তোকে ঘিরে পর্ব-২২+২৩

0
1116

#তোকে_ঘিরে❤
#পর্ব_২২
#ফাবিয়াহ্_মমো🍁

রাতের আটটা বাজে কে আমাকে কল দিয়ে ভুজং ভাজং প্রশ্ন করবে? সিক্সথ্ সেন্স বলছে লোকটার জবাব দিস না! বাজেভাবে বিপদে পরবি! লোকটা আমার চুপটি পেয়ে হ্যালো হ্যালো করে চেচিয়ে বললো,

– এই যে মিস! আমার হাতে সময় নেই! কে আপনি! কি পরিচয় ইন্সটেন্টলি আন্সার দিন!
– আশ্চর্য তো! কে আপনি সেটা আগে বলুন!
– ওয়েল, আমি কোনাবাড়ি থেকে কল করেছি। চিনেন জায়গাটা?
– বড় তাজ্জব লোক দেখছি! আপনি কোথায় আছেন সেটা আমি কিভাবে বলবো? আপনি কি নেশা করে কল দিয়েছেন?

আমার হালকা চেচানো শব্দ পেয়ে শ্রেয়া চট করে ঘুম ঠেলে সচকিত কন্ঠে বলে উঠলো,

– পূর্ণতা কোনো সমস্যা হয়েছে? ফোনে কে?
আমি ঠোট উল্টিয়ে বুঝালাম দোস্ত জানিনা। শ্রেয়া চোখ কচলে আমার হাত থেকে ফোন নিয়ে কানে ধরে বলে উঠলো,

– রাতের বেলা পিরিতি করার জন্য মেয়েকন্ঠ খুঁজিস?চড়িয়ে গাল ফেটে দিবো বদমাইশ! ফোন রাখ নইলে…

শ্রেয়ার চটান চটান কথা শুনে ওপাশের অপরিচিত লোকটা কি বললো শুনিনি শ্রেয়ার মুখ তেলাপিয়া মাছের মতো হা হয়ে গেল। আমি ভ্রুকুচকে প্রচণ্ড কৌতুহলে মাথা ঝাকিয়ে বোঝাই কি হয়েছে? ও আমার দিকে খুবই রুগ্ন ব্যক্তির মতো কাপা হাতে আস্তে করে ফোন বারিয়ে দিলো। ওর ঠোঁট কাপঁছে, চোখের কোটরে ভীষন উত্তেজনায় স্থির হয়ে আছে, একনাগাড়ে ঢোক গিলছে! আমি আবার ফোন কানে লাগিয়ে কিছু বলবো হঠাৎ কলের বিপরীতে তার কন্ঠস্বর পেয়ে রীতিমতো আমি বাকরুগ্ধ! আমার জিভটা পর্যন্ত নড়ছেনা! শরীরে আচমকা দূর্বল বোধ গ্রাস করেছে। ব্যথিত গলায় কাশতে কাশতে বলে উঠলো পূর্ব,

– হ্যালো? আমার শেষ ইচ্ছাটা শুনবে না? না শুনিয়ে মরে গেলে আমার আত্মা মেবি শান্তি পাবেনা। বলবো?

আকাশের মস্ত বড় গোলাকার চাদঁটা রাতের আধারে একা বিষন্ন উদাসীন লাগছে। আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় তখন বেকায়দায় চলছে মাথা ঘুরাচ্ছে শরীরটা শীতের প্রকটের মতো দুলছে। আমার নার্ভ কর্মক্ষমতা হারানোর জন্য তড়িঘড়ি করছে টের পাচ্ছি তবুও আমি শতচেষ্টা করে কথা বলার নূন্যতম শক্তি জোগাতে পারছিনা। ফোনের ওদিকটায় ঘন ঘন নিশ্বাস জোরালো হয়ে তীব্রতায় শোনা যাচ্ছে মনেহচ্ছে দীর্ঘসময় জুড়ে ওকে কেউ পিটিয়েছে। চোখ থুবড়ে কান্নায় ছলছল হয়ে গাল ভিজে যাচ্ছে আমার সেদিকে ধ্যান নেই। সে স্মিতস্বরে থেমে থেমে বলে উঠলো,

– এই মেয়ে? কিছু তো বলো? আমার চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই সেন্সলেস হবো।

চোখ বন্ধ করে বুকের ঢিপঢিপ ছন্দের কাছে নিজের বাঁ হাত রাখলাম কানে ধরা ফোনের হাতটা ক্রমান্বয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। আমার বুকটা বেকাবু ভঙ্গিতে ধুকপুক করছে। আমি শ্বাসকার্য চালানোর জন্য মুখ হা করে শ্বাস টানছি। চলন্ত ট্রেনটা আরো মাতানো স্পিড দিয়ে পো পো সাইরেন বাজিয়ে চলছে। জানালায় কপাল ঠেকিয়ে হাত পিছনে ঘুরিয়ে শ্রেয়ার দিকে ফোন ছেড়ে দিতেই আমি চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিলাম। রাতেরবেলা আমার ফোনে আসা এই কলটার সারমর্ম একটু আধটু বের করলাম। পূর্ব যেখানে গিয়েছে হয়তো ওই জায়টার নাম কোনাবাড়ি। যে লোকটা আমায় কল করেছে হতে পারে সে রাস্তার কোনো পথচারী যে পূর্বকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে সাহায্য করতে এসেছে এবং পূর্ব তাকে অনুরোধ করেছে আমায় কল করতে। অপরিচিত লোকটা আমাদের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত উত্তর পেয়ে পূর্বের কাছে ফোন দিয়ে দিলে পূর্ব কথাগুলো বলে উঠে। আমার অবচেতন মন পুরো ঘটনার সমীকরণ মিলিয়ে দিলো। পাশ থেকে শ্রেয়া আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করছে পূর্ব আমায় কি বলেছে? আমি চোখ বন্ধ করে তন্দ্রাচ্ছন্ন গলায় বলে উঠলাম,

– কিছুই বলেনি। বলেছে, পূর্ণ ভালো আছো? আমিও বলেছি হ্যাঁ সুস্থ আছি। একটুকুই।

শ্রেয়া চরমভাবে অবাক হয়ে বললো,

– আমার বিশ্বাস হচ্ছে না পূর্ব ভাইয়া তোকে এগুলো বলেছে! উনার ভয়েস অন্যরকম লাগছিলো পূর্ণতা!
– লাগতেই পারে স্বাভাবিক। এতে সিনক্রিয়েট করিস না।

মানুষের উচিত স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক আচরন করা এবং অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অস্বাভাবিক আচরন। যেমন শোকের মাতমে হাসাহাসি করলে বেমানান।তেমনি চরম আনন্দের মূহুর্তে বেকায়দায় রাগারাগী করলে দৃষ্টিকটু। শ্রেয়া আমার নরমাল বিহেভটা নিতে পারছিলো না একদমই। ও আমার হাত চেপে কাতর গলায় বলে উঠলো,

– তুই ঠিক আছিস? মিথ্যে অভিনয় কাকে দেখাচ্ছিস? আমাকে অন্তত সত্যটা বল, ভাইয়া তোকে কি বলেছে। আমার মন মানছে না পূর্ণতা। নিজের দু’কানে শুনেছি ভাইয়া ঠেলে ঠেলে বলছিলো, ‘প্লিজ পূর্ণতার কাছে ফোনটা দাও’।

আমি কোল থেকে ওর হাত সরিয়ে ঘাড়টা ডানদিকে কিন্ঞ্চিত ঘুরিয়ে তাকালাম,

– বললামতো পূর্ব আমাকে ভালো আছো জিজ্ঞেস করেছে। উনি ঘুম থেকে উঠলে ওরকম গলায় কথা বলেন টেনশন নেওয়ার কিছুই হয়নি।
শ্রেয়া সন্দেহজনক গলায় বললো,
– সত্যি তো?
– সত্যি।
– তুই সিউর দিচ্ছিস বলে বিশ্বাস করলাম। কয়টা বাজে? ট্রেন এখন কোন স্টেশন কভার করলো?
– পিয়ারপুর। সামনে জামালপুর আসছে।
– পৌছতে অনেক দেরি আছে। দেওয়ানগন্জ আসতে আসতে আরেকচোট ঘুমানো যাবে। আমি ঘুমাই।

হাই তুলতে তুলতে ঘুমিয়ে পরলো শ্রেয়া। আমার চোখ বন্ধ হলেও গাল ভিজে যাচ্ছিলো। ওড়নাটা মোচড়াতে মোচড়াতে আঙ্গুলের সাথে পেচিয়ে ধরেছি। শ্রেয়ার কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে চিন্তা করছি কল করবো কিনা। কপালে হাত রেখে জানালার দিকে মুখ করে কললিস্টে ঢুকে নিচের দিকে স্ক্রল করলাম। স্ক্রিনের উপর লিখা উঠলো, ‘Purbika apu’। কল অপশনে ক্লিক করে কানে ফোন লাগিয়ে কয়েকটা টোন না যেতেই রিসিভ করলো আপু,

– ওহ্ পূর্ণতা এখন কোথায় আছো? ট্রেন কোন্ স্টেশনে? আসতে কতদূর?

