তুমিময় আসক্তি পর্ব-৩১+৩২

0
1156

#তুমিময়_আসক্তি
#কলমে_আলো_ইসলাম

“৩১”

–“” রুদ্রর মুখে সরি শুনে দোলা ভীষণ রকম অবাক হয়ে তাকায়। রুদ্র দোলার দিকে একটা অসহায় ফেস ধারণ করে আছে। দোলার ভ্রু কুচকে আসে কিছুখন বাদে। রুদ্রর সরিটা সে শুনতে পেলেও শকড কাটিয়ে উঠতে পারছে না কোনো ভাবে।
— এমন করে তাকিয়ে আছো কেনো? বললাম তো সরি! কথাটা বলে রুদ্র অন্যদিকে তাকায়। দোলা একই ভাবে রুদ্রকে এখনো বিচরণ করছে।
— গতকাল রাগ হয়ে গিয়েছিলো তোমার শরীর খারাপ দেখে। আজ কয়টা দিন তোমার এমন শরীর খারাপ করছে অথচ না ডক্টর দেখাচ্ছো আর না ডক্টর ডাকতে দিচ্ছো। তোমার দায়িত্ব আমার উপর আছে। তাই যেকোনো সমস্যা দেখা আমার কর্তব্য। নাহলে পরে মানুষ বলবে রুদ্রনীল চৌধুরী তার ওয়াইফের কেয়ার করেনি।

– রুদ্রর এই কথাটা শুনে দোলার আবার রাগ হয়। অন্য দিকে ফিরে বসে আবারও।
— রাক্ষস একটা এখনো অন্যের দোষ দিয়ে যাবে। তাও স্বীকার করবে না যে তার চিন্তা হয় আমার জন্য। আমিও দেখব কতদিন অন্যের উপর দিয়ে যায়।

— কি হলো নাও৷ সরি তো বললাম আবারও প্যাকেট গুলো দোলার দিকে ধরে বলে। দোলা ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে থেকে প্যাকেটটা হাতে নিলে রুদ্র একটা স্বস্তি শ্বাস ছেড়ে আবার গাড়ি স্টার্ট দেয়। দোলা প্যাকেট’টা খুলে দেখে তার মধ্যে আইস্ক্রিম আর ফুসকা। যদিও আইস্ক্রিম গলতে শুরু করে দিয়েছে অলরেডি। কিন্তু ফুসকা’ দেখে দোলার মনটা একদম ফ্রেস হয়ে যায়। অজান্তেই ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে দোলার৷ সেটা দেখে রুদ্রর ঠোঁটের কোণেও হাসি উঁকি দেয়। কিন্তু দোলার দৃষ্টির আড়ালে।

–” তানিয়া আর সজল একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছে। তানিয়ার মুখ’টা গম্ভীর সাথে সজলেরও। সজল তানিয়ার উপর রাগ করে দুদিন কন্ট্রাক্ট করেনি। তানিয়া তাকে কেনো আগে জানায়নি এইসব। ওর মনিমার জন্য সবটা করতে পারে সজল। কিন্তু যারা সে মানুষটাকে ঘৃণা করতে পারে। সঠিক ভুল বিচার না করে অপরাধের কাঠগড়ায় দাঁড় করায় তাদের মতো মানুষের সাথে আর যা-ই হোক কোনো সম্পর্ক করা যায় না।

–“” কেনো করছো এমন আমার সাথে? আমার কি দোষ এখানে বলতে পারো? ছলছল চোখে তাকিয়ে বলে তানিয়া। সজল নিশ্চুপ।
–” এই দুইটা দিন কিভাবে কেটেছে আমার একবারও বোঝার চেষ্টা করেছো? প্লিজ আমার সাথে এমন করো না সজল। আমি সত্যি তোমাকে ভালবাসি। তাছাড়া আমার পরিবারের কোনো দোষ নেই এখানে৷ আমরা সবাই পরিস্থিতির স্বীকার। বউমনি তো চেষ্টা করছে সত্যিটা খুঁজে বের করার৷ যখন সত্যি টা প্রকাশ পাবে তখনই আসল অপরাধী সামনে আসবে। মামিকে তখন আর কেউ দোষ দিবেনা৷ সবাই অনুতপ্ত হবে তাদের করা কাজের জন্য।

–” সজল তানিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে তানিয়ার চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। কান্না করেছে অনেক এটাও বোঝা যাচ্ছে৷ কিন্তু সজলের রাগ হচ্ছে রুদ্র আর তার বাবার প্রতি। তারাই তো রত্না চৌধুরীর সব চেয়ে কাছের মানুষ। আর ওরা কি-না একটা কথা, একটা চিঠির উপর ভিত্তি করে এমন দূরে সরে আছে৷ মানুষ টা কেমন আছে কোথায় আছে জানার প্রয়োজনটাও করেনি।

–” তানিয়া প্রবল আগ্রহ নিয়ে সজলের দিকে তাকিয়ে আছে৷ সজল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে সরি! আসলে আমি নিজেকে বুঝাতে পারছিলাম না। মনিমা আমার কাছের একজন শুধু তা নয়৷ সে আমার মা। আমি মায়ের আসনে বসিয়ে৷ তাই দোলার থেকে সব শোনার পর অনেক রাগ হয়েছিলো তোমাদের পরিবারের উপর। তবে আমার মনিমাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে যা করা লাগে আমি করব। আমার মনিমা যে পরিস্থিতির স্বীকার ছিলো। সেও এতদিন বিনাদোষে দোষী হয়ে এসেছে তার সব প্রমাণ আমি দেব। কিন্তু মনিমাকে কখনো ওদের কাছে ফিরতে দেব না। আমার কাছেই থাকবে মনিমা। যারা প্রিয়জনের মুল্য দিতে পারে না। তাদের মতো মানুষের কাছে আমার মনিমা যাবে না। তেজী কন্ঠে বলে কথা গুলো সজল।

–‘ যদি মামি ফিরতে চাই আমাদের কাছে। তাহলে কি করবে তুমি? তানিয়ার কথায় সজলের দৃষ্টি স্থীর হয়ে যায়। কিছু সময়ের জন্য থমকে যায় সে। সত্যি তো যদি রত্না চৌধুরী ফিরে যেতে চাই তাহলে সজল তাকে কোন অধিকারে আটকাবে?
-‘ জানি না আমি কি করবো তখন নুয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে সজল। তানিয়াও আর কথা বাড়ায় না। এরপর ওদের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যায়। সজল দোলার সাথে থেকে সব সত্য বের করতে সাহায্য করবে বলে মনস্থির করে।

