#তোকে_ঘিরে ❤
#পর্ব_৫৮.
#ফাবিয়াহ্_মমো
রাতটা দীর্ঘ। চারপাশ নিস্তব্ধ। আকাশটা থেমে থেমে মৃদ্যু শব্দে ডেকে উঠছে। বৃষ্টি শেষ হওয়ার পর বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে জমাটবদ্ধ পানিগুলো একনাগাড়ে কোথাও পরছে। বাতাসটা শীতল। গায়ে মোটা কম্বল জড়িয়ে ব্যস্ত শহরটা ঘুমিয়ে পরেছে। অন্ধকারময় স্বল্প আলোর রুমটা এখন বেশ শান্ত। পূর্ণতাকে বুকে টেনে শুয়ে আছে পূর্ব। এলোমেলো চুলগুলো পূর্বের আঙ্গুলের ফাঁকে পরম আবেশে হেলেদুলে খেলছে। পূর্ণতার উষ্ণ নিশ্বাস পূর্বের উজ্জ্বল ফর্সাটে বুকটার উপর ক্ষণেক্ষণে পরছে। পূর্ব তাকিয়ে আছে স্বচ্ছ কাঁচের থাই জানালার বাইরে। রাতের তারাগুলো কালো চাদরে মুক্তোর মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। অজানা ভয়, অচেতন মন বারবার সুক্ষ কারনে চিন্তার সাগরে ডুবছে। নির্বাচন যতো এগিয়ে আসছে, ভেতরে ভয়ের কোন্দল ততোই যেনো জটলা বেধে কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আজ পূর্ণতাকে এভাবে কাছে টেনে রাখার বর্ণিল মূহুর্তগুলো সে জীবনের একেকটা বিশেষ স্মৃতি হিসেবে জমা করছে। পূর্ণতাকে ছাড়া তার জীবনের গতিধারা যে অচল, এটুকু বুঝে গেছে পূর্ব। যতো উত্থাল-পাত্থাল ঝড়ই আসুক, সে পূর্ণতার কাছে ভিড়লে সবকিছুই ভুলে যায়। অদ্ভুত ভাবে সকল যন্ত্রণা পূর্ণতার আবেগ, স্পর্শ, ভালোবাসার আচ্ছাদনে মুছে যায়। পূর্ব অঘোর চিন্তায় মশগুল থাকলে হঠাৎ তার খোচা খোচা দাড়ির উপর নরম হাতের স্পর্শ পায়। চকিতে তাকাতে গিয়ে দেখে পূর্ণতা বুকে থুতনি ঠেকিয়ে কেমন শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে। এই শান্ত, চন্ঞ্চল ভাবটা পূর্বের কতই প্রিয় তা পূর্ণতা হয়তো জানেনা। পূর্ব গাল থেকে হাতটা টেনে ঠোঁটের কাছে এনে প্রতিটা আঙ্গুলে চুমু খেলো। পূর্ণতার মাথা থেকে হাত সরিয়ে ওর চিবুক স্পর্শ করে বললো,
– ঘুমাওনি?
পূর্ণতা শান্ত দৃষ্টিতে ‘না’ সূচকে মাথা নাড়ালো। কোনো শব্দ উচ্চারণ করলো না। পূর্ব আঙ্গুলের ফাঁকে আঙ্গুল গুঁজে দিয়ে মুঠোবন্দি করলো পূর্ণতার হাতটা। ওভাবেই শক্ত করে ধরে রইলো সে। পূর্ণতার কপালে কিছু চুল এসে চোখের উপর বিরক্তির উদ্রেক করলে আঙ্গুলে চুলগুলো কানের পেছনে সরিয়ে দেয় পূর্ব। আবারও সে শান্ত কন্ঠেই জিজ্ঞেস করলো,
– ঘুমাওনি কেন? তোমার আসল শয়নশয্যায় শুয়ে আছো। এরপরও ঘুম নেই?
পূর্ণতা চোখ বন্ধ করে ছোট্ট নিশ্বাস ছাড়লো। সেই নিশ্বাসের উষ্ণ বায়ুটা আবারও পূর্বের বুকের উপর আছড়ে সেটা চর্তুদিকে ছেয়ে গেলো। চোখ খুলে পূর্বের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রসন্ন কন্ঠে বললো,
– কালরাতেও হয়নি ভাবতে পারিনি আজ রাতে তোমাকে পাবো। এখন কাছে পেয়েও হারানোর ভয়টা খুব করে কাজ করছে পূর্ব। তোমাকে পাওয়া তো সোনার হরিণ পাওয়ার মতো সুখ। এখন যে কালকের জন্য চিন্তা হচ্ছে!!
পূর্ণতার কথা শুনে শব্দ করে হেসে উঠলো পূর্ব। খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতেই বালিশ থেকে মাথা তুলে পূর্ণতার কপালে ঠোঁট স্পর্শ করে পুনরায় শুয়ে পরলো। পূর্ণতার চোখে মুখে তখন ভীত অবস্থার শঙ্কা। মুখে সেটা প্রকাশ না করলেও পূর্ব ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আশ্বাস বাণীতে বলে উঠলো,
– আমাকে এতো বেশি মহা মূল্যবান ভাবো দেখেই তুমি মাত্রার চেয়ে বেশি কষ্ট পাও। কালরাতে কেমন ছিলে, আর আজ রাতে কেমন আছো সেসব ভেবে তো টেনশন করে লাভ নেই। আমি তোমার আশেপাশে, সামনে-পিছে সবখানেই আছি এটুকু শিউর থাকো। টেনশনের ঝুলিটা আমার কাছে দিয়ে চুপচাপ একটু ঘুমাও। নয়তো এই চোখদুটো দেখছো না? এই চোখদুটোর নিচে কালি জমে বয়স তেত্রিশ বানিয়ে দিবে।
পূর্ণতা আর কথা না বারিয়ে শুয়ে পরতেই কম্বলটা গায়ে টেনে ঢেকে দিলো পূর্ব। রাত যতো দীর্ঘ হচ্ছে ঠান্ডা ভাবটা একটু করে যেনো বাড়ছে। পূর্ব চোখ বন্ধ করলেই অযথা চিন্তা এসে ভিড় করে মাথায়। ইমতিয়াজ উদ্দিন এখনো পিছু ছাড়েনি পূর্বের। আগে সরল ভাষায় হুমকি দিতো, এখন অশ্লীল ভাষায় পূর্ণতাকে ক্ষতি করার কথা উঠায়। লোকটা এমপির ক্ষমতা না পেয়েও যেভাবে মানুষ হাত করে রেখেছে এতে বোঝাই যায় ইমতিয়াজের মতো মানুষ কতটা ভয়াবহ। কাল বাদে পরশু ওই বদমাইশ লোকটা ঠিকই টুকে টুকে পূর্ণতার খোঁজ বের করবে। পূর্ণতা চোখ বন্ধ করলেও স্পষ্ট টের পাচ্ছিলো পূর্ব কোনো কারনে ঘুমাতে পারছেনা। রাত এখন তিনটা বাজলেও ঘুমের কোনো হদিশ নেই পূর্বের। পূর্ণতা আবার মাথা উঠিয়ে কপাল কুঁচকে ক্ষেপে গিয়ে প্রশ্ন করলো,
– নিজে ঘুমাচ্ছো না কেন?
