“বাইরে।”
তারপর কুপি হাতে বেরিয়ে পড়ল। গ্যাস লাইট দিয়ে কুপি বাতি জ্বালিয়ে সে এগিয়ে চলে বড় ঘরের দিকে। বড় ঘরে যাওয়ার সময় মাঝখানে আরেকটি ঘর পরে। সেই ঘরে এতদিন সে আর মোরশেদ থাকলেও আজ ওই বিছানায় জায়গা হয়েছে আরেক জনার। বকুল ঘরটার সামনে আসতেই কেমন অসাড়তা অনুভব করে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য পা থমকে যায়। অজান্তেই কানে ভেসে আসে চাপা শীৎকারের আওয়াজ! নতুন বউ ভালোয় আদরে ডুবেছে। বকুলের চোখের জল এবার চিবুক ছোঁয়। সে চপল পায়ে কুপি হাতে এগিয়ে চলে উঠোনের দিকে…
চলবে।