আমি মুখে হাত রেখে কান্না আটকাচ্ছি তবুও বাধ মানছেনা। আপু কিছুক্ষণ চুপ থেকে কি বুঝলো জানিনা হঠাৎ উনিও অপ্রকৃতিস্থ কন্ঠে বলে উঠলো,

– পূর্ণতা কিছু কি হয়েছে? আমায় বলো! তুমি চুপ আছো নিশ্চিত কিছু সিরিয়াস কেস আছে!
– আপু একটু আগে কল এসেছিলো,
– পূর্ব কল দিয়েছে? কি বলেছে হারামি? তুমি আগে কান্না থামাও তো। কান্না করছো কেন? চুপ চুপ।
– আপু আমার ভালো লাগছে না…
– ইশ কি যে করি! পূর্ণতা তুমি দেওয়ানগন্জ স্টেশনে নামো। আমি তোমাকে আমার কাছে আনছি।
– আমাকে যাওয়ার পারমিশন দিবেনা আপু…বিয়ের আগে ওখানে যাওয়া নিষেধ বলেছে।
– সেটা দেখার দায়িত্ব আমার। তুমি এলে তখনই শুনে নিবো ওই পূর্ব তোমায় কি বলে কাঁদিয়েছে!
– ও ভালো নেই আপু…
– ও জাহান্নামে যাক! ওর কথা আমায় বলতে এসো না! ওকে কতবার করে বোঝালাম এইসব ছাইপাঁশ রাজনীতি ছেড়ে বাবার ব্যবসাটা ধরে ফেল। আমার কথা আমলে নিয়েছে? আমলেই নেয়না! মুখ ব্যথা হয়ে গেল ওকে বোঝাতে বোঝাতে! এখন তুমি কান্না করো না, আমি সব দেখছি কেমন? তুমি আগে পৌছাও..পৌছে ফোন কর।

পূর্ণতা কল কেটে জানালায় দুহাত রেখে হাতের উপর গাল লাগিয়ে দিলো। চোখ থেকে থেমে থেমে পানি গড়িয়ে হাতের উপর পরছে। ট্রেনের বেগতিক স্পিডে জানালা দিয়ে হু হু করে বাতাসের ঝাপটানি পূর্ণতার মুখের উপর আসছে। পূর্ণতা চোখ মেলে বহুদূরের জোৎস্না স্নাত গাছপালা দেখছে। পূর্ব কি এখন ভালো আছে? ওর শেষ ইচ্ছাটা আজও শোনা সম্ভব হলো না পূর্ণতার। কিছু বলার আগেই পিনপতন নিরবতায় আচ্ছন্ন করেছিলো ওপাশ। শেষ কথাটুকু চুড়ির রিনঝিন শব্দের মতো সতেজ হয়ে বাজছে, ‘আমার চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই সেন্সলেস হবো’ — পূর্ণতা চোখ কুঁচকে ঠোঁট কামড়ে কান্নার আর্তনাদ আটকায়। মানুষটা নিশ্চয়ই ভালো নেই।

রাত আড়াইটার দিকে ট্রেন মেলান্দহ্ স্টেশন পেরিয়ে দেওয়ানগন্জ স্টেশনে থামে। যাত্রীরা প্ল্যাটফর্মের ভেতরে ঢুকতে বেশ ব্যস্ত। আয়মান, ওয়াকিলসহ সব পুরুষরা একযোগে ট্রেন থেকে বস্তাবস্তি নামাচ্ছে। পূর্ণতা ও বাকি মহিলারা ট্রেন থেকে নেমে বাইরে দাড়িয়ে নিজেদের ব্যাগ পত্তর সব জিনিস গুণে গুণে দেখছে সব ঠিকঠাক আছে কিনা। শেষে সবাই প্ল্যাটফর্মের ভেতরে ঢুকে অটোরিকশা ঠিক করে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা ধরে। মোটমাট সাতটা অটোরিকশা বোঝাই করে নিরিবিলি গ্রামের রাস্তা ধরে অটোরিকশা চলছে। পূর্ণতা পূর্বিকাকে কল দেয়নি। জানেই ওর মা ওকে পূর্বদের ওখানে যেতে দিবেনা। ওরা সবাই যখন নানাবাড়িতে পৌছে হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসে তখন ঘড়িতে বাজে সাড়ে তিনটারও বেশি। বড়রা বিছানার উপর বসেছে, ফ্লোরে বিশাল পাটির উপর বসেছে পূর্ণতারা অর্থাৎ ছোটরা। লম্বা জার্নি করে সবাই যখন ক্লান্ত দেহ নিয়ে বিছানায় শোয়ার সিদ্ধান্ত নিতে উঠোনে দাড়ায় তখনই সবাইকে চমকে দিয়ে পূর্বিকা, ফুয়াদ ও মিথুন উপস্থিত হয়। পূর্বিকা সবাইকে বিশেষ করে পূর্ণতার মা-কে বলে সেই বিকেল থেকে পূর্বের মা পূর্ণতার সাথে দেখা করার জন্য অস্থির হয়ে আছেন – এই সেই বুঝিয়ে পূর্ণতাকে নিয়ে যায় সঙ্গে করে। ফুয়াদ পূর্ণতার দিকে ভেংচি কেটে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসলো। মিথুন বসলো ফুয়াদের পাশে। পূর্বদের বাড়িতে বিয়ের আয়োজনের জন্য মধ্যরাতেও সবাই জাগ্রত ছিলো। পূর্ণতাকে পেয়ে সত্যি সত্যি পূর্বের মা খুশিতে মত্ত হলো। পূর্ণতাকে পূর্বিকার ঘরে পাঠিয়ে হাতে দুই প্লেট খাবার নিয়ে রুমে ঢুকলো। হাসিমুখে প্লেটগুলো বিছানায় রেখে দরজা একটু ঠেলে দিয়ে বিছানায় উঠে বসতেই বলে উঠলো,

– মা, তুমি আসবে বলে পূর্বিকা এখনো মুখে খাবার তুলেনি। দুজন একটু খেয়ে নাও কেমন?
পূর্বিকা আমোদিত কন্ঠে অনুরোধ করে বললো,
– তুমি পূর্ণতাকে খাইয়ে দাও আম্মু। ওর শরীর দেখেছো? ট্রেনের কামরার মতো এখনো টলছে।

পূর্বের মা সানন্দে পূর্ণতাকে খাইয়ে দিতে লাগলো। যদিও পূর্ণতা অনেকবার বাধা দিয়ে না না করেছে লাভ হয়নি। পূর্ব একেবারে মায়ের মতো জিদ পেয়েছে। এক কথাই শেষ কথা!

– আমি বাথরুমে সাবান, তোয়ালে রেখেছি গোসল করে শুয়ে পরবে পূর্ণতা। গোসল করলে শরীর পাতলা লাগবে। ঠিকআছে?