পূর্ব ওর রাগান্বিত মুখ দেখে যেই হাসি দিবে ওমনেই পূর্ণতা ওর ঠোঁটে হাত চেপে ওই ভঙ্গিতেই বললো,
– একদম হাসবেনা! আমি এখানে হাসির কি বলেছি? আমার সাথে ফাজলামি করছো? কি কারনে ঘুমাচ্ছো না? পার্টির চিন্তা নিয়ে রাতনষ্ট করার ধান্দা তোমার? নাকি ওয়াসিফ ভিলায় আরেক বউ রেখে এখানে প্রথম বউয়ের সাথে সময় কাটাতে এসেছো? কি নিয়ে তুমি ঘুমাচ্ছো না বলো দেখি! আমি সত্যি তোমার পেটের কথা শুনতে চাই! দয়াকরে আর লুকিয়ে রেখো না।
পূর্ণতার অবস্থা দেখে চোখ বন্ধ করে হেসে দিলো পূর্ব। এখনো ঠোঁটের উপর পূর্ণতার হাত। আর সেই হাতের আড়ালেই পূর্ব ঠোঁট চেপে হাসছে। পূর্ণতা স্থির পানে পূর্বের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। ঘন লম্বা পাপড়ির চোখদুটো হাসির জন্য বন্ধ হয়ে আছে। আল্লাহ্ পাক মানুষের সর্বস্ব কেড়ে নিলেও রাতের অন্ধকার শেষে ভোরের কিরণ হিসেবে এক টুকরো হাসির মুর্ছনাটা সর্বত্র যেনো ছড়িয়ে দেয়। মানুষটার গম্ভীর মুখের পেছনে হাসির ছায়াটা এতো সুন্দর, মন ও মস্তিষ্ক বশীভুত হয়ে যায় তা দেখে। পূর্বের ঠোঁট থেকে কখন হাতটা সরিয়ে ফেলে পূর্ণতার সেই ধ্যান নেই। এখনো মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পূর্বের দিকে। পূর্ণতার ওমন চাহনি দেখে ধীরে ধীরে হাসি থামিয়ে ফেলে পূর্ব। পূর্ণতাকে কাছে টেনে চোখ বন্ধ করে ওষ্ঠ স্পর্শ করে পূর্ণতার মুখের সর্বস্ব। পূর্ণতা বুঝতে পারে, পূর্ব গা ঢাকা দেয়ার জন্যই এখন কারসাজি চালাচ্ছে। আর সেই চিন্তামগ্ন কথাগুলো ব্যক্ত করবেনা পূর্ণতার কাছে। পূর্ব বালিশে মাথা রাখতেই পূর্ণতাকে জড়িয়ে ধরে সেদিনের মতো, যেদিন পূর্ণতা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে পূর্বের গাড়ির কাছে সেন্সলেস হয়েছিলো। হিম হয়ে যাওয়া পূর্ণতার শরীর দুইহাতের মাঝে আবদ্ধ করে উষ্ণ বুকের সাথে চেপে ধরেছিলো সে। ঠিক বুকের পাজরের কাছে পূর্ণতার অস্তিত্ব ছিলো তখন। অদৃশ্য অধিকারবোধে পূর্ণতার গায়ে হাত রাখতেও দ্বিধান্বিত ছিলো না পূর্ব। সেই রাতটুকু আজও স্মৃতি হিসেবে সতেজ হয়ে মনের আঙিনায় নেচে বেড়ায়। ট্রেনের বগিতে পূর্ণতার সাথে খুনশুটিগুলো মনে পরলে এখনো হাসিতে মন উজাড় হয়। সেই প্রথম গভীর স্পর্শ পেয়েছিলো ট্রেনে থাকাকালীন পূর্ণতার কোলে। ঘুমের ঘোরে না থাকলেও ঘুমের অভিনয়ে চোখ বন্ধ করেছিলো সে। সেই ছোট্ট কোলটায় মাথা রেখে পূর্ব শান্তি পেয়েছিলো বহুদিন পরে। নিশ্বাসের সাথে পূর্ণতার গায়ের গন্ধও যেনো একীভূত হয়ে প্রাণচঞ্চল করে দিচ্ছিলো পূর্বের। নিজেকে নিয়ে সেই প্রথম অমন ভিন্ন অনুভূতির শিকার হয় পূর্ব। পা-কাটা পূর্ণতার কোমর ধরে যখন ট্রেন থেকে প্ল্যাটফর্মে নামায় সেই স্পর্শ আর আজকের স্পর্শ এখনো আগের মতোই নতুন লাগে ওর। মানুষ কখনো পুরোনো হয়না, অনুভূতি কখনো হারিয়ে যায়না, সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা কখনো মৃত হয়না। মনের কোণে দিনকে-দিন ভালোবাসার শান্তিতে কোণঠাসা হতে থাকে তখন। আজও অটোরিকশায় উল্টোদিকের সিটে বসে আড়চোখে পূর্ণতার ছটফট চোখদুটো মনে করে পূর্ব। নিজের অনুভূতি নিয়ে যখন দ্বিধাপূর্ণে লিপ্ত ছিলো তখন আর পূর্ণতার দিকে পাত্তার চোখে দেখেনি সে। দাদাবাড়িতে ফিরে এসে পূর্ণতার সাথে যেই অঘটন কাজগুলো চাচাতোভাইবোন করেছিলো হয়েছিলো, সেজন্য তাদের উত্তম শাস্তি দিয়েছিলো সে। কিন্তু কেনো দিয়েছিলো তখনও প্রশ্নের জবাব মেলেনি পূর্বের। রাতে ঘুমাতে গিয়ে সে অনুভব করলো তার হাতদুটো কাউকে আকড়ে ধরার জন্য নিশপিশ করছে। কারো উষ্ণতায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে ইচ্ছে করছে। পূর্ব ওই মূহুর্তেও নিজেকে বুঝতে পারেনি। কথায় আছে, প্রকৃতি আকাঙ্ক্ষিত মানুষের সাথে পাঁচবার সাক্ষাৎ করায়। প্রকৃতির সেই অদ্ভুত নিয়মের জোরে আবারও দেখা হয় তার। পুরোনো কিছু অতীত আনিশার ডোরেই দেখা করিয়ে দিলো বর্তমান অনুভূতি পূর্ণতার সাথে। জীবনে কোনো মেয়েকে দেখে কাছে রাখার তীব্র বাসনা কখনো কাজ করেনি পূর্বের। সেই কঠোর চেতনার বলিষ্ঠ দৃঢ়তায় কখন যে পূর্ণতার ছোঁয়ার জন্য আকুল হয়ে উঠে টের পায়নি পূর্ব। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার মাধ্যমেই দিন যেতে লাগলো ওর। কিন্তু গ্রামীণ পরিবেশে দাদাবাড়ির নির্মল আঙিনায় কাউকে পাওয়ার জন্য আবেদন করতো মন। নিজের সমস্ত বাধকে আর ধরে রাখতে না পেরে ছুটে গিয়েছিলো পূর্ণতাদের নানাবাড়িতে সন্ধ্যার সময়। চোরের মতো একপলক কাঙ্ক্ষিত জিনিসকে দেখার জন্য ঢুকেছিলো কালো আধারির রুমটায়। পূর্ণতা তখন ভারাক্রান্ত চেহারায় বিছানায় ঘুমন্ত ছিলো। রুমের ওইটুকু আবছায়াতে সম্পূর্ণ পূর্ণতাকে দেখতে পারলো পূর্ব। কিন্তু হঠাৎ পূর্ণতার ঘুম ভেঙ্গে গেলে আর দাড়িয়ে থাকার জো খুজেঁ পায়নি ও। শেষ বিদায় জানিয়ে সে চলে গিয়েছিলো। এরপর থেকে শুরু হয় মন ও মস্তিষ্কের কুরুক্ষেত্র। মন যেখানে পূর্ণতার খোঁজে আনচান করতো, মস্তিষ্ক সেখানে বাধা দিয়ে চুটিয়ে পার্টি করতে সায় দিতো। সারাদিন নানা ব্যস্ততায় সব ভুলে থাকলেও রাতটুকুতে বন্ধ চোখের পাতায় পূর্ণতার স্মৃতিগুলো নেড়েচেড়ে ভাবতো। ঠিক দ্বিতীয় সপ্তাহের চর্তুথদিন খোঁজ দিলো ছেলেরা। ‘অ’ থেকে ‘ঔ’ পযর্ন্ত সব তথ্য এনে দিলো পূর্ণতার। ইচ্ছে করছিলো সব ছেড়েছুড়ে পূর্ণতার কাছে ছুটে গিয়ে সেই অধিকারবোধে পূর্ণতার মাঝে লুকিয়ে যেতে। কিন্তু সেটা পূর্ব করতে পারেনি আর। পাগলামাপূর্ণ আচরণ ও অসঙ্গতিপূর্ণ কথাবার্তার জন্য পূর্ণতা তখন ডাক্তারের চিকিৎসায় আওতাধীন ছিলো। খোদেজার স্ট্রিক্টনেস মনোভাব শুনে আর এগোয়নি পূর্ব। সময় যেন যন্ত্রণার প্রহর আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিলো। খোদেজা এদিকে বিয়ের জন্য ছেলে রেডি করলে দূর থেকেই উন্মাদের মতো কঠিন অবস্থা হয়ে যায় পূর্বের। আবারও দলবল ডেকে গুপ্তবেশে রাস্তা থেকে সরায় ওই ছেলে পক্ষকে। সামনে আসে সেদিন পূর্ণতার কাছে। কিন্তু ওই স্বল্প সাক্ষাৎ পূর্ণতার মনে তৃপ্তি দেয়নি। সে স্বাভাবিক সম্পর্কের মতো যখন পূর্বকে নিজের করে চাইলো তখনই ওর অবস্থা বেগতিক হয়ে উঠলো। ওই মূহুর্তে রাজিবের করা নোংরা ঘটনা শুনে হন্যে হয়ে ছুটে আসলো পূর্ব।। আয়মানের একটি কলের কারনে নিজের ভেতর নিয়ন্ত্রণের সব শৃঙ্খলাকে জলান্ঞ্জলি দিয়ে পূর্ণতার কাছে আসলো। জীবনে প্রথমবারের মতো ও অনুভব করলো ওর জীবনে পূর্ণতাকে দরকার। সেটা চাহিদার জন্য নয়, নিজের আবেগশূণ্য জীবনে এক টুকরো ভালোবাসার কাঙাল হিসেবে দরকার। ভাবতে ভাবতেই পূর্ব অনুভব করলো ওর খোচাময় দাড়ির উপর ওষ্ঠ স্পর্শ হচ্ছে। চোখ খুললো তৎক্ষণাৎ এবং আশ্চর্য হয়ে কিছু বলবে তার আগেই পূর্ণতা ওর ঠোঁটের চর্তুপাশে ওষ্ঠযুগল ছুঁয়িয়ে দিলো। পূর্ণতার আকস্মিক কাজগুলোর সারমর্ম কেনো জানি পূর্ব ধরতে পারছেনা। সে পূর্ণতাকে বাধা দিতেই মাথার একগুচ্ছ চুল খাবলে ধরে সজাগ কন্ঠে বললো,
– তুমি এমন আচরণ করছো কেন? আমিতো রাতে এমনেই কম ঘুমাই। কিন্তু এই প্রথম তুমি আমাকে পেয়েও ঘুমাচ্ছো না, ব্যাপারটা কি বলোতো?
