তোমার নামে হৃদয় পর্ব-২৭+২৮+২৯+৩০

0
330

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (২৭)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
চোখ মেলে তাকাতে আমি নিজেকে সাদিবের রুমে আবিষ্কার করলাম। অনুভব করলাম মাথাটা ভীষণ ভার ভার লাগছে। মনে হচ্ছে যেন কেউ ভারী কোনো বস্তু মাথার ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। সাথে নিজের অবস্থান দেখে আশ্চর্য হলাম। মনে পড়ল আমি তো ছাদে বৃষ্টিতে ভিজছিলাম তাহলে এখানে এলাম কি করে? হয়তো এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তাই মনে নেই। ততক্ষণে দরজার দিকে নজর পড়তে সাদিবকে দেখতে পেলাম। কিছু বলতে চেয়েও এক চাপা অভিমানের কারণে কথাগুলো মুখ অব্ধি এসে থেমে গেছে। কথা বলবো না ভেবে বসা থেকে আবার শুয়ে পড়তে নিচ্ছিলাম তখন সাদিব নিজে থেকে বলল, ” অসুস্থ শরীরে বৃষ্টিতে ভেজাটা কি খুব জরুরি ছিল? ” সাদিবের কণ্ঠে গাম্ভীর্য বজায় রইল। যার ইঙ্গিত করে সে এখনো রেগে আছে। সাদিবের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বিপরীত দিকে মুখ ফিরিয়ে রইলাম। জানালার দিকে চোখ পড়তে দেখলাম বাহিরটা ততক্ষণে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে গেছে। সময়টা আন্দাজ করতে চাইলাম। সেই তো দুপুর পেরিয়ে প্রায় বিকেলের দিকে ছাদে গিয়েছিলাম। তাহলে এখন সময় কখন হবে? দেয়াল ঘড়িতে নজর দিলাম। পৌনে এগারোটা বাজে। মাঝে এতো সময় কেটে গেছে? আর এতো সময় ধরে কি আমি পড়ে পড়ে মরার ঘুম দিয়েছিলাম নাকি? ইশ কত পড়া বাকি আছে। হাতে মাত্র দু’টো দিন মানে কাল বাদে পরশু আমার পরীক্ষা। এখনো কিছু পড়া হয়নি। পরীক্ষার খাতায় তো এরপর এক্সামিনার নাম্বারের পরিবর্তে আমাকে বড় করে একটা চশমা এঁকে দেবে। এদিকে খিদের যন্ত্রণায় পেটটাও হা-হুতাশ করা শুরু করে দিয়েছে। সারাদিন যেন তেন সহ্য করলেও এখন আর পারছি না। না পারছি কাউকে বলতে না পারছি সহ্য করতে। শেষে উপায়ান্তর না দেখে সাদিবের দিকে করুণ চাহনিতে তাকালাম তার একটু বোঝার আশায়। আপসোস সে ততক্ষণে অন্যপাশ ফিরে শুয়ে পড়েছে। খিদের অসহ্য যন্ত্রণায় একসময় হু হু করে কেঁদে দিলাম। বুঝলাম আমি না বললে এখানে কেউ আমাকে বোঝার মতো নেই। সাত পাঁচ ভেবে বিছানা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালাম। বাধ্য হয়ে কিচেনের দিকে রওয়ানা হলাম। তখন পেছন থেকে সাদিব বাঁধা দিল, ” অসুস্থ শরীরে কোথায় যাচ্ছো? ”

ভেজা কণ্ঠে বললাম, ” কিচেনে। প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। ”

আমি কাঁদছি সাদিব বুঝতে পেরে হকচকিয়ে গেল। তাতে করে তার মন গলল কিনা জানি না। উঠে এসে কপোল জোড়ায় হাত রেখে বৃদ্ধাঙ্গুলের সাহায্য সযত্নে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
” তুমি কাঁদছো? আ’ম স্যরি কাল রাগের মাথায় তোমাকে হার্ট করে ফেলেছি। আসলে মায়ের কাছে তখন এসব শুনে মাথা ঠিক রাখতে পারি নি। প্লিজ কান্না থামাও! তোমার কান্না দেখে নিজের কাছে ভীষণ গিল্টি ফিল হচ্ছে। ”

খাওয়া দাওয়া অপছন্দ করার কারণে আমার খুব একটা খিদে পায় না। বলা চলে কখনো কখনো ইচ্ছে করেও খাই না। অন্যদের কি হয় জানি না, যখন আমার খিদে বেশি পরিমাণে বেড়ে যায় তখন গা কাঁপুনির জন্য আমি স্থির থাকতে পারি না। এ মুহুর্তে আমার সাথে হয়েছে ঠিক তাই। এতোক্ষণ ঠিকঠাক মতো স্থির থাকলেও এখন স্থির থাকা অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সাদিবকে কাঁপা কণ্ঠে বলেছি, ” ডাক্তার সাহেব আমার প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। খিদের চোটে আমার গা-টা কাপছে। আমার দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে। ” কথা বলে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। সাথে সাথে ফ্লোরে বসে মাথা বিছানায় এলিয়ে দিলাম। আমার অবস্থা দেখে সাদিব এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়িয়ে থাকল না। ছুটে গেল কিচেনের দিকে।

রুমের বাহিরে যাওয়ার সময় সাদিবের রুনার সাথে দেখা হয়ে যায়। সাদিব রুনার দিকে তোয়াক্কা না করে নিজের কাজে চলে যায়। তাকে কিচেনে ডুকতে দেখে রুনা কৌতুহল বসত রুমের দিকে উঁকি দেয়। দেখতে পায় আমার করুণ অবস্থা। সে কি আসলে আমার অসুস্থতা বুঝল কিনা জানি না। সেখান থেকে খানিকটা এগিয়ে এসে বলল, ” কি হয়েছে তোমার? এভাবে এখানে বসে আছো কেন? আর ভাইয়াই বা কিচেনে কেন গেল? তাকে তো কখনো ওদিকে যেতে দেখি না। স্বামীকে দু’টো ভাতও বেড়ে খাওয়াতে পারো না বাহ্। তোমার তুলনাই হয় না। ”

একে তো অসুস্থ তার ওপর এই বদ ছেমরির যতসব গা জ্বালানো কথাবার্তা। কষ্টের সাথে সাথে এবার রাগ এসে জমাট বাঁধল। ইচ্ছে করছে কষে কানের নিচে দুইটা লাগাই। বেয়াদব বেয়ারা মেয়েছেলে কোথাকার। আগুন লাগিয়ে দিয়ে শান্তি হয় নি। এখন আসছে আগুনে ঘি ঢালতে। শুধু সাদিব আমার বিরূদ্ধে গেছে নইলে তোর মত মেয়েকে সোজা করা আমার বাম হাতের খেল। মনের কথাগুলো মনেই চেপে রাখতে হল। তন্মধ্যে সাদিব খাবারের প্লেট হাতে চলে এলো। সাদিবকে রুনা কিছু বলতেই যাচ্ছিল সাদিব সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করল না। সাদিব আমার মুখোমুখি ফ্লোরে বসে পড়ল। প্লেট থেকে ভাত মাখিয়ে মুখের সামনে ধরল। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও অসুস্থতার কারণে আমাকে তার হাত থেকেই খেতে হলো৷ অভিমান মনে চেপে রেখেই তাই চুপচাপ খেয়ে নিলাম। রুমের বাহিরে থেকে রুনার চোখে এরূপ দৃশ্য এড়ালো না।

