#পুষ্প_কন্যার_প্রেম_পাবক
#পর্ব১০
#রাউফুন
তীর্থ পৌঁছে দেখলো বাড়িটা কেমন ফাঁকা লাগছে একদম। সবাই কোথায় গেলো? তার কপালে চিন্তার ভাজ! সে সব ঘরে উঁকি দিলো৷ শেষে জেঠি মায়ের ঘরে উঁকি দিতেই দেখলো, জেঠিমা শুয়ে নিঃশব্দে কাঁদছেন। সে আরও বিচলিত হলো৷ ব্যাগ ফেলে ছুটে রুমে গেলো! জোরে জোরে শ্বাস টেনে বললো, ‘জেঠিমা, ও জেঠিমা, এই অসময়ে শুয়ে আছো যে? কি হয়েছে? কাঁদছোই বা কেন?’
সুফিয়া, চোখ মেলে চাইলেন। চোখের কোণে এখনো পানি লেপ্টে আছে। তীর্থ দু হাতে জেঠিমায়ের অশ্রুসিক্ত চোখ সযত্নে মুছে দিলো। তীর্থকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন তিনি।
‘বাড়ির সবাই কয় জেঠিমা? ঋতু, ঝুমুর, জেঠা, তুষার ভাই! সবাই কোথায়?’
সুফিয়ার কান্নার বেগ বাড়লো। তিনি ক্রন্দনরত কন্ঠে আওড়ালেন,
‘তোর ঋতু আপা শশুর বাড়িতে চলে গেছেন। শাশুড়ী মায়ের অসুখ তো তাই। আর ঝুমুরের কিছু ভালো লাগছিলো না বলে ওর নানি বাড়িতে গেছে কদিন বেড়িয়ে আসবে তাই।’
‘তাই তুমি একলা ঘরে কাঁদছো? উঠো, উঠো! ঝুমুর ই বা কেমন হ্যাঁ? তোমায় একলা ফেলে চলে গেলো?’
‘ওঁ কি যেতে চাইছিলো নাকি? ওর মামা এসেছিলো। জোর করে নিয়ে গেলো যে। আমি তোর জেঠাকে একা রেখে যায় কি করে?’
‘আচ্ছা, আচ্ছা শান্ত, শান্ত! আর কাঁদে না আমার মা। লক্ষী জেঠিমা আমার! আমি আছি, আমি আছি না!’
অনেকটা ভরসা পেলেন সুফিয়া। তীর্থ ব্যাগ হাতে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলো,’খেয়েছো তুমি?’
সুফিয়া দু-দিকে মাথা নাড়লেন। যার অর্থ তিনি খান নি।
‘কি যে করো না, বসো, তোমার উঠতে হবে না। আমি খাবার নিয়ে আসছি!’
‘তুই তো সবেই এলি, আমি তোকে খাবার দিচ্ছি!’
‘লাগবে না, তুমি খাবে। মা ইয়া বড় নদীর বোয়াল মাছ রেঁধে পাঠিয়েছে তোমার জন্য! তোমার তো ভালো লাগে খুব তাই না?’
তীর্থ ব্যাগ থেকে বের করে টিফিন বক্স টা রাখলো। সুফিয়া উঠতে চাইলেও উঠতে দিলো না। ব্যাগ নিজের ঘরে রেখে এসে নিজেই ভাত বেড়ে আনলো৷ এনে সুফিয়াকে নিজের হাতে খাইয়ে দিতে লাগলো। সুফিয়া বারন করলেও শুনলো না। সুফিয়া আবেগ প্রবণ হয়ে তীর্থকে অগনিত স্নেহের চুমু এঁকে দিলেন।
বিকেলে জেঠো বাড়ি ফিরলে তীর্থর আর ভালো লাগছিলো না। বাড়িটা একদম শুন্য শুন্য লাগছে। খাঁ খাঁ করছে চারিদিকে। তীর্থ ঝুমুরের ঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখলো দরজা টা ভেজানো শুধু। সে না চাইতেও একবার ঘরে ঢুকলো। ঘরের আঁনাচে কাঁনাচে ঝুমুরের ছোঁয়া পেলো সে। পড়ার টেবিল, আলমারি, বিছানা টা সুন্দর করে পরিপাটি করে রাখা৷ আলমারি খুলে রাখা ছিলো। তাতে ঝুমুরের পোশাক নেই একটাও। কিন্তু অবাক হওয়ার বিষয় হলো, তার অব্যবহৃত সকল, টি-শার্ট, শার্ট, প্যান্ট, এমন কি লুঙ্গিও, সবশেষে পেলো তার আন্ডারওয়্যার। এটা দেখার পর সে হাসবে না কাঁদবে ভেবে পেলো না৷ তার ওমন শখের আন্ডার প্যান্ট এখানে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ইশ কি বিচ্ছিরি ব্যাপার স্যাপার! এসব দিয়ে ঝুমুর কি করে? এখানে কেন রেখেছে পাগলীটা! কেউ যেনো তক্ষুনি কানে কানে বললো, ‘ছিঃ তীর্থ, অন্যের আলমারি দেখতে নেই জানিস না? আর দেখলি, দেখলি, এখন বলছিস এগুলো এখানে কেন রেখেছে? ইশ কি গোবরে ঠাসা তোর মাথাটা! বিচ্ছিরি, একদম বিচ্ছিরি!’