– আন্টি, একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

পূর্ণতার কৌতুহলপ্রদ কথার প্রক্ষিতে পূর্বের মা স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠে,

– পূর্ব কেন অন্য পথে গেলো এটাই জানতে চাচ্ছো তো? বলবো মা। সব বলবো।

পূর্ণতা বিষম খেয়ে কাশতে লাগলো। ওর কাশির প্রকট বাড়তে থাকলে পূর্বিকা খাওয়া বাদ দিয়ে পূর্ণতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। পূর্বের মা চটপট গ্লাসে পানি নিয়ে পূর্ণতাকে খাইয়ে দিলে পূর্ণতা শান্ত হয়ে বলে,

– আপনি আমার মনের কথা কি করে জানলেন?

পূর্বের মা মুচকি হেসে পূর্ণতার দিকে লোকমা তুলে বলে উঠলেন,

– হা করো পাগলী, বলবো তো বলেছি। আগে চটজলদি খেয়ে নাও। একটা ঘটনা বলি… পূর্ব যখন স্কুলে নতুন ভর্তি হলো সেদিন তুলকালাম কান্ড বাধালো। হেড টিচার হুড়োহুড়ি করে ডাকালো তোমার শ্বশুর মশাই ও আমাকে। আমি কলেজ থেকে তিনঘন্টার ছুটি নিয়ে স্কুলে যেয়ে শুনি ছেলে স্কুলের দারোয়ানকে পাথর ছুড়ে মেরেছে। লোকটার চোখের নিচে দুই ইন্ঞ্চি কেটে গিয়ে হুলস্থুল অবস্থা। প্রচুর ভয় পেয়েছিলাম ওই অবস্থা দেখে যদি স্কুল অথরিটি কোনো কঠিন পদক্ষেপ নেয় তাহলে আমার ছেলেটা অকারণে ফেসে যাবে। পরে হেড টিচারের সামনে ওকে থাপ্পর মেরে জিজ্ঞেস করি কেন দারোয়ানকে পাথর নিক্ষেপ করেছিস। ও গালে হাত দিয়ে রাগে কিড়মিড় করে বলে, ‘এই দারোয়ানটা ফকিরের বাচ্চা বলে আমার বন্ধুর মুখে থুথু মেরে গলাধাক্কা দিয়ে তাড়িয়েছে।’ আমি ওর কথা শুনে হতবাক! কি বলবো কি করবো কিছুই তখন মাথায় আসছিলো না। শুধু ওর মুখটা দেখছিলাম.. ওটুকুনি পাচঁ বয়সের বাচ্চার মুখ রাগের কারনে ঘামছিলো ভাবা যায়? পুরো রক্তজবাব মতো লাল হয়ে গিয়েছিলো। হেডটিচার ওর সেই বন্ধুকে বাইরে যেয়ে আনতে বলে। ও বাইরে গিয়ে কাকে আনে জানো? যার শরীরে ময়লা ছেড়া সেলাই করা গেন্জি আর ফুটোফাটা হাফপ্যান্ট ছাড়া কিছুই নেই , মুখ ধূলোয় ভরা, চুল উশখুশ, কদ্দিন ধরে যেন ভুখা ছিলো এমন একটা পথের ছেলেকে পূর্ব বন্ধু বলে স্কুলের হেড মাস্টারের সামনে দাড় করায়। ওই ছেলের নাম মবিন। মবিনের খুব ইচ্ছা পড়াশোনা করার কিন্তু এতিম বলে পড়ার সুযোগ পায়নি। নির্বোধ পিচ্চি ছেলেটা রাস্তায় ময়লা কুড়িয়ে চলে দিনের পর দিন রাস্তায় ঘুমায়। পূর্ব আমার শাড়ির আচঁল টেনে ওর বাচ্চাসুলভ কন্ঠে সেদিন বলে, ‘আম্মু দারোয়ান ওকে থুথু মেরে পচাঁ পচাঁ গালিও দিয়েছে। তুমি না সবসময় বলো মানুষকে কষ্ট দিলে আল্লাহ্ কষ্ট পান। এই দারোয়ানটা ওকে কষ্ট দিয়েছে আম্মু। আমি ওকে শাস্তি দিয়েছি।’ হেড টিচার চোখের চশমা খুলে দারোয়ানকে সাথেসাথেই বরখাস্ত করে দেয়। ওই পিচ্চি এতিম বাচ্চাটাকে ভালো একটা এতিমখানায় পাঠানোর ব্যবস্থা করে উনাদের স্কুলে ফ্রিতে পড়ার চান্স করে দেয়। সব কেমন যে সিনেমার মতো মনে হচ্ছিলো আমি বাকরুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। হেড টিচার এতোই পূর্বের ওটুকুনি বুদ্ধি দেখে এতোই পুলকিত ছিলো যে সেদিন উনি সব টিচারের সামনে পূর্বকে কোলে তুলে ওর ক্লাসে নিয়ে যায়। তোমার শ্বশুর মশাই যদি মিটিংয়ের ফাকেঁ এসে একবার ওই দৃশ্যটা দেখতো…প্রাণটা জুড়িয়ে যেতো মা। হেড টিচারটা যে রাগী আমি নিজেই সাবধানে কথা বলার সাহস পেতাম না। অথচ দেখো? আমি নিজেই একজন কলেজের প্রফেসর ছিলাম। তোমার শ্বশুরের আচরন এখনো ভুলতে পারিনি মা। সেদিন রাতে মিটিং শেষ করে বাসায় ফিরতেই প্রচুর মেরেছে পূর্বকে। পূর্বেরও জিদ আব্বু শুধু শুধু কেন মারবে? পিটিয়ে নাক দিয়ে স্রোতের মতো রক্ত বের করে ফেলেছিলো। আমি যে কিছু বলবো সে সুযোগও তোমার শ্বশুর দেয়নি। মাথা গরম ওয়ালা মানুষ জানলে কখনোই বিয়ে করতাম না তোমার শ্বশুড়কে। এখন বড় হয়ে বাপ বেটা দুটো একই ভেলকির রাগ পেয়েছে।

এটুকু বলতেই পূর্বের মা মাথা নিচু করে সাবধানে চোখে আঙ্গুল ছোঁয়ালো।পূর্ণতাকে এই অশ্রু দেখানো যাবেনা মেয়েটা আরো কষ্টে নিপতিত হবে। মায়ের মন সন্তানের অমঙ্গল সম্বন্ধে পূর্বাভাস বহু আগেই পেয়ে যায়। পূর্ণতার খাওয়া আটকে চোখ দিয়ে তখন পানি গড়াচ্ছিলো। পূর্বিকা কলপাড়ে চলে গিয়েছে।মায়ের কাছে ছোট ভাইয়ের সুন্দর কাজ শুনে এই মূহুর্তে রাগ গলাতে একদম ইচ্ছা করছেনা। পূর্ণতার কষ্ট দেখলে পূর্বিকার ইচ্ছে করে পূর্বের গলায় একটা কোপ মারতে! দেশের উন্নয়নে কি মানুষের অভাব পরেছে যে ওকে রাজনীতির রোষানলে ডুব দিতে হবে? ১৯৭১ সালের সেই ঐক্যবদ্ধ বাঙালি, ২০২১ সালে করছে কারচুপি। এটা কি ও বুঝে না?

