প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ২
কাল বিকেল থেকেই সর্বনাশের শুরু।
প্রজাপতি উৎসবে সিলভার লাইন প্রজাপতির দারুণ রঙ্গিন পাখা ঝাঁপটানির মাঝ দিয়ে যখন রঞ্জনের আবির্ভাব ঘটলো, আমি চমকে উঠেছিলাম। মনটা আমার মাথার সঙ্গে বিদ্রোহ করে বলে উঠেলো, সহসা প্রেম আসিলো কী মহাসমারোহে। ছেলেটা কাছে এসে মিষ্টি করে হেসে বললো,
-আমি রঞ্জন, ঘুড়ি ওড়াবেন?
রঞ্জনের একশ ডিগ্রী সেলসিয়াস স্ফুটনাঙ্ক হাসিতে আমার মন আইসক্রিমের মত গলে টুপ টুপ করে ঝরতে শুরু করেছে। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
-ঘুড়ি? ঘুড়ি কোথায়?
রঞ্জন আবার যাদুকরী হাসি দিয়ে বললো,
-এই যে, আমার হাতে।
তাই তো, আমি ওর মোহন মুখে চেয়ে জগত ভুলে গিয়েছিলাম। রঞ্জনের হাতে দুটো রঙ্গিন প্রজাপতি শেপের ঘুড়ি। ছোট দুটো ডালে নাটাইয়ের মত করে ঘুড়ির সুতো প্যাঁচানো।
-আসুন, সুইজারল্যান্ডের বাতাস থাকতে থাকতে ঘুড়ি উড়িয়ে আসি।
রঞ্জন যদি ইতস্তত করতো, ওর মাঝে যদি নার্ভাসনেস থাকতো, আমি হয়তো না করতাম। কিন্তু রঞ্জন এমন জলের মত সহজভাবে কথাটা বললো, আমি না করতে পারলাম না। ভাসানী হলের কাছে জলঘেরা সুইজারল্যান্ডে আমরা সত্যি ঘুড়ি উড়িয়ে দিলাম আকাশে। দুটো প্রজাপতির মত ঘুড়ি ফড়ফড় করে আকাশে উড়ছে, ঘুড়ি তো না যেন আমার মন উড়ছে। রঞ্জন বললো,
-আপনি জানেন প্রজাপতি ভালোবাসার প্রতীক?
আমি কোন উত্তর দিলাম না। রঞ্জন দমে না গিয়ে বললো,
-এ জন্যই আজ প্রজাপতি উৎসবে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছি।
-কেন দেখা করতে চেয়েছেন?
-সে তো আমার চিঠিটেই লেখা। একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন?
-কী ব্যাপার?
-আপনাদের প্রীতিলতা হল উপর থেকে দেখতে প্রজাপতির মত। লাল প্রজাপতি।
-তাই তো, ওভাবে ভাবিনি আগে। আমি একটা কথা জিগেস করি?
-করুন।
– এসব বলে, এত আয়োজন করে আপনি কি আমায় ইম্প্রেস করার চেষ্টা করছেন?
-জি, একদম ঠিক। আমার সকল গান তোমারে লক্ষ্য করে।
– আমি এখনো ইম্প্রেসড হইনি।
-তাহলে আরেকটু চেষ্টা করার সুযোগ দিন। আজ সন্ধ্যায় মুক্তমঞ্চে চলে আসুন। প্লিজ।
আমি কোন উত্তর দিলাম না। তারপর সন্ধ্যায় যে কী হয়ে গেলো। আমি ঠিক ঠিক সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চে হাজির হলাম। অ্যান ইন্সপেক্টর কলস দেখার সময় হু হু করা বসন্ত বাতাস বইছিলো, রঞ্জন সহসা আমার আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে ফেললো।
আঙ্গুল ছোঁয়া একটা সামান্য ব্যাপার। বাজারে বোয়াল মাছে কিনতে গেলেও আঙ্গুল ছোঁয়াছুঁয়ি হয় । কিন্তু রঞ্জনের হাই ভোল্টেজ আকর্ষণে আমি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত কেঁপে উঠলাম। ছেলেদের সঙ্গে বেশী মিশি না বলেই হয়তো এমন হলো। সারা রাত ঘুমের ভেতর রঞ্জনের কথা ভাবলাম। কী একটা অবস্থা, লজ্জাজনক ব্যাপার।
আজ সকালে ক্লাসে ফিলোসফি কুইজ। কুইজের কোন প্রেপারেশন নিতে পারিনি কারণ কাল সারারাত মন ছিল রঞ্জনে রঞ্জিত। আমার এখন নার্ভাস লাগছে। কুদ্দুস স্যার ক্লাসে ঢুকেই বললেন,
-তোমার আছে ডাঙ্গা, আমার আছে জল,
তোমার বসে থাকা, আমার চলাচল।
গানের এ দু লাইনে একাধিক দার্শনিকের ফিলোসফি লুকোনো আছে। বলতে পারো এরা কারা? প্রাচীন যুগ থেকে আরম্ভ করে বলো।
চামচিকা চামেলী কুই কুই করে বললো,
-এরা রবীন্দ্রনাথ স্যার।
-আমি কে গান লিখেছে জানতে চাইনি। এটা ফিলোসফি কুইজ।
রুবানা কখনো ক্লাসে আসে না, কোন এক ছেলের সঙ্গে পাঙ্খা হয়ে ঘুরে বেড়ায়।, সে হঠাৎ উত্তেজিত কন্ঠে হাত তুলে বললো,
-আমি জানি স্যার।
-কোনটা জানো?