–“” রাজের সাথে আশার বিয়ের পাকা কথা হয়৷ রাজের পরিবার ভালো। রাজও দেখতে শুনতে মাশা-আল্লাহ। তাই আশার পরিবার আর দ্বিমত করেনি। তাছাড়া রুদ্রর জন্য তারা আর কোনো বাদবিচার করিনি৷ রাজ আর আশার বিয়েটা হবে আশার এক্সাম শেষ হলে। দোলারে আর দু-মাস পর দ্বিতীয় বর্ষ ফাইনাল পরিক্ষা৷ সেটা শেষ হলে রাজের সাথে আশার বিয়ে হবে। আপাতত আকদ করে রাখবে ওদের৷ রাজের পরিবারও রাজী এই সিদ্ধান্তে৷

–” দোলা রেডি হচ্ছে। উদ্দেশ্য সজলের বাড়ি। সাথে আজ তানিয়াও যাবে। রত্না চৌধুরীর সাথে সরাসরি কথা বলবে দোলা। কেনো তিনি সবটা জেনেও চুপ করে আছেন। প্রিয়জনদের থেকে দূরে আছেন সব প্রশ্নের উত্তর দোলা নিয়ে তবে আসবে। জেসমিন চৌধুরীকে আর কোনো অপরাধ করার সুযোগ দোলা দিতে চাই না। পরিবারের শান্তি ফিরে নিয়ে আসা তার দায়িত্ব বাড়ির বউ হিসাবে৷ এতে যদি তার সংসারে কেউ ক্ষতি করতে চাই তাহলে দোলা তাকে ছেড়ে কথা বলবে না। হোক সে আপনজন। কিন্তু অপরাধ সবার জন্য সমান।

–” তানভীর আহমেদ, জাহির চৌধুরী, জেসমিন চৌধুরী ড্রয়িং রুমে বসে আছে৷ দোলা আর তানিয়াকে একসাথে রেডি হয়ে নামতে দেখে জেসমিন চৌধুরী বাকা চোখে তাকিয়ে থাকে।
— কি রে তোরা কোথাও যাচ্ছিস নাকি? তানভীর আহমেদ হাস্যমুখে জিজ্ঞেস করেন৷ জাহির চৌধুরীও আগ্রহ পূর্ণ চোখে তাকিয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষায়
–” একটু বাইরে যাব বাবা। কিছু কেনাকাটা করার আছে৷ তাই বউমনিকে সাথে নিলাম তানিয়াও হাসি মুখে বলে। ( দোলারে কলেজ দুদিন ছুটি আছে তাই তানিয়া শপিং করার কথা বলে)
— দোলা মা তোর শরীর কেমন আছে এখন? তানভীর আহমেদের কথায় দোলা মৃদু হেসে বলে জ্বি ভালো।। — আচ্ছা সাবধানে যাস আর তাড়াতাড়ি ফিরিস বলে আবারও জাহির চৌধুরী আর তানভীর আহমেদ কথা বলাতে ব্যস্ত হয়ে যায়। কিন্তু জেসমিন চৌধুরী দোলার দিকে গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছেন। দোলা যাওয়ার আগে জেসমিন চৌধুরীর দিকে তাকায় একবার তারপর বেরিয়ে যায়। দোলারা বের হতেই জেসমিন চৌধুরী ফোন হাতে উঠে আসেন৷

–” রুদ্র আর রাজ অফিসের ক্যান্টিনে বসে আছে। রাজ রুদ্রর প্রতি কৃতজ্ঞ। রুদ্র সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে বলে আশাকে এত সহজে রাজ পেয়েছে৷ রাজ এই পর্যন্ত অসংখ্যবার রুদ্রকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। কিন্তু রুদ্র আছে তার চিন্তায়। দোলার শরীর দিন দিন খারাপ হচ্ছে। তাছাড়া দোলাকে তার মনের কথাটা এখনো বলে উঠতে পারেনি। কিভাবে বলবে সেটাও বুঝতে পারছে না।

— দোস্ত প্লিজ হেল্প কর আমাকে। আমি দোলাকে আমার মনের কথাগুলো কিভাবে জানাবো বুঝতে পারছি না। দোলার সামনে গেলে আমার কথা বন্ধ হয়ে যায়৷ এটা ওটা নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। আসল কথাটা বলতে চেয়েও পারিনা মলিন চেহারায় বলে রুদ্র। রাজ রুদ্রর মুখোভঙ্গি দেখে উচ্চ স্বরে হেসে বলে তুইও ভয় পাস রুদ্র৷ আমি জানতাম রুদ্রনীল চৌধুরীকে সবাই। কিন্তু রুদ্রনীল চৌধুরী যে তার মনের কথা বউকে জানাতে ভয় পাই জানতাম না৷

— খুব মজা নেওয়া হচ্ছে তাই-না। আমি আছি আমার জ্বালায় উনি এসেছেন মজা করতে। লাগবে না তোর বুদ্ধি। যা করার আমি করব মুখটা গম্ভীর করে বলে রুদ্র৷ রাজ হাসি থামিয়ে বলে আমিও তো এটাই চাই তুই কর সবটা। তুই ভাবিকে নিজের মনের কথা নিজের মতো করে জানা। অনেক তো হলো মান অভিমান রাগ জেদ। এবার এক সাথে থেকে জীবন টা শুরু কর। তোদের তো জীবন একসাথে জুড়ে গেছে অনেক আগে৷ এখন সেটা একসাথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্র‍য়াস। তাছাড়া সত্যি দোলা মেয়েটা অনেক ভালো। তুই অনেক ভাগ্য করে দোলার মতো একটা মেয়েকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিস৷ তাই বলব আর দেরি করিস না। মনের কথাটা জানিয়ে দেয়৷ বলে দে তুই দোলাকে ভালোবাসিস৷ সারাজীবন একসাথে থাকতে চাস৷ সব কিছু পেছনে রেখে সামনে এগিয়ে যেতে চাস।

— রুদ্র মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাজের দিকে তাকিয়ে আছে। রুদ্রও এখন বিশ্বাস করে! সত্যি সে অনেক ভাগ্য করে দোলার মতো একটা মেয়েকে জীবনে পেয়েছে। যে ভালবাসতে জানে৷ আগলে রাখতে জানে৷

— কিন্তু কিভাবে করবো দোস্ত এটাই বুঝতে পারছি না। করুণ স্বরে বলে রুদ্র।
– আরে তুই এত ভাবছিস কেনো। ভাবিকে নিয়ে বাইরে কোথাও যা৷ সব কিছু এরেঞ্জ কর ভাবির পছন্দ মতো। তারপর ফিল্মের হিরোদের মতো করে প্রপোজ করে দিবি। ব্যাস হয়ে গেলো।
— রাজের কথাটা রুদ্র ভালো লাগে। রুদ্র মুচকি হেসে বলে আইডিয়া পেয়েছি৷ আমি কালই দোলাকে আমার মনের অনুভূতি জানাবো। আমার ভালোবাসার প্রকাশ করবো।

