নীল সীমানার শেষপ্রান্তে পর্ব-২৮+২৯

0
6625

#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_২৮||

নিজের মায়ের দিকে অনেকক্ষণ ধরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার গতিবিধি বোঝার চেষ্টা করছে আহিল। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হচ্ছে সে।

—“তুমি আজ রান্না করছো কেন? আমি কথার বিয়েতে যাবো না বলে তুমিও কি যাবে না নাকি?”

আহিলের মা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,
—“যখন বিয়েই হচ্ছে না, তখন গিয়ে কী লাভ?”

আহিল হতচকিত হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
—“হোয়াটটট? বিয়ে হবে না মানে?”

—“এতো মানে টানে তো জানি না! শুধু এটাই শুনেছি, কাল কথা এই বিয়ে করতে পারবে না বলেছে।”
_________

কালকে থেকে কথাকে কতগুলো কল যে দিলাম, তার কোনো হিসেব নেই। কিন্তু এই মেয়ে মনে হয় কসম দিয়েছে, আমার কোনো দরকারি ফোন সে ধরবে না। ও আবার কেন বিয়েটা ভেঙে দিলো, সেটাই মাথায় ঢুকছে না। তার ওপর এখন বাড়ি থেকেও উধাও! কথাকে কল দিতে জয়কে বললাম,
—“আচ্ছা, কথা তো নিজের ইচ্ছায়ই বিয়েটাতে রাজী হয়েছিল। তাহলে কী এমন হলো যে,,,,,”

জয় একটা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
—“ফোনে পেয়েছো মেয়েটাকে? কোথায় যে গেল? সবদোষ ঐ আহিলের! ওকে তো এখন আমার মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে। ”

—“ফোন ধরছে না। বারবার শুধু রিং হয়ে কেটে যাচ্ছে। কথা নাকি কারো ফোনই তুলছে না! আপনি একটু ওর লোকেশন ট্রেস করে দেখুন না।”

—“আচ্ছা, দেখছি। তুমি একটু শান্ত হয়ে বসো।”

জয় কিছুক্ষণ গুগলে কথার মোবাইল নাম্বারের লোকেশন ঘেটেঘুটে দেখে অবাক হয়ে বললো,
—“মুন, কথা এয়ারপোর্টে কী করছে?”

কথা এয়ারপোর্টে আছে! আমার সব বোঝা শেষ। জয়কে তাড়া দিয়ে বললাম,
—“চলুন, জয়। আমাদের এখনই এয়ারপোর্টে যাওয়া উচিত। তাড়াতাড়ি চলুন। ”

এমন সময়ই আমার ফোনে কল এলো। আমি ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলাম, আহিল ভাই কল দিয়েছে।

জয় আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো
—“কে ফোন দিয়েছে?”

—“আহিল ভাই। ”

—“ওকে, তুমি কথা বলে এসো। আমি গাড়ি বের করছি।”
বলেই জয় চলে গেল।

আমি ফোন রিসিভ করে বললাম,
—“কেন ফোন দিয়েছো আমায়?”

আহিল এমন প্রশ্ন শুনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। আজ নিজেকেই নিজের কাছে অপরাধী মনে হচ্ছে তার। একটা মানুষ তাকে এমন নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসে গেছে আর সে শুধু বোকামি করে তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। এখনো একটা ভ্রমের পেছনে ছুটে নিজের জীবনটাকে নষ্ট করছে, সাথে কথারও। এবার তাকে নিজের জীবনটাকে গুছাতে হবে, আর তার জন্য কথাকে চাই।
আহিল নিজের চোখের পানি গুলো মুছে বললো,
—“কথা কোথায়? কী হয়েছে ওর?”

—“সেটা জেনে তুমি কী করবে? তোমার তো আর এব্যাপারে কোনো কিছু যায়-আসে না।”

—“সেটা বলে তোর আমায় আর খোঁচা না মারলেও চলবে। এসব পিনমূলক কথা বাদ দিয়ে আমার প্রশ্নের উত্তর দে, ফাস্ট!!”