-আমার আছে জলের অংশটা স্যার।
-ভেরী গুড, বলো তাহলে।
-ঢাকা ওয়াসা স্যার। আব্বা ওখানে চাকুরী করে স্যার।
ক্লাসের সবাই হেসে ফেললো। স্যার হতাশ কন্ঠে বললেন,
-আর কেউ পারবে, তোমার আছে ডাঙ্গা, আমার আছে জল? আমার আছে জল কার ফিলোসফি?
ভদ্র ছেলে আরিফ দ্বিধান্বিত কন্ঠে বললো,
-থেলিস নাকি স্যার?
-এই তো, আরিফ ঠিক বলেছে। গ্রীক ফিলোসফার মিলেটাস বলেছিলেন সব কিছু জল দিয়ে তৈরি। দু হাজার ছয় শ বছর আগে।
পোষা ছাত্রী শাপলা এবার মাতব্বরি করে বললো,
-আমি একটা কথা বলি স্যার?
-হ্যাঁ বলো।
-তোমার আছে ডাঙ্গা কে বলেছে স্যার?
-শুধু ঘোলা জলের মাঝে পাপড়ি মেলে ফুটলে তো হবে না শাপলা, তুমি না হয় উত্তরটা দাও।
শাপলা হেসে বললো,
-আমি জানি স্যার।
-ভণিতা করছো কেন তাহলে?
-জেনোফেন স্যার, উনি বলেছিলেন পানি থাকলে, মাটি থাকতে হবে। ডাইকোটমি।
-থ্যাঙ্কু শাপলা। এখন কেউ একজন বলো, তোমার বসে থাকা আমার চলাচল কার ফিলোসফি?
আঁতেল আঁশরাফ চশমার ফাঁকা দিয়ে তাকিয়ে বললো,
-মিশেল ফুকো, জ্যাক দেরিদা, নোয়াম চমস্কি স্যার?
– মিশেল ফুকো আর জ্যাক দেরিদার কথা আপাতত ভুলে যাও। আড়াই হাজার বছর আগে ফেরা যাক। এমন একজন ফিলোসফারের নাম বলো যে ফুকো, দেরিদার কম ছিল না।
লাড্ডু স্যারের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বললো,
-নিতশে নাকি স্যার?
-আর ইউ জোকিং লাড্ডু? কে বলতে পারবে?
এবার মিলি বললো,
-হেরাক্লিটাস স্যার।
স্যার হেসে বললেন,
-তুমি ঠিক বলেছো মিলি। তুমি সব সময় ঠিক বলো। হেরাক্লিটাসের ফিলোসফি কারো মনে আছে?
আবার সবাই চুপ। স্যার মিলির দিকে তাকিয়ে বললেন,
-ঝিলিমিলি, তোমার মনে আছে?
-আবছা আবছা মনে আছে স্যার।
-বলো না মিলি, তোমার আবছা আবছাই অনেকের পরিষ্কারের চেয়ে পরিষ্কার।
– উনি বলেছেন এভ্রিথিং ইজ ইন ফ্লাক্স স্যার।
-এভ্রিথিং ইজ ইন ফ্লাক্স, তার মানে কী মিলি?
-টেনশন আর কন্ট্রাডিকশন থেকে গতি তৈরি হয় স্যার, তোমার বসে থাকা, আমার চলাচল।
কুদ্দুস স্যার খুশী হয়ে মিলির এত কাছে এলেন মনে হলো মিলির গায়ে ঢলে পড়বেন। মিলির কাছে ঘেঁষে হাত নাড়াতে নাড়াতে স্যার বললেন,
-ঠিক মিলি ঠিক, এভরিথিং ইজ ইন ফ্লাক্স,
দেখিতেছি আমি আজি
এই গিরিরাজি,
এই বন, চলিয়াছে উন্মুক্ত ডানায়
দ্বীপ হতে দ্বীপান্তরে, অজানা হইতে অজানায়।
নক্ষত্রের পাখার স্পন্দনে
চমকিছে অন্ধকার আলোর ক্রন্দনে।
শ্যামলি আমার পাশে বসা ছিল। ও ফিসফিস করে বললো,
-স্যার মিলির শরীরের এক ইঞ্চি উপর দিয়ে হোভারক্রাফটের মত যেভাবে হাত চালাচ্ছেন, তার চেয়ে ছুঁইয়ে দিলেই পারেন। নইলে বিয়ের প্রস্তাব দিক।
আমি হাত দিয়ে মুখ চেপেও হাসি সামলাতে পারলাম না, ফিক করে হেসে ফেললাম।
স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-কী , রূপা? অ্যানিথিং রং?
