তুমিময় আসক্তি পর্ব-২৯+৩০

0
1109

#তুমিময়_আসক্তি
#কলমে_আলো_ইসলাম

“২৯”

–“” দোলা আর সজল বসে আছে পার্কে। দোলা একাই গিয়েছে। তানিয়া দোলার সাথে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু মাঝখান থেকে জেসমিন চৌধুরী এসে তাকে বাঁধা দেয়। তানিয়াকে নিয়ে নাকি বাইরে যাবে সে। কোনো একটা দরকারী কাজ আছে। তানিয়াও না বলতে পারিনি। কারণ এসে পর্যন্ত তার মাকে তেমন সময়ই দেয়নি সে। তানিয়া তার মাকেও যথেষ্ট ভালোবাসে।
-” জেসমিন চৌধুরীর আজই কি এমন কাজ পড়লো যার জন্য তানিয়াকে জোর করে রাখতে হলো বুঝতে পারে না দোলা। তানিয়া বলেছিলো সে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে কলেজ থেকে তারপর না হয় যাবে৷ কিন্তু জেসমিন চৌধুরী কোনো কথা শুনেনি। তাই তানিয়া বাধ্য হয়ে থেকে যায়।

–“‘ পার্কের একটা বেঞ্চে বসে আছে দুজন। সজল অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে দোলার গুরুত্বপূর্ণ কথা শোনার জন্য। যতখন দোলার থেকে সব না শুনছে ততখন সে যেনো শান্তি পাচ্ছে না ভেতরে। দোলা বলার পর থেকে তার মধ্যে একটা অজানা টেনশন কাজ করছে। দোলা চুপ করে বসে আছে অন্য দিকে তাকিয়ে। আসলে দোলা সজলকে ঠিক কিভাবে বলবে কথা গুলো সেটা বুঝতে পারছে না।

–‘ দোলা প্লিজ এবার বলুন কি বলতে চান৷ যথেষ্ট টেনশন দিয়েছেন গতকাল থেকে। আর টেনশনে রাখবেন না প্লিজ করুণ স্বরে বলে সজল। সজলের কথায় দোলা মৃদু হেসে বলে, বলব বলে তো আসতে বলেছি আপনাকে। আসলে কিভাবে শুরু করবো এটাই বুঝতে পারছি না৷ আপনিও বা কেমন ভাবে নেবেন কথাগুলো সেটাও বুঝতে পারছি না।
— এত না ভেবে বলে দিন। সজলের কথায় দোলা একটু নড়েচড়ে বসে।

— আসলে আপনার মনিমা’কে নিয়ে কথা ছিলো৷ উনার সম্পর্কে জানার জন্য আপনাকে আসতে বলেছি। আমার অনেক কিছু জানার আছে উনার ব্যাপারে! অনেক’টা সংকোচ নিয়ে বলে দোলা কথাগুলো।
-” সজল গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে দোলার দিকে। আসলে দোলা ঠিক কি বলতে চাইছে সজল বুঝিনি।
— আমি না আপনার কথা ঠিক বুঝলাম না কৌতুহল নিয়ে বলে।
–“” আপনি মনিমা’কে কোথায় পেয়েছেন? আর কবে থেকে উনি আপনাদের সাথে আছে? সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করে দোলা এবার৷ কোনো রকম ভণিতা ছাড়াই।
–‘ কেনো বলুন তো? উল্টো সজল প্রশ্ন করলে দোলা দৃঢ়তার সাথে বলে দয়া করে এখন কোনো প্রশ্ন করবেন। আমার প্রশ্নের জবাব দিন। আমি সব বলব আপনাকে। আপনাকে সবটা বলব বলে না আমাদের দেখা করা।

–‘ সজল দোলার চোখ মুখ বিচরণ করে বেশ কয়েকবার। দোলার মধ্যে সিরিয়াস ভাবটা অনেক বেশি দেখাচ্ছে আজ। সজল দোলার কথা মতো আর কোনো প্রশ্ন করতে যায় না।
-‘ আসলে উনি অনেকদিন আগে থেকে আছেন আমাদের সাথে। বাবা মনিমাকে নিয়ে এসেছিলো আমাদের বাড়িতে। আমি তখন ছোট ছিলাম। কিন্তু মনিমা অসুস্থ ছিলো। এক্সিডেন্ট করে রাস্তার পাশে পড়ে ছিলেন। বাবা তাকে দেখতে পেয়ে হসপিটাল নিয়ে যায়। এরপর ট্রিটমেন্ট করানো হয়। কিন্তু এক্সিডেন্টে মনিমার পা’টা বাজে ভাবে নষ্ট হয়ে যায়। যার ফলে মনিমা হাঁটাচলা করতে পারে না। আমার মা ছোটবেলায় মারা যায়। এরপর বাবা আর বিয়ে করেনি আমার কথা ভেবে। মায়ের আদর ভালোবাসা কেমন হয় আমার জানা ছিলো না। প্রথম যেদিন মনিমাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসে আমি অনেক খুশি হয়েছিলাম। কারণ বাবা আর আমি ছাড়া কেউ ছিলো না বাড়িতে। সার্ভেন্ট সব কাজ করতো ঠিকই কিন্তু মায়ের অভাববোধটা আমার রয়ে যেতো। এরপর মনিমা আসলে সে আমাকে নিজের সন্তানের মতো আগলে নেয়। আমিও মনিমাকে পেয়ে নিজের মায়ের স্থান দিই।

–“” আচ্ছা কখনো উনার পরিবার, বাড়ি, আত্মীয় স্বজন এইসব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেননি? কৌতুহলী পূর্ণ চোখে তাকিয়ে বলে দোলা। দোলার কথায় সজল সাবলীল ভাবে তাকিয়ে বলে হুম করেছিলাম। কিন্তু মনিমা কিছু বলেনি৷ সব সময় এড়িয়ে গেছে। আর একটা কথা বলত তার নাকি কিছু মনে নেই। আমরা যেনো তার পরিবার সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস না করি। তাহলে মনিমা বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। তাই আমি বা বাবা কেউ আর মনিমাকে এই সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করতাম না। তাছাড়া মনিমার পরিচয় যায় হোক না কেনো। সে আমার খুব ভালো বন্ধু, আমার মা, আমার সব কিছু। জীবনে মায়ের আদর, ভালোবাসা কেমন হয়, মায়ের অনুভূতি সব কিছু মনিমা পূরণ করে দিয়েছে। এর জন্য আমি কৃতঙ্গ মনিমার কাছে।

–” দোলা আবেগী হয়ে সজলের কথা শুনছে৷ যে মানুষটা অন্য একজনকে এত আপন করে নিতে পারে৷ অন্যের সংসারকে নিজের করে নিতে পারে! সে নিজের সংসার ছেড়ে চলে যাবে এটা কি করে হয়? দোল বুঝতে পারছে না রত্না চৌধুরী কেনো গেলো? আর তার এক্সিডেন্ট বা কি করে হলো। কি হয়েছিলো সেদিন?