—“এয়ারপোর্টে আছে। ”

—“ওকে ”
বলেই ফোন কেটে দিয়ে বেড়িয়ে গেল আহিল। যতো তাড়াতাড়ি এয়ারপোর্টে পৌঁছাবে, ততোই বেটার।

আহিল একহাত দিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করছে আর অন্য হাত দিয়ে চোখের পানি মুছছে। চোখে জমে থাকা নোনাজল গুলো আজ বড্ড বেশি বেপরোয়া হয়ে গেছে। সেই পুরোনো মুহূর্ত গুলো শুধু বারবার স্মৃতিতে হানা দিচ্ছে।

কথা যখন আহিলকে খাবারের জন্য ডাকতে আসতো, তখন আহিল বলতো,
—“তোকে আসতে কে বলেছে? আমার খিদে মিটে গেছে। যা এখন।”
বলেই মুখের ওপর ধাম করে দরজা লাগিয়ে দিতো।

আহিলের মনে আজ একটাই প্রার্থনা, কথা যেন আজ আর দূরে চলে না যায়।
___________

এয়ারপোর্টে বসে বসে নিজের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলোর হিসেব মেলাচ্ছে কথা।

কাল রাতে,,,,
কথার ফোনে একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসে। কথা ফোন রিসিভ করভ করতেই ওপাশ থেকে পুরুষালি কণ্ঠ স্বর ভেসে এলো।

—“হ্যালো, আপনি কি মিস আনিলা রাহমান কথা বলছেন?”

—“ইয়েস। আপনি কে?”

ওপাশ থেকে হালকা হাসি মিশ্রিত স্বরে ছেলেটি বলে উঠলো,
—“আমি আদি । আশা করি, চিনতে পেরেছেন।”

কথা নামটা শোনার পর কিছুক্ষণ চুপ হয়ে গেলো। এই আদির সাথেই ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে।

—“জ্বী, চিনতে পেরেছি। আজ হঠাৎ আপনি আমায় কল করলেন যে! কিছু কি বলার আছে? ”

—“বলার তো অনেক কিছু আছে। একটা নতুন সম্পর্কের সূত্রপাত যখন ঘটতে যাচ্ছে, তখন আমাদের একে অপরের সাথে পরিচয় তো হওয়াই উচিত। ”

কথা ঠিকই বুঝতে পারছে, আদি ওকে ঠিক কী বুঝাতে চাইছে। তাই নিজেই সবকিছু খোলাসা করার প্রেক্ষিতে বললো,
—“আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য, যেটা আপনাকে আমার জানানো উচিত, সেটা হলো, আমার ভালোবাসার মানুষ অন্য কেউ এবং একমাত্র সেই। ”

আদি হালকা একটা শক খেলেও আবার হেসে বললো,
—“তাহলে তাকেই বিয়ে করুন। যাকে ভালোবাসেন, তাকে বিয়ে না করে অন্য একজনকে বিয়ে করছেন। রিডেলটা ঠিক মিলছে না মিস।”

কথা হালকা হেসে বললো,
—“যাকে ভালোবাসি, সে যদি আমায় না চায় তাহলে আমার কী করার আছে বলতে পারেন? কোনোদিক থেকেই কম চেষ্টা করিনি আমি। কিন্তু তবুও কিছু থেকে কিছু হয়নি। আমার আজ কোনো আক্ষেপও নেই। হয়তো সবাই সবকিছুর জন্য পৃথিবীতে আসেনা আর আমিও সেই শ্রেণীভুক্ত একজন।”

আদি নিজের গলাটা খানিকটা ভিজিয়ে বললো,
—“আপনার লজিকটাকে আমি সাপোর্ট করি। কিন্তু দেখুন, মানুষের সাইকোলজিক্যাল স্যাটিসফ্যাকশন বলেও একটা ব্যাপার স্যাপার আছে। আপনি যেই ব্যক্তির কথা বলছেন, তার প্রতি আপনাার ফিলিংস ঠিক কতটুকু?”