– উনি রাজনীতিতে কেন যুক্ত হলো?
– তুমি ডাক্তার হতে চাইলে কি করো? তোমার প্রথমে স্কুলে পড়তে হয়, তারপর কলেজ। কলেজের রেজাল্ট দিয়ে মেডিকেল ইন্সটিটিউটে এডমিশন নিতে হয়। কিন্তু লক্ষ হলো একটাই ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করা। নানা ধাপ অতিক্রম করো শুধু মানুষকে সেবা করার জন্য। পূর্বেরও এক কথা, আমি দেশের মানুষকে সেবা করতে চাই। তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতে চাই। সবাই ডাক্তার, ইন্জিনিয়ার, লয়ার হয়…আমি হবো লিডার। পূর্ব ব্রাইট স্টুডেন্ট ছিলো মা। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় জেলা টপ করেছিলো। সেই ছেলেকে শখ করে পাবলিক ভার্সিটিতে পাঠালাম। এরপর কাদের সাথে মিলে যে জীবনের লক্ষ্য ভুলে রাজনীতির পথটা ধরলো জানিনা। ওর কোনো বন্ধু নেই মা। ওর উগ্র মেজাজের কারনে কখনো কোনো বন্ধু হয়নি। একা একা জীবনের এতোটা পথ পার করে ও তোমায় কিভাবে পছন্দ করলো এখনো আমার অজানা। হিসাব ছাড়া মেয়েদের ছবি দেখিয়েছি, ওর শেষ কথা! ও বিয়ে করবে না! আমিও বিয়ে করানোর অটল যুদ্ধে পরাজিত হয়ে হাল ছেড়ে দিলাম। এর মধ্যে হুট করে একদিন আমার স্টাডিরুমে এসে বললো, আম্মু আমি বিয়ে করবো, কাল সকালের মধ্যে মেয়েপক্ষ কনফার্ম চাই! তোমার শ্বশুর আর আমি পারিনা রাতের বেলাই তোমাদের বাসা চলে যাই। গিয়ে তোমাকে তুলে এনে ছেলের ইচ্ছা পূরণ করি।

– উনি যে আপনাদের সাথে আসলো না আপনারা রাগ হন নি?
– গাধা পিটিয়ে যেমন ঘোড়া বানানো যায় না। পূর্বকে বলেও কখনো সোজা করা সম্ভব হয়নি। তোমার শ্বশুর তো ওকে দু’চোখে দেখতেই পারেনা।

পূর্বের মা খালি প্লেট নিয়ে উঠে দাড়ালো। পূর্ণতা খাট থেকে নামতে নামতে পূর্বিকা এসে পরলে ওকে নিয়ে বাথরুমে চলে যায়। কলপাড়ে গিয়ে দেখে দুটো টিনের বালতি ওর জন্য ভরা।

– আপু? বালতি গুলো তুমি ভরেছো? চাপকল চাপতে কষ্ট হয়নি?
পূর্বিকা একগাল হেসে বললো,
– আমার ছোট ভাই তোমায় যে কষ্ট দিচ্ছে আমি কিন্তু মেয়ে সব বুঝি। যাও গোসল সারো।

পূর্বিকা দুঃখ চেপে তর্জনী উঠিয়ে দেখায় নাইলনের রশির উপর পরনের কাপড়, সাদা তোয়ালে ঝুলানো।পাশে সোপকেসে একটা সাবান রাখা। পূর্বিকার আচরনে খানিকটা আবেগান্বিত হলো পূর্ণতা। পূর্বের কারনে এতো সুন্দর মনের পরিবার পেলো বলে নিজেকে ভাগ্যবতী ভাবা উচিত না??

সূর্য যখন মধ্য আকাশে স্থির থেকে গরমের প্রকট বোঝাচ্ছে তখন বাড়িতে ফিরলো পূর্ণতা। হাতে একগাদা শপিং ব্যাগ যা হবু শ্বাশুড়ি জোর করে দিয়েছে। পূর্ণতা ব্যাগ হাতে রুমে ঢুকতেই পেছন থেকে দরজা লাগানোর আওয়াজ হয়। পূর্ণতা কপাল কুচকে পিছু ফিরে দেখে আনিশা।

– কপালজোরে বিয়ের পিড়িতে বসলি দেখি। শুনলাম খালা এখনো তোর বিয়েতে খুশি না। তা পূর্বের সাথে রাত কেমন কাটলো?
– পূর্ব বাসায় ছিলো না আপু। উনি জরুরী কাজে বাইরে। পূর্ণতা প্রথম বাক্যটা সত্য বললেও শেষের বাক্যটা মিথ্যা বললো।
– তুই আমাকে তোর মতো বোকা ভাবিস? যে পানিতে তুই সাঁতার কাটছিস সেই পানিতে আমি ডুব দিয়ে এসেছি। কাজেই মিথ্যে বলার প্রয়োজন দেখছিনা।

পূর্ণতা আনিশার কথায় অবাক হলো। আনিশা পেচানো কথায় কি অর্থ বোঝালো?

– আমি বোকা না আপু। তাছাড়া পেচিয়ে বলার প্রয়োজনও আমি দেখছি না।

আনিশা দুহাতে ভর দিয়ে পিঠ কিছুটা পিছনে ঝুকিয়ে বিছানায় হেলতেই বললো,

– পূর্ব দলের কাজে বাইরে গেছে নিশ্চিত! তুই এখন যতোই মিথ্যা বলবি পার পাবিনা বুঝলি? দেখ্ আবার মার খেয়ে আসে কিনা। লাশ হয়েও ফিরতে পারে গ্যারান্টি নেই।
– তুমি প্রচণ্ড বিরক্ত করছো আনিশা আপু!দয়া করে বাইরে যাও এবং দিহান ভাইকে সময় দাও।
– আহা! রাগছিস কেন? আমার উপর রাগ ঝেড়ে কোনো লাভ নেই তো। পূর্ব তো সুস্থ সবল ফিরে আসবেনা। একদন্ড মার খেয়ে তবেই ফিরবে আমি খাতা কলমে লিখে দিতে পারবো।
– তুমি এখান থেকে বেরুবে!
– আমার সাথে চেচিয়ে লাভ নেই খুকি! পূর্ব তোকে টিস্যু পেপারের মতোই নিজের জীবনে ইউজ করছে সেটা এখন নাহ্, পরে বুঝবি। হাইয়েস্ট এক সপ্তাহ তোর সাথে মনোরন্জন করবে এরপর দি এ্যান্ড। তোকে নোংরা টিস্যুর মতো ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে আবার অন্য মেয়ে ধরবে। বুঝেছিস?

আনিশার ফালতু কথা শুনে পূর্ণতার ইচ্ছে করছিলো যেয়ে একটা থাপ্পর মেরে আসতে! ভদ্রতার খাতিরে কিছু করেনি পূর্ণতা। মনে মনে ভাবলো, আজ পূর্ব যদি বায় চান্স তোমার একটা কথা শুনতো…ও তোমাকে কি যে করতো তুমি হয়তো ভালো করেই জানো আপু! পূর্ণতা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে শপিং ব্যাগগুলো আলমারিতে তুলে বাইরে চলে গেল। আনিশা বিছানায় সম্পূর্ণ পিঠ লাগিয়ে সিলিংয়ে তাকিয়ে অন্যমনস্ক কন্ঠে বলে উঠলো, কচি মেয়ে দেখলে পুরুষের শরীর নেতিয়ে পরে, পূর্বও তোকে ছেড়ে দিবে পূর্ণতা…দেখিস।

পূর্ণতা খোশমেজাজে নানাভাইয়ের সাথে গল্প করছিলো হঠাৎ খোদেজা এসে ওদের মাঝে চট করে বলে উঠে,
– পূর্ণতা, আমার সাথে আয়। কথা আছে।

নানাভাই গামলা থেকে এক মুঠো মুড়ি নিতেই চমকে উঠে বললো,
– আমার নাতীনকে বকবি? এমন করে ডাকছিস কেন খোদেজা?

খোদেজার কন্ঠে যেই কঠোরতা ছিলো পূর্ণতা একনিমিষেই বুঝলো মা ওকে খুবই জরুরী কিছু বলার জন্য সাথে ডাকছে। খোদেজা শান্ত গলায় বলে উঠলো,
– আব্বা, তোমার নাতনী যা করার তা তো করেই ফেলেছে এখন বকে তো লাভ নেই। দরকারি কথা ছিলো এজন্য ডেকেছি।

পূর্ণতা ওদের কথোপকথন আর না বারিয়ে মায়ের সঙ্গ ধরে ওর রুমের দিকে গেলো। খোদেজা দরজার ডাসা লাগিয়ে পূর্ণতার দিকে আসতেই মুখের আভা কঠিন থেকে কঠোর রাগের রূপ ধারন নিলো। পূর্ণতা ঢোক গিলে চোখ নিচের দিকে করলে পূর্ণতার বাহু ঝাকিয়ে কর্কশকণ্ঠে বলে উঠে,

– উপোস আছিস কেন? ওই শয়তানটার জন্য? ওই শয়তানটার কোনো খোঁজ খবর নেই এ শোকে উপোস করছিস? ওর ভাই তোর বাপকে ফোন দিয়ে বলেছে পূর্ব বাড়িতে ফিরেনি! এখনো তোর আহ্লাদ মিটেনা বিয়ে করার? ওই শয়তান যে তোকে কদিনের মধ্যে খেয়ে ছেড়ে দিবে বুঝিস না কেন? ডিভোর্সী হয়ে বেঁচে থাকতে চাস?