অতিরিক্ত কোনো জিনিসই স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। সেটা যতই পুষ্টিকর খারাপ হোক না কেন? চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত নেওয়া কোনো মানুষের পক্ষে সেটা নেওয়া সম্ভব না। যদিও একেক মানুষ একেক পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ করে কেউ বেশি কেউ হয়তো খুব কম। এই ধরুন না গরুর দুধের কথাই বলা যাক। দুধ ভিটামিন সমৃদ্ধ পুষ্টিকর খাবার ঠিকই। কিন্তু আপনাকে যদি দুধের বিশাল এক গামলায় মধ্যে ফেলে দেওয়া হয় এতে করে আপনি ডুবে মারা যাবেন। তাতে কি হলো? পুষ্টিকর খাবারেই তো ডুবে মরলেন। সারাদিন অভুক্ত থাকার কারণে খাবারের দানা পেটে যেতেই পেটের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল। যতটা না খিদেরর চোটে চৌচির লাগছিল ততটা নিতে পারা সম্ভব হয় নি। তাই মাঝপথে খাওয়া থামিয়ে দিতে বাধ্য হলাম।

” প্লিজ আর না! ”

“কিছুই তো খেলে না। সবটা শেষ কর তারপর মেডিসিন নিতে হবে। ”

” আমার পক্ষে আর সম্ভব না। এরপর বেশি জোর করে খেলে সব পরে উগড়ে ফেলবো। ” শুনে সাদিব আর জোরাজোরি করল না। সেভাবেই প্লেটটা সরিয়ে রাখল।
.

.
সাদিব আমার মুখোমুখি বসে আছে। সেই তখন থেকে এক ধ্যানে এদিকে তাকিয়ে থাকায় এবার বেশ অস্বস্তি লাগছে। অস্বস্তি কাটাতে তাই দৃষ্টি নিচের দিকে নিবদ্ধ অবস্থায় রেখেছি। কথা বলার মতো শক্তি বা ইচ্ছে দুটোর কোনোটাই পাচ্ছি না। চোখের সামনে এভাবে আমার মতো চঞ্চলতায় ভরপুর মেয়েক চুপচাপ বসে থাকতে দেখে সে আমার গত দিনকার মন খারাপ বুঝল। তবে কথা শুরু করল অন্য প্রসঙ্গে।

” বৃষ্টির সময় ছাদে কেন গিয়েছিলে? ” সাদিবের কণ্ঠস্বর শান্ত ঠেকল।

কোনো ভণিতা ছাড়াই আমি সরাসরি জবাব দিলাম, ” ঘরে একা থাকতে ভালো লাগছিল না। ”

সাদিব ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ” ঘর ভর্তি এতোগুলো মানুষ থাকতে তোমার একা লাগছিল? ”

আমার তরফ থেকে সাদিব কোনো প্রতিত্তোর পেল না। আমি নির্বাক রইলাম এবং আমার দৃষ্টি তখনও নিচের দিকেই নিবদ্ধ। সাদিব পুনরায় বলল, ” বাসায় সারাদিন সাদিয়া ছিল, রুনা ছিল। ওদের প্রয়োজনে ডেকে নিতে! ”

” কি হলো কিছু বলছো না কেন? আমি তো তোমাকে কিছু বলছি তুমি কি শুনতে পাচ্ছো? ”

” হ্যাঁ আমি শুনছি! ”

” তুমি জানো তোমাকে আমি ছাদে কি অবস্থায় পেয়েছিলাম? সেন্সলেস হয়ে পড়ে পড়ে ভিজছিলে। যদি ঐ অবস্থায় বজ্রপাত হতো? ”

স্বভাব সূলভ না ভেবেই জবাব দিয়ে ফেলছি, ” হলে হতো। ”

সাদিব আমার এক হাতের কব্জিতে ধরে তার দিকে ফেরাল। কথাটা বলার পর মুহূর্তে খেয়াল করলাম সাদিবের কণ্ঠে কিঞ্চিৎ রাগের আভাস। গুরুতর সময়ে আমার খামখেয়ালীপনায় ভরা জবাব হয়তো সে আশা করেনি।

” মানে কি? আমি তোমাকে কিছু বলছি আর তুমি ঠিকঠাক কথা ছেড়ে খামখেয়ালীপনা করছ কেন? এভাবেই কিন্তু আমার রাগ উঠে তামান্না! ”

” কি করবো আমি মানুষটাই তো এমন। কোনো কথা সিরিয়াসলি নিতে পারি না। ”

” নিতে পারো না তো নিতে শিখ। তাও তো করছ না। পরেরবার যেন তোমাকে আমি বৃষ্টিতে না ভিজতে দেখি। আর একা লাগলে ওদের সাথে গল্পগুজবে সময় কাটাবে। এভাবে দেখবে তোমার সাথে ওদের সম্পর্কটা এক সময় স্বাভাবিক হয়ে যাবে। ”

আমি তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলাম। বললাম, ” সম্পর্ক আর কখনো স্বাভাবিক হওয়ার নয়। স্বাভাবিক থেকেই তো এতো কিছু হল। এখন তে মনে হচ্ছে তখন স্বাভাবিক না হওয়াটাই বোধহয় বেশি ভালো হতো। ”

” ঘুরে ফিরে সেই প্রসঙ্গে যাচ্ছো কেন? দেখ যা হওয়ার হয়ে গেছে। একে তো আমি তোমার থেকে এটা একদম আশা করি নি। তার-ওপর তুমি এখনো নিজের দোষ মানতে চাইছো না। ”

” আমরা অনেকের কাছ থেকেই অনেক কিছু আশা করি না। কিন্তু তবুও মানুষ আমাদের তাদের নিকট হতাশ হতে বাধ্য করে। আমাকে দোষারোপ করার আগে গিয়ে নিজের আদরের ছোট বোনের কাছ থেকে পারলে সত্যিটা গিয়ে শুনে এসো। ”

সাদিবের রাগে তাকে তোষামোদি করবো কি! ওর কথায় বরং আমার নিজেরই রাগ উঠে গেছে। নিজের বোন ধোয়া তুলশী পাতা অথচ দোষ না করেও আমাকে দোষারোপ করছে। যেটা আমার একদমই সহ্য হচ্ছিল না।

রাত বাড়তে গা কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসল শরীরে। জ্বরের প্রকোপে ভ্যাপসা গরম আবহাওয়ার মধ্যেও ঠান্ডার জন্য ঘুমতে পারছি না। কাঁথাতেও যেন শীত মানছে না। একে তো অনেক রাত করে ঘুমিয়েছি তার ওপর মধ্যরাতেই ঘুমের ব্যাঘাত। পরক্ষণে আমি খেয়াল করলাম দু’টো হাত আমাকে আঁকড়ে ধরেছে। ঠান্ডা থেকে বাঁচতে উষ্ণতার পাওয়ার লোভে আমিও আঁকড়ে ধরা লোকটির ডাকে সাড়া দিতে বাধ্য হলাম…..