—“আমার সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে শুধু তার বসবাস। ওকে ছাড়া আমি অন্য কাউকে নিয়ে কিছু ভাবতেই পারবো না।”

—“তাহলে!! নিজের ওপর জোরাজুরি করে একটা ডিসিশন নিলেই তো আর হলো না। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একবার দূরদৃষ্টি দিয়ে দেখুন। তবে, ভাববেন না, আমি আপনাকে বিয়ে করবো না বলে এসব বলছি। এমনি আজ আপনার সাথে কথা বলতে মন চাওয়ায় কল দিলাম। এখন সবকিছু শোনার পরও আমার কোনো আপত্তি নেই। আপনার মতো মানুষকে যে পেয়েও হারিয়ে ফেলছে, তাকে আজ দেখতে ইচ্ছে করছে অনেক। আপনার কনফেশন শুনেই আমি বুঝে গেছি, আপনি অসাধারণের থেকেও বেশওলি কিছু। আর এটাও বুঝেছি, আপনার মনে আমার জন্য কোনোদিন জায়গা তৈরি হবে না। ”

কথার এবার ভাবান্তর ঘটলো। সত্যিই তো! সে যাকে কখনো ভালোবাসতে পারবে না, তাকেই সে এখন বিয়ে করে তার জীবনটা ধ্বংস করে দেবে কীভাবে? না, এটা অসম্ভব।

—“সরি মি. আদি। আমি আপনাকে বিয়ে করছি না। আমার সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল।”

আদি মুচকি হেসে বললো,
—“আমি এটাও জানতাম যে, আপনি এক্ষুনি নিজের সিদ্ধান্ত চেঞ্জ করে ফেলবেন। আপনার মতো এমন সবদিক থেকে পারফেক্ট একটা মেয়েকে কেউ কীভাবে রিজেক্ট করে, সেটাই আমার বুঝে আসলো না!’

—“আসলে ওর আমাকে সহ্যই হয় না। আমি ওর দুচোখের বিষের মতো। যাইহোক, আপনি কি নিজের পরিবারকে বলতে পারবেন নাকি আমিই ক্যান্সেল করে দিবো।”

—“দরকার নেই ক্যান্সেল করার। বিয়ে ভেঙে দিলে কী করবেন আপনি?”

কথা কাঠকাঠ গলায় বললো,
—“এ বিয়ে আমি করতে পারবো না। আর আমার করণীয় নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না। আমি এখান থেকেই খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি আপনার বাসায়।”

এরপরই বাবা-মাকে বলে বিয়ে ভেঙে দেয় এবং ইউকে এর টিকেট বুক করে কাউকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে কথা।

ভাবতে ভাবতেই কথার ফ্লাইটের টাইম হয়ে গেছে। কথা নিজের লাগেজ নিয়ে ইমিগ্রেশনের ভেতরে চলে গেল। আরো আধঘন্টা পর প্লেন টেক-অফ করবে। কথা নিজের লাগেজ বেল্টে ছেড়ে দিয়ে প্লেনে উঠতে চলে চলে গেল। এতোক্ষণ একটুও না কাদলেও এখন চোখ দিয়ে শুধু পানি পড়ছে। সে আর এদেশে আসবে না, বাবা-মা এর সাথে দেখা হবেনা, আহিলকে আর কখনো দেখতে পাবে না। তবুও সে এই দেশ ছেড়ে চলে যাবে।
__________

এদিকে আহিল ইমিগ্রেশনে গিয়ে কথার ফ্লাইটের সব ডিটেইলস শুনে দেখলো প্লেন টেক-অফ করতে আর মাত্র পনের মিনিট বাকি। আহিল আর দেরী না করে দৌড়ে ভেতরে চলে যায়। আহিলের পরিচয় শুনে কেউ তাকে আটকাতে পারেনি। আহিল গিয়ে দেখে সব যাত্রী প্লেনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে সাদা শাড়ি পরিহিতা একজনের চলনবলন দেখে আহিল বুঝে গেছে যে, ঐটাই কথা। কথাকে দেখার সাথে সাথে আহিল ছুট লাগালো।