পূর্ণতা মাথার পেছন থেকে পূর্বের হাতটা সরিয়ে চুপচাপ ওর গালের সাথে গাল মিলিয়ে পূর্বের গলার ফাঁকে মুখ গুঁজলো। পূর্ব ধারণা করতে পারছে, পূর্ণতা প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। কিছু নিয়ে হাসফাস করছে, ছটফট করছে, চিন্তায় ভুগছে। পূর্ব মাথায় হাত বুলিয়ে কৌতুহল গলায় প্রশ্ন করলো,
– তুমি যে কিছু একটা ভেবে টেনশন আছো, সেটার মূল ঘটনা কি আমাকে নিয়ে? আমার ব্যাপার হলে বলো পূর্ণ, প্লিজ ক্লিয়ার করে নিজেকে শান্ত করো।
পূর্ণতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে পূর্বকে জাপটে ধরে বললো,
– তুমি যদি রাজনীতি না করো কিছু হবে? ছেড়ে দাও না এসব। কি দরকার নিজেকে ভয়ের ভেতর রেখে? আমার প্রচুর ভয় করছে পূর্ব। তোমার যদি ভুলেও কিছু হয়…
পূর্ণতা আর কথা শেষ করলো না। এর মধ্যে পূর্ব হেসে দিয়ে বললো,
– আমার যদি কিছু হয়েও থাকে তোমার জন্য অন্ততপক্ষে বেঁচে থাকার চেষ্টা চালাবো। এইপথে নামার আগে অবশ্যই সলিড পরিকল্পনা করে রেখেছি। আমি কখনোই কাপুরুষতা পছন্দ করিনা পূর্ণ। আমি যদি নিজের স্থানে সত্য থাকি, কোনো মিথ্যার জাল এসে আমাকে ছুঁতেও পারবেনা। কথাটা কি ভুলে গেছো? ‘সত্যের মৃত্যু নেই’। সত্য যদি কখনো সামনে আসতে দেরিও করে উপরে কিন্তু আল্লাহ্ আছেন। আল্লাহ্ কখনো মিথ্যাবাদিকে সার্পোট করবেনা। রাজনীতি শুধু আমি একাই করছিনা, আরো অনেকে করছে। এদেশের রাজনীতি যেমন আমিও নিজেকে ওমনভাবেই তৈরী করেছি। কেমন খেলায় কোন্ কার্ড ফেলতে হয় সবকিছুই শিখেছি। বামপন্থীতে যুক্ত থেকে নানা ধাক্কা খেয়ে শিক্ষা পেয়ে এরপর নিজের শক্ত ঘাঁটি ধরেছি। এখন যদি দলের কিছু নিচুস্তরের মানুষ আমাকে নাও পছন্দ করে আমার তাতে কিছুই করার নেই। আমি সবাইকে খুশি করানোর টাস্ক নিয়ে জন্মাইনি পূর্ণ। আমি কখনোই শতভাগ মানুষকে খুশি করাতে পারবো না। একজন না-একজন আমার পরিপক্ক নিখুঁত কাজেও শত শত খুত বের করবে। তুমি নিজেই বলো, তুমি কি আমাকে কাপুরুষের মতো পিছিয়ে থাকতে বলবে? নাকি সত্যের পথে থেকে মানুষের জন্য এগিয়ে আসতে বলবে? তুমি ঠিক কি চাও বলো? তুমি কি একজন রাজনীতিবিদ ওয়াসিফ পূর্বকে চাও? নাকি নিজের স্বামী হিসেবে একজন ভীরু লোককে চাও?
পূর্বের কথা শুনে চুপ করে থাকলো পূর্ণতা। পূর্বের প্রতিবাদী চিন্তাচেতনা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই, মানুষের জন্য সরকারি ভাবে একটা অনুমোদন নিয়ে কিছু করার বাসনা ঠিক দীর্ঘদিনের। এই দীর্ঘদিনের ইচ্ছাতে পূর্ণতা নিজের আকাঙ্ক্ষা চাপিয়ে দেওয়ার ভুলটা কখনো করেনি। কিছু সময় নিশ্চুপ থেকে পূর্ণতা পূর্বের চোখের দিকে দৃষ্টি ছুড়লো। পূর্বের বুকে তখন ধুকপুক করছে উত্তর জানার জন্য। পূর্ণতা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় জোর কন্ঠেই উচ্চারণ করলো,
– তুমি অবশ্যই নির্বাচনে লড়বে এতে আমার বাধা নেই। তুমি সবার জন্য চিন্তা করবে আমি কখনো ক্ষুদ্ধ হবোনা। কিন্তু যদি কখনো তোমার উপর চিলতেখানি আচঁ পরে আমি স্বার্থপরের মতো তোমাকে সবকিছু ছাড়তে বাধ্য করবো। আমি তোমার সামান্যতম ক্ষতি দেখার জন্য কোনোদিন প্রস্তুত নই। এমপির জন্য কিছুদিন বাদে ভোট হবে আমি নিজে গিয়ে ভোট দিয়ে আসবো। কিন্তু কেউ যদি তোমাকে ক্ষতি করতে চায় আমি কিন্তু চুপ থাকবো না বলে দিলাম! আমি তোমার পার্টি অফিসে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে আসবো। সব কয়টাকে কি কি করবো তা তুমি তখনই প্রমাণ পাবে।
কঠোর আওয়াজে কথাগুলো ব্যক্ত করতেই পূর্বকে জড়িয়ে আবার শুয়ে পরলো পূর্ণতা। পূর্ব নির্বাক চাহনিতে হতভম্ব হয়ে আছে। কোনো মেয়ে পার্টি অফিসে আগুন জ্বালানোর কথা এতোটা বলিয়ান ভাবে বলতে পারে জানা ছিলো না পূর্বের। কিন্তু মনের মধ্যে এখন থেকেই ভয় কাজ করা শুরু করলো ওর। ইমতিয়াজ উদ্দিন হয়তো পূর্বকে ছেড়ে দিবেনা। নির্বাচনের বেশিদিন নেই।
.
সকাল সাতটা। রাতটুকু নির্ঘুমে কাটানোর চিন্তা থাকলেও আযানের পর চোখ লেগে আসে পূর্বের। এখনো উঠেনি সে। পূর্ণতা আড়মোড়া ভেঙ্গে চোখ ঝাপটা মেরে তাকাতেই দেখে এখনো সে পূর্বের বুকে। পূর্বের কপালে চুলগুলো সারি সারি ভঙ্গিতে ছেয়ে আছে। শরীরে এখন তাপমাত্রা তুলনামূলক কম। জ্বরের উত্তপ্ত ভাবটা কেটে গেছে। পূর্ণতা কম্বল সরিয়ে উঠে যেতে নিলে হঠাৎ চুলে টান অনুভব করে ছিটকে পরলো আবারো পূর্বের উপর। আচমকা কাহিনীতে আশ্চর্য হয়ে তাকালে পূর্ণতা দেখলো পূর্ব চোখ ছোট করে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। পূর্ণতা ঢোক গিলে কিছু বলবে তার আগেই পূর্ব গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,
– সাহস বেড়ে গেছে? আমার আগে উঠো কিভাবে?
পূর্ণতা আবিষ্কার করলো পূর্ব রাতের পর দিনের আলোতে আবার কাঠিন্য স্বভাবের রূপ ধারণ করেছে। সেই কাটকাট জবাব, গম্ভীর গলা, হাসিহীন চেহারা। পূর্ণতা সরল গলায় ঠোঁট ভেদ করে কিছু বলবে পূর্ব ওকে কম্বলের সাথে পেঁচিয়ে বিছানায় উঠে বসে। এক ভ্রু উঁচু করে তীক্ষ্মদৃষ্টিতে বলে,
– আম্মার স্বভাবটা ছাড়ো পূর্ণ। এতো ভিজে বিড়াল সাজার মানে হয়না। স্বামীর সাথে উঠলে-বসলে-খেতে পারলে ঘুমাতে-হাঁটতে-গোসলও করতে পারবে। হিসাব বুঝছো?
পূর্বের কথার প্যাঁচ বুঝতে আর বাকি রইলো না পূর্ণতার। বেটা সারারাত জ্বালিয়ে এখন দিনের শুরুতেও জ্বালাতে চাইছে বোঝা শেষ।পূর্ণতা লজ্জায় মাথা নিচু করেই রইলো, কিছুই বললো না মুখ দিয়ে।
.
সকালের নাস্তাটা সেরে নতুন জবের নতুন বেশভূষায় রেডি হলো আয়মান। গায়ে সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট, গলায় কালো টাই ঝুলিয়ে পুরোপুরি ফর্মাল গেটআপে তৈরী হলো। শার্ট ইন করে হাতে সিলভার রঙের ঘড়ি পরতেই স্যূটটা গায়ে দিলো। অফিসের কিছু ডকুমেন্টস ঢুকিয়ে ক্যাজুয়েল ব্যাগ নিলো। কালো চকচক করা সুজ পায়ে ঢুকিয়ে পকেট চেক করে নিলো সে। আফিয়া রান্নাঘর থেকে দৌড়ে ছেলের জন্য বিদায় জানাতে আসে। ছেলের দিকে আপাদমস্তক তাকিয়ে বলে,
– বাবা রে, তোকে দেখলে বুকটা পুড়ে।
আয়মান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দরজা খুলতে গিয়ে পিছু ফিরে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
– হোয়াট? তোমার বুকে কি জন্যে আগুন লাগতে গেলো? বাবা কোথায়?
ছেলের কথার ধরন দেখে কপট রাগ নিয়ে বললো আফিয়া,
– দেবো থাপ্পর! অসভ্যতার মতো এগুলো কি বলছিস?
– এখানে তুমি অসভ্যতার কি দেখলে? আমাকে দেখে তোমার বুক পুড়ে এর জন্য আমি কি করতে পারি?