— আচ্ছা তুই না বলেছিলি ভাবির শরীর খারাপ। কেমন আছে এখন? চিন্তিত কন্ঠে বলে রাজ৷ রুদ্র মুখটা ফ্যাকাসে করে বলে জানি না কি হয়েছে। তবে রিপোর্ট কাল আসলে তবে জানা যাবে। শরীর টা যে ভালো নেই বোঝা যায়। যখন তখন বমি করে জানিস। সাথে নাকি মাথাও ঘোরে। আমার মনে হয় শরীর দুর্বল। যার জন্য এমন সমস্যা। ঠিক মতো তো খাওয়া দাওয়াও করে না। সবার কেয়ার করার সময় আছে উনার৷ কিন্তু নিজের যত্ন নেওয়ার সময় যত অনিহা অভিমানী হয়ে বলে রুদ্র। রাজ মুচকি মুচকি হাসে রুদ্রর কথায়৷ যে মানুষটাকে সহ্য করতে পারতো না। তার জন্য আজ কত চিন্তা। ভালবাসা মানুষকে কতটা বদলে দিতে পারে। তার কত শক্তি একটা ভালোবাসার মানুষকে দেখলে বোঝা যায়।

———————————————-

— রত্না চৌধুরীর সাথে বসে আছে দোলা, তানিয়া। সজল বসে আছে একটা সোফায়। পরিবেশটা থমথমে। রত্না চৌধুরী কান্না করছেন। কারণ দোলা এসে জাহির চৌধুরী আর রুদ্রর ছোটবেলার ছবি দেখায় রত্না চৌধুরীকে। রত্না চৌধুরী ছবিটা দেখে চমকে উঠে দোলার দিকে তাকিয়ে ছিলো। এতদিন পর দুটি প্রিয় মুখ দেখে গাল গড়িয়ে পানি পড়ে আপন মনে। বুকের মধ্যে ধক করে উঠে সাথে। এতদিন পর এসে প্রিয় মানুষদের দেখবে ভাবিনি সে৷

–“” তানিয়া, দোলার চোখেও পানি। সজল মুখটা গম্ভীর করে রেখেছে৷ রত্না চৌধুরী শাড়ির আঁচল মুখে চেপে ধরে কান্না করছে।
— মা প্লিজ চুপ থাকবেন না। আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিন। আপনাকে ছাড়া আপনার সন্তান স্বামী কেউ ভালো নেই৷ আপনার সংসারে সুখ নেই। প্রতিনিয়ত সবাই ভালো থাকার অভিনয় করে যাচ্ছে৷ বাবা এখনো চোখের পানি ফেলে আপনার কথা ভেবে৷ আপনাকে এখনো অনেক ভালোবাসে মা৷

– দোলার কথায় রত্না চৌধুরীর কান্নাটা আরো বেড়ে যায়। রুদ্রর জন্য অনেক কষ্ট হচ্ছে তার৷ রুদ্র তো তার জীবনের সব কিছু। তাকে ছেড়ে এতদিন দূরে থাকতে হয়েছে তার।
– মামি বলো না! কেনো তুমি সব কিছু জেনেও দূরে সরে আছো৷ কেনো ফিরে যাওনি তোমার সংসারে৷ কেনো তোমাকে চলে আসতে হয়েছিলো বাড়ি ছেড়ে? আর তোমার কেনো এমন অবস্থা? প্লিজ মামি চুপ করে থেকো না৷ সবটা বলো। আমরা চাই সব কিছু স্বাভাবিক করতে৷ তোমাকে তোমার স্বামী সন্তানের কাছে ফিরিয়ে দিতে৷ আমরা সবাই একসাথে আবার নতুন করে বাঁচতে। তানিয়ার শেষের কথায় রত্না চৌধুরী মায়াভরা চোখে তাকায়। তানিয়া আশ্বস্ত দিয়ে বলে হ্যাঁ মামি৷ আমরা একসাথে থাকব। জিবনের বাকি সময়টা এক সাথে কাটাতে চাই৷ অনেক হয়েছে ভুল বোঝাবুঝি, প্রিয়জন থেকে দূরে থাকা। এবার সব কিছুর একটা সমাধান চাই।

–” সজল সোফা থেকে উঠে রত্না চৌধুরীর সামনে এসে হাটুমুড়ে বসে! রত্না চৌধুরীর একটা হাত মুঠোয় নিয়ে নরম স্বরে বলে, মামনী তুমি যদি না চাও তোমার সংসারে ফিরতে তাহলে তোমাকে কেউ জোর করবে না। আবার যদি তুমি চাও তোমার স্বামী সন্তানের কাছে ফিরে যেতে তাও বাধা নেই। কিন্তু আমি চাই তুমি মাথা উঁচু করে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়াও। ওদের ভাবনা গুলো ভুল প্রমাণ করে দিয়ে আসল অপরাধীকে সামনে নিয়ে এসো। যারা বা যে তোমার এই অবস্থা করেছে৷ তোমার জীবন থেকে ২২টা বছর কেড়ে নিয়েছে৷ তোমার স্বামী সন্তান থেকে দূরে রেখে কষ্ট দিয়েছে আমি তাদের প্রত্যেককে শাস্তি দিতে চাই। রক্তবর্ণ চোখ ধারণ করে বলে সজল।

— রত্না চৌধুরী সজলের মাথায় হাত রেখে ফুঁপিয়ে উঠে।
– মা বলুন না! কি হয়েছিলো সেদিন। আপনি কেনো দূরে আছেন এখনো সবার থেকে?

–‘ রত্না চৌধুরী একটু থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করে,

–” রুদ্রর বাবার সাথে আমার বিয়েটা সবাই মেনে নেওয়ার পরে আমরা বাড়িতে ফিরে আসি। এরপর আমাদের দিন অনেক ভালো ভাবে কাটছিলো। সবাই আমাদের মেনে নিয়ে অনেক খুশি ছিলো। শুধু জেসমিন আমাদের মেনে নিতে পারিনি। তার একটা আলাদা রাগ ক্ষোভ আমার উপর ছিলই। জেসমিন প্রায় বাবা মায়ের সাথে ঝামেলা করতো ( জাহির চৌধুরীর বাবা মা)। কারণ তারা আমাকে মেনে নিয়ে অনেক ভালো আছে তাই। মা জেসমিনকে বুঝাতেন। কিন্তু তারপরও সে জেদ নিয়ে থাকতো। এরপর রুদ্র হলে সবাই আরো খুশি হয় রুদ্রকে পেয়ে। জেসমিন রুদ্রকে সহ্য করতে পারতো না। এরপর রুদ্রর বয়স যখন পাঁচ বছর তখন ঘুমের মধ্যে মা চলে যান না ফেরার দেশে৷ মায়ের হঠাৎ মৃত্যু আমরা কেউ মানতে পারিনি। পরিবারে শোকের ছায়া নেমে আসে।

