প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ১৪
আনন্দ দীঘিতে মিতির নিথর শরীরাটা ডুবে গিয়েছিল।
সুরাইয়া আর কানিজ আনন্দ দীঘির পাশে দিয়ে টিএসসির দিকে যাচ্ছিল। সুরাইয়ার প্রথম চোখে পড়ে কালো ওড়নার মত একটা কী যেন দীঘির জলে ভাসছে । এক মুহূর্ত নষ্ট না করে সুরাইয়া ঝাঁপ দিয়েছিল দীঘিতে। সুরাইয়া সাঁতার ভালো জানে, অ্যাথলেটিক কম্পিটিশনে জাহাঙ্গীরনগরের প্রতিনিধিত্ব করে। অল্প সময়ের ভেতর মিতির দেহটা সুরাইয়া ঘাটে নিয়ে আসে। সুরাইয়ার বান্ধবী কানিজ বিএনসিসি করে, কিছুদিন আগেই ও কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস আর ফার্স্ট এইডের ট্রেনিং নিয়েছে। কানিজ কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর মিতির শ্বাস ফিরে এলো।
সুরাইয়া এর মাঝে অনেকগুলো হাসপাতালে ফোন করেছে।আজ ভাগ্য ভালো, দশ মিনিটের ভেতর সাভার সিএমএইচ হাসপাতাল এম্বুলেন্স পাঠিয়ে দিলো। সুরাইয়া এই ফাঁকে অতন্দ্রিলাকে টেক্স করে পুরো ঘটনা জানালো। অতন্দ্রিলা আবার আমাকে টেক্সট করলো।
অতন্দ্রিলার টেক্সট পেয়ে আমি সঙ্গে সঙ্গে ওকে ফোন করলাম। জিগেস করলাম,
-খারাপ খবর মানে কী?
অতন্দ্রিলা বুদ্ধিমতি চালাক চতুর মেয়ে, সহজে কোন কিছুতে ভড়কে যায় না। সে পর্যন্ত কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
-মিতিকে আনন্দ দীঘিতে একজন ভাসতে দেখেছে।
আমি চিৎকার করে উঠলাম,
-কী বলছ এটা? আমি আসছি এখুনি।
-এখন এসে লাভ নেই।
-কেন? কী হয়েছে?
-সুরাইয়া আর কানিজ ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে।
সুরাইয়া কে, আমি জানি না কিন্তু কানিজকে চিনি। বললাম,
-মিতিকে ওরা কোন হাসপাতাল নিয়ে গেছে?
-সাভার সিএমএইচ।
-মিতি কেমন আছে এখন? ও কি ঠিক আছে?
-আমি আর কিছুই জানি না, রূপা। ও বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে তাও জানি না। তুই কি এখন যাবি?
-আমি দেখি রঞ্জনের সঙ্গে যাওয়া যায় কিনা। তোর সঙ্গে পরে কথা বলবো।
অতন্দ্রিলার ফোন রেখে আমি রঞ্জনকে ফোন করে বললাম,
-মিতির একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, সাভার সিএমইচে নিয়ে যেতে পারবে?
রঞ্জন বললো,
-এখন? আমি তো ঢাকায় যাচ্ছি। মারুফের বার্থ ডে। স্যরি রূপা, এখন তো পারছি না। কাল পারবো।
বুঝলাম যাবার ব্যবস্থা আমাকেই করতে হবে। আমি ফোন রেখে তাড়াতাড়ি করে রেডি হয়ে ক্যাম্পাসের বাইরে চলে এলাম। জাহাঙ্গীরনগরের গেটের বাইরে আসতেই বেবি ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম। অতন্দ্রিলাকেও গেটের কাছে আসতে টেক্সট করেছিলাম। সিএমেইচ হাসপাতাল এখান থেকে খুব একটা দূরে না। জ্যাম ঠেলে পনেরো মিনিটের ভেতর আমরা সিএমেএইচ হাসপাতালে চলে এলাম।
হাসপাতালে ঢুকেই দৌড়ে রিসেপশনে গেলাম। মিতির কথা বলতেই রিসেপসনিস্ট কাকে ফোন করলেন। একজন নার্স এসে আমাদেরকে বললেন ওনাকে অনুসরণ করতে। ওনার পেছন পেছন আমরা দোতালার একটা কেবিনের কাছে এলাম। আমদের বাইরে দাঁড়িয়ে রাখিয়ে নার্স ভেতরে গেলেন। ভেতর থেকে একজন অল্প বয়স্ক ডাক্তার বেরিয়ে বললেন,
-আমি মেজর সেলিম। পেশেন্ট আপনাদের কে হন?