–‘ আচ্ছা আপনি আমাকে এত কিছু জিজ্ঞেস করছেন কেনো? মনিমাকে নি আপনি চেনেন। সজলের কথায় দোলা চমকে তাকায় ভাবনা ছেদ করে।
–‘ আমি আপনাকে সব কিছু বলেছি। আশা করছি আপনি আমার থেকে কিছু লুকাবেন না! অনেকটা আশাবাদী হয়ে বলে সজল।
– দোলা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, আসলে আমার হাজবেন্ডের মা উনি। আমার শাশুড়ীমা রত্না চৌধুরী। দোলার কথায় সজল যে অনেকটা অবাক হয়েছে সেটা তার চোখ মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে। প্রথম আপনার বাড়িতে মাকে দেখে অবাক হয়েছিলাম আমি এবং তানিয়া। যদিও আমি তাকে দেখছিলাম না আগে কিন্তু তানিয়া চিনতে পারে। আমি বাড়ি গিয়ে বাবা মানে আমার শ্বশুরমশাইয়ের ঘরে উনার ছবি দেখি। এরপর দোলা রত্না চৌধুরীর ছবি বের করে দেখায় সজলকে। সজল রত্না চৌধুরীর ছবি দেখে অবাক হয়ে দোলার দিকে তাকায়। দোলা মলিন চেহারায় সজলের দিকে তাকিয়ে আছে।

–“” কিন্তু মনিমা এক্সিডেন্ট করে রাস্তায় কিভাবে! কিছু বুঝছি না? আর উনার বাড়ির মানুষ উনার খোঁজ করেননি কেনো তাহলে এতদিন। সজলের কথায় তানিয়া মাথা নিচু করে ফেলে। অপরাধবোধে যেনো ভুগছে সে নিজেই।

— দোলা প্লিজ চুপ থাকবেন না। সবটা যখন সামনে এসেছে, তাই আর লুকাবেন না কোনো কিছু। ক্লিয়ার করে বলুন। আমি চাই মনিমা তার পরিবারে ফিরে যাক। আমি দেখেছি মনিমাকে সবার আড়ালে চোখের পানি ফেলতে। রাতের আধাঁরে প্রিয় মানুষের জন্য আহাজারি করতে। মনিমা তার পরিবারে পরিজনকে অনেক ভালোবাসে তাদের কাছে চাই! সেগুলো তার চোখের পানি প্রমাণ করে। মনিমা ভালো নেই ভেতর ভেতর অনেক কষ্ট পায় এটাও আমি জানি৷ তাই সবটা আমাকে বলুন প্লিজ অনুরোধ করে বলে সজল।

–” দোলার চোখ ছলছল করছে। কি করে বলবে সে মিথ্যা কথা গুলো। যে কথা গুলোর ভিত্তিতে তার প্রিয় মানুষ গুলো তাকে এতদিন ঘৃণা করে এসেছে। খারাপ চোখে দেখে এসেছে। ছেলে হয়ে মায়ের জন্য প্রতি মুহূর্তে অভিশাপ দিয়ে গেছে। অভিযোগ,অভিমানের দেয়াল গড়ে রেখেছে।
— সজল এখনো অনেক আশাবাদী হয়ে তাকিয়ে আছে দোলার দিকে। দোলা এরপর সজলকে সবটা খুলে বলে। সব শোনার পর সজলের ভীষণ রাগ হয় রুদ্র আর তার পরিবারের উপর। কোনো কিছু যাচাই-বাছাই না করে এতবড় অপবাদ দিতে পারেন কি করে তাড়া? একটা চিঠির উপর ভিত্তি করে সম্পর্ককে শেষ করে দিয়েছে। কোনো খোঁজ করেনি। বিশ্বাস এতটা ঠুনকো ছিলো তাদের?
— দোলা অপরাধীর মতো সজলের সব অভিযোগ শুনছে। সত্যি তো রুদ্ররা ভুল করেছে। একটা চিঠি আর কিছু কথার ভিত্তিতে একটা মানুষকে ভুল বুঝে এতদিন দূরে রাখতে পারে না। মানুষটা বেঁচে আছে না-কি মরে গেছে! কেমন আছে একবার জানার প্রয়োজনবোধও করে না।

–” আমি চাইনা মনিমা ওইখানে ফিরে যাক। যারা মনিমার মতো মানুষকে চিনতে ভুল করে। তার চরিত্র নিয়ে সন্দেহ করে তাদের মতো মানুষের কাছে আমার মনিমা থাকতে পারে না। তাদের তো বিশ্বাসী নেই এই মানুষটার প্রতি তাহলে কোন ভিত্তিতে সেখানে যাবে। রাগী কন্ঠে বলে সজল।

-‘ আপনার রাগ করাটা স্বাভাবিক আমি জানি। কিন্তু একবার উনাদের কথাটা ভাবুন। বিশেষ করে আমার স্বামীর কথাটা ভাবুন। ওইটুকু বয়সে মাকে ছাড়া থাকা কতটা কষ্টের সেটা তো আপনার কাছে অজানা নয়। হ্যাঁ মানছি সত্য মিথ্যার জালে ফেসে গেছে তারা৷ কিন্তু তাদের সিন্ধান্তও ভুল ছিলো না। প্রিয় মানুষের থেকে আঘাত পেলে যে কেউ কঠোর হয়ে যায়। ওই সময়টা কি করা উচিত ছিলো তারা বুঝেনি। মায়ের কথাটা সত্যি বলে মেনে নিয়েছে৷ আসলে মানতে বাধ্য হয়েছে বা মানতে বাধ্য করেছে বলতে পারেন।