পূর্ণতা ব্যথাতুর কন্ঠে চোখ শীতল করে বলে উঠে,
– তুমি উনাকে দেখতে পারো না কেন মা? কি খুত আছে উনার মধ্যে? এই কঠিন কথাগুলো বলো না…
– চুপ! তোর মতো নির্লজ্জা কে পেটে ধরে নিজের গর্ভ কলুষিত করে ফেলেছি! পাপ হয়ে গেছে আমার তোকে বাচিঁয়ে রেখে! তোর বাপকেও বুঝিয়ে পারছিনা ওই রাজনীতি ফাজনীতির ছোকরা আমার সহ্য না! শয়তানটা নিজে মরবে সঙ্গে তোকে নিয়ে মরবে! এই দিন দেখার জন্য তোকে বড় করেছি? কি জাদু করেছে ওই বদমাশটা!

পূর্ণতার চোখভর্তি শুধু অশ্রুর খেলা হচ্ছিলো। চোখ দুটো যেন প্রতিযোগিতা করছে কার আগে কে বেশি অশ্রু ঝরাবে। পূর্ণতাকে চুপ করে কাঁদতে দেখে খোদেজা গর্জে উঠে পূর্ণতার গালে হাত রেখে বলে,

– সময় আছে না করে দে…আমি নিজে তোকে ভালো সেটেল্ড ছেলে দেখে বিয়ে দেবো! দরকার পরলে রাজপুত্রের মতো ছেলেকে তোর কাছে এনে দিবো! ওকে ভুলে যা! ওই ছেলের কোনো ভবিষ্যৎ নেই…বাপের ব্যবসা দিয়ে নিজের কোনো সোচ্চার হয়না। তোকে কথা দিচ্ছি তোর সব আয়েশের ব্যবস্থা আমি করে দিব তুই শুধু একবার না কর!

– আমি বিয়েতে না করবো না মা।

হাত উঠিয়ে প্রচন্ড শক্তি দিয়ে চড় মারে পূর্ণতার গালে। সারাদিন উপোসে থাকা শরীরটা তাল সামলাতে না পেরে ছিটকে স্ট্যান্ডের বিছানার সাথে ধাক্কা খেয়ে ফ্লোরে পরে ব্যথা পায়। খোদেজা হনহন করে দরজা খুলে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে বেরিয়ে যায়। পূর্ণতা বিছানা ধরে খুব শক্তি খাটিয়ে উঠে দাড়ায়। পূর্বের ব্যাপারে এই খবরটা নিশ্চয়ই ফুয়াদ, মিথুন বা জাওয়াদদের মধ্যে থেকে কেউ দিয়েছে। তা নাহলে মা কখনোই ওই বাড়ির খবরাখবর জানতে পারতো না। ফুয়াদরা কি পূর্বের বিয়েটা হোক সেটা চাচ্ছেনা? পূর্বের জন্য সুস্থতার মানত করে পূর্ণতা আজ সকাল থেকে রোজা আছে প্রচণ্ড ধাক্কায় মাথাটা ঝিমঝিম করে শরীর অসুস্থ লাগছে। কেন যেনো মনটা কু ডেকে উঠছে, ভয় লাগছে, অস্থির হয়ে ছটফটানি অনুভব হচ্ছে। হাঁটার শক্তি পাচ্ছেনা পূর্ণতা, গতকালকের ট্রেন জার্নি তার উপর রোজা থাকা…শরীর নেতিয়ে পরেছে পূর্ণতার। বিছানায় পিঠ লাগিয়ে পা দুটো ফ্লোরে ঠেকিয়ে কপালে কবজি রেখে শুয়ে আছে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ফুপিয়ে কাঁদছে। কলিজাটা ফেটে যাচ্ছে পূর্ণতার! কেন পূর্ব বারবার ওকে দূরে পাঠিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে বের হয়? যদি আনিশার কথা সত্যি হয়? যদি মনের কু ডাকটা সত্যি হয়? যদি পূর্বের কিছু হয়? কিছু ভাবতেই পারছেনা পূর্ণতা..ঠোঁট কঠিন করে কামড়ে আরো হুহু করে কেদেঁ উঠে। একদিকে মা চায় না পূর্বের মতো রাজপথ চষে খাওয়া ছেলের সাথে বিয়ে হোক! অপর দিকে প্রকৃতি চায় না পূর্ব সুস্থভাবে ফিরুক! মন বলছে আনিশার কথাই সত্যি হবে, পূর্ব সুস্থভাবে ফিরবেনা বোধহয়।

– ‘ চলবে ‘

#তোকে_ঘিরে❤
#পর্ব_২৩
#ফাবিয়াহ্_মমো🍁

বাড়ি সুদ্ধো বিদঘুটে আধারে মিলিয়ে আছে, প্রতিটি ঘরে ঘরে হারিকেন জ্বলছে। বিকেলের ভয়াবহ তান্ডব শেষে কেউ ইলেক্ট্রিসিটির লাইন জ্বালাতে পারেনি। কি ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিলো বিকেলের শেষ দিকে! চারধার বিদঘুটে অন্ধকার করে কালো মেঘে আকাশ ঢেকে গিয়েছিলো! পূর্ণতা এমন বাদলা দিনে আল্লাহ্কে ডাকছিলো ওর মন পূর্বের জন্য অশুভ পূর্বাভাস তিলতিল করে টের পাচ্ছে। পূর্ণতা পাগলের মতো অস্থির হয়ে উঠেছিলো, রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে জঙ্গলের পেছন জানালায় তাকিয়ে তাকিয়ে অঝোরে নিঃশব্দে কাদঁছিলো। প্রবল হাওয়ায় গ্রামাঞ্চলে ইলেকট্রিসিটির বোর্ড লাইনে দারুন সমস্যা হয়, যার ফলাফল পুরো আটটা গ্রামে বিদ্যূৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ভয়াবহ অন্ধকারে তলিয়ে আছে পুরো গ্রাম। শ্রেয়া জোর করে পূর্ণতার রোজা খুলে কিছু হালকা নাস্তা খাওয়ায়। মাথায় হাত বুলিয়ে ঠোঁটের কাছে দুধের গ্লাস এঁটে অভয় বানীতে শোনায়,

– ভাইয়া সুস্থ থাকবে পূর্ণতা, তুই যদি নিজের অবস্থা খারাপ করে ফেলিস ভাইয়া খুশি হবে বল? কষ্ট পাবে না?

পূর্ণতা দুধের গ্লাসে চুমুক দিতেই টুপ করে গাল ভিজিয়ে অশ্রুকণা পরে। শ্রেয়ার কষ্ট হয় অনেক! বেষ্টফ্রেন্ড নামক মানুষটাকে বেষ্টনীর মতো আগলে রেখেও কষ্ট পোহাতে হচ্ছে… শ্রেয়ার খুব দুঃখ লাগে, অদ্ভুত ভাবে কান্নাও পায়। আয়মান পূর্ণতার বিয়ের বাজার সদাইয়ে ব্যস্ত থাকলেও এক মূহুর্তের জন্য পূর্ণতার কাছে এসে সাহস জুগিয়ে বলে,

– ভাই তোরে কি শিখাইছিলো ভুইলা গেছোস? তুই হইলি পার্ফেকশন মানে বাংলায় পূর্ণতা! হুদাই কাইন্দা লাভ আছে বল? ভাইয়ে দেখ ক্যামনে এন্ট্রি মারে! তোরে দেখিস ক্যামনে চমকায়া দেয়! তুই ছেড়ি খাইয়া লইয়া ফিটফাট হ, ভাইয়ে যেই সারপ্রাইজ দিবো তুই কাইত হইয়া যাবি নে!!

