নীল সীমানার শেষপ্রান্তে পর্ব-২১+২২

0
4556

#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_২১||

রাতের শুনশান নিস্তব্ধতায় কারো তীক্ষ্ণ আর্তচিৎকার যেন পুরো পরিবোশটাকে আরো বেশি ছমছমে করে তুলছে। এখান থেকে মানববসতি কয়েক মাইল দূরে হওয়ায় এই আর্তনাদ শোনার কেউ নেই।

—“করে নে, যত ইচ্ছা চিৎকার করে নে! তোর ওপর আমার শুধু এটুকু দয়াই দেখাতে ইচ্ছে করছে। এর বেশি কিছু না। আমার ডার্ক হাউসের কর্তৃত্ব তোর মতো অযোগ্য একজনকে দেওয়াটাই ভুল হয়েছে।”

বলেই নিজের লং ব্ল্যাক স্যুটটা একটানে খুলে ছুড়ে মাটিতে ফেলে দিল আহিল। তার সারা শরীর রাগে থরথর করে কাপছে আর পরনের কালো শার্টটা ঘামে জবজবে হয়ে ফর্সা শরীরের সাথে লেপটে আছে। নিজের পায়ের তলা দিয়ে লাল তাজা রক্তের প্লাবন বয়ে চলেছে, তাতে তার কোনো কিছু যায়-আসে না।
নিজের হাত থেকে রিভলবারটা একজন গার্ডের দিকে ছুড়ে দিয়ে ফ্লোরে ধপ করে বসে পড়লো আহিল। কোনোকিছুতেই যেন নিজের মনটাকে শান্ত করতে পারছেনা। কাঁদতে কাঁদতে জোরে চিৎকার দিতে লাগলো সে, যেহেতু এখানে তার আর্তনাদ কেউ শুনতে আসবে না।

—“কেন করলে আমার সাথে এমনটা আল্লাহ? কেন করলে? আমার ফিহুকে কি আমি আর কোনো দিন আমার কাছে ফিরে পাবো না? ওর থেকে দূরে থাকাকালীন আমার দম বন্ধ হয়ে আসতো। আর এখন ওকে অন্য কারোর সাথে দেখে আমি ধুঁকে ধুঁকে মরবো। কী নিয়ে বাঁচবো আমি??”
আহিলের এমন বেদনাবিধুর চিৎকার শুনে ওর গ্যাং-এর সবাই নির্বাক হয়ে গেছে। তারা সবসময় তাদের বসের কঠিন রূপটাই দেখেছে।

—“স্যার, আমার কোনো দোষ নেই। আমি যতোটুকু খবর যেখান থেকে পেয়েছি, আপনার কাছে পৌঁছে দিয়েছি। ”

ফ্লোরে পড়ে থাকা লোকটা বুকে হাত দিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো। আহিল লোকটার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—“তোকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম ফিহুর প্রতিদিনের সব খবর আমায় দিতে। ওর বিয়ে হয়ে গেছে এই নিউজটা তুই আমায় দিতে পেরেছিস? বল?”

—“গত মাসে আমি আপনার সাথে নরওয়েতে গিয়েছিলাম। তাই তখনকার নিউজ জানতে পারিনি। পরবর্তীতে যখন দেখলাম ফাহমিদা ম্যাম জাহিদ মাহমুদের বাড়িতে থাকে, আমি ভেবেছিলাম হয়তো ওনার চাকরির সুবাদে সেখানে থাকেন। ভাবতে পারিনি যে, ওনার বিয়ে হয়ে যাবে। ”

—“তোকে নিজের অনুমানের ওপর ভিত্তি করে কোনো কিছু করতে বলিনি আমি। তোর জন্য আজ আমার এই দিন দেখতে হলো। তোদের নিয়ে এই গ্যাংটা আমি তৈরি করেছিলাম যেন আমার প্রফেশনাল লাইফের জন্য আমার পরিবারের কোনো ক্ষতি যেন আমার শত্রুরা করতে না পারে। আর তোর ওপর আমি সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট দায়িত্ব টা দিয়েছি। হিম ফিহুকে হ্যারাস করেছে এই খবর টা দিতে পারলি, অথচ ওর বিয়ের খবরটা দিতে পারলি না!! আমায় কিছু একটা করতে হবে।”
বলেই ভাবতে ভাবতে চলে গেল আহিল। আবার ঘাড় ঘুরিয়ে বললো,
—“হিমের কী অবস্থা এখন?”