–“” দেখুন দোলা সবটা বুঝতে পারছি। তারপরও উনাদের সিদ্ধান্ত আমি মানতে পারছি না। মনিমা আমার মা হয়ে আছে আর থাকবে। উনাদের কাছে তো মনিমা মৃত প্রায়। তাহলে আর নতুন করে কোনো কিছু করার মানে হয়না৷ আপনি প্লিজ মনিমাকে এই সব কিছু বলবেন না৷ আর না এইসবে জড়াবেন। অভিমান নিয়ে বলে সজল।
– দোলা অসহায় ফেসে তাকায় সজলের দিকে।
— ভালো থাকা বললে কি ভালো থাকা যায় সজল? দোলার প্রশ্ন সজল প্রশ্নবোধক চাহনি নিয়ে তাকায়। আমি জানি উনারা কত কষ্টে আছেন মা কে ছাড়া। প্রতিনিয়ত ভালো থাকার অভিনয় করে যাচ্ছে সবাই। কিন্তু প্রকৃত দিক থেকে কেউই ভালো নেই। সব সময় মাকে মিস করে তারা। দয়া করে আপনি উনাদের ভুল বুঝবেন না। আমি চাই সবাই এক সাথে থাকুক আবার৷ বাকি দিন গুলো যেনো সবাই একসাথে কাটাতে পারি আমরা।

— কি করতে চাইছেন আপনি? তিক্ততার সাথে বলে সজল।
– আপাতত সত্যটা খুঁজে বের করতে আর মাকে তার পরিবারে ফিরিয়ে দিতে৷ তার জন্য আপনার সাহায্য আমার লাগবে। প্লিজ না বলবেন না অনুনয় করে বলে দোলা। সজল কি বলবে বুঝতে পারছে না। একদিকে যেমন রাগ হচ্ছে আরেক দিকে মন বলছে সব কিছু ঠিক হয়ে যাক। রত্না চৌধুরী যে সত্যি ভালো নেই তার স্বামী সন্তান ছাড়া।

— আমি একটা কথা বুঝতে পারছি না ভাবান্তর হয়ে বলে দোলা। দোলার কথায় সজল পূর্ণ দৃষ্টিপাত করে তার দিকে।
–” মা কেনো এতদিন বাড়িতে ফিরে যায়নি। কেনো দূরে দূরে আছে সবার থেকে। তার সন্তানকে কি একবারও দেখতে ইচ্ছে করেনি। যার হাত ধরে সংসার জীবন শুরু করেছিলো তার কথা কি একবারও মনে হয়না৷ কেনো মা সব কিছু জেনে চুপ করে বসে আছে বুঝতে পারছি না।
— এটা আমিও বলতে পারব না৷ মনিমা পারবে একমাত্র বলতে৷ তবে এর মধ্যে কোনো কারণ তো নিশ্চয় আছে৷ নাহলে মনিমা নিজের স্বামী সন্তান থেকে কেনো দূরে থাকবে। সজলের কথায় দোলা কিছুখন সজলের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে আমি তো সবটা খুঁজে বের করবো। এর পেছনে কে আছে আমি খুব ভালো করে জেনে গেছি৷ এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা সবটা সামনে নিয়ে আসার।

–‘ এরপর দোলা সজলের সাথে কথা শেষ উঠতে যায় তখনই মাথায়া ঘুরে উঠে তার৷ এতে দোলা পড়ে যেতে নিলে সজল দোলাকে শক্ত করে ধরে ফেলে। দোলাকে ধরে আবার বেঞ্চে বসিয়ে দেয়৷

-‘ ঠিক আছেন আপনি? চিন্তিত গলায় বলে সজল। দোলা একটু চুপ থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে আইম ফাইন। ওই মাথাটা একটু ঘুরে গিয়েছিলো। প্রচন্ড রোদ তাই হয়তো। চিন্তা করবেন না৷ আমি আসছি বলে দোলা উঠে হনহন করে চলে যায়। দোলার শরীরটা আবার খারাপ লাগছে৷ হঠাৎ হঠাৎ এমন হওয়ার কারণ দোলা বুঝতে পারছে না।

–” তানিয়া অনেক খুশি আজ। কারণ তার বাবা কাউকে কিছু না বলে হুট করে দেশে আসে৷ তানিয়া তানভীর আহমেদকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে সোফায়। জেসমিন চৌধুরীও খুশি আজ! অনেক খুশি। এতদিন পর তানভীরকে দেখে সাথে আরেকটা কারণে। আজকের দিনটা তার জন্য এত লাকী হবে ভাবিনি সে৷ জাহির চৌধুরী তানভীরকে জড়িয়ে ধরেছিলো দেখা মাত্র। তিনি তানভীরকে অনেক পছন্দ করে। তানভীরও জাহির চৌধুরীকে অনেক সম্মান করে।

–” তানভীর মায়া ভরা দৃষ্টিতে জেসমিন চৌধুরীর দিকে তাকায়। অনেক দিন পর দেখছে তাকে। জেসমিন চৌধুরীর সাথে তানভীরের তেমন যোগাযোগও নাই৷ জেসমিন চৌধুরীর কাজকর্ম তানভীর কখনোই সমর্থন করেন না। তাই তো তিনি তানিয়াকে নিয়ে দূরে চলে গিয়েছিলেন জেসমিনের থেকে। জেসমিন চৌধুরীকে সে এখনো অনেক ভালোবাসে৷ জেসমিন চৌধুরীও যে তানভীরকে ভালবাসে না! এমনটা নয়। কিন্তু তার লোভ তাকে সব সম্পর্ক থেকে দূরে রেখেছে।

— দোলা বাড়িতে ঢুকতেই তানভীর আহমেদকে দেখে চমকে উঠে। সাথে সাথে ভ্রু কুচকে আসে তার৷ কারণ তানভীর আহমেদের কথা সে শুনেছে শুধু। কিন্তু দেখেনি কখনো। অচেনা কাউকে দেখলে একটু খটকা সাথে অবাক সবাই হবে স্বাভাবিক। দোলার ক্ষেত্রেও তাই। দোলা তানিয়ার দিকে একবার তাকায় জাহির চৌধুরীর দিকে একবার তাকায়৷ এরপর তানভীর আহমেদের দিকে তাকালে দেখে সে মুখে সুন্দর একটা হাসি ঝুলিয়ে দোলার দিকে তাকিয়ে আছে। দোলাকে দেখে জেসমিন চৌধুরী বাকা হাসে।