আয়মানের তাচ্ছিল্যপূর্ণ কথা শুনে কান মলে ধরলেন আফিয়া। ব্যথায় আয়মান ‘ মা ব্যথা পাচ্ছি, ছাড়ো ছাড়ো ‘ করে আর্তনাদ করতে থাকলে আফিয়া চেঁচিয়ে বলে উঠেন ছেলেকে,
– বিয়ে কবে করবি তুই? আর কতদিন আমাকে জ্বালিয়ে মারবি? তোর প্যান্ট শার্ট ধুতে ধুতে আমার হাত ক্ষয় গেলো। বুকের ধড়ফড়ানি রোগে আর বাঁচিনা। আর কদ্দিন তুই আমাকে জ্বালাবি বল?
আয়মান শেষ পযর্ন্ত মায়ের কান মলা থেকে নিস্তার পেলো। কানে হাত ডলতে ডলতে ব্যথিত ভঙ্গিতে বললো,
– কান দেখো তো লাল করছো কিনা। ইশ কেউ এইভাবে ধরে? ছিড়েই তো ফেলছিলে কানটা!
আফিয়া কান দেখতে গিয়ে আরেকবার জোরে মোচড়ে দিলেন সেখানে। ব্যথার জায়গায় ব্যথা পেয়ে তীব্র চিৎকারে ‘ আউ..’ করে উঠতেই আয়মান চোখ কুঁচকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পরে অফিসের উদ্দেশ্যে। নিদিষ্ট জায়গায় অফিসের গাড়ি থামলে তাতে উঠে পরে অফিয়ে পৌছায় আয়মান। কেবিন পযর্ন্ত যেতে যেতে সব জুনিয়র স্টাফদের সালাম ও গুড মনিং বার্তা ফিরাতে ফিরাতে প্রবেশ করে কেবিনে। ডেস্কের উপর ব্যাগটা রেখে গা থেকে কালো স্যূটটা খুলে চেয়ারে ঝুলিয়ে দেয়। চেয়ারে ঠিক করে বসতেই ডেস্কের ল্যাপটপটা অন দিয়ে ব্যাগের চেইন খুলে ও। ডকুমেন্টের ফাইলগুলো বের করে ল্যাপটপের পাশে রাখতেই কেবিনে নক করে কেউ। আয়মান স্ট্রিক্ট ফর্ম নিয়ে রিসপন্স দেয়,
– কাম ইন।
ভেতর থেকে সাড়া পেতেই জুনিয়র স্টাফ রাকিব হাসিমুখে একটা ফাইল চেক করাতে ঢুকলো। আয়মান তখন ডকুমেন্টের ফাইল খুলতে খুলতে রাকিবকে একটা ইর্ম্পট্যান্ট পয়েন্ট বলবে ওমনেই চোখ আটকে কথা থেমে গেলো ওর। একটা হাস্যোজ্জ্বল মেয়ের এ্যালবাম সাইজের ছবি ফাইলের ভেতর। আশ্চর্য হতে গিয়ে আয়মান সত্যিই কথা গুলিয়ে ফেললো। ফাইলের ভেতর সাবিহার ছবি কোত্থেকে উদয় হলো? ছবিটার দিকে তাকাতেই হঠাৎ রাকিবের উপস্থিতি খেয়াল হলো ওর। রাকিব একদৃষ্টিতে স্যারের ফাইলে গুঁজে থাকা ছবিটার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। রাগে আয়মানের রক্ত গরম হচ্ছিলো তখন! ইচ্ছে করছিলো কাঁচের ডেস্কে জোরে একটা ঘুষি মেরে সব চুরমার করে ফেলতে! নির্ঘাত মা এই উটকো কাজ করছে! বিয়ের জন্য মেয়ের ছবি দেখানোর কারসাজি হিসেবে ফাইলে ঢুকিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অবাক কান্ড হলো, শত শত মেয়ের মধ্যে সাবিহার ছবি কি করে এলো?
.
সকালে গোসল সেরে নাস্তা করে ঔষুধ গিলতেই পূর্বের ফোন চলে এলো পার্টি থেকে। পূর্ণতা পাশেই বসে ছিলো ওর এবং কি বলবে সেটা দেখবে। পূর্ব কানে ফোন লাগিয়ে পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে ছিলো। পূর্ণতার চোখ বলছে পূর্ব আজ যেনো কোথাও না যাক, ওর কাছেই থাকুক। কিন্তু মুখ ফুটে আবদানটা যেনো প্রকাশ করার সাহস পাচ্ছেনা। পার্টির লোক ফোনের বিপরীতে বিভিন্ন কথা বলতেই পূর্ব তাদের জানিয়ে দিলো সে জ্বরাক্রান্ত এবং ভীষণ অসুস্থ। অন্তত আজকের দিনটা সে একটু বিশ্রাম চায়। কাল থেকে সে আবার প্রচারণার জন্য নামবে। এটুকু শুনে পূর্ব যখন ফোন কাটলো ঝড়ের বেগে পূর্ণতা ঝাঁপিয়ে পরলো ওর উপর। পূর্ণতা খুশিতে অশ্রু বিসর্জন করে ফেলেছে দেখে পূর্ব না হেসে পারলো না। পূর্ণতার দিকে হেসে দিয়ে বললো,
– আরো চব্বিশ ঘন্টা বরাদ্দ করলাম বুঝলে? এই চব্বিশ ঘন্টা এখন তোমার। শরীরে যেটুকু তাপমাত্রা আছে আমি কিন্তু এতেই মাঠে নেমে যেতাম। জানিনা সামনের অনিশ্চিত পথে বেঁচে থাকা হয় কিনা তবুও তোমার কোনো খোয়ায়েশ যেনো অপূর্ণ না থাকে।
পূর্ব মুখ থেকে ইনিয়ে-বিনিয়ে ‘মৃত্যু’ শব্দটার মানে বুঝলে বুক মোচড়ে আসে পূর্ণতার। নিজেকে নিঃস্ব, শূন্য, খালি লাগে তার। আর কোনো উপায় নেই পূর্বকে বোঝানোর জন্য। যেখানে সব রাস্তাই পূর্বের আর্দশ চেতনার যুক্তির কাছে বন্ধ হয়ে যায়। পূর্ণতার আবেগপূর্ণ চিন্তাভাবনা পূর্বের নিঃস্বার্থ সেবাধর্মের কাছে ফিকে হয়ে যায়। পূর্ণতা নিজেকে সামলে নিয়ে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করতে গেলো। নূরানী খোদেজার আগমনে রুমের সর্বত্র গোছগাছ এবং পরিচ্ছন্ন কাজে লেগেছে। পূর্ব খুবই এক্সাইটেড শ্বাশুড়ি আম্মা তাকে এখানে দেখে কেমন প্রতিক্রিয়া দিবেন। আজ ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস ট্রেনে দুপুর একটায় ফিরবেন। খুব জমকালো সংঘর্ষের জন্য পূর্বও বেশ সজাগ এবং প্রস্তুত।
ইমতিয়াজ উদ্দিন খবর পেয়েছেন আজ পূর্ব অসুস্থতার জন্য আসছেনা। এই প্রথম যেনো বিরল প্রজাতির প্রাণী দেখার মতো আশ্চর্যজনক ঘটনা। তিনি সাইফুল খন্দকার ও মাসুদ আলমগীরকে নিশ্চিতরূপে বলে দিলেন বউয়ের সাথে লুতুপুতুতে ব্যস্ত ওয়াসিফ পূর্ব। তাই আজ আসেনি পার্টির প্রচারণার জন্য। সাইফুল খন্দকার উশখুশ গলায় বলে উঠলেন,
– ইমতিয়াজ সাহেব? একটা কথা বলি?
মেহেদি দেয়া লাল দাড়ি বুলাতে বুলাতে ইমতিয়াজ উদ্দিন বললেন,
– ভূমিকায় না এসে সোজাসুজি বলুন সাইফুল সাহেব।
সাইফুল সাহেব এবার মাসুদ আলমগীরের সাথে চোখাচোখি করে নিলেন। দুজনের ভেতরেই জটিল কোনো চক্রান্ত ফাঁদার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ইমতিয়াজ উদ্দিন সেটা বুঝতে পেরে দাড়ি বুলানো থামিয়ে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
– সুন্দর কিছু ভেবেছেন নাকি মহোদ্বয় সাহেবরা?
দুজনই কেমন অদ্ভুত হাসি দিয়ে ঠোঁট চওড়া করলেন। এরপর মাসুদ আলমগীর ইমতিয়াজ উদ্দিনের কাছে ঝুঁকে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে এমন ভঙ্গি করলেন যেনো দেয়ালের ভেতর মানুষ লুকিয়ে তাদের গোপন কথা শুনছে। তিনি আস্তে আস্তে কন্ঠ নিচু করে বললেন,
– মাল রেডি হয়ে গিয়েছে ইমতিয়াজ সাহেব। এখন চেকটা একটু সুন্দর করে সাজিয়ে আমাদের ধণ্য করুন। বুঝেনই তো দলের ভেতরে থেকে চুপিচুপি ওমন কাজ করা আজকাল কত কষ্টসাধ্য হয়ে গিয়েছে। তাই যদি আরকি একটু মেহেরবানি হিসেবে বেশি উপঢৌকন দিতেন তো ….
কথার শেষে বিশ্রী করে হাসলেন মাসুদ আলমগীর। তার দেখাদেখি সাইফুল খন্দকারও তোড়জোড় করে হেসে দিলেন। ইমতিয়াজ উদ্দিন গম্ভীর ভঙ্গিতে এমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন যেনো নির্দিষ্ট এমাউন্টে এক্সট্রা চাওয়াতে প্রচণ্ড ক্ষেপে আছেন। সাথেসাথেই হাসি থামিয়ে চুপ করে গেলেন দুজন। এরপর আকস্মিকভাবে দুজনকে চরমসীমায় চমকে দিয়ে হো হো করে হেসে দিলেন ইমতিয়াজ উদ্দিন। দম ফাটা হাসিতে হেসে দিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,
– ওই অবোধ বালককে উপরে পাঠাতে যদি আরো দুটো শূন্য বসাই সমস্যা হবে কি মহোদয় সাহেবরা? কাজ ওটা পারবেন তো?
