#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৫৭
” বস আজকে গায়ে হলুদ। ”
ফোনের অপর প্রান্ত হতে ভ’য়ানক হাস্য ধ্বনি ভেসে এলো। শ্রবণ ইন্দ্রিয়ে পৌঁছালো হু’মকির বার্তা,
” অপেক্ষা শুধু আগামীকালের। রাতের আঁধারে ওদের জীবনেও কালো অন্ধকার নেমে আসবে। এ আমার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি। হা হা হা। ”
বড় ভ’য়ানক শোনালো সে হাস্য কলরব। কর্ণে যেন তব্দ লেগে গেল। এ প্রান্তে থাকা মানবের অধরকোণে ফুটে উঠলো কুটিল রেখা। কি হতে চলেছে আগামী দিন? বড়ই ভ য়াবহ কিছু? এ কোন বি*ভৎস পরিকল্পনা রচিত হচ্ছে? কার জীবন ধ্বং-স করার চলছে ষ ড়যন্ত্র!
.
বরাদ্দকৃত কক্ষে ফুফুর পাশে বসে দুয়া। সাজেদা অনুতপ্ত চাহনিতে তাকিয়ে ভাতিজির মায়াবী মুখপানে। আলতো করে দুয়া’র হাতে হাত রাখলেন উনি। দুয়া মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। টুপ করে ফুফুর গালে চুমু এঁকে বললো,
” ফুপি! তুমি শুধু শুধু মন খারাপ করছো। আজ না তোমার দুয়া মায়ের গায়ে হলুদ? আজকের দিনে এভাবে মন খারাপ করলে চলবে? ”
” আমি খুব খারাপ ফুফু তাই না রে? ফুফু হয়ে ভাতিজির জীবনে সর্বনা শ ডেকে আনতে চেয়েছিলাম। তার বদনাম করে…”
দুয়া ফুফুর কাঁধে মাথা এলিয়ে দিলো। মিহি স্বরে বলতে লাগলো,
” আগের কথা মনে করে দুঃখ পেয়ো না ফুপি। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। ওসব মনে করে শুধু শুধু কষ্ট পেয়ো না। শরীর খারাপ করবে। তুমি শুধু এটা জেনে রাখো যে তোমার দুয়া কৃতজ্ঞ তোমার কাছে। ”
চমকালেন সাজেদা! বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে উঠলেন,
” কৃতজ্ঞ! কেন মা? ”
” তোমার জন্য যে তারে দ্রুত আমার জীবনে পেয়েছি। ”
অনুশোচনার মাঝে এক চিলতে তৃপ্তি ধরা দিলো। দুয়া আঁখি পল্লব বন্ধ করে প্রসন্ন হৃদয়ে স্বীকার করলো,
” আমি কৃতজ্ঞ মহান রবের কাছে। তোমার কাছে। তাকে আমার অর্ধাঙ্গ রূপে উপহার দেয়ার জন্য। জাযাকিল্লাহু খইরন ফুপি! ”
সাজেদার বক্ষদেশ হতে অনুশোচনার ভারী পাথর নেমে এলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন উনি। আদুরে ভঙ্গিতে আগলে নিলেন ভাতিজিকে। মাথায় হাত বুলিয়ে প্রাণ ভরে দোয়া করে দিলেন।
.
