#প্রিয়তমা_প্রজাপতি🩷 [পর্ব-০৬]
~আফিয়া আফরিন
এরপর মাসখানেকের মত সময় কেটে গেল। প্রকৃতিতে বর্ষাকালের আগমন ঘটলো। নতুন ঋতুর আগমনের মতো করে, মিফানের জীবনেও হয়তো খুব সূক্ষ্মভাবে তার প্রজাপতির আগমন ঘটলো।
হ্যাঁ ঘটনাটা খুব সূক্ষ্ম। একটু গভীর ভাবে ভেবে না দেখলে সহজে ধরা যায় না এমন।
এইতো ঘটনা না টা ঘটে পরশু বিকেলে। মিফান সাইকেল চালিয়ে গুনগুন করে সামনে এগোচ্ছিলো। মাছ রাস্তায় হঠাৎ করেই অনিন্দিতার সামনে দেখা হল। দোকান থেকে কি যেন কিনতে এসেছে। অনিন্দিতা কে দেখেই মিফান ভ্রুজোড়া কুঁচকে ফেলল।
সাইকেলে চড়েই বলল, ‘এই প্রজাপতি!’
অনিন্দিতা ঘুরে তাকালো। ইশারায় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলে নিজের কাজ সারল। তারপর মিফানের দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘একটু বাড়ি পৌঁছে দে তো আমায়। বর্ষাকাল আসতে না আসতেই রাস্তাঘাট একদম কাঁদায় প্যাচে প্যাচে হয়ে গেছে।’
মিফানের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ থাকলেও অনিন্দিতার নিঃসংকোচ আবদার সে এড়িয়ে যেতে পারে নাই।
বলল, ‘সাইকেলেই যাবে?’
‘না তোর মাথায় করে যাব। নিয়ে যা আমাকে মাথায় করে।’
‘আমায় ভালবাসলে তো সব সময় মাথায় তুলেই রাখব। ভালোবাসো একটু আমাকে! ভালোবাসো না কেন হু?’
‘চুপ। এখন নিয়ে চল আমাকে!’
অনিন্দিতা সাইকেলে চেপে বসলো। আলতো করে মিফানের কাঁধে হাত রাখলো। আরেক হাতে দোকান থেকে কেনা জিনিসপত্রগুলো ধরে রাখল।
মিফানকে বলল, ‘চল।’
মিফান চলতে শুরু করল। পুরোটাই যেন তার স্বপ্ন, এখনই বোধহয় মা এসে ডাক দিয়ে ঘুম ভেঙে ফেলবে। সেই স্বপ্নটাকে আরেকটু রংধনু সাজে রাঙিয়ে দিতে বোধহয় অনিন্দিতা গুনগুন করে গান গেয়ে উঠলো।
‘প্রেমে পড়া বারণ, কারণে অকারণে
আঙ্গুলে আঙ্গুল রাখলেও
হাত ধরা বারণ!’
মিফানের অদ্ভুত ভালো লাগলো, এইরকম ভালো লাগাকে বোধহয় ভয়ংকর ভালো লাগা বলে। এই ভয়ংকর রকমের ভালোলাগা গুলো বোধহয় দীর্ঘস্থায়ী হয় না, তাই অতি অল্প সময়েই তারা নিজেদের গন্তব্যে পৌঁছে গেল।
অনিন্দিতা মিফান কে বলল, ‘তুই এখানেই থাক যাবি না কোথাও, আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি আবার।’
মিফান বুকে হাত বেঁধে অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণের মাথায় অনিন্দিতা এসে হাজির। চুলে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে বলল, ‘এখন আমায় ঘুরতে নিয়ে চল।’
অনিন্দিতার কথা শুনে মিফান বেশ অবাক হলেও তা প্রকাশ করলো না। মুখে বরাবরের মতো শান্তশিষ্ট ভাবটা বজায় রেখে বলল, ‘আচ্ছা চলো। কোথায় যাবে? আর সাইকেলে? সমস্যা হবে না?’