পূর্ণতা দুঃসময়ের মধ্যেও আয়মানে কথায় হাসে। খুবই মৃদ্যূ ভঙ্গিতে হেসে চোখের পানি ছেড়ে দেয়। খোদেজা যেই থাপ্পরটা মেরেছিলো এখনো ছাপ বসে আছে গালে। আনিশা আপাতত নিজের মতোই দিহানের সাথে টাইম পাস করছে। দিহানের মতো সরল সহজ ছেলেকে নিজের রূপের মায়ায় মোহিত করে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখছে আনিশা। আনিশার মনে চাপা ক্ষোভ! পূর্ব কেন বিশ্বাসঘাতকতা করলো? পূর্ণতাকে কেনো বিয়ে করতে চাইছে? আনিশার এখনো স্পষ্ট মনে আছে পূর্ব কিভাবে আনিশার কানের নিচে চড় বসিয়ে রাগে হনহন করে বলেছে,

– তোমার বুঝা উচিত! তোমার প্রোপোজাল একসেপ্ট করার পর নিজেকে অনেক বুঝিয়েছি তোমাকে প্রতি ফিল করার জন্য, যেভাবে তুমি উল্টাপাল্টা কাজ করো আমার মনকে আমি বুঝিয়েছি সেভাবে করতে। বাট উইথ গ্রেট সর‍্যো! এই মন কোনোভাবেই তোমার প্রতি টান অনুভব করছেনা! আমার দোষ নেই সরি! তোমাকে আমি আগেই বলেছি, প্রেম-ভালোবাসা দুটো দুই ব্যাপার। প্রেমের বেলায় মন কাজ করবে, ভালোবাসার বেলায় মন ও শরীর দুটোই সচল থাকবে। আমি তোমার সাথে নরমাল প্রেমটাই করতে পারছিনা ভালো কিভাবে বাসবো? আই এম রিয়েলি ভেরি সরি, আমার দ্বারা তোমাকে বিয়ে তো দূর রিলেশন টিকানোর এবিলিটি নেই। প্লিজ, নিজেকে সস্তা বানানো বন্ধ করো আমি তোমার প্রতি ফিল করতে পারছিনা।

আনিশা এখনো পূর্বের কথাগুলো সতেজ ভঙ্গিতে ভাবে। যেনো কানের মধ্যে রিনরিন করে এখনো বাজছে। পূর্ব তাহলে পূর্ণতাকে ভালোবাসে ফেলেছে? কখন? কিভাবে? কবে? আনিশা তিন বছর ধরে রিলেশন ট্যাগ লাগিয়ে পূর্বের গার্লফ্রেন্ড হিসেবে যে সুনাম অর্জন করেছিলো পূর্ণতা বউ হিসেবে কেনো সেটা গোপন থাকছে? কেনো শহরে বিয়েটা হচ্ছেনা? পূর্ব কি চায় না ওর রাজনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য পূর্ণতার কিছু হোক? তাহলে আনিশা যখন গার্লফ্রেন্ড ছিলো যদি পূর্বের শত্রুদলের কারনে কোনো ক্ষতি হতো এতে পূর্বের কোনো ভ্রুক্ষেপ বা কষ্ট হতো না? তার মানে পূর্ব পূর্ণতার ভালোর জন্যই নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে প্রতিটা গুটি ফেলছে। পূর্ণতাকে বাচানোর জন্যই পূর্বের যতো ভয়ংকর কারসাজি। পূর্ব কি নিষ্ঠুর! তোমার সুখ আমার সহ্য হচ্ছেনা পূর্ব! তুমি আমার খালাতো বোনের স্বামী হতে চলেছো তবুও তোমার সাথে পুরোনো হিসাব চিন্তা করলে বুক ঠেলে অভিশাপ আসে! শুধুমাত্র তোমার জন্য আমার খালাতো বোনের জীবনে দূর্ভিক্ষ নামবে পূর্ব! কেবল তুমি দায়ী পূর্ণতার প্রতিটা কান্নার জন্য! আনিশার খারাপ লাগে পূর্ণতার কথা চিন্তা করলে। যার মনটা সবার জন্য কাতরায়, পরিবারের প্রতিটি মানুষের জন্য ভাবে, সবাইকে কতটা ভালোবাসে! অথচ নিয়তি দেখো, সেই মিষ্টি পরী পূর্ণতা পূর্ব নামক রাজনৈতিক পথিকের জন্য অস্থির হয়ে উঠে। হায়রে লীলাখেলা…

‘আকাশে মেঘের মতো আমার জীবনে অনুভূতি এসেছিলো সেই মেঘগুলো বৃষ্টি না দিয়েই উধাও হয়ে গেলো। এখন শ্বাস-প্রশ্বাস শুধু টানছি আমি, আমার জীবনে আর নেই তুমি…’

আনিশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে আকাশের পানে তাকিয়ে রইলো। কি ব্যথা হচ্ছে বুকে! এই ব্যথা কমবে কবে? কবে রেহাই পাবে অতীতের একতরফা ভালোবাসা থেকে?

.

হারিকেনের পলতে নামানোর কারনে নিভু নিভু আলোতে ভূতুড়ে পরিবেশ ধারন করেছে রুমের মধ্যে। মাথার উপর টিনের চালে গাছের ডালপালার ধাক্কাধাক্কি চলছে।কি বিদঘুটে শব্দ! বাইরে এখনো হো হো প্রতিধ্বনির বাতাস। যেন বাতাস বলছে, ‘হে মানব সমাজ! আমাকে ভয় করো! একদিন এভাবেই আমি আল্লাহর পক্ষ হতে কিয়ামতের নিদর্শন পাবো! তোমাদের এই রঙিন দুনিয়া ধূলোয় ধূলিসাৎ করে গুড়িয়ে দেবো!’ পূর্ণতার চোখ দুটো ভীষন ফুলে উঠায় পাতাদুটো প্রচণ্ড ভারী হয়ে আছে। চোখ খুলতেও হিমশিম খাচ্ছে পূর্ণতা। পূর্ণতার অকারনে কান্নার রহস্যটি সবার কাছে মেয়েদের বিদায়কালীন কান্নাসুর মনে হচ্ছে। আগামীকাল পূর্ণতা সবাইকে ছেড়ে নতুন পরিবেশে নতুন পরিবার পাবে তাই হয়তো বুকের ভেতর কান্না ঠেলে চোখ উজাড় করে কাঁদছে। কিন্তু রহস্য সবসময় রহস্য হয়ে থাকতেই পছন্দ করে বেশি। পূর্ণতার কান্নার রহস্য এখনো সবার অজানা, শুধু দু’ একজন জানতো আসল কারনটা। পূর্ণতা লম্বা হয়ে বিছানায় শুয়ে কপালের উপর কবজি উঠিয়ে উল্টে রেখেছে। হঠাৎ ফোনের টুংটাং রিংটোনটা বেজে উঠলে কপাল থেকে কবজি সরিয়ে বামে তাকায় পূর্ণতা। ফোনের সাদা আলো জ্বলজ্বল করছে। হাত বারিয়ে থাবার মধ্যে ফোন মুঠো করে আনলে চোখের পাতা ঝাপটা মেরে পরিস্কার করে তাকায়। Comrade is calling… লাফ দিয়ে উঠে বসে শক্ত হয়ে যায় পূর্ণতা! চোখদুটো হাতের উল্টোপিঠে তাড়াতাড়ি মুছে রিসিভ করে কানে লাগায়, বুকটা কি ধুকপুক করছে! হৃদ যন্ত্রটা এই বুঝি ফেটে গিয়ে বীভৎস কারবার করে ফেলবে!

– হ্যালো, পেছনের দরজা খুলে একটু বাইরে আসো না, একটু আসো প্লিজ..

