তোমার নামে হৃদয় পর্ব-২৩+২৪+২৫+২৬

0
266

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (২৩)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
উপস্থিত সবার মাঝে সাদিয়াকে নিয়ে যেতে এক ভদ্র মহিলা হাসি মুখে সাদিয়াকে ডেকে নিজের পাশে বসালেন। বোঝাই যাচ্ছে উনি হয়ত পাত্রের মা। থুতনিতে হাত রেখে মন্তব্য করলেন, ” বাহ্ মেয়ে তো ভারী মিষ্টি দেখতে। বুঝতে হয় আমার ছেলের পছন্দ আছে। ” ভদ্র মহিলার কথা বলা শেষ হতে পাত্রের আসনে বসা লোকটা সাদিয়ার দিকে না তাকিয়ে আড়চোখে বরং আমার দিকে তাকিয়েছে। ততক্ষণে আমি মজলিস থেকে অনেকখানি দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়েছি। লোকটার মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছি।

ভরা মজলিসের মাঝে সাদিব উঠে এসে আমাকে ইশারায় ভেতরের দিকে যেতে বলে নিজেও সাথে চলল। আমি চলে আসার সময় পেছন থেকে শুনতে পেলাম লোকটা বাবাকে জিজ্ঞেস করল, ” উনি কে? ”
বাবা বললেন, ” আমার পুত্রবধূ বলতে পারেন আমার আরেকটি মেয়ে। ”
.

.
” তোমাকে ঐখানে কে যেতে বলেছে? ” সাদিব ঝাঁঝালো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল।

সাদিবের এহেন আচরণে আমার মাঝে বিস্ময় ভর না করে পারল না। ” মানে? ”

” এতো মানে পানে জানি না। ওরা যতক্ষণ আছে ততক্ষণ তুমি বাহিরে যাবে না, এখানে চুপচাপ বসে থাকবে। প্রয়োজনে বসে বসে মোবাইল গুতাও তাও যাবে না। ”

” কি আশ্চর্য! কেন সেটা তো বলবে? আমি যাওয়ায় সেখানে এতো কি প্রবলেম ক্রিয়েট হলো শুনি? ”

” এতো আশ্চর্য হওয়ার তো কিছু নেই তামান্না। আমি তোমার হাসবেন্ড, তোমার হাসবেন্ড বলেছে বিধায় তুমি যাবে না। ”

সাদিবের চোখে মুখে জেলাসি ভাব যেন আচমকা আমার হৃদয়ে ছুঁয়ে গেল। মনে মনে ভাবলাম ‘ডাক্তার সাহেব তোমার চোখে তো এতোদিন এটাই দেখতে চেয়েছিলাম! তবে তুমি যাই বল না কেন বাহিরে না গিয়ে থাকলেও এখানে একা বসে থেকে বোরিং আমি হচ্ছি না! তাছাড়া তোমাকে তো একটু বাজিয়ে দেখারও দরকার আছে কি বল! ‘ চোখে মুখের ভাব এমন বজায় রাখার চেষ্টা করলাম, যেন সাদিব বুঝতে না পারে আমি যে তাকে বাজিয়ে দেখছি।

” তুমি এমন ভাব করছো যেন আমি বাহিরে গেলে লোকটা আমাকে তার সাথে করে নিয়ে চলে যাবে? ”
সাদিবকে আওড়াতে শোনা গেল, ” নেবেই তো! ”

” কেন নেবে? একটা বিবাহিত মেয়েকে তাদের নিতে দায় পড়েছে? ”

” না পড়ুক। লোকটা ইরিনার বিয়ের পর থেকে তোমার পেছনে লাগতে লাগতে যে এতো দূরে চলে আসবে কে জানত? ”

” আরে তুমি এত হাইপার হচ্ছ কেন? ওরা তো সাদিয়াকে দেখতে এসেছে। এখন নিশ্চয়ই আর ভুল মেয়েকে দেখতে আসেনি। ”

” লোকটা ফ্যাল ফ্যাল করে সেই তোমাকেই দেখছিল। আমি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি। ”

সাদিবের দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছি। ” তাহলে আমি বলি কি এ বিয়েতে না করে দিলেই পারো! ”

সাদিব অস্থির হয়ে উসখুস করতে করতে বলল,” এ মুহুর্তে সেটা বলতে পারছি না বলেই তো তোমায় নিয়ে ভেতরে চলে এসেছি। উফফ্ অসহ্য লাগতেছে! ”

” কারে অসহ্য লাগতেছে? ”

সাদিব এতোক্ষণ কথা বলার সময় মেঝেতে দৃষ্টি নামিয়ে কথা বলছিল। আমার প্রশ্নে সে চোখ তুলে তাকাল। এক পলক তাকিয়ে থেকে বিরক্তি চেপে বলল, ” তোমাকে। ”

” তাহলে আমি চলেই যাই। এতো যখন তোমার আমাকে অসহ্য লাগছে! ” বলে তার পাশ থেকে উঠতে যাব, ওমনি আমার হাত ধরে টেনে আবার তার পাশে নিয়ে দাঁড় করাল। দৃষ্টিতে যথেষ্ট কড়াভাব সংযুক্ত রয়েছে।

” কি হয়েছে? ”

“কোথাও যাবে না তুমি! গেলে ওখানে অনেক কথাই উঠতে পারে। হতে পারে মা তোমাকে কথা শোনাবে, তাই তোমার এ মুহুর্তে আমার পাশে বসে থাকাই শ্রেয়! আমিও বাহিরে যাচ্ছি না। চুপচাপ বসে থাক। ”

সাদিবের কথার যুক্তি বুঝতে পেরে আমিও আর লাগিনি। তার বলা অনুযায়ী যথেষ্ঠ চুপচাপ পাশে বসে থাকার চেষ্টা করছি। কিন্তু আমি তো আমিই। চুপচাপ থাকাটাই যেখানে দুস্কর সেখানে বসে থাকা তো বহু দূরের ব্যাপার। সাদিব খাটে আধশোয়া হয়ে ফোন ঘাটাঘাটিতে ব্যস্ত। এদিকে আমি তার পাশে বসে আনমনে পা দুলিয়ে চলছি। কিয়ৎক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর মায়ের ডাক এলো। ” বাবা কই তুই? এখানে কি করছিস?”

