পুষ্প কন্যার প্রেম পাবক পর্ব-০৯

0
149

#পুষ্প_কন্যার_প্রেম_পাবক
#পর্ব৯
#রাউফুন

তীর্থ একটা নির্জন জায়গায় বসে আছে। জায়গা টা সে নিজেই আবিষ্কার করেছে। এখানে সচরাচর কেউ আসে না বললেই চলে৷ সামনেই বিশাল খাল! নরম ঘাসের উপর বসে এই খালের ঢেউ দেখতে দেখতে সে বিভোর হয়। খুব কাছে এসে নরম ঘাসের উপর গা এলিয়ে দেই সে। মাটির সোঁদা গন্ধে কেমন মা মা গন্ধ পায়। সেই বিকেলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে সে। আর ফেরেনি। বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে এই জায়গা টা। আশে পাশে কতগুলো বুনো গাছ। পাখির কিচিরমিচির শব্দ, বাতসের শোঁ শোঁ শব্দ। জায়গা টা বেশ নির্জন বলেই তার মনে ধরেছিলো প্রথম বারেই। তার যখনই মন খুব বেশি খারাপ থাকে এখানে এসে সময় কা’টাতো। খালের ঘাটের সঙ্গে একরত্তি এক নৌকা বাঁধা রয়েছে। বর্ষায় বেশি বৃষ্টি হলে খাল ভরে যায়। ঢাকা থেকে গ্রামে এসেই এখানে ছুটে এসেছে সে। তার ভালো লাগছিলো না ঝুমুরের ইগনোরেন্স। বাড়ি ফিরেই এদিকে আসাটা ঠিক হয়নি। মায়ের সঙ্গে ভালো ভাবে বাক্য বিনিময় ও হয়নি। মা অবশ্য বেশ জানতে চেয়েছে সে হঠাৎই ঢাকা থেকে বলা নেই কওয়া নেই কেন ফিরলো? সে উত্তর দেইনি। ব্যাগ রেখে সোজা এখানে এসে বসেছে। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত মনটা বিষাদে ছেঁয়ে আছে।

এটা কি শুধুই ঝুমুর তার সঙ্গে কথা বলে না বলেই হচ্ছিলো? অশান্ত হচ্ছিলো মন, সবকিছু বিষাক্ত লাগছিলো? এমন দহন কেন? কারোর শুধু মাত্র কথা না বলাতেও বুঝি এমন দগ্ধ হতে হয়? কিন্তু কেন? কেন এমন দমবন্ধ লাগছিলো তার? জেঠিমাকে গ্রামে আসার কথা বলতে বিচলিত হন তিনি। সে বলেছে বড্ড মন কেমন করছে মায়ের জন্য তাই গ্রামে আসবে। কদিন মায়ের কাছে থেকে আবার ফিরবে। ব্যস জেঠিমা আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি। বরং বলেছিলো, ‘মন খারাপ করবেই তো, কতদিন যাস না গ্রামে! কদিন ঘুরে আয় গিয়ে, দেখবি ভালো লাগছে! কি সারাদিন বইয়ে মুখ গুজে রাখিস বল তো?’

তীর্থ একটা মাটির ঢেলা কুড়িয়ে নিয়ে নদীর দিকে ছুড়লো। ঢিলটা নদীর মধ্যে কুব্ কুব্ করে ডুবে গেলো। ঢেউ উঠলো৷ ঢেউগুলো প্রথমে একটা কাঁসার থালার মতো গোল হলো, তারপর ক্রমশ ছড়িয়ে পরলো কাঁপতে কাঁপতে। তীর্থ পর পর কয়েকবার মাটির ঢেলা ছুড়লো। সেইম দৃশ্য হলো, সে মন দিয়ে সেই দৃশ্য দেখলো প্রতিবার। তারপর? তারপর আস্তে আস্তে নিচে নেমে নদীর খালে পা ডুবালো। অনবরত পদদলিত করতে লাগলো নদীর পানিতে। থক থক শব্দে মুখরিত হলো। একটু শান্তি লাগছে। কিন্তু কতক্ষণ ভুলে থাকা যায়? দশ মিনিট, বিশ মিনিট? এরপর, এরপর আবার সেই ভোঁতা অনুভূতি। উফফ! বিরক্ত সে। ঝুমুর তার সঙ্গে কথা না বললে তার কি? কিছুই না। একরত্তি মেয়ের কি তেজ, কি কথার দাম, সত্যিটা না জেনেই এমন জেদের বহর কেন? ওখানে থাকলে নির্ঘাত নিজের জেদ চাপা দিয়ে তীর্থ ঝুমুরের সঙ্গে কথা বলতে যেতো। সে গোঁ ধরে বসে থাকতে পারতো না ঝুমুরের ন্যায়।