চলবে…

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (২৮)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
আজ ঘুম থেকে উঠতে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। গত রাতের জ্বরের প্রকোপ একটাই বেড়ে গিয়েছিল যে অনেকটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে রাতটা পার করেছিলাম। তাই খুব একটা মনেও করতে পারছি না ঠিক কি হয়েছিল। এতটুকু মনে পড়ছে কাল প্রথমবারের মতো সাদিবের খুব কাছাকাছি ছিলাম। সারাটা রাত ওর সংস্পর্শে কাটিয়েছি। শরীরটা এ মুহুর্তে ভীষণ দুর্বল লাগছে। বিছানা ছেড়ে ওঠার মতো শক্তিটা পর্যন্ত পাচ্ছি না। তবুও সব ঝেড়ে জুড়ে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করলাম।

যতই অসুস্থ থাকি না কেন? স্বভাব জনিত চপলতার দরুন সেই ছোটবেলা থেকেই কখনো আমাকে শুয়ে থাকতে দেখা যেত না। সমসময় দৌড় ঝাপ করার উপরে থাকতাম। এ নিয়ে মামনি আমার সাথে কম চেঁচাত না। প্রতিবার মামনি চেঁচাত আর বাবা তাকে শান্ত করত। আমাদের বাসা অনেকটা গ্রাম সাইডে হওয়ার দরুন আমার গাছে ছড়া থেকে শুরু করে প্রায় সব কিছুর অভিজ্ঞতা আছে। বিশেষ করে দাদা বাড়ি আর নানা বাড়ি এই দুই বাড়িতে গেলে আমার দৌড় ঝাপ বেশি বেড়ে যেত। তখন মামনি চেঁচালেও লাভ হতো না। সেদিকে মামনির বকার হাত থেকে আমাকে বাঁচানোর মতো লোকের অভাব নেই। বাড়ির পেছন দিকটায় প্রায় সব ধরনের ফলফলাদির গাছ লাগানো হয়েছে। বিশেষ করে বাঙালি সব ফলফলাদি। এই তো সেদিনের কথা দেশী গাব পাড়তে গাছে উঠেছিলাম। আমি গাছের ওপর আর তনিমা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল। গাব পেড়ে পেড়ে তার হাতে মারছিলাম সে অভিজ্ঞ লোকের মতো কেচ ধরছিল। সেবার এই গাবের কশের কারণে আমার সখের সুন্দর মেরুন রঙের জামাটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এসব নজরে পড়তে তনিমা নিচে থাকায় মামনি তেড়ে এসে ওকে কষে এক থাপ্পড় মেরেছিল। আমাকে রেগে সারা বাগান দৌড়িয়েছে। শেষে না পেরে হাঁপিয়ে ওঠে এবং হাতের নাগালে পায়নি বিধায় ইচ্ছে মতো বকেছিল! গায়ে জ্বর নিয়েও আমি কম দুষ্টুমি করি নি। জ্বর হতো আমার, এই জ্বর নিয়ে হাটাহাটি দৌড়াদৌড়ি করতাম আমি অথচ মায়ের বকা শুনলে মনে হতো অসুস্থ আমি না অসুস্থ উনি নিজেই। ” মানুষ অসুস্থ হলে একটু রেস্ট নেয়। একে কখনো আমি এক জায়গায় একটু স্থির থাকতে দেখিনি। তুমি বড় হচ্ছো তামান্না! এখন তো অন্তত নিজের খেয়াল রাখ। তোমার খেয়াল তোমার নিজেকেই রাখতে জানতে হবে। অন্য কারোর ঠেকা পড়েনি যে আমার মতো নিজের কাজকর্ম সব ফেলে তোমাকে নিয়ে পড়ে থাকবে। ”

মনে পড়ে শেষবার যেদিন সাদিবরা আমাদের বাসায় ওর বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র নিয়ে গিয়েছিল তখন আমি পাশের বাসার জলপাই গাছে ঢিল ছুড়ে মারতে বেরিয়েছি। পাশের বাড়ির জলপাই গাছে প্রতিবারের ন্যায় সেবারও বেশ বাম্পার ফলন হয়েছিল। বাড়ির মালিক এতো জলপাই দিয়ে যে কি করে কে জানে! বাড়ির পেছন দিকের প্রাচীরের ওপর দিয়ে জলপাই গাছের বিশাল ডালপালা ছড়িয়েছে। সে ডাল জুড়ে জলপাইও ছিল অনেক। বাবা মামনি তখন সাদিবের বাবা মায়ের সাথে খোশগল্পে ব্যস্ত। এই সুযোগটাকে আমি আর তনিমা মিলে কাজে লাগাই। দু’জন মিলে বাবা মামনির চোখে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছিলাম সেদিকে। গাছ থেকে পাড়ার জন্য আশেপাশে লাঠি ছটা কিছুই খুঁজে পাইনি বিধায় টুকরো টুকরো ইট দিয়ে কাজ চালাতে গিয়েছিলাম। খুব বেশি সুবিধে করতে পারছিলাম না দেখে প্রাচীর টপকে প্রাচীরের ওপরে উঠে বসে পড়ি। সেখান থেকে হাত বাড়িয়ে যা পেরেছি নিয়েছি। সাদিব বড়দের মাঝখানে থাকাকালীন সময় তার ফোন এসেছিল এবং সে ফোনে কথা বলতে তাদের থেকে খানিকটা সরে জানালার সাইডে চলে আসে। জানালার থাই গ্লাস খোলা ছিল তারজন্য ঘটনাটি সাদিবের চোখ এড়াতে ব্যর্থ হয়নি। তবু সে সেদিকে খুব একটা পাত্তা না দিয়ে নিজের মতো ফোনালাপে ব্যস্ত ছিল। তার ফোনালাপের মাঝখানে হঠাৎ প্রাচীরের দিক থেকে ধপ করে একটা শব্দ হয়।

শব্দের কারণ এবং উৎস খুঁজতে ড্রয়িং রুম থেকে সবাই উঠে জানালার এদিকটায় চলে আসে। কিন্তু ততক্ষণে আমরা দুবোন পগারপার। কে আর খুঁজে পায় আমাদের! মা যদি একবার জানতে পারে আবার গাছে উঠেছি তাহলে কপালে নির্ঘাত শনি আছে। আমাকে না পারলেও তনিমা পড়বে বেখাপ্পায়। শব্দটা ঠিক কিসের ছিল সেটা কেউ না বুঝলেও সাদিব ঠিকই বুঝেছিল। সাদিবরা চলে যাওয়ার পর মামনি দু’জনকে খুঁজতে আসলে দেখে দুই বোন রুমের দুই কোণায় গাপটি মেরে চুপচাপ বসে আছি। মাকে দেখে আমি মুখ তুলে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি, ” মামনি কিছু বলবে?”