সাদিব ফোন রেখে উঠে বসল। ” কেন মা কি হয়েছে? ”

” কি হয়েছে মানে? ঐখানে বিয়ের কথাবার্তা চলছে তুই ভাই হয়ে রুমের মধ্যে বউ নিয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছিস। এতো অধঃপতন কবে হয়েছে তোর? ” মা যে সাদিবের পাশে আমাকে বসে থাকতে দেখতে পেয়ে খুশি হননি তা উনার চোখেমুখের অবস্থাই স্পষ্ট জানান দিচ্ছে। আমাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, ” তোমাকেও বলি, একেবারে ঘরের ভেতরে এসে খুঁটি গেড়ে বসে আছ। অসময়ে বসে থাকার মানে কি? এলে তো এলে আমার ছেলেটাকেও সাথে করে নিয়ে এলে? এমন তো না যে তোমাকে আমি শুধু খাটাই। আজকের দিনেই তো অন্তত একটু সাহায্য করতে পার আমাকে। ”

” মা তুমি ভুল বুঝছো। আমারই ঐখানে ভালো লাগেনি। শরীরটা ভালো লাগছিল না দেখে চলে এসেছি। ”

” সেকি কি হয়েছে তোর। ” মা ব্যস্ত হয়ে সাদিবের মাথায় হাত বোলালেন।

” এতো ব্যস্ত হয়ো না। শুধু মাথাটা একটু ধরেছে এই যা! ”

শুনে মা আমাকে আদেশের স্বরে বলল, ” তুমি দাঁড়িয়ে কি দেখছ? যাও ছেলেটার জন্য এক কাপ গ্রীণ টি করে আন। বলল না ওর মাথা ধরেছে? সারাটা দিন বাহিরে বাহিরে খেঁটে বেড়ায় ছেলেটা। অথচ ঘরে এসেও একটু শান্তি জুটে না। ” শেষের কথাটা বিড়বিড় করে বললেন।

সাদিবের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। বাহিরে কি সত্যি যাব কি যাব না, সেই ভাবনা মন জুড়ে বিচরণ করছে। মায়ের সামনে সাদিবও সেভাবে কিছু বলতে পারল না। শুধু নিষেধ করেছিল এ সময়ে তার গ্রীণ টি চাই না। কিন্তু মা তো নাছোড়বান্দা তিনি ঠিক পাঠিয়ে দিলেন।
আসার সময় তাই যথেষ্ট চেষ্টা করলাম নিজেকে আড়াল করার। মা’র পরপর সাদিবও রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসতে নিচ্ছিল। পরক্ষণে আমাকে ওড়না প্যাঁচিয়ে ঘোমটার আড়ালে দেখতে পেয়ে পুনরায় ফিরে গেছে। হয়তো বুঝেছে কোন ব্যাপার না। তাদের চক্ষু আড়ালে থাকতে সক্ষম তো হয়েছি। কিন্তু ঘটনা ততক্ষণে যা ঘটার ঘটে গেছে। সবটা মায়ের অন্তরালেও রইল না। তারা চলে যাওয়ার পরপরই বোমাটা ফাটল।
.

.
ড্রয়িং রুমে মা মুখ বেজার করে বসে আছেন, সাদিয়ার মুখে আত্মতৃপ্তির হাসি, বাবা হতভম্ব! সাদিব আমাকে নিয়ে চলে আসার পরমুহূর্তে পাত্র তার মায়ের কানে কানে নাকি বলেছে, পাত্রী হিসেবে সে আমাকে ভেবেছিল। অন্যথায় সাদিয়াকে তার পছন্দ হয়নি। বিয়ে করলে অন্য কাউকে করবে তবুও সাদিয়াকে নয়! শুনে ভদ্রমহিলা ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও খুব একটা সুবিধে করতে পারেনি। মেয়ের ভালো পরিবার, ভালো বংশ মর্যাদা দেখে তিনি সাদিয়ার জন্যে রাজি হলেও পাত্র সাদিয়াকে সরাসরি নাকচ করে সবার সামনে দিয়ে হিড়হিড় করে চলে গেছে।

সাদিবের ফুপু মা এবং বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ” শেষে কিনা এই দিনও দেখার বাকি ছিল। কোনো বাড়িতে আমি আজ অব্ধি শুনি নি যেখানে বাড়ির অবিবাহিত মেয়ে রেখে লোকে কিনা ছেলের বউকে পছন্দ করে? ”

ফুপু শ্বাশুড়ির কথার পিঠে বাবা বললেন, ” এটা মাত্র একটা ভুল বোঝাবুঝি ছিল। সেটার মিটমাট হয়েছে ভালোই হয়েছে। ”

মা তেতে উঠলেন, ” কোথায় ভালো হয়েছে শুনি? তারা যে মুখের উপর অপমান করে গেছে তার বেলায়? ”

” আহ্ সামিরা, দুনিয়ায় কি ছেলের কমতি পড়েছে নাকি? আমার মেয়ের জন্য আমি এর থেকেও হাজার গুণে ভালো পাত্র খুঁজে বের করব। ”

ড্রয়িং রুমে কথার করাঘাত সাদিবের কানে যেতেও সক্ষম হয়েছে। সাদিবের তখনকার আন্দাজই ঠিক ছিল। পাত্র পক্ষ বাসায় থেকে গেলে নির্ঘাত একটা কান্ড কীর্তি ঘটবে! তবে বাবার উপস্থিতির জন্য মা সেদিন বেশি কিছু বলতে পারেননি। শুধু রাগে গজগজ করে গেছেন। সবটা বুঝতে পেরে সাদিব আমাকে বলে, ” দেখেছ, কেন তখন সেদিকে মুখো হতে দেইনি? ” হাত থেকে ধোঁয়া উঠা গ্রীণ টির গরম কাপটা টেনে নিয়ে বলে, ” এই জন্যই শরিয়ত মোতাবেক হাসবেন্ডের কথা সব সময় শুনতে হয়। আশা করি পরের বার তোমাকে এটা মনে করিয়ে দিতে হবে না। ”

চলবে……

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (২৪)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
সাদিয়া অন্যদিনের তুলনায় আজ ভীষণ প্রফুল্ল। গুণগুণ করে কখনো গান গাইছে তো কখনো ওড়না উড়িয়ে নেচে চলেছে। সারাদিন সে ঘরেই ছিল। বাহিরে বেরুনোর বিশেষ কোনো প্রয়োজন পড়েনি। এভাবে নেচে গেয়ে কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পরে ব্যক্তিগত ব্যবহার্য ফোনটি হাতে তুলে আনমনে ফোনের স্ক্রিনে টাইপ করা শুরু করে দেয়। অতঃপর টাইপ শেষে স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে ফোন হাতে রুম ছেড়ে বেরোয়।

ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। দু’দন্ড দম ফেলবার সময়টুকুও পাচ্ছি না। সারাবছর যত ফাঁকি ঝুঁকি মেরেছি তার কড়ায় গন্ডায় হিসেব চুকচ্ছি। বাহিরে আবহাওয়ায় গরমের প্রকোপ ভালো মতোই ছড়াচ্ছে। রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে নেমে ঘেমে একাকার অবস্থা। তার ওপর ধূলোবালিতে আমার এলার্জির সমস্যা রয়েছে। প্রতিদিনের এরূপ অবস্থায় বাসায় ফিরে সাওয়ার না নিয়ে থাকা দুষ্কর। পরীক্ষা শেষ করে বাসায় ফিরে আসতে দেখা হয়ে যায় ননদীনির সাথে। ননদিনীকে দেখে বুঝলাম তিনি বেজায় খুশি। এতো খুশির কারণ ঠিক কি হতে পারে এ মুহুর্তে জিজ্ঞেস না করে আন্দাজ করাটাও মুশকিল। পরশু পাত্রপক্ষের থেকে নেতিবাচক জবাব শুনেও তাকে এতোটা খুশি হতে দেখিনি।