সে-বার স্কুলে বাড়ি থেকে ডিম ভাজা দিয়ে আর শুটকি মাছ পেয়াজ দিয়ে ভুনা করে টিফিন বক্সে খাবার দিয়েছিলো তার মা। বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে খেতে গিয়ে বুঝলো, ডিম ভাজিতে ভীষণ নুন৷ সেদিন বন্ধুদের সামনে লজ্জায় কতক্ষণ তাজ্জব বনে ছিলো৷ সেদিনের ডিম টা তো ঝুমুর ভেজে দিয়েছিলো। ক্লাস সিক্সে পড়ুয়া মেয়ে কি আর ডিম ভাজতে পারে? দিয়েছে ইচ্ছে মতো লবণ ঢেলে। সে বন্ধুদের বলেছিলো, ‘এই ডিমটা আমার জেঠাতো বোন ভেজেছে। প্রথমবার ভেজেছে তো তাই লবণ বেশি হয়েছে। ওঁ বুঝতে পারেনি। খেয়ে দেখলে হইতো ওমন নুনে পোঁড়া ডিম আমাকে দিতো না।’

কিন্তু বাড়িতে এসে রা’গে ক্ষোভে ঠাটিয়ে চ’ড় বসিয়ে দিয়েছিলো তীর্থ৷ ঝুমুর তার থাপ্পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেছিলো৷ ঠিক ছোট বেলার মতো। সে কি ঝুমুরকে একা রেখে কোথাও যেতে পারতো? উঁহু, জ্বালিয়ে মা’র’তো তাকে। এক নম্বরের ধা’ড়ি বজ্জাত মেয়ে ছিলো। এখনি বা কম কি? তীর্থর সব সময় পিছু নিতো বলে সে বলেছিলো, ‘আমার পিছু নিলে খবর আছে কালি। তোকে রেখে চলে আসবো বাজারে। তখন একা দেখে তোকে, ছেলে ধরা ধরে নিয়ে যাবে। এরপর মা’থা কে’টে নতুন ব্রিজ হচ্ছে না? সেখান তোর মাথা দিয়ে দিবে। ছোটদের বেশি ধরে জানিস তো?’

উঁহু শুনেনি, এতো ভয় দেখানোর পরেও ঝুমুর শুনেনি তার কথা। গোঁ ধরে বলেছিলো, ‘আমি তোমার পিছন ছাড়ুম না তীর্থ ভাই!’ সেকথা শুনে সেদিনও রাগে ধাক্কা দিয়েছিলো তীর্থ। ধাক্কার জোর ছিলো খুব। গাছের গুড়ির সঙ্গে লেগে কপাল কে’টে যা-চ্ছে তাই অবস্থা। কপালের দাগ টা কি এখন চলে গেছে? নাকি আছে? সেভাবে অনেক দিন দেখা হয়নি ঝুমুরকে। শহরে গিয়ে শরীর আর কালো নেই মেয়েটার। ময়লাটে ভাব কে’টে ফর্সা ত্বক লাগে এখন।

কি ঘেড়ে মেয়ে, পরদিন ই যখন সে বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে যাওয়ার জন্য বেরোবে সেই আবার পিছু নিলো। পেছন থেকে সুতির শার্ট খানা টেনে ধরে বলল, ‘আমারেও নিয়া যাও তোমার সাথে! আমিও যামু তোমার লগে।’ এদিকে জ্বরে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলো না মেয়েটা। এমন ধ্যাটা মেয়ে সে জম্মে দেখেনি। সেদিনও নিষ্ঠুরভাবে ঝুমুরকে রেখে চলে গেছিলো খেলতে। পরে শুনেছিলো, ঝুমুর ভীষণ বাজে ভাবে মাটিতে গড়াগড়ি করে কেঁদে কেঁদে বলেছিলো,

‘আমি আর জীবনে তোমার পিছু নিমু না তীর্থ ভাই!’