তীর্থ হাসলো আনমনে। এরপর পড়ার টেবিলে বসে ঝুমুরের বই মেলে দেখতে লাগলো। ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলো সবটা। প্রতিটি জিনিস ছুয়ে দেখছিলো আর ঝুমুরকে অনুভব করছিলো বেশ গাঢ় ভাবে। শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কেমন শির-শিরানি অনুভব করছিলো ঝুমুরের কথা ভাবতেই। হঠাৎই এরকম অনুভূতির মানে কি? এর আগে তো এমন হয়নি তার। সে কি ঝুমুরকে খুব বেশি মিস করছে? ঐ যে একটা গান আছে না,
‘বাহির বলে, দূরে থাকুক..
ভেতরে বলে আসুক না,
ভেতর বলে, দূরে থাকুক
বাহির বলে আসুক না….!’
ঝুমুর দূরে আছে বলেই কি এতোটা বিচলিত হচ্ছে তার মন? এতোটা উচাটন করছে বুকটা। হঠাৎই তীর্থর বিবেকে বাঁধা দিলো। এভাবে কারোর অনুপস্থিতিতে তার ঘরে আসাটা ঠিক হয়নি। সে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পরলো বাড়ি থেকে। ঠিক করলো সে আর ঝুমুরকে ভাববে না কখনোই!
•
ক্লাবে খেলা হচ্ছে। তীর্থ গেলে তাকেও খেলায় নেওয়া হলো। ক্রিকেট খেলা বরাবরই তীর্থর খুবই পছন্দের। লিপন তার বিপরীত পক্ষের দল। সেদিনের পর থেকে তীর্থ ভেবেই নিয়েছে লিপন ভালো হয়ে গেছে। খেলার শেষে দিকে, তখন শেষ ওভার! তীর্থ স্ট্রাইকে ছিলো। শেষ ওভার বল করছে লিপন। সে ইচ্ছে করেই বল জোরে করছিলো। একবার বল গিয়ে তীর্থর মাথায় লাগলো। হঠাৎ বল মাথায় লাগাই টাল সামলাতে না পেরে নিচে পরে গেলো তীর্থ। হীরক আর মিলন এগিয়ে এসে তীর্থকে তুললো। বাকিরাও ততক্ষণে এসে গেছে। দুই দলের মধ্যে মুহূর্তের মধ্যে হট্টগোল লেগে গেলো। লিপন ক্ষোভের সহিত বললো, ‘এই তোরা, ব্যাটা তীর্থকে ধর৷ সেদিন আমাকে কত মে’রে’ছে। আজ তার শোধ তুলেই ছাড়বো!’
এই কথা শুনে মা’রামারির এক পর্যায়ে হঠাৎই তীর্থর মাথায় দপ করে আগুনের ফুলকির ন্যায় রাগ চেপে বসলো। দিক বেদিক না ভেবে হাতের ব্যাট টা ঠাস করে চাপিয়ে দিলো লিপনের মাথার কোণে। লিপন হতবিহ্বল হয়ে মাঠের মধ্যে পরে গেলো।
‘এই খু’ন করেছে রে। এই ধর, ধর।’
‘তীর্থ পালা!’ বলল হীরক।
‘সর্বনাশ করলি রে, যদি থানা পুলিশ হয় তখন?’