আহিল ছুটে গিয়ে কথার হাত ধরে ফেললো। হঠাৎ হাতে টান লাগায় কথা ভ্রু কুঁচকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। চোখের সামনে উপস্থিত ব্যক্তিটাকে দেখে কথা পুরো বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। ঠোঁট অনবরত কাঁপছে, কিন্তু কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না।

এদিকে আহিল ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেছে। তার ওপর রাগে চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। কথার হাতের কব্জি মুচড়ে ধরে টেনে নিয়ে বেরিয়ে এলো আহিল।
কথা এখনো শকের মধ্যে আছে। কী থেকে কী হচ্ছে, কিছু বুঝতে পারছে না।

আহিল একটু আড়ালে গিয়ে কথাকে দেয়ালের সাথে ঠেসে ওর চোয়াল চেপে ধরে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বললো,
—“কোথায় যাচ্ছিলি? কাউকে কিছু না জানিয়ে কই উধাও হয়ে যাচ্ছিলি তুই। তোর সাহস কী করে হলো এভাবে বিদেশে যাওয়ার?”

কথা ব্যথা কুঁকড়ে উঠে বললো,
—“আআমি যেখানে ইচ্ছে, সেখানে যাবো। তাতে তোমার কী? এখানে কেন এসেছো তুমি? তুমি তোমার জীবন নিয়ে থাকো। আমার তো আর কোনো ভ্যালু নেই, তাই না?”

আহিল একথা শুনে কথাকে নিজের বুকের মধ্যে ঝাপটে ধরলো। এমন আকস্মিক ঘটনায় কথা বেশ অবাক হলেও একটা অন্য রকমের ভালোলাগা কাজ করছে ভেতরে ভেতরে।

আহিল কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—“আমায় মাফ করে দে, কথা। জানি আমি তোর সাথে অনেক অন্যায় করেছি। যার কোনো মাফ হয় না। কিন্তু আমারই বা কী করার ছিল বল? ফিহুকে সেই ছোট থেকেই ভালোবাসতাম আমি। ওর জায়গায় অন্য কাউকে বসানোর কথা কখনো ভাবিনি। তবুও তুই আমায় নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসে গেছিস।”

কথা আহিলের মুখের দিকে তাকিয়ে ওর চোখ মুছে দিয়ে বললো,
—“এই কাঁদছো কেন তুমি? তুমি জানো না, তুমি কাঁদলে আমার কষ্ট হয়?”

আহিল প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—“কেন?”

কথা মুচকি হেসে বললো,
—“তোমায় ভালোবাসি বলে।”

—“তোর পবিত্র ভালোবাসার যথাযথ সম্মান দিবো আমি। আর কষ্ট পেতে দিবো না।”

—“আমরাও অনেকক্ষণ ধরে কষ্ট করে দাড়িয়ে দাড়িয়ে তোদের কাহিনী দেখছি। এবার আমাদেরও একটা ব্যবস্থা কর ভাই। পা তো আর পায়ের জায়গায় নেই।”

আহিল আর কথা পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো আমি আর জয় দাড়িয়ে আছি।

-চলবে…….

#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_২৯(বিবাহ রম্য)||

আমি ধুপধাপ পা ফেলে কথাকে আহিল ভাইয়ের কাছ থেকে একটানে ছাড়িয়ে নিয়ে দূরে সরে গেলাম। জয়, কথা আর আহিল ভাই যে মারাত্মক ভাবে অবাক হয়েছে , তা আমি ভালো করেই জানি। আহিল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,
—“তুমি এই মেয়েটাকে এতো কষ্ট দেওয়ার পর ভাবলে কীভাবে যে, ওকে তোমার সাথে বিয়ে হতে দিবো?”

আমার কথা শোনার সাথে সাথে আহিল ভাই নিজের অক্ষিগোলক ইয়া বড় বড় করে ফেললো। বলে কি এই মেয়ে! কথা কিছু বলতে যাবে, তার আগেই আহিল বললো,
—“কী যা তা বলছিস তুই? তুই আমাদের বিয়ে হতে দিবি না?”