— দোলা কৌতুহল ভরা চাহনি নিয়ে বাড়ির মধ্যে এগিয়ে আসে আস্তে আস্তে। দোলাকে দেখা মাত্র তানিয়া উল্লাসিত কন্ঠে বলে ওইতো বউমনি চলে এসেছে। তানিয়ার কথায় সবাই মুচকি হাসি দেয়। সবার ভাবখানা এমন যেন, এতখন তার জন্যই অপেক্ষা করছিলো সবাই।
–‘ কি রে দোলামা এত দেরি হলো যে? জাহির চৌধুরীর কথায় দোলা ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে কি বলবে ভাবছে৷ তানিয়া বিষয়টা চাপা দেওয়ার জন্য বলে বউমনি এসো পরিচয় করিয়ে দিই আমার বাবা৷
– তানিয়ার বাবা কথাটা শুনে দোলার মধ্যে সব কৌতুহল দমে যায়৷ মুখে মৃদু হাসি নিয়ে এসে সালাম দেয়। তানভীর আহমেদ তো দোলাকে দেখে অনেক খুশি। অনেক মিষ্টি দেখতে দোলা৷ তার ভীষণ পছন্দ হয় দোলাকে। তানভীর আহমেদ উঠে এসেছে দোলার সামনে দাঁড়িয়ে বলে মাশা-আল্লাহ অনেক মিষ্টি দেখতে আমাদের রুদ্রর বউ। তার কথায় দোলা লজ্জা মিশ্রিত একটা হাসি দেয়৷
— শুধু কি মিষ্টি বাবা৷ অনেকটা মিষ্টি আর অনেক ভালো। আমি তো এখানে এসে আমার একটা বেস্টফ্রেন্ড পেয়েছি।
– এই জন্য বুঝি এই বুড়ো বাবাটার কথা ভুলে গেছো অভিমান পুর্ণ কণ্ঠে বলে তানভীর আহমেদ রসিকতা করে তানিয়াকে।
তানভীর আহমেদের কথায় জাহির চৌধুরী হেসে বলে তানি মা তোমার শিষ্য। আর সে তোমাকে ভুলবে। তবে একদিক দিয়ে ভালো হয়েছে৷ তুমি দেশে এসেছো।।আর কিন্তু যেতে দিচ্ছি না। আমরা সবাই একসাথে থাকব এখন থেকে বুঝেছো৷ শাসনের সুরে বলে জাহির চৌধুরী। তানভীর আহমেদ জাস্ট একটা হাসি দেয় তাতে।

–‘ প্রথম বউমার মুখ দেখলাম। তাই কিছু একটা তো উপহার দিতেই হবে। কি দেওয়া যায়রে তানি মা আমার আরেকটা মেয়েকে।
– ভালোবাসা, দোয়া, অনুপ্রেরণা। এই গুলো দিলে হবে। আর কিছু চাইনা। মুচকি হেসে বলে দোলা। দোলার কথায় তানভীর আহমেদ মুগ্ধ হয়। সত্যি অনেক ভালো আর সরল মনের মানুষ তুই মা দোলার মাথায় হাত রেখে বলে।
— তানভীর আহমেদ দোলার জন্য এক জোড়া সুন্দর চুড়ি নিয়ে এসেছেন। বিদেশ থেকে ঠিক করেন তিনি এটা দোলাকে দিবে৷ ব্যাগ থেকে চুড়ির বক্সটা বের করে দোলার হাতে দেয়। এই সব দেখে জেসমিন চৌধুরী রাগে ফুসতে থাকে৷ দোলার জন্য এত দামী গিফট সে মানতে পারছে না। জেসমিন চৌধুরী রাগ দেখিয়ে চলে যায় ঘরে। এটা কারো দৃষ্টিগোচর না হলেও দোলার হয়। দোলার মনটা খারাপ হয় এতে।

–” দোলা আর তানিয়া গবেষণায় বসে গেছে৷ দোলা ফেরার পর থেকে তানিয়া উৎসুক হয়ে আছে সজল কি বলেছে সেটা জানার জন্য। রুদ্র এখনো আসেনি বিধায়! তারা এই ঘরেই জমিয়ে আড্ডা দিতে পারছে৷ দোলা তানিয়াকে সবটা খুলে বলে। এরমধ্যে দোলা দরজার বাইরে কারো ছায়া দেখতে পাই।
— দোলা অনুমান করতে পারে ছায়াটা কার।

–” জানো দোলা মায়ের একটা চিঠি বাবার থেকে পেয়েছি। মা যে চিঠি টা লিখে রেখে চলে গিয়েছিলো বুঝেছো তো? আমার না কেমন জানি খটকা লাগছে চিঠিটায়। আচ্ছা ওইটা কি আদোও মায়ের হাতের লেখা। আমার তো মনে হয়না ওইটা মায়ের হাতের লেখা৷ আমি যতদুর শুনেছি মায়ের হাতের লেখা সুন্দর আর ফ্রেস লেখা ছিলো। কিন্তু চিঠির লেখাটা একটু অগোছালো আর কেমন জানি। আমাকে না ভালো করে দেখতে হবে সত্যি ওইটা মায়ের হাতের লেখা নাকি! চিঠিটা আমি ড্রয়ারে রেখেছি। পরে দেখবো। দরজার আড়ালের ছায়াটাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে দোলা.।
-কিন্তু এইদিকে তানিয়ার অবস্থা হযবরল। দোলার হঠাৎ এইসব কথার কোনো মানেই বুঝতে পারে না।

–‘ বউমনি তুমি কি.. তানিয়াকে বাকিটা বলতে না দিয়ে দোলা বলে আরে শুনো না৷ আমি সব দেখছি চিন্তা করো না৷ আমি ঠিক খুঁজে বের করে নিব৷ এখন আমি যাই সবার জন্য নাস্তা করতে হবে। পরে কথা হবে কেমন। তখন সঙ্গে সঙ্গে ছায়াটা সরে যায়। দোলা একটা স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে বুকে হাত দিয়ে।

— বউমনি এতখন কি সব বলছিলে পাগলের মতো। আমি কি জিজ্ঞেস করলাম আর তুমি কি সব বলে গেলে। কৌতুহল নিয়ে বলে তানিয়া। দোলা একটা ভুবনভোলানো হাসি দিয়ে বলে ও কিছু না৷ চলো নাস্তা রেডি করি সবার জন্য। এরপর তারা দুজনে একসাথে কিচেনে যায়। দোলার মধ্যে অনেক এক্সাইডমেন্ট কাজ করছে। মনে মনে অনেক কিছু ভাবছে৷ সব কিছু প্ল্যান মাফিক হলে তবেই সবটা এগুবে ঠিকঠাক।

–‘ চলবে…

#তুমিময়_আসক্তি
#কলমে_আলো_ইসলাম

“৩০”

