তোমাকে ঘিরে আমার অনুভূতি পর্ব-১৬

0
703

#তোমাকে_ঘিরে_আমার_অনুভূতি💖
#পর্ব_১৬
#Anika_Fahmida

আদ্র অনুকে বিয়ে করতে চায় এই কথাটা আদ্রের মুখ থেকে শুনে আনোয়ার হোসেন রেগে গেলেন। তাই রাগের ফলস্বরূপ আনোয়ার হোসেন আদ্রের গালে ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। আদ্র কখনো ভাবে নি তার বাবা আজ তাকে এভাবে থাপ্পড় দিবে। যেই বাবা কখনো আদ্রের গায়ে হাত তুলেনি আজ সেই বাবাই আদ্রকে থাপ্পড় দিল! এদিকে আদ্রের মা রেহেনা পারভিনও এই দৃশ্য দেখে কেঁদে ফেললেন। আদ্র ব্যথিত স্বরে অবাক হয়ে আনোয়ার হোসেনকে বলল,

–বাবা তুমি আমাকে মারলে?

আনোয়ার হোসেন কড়া গলায় আদ্রকে বলল,

–হ্যা মারলাম। তুই কি করে বললি যে তুই অনুকে বিয়ে করতো চাস? মুখে একবারও আটকালো না? নেহাতই তোরা ছোট বেলা থেকে একসাথে বড় হয়েছিস তাই তোদের আমি কিছু বলতাম না। কাজিনরা গল্প আড্ডা করে ভেবে এতো কিছু মনে করতাম না। কিন্তু আজ তুই বেশি অতিরিক্ত বলে ফেলেছিস। অনুদের পরিবারের স্টেটাস আর আমাদের পরিবারের স্টেটাস আকাশ পাতাল তফাৎ। অনু মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। আমি কখনো আমার ছেলের বিয়ে কোনো মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের সাথে দিব না।

রেহেনা পারভিন আনোয়ার হোসেনকে বলল,

–তুমি আমার বোনের পরিবার নিয়ে আর একটা বাজে কথাও বলবে না। আমার বোন তোমার খায় পড়ে না।

আনোয়ার হোসেন রেহেনা পারভিনের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,

–বাহ্ যেমন ছেলে তার তেমন মা। মায়ের যদি এরুকম কথাবার্তা হয় তাহলে ছেলেও তো তেমনই হবে।

আদ্র চোখ বন্ধ রাগ কনট্রোল করার চেষ্টা করে আনোয়ার হোসেনকে বলল,

–বাবা প্লিজ তুমি মাকে কিছু বলো না। আমাকে যা বলার বলো। কিন্তু মাকে কিছু বলো না।

আনোয়ার হোসেন গম্ভীর স্বরে আদ্রকে বলল,

— কেন বলবো না? তোর মায়ের অতিরিক্ত আশকারা পেয়েই তো তুই এমন বেয়াদব হয়েছিস। আদ্র একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ আমি অনুকে আমার ঘরের পুত্রবধু হিসেবে কখনো মেনে নিব না। তুই অনুকে ভুলে যা। অনু তোর কাজিন ঠিক সেই সুবাদে কাজিন হয়েই থাকবে। আমি দেশের নামকরা বিজনেসম্যানের মেয়ের সাথে তোর বিয়ে দিব।

আদ্র একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে আনোয়ার হোসেনকে বলল,

–নামকরা বিজনেসম্যানের মেয়েকে আমি বিয়ে করতে পারব না বাবা। আমার অনুকেই লাগবে। তুমি অনুকে পত্রবধু হিসেবে মানো বা না মানো আমি অনুকেই বিয়ে করব। ভালোবাসায় স্টেটাস মানে না বাবা। স্টেটাস মানে না। আমি অনুকে ভালোবাসি। তাই আমি অনুকেই বিয়ে করব। তুমি আমাকে আটকাতে পারবে না।

আদ্র সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে নিজের রুমে চলে গেল। আদ্রের মা রেহেনা পারভিনও আদ্রের রুমের দিকে ছুটলো। আনোয়ার হোসেন ভাবতেও পারছেন না যে আদ্র অনুর জন্য এতোটা পাগল হয়ে গেছে। কি করে তিনি আদ্রকে আটকাবে সেই চিন্তাই মাথায় ঘুরতে লাগল।