তমস্র রজনী। রিসোর্ট প্রাঙ্গন আজ হলদে রঙে সুসজ্জিত। সকলের আকর্ষণের মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো একটি কারুকার্য খচিত আকর্ষণীয় দোলনা। বৃহৎ আকৃতির দোলনাটি গাঁদা ফুলের সমারোহে সজ্জিত। অগণিত গাঁদা ফুলের উপস্থিতি যেন দোলনার ব্যাকড্রপ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিছু ঝুলন্ত ফুলের বল দোলনার আকর্ষণ আরো বৃদ্ধি করে দিয়েছে। কমলা রঙে আবৃত দু’টো কুশন স্থান পেয়েছে দোলনায় বসার স্থানে। সকলের মধ্যমণি হয়ে বসে হবু কনে দুয়া। পড়নে তার জর্জেট মাস্টার্ড ইয়েলো রঙা ফ্রন্ট স্লিট আনারকলি স্যুট। দোপাট্টাটি শালীনতার সহিত আবৃত করে রেখেছে গাত্রের উর্ধ্বভাগ। মসৃণ কেশ দু পাশে বিভক্ত করে ছেড়ে রাখা। সিঁথির মধ্যখানে শোভা পাচ্ছে কৃত্রিম পুষ্পে তৈরি টিকলি। দু কানে বড় বড় পুষ্প কানের দুল। দু হাতের কবজিতে পুষ্পের মালা বাঁধা ব্রেসলেট রূপে। মুখশ্রীতে মানানসই কৃত্রিম প্রসাধনীর ছোঁয়া। দেখতে বেশ মোহনীয় লাগছে! হলদে অনুষ্ঠানে শুধুমাত্র নারীদের যাতায়াত। নিষিদ্ধ পুরুষ জাতি। এ নিয়ে তরুণরা কম আপত্তি করেনি। তবে লাভ হয়নি। হলদে আচ্ছাদিত কনেকে দেখা তাদের জন্য নিষিদ্ধ। তূর্ণ মশাই এসবের ভিড়ে ভাবলেশহীন। রয়েছে নিজস্ব চিন্তায়।
দোলনায় বসে দুয়া। ওর কপোলের মসৃণ ত্বকে হলুদ ছুঁয়ে দিলেন তাহমিদা। ওনার চোখে অশ্রু ঠোঁটে খুশির ছাপ। মেয়ের ললাটে স্নেহের চুম্বন এঁকে দিলেন উনি। মায়ের অবস্থা অনুধাবন করে মেয়েটিও স্বল্প আবেগী হয়ে পড়লো। তা অনুধাবন করে এগিয়ে এলেন তাসলিমা। বোনকে তাড়া দিয়ে বললেন,
” কি রে তোর হলো? সর। আমাদেরকেও একটু সুযোগ দে। ”
তর্জনী ছুঁয়ে নেত্রকোণে জমায়িত অশ্রু মুছে নিলেন তাহমিদা। হাসিমুখে সরে গেলেন। এবার জায়গা পেয়ে এগিয়ে এলেন তাসলিমা। দুয়াকে হলদে রঙে আবৃত করে কেশের মাঝে চুমু দিলেন। দোয়া করলেন মন থেকে। অতঃপর মৌমাছির ন্যায় হা’মলা করলো তরুণীর দল। বন্ধুরা, বোনেরা হৈ হুল্লোড় করে মেয়েটির আপাদমস্তক হলদে বানিয়ে ফেললো। হাসতে হাসতে অবস্থা কাহিল মেয়েটির। কেউ কেউ খুব করে সুড়সুড়ি দিয়ে জর্জরিত করে ফেলছে। নিষেধাজ্ঞা মোটেও শুনছে না। সকলেই আনন্দে আটখানা। ঠিক সে মুহূর্তে ঘটলো সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত কাণ্ড। ছুটে এলো মিহাদ, বিশাল, জাহিন। হবু কনেকে হলুদে হলুদে মাখোমাখো করে তবেই ক্ষ্যা ন্ত হলো। দুয়া’র মামী সাথি চোখ রাঙানি দিলেও কাজ হলো না। ওরা নিজেদের কাজ সমাপ্ত করে দাঁত কেলিয়ে হাসতে হাসতে প্রস্থান করলো। সাথি গরম চোখে তাকিয়ে রইলেন অপদার্থ পুত্র মিহাদের পানে।
.
ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে দশের ঘরে। খট করে শব্দ হলো। ওয়াশরুমের দ্বার উন্মুক্ত করে বেরিয়ে এলো দুয়া। পড়নে এখনো ফ্রন্ট স্লিট আনারকলি। দোপাট্টাটি পড়ে রয়েছে বিছানার এক অংশে। চোখেমুখে, গলদেশে, হাতে পায়ে এখনো হলদে আভা দৃশ্যমান। হলদে রঙ পুরোপুরি ম্লান হচ্ছে না। গোসল করা আবশ্যক। নাহলে রাতে ঘুম হবে না। গা চিটচিট করবে। দুয়া বিড়বিড় করতে করতে সমতল আরশির সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালো। ক্ল্যাচার দিয়ে আবদ্ধ করলো কেশের পেছনাংশ। বেশ গরম লাগছে। অস্বস্তি অনুভূত হচ্ছে। মেয়েটি কাবার্ড হতে পোশাক বের করছিল। ঠিক সে মুহূর্তে শব্দ হলো। শব্দ উৎস অনুসরণ করে কক্ষের দ্বারে তাকালো দুয়া। হলো হতবিহ্বল! তূর্ণ দাঁড়িয়ে।
” তুমি! ”
পড়নে মানুষটির রেশম এমব্রয়ডারির সঙ্গে সিল্ক এবং সিল্কের মিশ্রণে একটি পার্ল হোয়াইট বুন্দি জ্যাকেট। সাথে ম্যাচিং কুর্তা এবং প্যান্ট। আজ দুয়া’র গায়ে হলুদ ছিল। তেমনিভাবে ছেলেরাও আলাদাভাবে পার্টি করেছে। ব্যাচেলর পার্টি বলা চলে। যদিওবা তাতে অনৈতিক কোনোকিছু সম্পাদিত হয়নি। শুধুমাত্র বয়েজ গ্যাং হৈ হুল্লোড় করে নিজেদের মতো করে সময় কাটিয়েছে। তূর্ণ’র কাছ থেকে জবাব না পেয়ে দুয়া নিজ কর্মে লিপ্ত হয়ে বলতে লাগলো,
” তোমাদের পার্টি এত তাড়াতাড়ি শেষ? আমি তো ভাবলাম মধ্যরাত অবধি চলবে। ”
” পার্টি শেষ হয়নি। চলছে। ”
ওর পানে তাকালো দুয়া। প্রশ্ন করলো,
” তাহলে তুমি এখানে কেন? যাও। এনজয় দ্যা পার্টি। তবে ভুলেও নে*শাটেশা করবে না যেন। ”
তূর্ণ ওর পানে এগোতে এগোতে নে’শালো কণ্ঠে বললো,
” ওসব ঠুনকো নে;শাদ্রব্যে আদ্রিয়ান তূর্ণ’র নে’শা হবে না। সে যে ভিন্ন মা,দকতায় আসক্ত। ”
কণ্ঠে কেমন ভিন্নতা। সম্মোহিত করছে বুঝি। শিহরণে আবিষ্ট হয়ে পিছু ঘুরে তাকালো মেয়েটি। তাতেই ফেঁসে গেল। ডুবে গেল অর্ধাঙ্গের নয়ন সাগরে। মুখোমুখি অতি সন্নিকটে দাঁড়িয়ে তূর্ণ। তপ্ত শ্বাস আঁকিবুঁকি করে চলেছে মায়াময়ীর মুখশ্রীতে। দু’জনে কতটা সময় একে অপরেতে মগ্ন রইলো বেহিসেবি তা। তূর্ণ ধীরগতিতে হাত বাড়িয়ে দিলো। নিজ হাতে নিলো দুয়া’র হাতে থাকা পোশাক। নয়নে নয়ন মিলিত রেখেই পোশাকআশাক ছুঁড়ে ফেললো বিছানায়। তাতে ঘোর হতে বেরিয়ে এলো মেয়েটি। অস্ফুট স্বরে বলতে সক্ষম হলো,
” তুমি কি.. ”
আর বলা হলো না। ওষ্ঠে তর্জনী ছুঁয়ে থামিয়ে দিলো মানুষটি। চেনা স্পর্শে পূর্বের ন্যায় শিউরে উঠলো কোমল কায়া। তূর্ণ আস্তে করে তর্জনী সরিয়ে নিলো। ডান হাতটি গলিয়ে দিলো কুর্তার পকেটে। সেথা হতে বেরিয়ে এলো ছোট প্যাকেট। যাতে রয়েছে হলুদের মিশ্রণ। তূর্ণ আলতো করে দুয়া’র হাতটি নিজ হাতের তেলোয় নিলো। কোমল হাতের তেলোয় হলুদ রাখার ফাঁকে ঘোর লাগানো স্বরে বললো,
