না_চাইলেও_তুমি_আমার পর্ব-২৭

0
3800

#না_চাইলেও_তুমি_আমার
পর্বঃ ২৭
জাহান আরা

মেইন ডোরের সামনে এসে চন্দ্র থমকে দাঁড়ায়।মাথায় যেন বাঁজ ভেঙে পড়ে চন্দ্রর,দরজায় বিশাল এক তালা লাগানো।
মুহূর্তে জেগে উঠা স্বপ্ন মুহূর্তেই ধপ করে নিভে যায়।প্রচন্ড শীতেও ঘামতে থাকে চন্দ্র।টলতে টলতে সোফায় গিয়ে বসে।

সুরমার চিৎকারে মাইনুল সাহেব ঘুম থেকে উঠে আসে আমিরের রুমের সামনে।ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে এরকম মারছে কেনো সুরমা কে।

ভিতর থেকে আমির জবাব দেয়,”বাবা,তুমি যাও এখান থেকে,আজ ওরে আমি খুন করে ফেলবো।ওর কতোবড় সাহস চন্দ্রকে ইন্ধন যোগায়,ওই ছেলের সাথে কথা বলিয়ে দিয়েছে,আজ ওকে এমন মারা মারবো যে ও সাহায্য করতে চাইলে ভুল করেও চন্দ্র ওর সাহায্য চাইবে না।ওর নাকের ডগায় নিশ্বাস এনে ছাড়বো।”

মাইনুল সাহেব চন্দ্রর পাশে সোফায় এসে বসেন।তারপর কোমল সুরে বলেন,”চন্দ্র মা,যা তো আমার জন্য এক কাপ চা বানিয়ে আন।তোর ভাবীর কান্ড দেখেছিস,কেমন একটা কাঁচা কাজ করে বসে আছে”

অবাক হয়ে যায় চন্দ্র,মানুষের উপরে এক রূপ আর ভিতরে এক রূপ থাকে কিভাবে?
বাবা ভাই খুব রাগী মানুষ বলেই জানতো চন্দ্র,কিন্তু এতোটা বিকৃত মস্তিষ্কের তা জানতো না।এই বাবার জন্মের মেয়ে সে ভাবতেই ঘৃণায় শরীর রিরি করে উঠে চন্দ্রর।
একটা মানুষ কে এতো মারছে আর উনি কেমন নির্লিপ্তভাবে চা চাচ্ছেন।
মানুষ এতোটা ও নিষ্ঠুর হয়?

চন্দ্র উঠে যায় চা বানাতে।কিচেনে যেতেই চন্দ্রর মাথায় একটা বুদ্ধি আসে।

চা বানিয়ে নিয়ে চন্দ্র বাবার সামনে রাখে,তারপর চোখেমুখে অপরাধবোধ ফুটিয়ে তুলে আস্তে আস্তে বলে,”বাবা আমি আসলেই বুঝি নি তোমরা আমাকে এতটা ভালোবাসো,আমাকে মাফ করে দিও বাবা,আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি বাবা।আমি কাল-ই ওকে ডিভোর্স দিয়ে দিবো।”

মেয়ের কথা শুনে মাইনুল সাহেবের মুখ হাসিহাসি হয়ে যায়।চন্দ্র কে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে,”সত্যি বলেছিস মা,সত্যি তো?”

“হ্যাঁ বাবা,আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি।”

“আমি জানতাম তুই বুঝবি তোর ভুল।”

“আচ্ছা বাবা,তুমি প্রেম ভালোবাসা কে এতো ঘৃণা করো কেনো,মা’কে তো তুমি খুব ভালোবাসতে,তাহলে?”

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মাইনুল সাহেব মেয়ের দিকে তাকালেন,চন্দ্রর মুখে গোবেচারা ভাব স্পষ্ট ফুটে উঠেছে,জবাব দিবেন কি না সেটা ভাবছেন।
বাবার বিশ্বাস অর্জন করতে চন্দ্র আবার বললো,”জানো বাবা,ওই লোক আমাকে বলেছে মা না-কি তোমাকে মোটেও ভালোবাসতো না,তুমি নাকি মা’কে খুব কষ্ট দিতে,আমি অবশ্য বিশ্বাস করি নি ওনার কথা,আমি তো দেখি মাঝেমাঝে মা’কে তুমি কতো মিস করো।”