— বাবা ঠিক করেন বাবার সব সম্পত্তি রুদ্রর নামে দিয়ে যাবেন। আর কিছুটা দিবেন জেসমিনের নামে৷ কিন্তু জেসমিন এটা কোনো ভাবে মানতে পারে না৷ এই নিয়ে বাবার সাথে প্রায় ঝামেলা লেগে থাকতো তার৷ এর কোনো কিছুই রুদ্রর বাবা জানতেন না৷ আমি দেখতাম সবটা৷ বাবা বারণ করতেন রুদ্রর বাবাকে জানাতে৷ কারণ তিনি তার মেয়েকে অনেক ভালোবাসতেন। অনেক বোঝানোর চেষ্টা করতেন জেসমিনকে। কিন্তু জেসমিন চৌধুরী তার সিদ্ধান্তে অটুট।

–‘ রুদ্রর বাবা ব্যবসার কাজের জন্য বাইরে যায় এক মাসের জন্য। কথাটা বলে থেমে যায় রত্না চৌধুরী। এই দিকে তানিয়ার ভেতরে উথাল-পাতাল ঢেউ। নিজের মায়ের করা কুকর্মের কথা কোনো সন্তানের কাছেই ভালো লাগে না। তানিয়াও তার মায়ের এমন রুপ মানতে পারছে না। তানিয়া জানে তার মা লোভি খারাপ কিন্তু এটাটা ডেস্পারেট সেটা বুঝিনি।

-‘ রত্না চৌধুরী আবার বলতে শুরু করে।
– একদিন জেসমিন সম্পত্তির উইল করে সেটা বাবাকে দিয়ে সাইন করাতে চাই। সব সম্পত্তির মালিক সে একা হতে চাই। কিন্তু বাবা নারাজ৷ তার সিদ্ধান্ত মেনে নেয় না। বাবা জেসমিনের উপর রাগ করে ঘরে থেকে বেরিয়ে আসে। সিঁড়ি পর্যন্ত আসতেই জেসমিন চৌধুরী বাবাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় রাগের বশে। বাবার তৎক্ষানিক মৃত্যু হয় উপর থেকে পড়ায় স্টোক করেন তিনি। বাবার হার্টের সমস্যা ছিলো। রুদ্র স্কুলে গিয়েছিলো। আমি আর জেসমিন একা ছিলাম বাড়িতে। জেসমিন এমন একটা কাজ করবে আমি স্বপ্নেও কল্পনা করিনি৷ নিজের বাবাকে সে নিজ হাতে খুন করবে সম্পত্তির জন্য সত্যি ভাবিনি।

— আমি সব কিছুর সাক্ষী থাকায় জেসমিন আমাকে ভয় দেখায়৷ আমি যদি কাউকে কিছু বলি তাহলে সে রুদ্রর ক্ষতি করে দিবে। আমি সেদিন ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারিনি৷ জেসমিনের স্বামী তানভীর ছিলো অনেক ভালো মানুষ। সে জেসমিনের এইসব কাজ কখনোই সমর্থন করতেন না। জেসমিনকে বোঝাতেন তিনিও৷ কিন্তু জেসমিন কারো কথায় শুনত না। তানিয়া তখনো হয়নি। তানভীরও বাড়িতে ছিলো না সেদিন। তাই জেসমিন চৌধুরীর এইসব অপরাধ চাপা পড়ে যায়। জেসমিন তার মন গড়া সব সাজিয়ে তুলে ধরে সবার সামনে। আমি সবটা জানার পরও সেদিন নিরুপায় ছিলাম৷ কিন্তু মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম রুদ্রর বাবা আসলে সবটা জানিয়ে দেব আমি। বাবার মৃত্যুর কথা শুনে রুদ্রর বাবাও অনেক ভেঙে পড়েছিলেন। কাজ ছেড়ে আসতে পারিনি তাও তিনি।

— এরপর জেসমিনের কু দৃষ্টি আসে আমার উপর। আমাকে বাড়ি থেকে তাড়ানোর জন্য উঠে পড়ে লাগে৷ আমি রুদ্রর বাবাকে সব জানাতে চাইলে আমাকে তার সাথে কন্ট্রাক্ট করার কোনো সুযোগ দেয় না। আমি রুদ্রকে নিয়ে সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকতাম ওই বাড়িতে৷ রুদ্র ওর ফুপিকে অনেক ভালবাসতো। সব সময় ওর কাছে থাকতো৷ এতে আমার আরো বেশি ভয় হতো। যদি কোনো ক্ষতি করে দেয় রুদ্রর তখন।

–‘ একদিন জেসমিন কিছুলোক নিয়ে এসে আমাকে তাদের হাতে তুলে দেয় রাতের আঁধারে। রুদ্র ঘুমিয়ে গিয়েছিলো। আমি অনেক হাতে পায়ে ধরি জেসমিনের সেদিন৷ রুদ্র কে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো বলেছিলাম। তাও শুনেনি আমার কথা৷ নারীপাচারকারীর হাতে তুলে দেয় আমাকে। কথাটা বলে রত্না চৌধুরী উচ্চ স্বরে কেঁদে উঠেন। দোলা তানিয়াও অঝোরে কান্না করছে। সজলের হাতে মুঠো শক্ত হয়ে আসছে।
— জেসমিন আমাকে বলেছিলো আমি যদি কখনো ওইখান থেকে পালিয়ে আসার চেষ্টা করি তাহলে রুদ্রর সেদিনই নাকি শেষ দিন হবে । রুদ্রকেও মেরে দিবে৷ আমি সেদিন জেসমিনের কথাটা অবহেলা করতে পারিনি। যে মেয়ে সম্পত্তির জন্য নিজ হাতে বাবাকে খুন করতে পারে। তার দ্বারা সব সম্ভব।

— আমাকে নারীপাচারকারীরা নিয়ে গেলে জেসমিন চৌধুরী একা রাজ্যত শুরু করে। রুদ্রর বাবা ছিলো সরল মনের মানুষ। ওকে বুঝানো কোনো ব্যাপার ছিলো না জেসমিনের। তাছাড়া রুদ্রর বাবাও জেসমিনকে অনেক ভালবাসতো। একটা বোন তাই ভাইয়ের অনেক আদরের ছিলো।