তনিমা ভেবেছিল মা ওর দিকে তাকায়নি। মায়ের সম্পূর্ণ নজর আমার দিকে। তাই বলদটা মুখে হাত দিয়ে মুখ নাড়াচ্ছিল। যেটা মায়ের শকুরের চোখের দৃষ্টি এড়ায় নি। দুইজন চুপিচুপি লবন মরিচ মাখিয়ে কাঁচা জলপাই খেতে গিয়ে মামনি চলে এসেছিল বলে লুকিয়ে ফেলেছি। কিন্তু সে তখনও বেখেয়ালে মুখ নাড়াচ্ছিল।

মামনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার থেকে জানতে চাইল, ” এই তনিমা তোর মুখে কি? কি খাচ্ছিস? ”

” কই মা না তো! কি খাবো? ”

” আমি স্পষ্ট দেখেছি তোর মুখ নড়ছে। ”

” আরে হ্যাঁ, আমি তো চুইংগাম খাচ্ছি। তুমি খাবে? দেব একটা? ”

এইদিকে সে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসছে অন্যদিকে আমি চোখ দিয়ে ইশারা করছি ঠোঁটের পাশটা মুছতে। সে তো সে-ই! কথা বলছে তো বলছে এদিকে তাকানোর কোনো ইয়ত্তা নেই।

” চুইংগাম খাচ্ছিস তাই না? তাহলে তোর মুখে লাল কি লেগে আছে বল তো? আজকাল লবণ মরিচ দিয়েও চুইংগাম খাওয়া যায়? কোন ব্যান্ডের একটা আমাকেও দে দেখি। একটু খেয়ে টেস্ট করে দেখি কেমন লাগে! ”

মায়ের কাছে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য ধরা খেয়ে কপাল চাপড়ে বসে আছি। আগাম প্রলয়ের জন্য বসে থেকে অপেক্ষার প্রহর গুনছি। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রলয় এসে দু’বোনের ওপর হামলা দেবে পাশাপাশি রেডিওতে সংবাদ প্রচার চলবে। প্রলয় শেষ হলেও রেডিওর সংবাদ শেষ হওয়ার সময় ঠিক অনুমান করা যায় না। ভাবতে ভাবতে রেডিওটি চলতে শুরু করে দিল।

মামনি আমার দিকে রাগত স্বরে বলে উঠল, ” তামান্না তুই আবার ইতরামি শুরু করে দিছিস? তোকে না আমি বারণ করেছিলাম অসময়ে গাছে না উঠতে। তখন যে পড়লি হাড়গোড় একটাও ভাঙ্গে নি। ”

মামনি বুঝে ফেলেছে তখন যে শব্দটা আমার পড়ার কারণেই হয়েছে। সাথে সাথে মুখ গোমড়া করে বললাম, ” পায়ে সামান্য ব্যথা পেয়েছি। ”

” সামান্য! সামান্য কেন একটু ভাঙতে পারল না? ” প্রায় অনেকসময় বকাঝকা করা শেষে শেষ পর্যায়ে এসে বলেছিলেন, ” আমি কিছু জানি না। তোদের বাপ এসে তোদের সামলাক। ”

বাবা শুনে বাবাও সেদিন বকেছিল বেশ!
” আমাকে বলা যেত না? আমি বাজার থেকে কম এনে দেই? ”

আমি বলি, ” বাজারেরগুলা আর এগুলা কি এক হল নাকি? ”

” তাহলে উনাদের বলে এগুলাই আনিয়ে দিতাম। তোমাকে প্রাচীর টপকাতে হবে কেন? এখন যদি পা ভাঙত তখন? ”

শব্দটা যে আমার প্রাচীর থেকে পড়ে যাওয়ার শব্দ ছিল, যেটা বাসার ভেতর থেকে সাদিব ব্যতিত কারোর চোখে পড়েনি। মূলত পড়েছি তো ওর কারণেই। নামার সময় আমাকে উঁচু প্রাচীরে বাদুরের মতো ঝুলতে দেখে লোকটা ফিক করে হেসে ফেলেছে। লোকটার অমায়িক সেই হাসির দিকে সেই মুহূর্তে আমার চোখ আটকে গিয়েছিল। হাসিটা উপভোগ করতে গিয়ে কখন আমার হাত সরে যায় প্রাচীরের গা থেকে বুঝতে পারি নি। ফলস্বরূপ আমি মাটিতে পড়ে যাই। পড়ে গিয়ে সামান্য ব্যথাও পেয়েছিলাম। মামনি আমার গায়ে হাত তোলেন না, তবে বকা দিতে একটুও ছাড় দেন না। তাই তখন বকার ভয়ে দুবোন সেখান থেকে পটাপট কেটে পড়ি।
.

.
সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে সবার উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও তামান্নাকে দেখা গেল না। এ নিয়ে সাদিবের ফুপু দু’চারটে কথা তুলতে নিয়ে পরক্ষণে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলতে পারলেন না। অবশ্য কেউ না তুললেও আশফাক শিকদারই সবার আগে তামান্নার ব্যাপারে কথা তুললেন।
” সাদিব তামান্না কোথায়? তুমি একা ব্রেকফাস্ট টেবিলে, ওকে দেখছি না যে! ”

” ও তো অসুস্থ বাবা। সারারাত ঠিক মতো ঘুমতে পারেনি সেজন্য আর ডাকি নি।”

চিন্তায় আশফাক শিকদারের কপালে ভাঁজ পরিলক্ষিত হল। সাদিবের পানে তাকিয়ে বোঝায় চেষ্টা করছেন দু’জনের মাঝে আদৌও সব ঠিক আছে কিনা। সে প্রসঙ্গে প্রশ্ন তুলতে গিয়ে পরক্ষণে খানিকটা ভেবে আর তুললেন না। শুধু জানতে চাইলেন, ” কি হয়েছে? ”

” কালকে বৃষ্টিতে অনেকক্ষণ ভিজেছে। অসুস্থতার কারণে পরে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছে। ”

গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ” তাহলে তো গুরুতর অবস্থা। এখন কেমন আছে?”

” মোটামুটি জ্বর সেরেছে। বাকিটা ওকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারবো। ”
.
.
ফ্রেশ হওয়ার পর এখন অনেকটা শান্তি লাগছে। ডাইনিং রুমে আসার সময় সবার কথোপকথন কানে আসে। কথার ধরণে বুঝলাম বাবা আমার ব্যাপারে সাদিবের সাথে কথা বলছেন। কাছাকাছি যেতে শুনতে পেলাম বাবা কণ্ঠে রাগ সাথে কিঞ্চিৎ ধমকের সহিত সাদিবকে বলছেন,

” তোমার রেসপনসেবলিটিতে থাকতে ওর এ অবস্থা হয় কি করে? কালকেই খেয়াল করেছিলাম একদিনে ব্যবধানে মেয়েটার চোখমুখের হাল কি হয়েছে। অসুস্থ তো হবেই। তোমাকে ভরসা করে ওকে তোমার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। এখন তো মনে হচ্ছে খুব বড় ভুল করে ফেলেছি। তুমি আসলে এ আমানতের যোগ্যই নও! ”

সাদিব নির্বিকার রইল। বলার মতো তার মুখ দিয়ে আর একটি শব্দও বের হতে চাইল না। কিন্তু সে চুপ থাকলেও পাশ থেকে তার মা ছেলের হয়ে চট করে জবাব খানি দিয়ে দিলেন। মনে হয় তিনি আগেই কথাটা ঠোঁটের ফাঁকে জমা করে রেখেছিলেন। যেন কথা উঠলে বলতে দেরি না হয়।

” তোমাকে বলেছিল কেউ তোমার বন্ধুর আমানত আমার ছেলের গলায় ছাপিয়ে দিতে? নিজে যে আগ বাড়িয়ে আমার ছেলের জীবনটা নষ্ট করে দিলে তার বেলায়? ”

বাবা কিছু বলতে নিয়ে আমাকে নজরে আসতে পরক্ষণে চেপে গিয়ে যথেষ্ট স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলেন। ওষ্ঠদ্বয় প্রসারিত করে জানতে চাইলেন, ” কেমন আছো মা? ”

” আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি বাবা। আপনি কেমন আছেন? আপনার শরীর স্বাস্থ্যের খবর ভালো তো? ”

” হ্যাঁ মা। আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। এসো বস এখানে। ”

সাদিব টেবিল ছেড়ে ওঠে যাওয়ার সময় সাদিয়াকে বলল, ” সাদিয়া খাওয়া শেষ হলে একবার এদিকে আয়। তোর সাথে দরকার আছে…

চলবে…..