একজন গার্ড শুকনো ঢোক গিলে বললো,
—“এখন কোমায় আছে। আমাদের সিক্রেট ট্রিটমেন্ট সেন্টারে। ওর আগের স্মৃতি সব মুছে গেছে। ”

—“গুড, যদি কোনো দিন সুস্থ হয়, তাহলে নরওয়েতে পাঠিয়ে দিবে। আর তা না হলে এভাবেই থাক।”

______________

বিকেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথাকে ফোন দিচ্ছি। কথা হলো আমার চাচাতো বোন। আমার থেকে দুই বছরের বড় হলেও আমার সাথে তার অনেক ফ্রেন্ডলি সম্পর্ক। তাই আমায় কখনো আপু বলে ডাকতে দেয় না।
কত গুলো কল দিলাম একটাও রিসিভ করছে না। সারাদিন একটুও সময় পাইনি কল দেওয়ার। কাল সারারাত জাগার পর সকালে একটু ঘুমিয়েছিলাম। তাই এখনই কল দিচ্ছি। কিন্তু কোনো খবরই নেই।

এদিকে জানালার পাশে চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর ডায়েরি লিখছে কথা। তার জীবনের অব্যক্ত কথাগুলো এই ডায়েরিতেই লিখতে অভ্যস্ত সে। একদিক দিয়ে কলম চালিয়ে ডায়েরির পৃষ্ঠা শেষ করছে অন্য দিকে সেই পৃষ্ঠার ওপর নিজের চোখের পানি গুলো পড়ে লেখার কালি গুলো সব ছড়িয়ে যাচ্ছে। শুধু এই ডায়েরিই না, পাঁচ বছরে মোট দশটা ডায়েরি লিখেছে কথা যার সবগুলোরই ভেতরের লেখা পড়ার কোনো জো নেই। মনের ভেতরের চাপা দুঃখগুলো যখন কেউ প্রকাশ করতে যায়, তখন নিরবে অশ্রু বিসর্জন দেওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। হোক না সেটা ডায়েরির মতো একটা নিষ্প্রাণ জড় পদার্থের সাথে, তবুও তো মনে হয় কেউ তার কষ্ট গুলো শুনছে, বুঝছে।

তবে নিজের অনুভূতিকে কখনো নিজের পথচলায় বাঁধা হয়ে দাড়াতে দেয়নি কথা। পড়াশুনা কমপ্লিট করে এখন বাবার বিজনেসে হাত দিয়েছে সে। নিজেকে ব্যস্ত রাখলে হয়তো সেই নিষ্ঠুর মানুষটার কথা তেমন একটা মনে পরবে না, যার কাছে তার ভালোবাসার বিন্দু মাত্র মূল্য নেই। কিন্তু মন যে বড়ই বেহায়া। সে শুধু নিষিদ্ধ ভাবনাতেই মত্ত থাকতে ভালোবাসে। রাতের আধারে চোখ বন্ধ করলে ঘুমের বদলে সেই নিষ্ঠুর মনের অধিকারী ব্যক্তিটার মুখাবয়ব ভেসে ওঠে। কেন ভুলতে পারে না সে?

এসব ভাবছে, লিখছে আর চোখের জল ফেলছে কথা, এমনসময় একজন তার কাঁধে হাত রাখে। কথা দ্রুত নিজের চোখের পানি মুছে ঘাড় ঘুরিয়ে বললো,
—“মা, কিছু বলবে?”