পূর্ণতা উত্তর দেওয়ার মতো সময় নষ্ট করতে চায় না! ধুপধাপ খাট থেকে পা ফেলে ফোন বিছানায় রেখে দরজার ডাসা খুলে দেয়। এই পেছনের দরজা দিয়েই পূর্ব গতবার দেখা করে গিয়েছিলো! আজ পূর্ণতা ন্যানো সেকেন্ড পযর্ন্ত দেরি করতে চাচ্ছেনা! বাইরে বাতাসের সাথে হালকা বৃষ্টি বইছে! যেকোনো মূহুর্তে আকাশ চিড়ে বৃষ্টির ফোয়ারা নামবে।পূর্ণতা কোনোমতে হারিকেনটা নেওয়ার মতো বিবেকে ছিলো নাহলে বাইরে যেই অন্ধকার! কেউ একহাত দূরে দাড়ালেও কিচ্ছু বোঝা যাবেনা। পূর্ণতা হারিকেনের পলতে বাড়াতে বাড়াতে ডানেবামে চোখ ঘুরাতেই হঠাৎ স্থির হয়ে গেলো! শরীরের সবকটি পশম কাটার মতো মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো! পূর্ণতার গলা শুকিয়ে যেন রৌদ্রতপ্তের কাঠ হয়ে গেল। কালো গাড়ির দরজা খুলে পূর্ব ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে আছে। চোখের চাহনি ক্লান্তিকর, উদভ্রান্ত, দূর্বল! শরীর এমন হয়েছে যেকোনো মূহুর্তে ধুপ করে মাটিতে নেতিয়ে পরবে। গাড়ির জানালাসহ সব কাচঁ ভাঙা। বাতাসে পূর্বের চুল এলোমেলো হয়ে উড়ছে। পূর্ণতা হারিকেন হাতেই দৌড়ে গিয়ে পূর্বের সামনে দাড়ালো। পূর্বের গালে হাত রাখতেই ঠোঁটে ভেঙে কেদেঁ দিলো। কি হাল হয়েছে পূর্বের! এই কি সেই পূর্ব? যার খানখান করা পুড়ে যাওয়া বুকটায় একটু উষ্ণ ছোঁয়া বসিয়েছিলো? পূর্ব হাতের উপর ভর করে এতোক্ষন দাড়িয়ে ছিলো হঠাৎ পূর্ণতার কাধে থুতনি রেখে নিজের শরীর ছেড়ে দিলো। অসম্ভব ক্লান্তিজনক দূর্বল গলায় আস্তে আস্তে বলে উঠলো,

– আমার মাথা ঘুরাচ্ছে পূর্ণ…খারাপ লাগছে..

ফিসফিস কন্ঠে বলতেই বলতে পূর্ব গা ছেড়ে দিতে শুরু করলো। পূর্ণতা একহাতে হারিকেন আকড়ে পূর্বকে আগলে ধরে ভেতরে নিয়ে বিছানায় শোয়ায়। দরজা ভালো মতো আটকে দিয়ে হারিকেন জায়গা মতো রাখে। এই মূহুর্তে মা না আসলেই চলে ! পূর্বকে এই অবস্থায় দেখলে বাড়ি মাতিয়ে তুলবে! মেইন দরজা তথা সামনের দরজায় ছিটকিনি আটকে দিয়ে পূর্বের কাছে গিয়ে বসে পূর্ণতা। পূর্বের সাদা পান্জাবী আর সাদা নেই ময়লায় ধূসরবর্ণে লেপ্টে গেছে। কিছু কিছু জায়গায় ছোপ ছোপ শুকনো রক্তের দাগ। হাতের নানা জায়গায় কাটা ছেড়া, চুলগুলো উশখুশ, চোখ মেলে তাকানোর জো পাচ্ছেনা পূর্ব। পূর্ণতা দ্রুত শ্রেয়াকে ফোন করে। একা একা বাড়ি ভর্তি মানুষের সামনে পূর্বের দেখভাল কিভাবে করবে?

– হ্যালো হ্যালো শ্রেয়া!! শ্রেয়া শোন, গোসলের মগ দিয়ে এক মগ পানি নিয়ে আয়। প্লিজ কোনো কারন জিজ্ঞেস করিস না! জলদি আয় প্লিজ! সাথে একটা কাপড় আনিস!

শ্রেয়া পূর্ণতার আচমকা আদেশের সূত্র মেলাতে পারেনা। পানি কেন লাগবে? শ্রেয়া কথামতো মগভর্তি পানি ও নরম কাপড় নিয়ে দরজায় টোকা দিলে পূর্ণতা চটপট সব হাতে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

– পূর্ব এসেছে। তুই বারান্দার চৌকিতে বসে পাহারা দে!
– আচ্ছা। শ্রেয়া মনেমনে খুশি হয়ে আজ্ঞা পালনে ব্যস্ত হয়।

পূর্ণতা দরজা লাগিয়ে বিছানার উপর মগ রেখে কাপড় ভিজিয়ে বাড়তি পানি চিপড়ে পূর্বের মুখ মুছে দেয়। পান্জাবী খুলে ভেজা কাপড় দিয়ে গা মুছে দিয়ে পূর্বের কাটা জায়গায় মলম লাগিয়ে দেয়। পূর্ব অবচেতন হয়ে শুয়ে আছে, কোনো হেলদোল নেই ওর। কোনাবাড়ি যাওয়ার পর সেই সুনশান এলাকায় কি হয়েছিলো এখনো ধূপের বেরাজালে রহস্য! পূর্ণতা ময়লা পান্জাবী ঘরের এককোণে থাকা আলনার উপর মেলে দিয়ে ফিরে এসে পূর্বের জুতা খুলে দেয়। টিনের উপর বৃষ্টির ঝনঝন শব্দ শুরু হয়েছে।বৃষ্টির দাপুটে খেলা কেবল শুরু! কখন এই বৃষ্টির মুষড়ে পরা থামে কে জানে? প্রকৃতি এখন ঠান্ডার চাদরে গা ঢেকে নিয়েছে। পূর্ব এখন ঘুমাচ্ছে। হারিকেনের আলোয় কেমন সুন্দর, মনোরম, অন্যরকম লাগছে পরিবেশটা! টিনের চালে ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ, মাটির মিষ্টি সোঁদা গন্ধ, পাতার ফাকে ফাকে বেড়ে উঠা নব্য ফুলের সুভাস, হারিকেনের মৃদ্যূ আলো, বদ্ধ রুমে গ্রামের সতেজতায় নিজের মধ্যে অদ্ভুত শান্তি অনুভব হচ্ছে। এই শান্তি শহুরে জীবনে উপভোগ করা যায়না। পূর্ণতা পরম শ্রান্তিতে পূর্বের কপালে ঠোঁট বসায়। ঠোঁট বসাতেই কেদেঁ দেয় আবার। দুহাতে পূর্বের মাথা আকড়ে বালিশ থেকে মাথা উচু তুলে চোখদুটিতে চুমু খায়। চোখের কোণা থেকে জল গড়িয়ে পূর্বের কানের পাশ ঘেঁষে গড়ায়। পূর্ব হালকা করে চোখ খুলে তাকায় পূর্ণতার দিকে বিড়বিড় করে বলে,

– প্রচুর কষ্ট দিয়েছি, কেঁদো না…আমার খারাপ লাগছে,

পূর্ণতা ফোপাতে যেয়েও ঠোঁট কামড়ায়। কান্নার শব্দ হুট করে ঘরের বাইরে চলে গেলে কেলেঙ্কারি হতে পারে। পূর্ণতা হেচকি তুলতে তুলতে নিচের ঠোট কামড়ে চোখ কুচকায়। পূর্বের শরীর এখনো প্রচণ্ড ব্যথায় টনটন করছে। তার চেয়ে বেশি ব্যথা হচ্ছে বুকে। চোখের পানিগুলো বুকের ভেতর তীরের মতো ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। পূর্ব ঠোট শক্ত করে ধীরগামীতে হাত উঠিয়ে পূর্ণতার কানের পাশে রাখে। পূর্ণতা কান্নারত কুচকানো চোখ খুলে তাকালে পূর্ব ছোট্ট নিশ্বাস ছেড়ে ঢোক গিলে বলে উঠে,