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (২৯)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
সাদিয়া মাথা নিচু অবস্থায় সাদিবের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চেহারা জুড়ে ভয়ের আভাস! এই বুঝি ভাইয়া সব জেনে গেল। ভাবী নিশ্চয়ই এতোক্ষণে সব সত্যি বলে দিয়েছে। তাই তো তার ভাই তার কাছ থেকে জবাবদিহিতা চাইছে। যদি ভাইয়া সত্যিটা জেনেই থাকে তাহলে সে যা কান্ড বাধিয়েছে এতক্ষণে প্রতিক্রিয়া স্বরূপ অন্তত তাকে একটা থাপ্পড়ও তো খেতে হত! অথচ ভাইয়ের সামনে আসতেই ভাই তাকে স্বাভাবিক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ” সাদিয়া ঘটনা কি খুলে বল তো! ”

সাদিয়া ভয়ে ঢেকুর তুলল। ভাইয়াকে কি সত্যিটা বলা উচিত? যদি মাকে বলে দেয়? ভয়কে যথা সম্ভব লুকানোর ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে জবাব দিল,
” কেন মা যে বলল শুনলে না? ”

” কি বলেছে মা? ”

সাদিয়া লুকোতে চাইলেও তার সে প্রচেষ্টা বেশিক্ষণ টিকে রইল না। ঠিক ধরা পড়ে গেছে সাদিবের চোখে। সাদিয়া নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটা মিথ্যেকে ডাকবার চেষ্টা করতে শতটা মিথ্যে বলার প্রয়োজন পড়ে। ঠিক সেরকম অবস্থা তার বেলায় হয়েছে। সেদিন নিজের প্রেমিককে এভাবে হেসে কথা বলতে দেখে মেজাজ তুঙ্গে চড়েছিল সাদিয়ার। একে তো হেসে কথা বলছে তাও তারই ভাইয়ের বউয়ের সাথে। তারওপর তার সাথে এতোদিনের সম্পর্ক অস্বীকার করতে নিচ্ছিল। রাগে সারা শরীর রি রি করছিল সাদিয়ার। রুনা ওর মাকে নিয়ে না আসলে ব্যাপারটা সেখানেই চাপা পড়ে যেতে পারতো। কিন্তু রুনার অনাকাঙ্ক্ষিত আগমনের জন্য ননদ ভাবীর সম্পর্কটা সেসময়ের পর থেকে পুরোপুরি বদলে গেছে।

সাদিয়াকে নির্বিকার দেখে সাদিব নিজেই বলল,
” কি হল কথা বলছিস না কেন? ”

যথেষ্ট স্বাভাবিক থাকার প্রচেষ্টা থেকে সাদিয়া জানাল,” বললাম তো মা যা বলেছে তাই তো। ”

সাদিব শান্ত গলায় বলল, ” তাহলে তুই ভয় পাচ্ছিস কেন? ”

সাদিবের এই একটি কথা মুহূর্তের ব্যবধানে সাদিয়ার কণ্ঠস্বর পরিবর্তন হয়ে গেল। কণ্ঠে এসে সংযত হল জড়তা। ” কই নাতো। ভয় কেন পাবো?”

” তার মানে তুই বলবি না তাই তো? ”

” কি তখন থেকে বলছিস বলতে? তোকে তো মা সব জানিয়েছে না? তাহলে এক কথা এতোবার শোনার কি আছে? ”

” দেখ সাদিয়া, মা মায়েরটা বলেছে। সব ঘটনার দু’টো দিক থাকে। ইন সাইড এবং আউট সাইড। বুঝিসই তো। নাকি তাও বুঝিস না! ”

সাদিয়া নির্বিকার থেকে মাথা দোলাল।
” উনি দেখেছেন বাহ্যিকটা। যেটা বেশিরভাগ দেখা যায় তাও আবার কিনা ভুল আকারে। উনি যা দেখেছেন তাই তো বলবেন! আসল ঘটনা তুই জানিস তাই তোর মুখ থেকে পুরোটা শুনতে চাচ্ছি। ”

সাদিয়া কয়েক মুহূর্ত ভাবল। ” ভাবী কিছু বলেছে তোকে? ”

” কে কি বলল তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। তুই তোরটা বল। অন্তত এটা বল তামান্না কি আসলেই তোকে নিয়ে গেছিল? ”

” না। আসলে ভাবির এখানে সত্যি কোনো দোষ নেই ভাইয়া। আমার কাকুতি মিনতি শুনে বেচারী বাধ্য হয়ে গেছিল। ” সাদিয়া শুরু থেকে সবটা খুলে বলল। সাথে এও বলল রাগ আর ভয়ের কারণে সে সত্যিটা অস্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে।

সাদিয়ার মুখে সবটা শুনে সাদিব কয়েক সেকেন্ড থমকে রইল। বোনের ভয়ার্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে তাকে কয়েকটা কথা শোনাতে গিয়েও শোনাল না। গম্ভীরমুখে প্রস্থান করতে চাইল।

” ভাইয়া প্লিজ মাকে কিছু জানাস না। আই প্রমিজ এরপর আর এমন হবে না! ”

” কি করতে হবে না হবে সেটা আমাকেই বুঝতে দে। এতোবড় দোষ করে এখনো কিভাবে এতো নিশ্চিন্তে থাকিস তুই? বেশি বড় হয়ে গেছিস? আমাদের কারোর দরকার নেই তোর? ”

সাদিবের ধমকে সাদিয়া কেঁপে উঠল। মাথা নত করে দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইল। ছোট থেকে যত আবদার তার এই ভাইয়ের কাছে। আজ তার ভুলের কারণে সেই ভাই-ই তার সাথে ধমকে কথা বলছে। অনুশোচনায় সাদিয়ার চোখের কোণা ভিজে উঠতে চাইল।
.