— পাচারকারীরা আমাদের বিদেশে পাচার করতে চাইলে আমি সুযোগ বুঝে পালিয়ে আসি সেখান থেকে। কিন্তু আমার বাড়ি যাওয়ার সাহস হয়ে উঠিনি।।কারণ আমি ফিরে গেলে রুদ্রর ক্ষতি করে দিত জেসমিন। তাছাড়া জেসমিন ততদিনে রুদ্রর বাবাকে যা বোঝানোর বুঝিয়ে ফেলেছিলো আমার নামে। তাই আমি যদি গিয়ে কিছু বলতামও সে আমাকে বিশ্বাস করতো না। কিন্তু নারীপাচারকারীর লোক আমার পিছু ছাড়ছিলো না। জেসমিন চৌধুরীর নির্দেশে তারা আমাকে হন্নে হয়ে খুঁজতে থাকে৷ ওদের হাত থেকে পালাতে গিয়ে আমার এক্সিডেন্ট হয় ট্রাকের সাথে। এরপর আমার আর কিছু মনে নেই৷ যখন জ্ঞ্যান ফিরে তখন আমি নিজেকে হসপিটালে আবিষ্কার করি। সামনে ছিলো হাচান ভাই। (সজলের বাবা) সে আমাকে আপন করে আশ্রয় দেয়।। সজলের মতো একটা ছেলে উপহার দেয় আমাকে। সজলকে পেয়ে আমার রুদ্রর কষ্টটা একটু কম হয়৷ কিন্তু সব সময় আমার ছেলেটার জন্য চিন্তা হতো, কষ্ট হতো। কেমন আছে, আমি ছাড়া কি করছে৷ এই চিন্তায় থাকতাম সব সময়। জেসমিন আমার ছেলের সাথে খারাপ কিছু করেনি এইসব চিন্তা আমাকে সব সময় তাড়া করে বেড়াতো৷ আমি এক মুহূর্তের জন্য শান্তি পায়নি আমার সন্তানকে ছাড়া৷ ওর জীবন সংশয় আমাকে সব সময় তাড়া করে বেরিয়েছে। তারপরও আমি অসহায়, নিরুপমা ছিলাম। রত্না চৌধুরী শাড়ির আঁচলটা চেপে ধরে আবারও কেঁদে উঠে। তানিয়ার নিশ্বাস আটকে আসছে যেনো৷ দোলার মধ্যেও অস্থিরতা। একটা মানুষ এত জঘন্য হতে পারে জেসমিন চৌধুরীকে না দেখলে বুঝতো না।

— চলবে…

#তুমিময়_আসক্তি
#কলমে_আলো_ইসলাম

“৩২”

–“” এলোমেলো পায়ে হেঁটে চলেছে তানিয়া। সজলের বাড়ি থেকে দোলা আর তানিয়া বেরিয়ে এসেছে কিছুখন আগে। সব শোনার পর থেকে তানিয়া স্তব্ধ হয়ে গেছে। থমকে গেছে তার সকল অনুভূতি। তার মা নামক শব্দটার প্রতি এসেছে অনিহা। জেসমিন চৌধুরী যে তার মা এটা ভাবতেও তার গা যেনো ঘিনঘিন করছে। দোলা রত্না চৌধুরীকে আশ্বস্ত করে এসেছেন। সে সব ঠিক করে রত্না চৌধুরীকে তার পরিবারের মানুষের সামনে নিয়ে যাবে। দোলা রত্না চৌধুরীর সমস্ত কথা রেকর্ড করে নিয়েছে। সময়তে কাজে দিবে। তাছাড়া এবার জেসমিন চৌধুরীর মুখ থেকে সব স্বীকারোক্তি নেওয়া বাকি। শুধু রত্না চৌধুরীর কথায় সব টা প্রমাণ হয়না। জেসমিন চৌধুরীর নিজের মুখের স্বীকারোক্তি প্রয়োজন। তাই দোলা মনস্থির করে এবার জেসমিন চৌধুরীর মুখ থেকে সবটা বের করবে। কিন্তু কিভাবে করবে সেটাই বুঝতে পারছে না দোলা। তানিয়াকে দেখে দোলার ভীষণ খারাপ লাগছে। তানিয়া সব শোনার পর থেকে একটা কথাও বলেনি৷ বরফের ন্যায় জমে গেছে যেনো সে। শুধু নিশ্বাসটাই যেনো চলছে বেঁচে থাকার তাগিদে এমন ভাব। দোলা আর তানিয়া পাশাপাশি রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। দোলা রিকশা ধরতে চাইলে তানিয়া হেঁটেই বেরিয়ে আসে। তার কোনো কিছুতে খেয়াল নেই। দোলা এই ভয়টাই পেয়েছিলো। তানিয়া সব শোনা বা জানার পর মানতে পারবে না। তাই দোলা একাই সবটা করতে চেয়েছিলো। যাতে করে তানিয়াও পরে জানতে পারে সবার সাথে সবটা। কিন্তু দোলা তানিয়া ছাড়া বের হতে পারতো না৷ সবাই তাকে সন্দেহ করতো। তাছাড়া জেসমিন চৌধুরীর কর্মকাণ্ড দোলার কিছুদিন যাবত ভালো ঠেকছে না৷ তাই তানিয়াকে পাশে রাখা৷ কিন্তু জেসমিন চৌধুরীর এমন খারাপ রুপ বেরিয়ে আসবে ভাবেনি দোলা৷ জেসমিন চৌধুরী এত জঘন্যতম খারাপ হতে পারে সেটা দোলার কল্পনার অতিত ছিলো।

— থামো তানিয়া! তানিয়ার ধরে থামিয়ে দিয়ে বলে দোলা। এরপরও তানিয়া কোনো রিয়াকশন দেখায় না৷ দোলার দিকে একবার তাকিয়ে অন্য দিকে তাকায়৷ ঠোঁট দুটি মৃদু কাঁপছে তানিয়ার৷ হয়তো কান্না আটকানোর ফল এটা৷ দোলার বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠে তানিয়াকে এইভাবে দেখে৷ চোখ লাল টকটকে হয়ে গেছে৷ কান্না গুলো ভেতরে জমে থাকার ফল এটা।
–” এরপর দোলা একটা রিকশা ডেকে তানিয়াকে নিয়ে উঠে পড়ে। আপাতত তানিয়াকে কিছু বলতে চাইনা সে রাস্তায়। তানিয়ার মনের অবস্থা অনেক খারাপ। একটু সময় তাকে দেওয়া উচিত নিজেকে সামলানোর জন্য।

–” রুদ্র অফিসে বসে আছে৷ মনে মনে ভীষণ খুশি সাথে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি আনমনেই। দোলাকে সে আজ প্রপোজ করবে। তার সব রকম ব্যবস্থা হয়ে গেছে৷ দোলাকে কিছু জানাতে চাইনা রুদ্র আপাতত। দোলাকে নিয়ে হঠাৎ চমকে দিবে এটাই প্ল্যান রুদ্রর৷