” কি ব্যাপার হুম? ননদিনীকে আজ একটু খুশি খুশি দেখাচ্ছে? ”

সাদিয়া প্রফুল্লতার সাথে বলল, ” একটু না বল অনেক। ”

” তাই নাকি! তা শুনি এতো খুশির কারণটা কি? ”

সাদিয়া খানিকটা আমতা আমতা করতে লাগল। হয়তো ভাবছে আমাকে বলাটা আদৌও কতটা যৌক্তিক হবে। তার হাবভাবে আমিও সেভাবে আমলে নেই নি। একে তো গরমে জুবুথুবু অবস্থা তার ওপর ক্লান্ত শরীর! একটু জিরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে তাই তাকে বললাম, ” আচ্ছা তুমি বরং বস, আমি ফ্রেশ হয়ে আসি কেমন? ”

সে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালে আমি আমার মতো করে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। আধঘন্টা বাদে ফিরে এসে রুমের কোথাও দেখতে না পেয়ে ভাবলাম হয়তো নিজের রুমে চলে গেছে। কতক্ষণই বা অযথা বসে থেকে অপেক্ষা করবে! পরক্ষণে তাকে বেলকনি থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। এবার তার চেহারা আগেকার তুলনায় খানিকটা মিইয়ে যাওয়া লাগল। আমাকে দেখে হতাশার সুর টেনে বলল, ” ভাবী তোমাকে না আমার একটা সাহায্য করতে হবে। ”

” কি সাহায্য? ”

” তোমাকে আমার হয়ে একজনের সাথে দেখা করতে হবে। ”

” মানে? ”

সাদিয়া তখনকার প্রফুল্লতার কারণ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত সবটা খুলে বলল। সাদিয়ার কথায় বিস্ময়ে আমি হতভম্ব না হয়ে পারলাম না। মেয়েটা এতোদিন ধরে আড়ালে আবডালে থেকে এতোকিছু করে বেড়িয়েছে অথচ কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পেল না!
.

.
সমবয়সী এক ছেলের সাথে সাদিয়ার রিলেশনে জড়িয়েছে। সম্পর্কের সময় সীমা প্রায় বছর তিনেক। ছেলেটার সাথে প্রায় সময় এদিক সেদিক ঘুরতে যাওয়া পড়ে। সব থেকে আজব লেগেছে এ বিষয়টায় যে ছেলেটার সাথে সাদিয়ার সম্পর্কের ব্যাপারে তনিমাও জানতে পারেনি৷ বলা যায় ছেলেটিই কাউকে বলতে নিষেধ করেছে। শেষবার সাদিয়া যখন ছেলেটির সাথে ঘুরতে বেরিয়েছিল তখন বাসায় জানতো সাদিয়া ক্লাস করতে গেছে৷ দু’জন দুই জায়গায় পড়ার কারণে তাদের দেখা সাক্ষাৎ সব সময় বাহিরে করা লাগতো। সেদিন দেখা করতে গিয়ে সাদিবের বাবার দোকানের এক কর্মচারী দেখে সাদিয়াকে চিনতে পারে৷ ছেলেটার ব্যাপারে বাবাকে বলা হলে তিনি সরাসরি মেয়েকে না জানিয়ে মায়ের মাধ্যমে সাদিয়ার থেকে জানতে চান। সাদিয়া তখন বেঁকে বসেছিল এবং সেখানেই তার মায়ের সন্দেহ প্রগাঢ় হয়। এ নিয়ে মা মেয়ের মধ্যে গোপনে যুদ্ধ বিগ্রহ চলতে থাকে। তারই মাঝে বাবার কাছে সাদিয়ার বিয়ের প্রস্তাব আসে। এমতাবস্থায় সাদিয়ার মুখ থেকে কথা বের করার জন্য এর থেকে ভালো উপায় আর দু’টো ভেবে পাননি তারা। সাদিয়ার কাছে সব শুনে বিস্মিত হলাম। একই ছাঁদের তলায় থাকি অথচ কিছুই জানতে পারলাম না!

সাদিয়া সবটা বলে স্থির হয়ে বসে রইল। সাদিয়াকে সোজাসাপটা বললাম, ” ছেলেটা কি সব জানে? ”

সাদিয়া ইতিবাচক জবাবে মাথা নাড়াল। ” সব শুনে কি বলে?”

” ও বলেছে ওর কথা যেন কোনোভাবে বাসায় না বলি। ”

” এ মা! সেকি, কেন?”

” ওর তো এখন স্ট্যাডি কমপ্লিট হয়নি না? জানালে বাসাতেও তো মেনে নেবে না। ”

” তাহলে সেদিন যে পালানোর কথা বলেছিলে? ”

” ও বলেছে বেশি জোর করা হলে যেন তার কাছে চলে যাই। ”

” সে বলল আর তুমি রাজি হয়ে গেলে? ”

সাদিয়া মাথা নাড়াল। বলল, ” কি করব? ভালোবাসি যে! ”

সাদিয়ার কথায় এ মুহুর্তে কেন জানি না তাচ্ছিল্যের সাথে হাসি পেল৷ পরক্ষণে মনে হলে আবেগের বয়স কোনটা ভালোবাসা কোনটা আবেগ কিছুই বোঝার মতো বোধ এখন হয়নি ওর। মেয়েটাকে শান্তনা দিতে বললাম,” ভালোবাসলে পালাতে হবে? ”

” এছাড়া উপায় নেই তো! ”

” আচ্ছা আমি তোমার ভাইয়ার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলব। ” কথাটা শুনতে পেয়ে সাদিয়া অনেকটা আঁতকে উঠল যেন! বসা থেকে সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ” না ভুলেও না। ভাইয়াকে বলা মানে মাকে বলা সমান। তুমি চেনো না মা জানতে পারলে আমাকে একদম পুঁতে ফেলবে। ”

সাদিয়ার কথায় এবার বিরক্ত লাগছে। ‘ প্রেম করার আগে মনে ছিল না এখন পুঁতে যাওয়ার ভয় পাচ্ছিস! ‘ কথাটা বলতে চাইলেও উপর থেকে বিরক্তি প্রকাশ করলাম না। বয়সই বা তার কতদূর! এ বয়সে এমন আবেগ থাকবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে আবেগের বশে বাবা মায়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে পালিয়ে বিয়ে করাটা একদমই বেমানান। প্রয়োজনে বাবা মায়ের হাতে পায়ে ধর। ছেলে এবং ছেলের পরিবার ঠিকঠাক মতো হলে কয়েকদিন পর ঠিক মেনে নেবে৷ আমাকে নির্বাক থাকতে দেখে সাদিয়া নিজে থেকে বলল, ” আমি তোমার কথা ওকে বলেছি। তুমি কি একবার ওর সাথে কথা বলবে প্লিজ? ”

