পূর্ণতা পর্ব-৩৩

0
524

#পূর্ণতা
#Writer_তানজিলা_তাবাচ্ছুম

৩৩.

খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে আছে তারা স্নিগ্ধ বাতাস তার গায়ে ছোঁয়া দিচ্ছে। ছাদে পায়চারি করছে। সেদিন রাতে আলোক তাকে আবার মোহরানার টাকা দেয়। তারা অনেকটা হতবাক ছিলো। হঠাৎ তারা ‌ফোনটা বেজে উঠলো। এতদিন ফোনটাকে এরোপ্লেন মুড করে রেখেছিল। কারন কল দেওয়া মত খোঁজ খবর নেওয়ার মত কেউ নেই। কিন্তু কাল হঠাৎ কি ভেবে অন করেছে। তারা ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো একটা রং নম্বর থেকে মেসেজ এসেছে ‘asish na tar_’ আর লেখা নেই। তারা নম্বর টাতে কল করলো কিন্তু নম্বর অফ দেখাচ্ছে। তারা বুঝতে পারলো না। তারার চিন্তিত হয়ে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে দূর থেকে হেঁটে আসা আলোককে দেখলো। আর আলককে দেখেই তারার চিন্তিত মুখে হাসি ফুটলো। আলোক দৃষ্টিপাত তারার দিকে আসতেই তারা মিষ্টি হাসলো। তারপর ছাদ থেকে নিচে নামলো। আলোক এসে তারাকে বলল,

‘ তোমার বাসা থেকে কল করেছিল।’

তারা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

‘ কেন_কেনো আর কখন?’

আলোক দরজা খুলে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,

‘ কিছুক্ষন আগে। অনেকদিন হয়েছে তাই তোমার বাবা তোমাকে ডাকছে কিছুদিন থাকার জন্য।’

তারা শুনে একটু আঁতকে উঠলো। কারণ তার বাবা তাকে মিস করবে এমনটা অসম্ভব। আর তারা আলোকের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

‘ আমি_আমি যাবো না।’

আলোক শুনে হকচকিয়ে গেলো। তারপর ভ্রু উচুঁ করে বললো,

‘ বাবা মা যেহেতু ডাকছেন যাওয়া উচিত। আর তুমি আসতে আসতে মা-বাবা রাও এসে যাবেন।’

তারা আলোকের উপর কিছু বলতে পারলো না।আলোক ফোনটাকে হাতে নিয়ে তারাকে বললো,

‘ কাল সকালে যাবো। রেডি থেকো।’

____________________

তারা সারাদিন চিন্তা এবং ভয়ে মগ্ন। কোনো ভাবে তার বাবা তার আর আলোকের কিছুদিন আগের সম্পর্কের কথা জেনে তাকে ডাকছে নাকি অন্য কারণে? যদি এই কারণে হয় তাহলে তারা বুঝতে পারছে সামনে কি হইবে। কিন্তু মেসেজটা কে দিলো?আর কিসের বা ছিল। তারার মনে এখনো কিছু প্রশ্ন আছে। যার উত্তর সে পায়নি। ওই ঘরে রক্ত কিভাবে এলো। ওই বাবা মেয়েকে কে মারলো। আর ওই রাতে আলোকের গায়ে রক্ত আর হাতে ছুরি ছিল কেনো? ভেবে পাচ্ছে না তারা । আলোক কে জিজ্ঞেস করতেও সাহস পাচ্ছে না সে।

_________________

রাতের ডিনারের জন্য আলোক তারা কে ডাকতে এসে দেখে সে ঘুমিয়ে পরেছে। এশার নামাজের পরেই তারা ঘুমিয়ে পড়েছে। আলোক ভাবলো কি করবে? পরিশেষে গিয়ে তারাকে ডাকলো,

‘ তারা_তারা?’