মিলনের কথা শুনেও তীর্থ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। হীরক আর মিলন তাকে ঠেলেও সরাতে পারলো না৷
লিপনের মাথা র’ক্তা’ক্ত! হাতের ব্যাটের দিকে আলগোছে তাকালো তীর্থ। ব্যাটে কিঞ্চিৎ র’ক্ত লেগেছে। সে ব্যাট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেই চোখের সামনে থেকে লিপনকে ধরাধরি করে হসপিটালের দিকে নিয়ে গেলো। সবাই একে একে ওঁকে রেখে চলে গেলো। সে মাঠে সম্পুর্ন একা। তার মনে হলো, তার মাথাটা একদম খালি হয়ে গেছে। খাঁ খাঁ করা জনশূন্য এক বিশাল মাঠের সে দাঁড়িয়ে আছে অবাঞ্চিত একজন মানুষ! হঠাৎই মনে হলো, একটা নোংরা কেচো তার সারা শরীর বেয়ে উঠছে। তার মনে হলো, এই ব্রহ্মান্ডে সে ছাড়া আর কেউই নেই৷ মিলন আর হীরক তো বলেই খালাস, এখান থেকে সটকে পরেছে।
তীর্থ আনমনে হেঁটে চলে গেলো ব্যাট খানা ফেলে৷ রাস্তায় ধারে হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়িয়ে পরলো তীর্থ। সামনেই পুলিশের জীপ। এখানে পুলিশ কেন? সারা শরীরের লোমকূপ দাঁড়িয়ে শিরশির করে উঠলো। সে ভেতরে ভেতরে ভয় পেলেও শিনা চওড়া করে পুলিশের জীপকে ছাড়িয়ে চলে গেলো। যেনো ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো তার। হাফ ছেড়ে বাঁচলো সে। যেতে যেতে হুট করেই ছুটে এলো হীরক আর মিলন। মিলন হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
‘তীর্থ, লিপণের তো রক্ত পরা কোনো ভাবেই বন্ধ হচ্ছে না। আমি আর হীরক গেছিলাম দেখতে, অবস্থা বেগতিক।’
‘ হ্যাঁ রে তীর্থ, যে ভাবে রক্ত পরছে, মনে হচ্ছে বাঁঁচবে না লিপনটা!’
তীর্থ আরও ভয় পেলো ওঁদের কথায়। সে ওঁদের পাশ কাটিয়ে চলে আসছিলো। হঠাৎই আবার সামনে এসে দাঁড়ালো হীরক। বিস্ময়ের সঙ্গে বলল,
‘তোর জেঠুদের বাড়ির সামনে পুলিশের জীপ দেখলাম জানিস? আসার সময় দেখলাম তোর জেঠো গল্প করছে। লিপনের বাবা-মা আবার পুলিশ কেস করে নি তো?’
টনক নড়লো তীর্থর। সে আনমনে বলল, ‘এখন কি করবো আমি?’
‘পালিয়ে যা!’ বললো মিলন।
‘পালাবো কেন?’
‘না পালালে পুলিশ ধরবে তোকে!’
ওঁরা চলে গেলো। তীর্থ গুঁটি গুঁটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো। কি যেনো ভেবে পাশের ঘন জঙ্গলের আর্কীনের পাশ দিয়ে ঝম্পন করে লাফিয়ে দৌঁড় দিলো।
তার মাথা ঝিমঝিম করছে৷ অনুতাপের বেড়াজালে আবিষ্ট হচ্ছে সে। কেন এমন হঠাৎই রাগের মাথার আঘাত করে বসলো লিপনকে। বার বার তার মস্তিষ্কে এসে নাড়া দিচ্ছিলো কিছু কথা, ‘এই খুন করেছে রে, ও মনে হয় বাঁচবেনা, র’ক্ত পরা বন্ধ হচ্ছে না। এসব ভাবছিলো আর প্রাণ পণে ছুটছিলো তীর্থ। এতক্ষণে নিশ্চয়ই জেঠা জেনে গেছেন তার ব্যাপারে। আর লিপন? ও কি মারা গেছে? মরবেই তো, ওতো রক্তক্ষরণ হলে কি কেউ বাঁচে? আর লিপনের মা? তিনি নিশ্চয়ই অজ্ঞান হয়ে গেছেন। সে যেনো শুনলো কেউ তার কানে কানে বলছে, এক ম’র’ণে দুই ম’র’ণ না হয় আবার!’
সে জানে না জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এই রাস্তাটা কোথায় এসে গেছে। জঙ্গল টা বেশি বড় ছিলো না বিধায় সে সহজেই পারি দিতে পেরেছে। বড় রাস্তার একটার পর একটা গলি লাফিয়ে লাফিয়ে পাড় করতে গিয়ে তার মনে হচ্ছিলো তার পা ছি’ড়ে যাচ্ছে।
#চলবে