ইমতিয়াজ উদ্দিনের হাসিতে জোরেশোরে তাল মিলিয়ে দুজন হেসে দিলেন। মাসুদ আলমগীর ও সাইফুল খন্দকার দুজন হাসির ভঙ্গিতেই চোখাচোখি করে কি যেনো বুঝিয়ে দিলেন। এরপর মাসুদ আলমগীর কাছে ঝুঁকে আগের ভঙ্গিতে স্বর নিচু করে বললেন,
– কাজটা কঠিন। কিন্তু অসম্ভব না। টপকানোর ইচ্ছা থাকলে আমাদের খুশিটা আরেকটু বাড়িয়ে দিলেই হবে।
.
দুপুর দুটোর দিকে বাসায় পৌঁছলেন খোদেজা ও কবির। পৌঁছেই তিনি ভ্রু কুঁচকে পূর্ণতার শাড়ি পরা নিয়ে কয়েকবার দৃষ্টি দিলেন। তার মেয়ে হঠাৎ কি কারনে এতোদিন পর শাড়ি পরলো বুঝতে পারলেন না। পূর্ব দুপুরের গোসল শেষে কালো টিশার্ট গায়ে ও ট্রাউজার পরে বিছানায় শুয়ে আছে। খোদেজা একবারও মেয়ের রুমে ঢুকেননি। তিনি ক্লান্ত দেহ নিয়ে ডাইনিং টেবিলের চেয়ার টেনে বসলেন। ওদিকে কবির গোসলের জন্য তাদের রুমে ঢুকে গেলেন। নূরানী পরবর্তী ঘটনা ঘটার জন্য এখুনি ভয়ে তটস্থ। এদিকে পূর্ণতার মুখেও বুলি নেই, ফুরিয়ে গেছে। খোদেজা দুজনের হাবভাব দেখে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। টেবিলের জগটা কাছে টেনে গ্লাসে পানি ঢালতেই জিজ্ঞেস করলেন,
– আমি আসার পরপরই দেখছি তোদের মুখ গোমড়া। আমার অনুপস্থিতিতে কি কিছু হয়েছে?
প্রশ্নটা ছুড়েই গ্লাস ভরতে লাগলেন খোদেজা। পূর্ণতা মাথা নিচু করে জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভেজাচ্ছে, সত্য বলার জন্য এখনো হিম্মত করতে পারছেনা সে। পূর্বকে নিয়ে যদি আরেকটা কটু কথা বলে পূর্ণতা নিজেকে সামলাতে পারবেনা খোদেজাকে ভয়ানক কথা শোনাতে। নূরানী খালাম্মার জম্পেশ রাগ সম্পর্কে জানে। তার অসুস্থ দুলাভাইকে যদি চড়-থাপ্পর মারে তাহলে নূরানী এখান থেকে হামেশার জন্য চলে যাবে। তার কতো ভালো দুলাভাইকে শুধু শুধু মারবে এটা সহ্য করবেনা নূরানী। দুজন নিজদের চিন্তায় মগ্ন থাকলে হঠাৎ পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো,
– আসসালামুয়ালাইকুম আম্মা।
হকচকিয়ে গেলো নূরানী ও পূর্ণতা। দুজনেই একে অপরের চোখের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ঢোক গিললো। খোদেজা পানির গ্লাসে চুমুক দেয়া যেনো ভুলে গেছেন। চোখের অক্ষিকোটর বিশাল বড় করে ঠোঁট গ্লাস লাগিয়ে বসে আছেন। এদিকে পানি সরাৎ সরাৎ করে খোদেজার থুতনি ভিজে কোলে পরতে লাগতে সৎবিৎ ফিরে তাড়াতাড়ি গ্লাস টেবিলে রেখে ঝট করে দাড়িয়ে পরেন। পানি ঝাটা দিতেই পূর্ব রুমের দরজায় সাথে ঠেস দিয়ে হাতভাঁজ করে আবারও বললো,
– সালামের উত্তর দেয়া ওয়াজিব শ্বাশুরি আম্মা।
খোদেজা ঝাট দেয়া থামিয়ে শুধু পূর্ণতার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালেন। পূর্ব সেটা লক্ষ করতেই ট্রাউজারের দুই পকেটে হাত গুঁজে ধীরেধীরে হেঁটে এসে বললো,
– নূরানী একটু রান্নাঘরে দৌড় দে। তোর ভাইয়া একটু জরুরী কথা বলবে।
নূরানী চুপচাপ সেখান থেকে কেটে পরলে পূর্ণতাও পূর্বের পাশ কাটিয়ে রুমে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ হয়। যেই পাশ কেটে পার হবে পূর্ব ট্রাউজার থেকে একহাত বের করে পূর্ণতার বাহু চেপে আটকালো। পূর্ণতা শিউরে উঠে পূর্বের দিকে তাকাতেই দেখলো পূর্ব খোদেজার দিকে কঠোর চাহনিতে তাকিতে আছে। খোদেজার দৃষ্টিতেও এখন ক্রোধ ঝরছে। পূর্ব তার গম্ভীর স্বভাবটা বজায় রেখে কাঠিন্য গলায় বলে উঠে,
– মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের স্বর্গ হলেও স্বামীর বুকের উপর নারীর স্বর্গসুখ! ব্যাপারটা ভুলবেন না, মা। ওর দিকে ওভাবে তাকানো বন্ধ করুন।
-‘ চলবে ‘
#FABIYAH_MOMO
#তোকে_ঘিরে ❤
#পর্ব_৫৯.
#ফাবিয়াহ্_মমো
পূর্বের বেপরোয়া ভাব ও চটান চটান জবাব দেখে প্রচণ্ড ক্ষেপে উঠলেন খোদেজা। কিন্তু পূর্ণতার কড়া চাহনি দেখে কিছুই বলতে পারলেন না। এদিকে কবির গোসল শেষে ডাইনিং স্পেসে এসেই দেখেন পূর্বকে ঘিরে এই চান্ঞ্চল্যকর অবস্থা। তিনি কপাল কুঁচকে খোদেজার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালে পুরো ঘটনার সংক্ষিপ্ত ব্যাপার আচঁ করতে পারেন। পূর্বের জন্য কিছুই বলতে পারছেনা পূর্ণতা। মনে উশখুশজনিত সমস্যা এবং প্রচণ্ড রাগে ওর গা জ্বলে উঠছে মায়ের চাহনি দেখে।পূর্ব কখনোই বড়দের অসম্মান করে কটু কথা সহ্য করতে পারেনা, তার উপর নিজের ব্যাপার নিয়ে কেউ খোদেজাকে কথা শোনাক সেটাও সে চায়না। পূর্ব ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামলানোর জন্য পূর্ণতাকে বিদায় জানিয়ে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। কবির সেটা মানতে একদম নারাজ হলেও শেষমেশ পূর্বের আশ্বস্ত সূচক হাসি দেখে ওকে যেতে দিলেন। স্ত্রীর উপর তিনিও দীর্ঘদিন যাবৎ ক্ষোভ পুষে রেখেছেন। খোদেজার কঠোর আচরণবিধি তারও কোনোভাবে সহ্য হয়না কিন্তু একবার ব্যবসায় যে লসটা হয় সেটার জন্য পরিবারটা ভালোই সঙ্কটের মুখে পরেছিলো। এরপর থেকে খোদেজা নিজের কর্মদক্ষতায় সবটুকু শক্তি খরচ করে লসের বিশাল টাকা এবং পরিবার দেখাশোনা করার দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ হয়। কবির যেখানে ব্যাপক লসের শিকার হয়ে বেকারত্ব গ্রহণ করেছিলো, সেখানে খোদেজা কর্তার ভূমিকা পালন করে সংসার ও অন্যান্য চাহিদাও মিটিয়েছিলো। সেদিনের ওইসব ঘটনার পর থেকে কবির ও খোদেজার মধ্যে নামেমাত্র স্বামী-স্ত্রী ছাড়া আর কোনো ভালোবাসার স্বাচ্ছন্দ্য ছিলো না। পদে পদে অমিল ও অমত অবস্থা সৃষ্টি হতে হতেই তাদের মধ্যে বেশ দূরত্ব এসে যায়। কবির এতোদিন শুধু এই কারনেই মেয়ের সংসার নিয়ে জোর গলায় কিছু বলার সাহস ও ভূমিকা রাখতে পারেন নি। কিন্তু আজ পূর্ব যখন বিদায় জানিয়ে চলে গেলো তখন তিনি পূর্ণতাকে জোর গলায় বলে দিলেন আজকের মধ্যেই মায়ের আচঁল ছেড়ে শ্বশুরবাড়ির দরজায় চলে যেতে। যেখানে এতোদিন পূর্ব কোনো পাত্তা দেয়নি সেখানে আজ যেহেতু পূর্ব নিজেই পূর্ণতার