আমি খানিকটা ভাব নিয়ে বললাম,
—“অবশ্যই দিব না। কথাকে আজ থেকে আমাদের বাড়িতে আটকে রাখবো। সামনের সপ্তাহে আদি ভাইয়ার সাথে বিয়ে দিয়ে দিবো। আদি ভাইয়া কথাকে তোমার থেকেও বেশি ভালো রাখবো।”

বলেই কথার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে আসলাম। এদিকে আহিল বিরহী নয়নে কথার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।
—“আহা রে, বেচারা! এতো কষ্ট করে পেয়েও হারিয়ে ফেললি! এতো দুঃখ কই রাখবি রে, ভাই? ”

জয়ের খোঁচা মারা কথা শুনে আহিল ওর দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
—“খুব মজা লাগছে না তোর? ইয়ার্কি মারছিস আমার সাথে?”

—“আমি কেন মজা করতে যাবো? আমি তো তোর ফুল সাপোর্টে আছি।”

আহিল কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
—“লাগবে না তোর সাপোর্ট। হেল্প করতে গিয়ে আমার লাইনে ব্যান্ড বাজিয়ে দিবি তুই। যা করার আমিই করছি। এগুলো আমার পাওনা ছিল। ”

বলেই গটগট করে হেঁটে চলে গেলো আহিল।
___________

—“মা, ও মা, কোথায় তুমি? বাড়িতে কি আছো নাকি? ”

ছেলের চিৎকার শুনে আনিয়া ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললো,
—“কী হয়েছে? এই অসময়ে সারা বাড়ি মাথায় তুলেছিস কেন?”

আহিল তার মায়ের সামনে গিয়ে বললো,
—“মাথায় তোলার মতো ঘটনা ঘটেছে তাই! আমি আজ কতো কষ্ট করে কথাকে বিদেশে যাওয়া থেকে আটকেছি, জানো? তবুও,,,,, ”

আনিয়া আহিলের কথার মাঝেই হতচকিত স্বরে বললো,
—“কী বললি? কথা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছিলো? ”

এমন কথায় আহিল আরো বিরক্ত হলো। এমনি আছে এক টেনশনে, তারওপর মায়ের যেন প্রশ্নের ঝুলি খুলে যাচ্ছে বারেবারে। বিরক্তি মাখা গলায় বললো,
—“উফ, তোমার কী মনে হয় আমি মিথ্যা বলছি? বললে বলছি। কিন্তু কথা সেটা না। কথা হচ্ছে , ফিহু কথাকে নিয়ে চলে গেছে। শুধু চলে গিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, আমায় বলে গেছে যে, কথার সাথে নাকি আমার বিয়ে হতে দিবে না। তুমিই বলো মা, এটা কোনো কথা হলো?”

আহিলের কথায় আনিয়ার প্রচুর হাসি পাচ্ছে। কিন্তু না পারছে হাসতে, আর না পারছে হাসি আটকাতে!

আহিল আবারো মাকে তাড়া দিয়ে বললো,
—“মা, কিছু তো বলবে নাকি? আমি এখন কী করবো? যদি সত্যি সত্যি কথার বিয়ে অন্য কারো সাথে হয়ে যায়? ”

আনিয়ার কাছে ছেলের এমন ভীতিটা বেশ ভাল্লাগছে। এমনটাই তো চাইতো সে! স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,
—“যখন মেয়েটাকে এতো কষ্ট দিতি, তখন তাকে হারানোর ভয় তো ছিল না! আজ যখন ওকে নিয়ে তোর এতো ভয়, তখন ওকে তোর জীবনের সাথে বাঁধার সব ব্যবস্থা তোর নিজেকেই করতে হবে।”
বলেই আনিয়া চলে গেল।