-না স্যার, প্লেটোর কথা ভাবছিলাম।
স্যার বিরক্ত হয়ে বললেন,
-আমি হেরাক্লিটাস নিয়ে কথা বলছি আর সেই সময় তুমি প্লেটো নিয়ে ভাবছো কেন?
আমি নার্ভাস হয়ে যা মন চায় গড়গড় করে বলে গেলাম,
-স্যার, ভাববাদের আইডিয়া তো সক্রেটিসের, মাঝখান দিয়ে প্লেটো ডায়ালগ লিখে সব ক্রেডিট নিয়ে নিলেন।
-প্লেটো ডায়ালগ না লিখলে আমরা কি সক্রেটিসের কথা জানতাম? যা হোক এখন তুমি কী বলতে চাও? হাসছিলে কেন?
-ধরি মাছ না ছুঁই পানি প্রেমের কথা ভেবে হাসি পেয়েছিল স্যার।
স্যার বিভ্রান্ত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি আরো নার্ভাস হয়ে বললাম,
-আমি বলতে চাইছি স্যার ধরি মাছ না ছুঁই পানি প্রেম তো সক্রেটিসের আবিষ্কার। মাঝখান দিয়ে প্লেটো ক্রেডিট নিলো।
-কীসের কী মাছের ডিমের প্রেম? কী বলছো?
-মাছের ডিমের প্রেম না স্যার, ধরি মাছ না ছুঁই পানি প্রেম। মানে প্লেটনিক প্রেম। মন যদি মাছ হয় আর পানি যদি শরীর হয়, তাহলে এই শরীর না ছুঁয়ে শুধু হৃদয় ছোঁয়াই তো প্লেটনিক প্রেম?
-হুম তা বলতে পারো। জাস্ট একটা ইমাজিনারি একজাম্পল দিই। এই ধরো মিলিকে আমি খুব ভালোবাসি কিন্তু ছুঁই না, এটা প্লেটনিক প্রেম বলা যায়। ওই গানটার মত, আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি আর মুগ্ধ এ চোখে চেয়ে থেকেছি। কি মিলি, ঠিক না?
আমি মিলির দিকে তাকিয়ে দেখলাম বেচারীর মুখ লাল আর বেগুনীর রঙের মাখামাখি হয়ে আছে। মিলি মাথা নীচু করে বললো,
– কাল্পনিক উদাহরণ হিসেবে ঠিক আছে স্যার ।
হঠাৎ ব্যাক বেঞ্চ থেকে একটা ছেলে বললো,
-কিন্তু স্যার প্লেটোর জায়গায় অ্যারিস্টটল হলে কী করতেন? উনি তো বস্তুবাদী ছিলেন?
-হুম, গুড পয়েন্ট। আরিস্টটল সব ধরে ধরে মেপে মেপে বোঝার পক্ষপাতি ছিলেন। দেয়ার ইজ নো প্রিএক্সিস্টিং আবসলুট ফর্ম অর ভারচু। ওনার মতে জ্ঞান অর্জন ডিডাক্টিভ বা অবরোহী না। জ্ঞান অর্জন হলো ইন্ডাক্টিভ মানে আরোহী। অভিজ্ঞতা থেকেই জ্ঞানের জন্ম। ফিলোসফিকে আজকাল যতই অবহেলা করা হোক, এম্পেরিকাল সায়েন্স তো আরিস্টটলের পকেট থেকেই বেরিয়েছে।
-তাহলে স্যার মিলি সম্পর্কে ইন্ডাক্টিভ বা এম্পেরিকাল নলেজ অর্জন করতে হলে কী করবেন? আই লাভ ইউ বলে মিলিকে জাপ্টে ধরবেন?
ছাত্রছাত্রীরা হি হি করে হাসছে। কুদ্দুস স্যার টলে না গিয়ে ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন,
-কন্সেপচুয়ালি তুমি রাইট কিন্তু সোসাইটি বলে তো একটা কথা আছে। বাই দা ওয়ে, তুমি কে? তোমাকে তো আগে এই ক্লাসে দেখিনি।
-আমি রঞ্জন। ফিজিক্সে পড়ি।
রঞ্জনের নাম শুনে আমি আঁতকে উঠলাম। ও আমাদের ফিলোসফি ক্লাসে এসে কী করছে?
স্যার বললেন
-তুমি ফিজিক্সে পড়ো? তাহলে আমাদের ক্লাসে এসে কথা বলছো কেন? তোমার নিজের ক্লাস নেই?
– আছে স্যার কিন্তু রূপা আমাকে আপনার ক্লাসে ইনভাইট করেছে।
স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
-রূপা তুমি ওকে এখানে ইনভাইট করেছ কেন? আমার ক্লাস কি বার্থ ডে পার্টি?
আমি রঞ্জনের দিকে তাকালাম, দুষ্টুটা উল্টো আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিয়ে হাসছে।
(চলবে)
#এশরারলতিফ