কাছে এসেছে, কাজেই এখানে থাকার কোনো মানে হয়না পূর্ণতার। এ কথা শুনে খোদেজা সমস্ত রাগ উজাড় করে কবিরকে পূর্বের বাড়ির লোকজনের কথা তুলে সেই বিভীষিকা আচরণের ঘটনাগুলো স্মরণ করায়। পূর্বের চাচার পরিবার ও চাচাতো ভাইবোনগুলো যেখানে এতোই জঘন্য সেখানে পূর্ণতা কি করে শান্তি পাবে! কবির একটা কথাও শোনেনি খোদেজার। তিনি চোখ শক্ত করে খোদেজাকে পাল্টা জবাবে বলে দিয়েছেন দুনিয়ায় সব পরিবারেই ছোটখাট ঝামেলা হয়। কিন্তু ঝামেলা মানে এই নয় যে স্বামী-স্ত্রী আলাদা হয়ে থাকবে। পূর্ব রাগের মাথায় হোক কিংবা জেদের বশে এতোদিন পূর্ণতাকে ইচ্ছে করেই সে দূরে ঠেলেছে। কিন্তু আজ যেহেতু নিজেই সব শর্ত ভুলে চলে এসেছে কাজেই পূর্ব মানসিক ভাবে অবশ্যই সুস্থ নেই। খোদেজা যে নিজ হাতে মেয়ের সুখের সংসারে আগুন জ্বালিয়ে তামাশা সৃষ্টি করছেন সব পার্টে পার্টে বুঝিয়ে দিলেন কবির। মেয়ে আজ বড় হয়েছে, তার বিয়েও হয়েছে। এই মূহুর্তে স্বামীর দায়িত্বে নিয়োজিত থাকাই পূর্ণতার কর্তব্য। এখানে মায়ের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ভাবনার জন্য সে স্বামীর সোহাগ ছেড়ে ওই নগন্য শর্তকে মূল্যবান করাটা বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। কবির দুপুরের খাবারের পর ঘোষণা দিলেন বিকেলের দিকে পূর্ণতাকে ওয়াসিফ ভিলায় রেখে আসবেন।এতোদিন যাবৎ যত মনোমালিন্য ও বিচ্ছিন্ন অবস্থা হয়েছিলো সব মিটিয়ে নতুন করে দুই পরিবারের সম্পর্কটা মজবুত করে আসবেন। যদি খোদেজার এতেও দ্বিমত থাকে সে যেনো কোনো ব্যাপারে নাক না গলায় এটাও পরিস্কার গলায় জানিয়ে দিলেন। পূর্ণতা বাবার কঠিনীভূত আচরণ খুব কমই দেখেছে বটে। তার উপর মায়ের সাথে কখনো উঁচু গলায় কথাও কবির বলেনি। নিতান্ত চুপচাপ, ঝামেলামুক্ত এবং সরল ভাবে চলতে ভালোবাসেন কবির। খোদেজার মতো বেহুদা চিন্তা ও ঝামেলা ডাকা একদম অসহ্য ভাবেই দেখেন তিনি। কিন্তু এ যাবৎ সব মুখ বুজে সহ্য করা গেলেও পূর্বের আচমকা আগমনে উনার চুপটি অবস্থা নাড়িয়ে দেয় যেনো। তাই তিনি ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে কথাও শুনিয়ে দেন খোদেজাকে।
.
মুখ টিস্যু চেপে গাড়িতে উঠতে হয়েছে পূর্বের। মাস্ক ও কালকের পোশাক এখনো কবিরের ফ্ল্যাটে পূর্ণতার কাছে। শরীরে ম্যাজম্যাজে ভাব থাকলেও কাল রাতের তুলনায় অনেকটাই সুস্থ বোধ করছে সে। স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে যেই গাড়ি টান দিবে ওমনেই ভ্রুকুটি করলো পূর্ব। গাড়ির সব জানালা আটকানো বিধায় ওকে কেউ দেখতে না পেলেও বাইরে দাড়ানো দারোয়ানের দিকে ওর তীক্ষ্ম দৃষ্টি আটকালো। দারোয়ান হতাশ মুখে এমন ভাবে কাঠের টুলে বসে আছে যেনো এখুনি হাউমাউ করে কেদেঁ দিবে। ব্যাপারটা খটকা লাগতেই সে বাধ্য হলো দারোয়ানের মুখোমুখি হতে। দারোয়ান প্রথমে খেয়াল না করলেও পরে যখন মুখ তুলে তাকায় চোয়াল বিশাল বড় হয়ে কথা জড়িয়ে যায়। পূর্ব আশেপাশে দৃষ্টি দিয়ে দারোয়ানকে একটু ভেতরে কোথাও প্রাইভেসি জায়গায় নিয়ে যেতে বললো। দারোয়ান তার ছোট্ট একরুমের অন্ধকার রুমে পূর্বকে নিয়ে গেলো। ময়লা বিছানা, শক্ত তোশক, ভ্যাপসা গন্ধে গা গুলিয়ে আসে রীতিমতো। এই দারোয়ান কিভাবে এমন অপরিচ্ছন্ন রুমে ঘুমান? পূর্বের সামনে একটা প্লাস্টিক টুলে দারোয়ান মাথা নিচু করে বসলো। পূর্ব লোকটাকে জোর দিতেই দারোয়ান নিজের নাম মোজাম্মেল উল্লেখ করে বললো তার বড় মেয়ে কলেজে পড়ে। শামসুল হক খান, (ডেমরা) কলেজে অধ্যয়নরত। মেয়ের জিদে কারনে ওই বড় কলেজেই ভর্তি করান তিনি। কিন্তু আর্থিক অবস্থা এতো শোচনীয় যে দুবেলা তিনি খেতেও ভয় পান। তার পরিবার ডেমরায় একটা ছোট্ট ভাড়া বাসায় থাকে, আর উনি এই আবাসিক এলাকায় দারোয়ানের চাকরী করে টাকা কামান। সবটা শুনে পূর্ব দারোয়ানের ফোনটা দিয়ে তার টিমের কাছে মিসকল দিলো। সাথেসাথেই ওই নাম্বারে ব্যাক করতেই পূর্ব নিজের পরিচয় দিয়ে দারোয়ানের সমস্যাটা গোপনে চুকিয়ে দিলো। দারোয়ান আপ্লুত হয়ে হাউমাউ করে কেদেঁ দিলেন পূর্বের হাতদুটো ধরে। অমায়িক ঠান্ডা কন্ঠে বললেন,
– তুমি আমারে উদ্ধার করলা বাজান। আমি চিন্তায় চিন্তায় কাহিল হইয়া গেছিলাম। বিষ খাইয়া মরবার পথও রাখেনাই আমার মাইয়া। ছোট থেইকাই স্বপ্ন দেখতো লেহাপড়া কইরা বড় কলেছে পরবো, আমি এক মূর্খ কামলা জীবনেও মাইয়ার বড়লোকি ইচ্ছা পূরণ করবার পারিনা। দুনিয়াডা বড় খারাপ গো বাজান। দুনিয়ার মানুষের কাছে হাত পাতলে থুথু দেয়, তারা টাকা দেয়না। এতো বড় ব্লিডিংয়ের মালিকও আমারে দু আনা দিয়া সাহায্য করলো না বাজান। তুমি ফেরেশ্তার মতো সাহায্য কইরা দিলা। এই ঋণ রক্ত দিয়াও শোধ করতে পারুম না বাপ। আমগোর মতো কামলার রক্তও বড়লোকের থুথুর চেয়ে দামী।
পূর্ব শেষ কথাটায় বিরোধ করতে চেয়েছিলো কিন্তু বাস্তব সত্যের জন্য কিছুই বলতে পারেনি। কিছু বড়লোক পরিবারের একজন সদস্যের মাসিক হাতখরচই থাকে দেড় লাখের মতো। তাদের যতোসব অদ্ভুত অভিলাষ ও শখের জন্য টাকা নষ্ট করতে বিবেকে বাধেনা। বাড়িতে শখের বশে মাছের খামার বানিয়ে খাবার কিনে দেখভাল করে, অথচ পথের ভিক্ষুককে এক টাকাও খুশিমনে দেয়না। পূর্ব মোজাম্মেল দারোয়ানকে ওয়াদা করালো ভুলেও কেউ যেনো না জানে সে এখানে আর্থিক সাহায্য করছে। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে তাহলে বলবে একজন অজ্ঞাত লোক কিছু গরীব মানুষদের সাহায্য করছে। দারোয়ান নিজের ভাষা হারিয়ে ফেলার মতো অবাক হয়ে গেলেও পূর্ব স্থান ত্যাগ করে চুপচাপ চলে যায়। দারোয়ান ধূলো উড়ানো পথটার দিকে তাকিয়ে থেকে নিরবে ইউনিফর্মের শার্টে চোখ ডলে। আকাশের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ নয়নে চোখ বুজে ফেলে দারোয়ান। দুনিয়াটা আজও বেঁচে আছে। আজও বেঁচে আছে কিছু সুপ্ত মানুষের দয়াময় গুণের জন্য।
.