তাজ্জব ব্যাপার হলো, এরপর আর কখনোই তীর্থর পিছনে যায়নি ঝুমুর। মনে মনে শান্তি পেলেও তীর্থ ঝুমুর এর কান্ড গুলো মিস করতো খুব। অভ্যস্ত হয়ে গেছিলো কি না? এবারেও কি তবে ঝুমুর সেরকম ভাবেই গোঁ ধরে তার সঙ্গে আর কথা বলবে না? যদি সত্যিই কথা না বলে তবে? এই ধাক্কা কি সইতে পারবে সে?

হঠাৎই তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে তীর্থ। পায়ে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করলো। সন্ধ্যা হয়েছে তাই অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না। কিছু কা’ম’ড়েছে। এতো ব্যথা যে সে আহ করে কুকিয়ে উঠলো। কোনো রকমে ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে দেখলো পায়ে কা’টার দাগ রয়েছে। পায়ের ফিংকি দিয়ে কালো কুচকুচে রক্ত গড়িয়ে পরছে। একি! একি কান্ড! তাকে কি সাপে কে’টে’ছে! সে ছুটলো। ভীষণ ভাবে ছুটলো। তাকে বাঁচতে হবে। সে মা’রা গেলে তার বাবা মা একা হয়ে যাবে। বিশেষ করে তার মা! মায়ের কথা চিন্তা করে হলেও সে বাঁচবে। নিজেই গ্রামের হসপিটালের দিকে টালমাটাল অবস্থায় ছুটলো। ভেঙে আসা, দুর্বল পায়ে আলুথালু ভাবে দৌঁড়ালো ! দুর্বলতায় চিত্ত কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে যেনো! তবে এই মুহুর্তে তার কাছে মনে হচ্ছে এই ব্যথার চেয়েও অনেক বেশি ব্যথা, ঝুমুরের তার সঙ্গে কথা না বলাটা। আধ ঘন্টা দৌড়ে হসপিটালের দরজা দাঁড়িয়ে ডক্টর এর উদ্দেশ্যে বলল, ‘ডাক্তার আমাকে বাঁচান। সাপে কে’টে’ছে আমাকে!’

ডক্টর হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এলেন। উৎকন্ঠা নিয়ে এগিয়ে বেডে শিফট করলেন তীর্থকে। ততক্ষণে তীর্থ লুটিয়ে পরেছিলো, শরীরের বল ছেড়ে দিয়ে। বি’ষ ছড়াতে পারেনি বেশি। মেছো সাপের কামড়ে কেউ ম’রে না। তবে যে টুকু বি’ষ আছে তা যথাযথ চিকিৎসার ফলে দ্রুত পানি হয়ে যাবে।

ঘন্টা দুয়েক চিকিৎসার পর তীর্থর জ্ঞান ফিরলে দেখতে পেলো তার বাবা মা দাঁড়িয়ে আছে। গ্রামের সবাই যেহেতু তাদের চেনে তাই বেশি অসুবিধা হয়নি খবর পাঠাতে। রুমি মুখে আঁচল চেপে কাঁদছেন। তীর্থর জ্ঞান ফেরা দেখে ছেলের বুকে হামলে পরলেন। আসলাম ও খুব বিচলিত হয়ে বলেন,

‘এসেই এমন ভাবে বাড়ি ছেড়ে কোথায় গেছিলি? মায়ের কথা শুনিস নি, দেখলি তো কি হলো?’

‘আহ আপনে থামবেন? কোথায় ছেলের আমার জ্ঞান ফিরছে, ভালো মন্দ জিগাইবেন তা না? বকাবকি শুরু করে দিসেন। আমার কথা ক্যান শুনলি না বাপ? আমার কথা শুনলে তো আইজ এই অবস্থা হইতো না।’

‘আমি ঠিক আছি আম্মা, চিন্তা করিও না। ওবাড়িতে জেঠিমা-দের আমার খবর দিয়েছিলে?’

‘না রে দেওন হয় নাই। দিতাছি খাড়া!’

‘নাহ আম্মা থাক। বললে অযথা চিন্তা করবেন উনারা।’

‘ঠিক আছে, কয় দিন মায়ের কাছে থাকো বাপ। বাপ-মায়ের বুক খালি হওয়া যে কতটা দুঃখের রে বাপ তুমি বুঝবা না।’

তীর্থ মায়ের চোখ মুছে দিয়ে হাসলো। এই একজন মানুষ যে কি না তাকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসে।
মায়ের জোরাজোরিতে এক সপ্তাহ গ্রামে থেকে তীর্থ ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।

#চলবে