” আমার কথা কি বলেছ? তুমি কি পাগল টাগল হলে নাকি সাদিয়া? তোমার মা যদি একবার শোনেন এ কথা তাহলে বুঝতে পারছ কি হতে পারে? ”

” আমি জানি মা তোমাকে অপছন্দ করে। কিন্তু এ কথাটা আমি শেয়ার করার মতো তুমি ছাড়া আর কাউকে ভরসা করতে পারছিলাম না। প্লিজ তুমি শুধু একটিবার কথা বল, শুধু একটিবার। এ কথাটা এমনিতেও তুমি ছাড়া কেউ জানতে পারবে না। ” সাদিয়ার অনুনয়-বিনয়ের কাছে আমাকে এ প্রকার বাধ্য হয়ে রাজি হতে হল। তবে আমিও ওকে একখানি কঠিন শর্ত জুড়ে দিলাম।
” তার আগে তোমাকে আমার একটা শর্তে রাজি হতে হবে। ”

” কি শর্ত! তুমি শুধু বল, ওকে পাওয়ার জন্য আমি যেকোনো শর্তে রাজি আছি। ”

” প্রথমত ওর সাথে আমি ছদ্মবেশে কথা বলব। যতক্ষণ কথা বলব ততক্ষণ তুমি আড়ালে থেকে ধৈর্য ধরে সবটা দেখবে। আশাকরি এটা কেন বলেছি তোমার কাছে তখনি ক্লিয়ার হয়ে যাবে। বাকিটা নাহয় পরে বলি? ”
.

.
বিকেলের দিকে সাদিয়ার সাথে তার বলা গন্তব্যে পৌছুলাম। জানি না মেয়েটার তকদিরে কি আছে! তবে তার মুখ থেকে যতটা শুনলাম তাতে স্পষ্টত ছেলেটার মধ্যে কোনো গন্ডগোল নিশ্চয়ই আছে। পরিবারকে জানানোর কথা বাদ দিলাম, নাহয় বেকার হওয়ায় পরিবারকে বলতে পারবে না। তাই বলে বেস্ট ফ্রেন্ডের থেকে লুকিয়ে এতোকিছু কিভাবে সম্ভব? তারওপর বিয়ের জন্য অপেক্ষা করতে না বলে সরাসরি পালিয়ে যেতে উস্কানি কেন দেবে? ছেলেটার ওপর সন্দেহ করার মতো এমন অনেকগুলো কারণ দেখেছি। আমি যা ভাবছি ভালোয় ভালোয় যদি সেরকমটি হয় তাহলে সেটা সাদিয়ার জন্য ভালো। অন্যথায় বাসায় গিয়ে আজকের মধ্যে সাদিবকে সবটা জানানোর সিন্ধান্ত নিয়েছি। যা হওয়ার সেটা পরে দেখা যাবে।

সামনে অনেকক্ষণ যাবত একটা ছেলেকে ঘুরঘুর করতে দেখছি। আড়ালে দাঁড়িয়ে সাদিয়া এদিকে লক্ষ্য রাখছিল। ছেলেটাকে এভাবে ঘুরতে দেখে সাদিয়ার দিকে তাকাতে সাদিয়া চোখের ইশারা করতে বুঝলাম এটাই সেই ছেলে৷ বুঝতে পেরেও সেভাবে নির্বাক হয়ে বসে রইলাম। অপেক্ষা করতে থাকলাম মোক্ষম সুযোগের। অবশেষে সেই সুযোগটা বোধহয় আমার হাতে ধরা দিতে বাধ্য হল।

” এক্সিকিউটিভ মি! আমি কি আপনার এখানে একটু বসতে পারি? ” ছেলেটি হাসি মুখে এগিয়ে এলো।

আমিও হেসে জবাব দিলাম। ” জ্বি অবশ্যই! ” আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা সাদিয়ার প্রতিক্রিয়া দেখতে পেছনের তাকালাম। মেয়েটার মুখটা স্বাভাবিকভাবেই অতক্ষণে ফ্যাকাশে হতে শুরু করেছে। ছেলেটা যাতে আমাদের পরিকল্পনা বুঝতে না পারে তাই আমি নিজের মতো করে ফোন ঘাটাঘাটি করে ব্যস্ততা দেখাচ্ছি। ছেলেটা যে কারোর জন্য অপেক্ষা করছে বোঝাই যাচ্ছে। কেউ একজনকে ফোন দিয়ে কথা বলার সময় খেয়াল করলাম ছেলেটার চেহারার রঙ পরিবর্তন হয়ে গেছে। এক হাত দূরে বসে ছেলেটার কথোপকথন শুনে বুঝেছি সে তার গার্লফ্রেন্ড মানে সাদিয়ার সাথে কথা বলছিল। সাদিয়া হয়তো জানিয়েছে সে আসতে পারবে না। বাসা থেকে তাকে বেরুবার অনুমতি দেয়নি। আসার সময় এমনটাই তার সাথে আমার কথা হয়েছিল। ছেলেটা ফোন রেখে রাগে চটপট করতে থাকে। আমার দিকে আড়চোখে দু-একবার তাকাতে লক্ষ্য করেছি। চেহারা আর গায়ের গড়নের ফলে অনেকে আমার বয়স নিয়ে প্রায় সময় বিপাকে পড়ে যায়। কেউ কেউ তো আবার প্রথম দেখায় তনিমা আর আমার মধ্যে তনিমাকে বড় ভেবে বসত। সেদিক থেকে অন্য সবার মতো ছেলেটা এখনো বুঝতে পারেনি আমি যে তার থেকে কয়েক বছরের সিনিয়র। শেষবার তাকাতে আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম, ” কোনো সমস্যা? ”

ছেলেটা পূর্বের ন্যায় রাগ চেপে হাসি ফুটিয়ে বলল, ” না! আপনাকে অনেকক্ষণ ধরে এখানে একা একা দেখছি কারোর জন্য অপেক্ষা করছেন বুঝি? ”
” না, একাই এসেছি। আমার বাসা কাছে তো তাই প্রায় সময় বিকেলের দিকে এদিকে হাঁটতে আসি। আপনি বোধহয় কারোর জন্য অপেক্ষা করছেন তাই না? নিশ্চয়ই আপনার গার্লফ্রেন্ডের জন্য? ”

” আরে না না, কি যে বলেন না আপনি। আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই। ”

ততক্ষণ অব্ধি সব ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু ছেলেটার সাথে দেখা করতে আসাটা যে আমার জন্য সামনে বড়সড় একটা বিপদ বয়ে আনবে তখনো বুঝতে পারি নি। অনেকটা নিজের অজান্তেই গিয়ে কুয়োতে ঝাপ দিয়েছি…..

চলবে…..