বাড়িতে পৌঁছে পলাশ ওয়াসিফের সাথে দেখা করে রুমে ফিরলো পূর্ব। আয়েশা ছেলের সাথে রুমে এসেই দেখা করলেন। কালরাতে পূর্ব কোথায় ছিলো এমন প্রশ্ন করলেন না। যেখানে হামেশার মতো পূর্ব কোনো জবাবের পাট চুকাবে না। পূর্ব শান্ত ভঙ্গিতে ফ্রেশ হয়ে পান্ঞ্জাবী পরতে লাগলো।আয়েশা কাল সন্ধ্যায় ওর জ্বরতপ্ত যে অবস্থা দেখেছিলো সেটার রেশ কিভাবে গায়ে পুষে আবার বাইরে যাচ্ছে তিনি তা জানেন না। পূর্বকে কোনোকিছুর জন্য বাধা দিলেও যে লাভ হবেনা এ সম্বন্ধে আয়েশা ভালো করেই জানেন। তিনি চুপচাপ ছেলেকে একপলক দেখেই পা চালিয়ে রুম থেকে বিদায় হলেন। পূর্ব ড্রয়ার থেকে সিজার নিয়ে ঔষুধের পাতা থেকে দুটো ক্যাপসুল কেটে পকেটে নিলো। যদি মাথা ঘুরায় তাহলে একসাথে দুটো গিলে নিবে। চুলে ব্রাশ করে মোবাইলটা হাতে নিতেই শূন্য বেডের দিকে চোখ পরলো। খোদেজা আজ না ফিরলে পূর্ব সত্যি পূর্ণতার কাছে থাকতো, কিন্তু ওই পরিস্থিতিতে ঝামেলা বাড়ানোর মানে হয়না। পূর্ব দুকানে মাস্কের রাবার লাগাতেই গাড়িতে চড়ে বসলো। মোমিন ড্রাইভিং সিটে বসে আছে কিছুক্ষণ যাবৎ। পূর্ব উঠতেই গাড়ি ছেড়ে দিলো পার্টি অফিসের দিকে। আজ প্ররোচনার জন্য রাস্তায় থাকার কথা হলেও পূর্ব সিদ্ধান্ত পাল্টে বস্তি এলাকায় ঢুকার চিন্তা করলো। সেখানকার অবস্থা ও মানুষের সমস্যা সম্বন্ধে জানাটা জরুরী। গাড়িটা বস্তির মুখে দাড়ালে কৈলেশ, সবুজ ও সাব্বির এগিয়ে এসে পূর্বের সাথে যোগ দেয়। কৈলেশের হাতে খাতা ও কলম, সাব্বিরের হাতে বড় ব্যাগ, সবুজ হাত নাড়িয়ে বিশদ ব্যাপারটা পূর্বকে বোঝাচ্ছে। দূর থেকে একজোড়া চোখ পূর্বের কার্যকৌশল অনুসরণ করে ফোনে সেগুলো কাউকে বলছে। পূর্বরা কেউ লোকটাকে দেখতে পায়নি। তারা বস্তির মানুষদের প্রতিটি ঘরে ঘরে সমস্যা নিয়ে কথা শুনছে। ইতিমধ্যে বস্তির সবার সাথেই পূর্বের একটা ভালো সম্পর্ক তৈরী হয়েছে, তারা ওকে যথেষ্ট সম্মান ও সমীহ নজরে দেখে। কাটায় কাটায় ঠিক আধা ঘন্টা পর হুলস্থুল চিল্লাচিল্লি করে বিকট মাইকিং করে মিছিলের শোরগোল শুনতে পায় পূর্বের দল। বস্তির ছোট বাচ্চারা ততক্ষণে শব্দ উৎসের দিকে ছুটে গিয়ে উত্তেজনায় লাফাচ্ছে। পূর্ব একজন বৃদ্ধার ঘরে ঢুকে তার সমস্যার কথাগুলো শুনছিলো তখনই কৈলেশ পূর্বের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,
– পূর্বদা, আপনার দেখাদেখি অপোনেন্ট দলের ক্যান্ডিডেট এখানে প্রচার চালাতে আসছে। এতোদিন ভুলেও এইদিকে চুপি মারেনি, আর যেই দেখছে আজ আপনি এখানে এসেছেন ওমনেই দলবল নিয়ে হাজির। কি করা উচিত পূর্বদা? ধমকে তাড়াবো?
কৈলেশের নির্বুদ্ধিতায় পূর্ব গম্ভীর মুখে কিছু বলতে গিয়েও বৃদ্ধার উপস্থিতিতে বলতে আর পারলো না। বৃদ্ধা নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। ময়লা ফ্লোরের এককোণায় একটি বুড়ো লোক নোংরা লুঙ্গি পরে শুয়ে আছে। বুড়ো-বুড়ির সন্তানরা তাদের তাড়িয়ে দিলে দুজন এই বস্তিতে আশ্রয় নেয়। বুড়ো সারাদিন ভ্যান চালিয়ে যা কামাতো তাতেই কোনোমতে পেটের টান চুকাতো। কিন্তু এক্সিডেন্টে বুড়ো দুইপা একসঙ্গে কাটার ফলে আর কিছু করতে পারেন না তিনি। ভিক্ষাবৃত্তিতে নিরুপায় হয়ে যোগ দিয়েছেন বুড়ি। চোখে দেখেনা, তার উপর পেটেও ভাত জুটেনা। পূর্ব সাব্বিরকে ডেকে বস্তার ছোট্ট খুপরির ভেতরে ঢুকতে বললো। কৈলেশ বেরিয়ে সাব্বির ঢুকলে পূর্ব ওর ব্যাগ থেকে একটা আয়তাকার বাক্স নিয়ে সেটা সন্তপর্নে খুললো। বুড়ির দিকে মিষ্টি হেসে লম্বা ডাটগুলো টেনে বুড়ির দুইকানের কাছে ঢুকিয়ে দিতেই বুড়ি আশ্চর্য কন্ঠে হড়কে গিয়ে বললো,
– ও বাবাগো এই জীবনে এই দিনও দেখমু ভাবতে পারিনাই। চশমা দিয়া আবার সবকিচ্ছু ভালা কইরা দেখমু ভাবিনাই বাপ, এই ফকিরের দিকে তাকাইলা তুমি…
বুড়ি যতটা সরল গলায় কথাটা বলছিলো তার গলা যেনো জমাট হয়ে থরথর করে কান্নায় কাপছিলো। অনবরত তিনি পূর্বের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। পূর্ব প্রতিবারের মতো এবারও বুড়ির হাতে কিছু নোট গুঁজে দিয়ে বেরিয়ে এলো। বেরুতেই দেখলো বিপরীত দলের প্রার্থী ইবরাহিম খান দুই হাত কোমরে পিছু করে বেধে হেঁটে হেঁটে সবাইকে ভোটের জন্য আহবান করছে। কৈলেশ দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত করে মুখে বললো,
– শালার ন্যাকামি দেখছেন পূর্বদা? এই কয়দিন রাস্তাঘাট আর দোকানপাটে ভোটের জন্য চিল্লাচিল্লি করলো অথচ এইদিকে চোখ তুলেও তাকালো না। আর আজ যেই শুনছে আপনি আসছেন ওমনেই বাজনা বাজিয়ে চলে আসছে। শালা খবিশের বাচ্চা!
পূর্ব তৎক্ষণাৎ কৈলেশের দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকালো কৈলেশ মিইয়ে যাওয়া ভঙ্গিতে ঢোক গিললো। পূর্ব ওর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে সামনে তাকাতেই গম্ভীর মুখে মাস্কের আড়ালে চোখ স্বাভাবিক রেখে বললো,
– যারা অযোগ্য তারা নিশ্চয়ই গালি দিয়ে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে চায়। আমি তোমার কাছ থেকে ইদানিং যে শব্দগুলো শুনছি সেগুলো মার্জিত করো। ইবরাহিম সাহেব কি করবেন, কি করছেন সেগুলো আমাদের দেখার দরকার নেই। জনগণ সবার এবং তাদের দেখার অধিকারও সকলের। কারোর সাথে আমার জন্য হিংসা করতে যেও না কৈলেশ। আমি অবশ্যই এসব সহ্য করতে রাজি না। চলো এখন। আর শোনো ইবরাহিম সাহেব সালাম দিতে ভুলবেনা।
পূর্ব একনাগাড়ে সবগুলো কথা উগলে ইবরাহিম সাহেবের দিকে এগুলো। পেছনে ওরা দুজনও এগিয়ে এসে পূর্বের সাথে সালাম দিলো। ইবরাহিম খান অবাক হতে গিয়েও শেষমেশ হেসে ফেললেন। পূর্ব হ্যান্ডেশেক করে সৌজন্য আচরণ দেখিয়ে নির্বাচনের জন্য শুভকামনা জানালো। বস্তির লোকেরা এ দৃশ্য দেখে ইবরাহিম খানের চোয়াল ঝুলানো মুখটা শুধু দেখলো। ইবরাহিম খান হয়তো ভেবেছেন নাম-ডাক-হাক পাওয়া ওয়াসিফ পূর্ব উনাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে চলে যাবে। কিন্তু পূর্ব যে সম্মানের ভঙ্গিতে আচরণ করতে এগিয়ে আসবে তা একদম অকল্পনীয় ছিলো। পূর্ব চলে যেতেই বস্তির সকলের মুখ কেমন যেনো ক্ষুদ্ধ ভঙিমার মতো কালো হয়ে গেলো। তাদের মধ্যে হাসি-হাসি ভাবটা আর নেই। ইবরাহিম খান জোরপূর্বক হাসি দিয়ে উনাদের কাছে যেতেই ভোটের কথা নিয়ে ইশতেহার দিলেন। কিন্তু মানুষ যেনো আপ্লুত হওয়ার বদলে উল্টো বিমর্ষ রূপ ধারন করলো।
.