” শুধু তুমি একাই হলদে রাঙা হবে মাইরা? আমায় হলুদ ছোঁয়াবে না? ”
কণ্ঠে কি প্রকাশ পেল? অনুনয় নাকি অসীম ভালোবাসা! জানা নেই মেয়েটির। সে মুহুর্তের মধ্যেই পুরোদস্তুর সম্মোহিত হলো। একটিবার তাকালো হাতের তেলোয় ঠাঁই প্রাপ্ত হলুদে। অতঃপর তাকালো স্বামীর নয়নে। নয়নে নয়নে হলো অব্যক্ত আলাপণ। নিঃশব্দ অনুমতি লাভ করলো মেয়েটি। জড়তা, লাজ পার্শ্বে রেখে আরো সন্নিকটে এলো। অতীব ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে দু’জনে। একে অপরের তপ্ত শ্বাস বেশ অনুভব করতে পারছে। দুয়া মন্থর গতিতে হাতটি উঁচুতে নিলো। হলুদে মাখা ডান হাতের তালু স্পর্শ করলো স্বামীর খরশান বাঁ কপোল। শিরশিরানি অনুভূত হলো সারা কায়ায়। তূর্ণ কি একটু হলেও কম্পিত হলো? বাঁ কপোলে হলুদ রাঙিয়ে হাতের তালু ছুঁলো ডান কপোল। সেথায় অবশিষ্ট হলুদ মেখে দিলো। অর্ধাঙ্গের দু কপোল এখন হলদে রঙে আচ্ছাদিত। ক্ষীণ দুষ্টু হাসির রেখা ফুটিয়ে স্বামীর নাকের ডগায় একটুখানি হলুদ ছুঁয়ে দিলো দুয়া। হাসলো নিঃশব্দে। সে হাসিটুকু হৃদয়ের অন্তঃস্থল হতে উপভোগ করলো তূর্ণ। ধন্য হলো আঁখি যুগল। তৃপ্ত হলো অন্তঃপুর। সহসা চমকে উঠলো মেয়েটি। তার হলুদ মাখা হাতটি নিজ হাতে আবদ্ধ করে ফেলেছে সম্মুখে থাকা মানব। হাতের তেলোয় আরো হলুদের ঠাঁই হলো। অতঃপর সে হলদে মাখা হাতটি চাপা পড়লো স্বামীর হাতের নিচে। অবাধে বিচরণ করতে লাগলো অর্ধাঙ্গের গলদেশে। যত্রতত্র। এমনটি প্রত্যাশা করেনি দুয়া। শিহরিত হতে লাগলো তার তনুমন। নিজ হাতটি ছাড়ানোর ব্যর্থ প্রয়াস চালালো। তবে সফলতা এলো না। বরং ঘটে গেল অনাকাঙ্ক্ষিত কাণ্ড। ডান কপোলে স্পর্শ করলো মানুষটির হলদে রাঙা কপোল। কিয়ৎক্ষণ পূর্বে সাফ করা কপোলের ত্বক পুনরায় হলদে রাঙা হলো। আবেশে মুদিত হয়ে এলো নেত্রপল্লব। দু কপোলেই হলুদের সঙ্গে একান্ত জনের স্পর্শ অনুভব করতে পারলো দুয়া। অতঃপর! তার কম্পিত ওষ্ঠাধর চলে গেল একান্ত মানবের আধিপত্যে। মোহাচ্ছন্ন মানব অধিকার এবং পবিত্র সম্পর্কের সূত্রে কোমল ওষ্ঠাধরে সর্বোচ্চ আধিপত্য বিস্তার করে গেল। একান্ত ক্ষণ বাদে কপালে ঠেকে গেল কপাল। ঘন শ্বাস পড়ছে দু’জনের। নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ মেয়েটি ঠাঁই নিলো স্বামীর বক্ষপটে। তৃপ্ত মানব নীরবে আগলে নিলো তার হালাল প্রিয়তমাকে। অতিবাহিত হলো পবিত্র-প্রেমময় লগ্ন!