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (২৫)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
” আরে না না, কি যে বলেন না আপনি। আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই। ”

ছেলেটার সাথে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে সাদিয়াকে লক্ষ্য করছি। কোনো মেয়েই তার প্রেমিককে অন্য মেয়ের সাথে হেসে কথা বলতে দেখলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে না। সাদিয়ার বেলায়ও ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি। সাদিয়ার চেহারার অবস্থা দেখে নিজেকে স্বার্থক মনে হচ্ছে। সে আবেগের বশে যেকোনো পদক্ষেপ নিতেই পারে। তাই বলে আমি সবটা জেনে বুঝে তাকে অপাত্রে ভালোবাসা দান করতে দিতে পারি না। কথার সাথে তাল মিলিয়ে আমি ছেলেটিকে বললাম, ” আপনি দেখতে এতো হ্যান্ডসাম অথচ গার্লফ্রেন্ড নেই। কথাটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য না। ”

ছেলেদের সাথে সবথেকে বড় প্ল্যাটিং এর থেকে ভালো কিছু আছে বলে মনে পড়ছে না। ভদ্রলোক হলে অবশ্যই এতোক্ষণ অপরিচিত একটা মেয়ের সাথে সেধে সেধে কথা বলতে আসতো না। আমার কাছে প্রসংশা শুনে ছেলেটা যে ভেতরে ভেতরে টসকাচ্ছে তা তার চেহারার হাবভাবে দারুণভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। আশা করি জায়গা মতো টোপ ফেলতে সক্ষম হয়েছি। এখন শুধু এখান থেকে ফেরার পালা। ছেলেটি এভাবে অনেক কথাই বলল, যার মধ্যে বেশিরভাগ ছিল নিজের সাফাই গাওয়া। এসব দেখে হঠাৎ এক কান্ড ঘটিয়ে বসল সাদিয়া। আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে ছেলেটির সামনে এসে দাঁড়াল। সাদিয়ার হঠাৎ উপস্থিতিতে ঘাবড়ে গিয়ে ছেলেটি একবার আমার দিকে তো একবার সাদিয়ার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। জড়তা নিয়ে আমতা আমতা করে বলল, ” তুমি? কখন এলে? ”

এতোক্ষণে সাদিয়াও ছেলেটার ওপর ভীষণভাবে ক্ষেপে গেছে। রেগে ছেলেটাকে কিছু বলতে যাবে তার আগে সাদিবের ফুপাতো বোন রুনা এবং মাকে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। এদিকে মাকে আসতে দেখে সাদিয়াকে এবার রাগের পরিবর্তে ভয় ঘিরে ধরেছে। শুধু সাদিয়া বললে ভুল হবে মায়ের সামনে পড়া মানে যে শুধু সাদিয়ার জন্য বিপদজনক তা কিন্তু নয়! বরং তার থেকেও বেশি বিপদের আভাসটা আমি নিজের জন্যই পাচ্ছি।

আমার সামনে দাঁড়িয়ে রুনা মাকে উদ্দেশ্য করে বলা শুরু করল,” দেখেছেন মামি আমি বলেছিলাম না আপনাকে? তখন তো বিশ্বাস করলেন না। এবার নিজ চোখেই দেখুন। জানাশোনা নেই কোথাকার কোন ছেলের গলায় আপনার মেয়েকে ঝুলিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছে আপনার বউমা। ”

রুনার কথায় মা ভীষণ ক্ষেপে গেছেন। তেতে উঠে বললেন, ” এই মেয়ে তুমি কোন সাহসে আমার মেয়েকে এখানে নিয়ে এলে? আমার ছেলের জীবন তো নষ্ট করলে এখন আমার মেয়ের পেছনেও উঠে পড়ে লেগেছ? ”

” আমার তখনই সন্দেহ হয়েছিল। আপনার মেয়েকে ছেলে ধরাতে এখানে নিয়ে আসছে। ” তারপর সাদিয়াকে উদ্দেশ্য করে রুনা বলল,” আর তোকেও বলি, ও বলল আর তুইও ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে চলে এলি? কেন রে তোর বাবা মা কি মরে গেছে?”

মা রাগে কটমট করতে করতে সাদিয়ার গালে চড় বসিয়ে দিলেন। আমার জানামতে মা সত্যিটা কিছুটা হলেও আন্দাজ করেছেন তা সত্ত্বেও তিনি রুনাকে বুঝতে দিতে চাইলেন না। বরং বললেন, ” কার অনুমতিতে তুই ঘরের বাইরে পা রাখলি? মায়ের থেকে এই মেয়েটা বেশি আপন হয়ে গেছে হ্যাঁ?”

সাদিয়া গালে হাত দিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। মা তাকে ঝাঁকিয়ে পুনরায় বললেন, ” কি হলো জবাব দে? এতো সাহস তুই কই থেকে পাইছিস? ”

রুনার বা মায়ের কারোর কথা তখনো সেভাবে আমলে নিলাম না। ভেবেছি ধরা পড়ায় এবার বুঝি সাদিয়া সবটা স্বীকার করবে! অথচ আমাকে অবাক করে দিয়ে সাদিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল, ” আমি আসতে চাইনি ভাবীই তো জোর করল। ”

মা আগের তুলনায় বেশি তেতে উঠলেন। বাজখাঁই কণ্ঠে আমাকে বললেন, ” ও তাহলে এই ব্যাপার? বাপের সাথে সাথে আমার মেয়ের মাথাটাও তাহলে আগে থেকে চিবিয়ে খেয়ে নিয়েছ? ”

আশেপাশের লোকজনের দৃষ্টি আমাদের দিকে। এতো মানুষের সামনে মা এভাবে বলায় ভীষণ অপমানিত বোধ করছি। এতোক্ষণ সাদিয়ার সত্যি বলার আশায় চুপ করে থাকলেও এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। সাদিয়াকে বললাম, ” সাদিয়া তুমি মিথ্যে কেন বলছ? আমি কখন তোমাকে বলেছি তুমিই তো…

সাদিয়া ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে গেছে যা তার স্বীকারোক্তিতে প্রকাশ পাচ্ছে। আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে নিজেই বলে উঠল, ” ভাবী আমি মিথ্যে কেন বলব? তুমি না বললে কি আমি এখানে আসতাম নাকি? ”

” এতো বড় সাহস তোমার? আমার খাচ্ছো আমার বাসায় থাকছো আর পেছন থেকে আমাকেই চুরি মারার চেষ্টা করছো? এতোদিন তোমাকে তোমার মতো ছেড়ে দিয়েছি তারমানে কি তুমি যা ইচ্ছে তাই করবে? ”

” মা আমার কথাটা একবার শুনুন! ”

” কি কথা শুনবো তোমার? চোখের দেখার চাইতে বড় কোনো প্রমাণ আছে কি! আজ শুধু সাদিব আর ওর বাবা একবার বাসায় আসুক। এর একটা হেস্তনেস্ত না করে আমি ছাড়ছি না। তোমাকে সহ্য করছি মানে এই না তুমি আমার পরিবারের সাথে যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াবে! ” বলে মা সাদিয়ার হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে বাসায় দিকে চলে গেলেন।

সাদিয়ার আচরণে নিজেকে এ মুহুর্তে সব থেকে বেশি অসহায় লাগছে। ওর কথা শুনেই তো এখানে এসেছি। আমি তো নিজে থেকে আসতে চাইনি অথচ বাঁচার জন্য আমার ঘাড়েই শেষমেশ সব দোষ চাপিয়ে দিল?
.