– কান্না করো না পূর্ণ, একটু থামো।

পূর্ণতা কান্না অবস্থায় ধীরাজ ভাবে মাথা ডানে বামে নাড়ায়। সারর্মম এই, আমি কান্না থামাতে পারছিনা পূর্ব। ফুস করে চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস ছাড়ে পূর্ব। শরীরের প্রতিটি পার্ট বিষের মতো যন্ত্রণা করছে। কোনোভাবেই এই যন্ত্রনার আখ্যা পূর্ণতাকে বুঝতে দেয়া যাবেনা। পূর্ণতা বিছানায় উঠে মাথার কাছে খাটের সাথে হেলান দিয়ে পূর্বের মাথা কোলে তুলে নেয়। চুলের ভেতর আঙুল ডুবিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই পূর্ব বদ্ধ চোখে ধীর কন্ঠে বলে উঠে,

– এখনো কাদঁছো? চুপ কর পূর্ণ। আমি তো ঠিক আছি। প্লিজ কেদোঁ না…একটু শোনো আমার কথা।

পূর্ণতা নাক টেনে কামিজের হাতায় চোখ ডলে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। পূর্বের মুখের উপর ঝুঁকে কপালে চুমু দিতেই পূর্ব ঠান্ডাহত গলায় বলে উঠে,

– কষ্ট পাচ্ছো খুব?

পূর্ণতা মাথা তুলে আরেক দফায় কামিজের হাতায় চোখ ঘষে। কান্নার হিরিকে এখনো হেচকির তালে তালে কাপছে পূর্ণতা। পূর্বের মাথায় নরম স্পর্শে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। টিনের ফুটোয় চোখ বসিয়ে ডানের লাকড়ি ঘর থেকে দেখছে আনিশা। পূর্ণতা যখন শ্রেয়ার হাত থেকে সন্দেহজনক ভঙ্গিতে মগ নিচ্ছিলো দূর থেকে আনিশা সেটা দেখতে পেয়েছিলো। যার দরুন এখন সে লাকড়ি ঘরের ফুটো দিয়ে পূর্ব-পূর্ণতার অবস্থা দেখছে। আনিশার হাত অজান্তেই আঁচলের সাথে মুচলেকা করছে। দাতেঁ দাতঁ চিবিয়ে চোখ দিয়ে পানি পরছে। ফুটো দিয়ে আরো দেখে,

– চোখ দুটোকে ফুলিয়ে কি করেছো পূর্ণ? শ্বাশুড়ি আম্মাজান তোমায় বকেনি?

পূর্ণতা এ প্রশ্নের জবাবে কিছুই বলেনি। পূর্বের সাথে এ যাবৎ একটা কথাও উচ্চারণ করছেনা। পূর্ব বুঝতে পারে, সহ্য ক্ষমতার বেশি কষ্ট পেলে মানুষ মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলে। বাকরুগ্ধ হয়ে চরমসীমায় দুঃখভোগ করতে থাকে। পূর্ণতার কথা না শুনলে শান্তি পাবে না পূর্ব। এই মেয়ে চুপ থাকলে আরো ভয়ানক কান্ড ঘটতে পারে। দেখা যাবে বিয়ের পরও কথা বলছেনা। পূর্ব কিছুটা নির্লিপ্ত গলায় বলে উঠে,

– আমি যদি জীবিত না এসে লাশ হয়ে ফিরতাম কেমন লাগতো? শুধু শুধু কাদছো কেন? আমি আগেই বলেছি আমার সাথে থাকা মানেই কষ্টভোগ করা। তুমি কথা শোনোনি। এখন কেনো কাঁদছো? বলো? জবাব দাও পূর্ণতা?

পূর্ণতা কয়েক মিনিট স্তব্ধ হয়ে পিটপিট করে তাকিয়ে থাকে পূর্বের দিকে। মাথার উপর ভিমরুল বুঝি ভো ভো করে উড়ছে। হঠাৎ পূর্বের উপর নিচু হয়ে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয় পূর্ণতা। পূর্ব অবাক! ভেবেছিলো এমন অলুক্ষনে কথার জন্য থাপ্পর খাবে উল্টো পূর্ণতা আদর করছে! টিনের ফুটো থেকে চোখ সরিয়ে আচঁলে চোখ ঢাকে আনিশা। কোথায় পূর্ণতার জায়গায় নিজে থাকতো অথচ নিষ্ঠুর ভাগ্যের পরিহাসে আচঁলে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে হচ্ছে আজ। আনিশা পা চালিয়ে লাকড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, চলে যায় নিজের রুমে। দিহান খাটে শুয়ে চুপচাপ বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে। আনিশা দরজায় পিঠ দিয়ে পেছনে থাকা হাত দিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। দিহান বই থেকে মুখ তুলে সচকিত চোখে আনিশার দিকে তাকিয়ে বলে,

– কি ব্যাপার? কোথায় ছিলে? দরজায় দাড়িয়ে আছো কেন? আসো…বসো।

আনিশা গুটিগুটি পায়ে দিহানের পাশে খাটে উঠে বসে। দিহান খুব মনোযোগ দিয়ে বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে। আনিশা দিহানের বুকে হাত রেখে বলে,

– এই শুনো না?
দিহান বইয়ে চোখ রেখে বলে,
– বলো শুনছি।
– একটু কোলে মাথা রেখে শুবে? আমি তোমার চুলে হাত বুলিয়ে দিবো?

দিহানের কানে যেতেই ধপ করে বই বন্ধ করে আনিশার কোলে মাথা রাখে। দিহান প্রচণ্ড খুশি হয়। আনিশা যেই দিহানের মাথায় হাত বুলাবে ওমনেই ধাক্কা দিয়ে দিহানকে কোল থেকে সরিয়ে খাট থেকে নেমে যায় আনিশা। আনিশার এহেন কান্ডি দিহান আশ্চর্য হয়ে গেছে! আনিশার উদ্ভট উদ্ভট আচরনগুলো খুব ঘায়েল করে দিহানকে। কেন এই অমানুষিক অত্যাচার? দিহান বুঝতে পারেনা।

– আনিশা? তুমি এমন করলে কেন? ঘাড়ে ব্যাথা পেয়েছি তো। কি হয়েছে তোমার?

আনিশা সেখান থেকে সরে এসে জানালা খুলে বৃষ্টির ছাটে গা হেলায়। দিহানের প্রশ্নে মাথা ঘাটাতে ইচ্ছে করছে না ওর! দিহান কখনো ওর পূর্ব হতে পারবেনা। চাইলেও না!

গত কয়েকদিনের সমস্ত রাগ, জিদ, ক্ষোভ একত্র করে ঢেলে দিচ্ছে পূর্বের ঠোঁটের উপর। বেশ খানিকটা সময় পেরুলে পূর্বকে ছেড়ে দেয় পূর্ণতা। জোরে জোরে নিশ্বাস ছাড়ছে দুজনেই। পূর্ব আহত গলায় তাচ্ছিল্য করে বললো,

– কি করলে তুমি পূর্ণ? ঠোঁট কেটে দিলে? আমার উপর এতো রাগ?

পূর্ণতা হারিকেনের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলো পূর্বের ঠোঁটে রক্ত। পূর্ব হাত দিয়ে রক্ত মোছার চেষ্টা চালাচ্ছে। পূর্ণতা পূর্বকে কোল থেকে নামিয়ে হেটে হেটে লাগেজ খুলে তুলোর প্যাকেট থেকে তুলো ছিড়ে আনে। পূর্বের হাত সরিয়ে কাটা ঠোঁটে তুলো চেপে ধরতেই মৃদ্যু গলায় বলে উঠে,

– যেখানে তুমি আমার রোগ বানিয়ে দিয়েছো সেখানে রাগ থাকলে সমস্যা কি?

পূর্ব অবাক হতেই হঠাৎ ফিক করে হেসে দিয়ে বলে উঠে,

– কি বললে?

– ‘চলবে’

# FABIYAH_MOMO🍁