কথা যতোই কান্না লুকানোর বৃথা চেষ্টা করুক না কেন, তার রায়িনা রাহমান ঠিকই বুঝতে পারছে। তবে তারও কিছু বলার নেই। তার মেয়ের ওপরের শামুকের মতো শক্ত খোলসের ভেতরে যে একটা কোমলপ্রাণ আছে, সেটা আর কেউ না জানলেও, তিনি বেশ ভালোই জানেন।

—“এভাবে আর কতো দিন চলবে, কথা? তোরও তো একটা ভবিষ্যৎ বলে কিছু আছে! আর কতো দিন এলজন মানুষের জন্য এভাবে চোখের পানি ফেলবি, আর অপেক্ষা করে থাকবি?”

কথা হালকা হেসে বললো,
—“যতো দিন না ও আমার কাছে ফিরে না আসে। আমি এখন মুভ অন করে ফেললে আমার অনুভূতিগুলো যে মিথ্যে হয়ে যাবে, মা! আর তাছাড়া আমি ওর জায়গায় কাউকে বসাতে পারবো না। ”

রায়িনা রাহমান বেশ ভালো ভাবেই জানেন যে, কথাকে এব্যাপারে কিছু বলে লাভ নেই। এ পর্যন্ত কম বুঝায়নি। তাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
—“এই নে, কে যেন বারবার কল দিচ্ছিলো? ফোনটা আমার ঘরে রেখে এসেছিলি সাইলেন্ট করে।”
বলেই চলে গেল রায়িনা রাহমান।

কথা ফোন অন করে দেখে ‘Fihu’ নামের টোটাল ১৬ টা মিসড কল। ভালোই অকাজ হয়ে গেছে! আজ কথার গুষ্টি উদ্ধার করে ফেলবে এই মেয়ে, ভাবতেই ভীতু ফেস করে কল ব্যাক করলো কথা।

আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথার ওপর অসম্ভব বিরক্তি ফিল করছি। এই মেয়েটাকে আমি যখনি ফোন দেই, তখন কোনোদিন রিসিভ করেনা। আমার দরকারের সময় তো পাই-ই না, এখন ওর দরকারেও পাচ্ছি না।
হঠাৎ ফোন রিং হওয়ায় আমি দাঁত কিড়মিড় করতে করতে রিসিভ করে বললাম,
—“কেন ফোন দিয়েছো আমায়? আমার সাথে কথা বলার কোনো দরকার আছে তোমার? আমি তো আর তোমার কিছু হই না! আমার সাথে কথা বলে কোনো লাভ আছে? তুমি,,,,

আমার কথার মাঝে বাঁ হাত ঢুকিয়ে কথা বললো,
—“ওফফ, থাম এবার। আল্লাহ, এতো কথা কোত্থেকে আসে তোর? ফোনটা সাইলেন্ট ছিল রে, বোনু!!”

—“তুমি কোনোদিন আমার দরকারের সময় কল রিসিভ করো না। বাবার অপারেশনের দিনও তোমায় কল দিয়েছিলাম, তুমি রিসিভ করোনি। এজন্য আজ আমায় সংসার করতে হচ্ছে। ”

—“অনেক সরি রে! আমি সেদিন দেশে ছিলাম না।”

—“এ পর্যন্ত কতবার যে সরি বলেছো হিসেব নেই। আর আমার জীবনের ওপর দিয়ে খালি ঝড় যাচ্ছে, ঝড়।”

কথা অবাক হয়ে বললো,
—“আবার কী হয়েছে? তোর বর কি আবার তার প্রেমিকাকে বিয়ে করে ফেলেছে নাকি?”