.
আজ পরীক্ষা থাকার দরুণ সকাল সকাল এই অসুস্থ শরীরেই বেরুনোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। দুইদিন ধরে টানা অসুস্থতার কারণে পড়াশোনা একদমই হয়নি বলা চলে। কাল যতটুকু পেরেছি কাভার দিয়েছি। প্রস্তুতি খুব একটা ভালো না। গত চার বছরে পড়ায় ফাঁকিবাজি করার ফল ভীষণ রকমে টের পাচ্ছি। আমার পেছনের সিট তন্ময়ের হওয়ায় বেশিরভাগ সময় ওরটা দেখেই খাতায় মেরে দিতাম। ভাবতাম একে এতো জ্বালাই তবুও সব কিভাবে যে সহ্য করে নেয়! আমি হলে কবেই পিঠে দুই ঘা লাগিয়ে দিতাম। সে যত ভালো বন্ধুই হোক না কেন! প্রতিবার ওর খাতা দেখে লিখতাম আর হল থেকে বেরিয়ে ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে দোয়া করতাম, ” তন্ময় আল্লাহ তায়ালা তোর ধৈর্য শক্তি বাড়িয়ে দিক। আমার তোকে এখনো অনেক জ্বালানো বাকি! ”
শুনে মৃদু হেসে জবাব দিত, ” কোথায় আর জ্বালাচ্ছিস! আমি তোর কাছে এর থেকেও বেশি ডিজার্ভ করি। ”

পরীক্ষায় হলে বাকি সবার জন্য তন্ময়ের একটা মজার ডায়লগ সব সময় তৈরি করা ছিল। একে তো সে ক্লাস টপার তারওপর কেউ তারটা দেখে ওপরে উঠে যাক এটা কেউই চাইবে না। তাই যখন দোলা বা বাকিরা দেখতে চাইতো সুন্দর একটা বাহানা দাঁড় করাত সে। বলা চলে কৌশলে এড়িয়ে যেত। বলত, ” দোস্ত দেখ এটা কত বড়। এতো বড় এটা লিখতে গেলে লিখতে তো পারবি না, তার চাইতে অনেক সময় নষ্ট হবে, বেল বেজে যাবে।আরেকটা লেখ কেমন? ” এই বলে নিজের খাতায় যে মনোযোগ দিত সেই মনোযোগ ফিরত একদম বেল বাজার পরে। সেদিক থেকে আমার সাথে খুব একটা সুবিধে করতে পারতো না। আমি ছিলাম নাছোড়বান্দা। একে তো ওর সামনে আমার সিট, তারওপর না দেখালে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল তো আছেই। সামনে থেকে শুধু ঠোঁট নাড়ালেই তন্ময় বুঝে ফেলতো আমি কি বলতে চাইছি। বলতে দেরি হতো তার হাজির করতে দেরি হতো না। সেটা যে জিনিসই হোক না কেন!আফসোস করছি এখন শেষ সময়ে এসে। কথায় আছে চোরের দশদিন গৃহস্থের একদিন। আমার অবস্থা হয়েছে অনেকটা সেরকম। সংকোচের কারণে এখন আমি চাইলেও তন্ময়কে বলতে পারবো না দেখানোর কথা। কে জানতো দুইজনের সম্পর্কটা গড়ে ওঠার আগেই সেটা এভাবে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে! পরিণত হবে দুঃস্বপ্নে!

মুখে হালকা কিছু তুলে বেরিয়ে পড়লাম হলের দিকে। আধঘন্টা আগে হলে পৌছুতে হবে। বাহিরের রোদের তাপের প্রখরতা এখনই ছড়াচ্ছে। পুরো দিন তো বাকি পড়ে আছে। দশটা থেকে পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা। আমাকে বেরুতে হয়েছে সাড়ে আটটার সময়। এখান থেকে যেতে লাগবে একঘন্টার মতো। শুধু বাজারের ঐদিকটায় জ্যাম না লাগলেই হল।

সাদিবের ওপর অভিমানটা এখনো জমা হয়ে আছে। তাই সাদিব নামিয়ে দিতে চাইলেও তার কথায় সায় জানাতে ইচ্ছে হল না। পেছন পেছন অনেকটা পথ হেঁটে এসেছিল। অটোরিক্সায় উঠার পর আয়নায় তাকিয়ে খেয়াল করেছি এদিকটা তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ। কি ভেবেছে সে যখন যা চাইবে তাই করবে নাকি! কখনো চাইল বিনা অপরাধে থাপ্পড় মারবে আবার যখন খুশি এসে স্যরি বললেই হলো? আমি কি এতো সস্তা নাকি!
.

.
পরীক্ষা শেষ করে হল থেকে বেরিয়েছি সবে। যতটা খারাপ ভেবেছি পরীক্ষা ততটা খারাপও হয়নি। বরং তুলনামূলক ভালো হয়েছে। আসলে আমার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ হয়ই এমন, যখন যেটা মন থেকে ভাবি সেটা সব সময় হয়না। যেমন- যেদিন ভাবি এই জিনিসটা খারাপ হবে কিংবা লেট করে বাসায় ফিরছি, মামনি নির্ঘাত আজকে মেরে বর্তা বানিয়ে ফেলবে। পরক্ষণে দেখি না, আসলে এমনটি খুব একটা হয় না। ভয়ে আল্লাহর নাম বেশি বেশি জপি বিধায় কিনা! আমার কাছে তো তাই মনে হয়।

আমি হল থেকে বের হতে তন্ময় পেছন থেকে ডাক দিল। ওকে ইদানীং অনেকটা স্বাভাবিক লাগছে। আগের মতো এখন আর আবেগি সুরে বলতে শুনি না, ” তামান্না তোকে না আজ ভীষণ সুন্দর লাগছে! ”

তন্ময়ের স্বাভাবিক থাকাটা আমার নিজের কাছে স্বস্তিদায়ক। শুরুর দিকে খুব গম্ভীর থাকত তন্ময়। কোথাও না কোথাও সেটা আমার মনে দারুণভাবে নাড়া দিত। আমার জন্য কেউ কষ্ট পাক এটা অন্তত আমি কখনোই চাইনি। তন্ময়ের ক্ষেত্রে তো মোটেই না। শত হলেও আমরা খুব ভালো বন্ধু। দু’জনের মাঝে কিছু না হোক বন্ধুত্বটা অন্তত বজায় থাকুক এটাই চাই।

আমার ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে মুহূর্তের ব্যবধানে তন্ময়ের চোখেমুখে আমার জন্য অস্থিরতার টের পেলাম। ” তোকে এমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে কেন? কি হয়েছে তোর? ”

ভেতরে ভেতরে নিজের ভুল ভাবনার জন্য মিইয়ে গেলাম। ভাবলাম যার অস্থির হওয়ার কথা তার খবর নেই অথচ আরেকজনের অস্থিরতা আমার সহ্য হচ্ছে না। তন্ময়কে বুঝতে না দিয়ে বললাম, ” কই না তো! আমি তো ঠিকই আছি। ”

” কোথায় ঠিক আছিস। তোর চোখগুলো কেমন ডেবে গেছে। আগেরদিনও ভালো ছিলি, দেখি গায়ে জ্বর টর হল কিনা! ” বলে আমার কপালে হাত ছোঁয়াতে আসলে আমি ছোঁ মেরে তন্ময়ের হাতটা সরিয়ে ফেললাম। হুট করে তন্ময়ের এভাবে কপালে হাত লাগানো ছিল আমার অপ্রত্যাশিত।

যতটা সম্ভব নিজেকে সামলে নিয়ে কিঞ্চিৎ রাগত স্বরে তাকে বললাম, ” সমস্যা কি! একবার বললাম না কিছু হয়নি তাও কেন গায়ে হাত দিচ্ছিস?”

তন্ময় বিস্মিত চাহনিতে চেয়ে আছে। আমার হঠাৎ আচরণের পরিবর্তন হয়তো সে আশা করেনি।
” গায়ে কোথায় হাত দিলাম। আমি তো শুধু জানতে চাইছিলাম তুই ঠিক আছিস কিনা! তাই বলে এভাবে রিয়েক্ট করবি? ”

চলেব…?