— আমি জানি তুমি চমকে যাবে। অবিশ্বাস্য চোখে হয়তো তাকিয়েও থাকবে। তোমার কৌতুহল ভরা দৃষ্টি আমাতে আবদ্ধ রবে। আমি সেটা মুগ্ধ হয়ে দেখব। তোমার কৌতুহল নিয়ে ভ্রু কুচকে আসা চাহনি, অবাক হয়ে তাকানো, কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে অসমাপ্ত বাক্য! সব কিছু আমি ফিল করতে চাই নিরব চাহনি নিয়ে। মনে মনে কথাগুলো বলে মুচকি হাসে রুদ্র। তারপর কাজে মন দেয়। সব কাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি বের হতে হবে আজ তাকে৷

–” তানিয়া এসে ঘরে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে৷ দোলা তানিয়াকে বিরক্ত করেনি৷ সে জানে তানিয়ার ভেতর এখন কি চলছে৷ তানিয়া কিছু সময় একলা থাকা দরকার। জেসমিন চৌধুরী তানিয়ার কাজে অবাক হয়। সে তানিয়াকে পিছু ডাকে কিন্তু তানিয়া তাতে সাড়া দেয় না। এতে জেসমিন চৌধুরীর সন্দেহ হয় একটু। হঠাৎ কি হলো তানিয়ার বুঝতে পারছে না।

–“” রুদ্র সব কাজ শেষ করে দোলাকে ফোন দেয়। রেডি হয়ে থাকতে বলে দোলাকে। রুদ্র এসে তাকে নিয়ে বের হবে। দোলা অনেকবার জিজ্ঞেস করলেও বলেনি রুদ্র। রেডি থাকতে বলে ফোন কেটে দেয়। রুদ্র কিছু ইমপোর্টেন্স ফাইল ব্যাগে নিয়ে বের হতে যাবে তখনই একটা পার্সেল আসে তার। রুদ্রর পিএ একটা খাম দিয়ে যায় রুদ্র কাছে। বলে কুরিয়ার থেকে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু কোনো নাম ঠিকানা নেই খামের উপর। রুদ্র ভ্রু কুচকে ভাবে কে, কি পাঠাতে পারে। এমন কোনো খাম আসার কথা তো ছিলো না। বের হওয়ার সময় এমন একটা ঝামেলা আসায় রুদ্র খানিকটা বিরক্ত হয়। ব্যাগ টা টেবিলে রেখে খামটা খুলে দেখতে থাকে।

— খামটা খুলে দেখতেই রুদ্র পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়। হাত থেকে পড়ে যায় খামের মধ্যে থাকা বস্তুটি । রাগে হাতের মুঠো শক্ত হয়ে আসে। চোখ দিয়ে যেনো আগুনের বারুদ ছুটছে৷ খামের মধ্যে সজল আর দোলার ঘনিষ্ঠ অবস্থার ছবি। সজল দোলা পার্কে বসে হেসে কথা বলছে তার ছবি৷ সজল দোলাকে ধরে আছে তার ছবি আছে৷ সব কিছু দেখে রুদ্র আর নিজেকে স্থীর রাখতে পারে না৷ ছবি গুলো হাতে নিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে আসে অফিস থেকে।

–“” দোলা রেডি হচ্ছে। রুদ্র তাকে নিয়ে কোথাও যাবে ভাবতেই হাসি আসছে দোলার৷ কিন্তু কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাকে দোলা এটা বুঝতে পারছে না৷ তানিয়ার জন্য মন খারাপ ছিলো দোলার৷ এখন মনটা হাল্কা লাগছে৷ কিন্তু তানিয়া এখনো তার রুম থেকে বের হয়নি৷ দোলা কয়েকবার গিয়েছিলো তানিয়াকে ডাকতে। কিন্তু তানিয়া একা থাকতে চাই বলে ফিরিয়ে দিয়েছে দোলাকে। দোলাও তাই আর বিরক্ত করেনি তানিয়াকে।
–” সময়টা গোধুলী লগন। সূর্য তার গন্তব্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে ডুব দেওয়ার জন্য। দিনের আলোকে গ্রাস করে রাতের আঁধার ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য।
– দোলা রেডি হয়ে অপেক্ষা করছে রুদ্র জন্য। যত সময় যাচ্ছে তত অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে দোলার মধ্যে। দোলা তানিয়ার রুমের দিকে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হয় আবার৷ মেয়েটা সারাদিন রুমে বসে আছে খাওয়া দাওয়া করা নেই৷ তার বাবা চিন্তা করছে। জেসমিন চৌধুরীও সন্ধিহান হয়ে আছে। রুদ্র আসার আগে দোলা তানিয়ার সাথে কথা বলে যেতে চাই। দোলা তার ঘর থেকে বের হতেই রুদ্র চিৎকার করে ডেকে উঠে দোলাকে৷ যে ডাকের মধ্যে নেই কোনো মলিনতা, না আছে স্নিগ্ধতা। শুধু কঠোরতাই বিরাজমান। দোলা কেঁপে উঠে রুদ্রর এমন চিৎকারে। বাড়ি শুদ্ধ সবাই অবাক রুদ্রর আকস্মিক বিহেভে। জাহির চৌধুরী, তানভীর আহমেদ, জেসমিন চৌধুরী যে যার রুম থেকে বেরিয়ে আসে রুদ্রর চিৎকার শুনে৷ তানিয়াও দরজা খুলে বের হয় এবার৷ দোলা ভয়ার্ত চোখে এগিয়ে যায় রুদ্র দিকে। আজ আবারও দোলার ভয় করছে রুদ্রকে দেখে৷ দোলা সেই আগের রুদ্রকে উপলব্ধি করতে পারছে৷ সে হিংস্র রুদ্র আজ দোলার সামনে দাঁড়িয়ে আছে চোখ লাল করে। রাগের বহিঃপ্রকাশ শুধু রুদ্র চোখে নয়! সারা মুখোমন্ডল জানান দিচ্ছে ললাট বর্ণ হয়ে।

— কি হয়েছে? আপনি এইভাবে চিৎকার করছেন কেনো হীনস্বরে বলে দোলা। কন্ঠে তার ভয়, চোখ মুখে আশঙ্কা। রুদ্র রাগী লুকে দোলার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুখন। উপস্থিত সবাই রুদ্র দিকের স্থীর চোখে তাকিয়ে আছে৷ হঠাৎ কি হলো কিছুই বুঝতে পারছে না কেউ। জেসমিন চৌধুরীর ঠোঁটের কোণে শয়তানি হাসি। সবাই চিন্তিত লুকে থাকলেও সে বেশ আয়েশে আছে৷ তানিয়াও কৌতুহলী হয়ে তাকিয়ে আছে।