—“আরে না! তার চেয়েও বড় কিছু,,,,,,
আমি কথাকে সব কিছু খুলে বললাম।

—“বলিস কী রে!! তবে যাই হয়েছে, বেশ ভালো হয়েছে। তুই- ও মেনে নে, তোর বরটা ভালো আছে। মনের দিক থেকে অনেক অনেস্ট, যতোটুকু বুঝলাম। ”

—“এতো তাড়াতাড়ি সব মেনে নিচ্ছি না আমি। আগে ভালো করে বুঝুক আমার কষ্টগুলো। আর ও নিজেকে আমার দিকে পরিপূর্ণ ভাবে টার্ন করাতে পারেনি। আমিও এখনো নিজেকে প্রস্তুত করতে পারিনি।”

—“হুম, দুইজনেরই সময় দরকার। আসলে হুট করে তোদের বিয়েটা হয়েছিল তোদের। তাই মানিয়ে নিতে সময় লাগছে। তবে আমি শুধু একটা কথাই বলবো, নিজেদের জীবনটা যতো তাড়াতাড়ি পারিস, গুছিয়ে নে। যেহেতু এতো বড় একটা ঝড় গেল, আবার কোনো সমস্যা আসবে না, এটা বলা যায় না। কারো ভালোবাসা একবার পেলে, তা সাথে সাথে গ্রহন করে নিস। হারাতে দিস না। সবার কপালে ভালোবাসা থাকে না। যাদের থাকে না, শুধু তারাই বুঝে এর কষ্ট।”

কথা যে কতটা কষ্ট থেকে এই কথাগুলো বলেছে, তা আমি বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পারছি। ওর সাথে আমার অনেক ভালে আন্ডারস্ট্যান্ডিং। আমাদের সব কিছুই শেয়ার করি একে অপরের সাথে।

—“আজ তেমায় একটা নিউজ দেওয়ার জন্য কল দিয়েছি। ”

কথা নিজের চোখ মুছে বললো,
—“হ্যাঁ, বল। কী নিউজ?”

—“আহিল ভাই ফিরে এসেছে। কাল আমার সাথে দেখা হয়েছিল। আমাদের বাসায় এসেছিলো। ”

কথা যেন একদমই নির্বাক হয়ে গেল। চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু বিন্দু ঝরছে, গাল দুটো বারবার সিক্ত হয়ে উঠছে। কাপা কাপা অধর যুগল দিয়ে শুধু একটা কথাই বেরিয়ে এলো,
—“তোমারই অপেক্ষায় গুনেছি প্রহর অগুনিত,
বুঝবেনা তুমি?
চিনবেনা আমায়?
শত-সহস্র রাতে বিসর্জন দেওয়া নিরব অশ্রু
যে শুধু তোমারই উদ্দেশ্যে। ”

-চলবে……….

#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_২২ (আহিল-কথার সাক্ষাৎ)||

কথার অবস্থা ভাবতেই আমার দিকে খারাপ লাগছে। আহিল ভাই কেন যে ওকে এতো এভয়েড করে চলতো? পাঁচ বছর আগে ভাই যখন গায়েব হয়ে গেল, আমরা ভেবেছিলাম সে আর কখনো ফিরে আসবে না। শুধু মাত্র কথা বাদে। কিন্তু এখন আমাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

—“কথা, আর ইউ ওকে?”

কথা মনে হয় কিছু ভাবছিল। আমার কথা শুনে হালকা কেঁপে ওঠে বললো,
—“আমি আসছি। আজই চিটাগাং থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিব আমি।”
বলেই ফোন কেটে দিলো কথা।

—“কার সাথে এতোক্ষণ ধরে কথা বলছো?”

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, জয় বিছানায় আরাম করে বসে আছে। আমি অবাক হয়ে বললাম,
—“আপনি?? এই অসময়ে বাসায় চলে এলেন?”

—“হ্যাঁ। কেন আসতে পারিনা বুঝি?”

—“পারেন। তবে আমি কবে থেকে অফিসে জয়েন করছি?”