আহিল কতক্ষণ ঘরের ভেতর পায়চারি করে কথাকে ফোন দিলো। দু বার রিং হতেই ওপাশ থেকে কথা ফোন রিসিভ করে বললো,
—“হ্যালো, আহিল ভাই!! ”

আহিল ক্ষেপে গিয়ে বললো,
—“কে তোর ভাই? সেদিন তো কতো চ্যাটাং চ্যাটাং করে নাম ধরে ডাকছিলি, আর আজ ভাই হয়ে গেলাম।

কথা খানিকটা ভাব নিয়ে বললো,
—“তখনকার কথা বাদ দাও। তুমি আমার থেকে বয়সে কতো বড়ো! তার ওপর তোমাকে যদি এখন আমি নাম ধরে ডাকি, তাহলে দুদিন পর যার সাথে আমার বিয়ে হবে, সে কী ভাববে বলো তো!”

—“মজা করছিস আমার সাথে? দেখ আমি এখন ফানি মুডে নেই।”

—“আমি কেন তোমার সাথে মজা করতে যাবো? আমি তো সত্যি বলছি!”

—“তুমি কেমন, তা আমার বেশ ভালোভাবেই জানা আছে। তোমার এতো ভাব নেওয়া কথা শুনে তুমি সত্যি বলছো, না মিথ্যা, তা আমি বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছি। এখন বল, কোথায় আছিস তুই?”

কথা নিজের মুখটা চুপসে নিয়ে বললো,
—“ফিহুদের বাড়িতে।”

—“তোকে ওখানে থাকতে হবে না। নিজের বাসায় চলে যা। আমি নিতে আসবো?”

—“নিজের বাসায় আমার জায়গা নাই। বাবা-মা বলে দিয়েছে, ফিহু যে সিদ্ধান্ত নিবে, সেটাই ফাইনাল। সামনের সপ্তাহেই আমার বিয়ে।”

—“হোয়াটটট!!!!”

—“হুম।”

—“আমি আজই আংকেল-আন্টির সাথে কথা বলছি। তারপর, এই ফিহুকে দেখছি। ওর জন্য কতো কিছুই না করলাম। আমাদের বিয়ের পর জয়েরও একটা বিয়ে দিয়ে দিবো। তখন বুঝবে মজা!”
বলেই ফোন কেটে দিল।

—“এহহহ!!! আইসেএএএ!! জয়কে বিয়ে দিবে বলে! আরে জয় কি তোমার মতো পাগল নাকি!”
ভীষণ রাগ লাগছে আহিল ভাইয়ের কথা শুনে। আমার সতীন আনার চিন্তা করছে! সাহস কতো দেখেছো?

কথা ভ্রু কুঁচকে বললো,
—“আহিলকে পাগল বললি কেন? আর ওকে এতো প্যারা কেন দিচ্ছিস সেটাও তো বলছিস না?”

—“ওহহ, তোমার অনেক কষ্ট লাগছে, না? আরো একটু সহ্য করে নেও। তারপর আজীবন শান্তিতে থাকতে পারবে। আমি যা করছি, তোমার আর আহিল ভাইয়ের সুখের জন্য করছি। আহিল ভাইয়েরও একটু কষ্ট করা দরকার। ”

—“সেটা তো বুঝলাম। কিন্তু তুই কী করতে চাইছিস?”

—“দেখবে দেখবে। ধীরে ধীরে সব দেখবে।”
বলেই রহস্যময় হাসি দিলাম।
_________

আহিল কাঁপা কাঁপা হাতে কথার বাবাকে ফোন দিলো। প্রথম বারে রিসিভ না হওয়ায় কিছুক্ষণ পর আবার দিলো। এবার কল রিসিভ করে ওপাশ থেকে আরমান রাহমান থমথমে গলায় বললেন,
—“হ্যালো, মিস্টার আরমান রাহমান বলছি। আপনি কে বলছেন?”