মাইনুল সাহেবের মুখে হতাশার চিহ্ন ফুটে উঠে।ক্লান্ত গলায় মাইনুল সাহেব বলেন,”তোর মা’কে আমি কখনো বুঝাতে পারি নি রে চন্দ্র,সে বুঝতেই চায় নি আমার ভালোবাসা।সবসময় ভেবেছে আমাকে শত্রু।
অথচ তোর মা’য়ের জন্য আমি এক আকাশ ভালোবাসা বুকে ধরে রেখেছিলাম,ওই শামসু তোর মায়ের মাথা চিবিয়ে খেয়েছে,না হলে তুই ভাবতে পারিস,আমার সাথে বিয়ের পর তোর মা ২বার পালিয়ে গিয়েছিলো ওই শামসুর সাথে,রাত্রির জন্মের পরে একবার,তোর জন্মের পরে একবার।”

চন্দ্র চমকে উঠে শুনে।মা ২বার পালিয়ে গিয়েছিলো আর বাবা এমনিই মাফ করে দিয়েছে মা’কে?
অসম্ভব এটা।
বুকের ভিতর কেমন ভোঁতা যন্ত্রণা হয় চন্দ্রর এটা ভেবে যে মা’কে ও বাবা এরকম অত্যাচার করতো যেমন ভাইয়া করছে এখন?
অসম্ভব তো না,তবে কি মা স্বেচ্ছায় দুনিয়া ছেড়ে গেছে না-কি!
ভাবতেই চমকে উঠে চন্দ্র আবার।অনেক কিছুই তার অজানা।হতাশ বোধ করে চন্দ্র।

“বাবা,আজ তোমাদের বিয়ের গল্পটা বলো না,ওই লোকটার থেকে তুমি কিভাবে মা’কে ছিনিয়ে এনেছিলে?
তুমি নিশ্চয় রূপকথার রাজকুমারের মতো ছিলে বাবা,নয়তো পারতে না,অনেক সাহসী ছিলে না বাবা?”

মেয়ের কথা শুনে মাইনুল সাহেব চোখ বন্ধ করেন,বাস্তবিকই তিনি রাশেদা কে ছিনিয়ে এনেছেন।সেই অতীতের কথা মনে পড়ে যায় আবার।চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠে সবকিছু।
কে বলবে এতোগুলা বছর কেটে গেছে যে এরইমধ্যে?
মনে হয় যেনো এইতো গতকালের ঘটনা এটা।

কেমন তৃপ্তি অনুভব করেন মনের মধ্যে,অবশ্যই তিনি রূপকথার রাজকুমার ছিলেন,তা না হলে কি পারতেন এরকম করে রাশেদা কে পেতে?

চন্দ্রর ডাকে কল্পনা থেকে ফিরে আসেন তিনি,আজ আবার নিজেকে রূপকথার রাজকুমার মনে হচ্ছে তার,আজও তিনি বিজয়ী।এইতো কেমন করে মেয়েকে আলাদা করে দিয়েছেন মেয়ের জামাই থেকে।
হুহ্,ভালোবাসা!
ভালোবেসে বিয়ে করবে তিনি মেনে নিবেন,এতোই সোজা!
আশ্চর্য হন তিনি,আজ এতো বছর পরেও তিনি ভালোবাসা শব্দে বিশ্বাসী না।
ভালো শুধু তিনি বেসেছেন আর কেউ বাসতে পারে না।

“বাবা,বললে না যে,শোনাও না গল্পটা। ”

হ্যাঁ আজ বলবেন তিনি,কেমন কৌশল করে রাশেদাকে বিয়ে করেছেন সেই গল্প বলবেন,কখনো তো মেয়েদের গল্প শোনান নি,আচ্ছা সব গল্প কি শোনানো যায়?
না পারবেন না সব গল্প শোনাতে,একটা গল্প তিনি পরম যত্নে বুকের ভিতর তালাবন্ধ করে রেখেছেন।সেই গল্প ৩জন মানুষ জানতো,রাশেদা তো মরেই গেছে,বাকি তিনি আর শামসুল। চন্দ্রকে অন্যকোথাও বিয়ে দিয়ে দেওয়ার আসল উদ্দেশ্য তার এটাই,তিনি কখনো চান না এই সত্য সামনে আসুক,কেউ জানতে পারুক,বিশেষ করে চন্দ্র।

সবকিছুতে নিজের নিষ্ঠুরতা প্রকাশ পেলেও এই একটা বিষয় নিয়ে তিনি টু শব্দ করেন নি,তবুও কেনো রাশেদা তাকে মেনে নিলো না?
এই বিষয়টাতেও কি রাশেদা বুঝতে পারে নি তার ভালোবাসা!