–“” জেসমিন চৌধুরী তার ঘরে পায়চারি করছে। দোলার কথা গুলো শুনে সে ভয় পেয়ে যায়। দোলা যে অনেক কিছু করতে পারে এটা জেসমিন চৌধুরীর বুঝতে বাকি নেই।
— নাহ কিছু একটা করতে হবে। এইভাবে সবটা শেষ হতে পারে না। ওই মেয়ে খুব বাড় বেড়েছে৷ এবার আমাকে কঠিন কিছু করতে হবে। দোলাকে পথ থেকে বিদায় দিতে হবে। আমি শেষে এসে সব হারাতে চাইনা। তার আগে চিঠিটা সরাতে হবে আমাকে৷ ওইটা যদি রত্নার লেখার সাথে কোনো ভাবে মিলিয়ে কাউকে কিছু বলে তাহলে সব প্ল্যান ভেস্তে যাবে৷ আর আমি এটা হতে দিব না কখনো। অনেক চিন্তিত জেসমিন চৌধুরী। দোলা এতদুর এগিয়ে যাবে ভাবিনি সে।

— তানভীর আহমেদ আসে জেসমিন চৌধুরীর ঘরে সে সময়। জেসমিন চৌধুরী তার চিন্তায় এতটা মত্ত ছিলো যে, তানভীর আহমেদকে খেয়াল করে না। তানভীর আহমেদ গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে জেসমিন চৌধুরীর দিকে। জেসমিন যে কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত এটা বুঝতে পারছে।
— জেসমিন চৌধুরী পায়চারি করতে করতে ঘুরতেই তানভীর আহমেদ কে দেখে চমকে উঠে মুখে হাসি নিয়ে আসার চেষ্টা করে।
– তানভীর আহমেদও বিপরীতে একটা হাসি দেয় কিন্তু ভ্রু কুচকে এখনো আছে৷
— তুমি? এসো ভেতরে। এতখনে আমার কথা মনে পড়লো তোমার? অনেকটা অভিমান নিয়ে বলে জেসমিন চৌধুরী। তানভীর আহমেদ কিছু না বলে জেসমিন চৌধুরীর দিকে এখনো একি ভাবে তাকিয়ে আছে। এসে পর্যন্ত তানভীর আহমেদ এখনো জেসমিন চৌধুরীর রুমে আসেনি আর না একলা কথা বলেছে৷

— কেমন আছো? ক্ষীণ স্বরে বলে তানভীর আহমেদ।
– হুম ভালো আছি। স্বাচ্ছন্দ্যে বলে জেসমিন চৌধুরী।
– হ্যাঁ জানি তুমি ভালো আছো আর থাকবে সব সময়। ভালো থাকার জন্য সব কিছু থেকে দূরে আছো। নিজের সংসার, স্বামী, সন্তান সব ছেড়ে এখানে আছো৷ তুমি ভালো থাকবে এতে কোনো সন্দেহ নেই আর না কখনো ছিলো। তবে আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করবে না?
– তানভীর আহমেদের এই কথায় জেসমিন চৌধুরী অপরাধ সূচক চাহনি নিয়ে তাকায়৷ তানভীর আহমেদের কথায় রাগ, ক্ষোভ, অভিমান সাথে প্রতিবাদ আছে জেসমিন চৌধুরী সব বুঝতে পারছে। তারপরও সে বুঝতে চাইনা কোনো কিছু। তাই তানভীর আহমেদের কথা গায়ে না মেখে বলে! কেমন আছো তুমি? তানভীর আহমেদ এতে একটা দীর্ঘশ্বাস সাথে তপ্ত হাসি রাখে। যে হাসিতে উপহাস ছাড়া কিছুই নেই।

–” কবে ফিরবে? হঠাৎ তানভীর আহমেদের এমন কথায় জেসমিন চৌধুরী ছোট ছোট চোখ করে তাকায়। সে যেনো কিছুই বুঝেনি তানভীর আহমেদের কথা এমন ভাব ধরে থাকে।
— কিসের কথা বলছো আর কোথায় ফেরার কথা বলছো?

— তুমি এতটাও অবুঝ নয় জেসু। যে আমার কথার মানে বুঝতে পারছো না। অনেক তো হলো এবার সব ছেড়ে চলো না আমরা একসাথে বাঁচি। জীবনের অর্ধেকটা সময় তো এইভাবে কাটালে৷ এবার নাহয় বাকি দিনগুলো আমরা একসাথে থাকি৷ তোমার স্বামী আছে সন্তান আছে৷ যথেষ্ট ধন সম্পদ আছে। এরপরও আর কি চাই তোমার? কেনো এখনো লোভটাকে জমিয়ে রেখেছো। দেখো যা কিছু করেছো সব ভুলে যেতে চাই আমি৷ আমি তোমাকে পাশে চাই। প্লিজ জেসু ফিরে এসো আমাদের কাছে। নতুন করে আমরা চলি একসাথে। রুদ্র, ভাইজান এরা তো তোমার আপনজন। তাহলে কেনো করছো এইসব?

— তানভীর আহমেদের কথায় জেসমিন চৌধুরীর রাগ হয়। মুলতঃ এইসবের জন্য সে তানভীরের সাথে যোগাযোগ করতো না। কারণ তানভীর আহমেদ সব সময় এক কথা বলে। যেটা জেসমিন চৌধুরী কখনোই পছন্দ করে না।

–‘ দেখো তানভীর। আমি কখনো বলিনি তোমার সাথে থাকতে আমার সমস্যা। তাছাড়া আমি তোমাকে নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছি। কিন্তু এইসব আমার বাবা মায়ের সম্পত্তি। আমার অধিকার আছে৷ আর আমি আমার অধিকার বুঝে নিচ্ছি। এতে যদি তোমার ভালো না লাগে আমার কিছু করার নেই৷ তুমি নিজ ইচ্ছেতে দূরে আছো তোমার মেয়েকে নিয়ে। আমার এখানে তোমাকে কিছু বলার নেই।

— তানভীর আহমেদ একটা টানাশ্বাস ছাড়ে। যে শ্বাসে হতাশা, আফসোস একসাথে প্রকাশ পায়। সে জানে জেসমিন কখনোই বুঝবে না। লোভ তাকে কোনো কিছু বুঝতে দিবে না! না আগে বুঝেছে আর না এখন বুঝবে। তবে সব কিছুর শেষ আছে৷ লোভের পরিনাম ধ্বংস। আর জেসমিন চৌধুরীর ও পতন খুব শীগ্রই হবে। আর সেদিন অনেক দেরি হয়ে যাবে সব কিছুর৷ তানভীর আহমেদ আর কিছু না বলে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। আপাতত তার জেসমিন চৌধুরীর সাথে কথা বলার মতো মনমানসিকতা নেই। অনেক কষ্ট মনে জমা রেখে তানভীর আহমেদ চলে যায়। জেসমিন চৌধুরী একটা ভেংচি কাটে তানভীর আহমেদের পেছনে।