.
বাসায় আসার পর রুম থেকে আর বের হইনি। বলা যায় ইচ্ছেই হয়নি। আমি তো জানি আমি কোনো দোষ করিনি। তারপরেও তখনকার ঘটনার জন্য এবং সাদিয়ার মিথ্যে স্বীকারোক্তির জন্য এ মুহুর্তে নিজের কাছে নিজেকে ভীষণ তুচ্ছ মনে হচ্ছে। কেন তার কথায় তখন সায় দিতে গিয়েছিলাম! এ বাসায় পা রাখার পর একমাত্র ও-ই তো ছিল আমার সময় কাটানোর সঙ্গী। বোনের বান্ধবী হওয়ার পাশাপাশি ওকে নিজের আরেকটা বোন ভাবতাম। অথচ সে যে আমার সাথে এভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করবে তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। রুমে বসে আমি পরবর্তী পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। যদিও এর মাঝে হাতে তিনদিন সময় আছে। তবুও একা একা বসে না থেকে ভাবলাম কিছুটা এগিয়ে রাখি। দরজা মুখোমুখি ভিড়ানো। সাদিব দরজা সশব্দে ধাক্কা মেরে হুড়মুড় করে রুমে ডুকে আমাকে বসা থেকে টেনে দাঁড় করাল। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই আমার বাম গালে ব্যথা অনুভব করলাম। সাদিবের শক্ত হাতের চপেটাঘাতের ফলে কিছুক্ষণের জন্য মনে হলো আমি আমার বাম কানে হয়তো শোনার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। সাদিব রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে, যা ওর আচরণে স্পষ্টত।

সাদিব রাগান্বিত কন্ঠে তুলনামূলক চিৎকার করে বলে উঠল, ” এতো সাহস কই থেকে আসে তোমার? জবাব দেও ওকে নিয়ে কেন গেছিলে? ”

” ডাক্তার সাহেব আমার কথাটা একটু শোন। তাহলে সবটা তুমি বুঝতে পারবে। ”

” কি শুনবো? শোনার জন্য বাকি রেখেছো কি? এতোগুলা মানুষ কি মিথ্যে কথা বলবে? ” সাদিবের কণ্ঠে রাগের পাশাপাশি হতাশা যুক্ত হল। ” তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম, বুঝতে পারিনি তার প্রতিদানে এ দিন দেখাবে। স্বাধীনতা দিলে মানুষ যে এতোটা বিগড়ে যায় তোমাকে না দেখলে জানতাম না। তোমাকে প্রশয় দেওয়াটাই ছিল আমার করা আরেকটা বড় ভুল। ” বলে সাদিব এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। হনহনিয়ে বাসার বাহিরে বেরিয়ে গেল।

সাদিবের এহেন আচরণে মনঃকষ্টের তীব্রতা নিয়ে আমি সেভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম। এক এক করে বাসার প্রতিটা সদস্য বিনা বাচবিচার ছাড়াই আমার সাথে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করে চলছে। কেউ একটাবারের জন্য আমার কাছ থেকে শুনতে চাইল না। সবার আচরণের বালাই উড়িয়ে দিলেও সাদিবের আচরণের কারণে তীব্র মনঃকষ্টে আমার চোখ জোড়া ভিজে উঠতে চাইল। এখন শুধু বাবা তুল্য লোকটিই বাকি রয়েছেন। উনিও কি সবার মতো ভুল বুঝবেন আমায়? একদিকে সেদিন সারাটা রাত সাদিব বাসায় ফেরেনি। অন্যদিকে রাগে অপমানের সাথে লোকটার বাহিরে কাটানো আমাকে সারাটা রাত নির্ঘুম কাটাতে বাধ্য করেছে।

দায়িত্বের খাতিরে প্রতিদিনকার মতো সকালে ডাইনিং রুমে যেতে সাদিব বাদে বাসার প্রতিটা সদস্যকে নজরে এল। আমাকে দেখা মাত্র সাদিয়া মাথা নিচু করে ফেলল। হয়তো সে এতো কিছুর পর আর চায় না আমার মুখোমুখি হতে। আমাকে দেখে ফুপু শ্বাশুড়ি ফোড়ন কেটে মাকে বললেন, ” সামিরা সাদিব যে বাসায় নেই এ খবর কি তোমার বউমা জানে? নাকি স্বামীর খবরাখবর রাখার দরকার নেই? ”

মা রাগে গজগজ করতে করতে বললেন,
” আপা আপনি খান তো। ছেলেটা সারাটা রাত বাহিরে থাকল না কই থাকল তাতে তার মা ছাড়া এমনিতেও কারোর কিছু যায় আসে না। না জানি কই আছে কি খাচ্ছে ছেলেটা! এতোবার ফোন করলাম ফোনটাও রিসিভ করছে না। ”

” সবাই সবকিছু নিতে পারে না। আগেই জানতাম।” খাওয়ার ফাঁকে রুনা মাকে বলল।

তিনজনের কথাগুলো চুপচাপ শোনা ছাড়া উপায় দেখছি না। আমার অসহায়ত্ব বাবা বুঝতে পারলেন কিনা জানা নেই। সবার কথা শুনে বাবা বললেন, ” রুনাকে মনে হয় ওর বাবা মা আদবকায়দা বলতে কিছু শেখাইনি। যদি শিখতো তাহলে বড়দের মাঝখানে এভাবে বেয়াদবের মতো কথা বলার আস্পর্ধা দেখাতে পারতো না।

বাবার এক কথায় রুনা সহ বাকি সদস্যরা সবাই চুপসে যেতে বাধ্য হল। ফুপু শ্বাশুড়িকে উদ্দেশ্য করে বাবা বললেন, ” মানুষের ঘরে আড়ি পাতা থেকে শুরু করে দেখছি সব বদ গুণই মেয়েটাকে শিখিয়েছিস! এভাবে চলতে থাকলে পরের বাড়ির ভাত বেশিদিন কপালে জুটবে বলে তো মনে হয় না। ওকে এসব থেকে সাবধান করে দিস! ”

সত্যিই কি মা ছাড়া কারোর কিছু যায় আসে না? নাকি প্রকাশ করতে পারছি না বলে মা বুঝতে চাইছেন না সাদিবের অনুপস্থিতি কারোর জন্য অস্থিরতার কারণ! সব মিলিয়ে আমার গলা দিয়ে সারাদিনে এক গ্লাস পানিও নামল না। আমি নিরপরাধ হলেও আমার কারণেই কাল রাতে সে বাড়ি ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। সেখানে তার অনুপস্থিতি নিসন্দেহে আমার খারাপ লাগার মুখ্য কারণ….