আমি বললাম
-আমি আর অতন্দ্রিলা ওর ভার্সিটির ফ্রেন্ড। আমি ওর রুমমেট।
-আপনাদের ভার্সিটির দুটো মেয়েই তো ওনাকে দিয়ে গেলো।
– এখন মিতির কী অবস্থা?
-অন স্পট রেস্কু ব্রিদিং করায় অল্পেতে বেঁচে গেছে। হাইপক্সেমিয়া হয়ে গেছে। হান্ড্রেড পারসেন্ট অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে। দেখা যাক কী হয়।
-আমরা কি ওকে একটু দেখতে পারবো?
-এখন পারবেন না। রাতে ফোন করে আসুন অথবা কাল সকালে একবারে আসুন।
এখানে আমাদের আর কিছু করার নেই। আমি আর অতন্দ্রিলা বাইরে বেরিয়ে এলাম। রায়হান ভাই মিতিকে না পেয়ে উৎকণ্ঠায় আছেন। আমি রায়হান ভাইকে ফোন করে পুরো ঘটনা বললাম। রায়হান ভাই সব শুনে বললেন,
-কিন্তু ও পানিতে পড়ে গেলো কীভাবে, স্লিপ কেটেছে নাকি?
-আমি জানি না আসলে কী হয়েছিল, কিন্তু ও দীঘিতে ডুবে যাচ্ছিল।
-বুঝলাম এখন, এ জন্যই মিতি আমার সঙ্গে দেখা করতে পারেনি।
-আপনি আসবেন না ওকে দেখতে?
-হুম, যাবো। সন্ধ্যার পরে। কাল আবার রাজশাহী যাচ্ছি। রাজশাহী একদিন থেকে ঢাকায় গিয়ে প্লেন ধরবো।
-আপনি কি এই সপ্তাহেই এডিনবরা চলে যাচ্ছেন?
-হ্যাঁ। কেন, মিতি বলেনি?
– আপনি তো জানেনই না এখনো মিতি কেমন আছে। এ অবস্থায় ওকে রেখে কীভাবে যাবেন?
-রূপা, আমি এখন ব্যস্ত। রাখছি, পরে কথা বলবো।
রায়হান ভাই ফোন রেখে দিলেন।
অতন্দ্রিলা বললো,
-রায়হান ভাই আসছে নাকি?
-পরে আসবে, এখন ব্যস্ত।
-ব্যস্ত মাই ফুট, শয়তানের হাড্ডি।
অতন্দ্রিলা তো জানেই না মিতি প্রেগ্ন্যান্ট। জানলে আমি নিশ্চিত ও রায়হানকে একটা চর মেরে আসতো। যা ঘটে গেলো, তারপর মিতির প্রেগ্ন্যান্সির খবর চেপে রাখা অন্যায় হবে। আমি বললাম,
-তন্দ্রা, একটা ব্যাপার তোকে বলা হয়নি কিন্তু এখন বলে রাখা ভালো।
-কী ব্যাপার?
-মিতি প্রেগ্ন্যান্ট।
-কী?
-হ্যাঁ, মিতি প্রেগ্ন্যান্ট।
অতন্দ্রিলা উত্তেজিত হয়ে বললো,
-তাহলে বোঝাই যাচ্ছে কী হয়েছে। রায়হান ভাই যা পাওয়ার পেয়ে এখন মিতিকে ডাম্প করেছে।
-না, ঠিক সেটা হয়নি। রায়হান ভাই মিতিকে বাচ্চা আবর্ট করতে বলেছে।
-আর মিতি সেটা চায়নি?
-না, আজ আবরশনের কথা ছিল।
-তুই আমাকে আগে বলিসনি কেন।
-মিতি না বললে আমি কীভাবে জানাই।
-তার মানে মিতি ডিপ্রেসড হয়ে সুইসাইড করতে চেয়েছে?
-তাই হবে হয়তো।
-বাচ্চাটা মানে ভ্রূণটার কোন ক্ষতি হয়নি তো?