–”দোলা তানিয়া একসাথে কিচেনে আছে। দুজন মিলে নাস্তা করছে৷ সন্ধ্যায় সবাইকে নাস্তা দিবে। তানভীর এসেছে! তার জন্য স্পেশাল কিছু তো করা লাগবে। দোলার অনেক ভালো লেগেছে তানভীর আহমেদকে। দোলা তানিয়া আর তানভীর আহমেদের কথা ভাবে আর ভাবে জেসমিন চৌধুরীর কথায়। দুজন মানুষ কত ভালো। আর উনি এমন লোভে দিনের পর দিন উচ্ছনে যাচ্ছে। মানুষ কতটা লোভী হলে নিজের স্বামী সন্তান সংসার ছেড়ে থাকতে পারে জেসমিন চৌধুরী তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।

–” জেসমিন চৌধুরী কিচেনে উঁকি দিতেই দেখে দোলা আর তানিয়া রান্নায় ব্যস্ত। সে একটা বাকা হাসি দিয়ে উপরে যায় রুদ্রর ঘরের উদ্দেশ্যে। দোলা পকোড়া করে তানিয়াকে বলে! তুমি চা’টা একটু করে নিবে প্লিজ। আমার ঘরে একটা কাজ আছে। যাব আর আসব। তানিয়া হাসিমুখে দোলাকে যেতে বলে। এদিকটা সে সামলে নেবে জানায়। দোলা দেরি না করে বেরিয়ে আসে কিচেন থেকে। জেসমিন চৌধুরীকে সে উপরে যেতে দেখেছে তাই তানিয়াকে বলে চলে আসে। আসলে দোলা এতখন নজরে রেখেছিলো জেসমিন চৌধুরীকে। সে জানতো জেসমিন চৌধুরী চিঠিটার কথা শুনে তার ঘরে খুঁজতে যাবে৷ দোলা মুচকি হাসি দিয়ে উপরে যায়।

— জেসমিন চৌধুরী হন্নে হয়ে চিঠিটা খুঁজতে শুরু করে। কোথাও না পেয়ে অনেক বিরক্ত হয় তিনি। এরপরও হাল ছাড়ে না। চিঠিটা খুঁজে বের করতেই হবে তাকে৷ দোলা তো বলেছিলো ড্রয়ারে রেখেছে তাহলে কোথায় সেটা মনে মনে বলে জেসমিন চৌধুরী।
— দোলা দরজার আড়াল থেকে জেসমিন চৌধুরীর কান্ড দেখছে আর মুচকি হাসছে৷ দোলা চাইছে জেসমিন চৌধুরী আর একটু সময় ধরে খুঁজুক চিঠিটা৷ বেশ মজা লাগছে তার এইভাবে দেখতে জেসমিনকে।

–” জেসমিন চৌধুরী কোমরে হাত রেখে দাঁড়ায়। কোথাও নেই চিঠিটা৷ এর মধ্যে দোলা প্রবেশ করে রুমে৷ এমন ভাব নিয়ে আসে যে সে মাত্র এসেছে আর জেসমিন চৌধুরীকে দেখে অনেক অবাক হয়েছে। জেসমিন চৌধুরী দোলাকে দেখে চমকে উঠে ঘাবড়ানো চোখে তাকায়। দোলা অবাক হওয়ার ভান করে বলে একি ফুপিমা আপনি এখানে? আমার ঘরে কি করছেন? এরপর দোলা ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখে পুরো ঘর এলোমেলো।

— একি অবস্থা ঘরের৷ কে করেছে এমন? আপনি করেছেন? কিছু খুঁজছিলেন ফুপিমা৷ ঘরের এই অবস্থা কেনো করেছেন? না জানার ভান করে বলে দোলা। জেসমিন চৌধুরী কয়েকটা ঢোক গিলে। এই সময় দোলাকে সে আশা করেনি।

— জেসমিন চৌধুরীকে চুপ থাকতে দেখে দোলা ভ্রু কুচকে বলে আচ্ছা কোনো ভাবে আপনি এটা খুঁজতে এখানে আসেননি তো? চিঠিটা বের করে জেসমিন চৌধুরীর সামনে ধরে বলে দোলা। মুখে তার সেই তৃপ্তিকর হাসি। এই দিকে জেসমিন চৌধুরীর অবাকের চুড়ায়। চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। তার মানে দোলা সব আগে থেকে জানে৷ এইসব ইচ্ছে করে করেছে৷ ভেবেই জেসমিন চৌধুরীর অনেক রাগ হয়। দোলা তো মুখে ভুবনমোহিত হাসি ধরে তাকিয়ে আছে।

–‘ তার মানে তুমি এইসব ইচ্ছে করে করেছো৷ আমার সাথে এতখন নাটক করছিলে মৃদু চিৎকার করে রাগী কন্ঠে বলে। দোলা মুচকি হেসে বলে সে আর বলতে। নাটক কি করে করতে হয় সেটা তো আপনার থেকে শেখা। তার একটু ড্রেমো দেখাইলাম আপনাকে। বেশ সুন্দর অভিনয় করতে পেরেছি আমি তাই-না ফুপিমা? আসলে দেখছিলাম চিঠির রিয়াকশন কেমন হয়। তবে কি বলুন তো! আমার পুরো বিশ্বাস ছিলো সব কিছুর পেছনে আপনি আছেন। ওই একটু বলে হাতের আঙ্গুল অনুসরণ করে দেখিয়ে বলে দোলা. এইটুকু ডাউড ছিলো। কিন্তু এখন একদম সম্পুর্ন বিশ্বাস করি এইসব কিছুর প্রধান চরিত্র আপনি। এই সুন্দর সংসারটা ভাঙার পেছনে দায়ী আপনি। মাকে এই বাড়ি থেকেও সরিয়েছেন আপনি তেজী কন্ঠে বলে দোলা চোখ গরম করে।

–‘ দোলার কথায় জেসমিন চৌধুরী জোরে হেসে উঠে শব্দ করে। জেসমিন চৌধুরীর হাসি দেখে দোলা চোখ মুখ কুচকে তাকায়।