–” রুদ্র দোলার দিকে ছবি গুলো ছুড়ে মারে। দোলার গায়ে লেগে ছবি গুলো ফ্লোরে ছড়িয়ে যায়। সবাই সে ছবির দিকে তাকিয়ে থমকে যায়। সজল আর দোলা একে অপরেকে ধরে আছে৷ তানিয়া সজলকে চিনলেও বাকিরা কেউ সজলকে চিনে না৷ তাই তাদের আগ্রহ এবং কৌতুহল দুটোই অনেক বেশি আকার ধারণ করে।
– দোলা ছবি গুলো দেখে আঁতকে উঠে। আগের চেয়ে দ্বিগুণ ভয়পুর্ণ চোখে তাকায় রুদ্র দিকে। তবে দোলার একটু অসুবিধা হয়না এইসব কাজ কে করেছে৷ কিন্তু আপাতত এইসব নিয়ে ভাবার সময় নয়। রুদ্রকে বুঝাতে হবে তাকে।
— আমি এই জন্য তোমাদের মতো মানুষকে ঘৃণা করতাম। তোমরা কখনো ভালো হতে পারো না। লোভী, দুশ্চরিত্র, তোমরা৷ মানুষকে ঠকানো তোমাদের কাজ। ঘরে স্বামী রেখে পরকিয়া করে বেড়াও ছিহ ধিক্কার দিয়ে বলে রুদ্র। রাগে রুদ্রর শরীরের মধ্যে রিরি করছে। দোলাকে একদম সহ্য হচ্ছে না তার সামনে৷

— রুদ্রর একেকটা কথায় দোলা যেনো তলিয়ে যায় অন্ধকারে। প্রবলভাবে আঘাত করে দোলাকে। থমকে যাওয়া চোখে তাকিয়ে থাকে রুদ্রর দিকে। মুখ দিয়ে কোনো কথায় বের হচ্ছে না তার। অনেক কিছু বলতে চেয়েও কোনো কথা আসে না৷ তানিয়াও কম অবাক হয়নি ছবি গুলো দেখে। ভীষণ রকম শক পেয়েছে সে। ছবি গুলো রুদ্রর কাছে কে দিলো? কে তুলেছে সেটা বুঝতে পারছে না তানিয়া। তানিয়া তার মায়ের দিকে তাকায়। জেসমিন চৌধুরী বেশ সাবলীল ভাবে আছেন । দেখে মনে হচ্ছে তিনি আগে থেকে জানতেন এমনটা হবে। তানিয়ার ঘৃণার পরিমাণটা বেড়ে যায় তার মায়ের প্রতি।

— দোলা তোমার সাথে ছেলেটা কে? আর এইটা কবেকার ছবি? কে তুলেছে এই ছবি? অতিব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে জাহির চৌধুরী। তিনিও অবাক হয় দোলার সাথে অন্য ছেলেকে দেখে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না দোলা এমন কিছু করতে পারে৷ তানভীর আহমেদ গভীর চাহনি নিয়ে সবটা বোঝার চেষ্টা করছে৷ দুদিনে দোলাকে তিনি যতটা দেখেছে, জেনেছে! তাতে দোলা এমন ধরনের মেয়ে নয়। তাহলে এই ছবি গুলো কোথায় থেকে আসলো। তানভীর আহমেদও জেসমিন চৌধুরীর দিকে তাকায় এবার।

— কি বলবে ড্যাডি ও৷ কি বলার আছে। নিজ মুখে ওর কুকর্মের কথা কীভাবে বলবে তোমাদের। তুমি না খুব ভরসা করতে ওকে। বিশ্বাস করতে৷ আমার জন্য ওকে নিয়ে এসেছিলে এ বাড়িতে। বাড়ির বউয়ের মর্যাদা দিয়েছো৷ দেখো ড্যাডি তোমার ভরসার পাত্রির অবস্থা। তোমাদের বিশ্বাস নিয়ে খেলেছে সে। আমাকে নিয়ে উপহাস করেছে। আমার জীবনে সাথে নাম জুড়ে অন্য জায়গায় পরকিয়া করে বেরায় সে। কিন্তু এই রুদ্রনীল চৌধুরী কে ফাঁকি দেওয়া এত সোজা নয়। কি ভেবেছে ও। এইসব করে বেড়াবে আর আমি জানতে পারবো না। দিনের পর দিন ভালো সাজার অভিনয় করে আমাদের ঠকিয়ে যাবে৷ আমি তা হতে দিব না৷ কোনো স্বার্থপর, বেইমানের জায়গা নেই এই বাড়িতে৷ আই হেট ইউ! আই হেট এ গার্ল লাইক ইউ। আই হেট ইউ দ্যা মোস্ট।

— রুদ্রর এই কথাটাই দোলা পিছিয়ে যায় দু কদম। চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। দৃষ্টিটা রুদ্রতেই আবদ্ধ আছে। রুদ্র চোখ ফিরিয়ে নেয় দোলার দিক থেকে।

– আমি আগেই জানতাম এই মেয়ে সুবিধার নয়। শুধু মাত্র সম্পত্তির জন্য এইবাড়িতে এসেছে৷ ওদের মতো মেয়ে কাউকে ভালোবাসতে জানে না। সংসার করতে জানে না। লোভ বুঝলি রে রুদ্র। লোভে ওরা এর থেকে ওর কাছে ছুটে বেরায়। বড়লোকের ছেলেদের ফাঁসায়। দেখ ওই ছেলেটা হয়তো বড়লোক। তাই ওকেও ফাঁসিয়েছে। কি ধুরন্ধর মেয়েরে বাবা। স্বামী থাকা সত্ত্বেও আরেকটা রিলেশন করা৷ সাহস বলিহারি তোমার বাপু নেকা স্বরে বলে জেসমিন চৌধুরী। তানিয়ার রাগ হয় এতে ভীষণ । আর চুপ থাকতে পারে না।
– শাট আপ মা। একদম বাজে বকবে না৷ বউমনি কিছু করেনি। এই গুলা সত্য নয়। বউমনিকে ফাঁসানো হয়েছে। আর সেটা তু… তার আগে দোলা থামিয়ে দেয় তানিয়াকে হাত উঠিয়ে। তানিয়া দোলার কাছে এগিয়ে গিয়ে দোলার দুই বাহু ধরে ঝাকিয়ে বলে তুমি চুপ করে কেনো আছো বউমনি? কেনো কিছু বলছো না তুমি? এই গুলা যে সত্যি নয় সেটা তুমি খুব ভালো করে জানো। তাহলে কেনো সবটা মুখ বুজে মেনে নিচ্ছো।
— দোলা এখনো চুপ করে আছে। কি বলবে সে এই মুহূর্তে। আর বললেও কেনো বিশ্বাস করবে তাকে। তাছাড়া রুদ্র তো বলেই দিয়েছে তাকে ঘৃণা করে। তাহলে কি লাভ কিছু বলে। নিজেকে নির্দোষ করে কি হবে?