আবারও মাথা গরম হয়ে যায় তার,খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করে,ছুঁড়ে মারে চায়ের কাপ-পিরিচ।লাথি মেরে টি-টেবিলের উপরের কাঁচ ভেঙে ফেলে।মনে পড়ে যায় রাশেদার বলা কথাগুলো,রাশেদা তাকে বলতো,তিনি রূপকথার রাজকুমার না,তিনি রাক্ষস ছিলেন,তাই ছিনিয়ে এনেছেন রাশেদাকে শামসুর কাছ থেকে।
কেনো রাশেদা তাকে রাজকুমার ভাবতে পারে নি,কেনো ভেবেছে তাকে রাক্ষস?

একদিকে সুরমার আর্তনাদ,অন্যদিকে হঠাৎ করেই মাইনুল সাহেবের ক্ষেপে যাওয়া,চন্দ্র সহ্য করতে পারে না আর।কেমন দমবন্ধ পরিবেশ,কি অসহ্য যন্ত্রণা!
এভাবে হাল ছেড়ে দিলে তো বাবার থেকে জানতে পারবে না কিছু।

উঠে গিয়ে বাবা কে জড়িয়ে ধরে আবার।ওপাশে আমিরের মার থেমেছে,সুরমার চিৎকার এখনো শোনা যাচ্ছে।
মাইনুল সাহেব কে টেনে সোফায় বসায় চন্দ্র,আজ তার জানতেই হবে।

“বাবা,কেনো এমন করছো,আমি তো তোমার কথা মেনেই নিলাম,বাবা শান্ত হও,আমাকে বলো বাবা কি এতো কষ্ট তোমার,বলো আমাকে।”

মাইনুল সাহেবের রক্তলাল চেহারা স্বাভাবিক হতে সময় লাগে।ঘড়িতে রাত আড়াইটা।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাইনুল সাহেব বলেন,”তোর মা ছিলো আমার দুই ব্যাচ জুনিয়র।আমি আর শামসু ছিলাম খুব ভালো বন্ধু,শামসু রাশেদার সাথে আমার পরিচয় করায় ওদের সম্পর্কের ২ বছর পর।রাশেদা কে যেদিন দেখি আমি সেদিন ই ওর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যাই,কিন্তু রাশেদা আর শামসু দুজন দুজনকে প্রচন্ড ভালোবাসতো।
আমি ও রাশেদা কে ভালোবাসতাম,শামসু যখন রাশেদার প্রেমে মগ্ন,আমি তখন ক্যারিয়ারের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ি,আমার ভালোবাসা দিয়ে আমি রাশেদা কে পেতাম না আমার জানা ছিলো,প্রেমে পড়ে শামসু লেখাপড়ায় অবহেলা করতে লাগলো।

অনার্সে থাকাকালীন আমি চাকরি খোঁজা শুরু করেছি,শেষ হতে হতেই চাকরি পেয়ে যাই।রাশেদার পরে তোর ছোট খালাও ততোদিনে বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠেছে,আমি প্রস্তাব দিতেই রাজি হয়ে যায় তারা।শামসু তখন পাগলা কুকুরের মতো হয়ে গেছে,আমার পা ধরে বসে থাকতো,আমি ভীষণ খুশি হতাম,নিজেকে কেমন বীরপুরুষ মনে হতো।
অবশেষে রাশেদার সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেলো।তুই যে বলেছিলি আসলেই আমি রাজকুমার ছিলাম কিন্তু রাশেদার কাছে হতে পারি নি।
ছলে-বলে-কৌশলে সবরকম চেষ্টা করেছি,কতোদিন নির্মমভাবে পিটিয়েছি তবুও রাশেদা আমাকে ভালোবাসতে পারে নি।
তোর জন্মের আগে পালিয়ে যায়,১ মাস পরে খুঁজে বের করেছি,তারপর আবার পালিয়ে যায় তোর জন্মের পরে,আমি আবারও খুঁজে বের করেছি,তারপর রাশেদা কে ঘরে বন্ধী করে রেখছি।
সেই থেকে আমি ঘৃণা করি,প্রচন্ড ঘৃণা করি ভালোবাসা কে।যারা ভালোবেসে বিয়ে করে তাদেরও ঘৃণা করি,আমি রাশেদার ভালোবাসা পাই নি,কারো ভালোবাসা আমি মেনে নিতে পারি না।
এজন্য তোদের কে কড়া শাসনে রেখেছি,আমি জানতাম তোরা কেউ ভুল করে ভালোবেসে ফেললেও আমি মেনে নিবো না তারচেয়ে ভালো তোরা যাতে প্রেমে না পড়িস।
আমি এরকম ছেলের কাছেও বিয়ে দিবো না মেয়েকে যে আগে কাউকে ভালোবেসেছে।”

“মা মারা গেছে কিভাবে বাবা?”

অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো মাইনুল সাহেব,তারপর বিড়বিড় করে কি যেনো বললো।তারপর উঠে চলে গেলো নিজের রুমের দিকে।

হঠাৎ করেই চন্দ্রর ভীষণ শীত করতে লাগলো,তার বাবা এতো ভয়ানক মানুষ ছিলো কখনো বুঝতেই পারে নি সে।
চন্দ্রর মনে হতে লাগলো তার বাবা আর ভাই আসলে মানসিকভাবে অসুস্থ। একটা সহজ বিষয় কে তাই তারা নিতে পারছে না।রাগ,জিদের বশে মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলেছে।

মাইনুল সাহেব আবার বের হয়ে আসেন রুম থেকে,তারপর বলেন,”কাল ডিভোর্সের পরপরই তোর বিয়ে দিবো আমি,তৈরি থাকিস মা”

চন্দ্রর মাথায় আগুন ধরে যায় এটা শুনে,চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,”আমি মায়ের মেয়ে বাবা,মরে যাবো তবুও নিষাদের থেকে আলাদা করতে পারবে না আমাকে।এতোক্ষণ তোমার আসল রূপ জানার জন্য এরকম করে কথা বলেছি,তুমি আসলেই একটা রাক্ষস।”

মাইনুল সাহেবের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয় চন্দ্র।বিছানায় শুয়ে কাঁদতে থাকে ফুপিয়ে ফুপিয়ে।

চন্দ্রর চোখেমুখে মাইনুল সাহেব সেই তেজ দেখতে পান যা রাশেদার চোখেমুখ ছিলো।
তবে কি তাকে এই একরত্তি মেয়ের ভালোবাসার কাছে মাথা নত করতে হবে?
কিছুতেই না।

আমিরের দরজায় নক করে মাইনুল সাহেব।
আমির বের হয়ে আসতেই চুপিসারে কিছু বলে আমির ‘কে।তারপর যে যার ঘরে চলে যায়।

সকাল ৯টায় নিশান,নিষাদ,হাসনাত সাহেব,এক গাড়ি পুলিশ নিয়ে চন্দ্রদের বাসায় আসেন।চন্দ্রদের ফ্ল্যাটের সামনে গাড়ি থেকে নামতেই নিষাদের ফোন বেজে উঠে।
শামসুজ্জামান সাহেব কল দেখে রিসিভ করে নিষাদ,ওপাশ থেকে ব্যস্ত গলায় শামসুজ্জামান সাহেব বলে,”হ্যালো,নিষাদ,আজকে অফিসে আসার সময় তুমি একটু চন্দ্রকে সাথে নিয়ে এসো তো।”

“চন্দ্র নেই স্যার,ওর বাবা চন্দ্রকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে,আমি আজ অফিসে যাবো না,আমি চন্দ্রদের বাসায় আসছি।”
নিষাদের কথা শুনে শামসুজ্জামান খান রেগে উঠে,তারপর বলে,”এড্রেস দাও ওদের বাসার,আমি আসছি।”

কল কেটে দিয়ে নিষাদ টেক্সট করে দেয় এড্রেস।তারপর সবাই মিলে ভিতরে প্রবেশ করে।
কলিং বেল বাজতেই রাবু এসে দরজা খুলে দেয়।সামনে এতো পুলিশ দেখে রাবু চমকে উঠে। রাবু এই বাসার কাজের মেয়ে,সকালে আসে বিকেলে যায়।
চিৎকার করে বলে,”খালুজান দেইখা যান পুলিশ আসছে বাসায়।”

আমির,মাইনুল সাহেব বের হয়ে আসেন ভিতর থেকে।আড়াল থেকে সুরমা তাকিয়ে দেখে নিষাদ কে,এই ছেলেটাকে কেমন উদভ্রান্ত লাগছে আজ,অথচ বিয়েতে কতো সুন্দর দেখাচ্ছিলো,ভালোবাসা কখন কাকে কিভাবে বদলে দেয়,কেউ বুঝে না।

চলবে…???