জয় বিরক্ত হয়ে বললো,
—“কী যে অদ্ভুত ব্যাপারে জেদ ধরো তুমি!! মেয়েদের আমি দেখি বাসায় বসে আরাম করে, খায়-দায়, সংসার করে, রূপচর্চা করে, আর তুমি এসবের কিছুই কর না, উল্টো চাকরি করার জন্য লাফাচ্ছো। ”

—“আমার ওসবে ইনট্রেস্ট নেই। আমি শুধু লাইফে অনেক শাইন করতে চাই। আমার স্বপ্নগুলো পুরন করতে চাই। ”

—“ওকে ওকে। কালকে চলো আমার সাথে। ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আর হ্যাঁ, আহিল আমায় ফোন দিয়ে বলেছিল, তোমার সাথে নাকি কী কথা আছে। আমার ফোনের কললিস্ট থেকে ওর নাম্বার নিয়ে ফোন দিও।”
______________

একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছি আমি আর আহিল ভাই। কালকে ফোন দেওয়ার পর আমায় আলাদাভাবে দেখা করতে বলেছে সে। আমি জানি কী ব্যাপারে কথা বলার জন্য ডেকেছে আমায়। আহিল ভাই তনিমার ব্যাপারে সবকিছু জানে, এটা ভাবলেই আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। তবে আমিও কম যাই না, সব ব্যবস্থা করেই এসেছি এটার মোড় ঘুরানোর জন্য। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সে এন্ট্রি নিল বলে।

—“তুই সবকিছু জেনেও জয়কে কেন বিয়ে করলি? আমি ভাবতে পারছি না যে, তুই কন্ট্র্যাক্টে বিয়ে করতে রাজী হয়েছিস!!”
আহিল একটা চাপা ক্রোধ থেকে দাঁতে দাঁত চেপে বললো কথা গুলো।

—“আমি আমার বাবা-মায়ের জন্য সব করতে পারি। তখনকার পরিস্থিতিতে কেউ আমায় এতো টাকা দিতো না। হয়তো এটাই আমার ভাগ্যে ছিল! নয়তো যাদের কাছ থেকে টাকা পাওয়ার কথা ছিল, তাদের কাউকেই আমি তখন পাশে পাইনি।”

—“তাই বলে একজন তোকে বিয়ের প্রস্তাব দিবে আর তুই রাজি হয়ে যাবি? একজন এজুকেটেড মেয়ে হয়ে এসব সিদ্ধান্ত কীভাবে নিতে পারিস?”

—“তুমি কি এসব কথা বলার জন্য আমায় এখানে ডেকেছো?”

আহিল নিজেকে একটু শান্ত করে বললো,
—“না, আমি তোকে একটা প্রস্তাব দেওয়ার জন্য ডেকেছি।”

আমি ভ্রকুটি কুঞ্চিত করে বললাম,
—“প্রস্তাব!! কিসের প্রস্তাব??”

—“এটাই যে তুই জয়কে ডিভোর্স দিয়ে দিবি।”

আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে বললাম,
—“হোয়াট!! আমি জয়কে ডিভোর্স দিবো? ”

—“কখনোই না। একজন মানুষের কথা শুনে তুই কেন নিজের ভালোবাসার মানুষকে ডিভোর্স দিবি?”
কোনো মেয়েলি কন্ঠ শুনে আমি আর আহিল ভাই হকচকিয়ে গিয়ে আওয়াজের উৎসের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, কথা হাতে হাত গুঁজে আহিল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আজ চার বছর পর কথাকে দেখছি আমি আর আহিল ভাই পাঁচ বছর পর। এ কয়দিনে একজন মানুষ এতোটাও পরিবর্তন হতে পারে আদৌ! কথা আগে সবসময় নরমাল থ্রি-পিস পরতো। আর আজ তাকে সাদা শাড়ি, ব্ল্যাক স্যুট আর সাদা হিজাব পরা অবস্থায় দেখে চেনার উপায় নেই যে, এটা আমাদের কথা।

আহিল ভাইয়ের মুখে প্রথম দিকে অবাকতা দেখতে পেলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই তা ক্ষোভে রূপ নিলো। থমথমে গলায় বললো,
—“আমি যার সাথে কথা বলছি, তার কাছ থেকেই উত্তর আশা করছি। কোনো থার্ড পারসনের কাছ থেকে না।”

কথা চেয়ার টেনে বসে বললো,
—“নিজের অবস্থান টা একবার বিবেচনা করে নাও। তুমিও তো ফিহু এবং জয়ের মাঝে থার্ড পারসন হিসেবে নাক গলাচ্ছ।”

আহিল হালকা চেঁচিয়ে বললো,
—“কী বলতে চাইছিস তুই, কথা?”