আদ্র নিজের রুমে এসে রেগে পাশে রাখা বড় ফুলদানিটা আঁচড়ে ভেঙে ফেলল। ফুলদানিটা টুকরো টুকরো হয়ে গেল। আলমারির আয়নাটাও গিটার দিয়ে ভেঙে ফেলল। আদ্রের সবচেয়ে প্রিয় গিটারটাকেও আদ্র আঁচড়ে ভেঙে টুকরো করে ফেলল। রেহেনা পারভিন আদ্রের রুমে এসে ভয় পেয়ে আদ্রের হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে বলল,

–আদ্র এসব কি করছিস তুই? রুমের জিনিসপত্র ভেঙে ফেলছিস কেন? থাম বাবা। এগুলো ভাঙলে কোনো সমাধান হবে না। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস।

আদ্র রেহেনা পারভিনকে বলল,

–কিছু ঠিক হবে না মা। কিছু ঠিক হবে না। বাবা কি করে আমার আর অনুর সম্পর্কটাকে অস্বীকার করতে পারল? আমি অনুকে ভালোবাসি জেনেও বাবা কি করে আমাকে এতোগুলো কথা শুনাতে পারল? আমার চাওয়া পাওয়ার কি কোনো মূল্যই কি বাবার কাছে নেই? মা আমি যদি অনুকে না পাই আমি কিন্তু সব কিছু ধ্বংস করে ফেলবো। নিজেকেও শেষ করে দিব।

রেহেনা পারভিন আদ্রকে বলল,

— না বাবা এমন কথা বলে না। শান্ত হ। তোর বাবার আপত্তি থাকলে কি হবে? আমি তো অনুকে মন থেকে পুত্রবধু হিসেবে মেনে নিয়েছি। তুই অনুকে বিয়ে করে নিয়ে আয় বাবা। আমার বোনের মেয়েটা আমার ছেলের বউ হবে তা ভাবতেই আমার যে খুশি লাগছে।

রেহেনা পারভিনের কথা শুনে আদ্রের রাগ কমে গেল। আদ্রের খুশি হয়ে রেহেনা পারভিনকে বলল,

–সত্যি মা অনুকে তুমি মেনে নিয়েছো?

–হ্যা রে বাবা অনুকে আমি মেনে নিয়েছি।

আদ্র হেসে রেহেনা পারভিনকে বলল,

–লাভ ইউ মা। এজন্য তোমাকে এতো ভালোবাসি।

–পাগল ছেলে আমার। আচ্ছা আমি তোর জন্য খাবার বানিয়ে নিয়ে আসছি। আর মন খারাপ করে থাকিস না৷

–ঠিক আছে মা।

রেহেনা পারভিন আদ্রের রুম থেকে চলে গেলেন। আদ্র নিজের বিছানায় বসে অনুর নাম্বারে ডায়াল করে কল দিল। অনুর ফোনটা বেজে উঠল। অনু ঘরের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। বিছানা থেকে ফোন বেজে উঠার শব্দ পেয়ে অনু মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল আদ্র কল করেছে। অনু ফোন রিসিভ করে বলল,

–হ্যালো আদ্র?

আদ্র গম্ভীর স্বরে অনুকে জিজ্ঞেস করল,

–তোর বাসায় কোনো ঝামেলা হয় নি তো অনু?

অনু মন খারাপ করে আদ্রকে বলল,

–আদ্র আমি বাসায় আসার পর থেকেই আব্বু আমাকে অনেক বকেছে। আদ্র তোমাকে আব্বু ভুল বুঝছে। আব্বু ভাবছে তুমি বাজে ছেলে। কি থেকে কি হয়ে গেল বলো। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। মাথা কাজ করছে না।

–আমি থাকতে তোর এতো চিন্তা কিসের? আচ্ছা অনু বিয়ে করবি আমাকে? আজকে রাতে তোকে আমি বিয়ে করতে চাই।

অনু আদ্রের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। মুখে কোনো কথা আসছে না৷ আদ্র আবারও অনুকে জিজ্ঞেস করল,

–কি হলো কিছু বলছিস না কেন?