– তানিয়া এবার রুদ্র সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
– ব্রো তুমি মাথা ঠান্ডা করো৷ আমার কথা গুলো একবার শুনো। এই গুলা একটাও সত্য নয়। সব সাজানো মিথ্যা। বউমনি অনেক ভালো মেয়ে। ও কাউকে ঠকায়নি! ঠকাতে পারে না৷ আমি তোমাকে সবটা বুঝিয়ে বলছি তাহলে দেখবে সবটা ক্লিয়ার হয়ে যাবে তোমাদের কাছে।
– স্টপ তানি৷ আমাদের মাঝে তুই একটাও কথা বলবি না। আজ আমি বলব তোরা শুনবি। অনেক বলেছিস এতদিন। অনেক বুঝিয়েছিস৷ এবার আমাকে আমার কথা বলতে দে৷ এরপর রুদ্র দোলার সামনে এসে দাঁড়ালে৷ দোলা ছলছল চোখে রুদ্রর দিকে তাকায়।
– রুদ্র দোলার হাত চেপে ধরে। কব্জির একটু উপরে শক্ত করে চেপে ধরে গম্ভীর কন্ঠে বলে এক সপ্তাহের মধ্যে আমি তোমার বাড়িতে ডিভোর্স পেপারে পাঠিয়ে দেবো। তোমার মতো ঠক প্রতারকের জায়গা এই বাড়িতে নেই৷ তোমার মতো কল গার্লের সাথে এই রুদ্রনীল চৌধুরীর কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। গেট আউট মাই হোম।

— দোলার নিশ্বাস আটকে আসছে৷ রুদ্রর বলা কল গার্ল শব্দটা বারবার কানে বাজছে৷ ভেতর থেকে ভেঙে চুড়ে দিচ্ছে এই শব্দটা। দোলা অনুভুতি শুন্য হয়ে গেছে৷ তানিয়া অবাক চোখে তাকিয়ে আছে৷ জাহির চৌধুরী হতাশ হয়ে সোফায় বসে পড়েছেন তানভীর আহমেদের খারাপ লাগে অনেক দোলার জন্য। আর জেসমিন চৌধুরী জয়ের হাসি মুখে ঝুলিয়ে আছে।

— রুদ্র দোলাকে ধরে বাড়ির বাইরে ধাক্কা মেরে বের করে দেয়। দোলা এতেও কোনো রেসপন্স করে না। দোলাকে বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয় রুদ্র। থমথমে পরিবেশ। সবার মনের মধ্যে কালবৈশাখী ঝড় বয়ছে৷ রুদ্রর মধ্যে সব থেকে বেশি কষ্ট হচ্ছে। দোলাকে সে ভালোবেসে ছিলো। সবার থেকে আলাদা ভেবেছিলো। কিন্তু এই মানুষটাও তাকে ঠকালো। রুদ্র দুইহাতে চুল ঠেলে ধরে পেছনে।

— অনেক বড় ভুল করলে ব্রো। এর জন্য তোমাকে অনেক পশ্চাতে হবে। বউমনি নির্দোষ৷ এখনো সময় আছে বউমনিকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো প্লিজ। রুদ্র তানিয়ার কথায় পাত্তা না দিয়ে হনহন করে উপরে চলে যায়। তানিয়া জাহির চৌধুরীর সামনে গিয়ে হাত জোর করে বলে মামু তুমি তো বউমনিকে চেনো। ও এমন কোনো কাজ করতে পারে বলে তোমার মনে হয়। বউমনি নির্দোষ। তুমি ব্রোকে বোঝাও মামু। ব্রো অন্যায় করছে বউমনির সাথে। জাহির চৌধুরী কোনো উত্তর দেয় না তানিয়ার কথায়। তানিয়া নিরাশ হয়ে ফিরে আসে। ছুটে ঘরে চলে যায় তার৷ জেসমিন চৌধুরী আজ খুব খুশি। অনেক আনন্দ হচ্ছে তার মধ্যে। তার পথের কাঁটাকে সরাতে পেরে ভীষণ খুশি সে।

— একটু পর ভাঙচুরের শব্দ আসে রুদ্রর ঘর থেকে। সবাই চমকে উঠে তাতে। জাহির চৌধুরী ব্যথিত চোখে উপরে তাকায় একবার৷ তানভীর আহমেদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বসে যায় একটা সোফায়। সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেলো আবার। সে পুরোনো ইতিহাস আবার পুনরাবৃত্তি হলো আজ৷

— এলোমেলো পায়ে হেঁটে যাচ্ছে দোলা। রুদ্রর বলা প্রতিটি কথা দোলার কানে এখনো বাজছে। মনে হচ্ছে রুদ্র এখনো সামনে থেকে সব কথা গুলো বলছে তাকে। দম বন্ধ হয়ে আসছে দোলার৷ সব কিছু এমন ভাবে এলোমেলো হয়ে যাবে ভাবিনি। জেসমিন চৌধুরী তার সাথে এত জঘন্য খেলা করবে কল্পনাও করেনি দোলা।
– দোলার রুদ্রর উপর রাগ ক্ষোভ অভিমান পাহাড় সমান জমা হয়। একটিবারের জন্য তাকে বিশ্বাস করতে পারলো না। চোখের দেখায় সব তার কাছে। একবার জানতে চাইলো না আসল সত্যিটা কি৷ আর পাঁচটা খারাপ মেয়ের সাথে আমাকেও তুলনা করলো৷ অনেক হয়েছে। অনেক সহ্য করেছি৷ আর ফিরতে চাইনা আমি ওই মানুষটার কাছে৷ যার মধ্যে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই আমার প্রতি তার সাথে আমি চাইনা থাকতে। লাগবে না এমন মানুষকে৷ আমি তো আমাকে নির্দোষ প্রমাণ করব সাথে জেসমিন চৌধুরীকেও আমি শাস্তি দেবো। কিন্তু আপনার কাছে আর কখনো ফিরবো না ছোট সাহেব। আপনি ভালো থাকুন৷ আমার মতো খারাপ মানুষের ছায়াও আর পড়বে আপনার উপর। দোলা এই সব মনে মনে বলে আর অঝোরে কান্না করছে। দোলার চোখের পানিরাও আজ বাধ মানে না। দোলা চেষ্টা করেও যেনো তাদের সামলাতে পারছে না৷ ভীষণ কষ্ট হচ্ছে দোলার৷ ওই বাড়ির প্রতিটি মুখের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠছে তার সামনে। সবার সাথে কাটানো সময় গুলো খুব করে যন্ত্রণা দিচ্ছে তাকে। দোলা তার বাড়ির দিকে অগ্রসর হয় এক আকাশ অভিমান, এক সমুদ্র ক্ষোভ, অনবরত বহমান বাতাসের ন্যায় তীব্র নিরাশা, ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন নিয়ে।

– চলবে.