আহিল একটা শুকনো ঢোক গিলে বললো,
—“আসসালামু আলাইকুম, আংকেল। আমি ডিটেক্টিভ আহিল আহরার। আশা করি আমায় চিনতে পেরেছেন। ”

আরমান রাহমান সালামের উত্তর নিয়ে বললো,
—“চিনতে পারবো না কেন? তোমার জন্যই তো আমার মেয়েটা আমার কোনো কথাই শুনে না। কম কষ্ট তো দেওনি আমার নিষ্পাপ মেয়েটাকে। এখন বলো, কেন ফোন দিলে আজ।”

আহিল নিজের চোখ খিঁচে বন্ধ করে বললো,
—“আপনি যদি চান, তাহলে আমি কথাকে বিয়ে করতে চাই। আমি ওকে যতো কষ্ট দিয়েছি, সব গুলোকে সুখে পরিঙত করবো, কথা দিলাম। আর আপনি ভালো করেই জানেন, কথা আমি ছাড়া আর কারো সাথে সুখী হবে না।”

একদমে কথাগুলো বলে দম ছাড়লো আহিল। ফোনের অপরপ্রান্তে পিনপতন নীরবতা। হঠাৎ নীরবতার প্রহরে ইতি টেনে আরমান রাহমান বললো,
—“আচ্ছা, আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে একটা শর্ত আছে। ”

—“সব শর্ত মানতে রাজী। আপনি বলুুন।”

—“না, এখন বলবো না। সেটা বিয়ের দিন তোমায় পুরন করতে হবে। এখন পুরো দমে প্রস্তুতি শুরু করে দাও। সময় বেশী বাকী নেই। ”

আহিল কিছুটা অবাক হলো। এতো সহজেই রাজী হয়ে গেল। আবার শর্তের কথাও বললো। কী আছে কপালে উপর ওয়ালাই জানে!
___________

বিয়ের দিন,,,,
আহিলের মাথায় যেন বড়সড় একটা বাজ পড়লো। তার মানে এটাই ছিল, এতো দিনের প্রতিশোধ। সবকিছু মুন করিয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। জয়, রাদিফ আর অর্ণব পাশ থেকে কিটকিটিয়ে হেসেই চলেছে।

আমি তাড়া দিয়ে বললাম,
—“কী হলো, কথা সেই কখন থেকে দাড়িয়ে আছে। ওকে কোলে তোলো, আর দোতলায় গিয়ে পুরো বারান্দা দশবার রাউন্ড দাও।”

আহিল দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—“তোর মাথা ঠিক আছে। এই প্রাসাদের মতো কমিউনিটি সেন্টারের দোতলার বারান্দা পুরোটা না হলেও দুই কিলোমিটার হবে। আমি একজন মানুষকে কোলে নিয়ে কীভাবে ঘুরবো? তার ওপর ওর শাড়ি আর গহনাই তো ওর ওজন দশ কেজি বাড়িয়ে দিয়েছে মনে হয়।”

—“ওতো শতো বুঝি না। শর্ত মানলে মানবা, না মানলে বিয়ে হবে না।”

অগত্যা আহিলকে শর্ত পুরন করতেই হলো।
—“অনেক কষ্ট হচ্ছে তোমার,তাই না? আমি এসব করতে না করেছিলাম।”

কথার এমন কথা শুনে আহিল মলিন হেসে বললো,
—“আরে বাদ দে। এগুলো সবই আমার প্রাপ্য ছিল। তোকে যে কষ্ট দিয়েছি, সে তুলনায় এটা কিছুই না। তবে আজ কেন জানি মনে হয়, শত কষ্টের মাঝেও, তোর মধ্যেই আমার সব সুখ। সত্যিই তোর ভালোবাসার অনেক জোর। মানতে হবে বস।”

বিয়ে শেষে আহিলকে ধরে ধরে গাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছে জয়। জয় টিটকারি দিয়ে বললো
—“আহারে, জীবনের একমাত্র বাসরটাও শান্তিতে করতে পারবি না রে, দোস্ত! ”

আহিল গাল ফুলিয়ে বললো,
—“আর বাসর, বেচে থাকলে কাল সকালে আমার কোমরের ডেলিভারি করতে হবে।”

-চলবে……….