— সত্যি দোলা তুমি অনেক বুদ্ধিমতী মেয়ে। সব কিছু এত সহজে বুঝে গেছো৷ এতদুর এগিয়ে গেছো। কিন্তু আফসোস তুমি সব জেনেও কিছু করতে পারবে না। কাউকে কখনো বলতে পারবে না৷ আর না পারবে আমাকে দোষী প্রমান করতে৷ কারণ তোমার কাছে চিঠিটা ছাড়া কিছুই নেই প্রমাণ করার৷ আর চিঠি দিয়ে কোনো কিছুই প্রমাণ হয়না।

— দোলা মুচকি হেসে উঠে। এতে জেসমিন চৌধুরীর হাসি থেমে যায়৷ কৌতুহল নিয়ে তাকায়।
— আপনার ধারণাও নেই ফুপি আমি কি করতে পারি আর কি করতে যাচ্ছি৷ আপনার করা সব পাপের শাস্তি আমি দেব। এই সুন্দর সংসারটা ভেঙেচুড়ে শেষ করে দেওয়ার শাস্তি আমি আপনাকে দেব৷ আমার স্বামীকে মাতৃহারা করা৷ মায়ের আদর ,স্নেহ ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করার দাম আমি নেব আপনার থেকে। আপনার লজ্জা করে না৷ নিজের ভাইয়ের সংসারে এইভাবে আগুন জ্বালাতে। এই সুন্দর সংসারটা নষ্ট করতে একটু বিবেকে বাধলো না৷ রুদ্র তো আপনার সন্তানের মতো। আপনি তো ওর ফুপি৷ আর ফুপি তো মায়ের সমতুল্য। বাবা তো আপনার নিজের ভাই। তাহলে কি করে পারলেন তাদের কষ্ট দিতে৷ প্রিয় মানুষ থেকে দূরে সরাতে।

— অনেক বলেছো তোমার নীতিমালা। তোমার থেকে কেউ জ্ঞ্যান নিতে আসেনি এখানে৷ আর আমি কি করবো না করবো একান্ত আমার ব্যাপার। তুমি বরং তোমার চিন্তা করো। অন্যের সংসারের চিন্তা না করে তোমার সংসারটা রক্ষা করবে কি করে সেটা নাহয় ভাবো৷ অনেক ছাড় দিয়েছি আর নয়৷ অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছো তুমি৷ এবার তোমার সময় শেষ। আমি আমার প্রতিপক্ষকে কখনো সুযোগ দিই না৷ তুমি আমার অনেকটা সময় নিয়ে নিয়েছো আর নয়। রেডি থেকো পরের ধাক্কা সামলানোর জন্য। তোমার জন্য বড় ধামাকা আসছে৷ এই বাড়ি থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে তোমাকে রুদ্র৷ আর রাজ করবো আমি এখানে আর আমার মেয়ে। আমি চেয়েছিলাম তানিয়ার বিয়েটা রুদ্রর সাথে দিয়ে এই সব সম্পত্তির মালিক আমি হবো৷ কিন্তু তুমি মাঝখানে এসে সব শেষ করে দিয়েছো৷ এখন আবার আমার পেছনেই উঠেপড়ে লেগেছো৷ একটা সিক্রেট বলি আজ তোমায় শুনো ফিসফিস করে বলে জেসমিন চৌধুরী। দোলা তো বিষ্ময় চোখে তাকিয়ে আছে জেসমিন চৌধুরীর দিকে।

-; তোমার শাশুড়ী মানে রত্না সে না আমার সব পরিকল্পনার কথা জেনে গিয়েছিলো। সে তোমার মতোই চালাক আর বুদ্ধিমান ছিলো৷ কিন্তু আফসোস বেচারা নিজেই দূরে চলে গেলো। আর কি পেলো শেষ পর্যন্ত। প্রিয়জনদের ঘৃণা, তৃরষ্কার বেচারি। আফসোস সুর তুলে বলে জেসমিন চৌধুরী।
— দোলা অবাক হয়ে শুনছে জেসমিন চৌধুরীর কথা৷ মানুষ সম্পত্তির লোভে আপন মানুষের সাথে এতো জঘন্য কাজ করতে পারে দোলা ভাবতে পারছে না৷ কি সাবলীল ভাবে সব অন্যায়ের কথা স্বীকার করছে নিজ মুখে৷ একটু অনুশোচনা নেই ভেতরে। দোলা যত দেখছে জেসমিন চৌধুরীকে তত অবাক হচ্ছে৷ অবশ্য দোলা আগেই বুঝে গিয়েছিলো জেসমিন চৌধুরী অনেক খারাপ একটা মানুষ। যার কাছে কোনো সম্পর্কের দাম নেই। কিন্তু সব কিছুর পেছনে টাকা সম্পত্তি থাকতে পারে ভাবিনি।।

— তোমার শাশুড়ীকে যেভাবে বিদায় করেছি! তোমাকে ঠিক সেভাবেই বিদায় দেব বাড়ি থেকে। আমার সাথে পাংগা নেওয়ার ফল কি হতে পারে বুঝবে এবার বলে জেসমিন চৌধুরী চলে যায়। আর দোলা এখনো একটা শকের মধ্যে আছে। কিন্তু জেসমিন চৌধুরী কি করতে চলেছে দোলা বুঝতে পারছে না। তার যে জেসমিন চৌধুরীর সাথে লড়াইটা কঠিন হয়ে গেলো এটা দোলা বেশ উপলব্ধি করতে পারছে৷ জেসমিন চৌধুরী নতুন করে কিছু করার আগে দোলাকে তার খেলা শেষ করতে হবে। সব কিছু খুব তাড়াতাড়ি সবার সামনে নিয়ে আসতে হবে। এর জন্য রত্না চৌধুরীকে লাগবে তার৷ রত্না চৌধুরীর সাথে কথা বলতে হবে তাকে। দোলা ঠিক করে নেয় এরপর সে কি কি করবে।