কথা ডোন্ট কেয়ার মুড নিয়ে বললো,
—“লাইফটা ওদের এবং সম্পর্কটাও একান্তই ওদের নিজেদের। ওরা ডিভোর্স নিবে, নাকি নিজেদের মাঝে সবকিছুতে ঠিক করে নিবে, সেটা ডিসাইড করার অধিকার একমাত্র ওদেরই। সবাই তো আর তোমার মতো না যে, মানুষের ভালোবাসার মর্ম বুঝবে না।”

আহিল নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বললো,
—“কথা, তুই কিন্তু বাড়াবাড়ি করছিস! আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিস না। এই পাবলিক প্লেসে আমি আপাতত কোনো সিনক্রিয়েট করতে চাচ্ছি না।”

কথা আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
—“বোনু, তুই,,,, ”
আমায় চোখ দিয়ে ইশারা করতেই আমি উঠে দাঁড়িয়ে আহিল ভাইকে কী বলার সুযোগ না দিয়েই সেখান থেকে চলে এলাম এবং কথার গাড়িতে গিয়ে বসলাম। এমনি কথার কথা গুলো সব আমার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছিলো। আগে ও আহিল ভাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারতো না, আর আজ কী সুন্দর পটর পটর করে জবাব দিচ্ছে।

—“ফিহু কেন চলে গেল এখান থেকে? আমি এখানে ওর সাথে কথা বলতে এসেছি, তোর সাথে না।”

কথা একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
—“জানি আহিল, আমি বেশ ভালো ভাবেই জানি সবকিছু। ”

আহিল ভ্রু কুঁচকে বললো,
—“আমি তোর থেকে বয়সে অনেক বড়। আর আমাকে তুই নাম ধরে ডাকছিস। তুই নিজেকে অনেক পরিবর্তন করেছিস, অনেক বড় বিজনেস টাইকুন হয়েছিস, তাই বলে আদবকায়দা কি সব জলাঞ্জলি দিয়ে দিলি নাকি?”

—“তো কি ভেবেছিলে? সারাজীবন শুধু তোমার অবহেলা গুলো সহ্য করে যাবো? ভালোবাসার মানুষ শুধু ভালোবাসার মানুষই হয়, কোনো ভাই না।”

—“তোর এসব ফাউল কথা আজও বাদ দিতে পারিসনি। তোকে বলেছিলাম, আমায় ভালোবাসতে? যত্তসব!! ”

বলেই আহিল বসা থেকে উঠে যেতে লাগলো। এমন সময় কথা বলে উঠলো,
—“ফিহুকে আজো অনেক ভালোবাসো, তাই না?”

আহিল অবাক চোখে তাকিয়ে আবার বসে পড়ে বললো,
—“মানে??”

কথা মুচকি হেসে বললো,
—“আমি জানি, তুমি সারাজীবন ফিহুকেই ভালোবেসে গেছো। আজও ওকে চাও তুমি। ”

আহিল চকিত চোখে তাকিয়ে বললো,
—“তুই কী করে জানলি? আমি আজ পর্যন্ত কাউকে কিছুই বলিনি।”

কথা ছলছল চোখে অন্য দিকে তাকিয়ে বললো,
—“মন থেকে ভালোবাসি তোমায়। তাই তোমার মনের কথা বুঝতে আমায় বেগ পেতে হয় না। তোমার চোখের ভাষা পড়ার ক্ষমতা আমার অনেক আগে থেকেই আছে। কিন্তু আফসোস! তুমি বুঝলে না।”