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (৩০)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
তন্ময়ের চাহনিতে বিস্ময় এসে ভর করল। আমার হঠাৎ আচরণের পরিবর্তন হয়তো সে আশা করেনি। ” গায়ে কোথায় হাত দিলাম! আমি তো শুধু জানতে চাইছিলাম তুই ঠিক আছিস কিনা! তাই বলে এভাবে রিয়েক্ট করবি? ”

” তো কি আশা করছিস তুই? ”

তন্ময় সেকেন্ড দুয়েক চুপ থেকে আহত স্বরে বলল, ” আচ্ছা আ’ম স্যরি! আমি বুঝতে পারিনি তুই এভাবে রিয়েক্ট করবি। ”

তন্ময়ের আহত কণ্ঠে তামান্না নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করল। ” ঠিক আছে বাদ দে! ”

” তো এক্সাম কেমন দিলি? ”

” মোটামুটি ভালোই। ” এভাবে টুকটাক কথা বলতে বলতে দু’জন যে যার মতো চলে আসলাম। দোলাকে আসার সময় আশেপাশে কোথাও দেখি নি। অবশ্য এটা আমার জন্য নতুন কিছু নয়। সাদিব আর আমার ব্যাপারে জানার পর থেকেই দোলা আমার থেকে নিজেকে যথেষ্ট আড়াল করে রাখে। তন্ময়কে কথার ফাঁকে দোলার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে সে জানাল, ” দোলা কি আর আগের মতো আছে রে? ”

তন্ময়ের বলার ধরণে খানিকটা অবাক হলাম। ” আগের মতো নেই মানে? ”

” বাসায় ওর বিয়ের ব্যাপারে কথা চলছে। ছেলে গর্ভমেন্ট জব হোল্ডার। বুঝিস না ভাবসাবই আলাদা। ”

” তাই বলে নিজের ফ্রেন্ডদের ভুলে যাবে? ”

” গত মাসে ওর এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। এক্সামটা শেষ হলে বিয়ের ডেট ফেলবে। আর তো মাত্র কয়েকটা দিন। তারপর সেও তোর মতো মিঙ্গেল হয়ে যাবে। ”

দোলার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তাও বিয়ের এতদূর এগিয়েছে অথচ মেয়েটা আমাকে একটু জানানোর প্রয়োজন বোধ করল না? শুনে কষ্ট লাগল। অবশ্য না বলাটাই স্বাভাবিক। আমি হলেও হয়তো বলতাম না। আমি তো তাদের থেকে সাদিব আর আমার ব্যাপারে লুকিয়েছি। যখন জানল তাও ভুলটা জানল। তারা আশা করেছিল আমার যেকোন খবরাখবর আমার থেকে সবার আগে শুনবে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে আমি তাদের এক প্রকার হতাশ করে দিয়েছিলাম। সাদিবের আর আমার সম্পর্কের ব্যাপারে জানার পর বন্ধুমহলের অনেকই আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। কেবলমাত্র তন্ময় ছাড়া। অথচ আমি উল্টো চাই ও-ই আমাকে সবার আগে এড়িয়ে চলুক।
.

.
কাল রাতে পড়ার চাপে ঘুমাতে পারি নি, যার জন্য এখন মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। একে তো রাতের ঘুম মারা তারওপর বাহিরে রোদের প্রখরতা। আমার এমনিতে রোদের তাপ খুব একটা সহ্য হয় না। সব মিলিয়ে মাথাটা ছিড়ে যাওয়ার উপক্রম। মাথা উপুড় করে শুয়ে আছি বিছানার এক কোণে। চেষ্টা একটু ঘুমানোর। ঘুমতে পারলে মাথা ব্যথাটা কমতো। চোখ লেগে আসতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়ে বালিশের পাশ থেকে মুঠোফোনখানি সশব্দে বেজে উঠল। বিরক্তির সাথে কণ্ঠ থেকে আপনাআপনি “ছ” শব্দটি বেরিয়ে আসল। মাথা ধরার মতো সব কারণ আজ যেন একসাথে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে।

বিরক্তি চেপে ফোন হাতে নিলে দেখতে পাই বাসা থেকে ফোন এসেছে। তাও আবার কিনা বাবার ফোন। অসময়ে বাবার ফোন পেয়ে অবাক লাগল। বাবা তো আমাকে কখনো ফোন করেন না! কথা হলে মামনি আর তনিমার সাথেই বেশি কথা হয়। বাবার খবর তাদের থেকেই পাই। তা সত্ত্বেও বাবার সাথে আমার খুব একটা কথা বলার প্রয়োজন পড়ে না। একদিকে বাবার সাথে ছোটবেলা থেকে আমার সখ্যতা কম। মামনি আর তনিমা আমার সবথেকে কাছের। আমার এমন কোনো গোপন কথা নেই যা তারা জানে না। বাবার গম্ভীর রূপটিি কেবল সারাজীবন আমার নজরে পড়েছে। কখন বাবার ভালোবাসাকে সেভাবে উপলব্ধি করা হয়নি। এমনটাও না যে বাবা তনিমা আর তকিকে আমার থেকে বেশি ভালোবাসে। বরং আমরা তিনজনই উনার নজরে সমান। তিন ভাইবোনের সাথেই তিনি গম্ভীর থেকেছেন৷

ফোন রিসিভ করে সালাম দিতে ওপাশ থেকে বাবার জবাব এলো, ” বাবা বলছিলাম। ”

” হ্যাঁ বাবা, বল কেমন আছ? ”

” ভালো আছি। তুমি কেমন আছ মা? তোমার শরীর ঠিক আছে? ”

” সব ঠিক আছে। ”

” ও বাড়িতে কি তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে? সবার সাথে এডজাস্ট করতে পেরেছ তো? ”

এডজাস্ট না করতে পারলেও করতে হবে বাবা। কারণ তোমাকে বললে তোমার উত্তর কি হবে তা আমার খুব ভালো করে জানা আছে। কথাগুলো আড়ালে লুকিয়ে রেখে বললাম, ” পারবো না কেন! সবাই তো আমার পূর্ব পরিচিত। আসার পরই এডজাস্ট করে নিয়েছি। কোনো সমস্যা হয়নি। ”

” তুমি কি কোনো কারণে আমার ওপর রেগে আছ মা? ”

” না বাবা। রাগ কেন করতে যাব? ”

” তাহলে তোমার কণ্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন? ”
বাবার এই একটা জিনিস আমাকে বাবার প্রতি কিছু না হোক অনেকখানি শ্রদ্ধা বাড়িয়ে দেয়। সেটা হচ্ছে বাবা সবসময় আমার কণ্ঠ শুনে ধরে ফেলতে পারেন যে আমার বোধহয় কিছু একটা হয়েছে। হয় রাগ অভিমান করে বসে আছি নয়তো অসুস্থ। যেটা অনেক ক্ষেত্রে মামনিও টের পায় না।

” ঐ একটু মাথা ব্যথা করছিল তাই। ”

” ঔষধ খেয়ে রেস্ট নিও ঠিক হয়ে যাবে। তোমাকে অনেকদিন হয়েছে বাবা দেখি না। তুমি কি একটু আসতে পারবে? ”

” বাবা আমার এক্সাম চলছে। শেষ হলে বাসায় বলে দেখব। ”

আমার জবাব শুনে ওপাশ থেকে বাবা কিছু সময় থম মেরে রইলেন। হয়তো পরিস্থিতি অনুধাবনের চেষ্টা করছেন৷ এমনিতে এ বাসায় আসার পর বাবার বাসায় সেভাবে যাওয়া হয়নি। সেই যে একবার গিয়ে দু’দিন ছিলাম তাতেই সীমাবদ্ধ। বাবা মাও যেতে বলেনি আমারও যাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি।

” ঠিক আছে মা। নিজের খেয়াল রেখ। ঠিকঠাক মতো পরীক্ষা দিও। রাখছি! ”
.