-বলতে পারছি না। কিন্তু ভাবছি শরীরের ভেতর নতুন প্রাণ জেগে ওঠা কী অত্যাশ্চর্য ঘটনা।
-কিন্তু একটা মন্ত্র ঠিক করে দেয় সেই ঘটনাটাকে মানুষ উপহাস করবে নাকি উদযাপন করবে।
অতন্দ্রিলা ভুল বলেনি। বাচ্চা নিয়ে মিতি খুব টেনশনে ছিল, কে জানে ওর হয়তো নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছিল। আমি হয়তো ওর পাশে ঠিকমত দাঁড়াতে পারিনি।
মিতির ওখান থেকে একটু পর আমরা ইউনিভার্সিটিতে ফিরে এলাম। মনটা খারাপ হয়ে আছে। কেন যেন মনে হচ্ছে রায়হান ভাই মিতিকে টিস্যু পেপারের মত ব্যবহার করেছেন। তা না হলে মিতির খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে সব কাজ রেখে উনি হাসপাতালে ছুটে যেতেন। এই লোক এখুনি মিতিকে অবহেলা করছে, বিয়ের পর তাহলে কী অবস্থা হবে?
আমি আর অতন্দ্রিলা চা খাবার জন্য টিএসসির ক্যান্টিনে এলাম। গিয়ে দেখি একটা কোণার টেবিলে মিলি বসে আছে। ওর কাছে গিয়ে জিগেস করলাম,
-কীরে তোদের কক্সবাজারের হানিমুন শেষ?
-হুম।
-অনেক মজা করলি কুদ্দুস দুলাভাইয়ের সঙ্গে?
-হুম, কিন্তু অল্পেতে রক্ষা।
-কেন কী হয়েছিল?
-তোদের কুদ্দুস স্যার সমুদ্রে দাঁড়িয়ে আমার ছবি তুলতে গেছে, হঠাৎ একটা বড় ঢেউ এসে ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।
-তারপর?
-আমি অনেক কষ্ট সাঁতার কেটে ওকে উদ্ধার করি।
-কুদ্দুস স্যার সাঁতার জানে না?
-না, সাঁতার, সাইকেল চালানো, কিছুই জানে না।
-তাহলে এই বোকা লোকটাকে বিয়ে করলি কেন?
-ও শুধু দর্শন জানে আর মন উজাড় করে অনেক ভালবাসতে জানে।
-তাহলে কুদ্দুস দুলাভাইয়ের সাতখুন মাফ।
মিলির চোখেমুখে আনন্দ ঝরে পড়ছে। মেয়েটা আসলেই সুখী হয়েছে। মিতির কথা বলে এই উজ্জ্বল মুখটা এখন ম্লান করে দিতে ইচ্ছে করছে না। বললাম,
-সন্ধ্যার দিকে রুমে আসিস, কথা আছে।
মিলির সাথে কথা বলতে বলতেই দেখি ইন্সপেক্টর লাবণি দিলশাদকে সাথে নিয়ে ক্যাফেতে ঢুকেছে। আমাদের টেবিলের কাছে এসেছে ইন্সপেক্টর লাবণি বললেন,
-রূপা, ভালোই হলো আপনাকে এখানে পেয়ে, একটু বাইরে আসবেন?
-জি, শিওর, কোন জরুরী ব্যাপার?
-বাইরে চলুন, বলছি।
আমরা বাইরে গিয়ে অ্যাম্ফিথিয়েটারের একটা লাল ইটের ধাপের উপর বসলাম। ইন্সপেক্টর লাবণি বললেন,
-আপনাকে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি?
-জি, করুন।
-আপনার বন্ধু রঞ্জন সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানেন?
আমি একটু বিব্রত হয়ে বললাম,
-হঠাৎ রঞ্জনের প্রসঙ্গ কেন?
ইন্সপেক্টর লাবণি বললেন,
-কারণ আছে। ওনার সাথে কীভাবে পরিচয়, কী কী জানেন একটু পরিষ্কার করে বলবেন প্লিজ।
-রঞ্জনের সঙ্গে আমার ছয় সাত মাস আগে পরিচয় হয়েছে। ও ফিজিক্সে পরে। রঞ্জনের বাবার মনে হয় বড় ব্যবসা আছে মেডিকেল ইকুইপমেন্টের। বেইলি রোডে ওদের ডুপ্লেক্স বাড়ি। রঞ্জন নিজে একটা ইয়ামাহা হোন্ডা চালায়।
-মনে আছে, একজন সেক্স অ্যাটাকের ভিক্টিমের কাছে থেকে আমরা একজন আক্রমণকারীর ডিটেলস পেয়েছিলাম?
-হ্যাঁ, মনে আছে।
-ওই বর্ণনার সাথে রঞ্জনের চেহাড়া আর শরীরের গড়ন অনেকটাই মিলে যায়।
-তাই? কোইন্সিডেন্টালিও মিলতে পারে।
-তা পারে কিন্তু তাহলে ওর ঘরের টিনের ট্রাঙ্কের ভেতর ভিক্টিমদের আন্ডারগারমেন্টস পেতাম না।
(চলবে)