‘যেখানে নিয়ে যাবি, যাবো। আর সাইকেলে সমস্যা হবে কেনো? সাইকেলে চড়ার লোভ টা সামলাতে পারব না দেখেই তো বললাম। না হয়, তোর মতো বাদরমুখোর সাথে কে যায়? আমার একটা প্রেস্টিজ আছে না?’
মিফান হাসল। মুখে কিছু বলল না। অনিন্দিতা সাইকেলে চেপে বসতে মিফান বলল, ‘ভালো করে ধরে বসো। আজকে বাতাস আছে। তোমার যেই লিলিপুট মার্কা শরীর, উড়ে যাবে তো!’
অনিন্দিতা কটমট করে তাকালো। বলল, ‘এমন ভাবে চেপে ধরব, যে আমার হাত থেকে ছাড়া পাবি না এই জীবনেও! অন্য কারো পেছনে ঘুরঘুর করা জন্মের মতো মিটিয়ে দেব, বেয়াদব!’
‘জেলাস হও? তবে ভালোবাসো না কেন প্রজাপতি। আর কতো অপেক্ষা করাবে বলো তো! ভালো লাগে কি এতো অপেক্ষা করতে?’
‘অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয় জানিস না!’
অনিন্দিতার এহেন কথায় চুপ করে গেলো মিফান। সত্যি যদি অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়, সত্যি যদি অপেক্ষায় শেষ পাতায় তার অনিন্দিতা লেখা থাকে; তাহলে তো অপেক্ষা করতে করতে সে এক জীবন ফুরিয়ে ফেলতে পারে অনায়াসে।
বড়ো রাস্তা পেরিয়ে মাঠে সাইড করতে বলল অনিন্দিতা। মিফান তাই করল। অনিন্দিতা খোলা মাঠে বুকভরে নিঃশ্বাস নিলো। এখানে এসে জীবনটা বেশ আনন্দের মনে হচ্ছে। সামনেই আকাবাকা রাস্তা, ঢেউ তোলা নদী। অনিন্দিতা মিফানের হাত ধরে বলল, ‘চল নদীর পাড়ে বসি।’
মিফানের মনে একশ রংবেরঙের প্রজাপতি ডানা ঝাপটালো। এই টুকুই তো চেয়েছিল সে ছোট্ট জীবনে, ব্যাস আর কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। শুধু অনিন্দিতা, অনিন্দিতা থাকলেই চলবে। এভাবে মনে মনে টুকটাক ভালোবাসা প্রকাশ করলেও চলবে, বেশ চলবে; না শুধু চলবে না একদম হাই স্পিডে দৌঁড়াবে।
.
.
বিচিত্ৰবেশী এই প্রকৃতি যেন তার সৌন্দর্যে মিশে যেতে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আজকের প্রকৃতি যেন অন্য দিনের চেয়ে একটু বেশি সুন্দর।
কিন্তু কারণ কি? অনিন্দিতার ভাবনা জুড়ে কেবল একটা ভাবনায় ঘুরপাক খেলো, সেটা হলো মিফান তার পাশে আছে বলেই আজকের প্রকৃতি এত সুন্দর।
প্রকৃতির সেই অমোঘ টান আমরা যেমন উপেক্ষা করতে পারি না, ঠিক সেই ভাবেই মিফানের পাগলপারা ভালোবাসা অনিন্দিতার পক্ষে উপেক্ষা করা আর সম্ভব হচ্ছে না।
কিন্তু এই ভালোবাসাতে বাঁধা পড়বে মে অনেক। এতো বাঁধা সামাল দিতে পারবে তো?