অনু ভয় পাওয়া স্বরে আদ্রকে বলল,

–আদ্র আব্বু জানলে কি হবে?

–কি হবে? কিছুই হবে না।

–আব্বু আমাদের বিয়ে মেনে নিবে না আদ্র। কিছুতেই মেনে নিবে না। আমার ভীষণ ভয় করছে আদ্র।

–অনু তোর ভয় আমি দূর করে দিব। আর কোনো কথা নয়। আজকে রাতেই আমরা বিয়ে করছি।

–আদ্র আমি তোমাকে কিছুদিন পর বিয়ে করি? আমি আসলে মানষিকভাবে বিয়ের জন্য তৈরি নই। আমার কথাটা একটু বুঝার চেষ্টা কর।

–কিন্তু আমি তোকে আজ বিয়ে করতে চাই অনু। বিয়ে করতে হলে আবার মানষিকভাবে তৈরির কি আছে?

–আদ্র সামনে আমার এক্সাম। আমাকে অনেক পড়তে হবে৷ এই অসময়ে বিয়ে করতে আমি চাই না। আর বাবার অমতে আমি কি করে তোমাকে বিয়ে করি তুমিই বলো? বাবা বিয়েটা মেনে নিবে না। বাবার রাগ আগে কমে নিক তারপর নাহয় তুমি আমাকে বিয়ে করো। তখন বাবা এতো রেগে যাবে না

–তারমানে তুই বলতে চাইছিস তুই আমাকে বিয়ে করবি না? এটাই বলতে চাইছিস?

–আদ্র তুমি আমাকে ভুল বুঝছো। আমি তোমার কাছে কিছু টাইম চাইছি। এইটুকু সময় আমাকে দিবে না?

আদ্র রাগী স্বরে অনুকে বলল,

–ওকে তোর যত টাইম লাগে তুই নিয়ে নে। কিন্তু আজ হোক বা কাল তোকে আমি বিয়ে করবই অনু ।

আদ্র ফোন কেটে দিল। অনুর ভয়ে হাত পা কাঁপছে। আদ্র এতো তাড়াহুড়ো করে বিয়ে কেন করতে চাইছে অনু বুঝতে পারছে না। এদিকে অনুর বাবা ভীষণ রেগে আছে। সামনে কি হবে অনুর জানা নেই।

গভীর রাতে অনু ড্রইং রুম গিয়ে আদ্রের দেওয়া চুড়ি আর চকলেটগুলো কুড়িয়ে নিয়ে নিজের রুমে নিয়ে আসলো। তারপর চকলেট, চুড়িগুলে টেবিলে রাখল। টেবিলে রাখা চুড়ি আর চকলেটগুলোর দিকে তাকিয়ে অনু মুচকি হাসল এই ভেবে যে আদ্র অনুকে ঠিক কতটা ভালোবাসে। অনু আদ্রের দেওয়া চকলেটগুলোর প্যাকেট খুলে খেতে লাগল৷

এদিকে গভীর রাত হওয়া সত্বেও আদ্রের চোখে ঘুম নেই। অনুকে আবারও একটা ফোন দিতে মন চাইছে কিন্তু অনুর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে ভেবে আদ্র আর ফোন দিল না৷ আদ্র বারান্দায় গিয়ে চেয়ারে বসে রইল৷ নিজের এক গালে হাত দিয়ে অন্যকিছু ভাবার চেষ্টা করলেও বারবার অনুর চিন্তাই আদ্রের মাথায় আসছে। আদ্র মনে মনে বলল,

–কেন অনু তুই এমন করছিস? বিয়েতে রাজি হলে কি এমন হতো? আমি যে তোকে কোনোভাবেই হারাতে চাই না। তুই কি বুঝিস না আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারবো না? নাকি বুঝেও না বুঝার ভান করিস!

