#ডাক্তার_মিস
পর্ব ২৮
ভোরের দিকে আধো ঘুম আধো জাগরণে বুশরার একবার মনেহলো একটা পুরুষালি হাত আলতোভাবে জড়িয়ে রেখেছে ওকে। তবে পরক্ষনেই মনে হল এটা ওর অসুস্থতায় দুর্বল চিত্তের কল্পনা।
স্বপ্নভঙ্গের ভয়ে ভুলেও চোখের পাতাজোড়া টেনে আলাদা করার চেষ্টা করলনা ও। বরং আরও কিছুক্ষণ এই আবেশটা অনুভব করার জন্য জোর চেষ্টা করলো যাতে ঘুম না ভাঙ্গে।
পাগলী মেয়েটা যদি জানতো এটা স্বপ্ন না তাহলে বোধহয় যত কষ্টই হোক বাকি রাতটা ঘুমাতো না।
সকালে আগে ঘুম ভাংলো রায়হানের। পর্দা ভেদ করে আসা আলোছায়ায় মায়াময় দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। বিয়ের কতগুলো দিন পেরিয়েছে, চিন্তা করল রায়হান। অথচ স্ত্রীর নুন্যতম অধিকার আদায়ের চেষ্টা করেনি আজ পর্যন্ত। চেষ্টা করেনি দৃষ্টি আকর্ষনের।
কখনো প্রশ্ন করেনি, কেন বাড়ি ফিরতে দেরী হয় নিয়মিত। কখনো প্রশ্ন করেনি কথাকে নিয়েও। এমনই জীবন কি চেয়েছিল ও? জীবনসঙ্গী বুদ হয়ে থাকবে অন্য কারও সাথে জড়ানো অতীতে? বুশরার যায়গায় ও থাকলে কি মেনে নিতে পারত এত সহজে? সহজ? আসলেই কি সহজ?
ভাবনায় ছেদ পড়ে বুশরা বার দুই কেঁপে ওঠায়। স্বপ্ন দেখছে নাকি মেয়েটা? ভয় পাচ্ছে?
– বুশরা… এই বুশরা…
মৃদু ধাক্কা দেয় রায়হান।
– ছেড়ে যেওনা প্লিজ…
বিড়বিড় করে বলে বুশরা। ভীষন অপরাধবোধ হয় রায়হানের। হাতের বাধন আরেকটু শক্ত করে ডাকে আবার।
– বুশরা। স্বপ্ন দেখছো?
এবার সংবিত ফিরে পায় মেয়েটা। চোখ খুলে পিটপিট করে তাকায়।
– আল্লাহ… সকাল হইয়ে গেছে? হসপিটালে যাওয়া লাগবে তো।
এই বলে যেইনা উঠতে চেষ্টা করে তখনই বাধাপ্রাপ্ত হয়ে নিজেরে রায়হানের বাহুডোরে আবিষ্কার করে সে।
অবিশ্বাসের চোখে তাকায় পাশের মানুষটার দিকে। ওকে কোন রকম পাত্তা না দিয়ে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে কপাল ছোঁয় রায়হান। শাসনের স্বরে বলে,
– আজকে হাসপাতাল যাওয়া হবে না। ছুটি নাও।
– কেন?
– আমি বলেছি তাই।
– সব আপনার কথামতই হবে?
অনুযোগের স্বরে বললো বুশরা। যদিও ও ভেবেচিন্তে বলে নি তবু কথাটার মধ্যের অভিমান টের পায় রায়হান। তাই এবার নরম স্বরে বলে,
– প্লিজ… একটা দিনই তো।
– আচ্ছা।
হাতমুখ ধুয়ে খাওয়ার ঘরে গেল দুজনেই। জ্বর না থাকায় খিচুড়ি আর ডিমভাজা দিয়ে আয়েস করে খেল বুশরা।
শিউলি বেগম বললেন,
– আজকের দিনটা ছুটি নিয়ে ঘরে থাক মা। হাসপাতালমুখো হয়েছিস তো তোর এক দিন কি আমার এক দিন।
বাধ্য মেয়ের মত “আচ্ছা” বলল বুশরা। এর আগেও অসুস্থ হয়েছে ও। তবে এত সহজে হাসপাতাল কামাই দিতে রাজি হয়নি। শিউলি বেগম অবাক হয়ে বুশরার দিকে তাকালেন। তবে তাতে লাভ হলো না। বুশরা গভীর মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছে। একই অবস্থা রায়হানেরও। Hasin Rehana – হাসিন রেহেনা
খাওয়াদাওয়া শেষে ঘরে আসলো বুশরা। হাসপাতালে জানিয়ে দিল আজ আসতে পারবে না, অসুস্থ। শেলফ থেকে একটা বই নিয়ে এসে আধশোয়া হয়ে কিছুক্ষণ পড়ার চেষ্টা করলো। তাতে অবশ্য খুব একটা লাভ হলো না। মনোযোগ নেই। তারপর ঘরের মধ্যেই পায়চারী করলো। আবার এসে বই নিয়ে বসলো।
দরজায় দাঁড়িয়ে বউয়ের কান্ড কারখানা দেখছিল রায়হান। এবার হেসে ফেলল।
– হাসছেন কেন?
– কই? না তো। এত অস্থির হয়ে আছো কেন?
– আপনার কথা শুনে শুধু শুধু ছুটি নিয়ে বাড়িতে বসে আছি। আমি একদম ফিট আছি। শুধু শুধু …
– আচ্ছা বাড়িতে বসে থাকতে হবে না, চলো।
– কোথায়? এই অবস্থায়?
– কেন? সাজগোজ করতে হবে নাকি?
– না, তা নয়। কিন্তু আমাকে একটা কথা বলুন তো…
– উহু… তাড়াতাড়ি। যেতে যেতে কথা হবে…
বুশরাকে কথা বলার কোন রকম স্কোপ না দিয়ে টেনে নিয়ে গেল রায়হান। গন্তব্য কোথায়? রায়হানই বলতে পারবে ভালো।
উঠান পেরোতেই পিছু ডাকলেন শিউলি বেগম।
– অসুস্থ মেয়েটাকে নিয়ে কোথায় চললি?
– চিন্তা করো না আম্মা। মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। তোমার মেয়েকে নিয়ে পালাবো না।
– বল তো যা। খোকা…
সদর দরজার পেরিয়ে বাইরে এসে দেখলো রায়হানের বাইক দাঁড় করানো। এক মুহুর্ত দেরী না করে বাইকে উঠে বসলো রায়হান। ইশারা করলো উঠে বসার জন্য। ও উঠে বসতেই বাইক স্টার্ট দিল রায়হান,
– যাচ্ছি কোথায় আমরা?
উত্তর দিল না রায়হান। গাড়ি চলছে হাসপাতালের পথে। বুশরার মনে হলো, রাগ করে বোধহয় বুশরাকে হাসপাতালে পৌঁছে দিবে। মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত বলেছিল লোকটা। তবে হাসপাতালের সামনে এসেও স্পিড না কমানোয় সেই সম্ভবনা উড়িয়ে দিল।
– আচ্ছা কোথায় যাচ্ছি বলতে হবে না। অন্যরকম আচরণ কেন করছেন সেটা তো বলুন।
– কি অন্যরকম?
পেছনে না ফিরেই প্রশ্ন করল রায়হান।
– হঠাত তুমি তুমি করে বলছেন। আবার সকালে …
কথা শেষ করতে পারলো না বুশরা। তবে মুচকি হাসলো রায়হান। সে হাসি অবস্য দৃষ্টিগোচর হলো না তার মিসেস এর।
– আপনি করে বলতে বলছো তাহলে আবার?
– না না … তা বলিনি…
তাহলে শক্ত করে ধরে বসো। রাস্তা ভালো না। আর আমি পরপুরুষ ও না।
সারাপথ আর বিশেষ কোন কথা হলো না। অবশ্য পথ খুবই অল্প। এক ঘন্টারও কম। তবে বেশ ভাঙ্গাচুরা। আর আসেপাশে জনবসতিও খুব কম। পথ সরু হতে হতে অনেক ছোট হয়ে গেছে। বাইক নিয়ে আসার কারন এবার বোধগম্য হলো ওর। Hasin Rehana – হাসিন রেহেনা
বাশের বেড়া ঘেরা এক বাগানের সামনে এসে বাইক থামালো রায়হান। বুশরা বসেই আছে দেখে বললো,
– নামো… এখানে আমাদের বরণ করার জন্য কেউ নাই তো।
লোকটার হয়েছে কি। আজ একটা কথাও সিধা ভাবে বলছে না। আচরণও করছে অদ্ভুত। ঘটনা সুবিধার লাগছে না বুশরার। অগত্যা নামলো বিনা বাক্যব্যায়ে।
বেড়ার দরজা পেরিয়ে হেঁটে গেল রায়হানের পিছুপিছু। থামলো রায়হানের সাথে। ওদের সামনে ছোট্ট একটা বাড়ি। অবশ্য বাড়ি না বলে কটেজ বললেই বরং মানানসই হয়। এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে রিসোর্ট আছে ভাবতে অবাক লাগলো বুশরার। আসেপাশে অবশ্য আর কোন কটেজ নাই। হয়ত গাছগাছালি দিয়ে আড়াল হয়ে আছে।
তবে ওদের দেখে এগিয়ে এলো না কেউ। অবশ্য কেউ থাকলেই না এগিয়ে আসবে।
– একটু দাঁড়াও, আসছি।
বলেই হারিয়ে গেল রায়হান। বুশরা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো বাগানটা। এত্ত সুন্দর যায়গায় কতদিন আসেনি ও, চিন্তা করলো। কিছুক্ষন বাদেই ফিরে এলো রায়হান। হাতে ছোট্ট একটা ব্যাগ।
– এসো।
টানা বারান্দা পেরিয়ে কটেজের দরজায় পৌঁছে বুশরা দেখলো তালা ঝুলছে। রায়হান এগিয়ে গিয়ে তালা খুললো। বুশরাও ভেতরে গেল রায়হানের সাথে।
ভেতরে দুটো ঘর। একটায় বিছানা পাতা। আরেকটায় মনেহয় খাওয়াদাওয়ার ব্যাবস্থা। শোবার ঘরের সাথে লাগোয়া গোসলখানাও আছে।
– হাতমুখ ধুয়ে নাও।
– না ঠিক আছে।
– পথে অনেক ধুলা ছিল।
এর পরে আর কোন কথা হয় না। বুশরা হাতমুখ ধুয়ে এসে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছিল সবকিছু। রায়হান এইটুকু সময়ের মধ্যে গোসলও করে নিয়েছে। সাদা পোলো টিশার্ট আর কালো ট্রাউজারে বেশ লাগছে ওরে। তবে মাথা মোছা ভালো হয়নি। চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে।
ওর খুব ইচ্ছা হলো তোয়ালেটা নিয়ে চুলটা মুছে দেয় ভালো করে। তবে নিজের ইচ্ছা নিজের মধ্যেই রাখলো ও।
– চলো আশপাশটা ঘুরিয়ে নিয়ে আসি তোমাকে।
হাটতে হাটতে বুশরা বললো,
– যায়গাটা অনেক অনেক অনেক সুন্দর। কিভাবে সন্ধান পেলেন? আগে এসেছেন? নাকি প্রথমবার?
– এত প্রশ্নের উত্তর একসাথে দিব কিভাবে?
– একটা একটা করে দিন।
– সামনে তাকাও।
এক মুহুর্ত সামনে তাকিয়ে বুশরা আবেগের আতিশয্যে বলে ফেলল,
– মাশাআল্লাহ… কি সুন্দর !
– এই নদীর নাম কি জানো?
– কি?
– ধলতা।
চলবে…