চলবে…..

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (২৬)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
আজ সারাদিন আশফাক শিকদার বাসাতেই রয়ে গেলেন। বাহিরে যাওয়ার জন্য বিশেষ কোনো প্রয়োজন মনে করলেন না। কাল সন্ধ্যার পর তিনি এবং সাদিব এক সাথেই বাসায় ফিরেছেন। তাদের বাসায় ফিরতে দেখে সামিরা নিজের অভিযোগের ঝুড়ি খুলে বসলেন। সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফিরেছেন বাবা ছেলে দু’জনেই। এমতাবস্থায় যে কারোরই হুট করে মাথা ঠিক থাকার কথা নয়। সাদিবের বেলায়ও ব্যতিক্রম ঘটেনি। আশফাক শিকদার প্রতিক্রিয়া জানানোর আগেই সাদিব রেগে নিজের ঘরের দিকে ছুটে যায়। পরবর্তীতে সাদিব তামান্নার মধ্যকার কথোপকথন তিনি না শুনলেও ভূল বোঝাবুঝিটা বাহিরে থেকে দেখে তিনি কিছুটা হলেও আন্দাজ করেছেন। আশফাক শিকদার ঠান্ডা মেজাজের মানুষ। সব সময় চেচামেচি থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে চেষ্টা করেন। রাগারাগি চেঁচামেচি তার স্বভাব বিরোধী। নাহলে এতবছর যাবত সামিরার মতো খিটখিটে মেজাজের মহিলার সাথে দিব্যি সংসার করে যেতে পারতেন না। স্বামী স্ত্রী দু’জনের মধ্যে একজন রেগে আগুন হলে অপরজনকে চুপ করে শুনে থাকতে হয়। দু’জনই যদি সমান তালে রেগে বোমা ফাটাতে থাকেন তাহলে সে সংসারে অতি শীঘ্রই ভাঙ্গনের জোগাড় হয়। যত যাই ঘটে গেছে আগে ঘটনা পুরোটার সত্যতার না জেনে তিনি হুটহাট কোনো সিন্ধান্তে চলে যাননি। সাদিব হয়েছে একদম তার মায়ের মতো রাগী স্বভাবের। তাই তো তখন কেবলমাত্র মায়ের মুখে অর্ধেক কথা শুনে ঘটনার সত্যতা না খুঁজে উল্টো রেগেমেগে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। সাদিবের রুমের সামনে পায়চারি করছেন আশফাক শিকদার। ভেতরে তামান্না একা রয়েছে। মেয়েটার সাথে একবার কথা বলা জরুরি মনে করলেন। একপক্ষের অভিযোগ শুনে অন্যপক্ষের উপর দোষ দেওয়া তো যায় না। বিচার করতে হলেও দু’পক্ষের মতামত শুনে তবেই রায় জানাতে হয়। এটাই তো নিয়ম! তাছাড়া তিনি যতটুকু জানেন তাতে করে তামান্না এমনটা করবে বলে মনে তিনি মনে করেন না। কিন্তু অন্যদিকে সাদিয়া তার নিজের মেয়ে। সাদিয়ার কয়েকদিন আগের আচরণের দরুন তিনি তামান্নাকে পুরোপুরি দোষ দিতে পারছেন না। তারচেয়ে অন্তত একটু হলেও সন্দেহ করছেন নিজের মেয়ের ওপর।

” মা আসবো? ”

যোহরের নামাজ শেষ করে জায়নামাজ গুছিয়ে রাখছিলাম। দরজার সামনে শ্বশুরকে নজরে আসতে দেখে তড়িঘড়ি করে জায়নামাজ রেখে উঠে পড়লাম।” বাবা আসুন না। অনুমতির কি আছে? ”

আশফাক শিকদার অনুমতি পেয়ে রুমে ডুকে রুমের আশেপাশে একবার চোখ বুললেন। চোখ বুলালেন বললে ভুল হবে তিনি আসলে সেভাবে করে কিছু একটা ভাবছেন হয়তো। উনার ভাবনার মাঝেই আমি বললাম, ” বাবা বসুন না। ”

তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া জানালেন না। সন্তপর্ণে বিছানার একপাশে বসলেন। হাতের ইশারা দিয়ে দেখিয়ে দিলেন উনার পাশে বসার। আমি উনার পাশে বসতে উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। যেটা আমার জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাপার ছিল। কাল বিকেল থেকে এখন অব্ধি গোটা একটা দিনে সবার আচরণে আমি ধরেই নিয়েছিলাম সবার মতো তিনিও হয়তো ব্যতিক্রম আচরণ করবেন না। এ মুহুর্তে আমার নিজের বাবার কথা ভীষণ মনে পড়ছে। শেষবার যখন উনি আর মামনি আমাকে দেখতে এসেছিলেন তখন যাওয়ার সময় বাবা ঠিক এভাবেই মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ” আল্লাহ সব সময় তোমার ভালো করুক! বাবার কথা রাখতে তুমি সেদিন নির্দ্বিধায় সায় দিয়েছিলে, তার প্রতিদানস্বরূপ তিনি যেন তোমার উপর সর্বদা খুশি থাকেন। বাবা সব সময় চাই দুঃখ কখনো আমার মেয়েকে স্পর্শ না করুক! ” অবাধ্য পানি কণা চোখের কোণে ভিড়তে শুরু করল। নিমিষেই না চাইতে আমার দু’চোখের কোণ ভিজে উঠল।

বাবা আমার চোখের পানি লক্ষ্য করে বললেন,” তুমি কাঁদছো কেন মা? ”

” বাবার কথা ভীষণ মনে পড়ছে! ”

তিনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বললেন, ” আমিও তো তোমার আরেকটা বাবা তাই না? ”

উনার প্রশ্নের জবাব মুখে না দিয়ে ইতিবাচক মাথা দুলাতে তিনি পুনরায় বললেন, ” তাহলে বাবাকে কালকের ঘটনাটা খুলে বল তো কি হয়েছে? আমি জানি আমার মা-টা এতো বড় ভুল করতে পারে না। কোথাও একটা ভুল হচ্ছে! ”

চোখের পানি মুছে বাবাকে শুরু থেকে শেষ অব্ধি সবটা খুলে বললাম। সব শুনে তিনি কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইলেন। এ প্রসঙ্গে উনার থেকে তেমন কোনো প্রতিত্তোর ফেলাম না। বরং আমাকে শান্তনা দিতে বললেন, ” মন খারাপ করো না মা। তোমার এক বাবা তোমার পাশে নেই তো কি হয়েছে এই বাবা তো আছে। দেখবে ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে। ”