মিফান একদৃষ্টিতে তাকাল অনিন্দিতার দিকে। কি সরলতা তার মুখচ্ছবি তে। এতো সরল ও মানুষ হয়! এতো সরল মানুষকেও ভালোবাসা যায়? কিন্তু, সরল মানুষগুলো বোধহয় সর্বদা ভালোবাসা উপেক্ষা করে।
মিফান জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বাচ্চাদের মত ঠোঁট উল্টাল। বেশ বড়ো একটা দম নিয়ে বলল, ‘তুমি আমার জীবনে সরলতায় পূর্ণ এক যৌগিক আশ্রয়; যেই আশ্রয়ে আমি মাথা গোঁজার ঠাই পাই না!’
সন্ধ্যা মিলানো পর্যন্ত মিফান আর অনিন্দিতা ওখানে থেকে গেল। তারপর, মিফান অনিন্দিতাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে নিজেও বাড়ি ফিরে এলো।
এই যে দু’জনের মন এলোমেলো হলো, আর ঠিক হলো না। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে।
অনিন্দিতা বারবার মিফানকে ফিরিয়ে দেওয়ার পরও মিফান অনিন্দিতার প্রতি তার মনটাকে ফেরাতে পারছিল না, সে জানে এটা কখনো সম্ভব না তাই ব্যর্থ চেষ্টাও করছে না।
কিন্তু, অনিন্দিতা? তার দিন কাটে কিভাবে? মিফান তো ভালোবাসার কথা প্রকাশ করে হ-য-ব-র-ল কান্ড ঘটাতে পারে। অনিন্দিতা তো পারে না। না পারে প্রকাশ করতে আর না পারে বেঁধে রাখতে। কি দোটানা? কি অসীম ভালোবাসার টান…..!
.
.
এরই মধ্যে কোন একদিন অনিন্দিতা ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে বের হলো। পথে যেতে যেতে হঠাৎ করে আজাদকে নজরে পড়ল। ঐ যে, উত্ত্যক্তকারী ওই ছেলেগুলোর মধ্য একজন। আজাদ অনিন্দিতা কে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো। অনিন্দিতা আড়ষ্ট ভঙ্গিতে পিছনে সরে গেল।
আজাদ হাসি হাসি মুখ করে বলল, ‘অনিন্দিতা ভালো আছো?’
অনিন্দিতা কন্ঠে আড়ষ্টতার রেশ টানলো। বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ভালো আছি।’
আজাদ নিজে থেকেই বলল, ‘আমিও ভালো আছি। তোমার ওই মিফান ভালো আছে? বাবারে বাবা, সেই কি হম্বিতম্বি করল ছেলেটা, তোমার জন্য। আমাদেরকে একদম পাড়া থেকে বিতাড়িত করে তারপর ছাড়লো।’
অনিন্দিতা অবাক হলো বটে! তারমানে সব মিফানের কাজ। আজাদকে বলল, ‘আচ্ছা আজাদ ভাই, থাকেন। আয়া আসছি, ইম্পরট্যান্ট ক্লাস আছে একটা।’
আজাদ হাসি মুখেই বিদায় দিল। ক্যাম্পাসে ক্লাসছ মনোযোগ দিতে পারল না অনিন্দিতা। পরপর দুটো ক্লাস করে বেড়িয়ে পড়ল। রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে লাগল। কোনোকিছুই মনে ধরছে না। চোখের পানি বি’সর্জ’ন দিলে হয়তো একটু শান্তি পাওয়া যেতো। কিন্তু একটা ভরসার স্থান দরকার; যেটা অনিন্দিতার থেকেও নেই!
বাড়ি ফিরল সন্ধ্যা করে। রাস্তায় রাস্তায় এতক্ষণ অযথা ঘুরে বেড়িয়েছে। বাড়ি ফিরে মিফানকে দেখতে পেলো।
মিফান উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘এতক্ষণ কোথায় ছিলে তুমি? বাড়ি ফিরতে এত দেরি হল যে?’