আহিলের এবার কথাকে বড্ড অদ্ভুত লাগছে। এই মেয়েটা কীভাবে তার মনের কথা বুঝে গেল? কানে শুধু বারবার একটা কথাই বাজছে, ‘আফসোস, তুমি বুঝলে না। ‘

—“আজও তুই আমার কাছে ভালোবাসার দাবি নিয়ে আসিস। তোকে তো আমি জীবনে কম অবহেলা আর কষ্ট দেইনি! তাও কী করে তুই আমার কাছেই ঘুরে ঘুরে আসিস? আমার প্রতি কি তোর একটুও ঘৃণা হয় না?”

নিজের অশ্রুসিক্ত চোখেই হেসে আহিলের দিকে তাকালো কথা।
—“তোমায় ভালোবাসি আমি, আহিল। তুমি নামক মানুষটার প্রতি শুধু আমার ভালোবাসাই কাজ করে। আর তুমি বলছো ঘৃণা করার কথা!! ভালোবাসার মানুষকে কখনো ঘৃণা করা যায় না। তোমাকে ঘৃণা করার আগে যেন আমার মৃত্যু হয়! আমার অনুভূতি গুলো তুমি কখনো বুঝোনি। আর বুঝবেও না। এই পাঁচ বছর তোমায় না দেখে আমার অবস্থা কী হয়েছিল তা তোমার পরিবারের কাছ থেকেই না হয় জেনে নিও!”

আহিল মাথা নিচু করে বললো,
—“আমি আমার কাজের জন্যই এতোদিন পরিবার থেকে দূরে ছিলাম যাতে তাদের কোনো ক্ষতি না হয়।”

কথা সামনের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—“একটা কথা বলবো, রাখবে? চিন্তা করো না, আমি নিজের জন্য কিছু চাইবো না।”

আহিল কথার দিকে তাকিয়ে বললো,
—“আমি জানি, তুই কখনো আমায় তোকে ভালোবাসতে বলবি না। বল কী কথা? পারলে রাখার চেষ্টা করবো। ”

কথা আহিলের কথা শুনে মুখে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বললো,
—“ব্যাস এটাই যে, তুমি এখন আর জয়-মুনের মাঝখানে যেও না। ফিহু সারাজীবন অনেক স্ট্রাগল করেছি। এখন ও একটু সুখে আছে তাই ওর সুখটা নষ্ট করে দিও না। ফিহু সারাজীবন তোমায় নিজের ভাইয়ের মতো ভালোবেসেছে। এতে তুমি কোনো দিন সুখী হতে পারবে না। তোমার নিজের জন্য একসাথে তিন তিনটা জীবন নষ্ট করো না। এখন তুমি কোনো ভাবে ওকে নিজের করতে চাইলে ও তোমায় ঘৃণা করা শুরু করবে। ওর কাছ থেকে তুমি তখন শুধু অবহেলা পাবে। আর ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে পাওয়া অবহেলার স্বাদ আমি বেশ ভালো ভাবেই জানি । তুমি সেটা কোনোদিন সহ্য করতে পারবে না।”

কথা উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
—“এই কথাগুলো জানানোর জন্যই আমার এখানে আসা। আশা করি, তুমি বুঝবে। আর পাচ বছর পর তোমায় একটু দেখার জন্য তৃষ্ণার্ত মনটা অনেক জ্বালাচ্ছিল। ভালো থেকো।”

বলেই দ্রুত পা চালিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলো কথা।
একবারো পেছন ফিরে তাকায়নি সে। তাকিয়ে আর কী হবে? ভেবেছিল আজ অন্তত আহিল তার সাথে একটু ভালো ব্যবহার করবে। আগের মতো দূর দূর করবে না। কিন্তু না, এই পাচ বছরে সে একটুও চেঞ্জ হয়নি। তাই আর নিজেকে আটকাবে না সে। সময় এসেছে নিজেকে ফোর্স করার।

-চলবে……….