রাতের দিকে ওয়াসিফ ভিলায় ফিরলো পূর্ব। ইচ্ছে করছিলো পূর্ণতার কাছে যেতে কিন্তু খোদেজার রূঢ় আচরণের জন্য আর মন মানলো না সেখানে। সিটের পেছনে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করলো পূর্ব। সাদা পান্ঞ্জাবীর বুকের কাছে দুটো বোতাম খুললো। অস্থির লাগছে। জ্বরটা বোধহয় আসবে-আসবে করছে। পকেটে ট্যাবলেট থাকলেও খাওয়ার ইচ্ছা হচ্ছিলো না ওর। এসির মৃদ্যু পাওয়ারে গায়ে কাটা দিয়ে শীত করছিলো পূর্বের। মোমিনকে বলে এসিটা বন্ধ করে নিলো সে। চলন্ত গাড়ি থেকে আকাশে তাকিয়ে উদাস হয়ে গেলো পূর্ব। কালরাতের মতো পূর্ণতাকে যদি আজও পাওয়া যেতো?পূর্ণতার কথা চিন্তা করলেই মন আর সামলে থাকতে চায়না। কিন্তু ওই অহেতুক শর্তই যেনো বড় দেয়ালের মতো বিবেকে বাধা দিচ্ছে এখনো। গেট দিয়ে গাড়ি ঢুকে সেটা পার্কিং এরিয়ায় থামতেই পূর্ব বুকের বোতাম দুটো লাগিয়ে ভেতরে ঢুকলো। শূন্য বাড়ি, কেউ নেই। চাকররা খাবার খেয়ে শুয়ে পড়েছে দশটার দিকে। জ্বর না থাকলেও বুকের শুষ্ক উঠোনে চৌচির অবস্থা ঠেকছে।
কালও রাত ছিলো, আজও রাত হয়েছে। কাল পাশে পূর্ণতা ছিলো, আজ পূর্ব একা-একা রুমে আসছে। নব্ মোচড়ে দরজা খুলতেই ঘুটঘুটে সেই আগের মতো অন্ধকার। লাইট জ্বালাতেই সেই অগোছালো অবস্থা। রুমে কেউ নেই সবসময়ের মতো। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে নব ছেড়ে পূর্ব মাথা নিচু করে বেডে এসে বসলো। বসতেই পিঠ ছেড়ে দিলো বেডে। কয়েক মূহুর্ত কাটলো নিস্তব্ধে। এরই মধ্যে কানে খট করে একটা শব্দ বাজলো ওর। চোখ খুলে যেই তাকাতে নিবে ওমনেই রিনরিন গলার সুর ভেসে এলো,
– কমরেড সাহেব? খারাপ লাগছে? আমি কি আসবো?
পূর্ব বিষ্ময়ের ঘোরে দরজার দিকে তাকিয়ে ধীরে-ধীরে বেড থেকে পিঠ উঠিয়ে বসলো। ভ্রুদ্বয়ের মাঝে ভাঁজ ফেলে চোখ দুটো অনেকবার ঝাপটালো। হ্যালুসিনেশন? কল্পনা? পূর্ণতার মতো সেমি পাগল হলো নাকি? টানা একগাদা প্রশ্ন তখন মাথার মধ্যে আঁকিবুকি করলেও পূর্ব দৌড়ে ছুটে গিয়ে পূর্ণতাকে জাপটে ধরলো। ওর মাথাটা শক্ত করে বুকে চেপে পিঠ আকড়ে ধরলো। সমান তালে বুকে চাবুক পেটাচ্ছে পূর্বের। এটা যেনো সত্যি হোক সেই মিনতি অগোচরেই চাচ্ছে। পূর্ব চোখ বন্ধ করেই পূর্ণতার মাথায় অজস্র ঠোঁট ছোঁয়াতে লাগলো। উন্মাদের মতো এমন আচরণ দেখে পূর্বকে ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই পূর্ণতা দরজাটা চাপিয়ে দিলো। পূর্ণতা অনেকক্ষন পর পূর্বের পিঠে হাত রাখলো। এতোক্ষন চুপ করে পূর্বের উন্মত্ত কারখানায় আটকা পরে হাতদুটো পিঠে রাখতে খেয়াল ছিলোনা। পূর্ব শান্ত হয়ে ওকে জাপটে রাখলে পূর্ণতা প্রসন্ন কন্ঠে হেসে বললো,
– আমাকে সঙ্গে নিয়ে আসলে কি খারাপ হতো? তখন ওভাবে চলে গেলে কেনো?
পূর্ব কিছু বললো না। হাতদুটো ঢিলে করে পূর্ণতাকে ছেড়ে দিলো। ওর দিকে আপাদমস্তক তাকিয়ে দেখলো শাড়ি পরেছে পূর্ণতা। কালো রঙের শাড়ি, খয়েরী রঙের পার, চুলে খোপা করা, চোখদুটোতে কাজল দেয়া, ঠোঁট আজ কৃত্রিম লিপস্টিকে ঢাকা। পূর্ণতা স্পষ্ট বুঝতে পারলো পূর্বের দৃষ্টি স্বচ্ছ না। চোখে অদ্ভুত নেশা-নেশা ভাব জড়িয়ে গেছে। বুকের বোতামে হাত উঠেছে পূর্বের। পূর্ণতা চোখের পলকে পূর্বের হাত ধরে তীর্যক চাহনিতে বললো,
– দুপুরে খেয়েছো? ঔষুধ নিয়েছিলে? কিচ্ছু করোনি, ঠিক না?
পূর্ব কোনো জবাব দিলো না। ড্যাবড্যাব করে পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে রইলো। রাতে যেহেতু সব চাকরদের ঘুমাতে যেতে বলেছে তাই নিজেই পূর্বের খাবার এনে রুমে ফিরে এসেছে। পান্ঞ্জাবী পাল্টে, সাদা প্যান্ট বদলে টিশার্ট-ট্রাউজার পরলো পূর্ব। রাতের খাবারটা পূর্ণতার সাথে খেয়ে আবারও সেদিনের মতো বারান্দায় বিছানা করলো। তবে এবারের বিছানাটা পূর্বিকার রুমে। পূর্বের রুমে বারান্দা না থাকায় স্থান পরিবর্তন হয়েছে। আকাশে একটা গোলাকার চাদঁ উঠেছে আজ। দিগ্বিদিক চন্দ্রকিরণে এমন প্রকৃতি হয়েছে জোৎস্নার আলো যেনো সত্যি চুয়ে চুয়ে পরছে। রুমের লাইট নিভিয়ে দরজা লাগিয়ে কোলে তুলে বিছানায় শোয়ায় পূর্ণতাকে। পূর্ণতার কপালে গভীর চুমু খেয়ে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। পূর্ণতা জানেনা পূর্ব হঠাৎ হঠাৎ ঠিক কি নিয়ে চিন্তায় ভুগে। এটুকু অনুমান করতে পারে হয়তো নির্বাচনের দুশ্চিন্তায় পূর্ব ধুকে ধুকে কষ্ট পাচ্ছে। পূর্ণতা তার নরম হাতদুটি দিয়ে পূর্বের খোচা খোচা গালদুটো আবদ্ধ করলো। ধরে কাছে টানলো। কিন্তু পূর্বের চোখদুটো বিষণ্নতায় কাতর। পূর্ণতা ঠান্ডা কন্ঠে নরম হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– টেনশনে আছো অথচ খুলে বলছো না। আমার দিকে ঠিক করে তাকিয়ে বলো তোমার মনের ভেতর কি চলছে।
পূর্ব চোখ বন্ধ করে কয়েক মিনিট নিশ্চুপ থাকলো। টিক-টিক-টিক করে সময় অতিক্রম হচ্ছে পূর্ব চোখও খুললো না, কিছু বললোও না। এদিকে পূর্বের আচমকা চুপচাপ অবস্থা দেখে ভয়ে পূর্ণতার বুকে ধড়ফড় ধড়ফড় করে হৃদপিন্ড ছুটছে। নিশ্বাসে টান লাগতে শুরু করেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ-কাঠ হচ্ছে টেনশনে। পূর্ব হঠাৎ ছোট্ট নিশ্বাস ছেড়ে চোখের পাতা ধীরে ধীরে খুললো। পূর্ণতার স্থিরদৃষ্টির দিকে চোখাচোখি হতেই অদ্ভুত শূন্য আভায় নিচু স্বরে বললো,
– হয়তো আমাদের আর দেখা হবেনা। আমার মন বলছে তুমি আর কোনোদিন আমায় পাশে পাবেনা। আমার বুকে মাথা রেখে হাতে হাত জড়িয়ে ঘুমটা হয়তো হারিয়ে যাবে পূর্ণ। আমি আবারও তোমাকে ফেলে ওয়াদা ভঙ্গ করে হয়তো অনিশ্চিত দিকেই ছুটে যাবো। হয়তো আর কখনো তুমি আমাকে এইভাবে কাছে টেনে রাখবেনা। সুযোগটা হারিয়ে…
পূর্ব তার কথা শেষ করলো না। কেনো জানি করতে পারলো না। বুকের কোথাও ক্ষরণ হচ্ছে ওর। চাপা ব্যথায় নিশ্বাস ভারী হচ্ছে।অবচেতন মন তোলপাড় করছে। অজানা ভয়ে মন কুকড়ে আসছে। পূর্ণতার দিকে চোখ ফেলতেই জোৎস্নার কিরণ যেনো জ্বলজ্বল করে অশ্রুর সাথে খেলছে ওর। পূর্ণতা নিচের ঠোঁট কামড়ে তাড়াতাড়ি চোখের উপর কবজি তুলে ঢাকলো। পূর্ব চমকে গিয়ে বিষ্ময় জড়ানো কন্ঠে কিছু বলবে তার আগেই পূর্ণতা ফুপানো কান্নায় জোর দেখিয়ে বললো,
– তুমি মরতে চাইলে মরো। আমিও তোমার মৃত্যুর পর ওই জায়গা তছনছ করে আসবো। সব শেষ করে দিবো আমি। কিচ্ছু বাদ রাখবো না ওয়াসিফ পূর্ব! আমি সব নষ্ট করে আসবো!
– ‘ চলবে ‘
#FABIYAH_MOMO