উনার কথায় বোধহয় জাদু আছে। কথাটা আমার কর্ণকুহরে পৌঁছাতে কোথাও মনে হল আমার মনে প্রশান্তি বয়ে এলো। তিনি বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন৷ চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলেন। পরক্ষণে থেমে গেলেন। পেছন ফিরে জানতে চাইলেন, ” সাদিব তোমাকে কি বলেছে? ”

আঘাতের কথা না তুলে ছোট বাক্যে জবাব দিলাম। ” সবার মতো ডাক্তার সাহেব আমাকে ভুল বুঝেছেন। ”

শুনে বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। আমাকে শান্তনার সহিত বলেন, ” ছেলেটার এই একটাই সমস্যা৷ পুরো কথা না জেনে বুঝে অযথা রাগ দেখিয়ে চলে গেল। তাকে নিয়ে আমার একটাই ভয় না জানি তার এই রাগ তাকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যায়। তবে আমার ছেলেটার মন ভালো। বাসায় ফিরে আসলে তুমি তাকে ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে বলবে। স্বামী স্ত্রীর মাঝে বেশি সময় ধরে ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে থাকতে হয় না। এতে শয়তানের প্ররোচনায় একটি সুন্দর সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। তাই আমি চাই তোমরা নিজেরা মিটমাট করে নেও। কেমন মা? ”

আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালে তিনি স্বস্তির সাথে প্রশস্ত হাসলেন।
.

.
অপরাহ্নের পরবর্তী সময়। আকাশ জুড়ে কালো মেঘের ঘনঘটা। বিনা নোটিশে আষাঢ়ে বৃষ্টির পূর্বাভাস। দেখতে দেখতে পরিবেশ জুড়ে শীতল হাওয়া বইতে শুরু করে দিল৷ মন খারাপের সময় এমন বিনা নোটিশে বৃষ্টির আগমনে হঠাৎ এক অদ্ভুত ইচ্ছে চেপে বসল। যেদিন আমার পরিচয়ের সাথে শিকদার বাড়ি বধূর পরিচয়ের সংযুক্তি ঘটেছে সেই দিনের পর থেকে চঞ্চলতা ভরা আমিটা একদম একা হয়ে গিয়েছি। নিঃসঙ্গতাকেই আমার একমাত্র সঙ্গী রূপে পেয়েছি। আশেপাশে এতো লোকজনের ভীড় থাকার পরেও আমার নিজের একটা ব্যক্তিগত মানুষ হলো না। যার কাছে আমার মনের সকল কথা নিরদ্বিধায় বলে দিতে পারবো। শত ব্যস্ততার মাঝেও যে আমার অযথা বকবকানি মনোযোগ দিয়ে শুনবে। কথা বলতে প্রিয় মানুষগুলোর জন্য এর থেকে বড় নিঃসঙ্গতা বোধহয় আর একটিও নেই। মানুষ সব সহ্য করতে পারে, নিঃসঙ্গতাও সহ্য করে নেয় একসময়। কিন্তু যার সাথে সারাটি জীবন কাটানোর প্রদক্ষেপ নিয়েছে সেই স্বামী নামক লোকটির অবহেলা সহ্য করাটাই দায়। সকালের পর থেকে সাদিবকে কয়েকবার ফোন করে কথা বলার চেষ্টা করেছি। এতোটাই রাগ পুষে রেখেছে আমার জন্য যে লোকটার আমার ফোন তোলার প্রয়োজন মনে হলো না। বুঝলাম আমি তার নামে মাত্র স্ত্রী হলেও মন থেকে সে কখন আমাকে স্ত্রী ভাবতে পারবে না। ভালোবাসার জন্য তার যেমন মানুষ চাই আমি সেটার যোগ্যতা রাখি না। তাই বলে অন্তত একটিবার আমাকে জিজ্ঞেস তো করতে পারতো। মানুষ খুনের আসামির কাছেও তো তার স্বীকারোক্তি শুনতে চায়।

কথাগুলো মনে হতে বুকের মাঝে চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। আকাশেরও বোধহয় আজ আমার মতোই মন খারাপ। তাইতো সে ধরনীর বুকে বৃষ্টি নামক কান্নার মাধ্যমে সবটা ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। বৃষ্টি নামতে আমি দৌড়ে চলে গেলাম ছাদে। এখানে কারোর শাসন বারণ শোনার নেই। আমি কোথায় আছি আপাতত কেউ জানতে চাইবে না। আগে যখন একটু খানি ভেজার জন্য বায়না ধরতাম মামনির কত বকাঝকাই না খেতে হতো। বলতো, ” তামান্না বেশি ভালো হবে না বলে দিলাম, অসুখ হলে ঔষধ দেওয়া তো দূরে আমি একদম দেখবো না তোকে! ” ত্যাড়ামি করে তবুও চলে যেতাম ভেজার জন্য৷ অতঃপর ফলস্বরূপ গা কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসতো। সন্তানকে অসুস্থ দেখলে কোনো মা-ই হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবে না। তাইতো মামনি মুখে যতই বলুক, ” অসুস্থ হলে একদম দেখবো না! ” মন বলে ঠিক উল্টোটা। আমার থেকে তনিমা হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপী। আমি চঞ্চল হলে সে ওপর থেকে বেশ শান্ত প্রকৃতির। কিন্তু আমার কাছে এলে তার জন্য সেই ভালোমানুষির মুখোশটা ধরে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে। দুষ্টুমির ক্ষেত্রে দু’জন সমান ভাবে পটু। শত হলেও ছোট বেলায় খেলার সাথি হিসেবে বাবা মায়ের কাছে তাকে আবদার করেছিলাম কিনা! আহা অতীত! ঠিক যেন সোনালী অতীত। সেসময় মায়ের শাসন বারণ অসহ্য মনে হলে কি হয়েছে এখন হাড়ে হাড়ে মায়ের কথার গুরুত্ব টের পাচ্ছি। টাইম মেশিন থাকলে ঠিক সেসময়টাতে আবার ফিরে যেতাম। বর্তমানে আর কখনোই আমি আসতে চাইতাম না। খোলা আকাশের দিকে মুখ তুলে অতীতের স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে আনমনে চোখের কোণে জমা পানিগুলো বৃষ্টির পানির সাথে ধুয়ে মিশে যাচ্ছে। মেঘের ভারী বর্ষণ মুখের ওপর আছড়ে পরাটা আমার ভীষণ ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে গতদিনের সাথে আজকের অস্বস্তি আর খারাপ লাগা থেকে কিছুটা হলেও রেহাই পাচ্ছি। এমনিভাবে কত সময় ভিজেছি জানি না। সারাদিনের নাওয়া খাওয়া থেকে বিরত থাকার দরুন হঠাৎ করেই আমার চারিদিকটা চোখের সামনে ঝাপসা হতে শুরু করল। নিমিষের মধ্যে দু-চোখ জুড়ে অন্ধকার নেমে এলো…

চলবে…

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]