অনিন্দিতা ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিপাত করল। বলল, ‘আমার দায়িত্ব নিশ্চয়ই আমি তোর উপর সঁপে দেই নাই যে তুই আমার উপর খবরদারি করবি। আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে একদম নাক গলাতে আসবে না।’
মিফানের উচ্ছ্বাসে ভাটা পরল। কি এমন হলো অনিন্দিতার?
সে পুনরায় বলতে নিলো, ‘আসলে আমি জানতে চাইছিলাম আর কি….!’
অনিন্দিতা একই রেশে বলল, ‘এত জেনে তোর কাজ নেই তো। যেমন আছিস তেমনি থাক। বেশি বাড়াবাড়ি করলে এখন যতটুকু আছিস, ততটুকু ও হারাবি। তাই আমার থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখবি।’
‘কিন্তু, তোমার কি হয়েছে? কেউ বলেছে কিছু?’
অনিন্দিতা মিফানের কথার জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলাম না। নিজের মতো করে নিজের ঘরে চলে এলো।
কিন্তু মিফানের মন শান্ত হলো না, অনিন্দিতার কি কিছু হয়েছে? মেজাজ এতো গরম কেন?
মিফান বাড়ি ফিরে এলো। অনিন্দিতা কে একটা ফোন করবে, এই মুহূর্তে এটা তার সাহসে কুলাচ্ছে না। মিফানের সেই রাত কাটল অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে।
আর অনিন্দিতার সেই রাত টা কেটে গেলো, কাঁদতে কাঁদতে। নিজের উপর রাগ সামলাতে পারছিল না। অযথাই চোখ ভিজে আসছে, গাল বেয়ে নোনা পানি গড়িয়ে পড়ছে। কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়েও গেলো।
এরপর মিফানের জীবনে শুরু হলো তার জীবনের সেরাতম কালো অধ্যায়। অনিন্দিতা পুরোদমে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক সব জায়গা থেকে ব্লক। এমনকি দেখা হলেও কথা বলে না।
একদিন মিফান শুধু ব্লক করার কারণ টা জানতে চেয়েছিল। তাতে রগরগে কণ্ঠে অনিন্দিতা জবাব দিলো, ‘সবাইকে সব জায়গা দিতে হয় না। কিছু মানুষকে মাঝে মাঝে তাদের নিজেদের জায়গা টা বুঝিয়ে দিতে হয়। তোকেও তোর জায়গা বুঝিয়ে দিলাম। ভালো থাকিস। ফারদার, আমার পিছু নিবি না।’
অনিন্দিতার কথা অপমানে লেগেছে মিফানের। তবুও সে ব্যাপার টা এড়িয়ে গেছে।
আর অনিন্দিতা, সে পড়ে গেছে ভালোবাসার কঠিন বেড়াজালে।
প্রতি মুহূর্তে ভেবে যাচ্ছে, ‘এত গন্ডি, এতো তারকাঁটা আমার জীবনেই কেন? একটু ভালোবাসতে চাই, ভালোবাসতে পারি না কেন? মিফানকে এতো অপমান, এতো অবহেলা করি সে দূরে যায় না কেন? আমি তো নিজের কাছে নিজে দিনকে দিন ছোটো হয়ে যাচ্ছি। মিফান, তোর প্রজাপতির যে নিজস্ব ডানা মেলে উড়তে পারার সাহস বা ক্ষমতা কোনোটাই নেই। তোর প্রজাপতির গতি যে একটা নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ। এই প্রজাপতি কে কেন ভালোবেসে কষ্ট পাচ্ছিস? এতো কষ্ট পাওয়ার যোগ্য তো তুই না!’
এতোকিছুর পরও মিফান অনিন্দিতার প্রতি স্থির। বেহায়ার মতো বারবার বলে, ‘একবার ভালোবাসি বলে দাও। তারপর সব কবুল, হ্যাঁ হব; তোমার যত অপমান, অবহেলা, যাচ্ছেতাই ব্যবহার সবকিছু মাথা পেতে কবুল করে নিবো!’
.
.
.
চলবে….!
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ]