#তুমি_নামক_প্রাপ্তি
#পর্ব:18
#Suraiya_Aayat
বিরাট বড়ো একটা হল ঘরের মাঝে চেয়ারে হাত-পা বাধা অবস্থায় রয়েছে একটা লোক, মাথা দিয়ে টুপ টুপ করে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে , চোখ মুখে একরাশ বিষণ্ণতা আর ক্লান্তির ছাপ , দেখে মনে হচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে পিপাসায় কাতর ৷
লোকটার সামনে আরিশ বসে আছে বেশ শান্ত শিষ্ট ভাবে, এখনো আরিশের মুখে রাগের আভা টুকু ফুটে ওঠেনি , তবে রেগে গিয়ে আগুনের মতো জ্বলে উঠতে হয়তো বেশিক্ষণ সময় লাগবে না ৷ কথায় বলে ঘি আর আগুনকে কখনো কাছাকাছি আসতে দিতে নেই তাহলে নাকি সবটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায় , তেমনি পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মিহিরের মনেও এখন এই আশঙ্কায় জন্মাচ্ছে ৷ দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে আরিসের সাথে কাজ করার পর আর তার সাথে এত সময় কাটানোর পরে মানুষটাকে সম্পূর্ণ বুঝে উঠতে না পারলেও কিছুটা হলেও এখন কিছুটা হলেও আরিশের মতিগতি বুঝে উঠতে পারে ৷ আরিশের কথায় ও অনেক রহস্য থাকে যা মিহির আগে বুঝতো না কিন্ত এখন বেশ ভালোই বোঝে ৷
আরিশকে আরূও কখনো পুরোপুরি ভাবে বুঝে উঠতে পারেনি সেখানে মিহির তো একজন বাইরের লোক ,তবু ও আরিশকে যতদূর যানে ততদূরের ভাবনা থেকেই বলছে আরিশ নিশ্চই লৈকটাকে ছেড়ে দেবে না, আজকে একটা সাংঘাতিক কিছু হবে ৷ শুধু ভয় পাচ্ছে আরিশ লোকটাকে মেরে না ফেললেই হয় কারন এটা বেআইনি ৷
আরিশ চুপচাপ শান্তশিষ্ট হয়ে লোকটার দিকে এক দৃষ্টিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলেছে আর সেই দৃষ্টি লক্ষ্য করে মিহির বলে উঠলো
” স্যার ৷”
মিহিরের কথা আরিশের যেন কানে গেল না ৷ আরিসের ভাবাবেগের কোন পরিবর্তন নেই দেখে আবার বলে উঠল
“স্যার ৷”
আরিশের মাঝে কোন পরিবর্তন নেই তা দেখে মিহির এবার খানিকটা জোরে বলে উঠলো
” স্যার আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন !”
মিহিরের এমন কথা শুনে আরিশ একটা দমফাটা হাসি দিয়ে উঠল ৷ সারা ঘর জুড়ে আরিশের হাসির প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে , কথাগুলো হয়তো এক দেওয়াল থেকে আরেক দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে পুনরায় সারা ঘরে এক তীব্র আর্তনাদ সৃষ্টি করছে ৷
আরিসে সামনে বসে থাকা লোকটা এতক্ষন ঝিম মেরেছিল কিন্ত হঠাৎ আরিশের এমন কণ্ঠস্বর শুনে তার সারা শরীর কেঁপে উঠলো ৷ শুকনো একটা ঢোক গিলে আরিসের দিকে তাকিয়ে বলল
” পানি , একটু পানি খাব, পানি খাব ৷”
আরিশ মিহিরের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলল “মিহির তুমি ওনাকে পানি দাওনি ? এটা কেমন কথা !তুমি কি ভুলে গেছো অতিথি আপ্যায়নে কখনো ভুল ত্রুটি করতে নেই এতে গৃহস্থের অকল্যাণ হয় ৷”
মিহির আরিশের ইশারা বুঝে মুচকি হেসে বলল “আচ্ছা স্যার ৷”
জলের বোতলটা হাতের কাছে থাকার কারনে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই একটা জলের বোতল এনে লোকটার মুখের সামনে ধরতেই তৃষ্ণার্ত মুখটা কিঞ্চিৎ হাসিতে ভরে গেল লোকটির ৷ লোকটার গালে পানি ঢেলে তিনি খানিকটা জল খেতেই বোতলটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিতেই লোকটা পুনরায় কেঁপে উঠলো ৷
আরিশ মুখটা তুলে লোকটার দিকে এবার শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়েই বলল
” আর্শিয়ানকে তুলে কোথায় পাঁচার করতিস ?”
লোকটা আরিশের কথা শুনে চমকে গেল , হঠাৎ করে এমন একটা প্রশ্ন হয়তো আরিশ এর মুখ থেকে আশা করেনি ৷ লোকটা ভেবেছিল হয়তো আর্শিয়ান কে তুলে নিয়ে যেতে দেখেছে বলেই হয়তো সেই অপরাধে ওনাকে এখানে আনা হয়েছে কিন্তু হঠাৎ করে আরিশ যে গোয়েন্দাদের ভঙ্গিতে এতো কথা বলবে তা ভাবেনি আর আরিশের এমন কথা শুনে উনি আর অবাক না হয়ে পারলেন না , কারণ যে মানুষটা প্রথম থেকে সবকিছু জানে ওদের পরিকল্পনা একমাত্র সেই এই সমস্ত বিষয়গুলি কে আন্দাজ করতে পারবে অন্য কেউ নয় ৷
লোকটা ভয়ে একটা শুকনো ঢোক গিলল, তবে এটা তো সত্যিই যে উনারা আর্শিয়ানকে পাচার করার জন্যই পালিয়ে নিয়ে যেতে চাইছিল ৷
লোকটা চুপ করে আছে দেখে আরিস এবার খানিকটা গলার আওয়াজ বাড়িয়ে বলল
” আপনাদের পাচার কেন্দ্রের ঘাঁটি কোথায় ? কোথা থেকে এই সমস্ত কারবার হয় আপনাদের ? আর এর মূর কালপ্রিট কে?”
উনি চুপ আছে দেখে আরিসের চোখ-মুখ ক্রমাগত লাল হয়ে আসছে, উনাকে চুপ থাকতে দেখে আরিশ এবার নিজের সর্বশক্তি দিয়ে একটা চড় মারলেন ওনার গালে, আরিসের চড় খেয়ে লোকটার মাথার ভেতর ভন ভন করতে আরম্ভ করে দিল ৷
আরিশ এবার উঠে গিয়ে উনার জামার কলার ধরে বলল
” তুই আমার কলিজায় হাত দিয়েছিস, তোকে আমি জ্যান্ত রাখবো না ৷”
মিহির যেন এতখন এটার ই ভয় পাচ্ছিল যে আরিশ বেআইনি ভাবে কিছু করে না বসে তাহলে তাতে করে সবটা ঘেটে ঘ হয়ে যাবে ৷
উনার মাথা চক্কর খাচ্ছে আর ওপর একটু বেগতিক করলেই আরিশ হয়তো ওনাকে খুন ই করে ফেলবে সেই ভয়ে উনি গড়গড় করে আরিশকে সব বলে ফেললেন সত্তিটা ৷
সব সত্তি বলার পর আরিশ আরো হিংস্র হলেই মিহির খানিকটা ভয় পেয়ে বললেন
” sir বেআইনি ভাবে কিছু করবেন না, তাতে করে আপনারই ক্ষতি ৷”
মিহিরের কথায় লোকটা ধরেই নিলো যে প্রায় আজকে ওনার শেষ দিন, তাই ভয়ে এবার চিৎকার করে বলল
” sir,আপনার ওয়াইফকে আগামী দশ দিনের মধ্যে চলান করা হবে, আর আরমান সাহেব যদি জানতে পারেন যে আপনি বেঁচে আছেন তাহলে আপনাকে আবার মেরে ফেলার চেষ্টা করবে ৷ আমি যা বলেছি সব সত্তি আপনাকে বলেছি আপনি এবার আমাকে ছেড়ে দিন, আমাকে মারবেন না,আমার বাড়ি আমার বউ আর আমার 10 বছরের ছেলে আছে, আমি ছাড়া ওদের কেউ নেই, আপনি আমাকে মারবেন না, আমি কখনো আর এই খারাপ কাজ করবো না ৷ আমি এ শহর ছেড়ে চলে যাবো আমার বউ বাচ্চা নিয়ে দয়া করে কিছু করবেন না ৷”
লোকটার মুখ থেকে এমন কথা শোনার পরপরই আরিশ লোকটার মুখ বরাবর আরেকবার পাঞ্চ করতেই ওনার ঠোঁট কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়লো ৷ আরিসে চোখে আগুনের ধারা বইছে, এতদিন নিজের স্ত্রী সন্তানের থেকে দূরে থাকার বেদনাটা যেনো আজ আরও সক্রিয় হয়ে উঠছে, দাও দাও করে জ্বলে উঠছে পুরনো সব ক্ষত ৷
লোকটা যে চেয়ারে বসে আছে সেই চেয়ারের হাতল ধরে উনার চোখে চোখ রেখে বলল
“আপনজনদের হারানোর কষ্ট টা বোঝেন আপনারা ?আপনাদের মত মানুষের জন্য আজ দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে আমি আমার স্ত্রী সন্তানদের থেকে দূরে দূরে আছি ,এক বছর ধরে বিছানায় শয্যাশায়ী ছিলাম , বিধ্বস্ত অবস্থা হয়েছিল আমার, পাশে আপনজনদের কাউকে পায়নি , বারবার মনে হতো এই বুঝি ছুটে যায় তাদের কাছে কিন্তু যেতে পারেনি শুধুমাত্র তাদেরকে আমি রক্ষা করতে পারব না এবং অন্যথায় তাদেরকে বিপদে পড়তে হবে তাই ৷ নিজের স্ত্রীর সন্তান প্রসবের বেদনা তার সাথে তার কষ্টটাকে ভাগ করে নিতে পারিনি ,তার গালে আলতো করে হাত দিয়ে তার কষ্ট থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য ব্যর্থ সান্তনা টাও তোকে দিতে পারিনি ,বলতে পারিনি
” আরুপাখি আর কিছুক্ষণ কষ্ট করো তারপর দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে ৷ ”
ছোট্ট আর্শিয়ানের মুখ থেকে বাবা শব্দটা শুনতে পারিনি, স্ত্রীকে ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখতে পারিনি কতকাল, তাকে আলতো করে হাত দিয়ে ছুতে পারিনি, মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমানো হয়নি কতরাত, তাইলে এখন কি সেই সময়গুলোকে আপনি ফিরিয়ে দিতে পারবেন আমার কাছে ? পারবেন না ! মানুষ নিজের জীবনকে উপলব্ধি করতে পারলে তখন যখন সে সবটা থেকে বঞ্চিত থাকে ৷ আমার জীবনের পাঁচ পাঁচটা বছরকে হারিয়ে না ফেললে বুঝতামই না যে জীবনে আপনজনের গুরুত্ব ঠিক কতটা ৷ আজ নিজের স্ত্রী ছেলেরা এত কাছে থেকেও তাদেরকে বাহুডোরে আবদ্ধ করতে পারিনা বলতে পারিনা যে ভালোবাসি, তোমরা ছাড়া আমি অপূর্ণ ৷”
কথাগুলো বলছে আরিস আর ওর চোখে জলগুলো ঘনীভূত হয়ে আসছে ৷ তার সামনে থাকা অপরাধী দৃষ্টিতে মাথা নত করে থাকা মানুষটার চোখেও এক ফোটা জল গড়িয়ে পরলো তা মিহিরের চোখ এড়ালো না ৷ সত্যি ভালোবাসা নামক জিনিসটা এমনই , কেউ পায় আবার কেউ পায় না ৷ যেমন মিহির চেয়েও তার ভালোবাসার মানুষটিকে নিজের কাজে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারেনি ৷ কথাগুলো ভাবতেই মীহির একটু আবেগী হয়ে পড়লো , আর চোখের কোনে জমে থাকা জলটা ঝটপট করে হাত দিয়ে মুছে নিল , পুরুষ মানুষের যে কাঁদতে মানা ৷
আরিশ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
” আপনি যা করেছেন ঠিক করেননি , আপনাকে ছেড়ে দিলে বাকি অপরাধীদের প্রতি অবিচার করা হয় আর সেই অবিচার কখনো আরিশ খান করেনি আর আজও করবে না ৷”
কথাটা বলে আরিশ বেরিয়ে গেল ৷
#চলবে,,,,