তারা উঠলো না। তারার মুখে বিষন্নতার ছাপ ফুটে উঠেছে। আলোক তারার হাত ধরে ডাকতেই দেখলো তারা শরীর প্রচণ্ড গরম। সাথে সাথে আলোক তারার মাথায় হাত দেখলো আর বুঝতে পারলো তারার জ্বর এসেছে।‌ তারা কে খাওয়ার জন্য অনেক ডাকলো আলোক কিন্তু তারা উঠলো না। না খেয়ে মেডিসিন ও খেতে পারবে না তাই অল্প হলেও খেতে হবে। কিন্তু তারা উঠলো না। আলোক ও আর রাতে খেল না। তারা না খেয়ে সারারাত থাকবে তাহলে সে খাবে কিভাবে? আলোক পানি পট্টি নিয়ে তারার পাশে শুলো। তারার মাথায় পট্টি দিল কিন্তু সে কোনো রেসপন্স ই করছে না। যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়েছে।

রাতে চারিপাশে নিরবতা ঘিরে ধরেছে। ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ শোনা যাচ্ছে। আলোকের কানে কেমন অস্পষ্ট শব্দ আসছে। যেনো কেউ কাদঁছে। কিন্তু এত রাতে কে? আলোক অনেক্ষণ যাবৎ শোনার পর পিটপিট করে তাকালো। তাকাতেই চকিয়ে গেল তারা চোখ বন্ধ করে কাঁদছে। আলোক জেগে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে নিজে বুঝতেই পারে নি। আলোক তারার কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত দিল। দেখলো আগের থেকে জ্বর বেড়েছে। তারা চোখ বন্ধ করে মৃদু আওয়াজে কাদঁছে। আলোক তারাকে নরম কন্ঠে বললো,

‘ তারা! তারা! তোমার কি খুব খারাপ লাগছে?’

তারা অস্থির হয়ে নড়াচড়া করতে শুরু করলো। আলোক এই মুহূর্তে কি করবে বুঝতে পারছে না। তারার মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে কানের কাছে বলে,

‘ তারা? তার__

তারা সমন থেকে ঘুরে আচমকাই আলোক কে জরিয়ে ধরে। হটাৎ এমন কিছু হওয়ায় আলোক একটু হিমশিম খেলো। তারা ডুকরে কাঁদতে শুরু করে। আলোক আবারো নম্র কন্ঠে ডাকতে শুরু করে,

‘ তারা তুমি কাদঁ__

তারা কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,

‘ আমি যাবো না আলোক। যাবো না।’

বলে কেঁদে উঠলো তারা। আলোক ঠিক বুঝতে পারলো না। তারাকে পাল্টা প্রশ্ন করলো,

‘ কোথায় যাবা না?‌আর কাঁদছো কেন?’

তারা এবার ‌মুখ তুলে তাকায়। আলোক ও তাকালো। আলোক দেখলো তারা কেমন বাচ্চাদের নিচের ঠোঁট উল্টো করে কাঁদছে। আলোকের তারাকে দেখে‌ কেমন হাসি পেল। সে হালকা হাসলো। তারপর তারা কে জিজ্ঞেস করলো,

‘ কাঁদছো কেন?

তারা আরো শক্ত করে জরিয়ে বলল,

‘ আমি_ আমি যাবো না। প্লিজ আপনি আমাকে নিয়ে যাবেন না। আমি কিছুতেই যাবো না।’

আলোক একটু অবাক হলো। তারা কি আদৌ এতটা ভালোবাসে‌ আলোককে যে সে নিজের বাপের বাড়ি যেতে চায়না! আলোক মোলায়েম কন্ঠ বলল,

‘ কেনো যাবা না? নিজের বাবা-মার সাথে দেখা করার ইচ্ছে নেই? তাদের মিস করো না? ওনারা তো তোমাকে এতটাই মিস করছে যে শেষমেশ আমাকেই বলল।’

আলোকের কথায় তারা কেমন তাচ্ছিল্য ভাবে হেসে বলল,

‘জানেন আলোক আমি ক্লাস ৬‌ এ পড়_পড়াকালীন এক ছেলে আমাকে প্রপোজ করছিল। কিন্তু আমি এইসব পছন্দ করতাম না কারন এগুলো হারাম! তাই এড়িয়ে যাই। ছেলেটা এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আমার বাবাকে বলেছিল ওর সাথে আমার ছোট থেকে প্রেম আরো কিসব জানি বলেছিল।’

আলোক কে আরেকটু চেপে ধরলো।

‘ তার জন্য ওইদিন বাবা লাঠি দিয়ে আমাকে অনেক জোড়ে জোরে মেরেছিল। উনি আমার! আমার কোনো কথা শুনে নি। ওই ছেলেটা যা বলেছিল তাই বিশ্বাস করেছে। জানেন পি_পিঠ_কোমরে এখনো এর দাগ রয়ে গেছে।’