•
ভোরের আলো আঁধার চিঁড়ে ধরনীর বুকে ছেয়ে যাচ্ছে। পূব দিগন্তে উদিত হতে প্রস্তুত দিবাকর। রিসোর্টের লনে এসে দাঁড়ালো দুয়া। দেহে মেখে নিতে লাগলো ভোরের হিমেল হাওয়া। আর মাত্র নির্দিষ্ট কিছু ঘন্টা। অতঃপর দ্বিতীয়বারের মতো ধর্মীয় এবং সামাজিক ভাবে পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হবে দু’জনে। বিগত রাতটি ছিল উত্তেজনাময় এক রাত। রাতভর ঘুমোতে পারেনি সে। বারংবার স্মরণে এসেছে আজকের সে-ই কাঙ্খিত মুহুর্ত। কেমন হবে সে লগ্ন, কেমন অবতারে তারা দু’জন সজ্জিত হবে, কেমন করে বাঁধা পড়বে পবিত্র বন্ধনে। আরো কত কি। সীমাহীন ভাবনায় রাতটি পেরিয়ে গেল। টেরও পেলো না কখন রাত পেরিয়ে ভোর হলো। অতঃপর হুঁশ ফিরতে আর দেরি করলো না। ওড়না জড়িয়ে বেরিয়ে এলো ভোরের পরিবেশ উপভোগ করতে। ভাবনায় মশগুল দুয়া’র ভাবনায় ছেদ পড়লো। হঠাৎ দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো স্বল্প দূরত্বে। এক নারী অবয়ব দৃশ্যমান। কে সে? তৃষা না? ও নিদ্রা ভঙ্গ করে উঠলো কখন? ধীরপায়ে এগিয়ে গেল দুয়া। দাঁড়ালো তৃষা’র ডান পাশে। কাঁধে হাত রাখতেই হকচকিয়ে গেল তৃষা। অশ্রুসজল নয়নে ভাবির পানে তাকালো। আবারো অশ্রুবিন্দু দেখে আশাহত হলো দুয়া। কতবার জিজ্ঞেস করেও উত্তর মিললো না। কি করে মিটাবে এ সমস্যা? ভাবনায় ছেদ পড়লো সহসা। ওকে শক্ত আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে কাঁদছে তৃষা। কাঁদতে কাঁদতে বলে চলেছে,
” আ আমি আর সহ্য করতে পারছি না ভাবি। আমি তো এটাই চেয়েছিলাম। তা তাহলে কেন এত কষ্ট হচ্ছে? কেন বুকের ভেতরটা ফালাফালা হয়ে যাচ্ছে? কেন? বিশ্বাস কর আমার খুউব যন্ত্রণা হচ্ছে। সইতে পারছি না। অ্যাই ভাবি। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রে। খুউব কষ্ট। ”
ক্রন্দনের অবিরাম ধ্বনি কর্ণ কুহরে পৌঁছাতেই দিশেহারা হয়ে পড়লো দুয়া। আদুরে হাতে ননদকে সামলানোর চেষ্টা করে গেল। আজ এসবের অন্ত টানবেই সে। জেনে নেবে সকল প্রশ্নের উত্তর।
°
রিসোর্টের এক জনশূন্য স্থানে ঘাসের আচ্ছাদনে মুখোমুখি বসে দু’জনে। প্রভাতের প্রথম কিরণ ছুঁয়ে যাচ্ছে গাত্র। দুয়া প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
” নিশাদ ভাইয়া ওয়েল এস্টাবলিসড্। দেখতে হ্যান্ডসাম। কোনো বাজে রেকর্ড নেই। তাহলে? রিজেক্ট করছিস কেন? ”
অবনত মেয়েটির মস্তক। মিহি স্বরে বলতে লাগলো,
” কারণ সে ভাইয়ার ব বন্ধু। আমার স্বপ্ন পুরুষ নয়। উনি আমার স্বপ্নে দেখা প্রেমিকের মতো নন। উনি শাসন করতে অভ্যস্ত। পা গলাটে, কেয়ারিং পুরুষ নন। ”