আদ্র মন খারাপ করে গান গাইতে লাগল,

বড় ইচ্ছে করছে ডাকতে
তার গন্ধ মেখে থাকতে
কেন সন্ধ্যে সন্ধ্যে নামলে সে পালায়
তাকে আটকে রাখার চেষ্টা
আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে তেষ্টা
আমি দাঁড়িয়ে দেখছি শেষটা জানলায়
বোঝেনা সে বোঝেনা
বোঝেনা সে বোঝেনা
বোঝেনা সে বোঝেনা
বোঝেনা সে বোঝেনা
বোঝেনা বোঝেনা বোঝেনা বোঝেনা
পায়ে স্বপ্ন স্বপ্ন লগ্নে
তার অন্য অন্য ডাকনাম
তাকে নিত্য নতুন যত্নে কে সাজায়
সব স্বপ্ন সত্যি হয় কার
তবু দেখতে দেখতে কাটছি
আর হাঁটছি যেদিক আমার দুচোখ যায়
বোঝেনা সে বোঝেনা
বোঝেনা সে বোঝেনা
বোঝেনা সে বোঝেনা
বোঝেনা সে বোঝেনা
বোঝেনা বোঝেনা বোঝেনা
বোঝেনা বোঝেনা বোঝেনা

আদ্র গান গাইতে গাইতে চেয়ারেই চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ল। হয়তো স্বপ্নে অনুকে দেখার ইচ্ছেটা আদ্রের মনে প্রবল হচ্ছে।

বেশ কিছুদিন অনুকে বাড়ির বাইরে যেতে দেওয়া হয় নি। আজ বাইরে যাওয়ার পারমিশন অনু পেয়েছে। তাই আজ অনেকদিন পর অনু ভার্সিটিতে গেল। ভার্সিটিতে গিয়েই পল্লবের সাথে অনুর দেখা হলো।পল্লব হেসে অনুর দিকে তাকিয়ে বলল,

–আসলে তাহলে।

অনু বুঝতে না পেরে পল্লবকে বলল,

–কোথায় আসার কথা বলছো?

–এই যে অবশেষে ভার্সিটিতে আসলে সেটাই বললাম। তোমাকে খুব মিস করছিলাম।

–ওহ। বন্ধুকে মিস করবে এটাই স্বাভাবিক।

–তুমি মিস করো নি?

–পল্লব আমার ক্লাস আছে। আমি গেলাম।

পল্লব অনুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে হতাশ হলো। এই অনুটা কেন যে পল্লবকে একটু বুঝল না। আদ্র এসে যাওয়ার পর থেকেই অনু পল্লবের সাথে কম কথা বলে যা পল্লবের কাছে ভালো লাগছে না। অনু যেতে যেতেই ব্যাগের মধ্যে ফোন বেজে উঠল। আদ্র ফোন করেছে। অনু রিসিভ করার সাথে সাথেই আদ্র বলল,

–কি করছিস অনু?

অনু শান্ত স্বরে আদ্রকে বলল,

–আদ্র আমি ভার্সিটিতে এসেছি।

–ব্রেকফাস্ট করেছিস?

–টাইম পাই নি।

–কেন করিস নি? না খেলে অসুস্থ হয়ে পড়বি রে বোকা মেয়ে। কিছু খেয়ে আসতে হয় এটাও জানিস না?

–আমি পড়ে সময় পেয়ে খেয়ে নিব।

আদ্র কিছু না বলে ফোনটা কেটে দিল। অনু অবাক হলো। এমনি হঠাৎ করে ফোনটা কেটেও দিল? অদ্ভুত!ভার্সিটির ক্লাস শেষ হওয়ার পর অনু বের হলে পল্লব অনু্কে দেখতে পেয়ে অনুর সাথে সাথে হাঁটতে হাঁটতে লাগল। অনু পল্লবকে জিজ্ঞেস করল,

–আমার সাথে কোথায় যাচ্ছো?

–তোমাকে বাসায় এগিয়ে দিব।

–দরকার নেই। আমি একা যেতে পারব।

–এমন করে কেন বলছো অনু?

অনু এবং পল্লব ভার্সিটির মাঠ পেড়িয়ে গেটের কাছে আসতেই চোখের সামনে আদ্রকে দেখে অনু অবাক হলো। আদ্র অনুর দিকে একবার তাকাচ্ছে তো একবার অনুর পাশে দাঁড়ানো পল্লবের দিকে তাকাচ্ছে। অনু ভয় পেয়ে গেল। সাথে ঘাবড়েও গেল। আদ্রের যেই রাগ। এখন কি হবে?

#চলবে…