কথা গুলো শুনতেই যেনো আলোকের ভিতরে আঘাত লাগছিল। সে দেখেছিল তারার কোমরের দিকে দাগ। ওইদিন যখন তারা তাকে প্রপোজ করছিল তারা শাড়ি পড়েছিল। কিন্তু শাড়িটা ঠিক মত না পড়তে পড়ার কারণে কোমরের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছিল তার। তখন আলোক লক্ষ্য করেছিল।তারা আলোকের বুকে মুখ গুঁজে কাদঁছে। আলোকের শার্টটা কিছুটা ভিজে ভিজে ভাব। তারা অনেকক্ষণ যাবত চুপ করে আছে। আলোক ভাবলো তারা কি ঘুমিয়ে গেল। আলোক একটু নড়তেই তারা আবার বলে উঠলো,

‘ আমি না রান্না করতে তেমন পারি না।সে_সেদিন মা আমাকে রান্না করতে দিয়েছিল। বাসায় মেহমান আসবে বলে। আম_আমি মাকে বলে রেখেছিলাম আমি রান্না পারি না কিন্তু তবুও মা আমাকে রান্না করতে দেয় কারণ ওইদিন ওনার শরীর ছিল অসুস্থ।’

বলে থামলো তারা। চোখ বন্ধ তবুও চোখ বয়ে তার নোনা পানি গড়িয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষন শ্বাস নিয়ে বলে উঠলো,

‘ মেহমানদের যখন খাবার খাওয়ানোর পর তারা বলেছেন কোনটাতে লবণ বেশি, কোনটাতে মসলা বেশি, কোনটাতে স্বাদ নেই আরো অনেক সব। সে_সেদিন এইসবের জন্য ম_মা_আম_আমাকে__

বলে জোরে জোড়ে কাঁদতে লাগে তারা। আলোক তাকে কিছু বলে নি। কাদুক নিয়ে ইচ্ছে মতন। কারণ কাঁদলে মন হালকা হয়! কষ্ট গুলো কম মনে হয়। তারা থেমে আদুরে কন্ঠে বললো,

‘ উনি আমাকে গরম স্টিল দিয়ে হাতে অনেক গুলো ছ্যাক দেয়। এ_এই য্_যে_

বলে হাতটা এগিয়ে দিল তারা। হাতা টা কিছুটা উপরে উঠাতেই আলোকের পুরো শরীর শিউরে উঠলো। তারার হাতের লম্বা লম্বা দাগ গুলো দেখে। তারা আর কিছু বলল না। আলোক তারার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। আলোক তারাকে কিছু জিজ্ঞেস করবে বলে ‌ডাকবে দেখে তারা ঘুমিয়ে গেছে। কিন্তু তারা ঘুমের মধ্যেও কাঁদছে। আলোক তারাকে ভালো করে শুইয়ে দিয়ে উঠে ব্যালকনিতে গেল। আলোকের এইসব শোনার পর আর ঘুম আসছে না। আলোকের এই মুহূর্তে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। কেননা সে সৎ মা পেয়েও যেন আপন মা পেয়েছে। এইসব বোঝা যায় কেউ জন্ম দিলেই মা হয়ে যায় না হলে ফুটপাতে এত সংখ্যক নবজাতক পাওয়া যেত না। আলোক ‌একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

__________________

সকালে ফজরের নামাজ পড়ে তারা ব্যালকনিতে গেল। শরীরে জ্বর টা কিছুটা কমেছে। কিন্তু আলোক কোথায়? আজ আলোক এখনো আসলো না। তারা চেয়ে আছে বাহিরের দিকে। তারা চেয়ার এনে বসে রেলিং এ মাথাটা একপাশ হয়ে হেলান দেয়। আর সেখানে আস্তে আস্তে সে ঘুমিয়ে পড়ে।

আলোকের ডাকে তারার ঘুম ভাঙ্গে। তারা পিটপিট করে তাকায়। আলোকের হাসি মাখা মুখ টা ভেসে উঠে।

‘ তারা উঠো!’

তারা কিছুক্ষণ ঝিমাতে ঝিমাতে উঠে পড়লো।

‘ তারা উঠে রেডি হও ফাস্ট।’

আলোকের কথা শুনে সে ছলছলে নয়নে তার দিকে তাকালো।

#চলবে….

#Tanju