.
মাগরিবের আজান হয়েছে অনেকক্ষণ। নামাজ শেষ করে জায়নামাজ গুছিয়ে দাঁড়িয়েছি। খেয়াল করলাম দরজার সামনের পর্দার ফাঁক ঘেষে মেঝেতে কারোর প্রতিচ্ছবি ভেসে আসছে। বোঝা যাচ্ছে এটি কোনো মহিলারই। এমনকি মালকিনকে চিনতেও খুব একটা অসুবিধে হয়নি। নামাজ পড়ার সময় সাধারণত আমি কম আলোতে বেশি সাচ্ছন্দ্যবোধ করি। বাহিরের রুম থেকে যেটুকু আলো আসে তাতেই হয়ে যায়। তারওপর সন্ধ্যা নামলেও বাহিরে এখনো বেশ আলো আছে। জানালা খোলা থাকায় সেখান থেকে আলো ঠিকরে রুমের ভেতরে প্রবেশ করছে।

” ভাবী আসব? ”

সাদিয়ার কণ্ঠস্বর কর্ণকুহরে পৌছালেও আমাকে সেরকম কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে না দেখে সাদিয়া সেখানটায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। পরক্ষণে তার মা দেখলে কোন কেলেঙ্কারি ঘটে ভেবে সাদিয়ার দিকে এক নজর তাকালাম। সাদিয়া সম্মতি পেতে সরাসরি এসে সামনে দাঁড়াল।

তার সেই চিরচেনা প্রফুল্লতা ঝেড়ে অনুনয়ের সাথে বলল, ” ভাবী আ’ম স্যরি। আসলে তখন আমার মাথা ঠিক ছিল না। রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। ”

সাদিয়ার কথার ধরনে ভ্রু জোড়া কুঁচকে তার দিকে তাকালাম। শান্ত মেজাজে বললাম, ” স্যরি কেন? ”

আমার প্রশ্নে সাদিয়া বুঝেছে তার ব্যবহারের জন্য মন থেকে কতটা কষ্ট পেয়েছি। তাতে করে তার অনুশোচনা হওয়াটা দরকার আছে। ” আমি জানি আমার সেদিন এমনটি করা উচিত হয়নি। কি করব বল, একে তো মা সেখানে এসে পড়ে তারওপর সেও আমার সাথে এত বড় প্রতারণা করে। আমি বুঝতে পারিনি আমার কারণে তোমার সাথে এতোকিছু হয়ে যাবে। ভাইয়া মা এরা সবাই তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করবে! ”

” বাদ দেও। এসব পুরাতন কথা না তুললেই ভালো হয়। ”

” মা তোমাকে কেন জানি না অপছন্দ করে আর ভাইয়ার সাথে তোমার সম্পর্ক যতটুকু স্বাভাবিক হয়েছিল, আমার কারণে তোমাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হল। এটা দেখে আমি সহ্য করতে পারিনি। তাই তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে ছুটে এসেছি। ”

“ক্ষমা কেন চাইবে তুমি? তোমার মা ভাই আমার সাথে কি করল না করল তাতে কার কি আসে যায়। কি করব বল আমার সাথে বিয়েটা তোমার ভাইয়ের দুর্ভাগ্য ছিল তাই তোমাদের পরিবারে এসেছি। তোমার ভাইয়ের জীবনটা আমার জন্য শেষ হয়ে গেল। ”

” এভাবে কেন বলছ? আমি জানি আমি দোষ করেছি। কেউ দোষ করে ক্ষমা চাইলে তো তাকে ক্ষমা করে দিতে হয় তাই না বল? চল না আমরা আগের মতো হয়ে যাই! আমি ভাইয়াকে সব সত্যিটা খুলে বলেছি। দেখ এরপর থেকে তোমাদের মধ্যে আর এমনটি হবে না। ”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ” আমার তোমার প্রতি কোনো অভিযোগ নেই সাদিয়া। শুধু তোমার কাছে একটা বিনীত অনুরোধ থাকবে। রাখবে? ”

সাদিয়া আমতা আমতা করল, ” কি অনুরোধ বল না? ”

” এরপর থেকে যাই কর না কর, প্লিজ তনিমাকে এসবে জড়িও না। জানি ও তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড! তবুও আমি চাই না ও এসবের সাথে জড়িত থাকুক। ”

শুনে সাদিয়া নিশ্চুপ রইল। হয়তো ভাবছে এরপরের জবাব সে কি দেবে। কয়েক সেকেন্ড নির্বিকার থেকে বলল, ” তনিমার ব্যাপারে একটা সিক্রেট বলব? জানি আমার কথা তুমি বিশ্বাস করবে না তবুও বলাটা জরুরি! ”

” কি? ”

সাদিয়া তনিমার ব্যাপারে যা বলল তা শুনে কয়েক মুহূর্তের জন্য আমি স্তম্ভিত হলাম। পরক্ষণে মনে হল নিজে একবার বিষয়টা খতিয়ে দেখা উচিত। নিশ্চয়ই সাদিয়ার কোথাও ভুল হচ্ছে।

সাদিয়া কথার তোপে অনেক কথাই বলল। ধরণ শুনে বুঝলাম স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা থেকেই এতো কথা বলা। আমি চুপচাপ তার অনর্গল বলে যাওয়া কথাগুলো শুনে গেলাম। বলার মতো সেরকম কিছুই খুঁজে পেলাম না। হ্যাঁ, না-য়ের মাঝে যতটা সম্ভব সীমিত রয়েছি। মাথার মাঝে শুধু তনিমাকে নিয়ে বলা কথাটা ঘুরপাক খাচ্ছে। এদিকে সাদিয়াকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না। অন্যদিকে ঝেড়ে ফেলে দিতেও মন সায় দিচ্ছে না। কথা শেষ করে সাদিয়া চলে যাচ্ছিল। যাওয়ার সময় রুমের বাহিরে তার দেখা হয়ে গেল সাদিবের সাথে। অসময়ে বোনকে এদিকে দেখে সাদিব চমকাল। সে আশা করেনি সাদিয়ার সাথে যে তামান্নার পুনরায় ভাব জমতে পারে। কিছু বুঝতে না দিয়ে সাদিয়ার থেকে জানতে চাইল, ” কিরে অসময়ে তুই এখানে? ”

” একটু ভাবীর সাথে দরকার ছিল। তারজন্য এদিকটায় আসা। ”

” তা দরকার সেরেছে? কথা বলেছে ও তোর সাথে নাকি এখনো রাগ করে বসে আছে? ”

” ঠিক বুঝতে পারছি না। বলল তো রেগে নেই। ”

সাদিব যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। পরক্ষণে কন্ঠে কাঠিন্যতা প্রকাশ ফেলো। ” যাক! না রাগলেই ভালো। ঠিক আছে তুই এখন যা। আর এসব করার চিন্তা মাথায়ও আনবি না। এবারের জন্য তোকে ছেড়ে দিলেও পরেরবার কিন্তু পার পাবি না বলে দিলাম।”

চলবে…..

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]