” শুধু পা গলামি করলেই তোর স্বপ্ন পুরুষ হওয়া যাবে? নাকি লোক দেখানো কেয়ার শো অফ করতে হবে? ”
নীরবতা ভেদ করে তৃষা নিজের মতো করে বলতে লাগলো,
” উনি ভাইয়ার বন্ধু। আ আমাদের সম্পর্ক কেউ মেনে নেবে না। বিনা দোষে দুই বন্ধুর সম্পর্ক নষ্ট হবে। আম্মু আব্বু আমায় এত বিশ্বাস করে। তাদের এই গাঢ় বিশ্বাস ভঙ্গ হবে। এটা আমি পারবো না ভাবি। বিশ্বাস কর। আর? আর আমি বিয়ের পর ভালোবাসায় বিশ্বাসী। কোনো টাইম পাস সম্পর্কে জড়াতে ইচ্ছুক নই। তুই জানিস এটা। তাহলে কি করে ওনাকে মিথ্যা স্বপ্ন দেখাই বল? বিগত কয়েক মাস ধরে ওনাকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলছি। ভেবেছি এতে কাজ হবে। ওনার অ্যাট্রাকশন ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। ভুলে যাবেন আমাকে। আমিও ওনার শোষণ থেকে রেহাই পাবো। কিন্তু.. ”
” কিন্তু তা হয়নি। উল্টো তাকে অবজ্ঞা করতে গিয়ে নিজেই মন হারিয়ে বসলি? ”
তৃষার নেত্রকোল অশ্রুতে ভরপুর হলো।
” এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। আমি তো ওনাকে চাইনি। এড়িয়ে গিয়েছি। অবজ্ঞা করেছি। অপেক্ষা করে গেছি স্বপ্ন পুরুষের জন্য। জানিস ভাবি? ও-ওনাকে বাধ্য হয়ে অপমান অবধি করেছি। এরপর উনি আমার পিছু ছেড়েছেন। তবে ভ ভালোবাসতে ভোলেননি। ”
” কি করে ভুলবে? দু বছরের ভালোবাসা ভোলা কি এতটাই সহজ? ”
আকস্মিক পুরুষালি কণ্ঠে স্তব্ধ হলো দু’জনে। ডানে তাকিয়ে লক্ষ্য করলো তূর্ণ দাঁড়িয়ে। তৃষা অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,
” ভা-ইয়া! ”
তূর্ণ এগিয়ে এলো। বসলো বোনের পাশে। দুয়া বিস্মিত কণ্ঠে শুধালো,
” নিশাদ ভাইয়া দুই বছর ধরে ভালোবাসেন? তুমি জানো এসব? ”
তূর্ণ বোনকে বাহুডোরে আগলে নিলো। তাকালো অর্ধাঙ্গীর পানে।
” আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হয়। জানবো না? হয়তো শুরু শুরু টের পাইনি। তবে বিগত একবছর ধরে আমি সবটা জানি। নিশাদ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। ”
ভাইয়ের বুকে মুখ লুকানো ললনা কেঁদে উঠলো ফুঁপিয়ে। তূর্ণ বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
” তোকে দু বছর ধরে ভালোবাসে ছেলেটা। খুব ভালোবাসে। আমার বন্ধু বলে বলছি না। ও সত্যিই হিরে। আমার বোনটাকে ইনশাআল্লাহ্ খুব সুখে রাখবে। কোনো কষ্ট পেতে দেবে না। ”
দুয়া নিশ্চিত হতে প্রশ্ন করলো,
” তোমার এই সম্পর্কে আপত্তি নেই? ”
” তোমার কি মনে হয়? আছে? ”
” নাহ্। কিন্তু মামণি বাবা? ”
” আশা করি তারাও আপত্তি করবে না। ”
দুয়া তাকালো ক্রন্দনরত তৃষা’র পানে। শুধালো,
” কিন্তু এই বোকা পা’গলী? এ কি করবে? ”
চলবে.