–‘” পরেরদিন সকালে… দোলা মুখটা গোমড়া করে রেডি হচ্ছে। কারণ রুদ্রর কাছে অনেক বকা শুনেছে গতরাত থেকে। দোলার শরীরটা আস্তে আস্তে খারাপ হচ্ছে অনেক। যখন তখন বমি করা মাথাঘোরা কিন্তু দোলা সেসবে পাত্তা দিচ্ছে না৷ এটা ওটা বলে এড়িয়ে যাচ্ছে! ডক্টর ডাকতে গেলেও বারন করছে। রুদ্র আর দোলার কথা শুনবে না৷ তাই দোলাকে বলে রেডি হতে৷ সে আজই দোলাকে ডক্টর দেখিয়ে যা টেস্ট করার করাবে৷ যদি বড় কিছু হয় তাহলে পরে মুশকিল হয়ে যাবে। রুদ্র কোনো রিস্ক নিতে চাইনা দোলাকে নিয়ে। রুদ্রর মনপ্রাণ জুড়ে এখন দোলা। রুদ্রও বুঝে গিয়েছে সে দোলাকে ভালোবাসে৷ এখন সেটা দোলাকে জানানোর অপেক্ষা তার। রুদ্র চাই আর সবার মতো সেও স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে! সংসার করতে৷ তার মধ্যকার ভুল ধারণা গুলোকে কবর দিয়ে নতুন করে সব শুরু করতে। মেয়েদের প্রতি একটা আলাদা জায়গা তৈরি করতে।

— রুদ্র দোলার দিকে তাকিয়ে আছে আয়নার মধ্যদিয়ে। দোলা তো মুখটা গম্ভীর করে রেখেছে। রুদ্র মুচকি হাসে দোলার মুখ দেখে৷ এরপর রেডি হতে থাকে।

–“”” রুদ্র ডক্টরের সাথে কথা বলে দোলার বেশ কিছু টেস্ট করায়। রিপোর্ট দুদিন পর দিবে বলে জানায়। রুদ্র দোলাকে নিয়ে আবার ব্যাক করে। এরপর আশার বাড়ি যাবে রাজের পরিবারকে নিয়ে। দোলা আশাকে সবটা জানালে আশা বলে তার পরিবারের সাথে কথা বলতে৷ রাজকেও আশার ভালো লেগেছে। কিন্তু সেটা ভালো লাগা পর্যন্তই। এর বেশি কিছু আশার দিক থেকে ছিলো না আর না এখন আছে । কিন্তু রাজ যে তাকে ভালোবাসে এটা শুনে আশার মনের মধ্যে অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছিলো।

–” দোলা রুদ্রর সাথে সারা রাস্তা কথা বলেনি। না যাওয়ার সময় বলেছে আর না আসার সময়। পুরো সময় মুখটা গম্ভীর করে রেখেছে৷ রুদ্র আড়ে আড়ে দোলাকে দেখে গেছে শুধু। কিন্তু সেও কিছু বলেনি মুখ ফুটে।।
— রাস্তার মাঝে রুদ্র হঠাৎ গাড়ি থামায়। রুদ্রর কান্ডে দোলা অবাক হয়ে তাকায় রুদ্রর দিকে৷ কিন্তু এরপরও মুখে কিছু বলে না৷ কারণ রুদ্রর প্রতি অনেক অভিমান জমা হয়েছে তার৷ সব সময় বকাবকি করে রুদ্র তার উপর।

–“” একটু ভালো ভাবে তো বোঝানো যায়। কিন্তু উনিতো রুদ্রনীল চৌধুরী। ভালো কথা তো মুখে আসেই না। আমিও কিছু বলব না! আর বকাও শুনব না এইভেবে মনস্থির করে দোলা। রুদ্র গাড়ি থামিয়ে নেমে যায় গাড়ি থেকে দোলাকে রেখে৷ দোলা তো রুদ্রর কাজে চমকে উঠে।

— আরে আমাকে রেখে কোথায় যাচ্ছে৷ রাস্তার মাঝে ফেলে রেখে চলে গেলো। আচ্ছা উনিও কি আমার উপর রাগ করেছে? করলে আমার কি৷ আমারও রাগ আছে, অভিমান আছে৷ আমি বলব না কথা৷ রেখে গেছে তো! থাকব সমস্যা কি? কিন্তু এই সাহস বেশিখন রাখতে পারে না দোলা। তার মধ্যে ভয় কাজ করে। গাড়ি থেকে মাথা বের করে এদিক ওদিক তাকিয়ে রুদ্রকে খুঁজছে৷ রুদ্র হঠাৎ কোথায় গেলো গাড়ি থামিয়ে বুঝতে পারছে না। দোলার চোখ মুখে ভয়ের ছাপ বিদ্যমান এখন।

–দোলা এদিক ওদিক তাকাতেই দেখে রুদ্র হাতে কিছু একটা প্যাকেট নিয়ে আসছে৷ তাই দেখে দোলার চোখ মুখ কুচকে আসে৷ কৌতুহলী হয়ে তাকিয়ে থাকে রুদ্রর হাতের দিকে। মুলত কি আছে বোঝার চেষ্টা তার৷

— রুদ্র আবার গাড়িতে বসে প্যাকেট গুলো দোলার দিকে এগিয়ে দেয়। দোলা তো রসগোল্লার সমান চোখ করে তাকায় রুদ্রর দিকে।

— দোলার এমন করে তাকানো দেখে রুদ্র বিরক্ত হয়ে বলে এমন বড় বড় চোখ করে কি দেখছো। ধরো এটা। আমি কি এটা ধরে সারাদিন এখানেই বসে থাকব। রুদ্রর কথায় দোলার আবার রাগ হয়। প্যাকেট টা না নিয়ে অন্য দিকে ঘুরে বসে। রুদ্র তো দোলার কান্ডে বেকুব হয়ে যায়। দোলার সাহস দেখে রীতিমতো অবাক।

— কি হলো নাও। ধমক দিয়ে বলে রুদ্র৷ আসলে প্যাকেটে আইস্ক্রিম আর ফুসকা আছে। দোলা ফুসকা আর আইসক্রিম খেতে পছন্দ করে এটা রুদ্র রোকনের থেকে জেনেছিল। তাই দোলার মনটা ভালো করার জন্য এই গুলা নিয়ে আসে৷

–‘ দোলা এখনো কোনো রিয়াকশন দেখায় না রুদ্রর কথায়। রুদ্র একটা হতাশার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নরম স্বরে বলে আচ্ছা বাবা আইম সরি। রুদ্রর এই একটা কথায় যথেষ্ট ছিলো দোলাকে নতুন শকড দেওয়ার জন্য। রুদ্র তাকে সরি বলছে ভাবা যায়। দোলা আগের তুলনায় দ্বিগুণ বড় বড় চোখে তাকায়। আর রুদ্র ফ্যালফ্যালে চোখে তাকিয়ে আছে দোলার দিকে।

–“” চলবে..