#প্রেম_আমার♥
#পার্ট-৩৯♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥
.
🌺
.
—- ঘোমটাটা একটু তুলো দেখি মা!
.
ছেলের মায়ের মুখে ঘোমটা তুলার কথা শুনে একরাশ বিরক্তি এসে হানা দিলো আমার চোখেমুখে! তখনই আব্বুর হঠাৎ জরুরী ফোন আসায় বসা থেকে উঠে সাইডে গিয়ে কথা বলতে লাগলো আব্বু।
আমি এখনও ঘোমটা না সরানোয় আবারও ছেলের মা বলে উঠলেন,
.
—- এতো লজ্জার কি আছে মা? আমরা তো কয়েকদিন পর তোমার আপনজনই হবো। একটু মুখখানা দেখি! নিহামের বাবার কাছে শুনেছি, তুমি নাকি ভারী লক্ষ্মী মেয়ে।
.
আবারও গা জ্বলে উঠলো আমার। আরে মেয়ে দেখতে এসেছে উনারা নাকি তুলে নিয়ে যেতে এসেছে? না দেখেই বলে দিলো কয়েকদিন পর আপনজন হয়ে যাবে?
ভদ্র মহিলার কথায় আমি চরম বিরক্ত হলেও পাশে বসা রুশো ভাইয়া আর অগ্নি ভাইয়ার যেনো ভীষণ মজা পাচ্ছে। তা বেশ বুঝতে পারছি আমি কারণ ঘোমটার আড়ালেও দেখতে পারছি রুশো ভাইয়া আর অগ্নি ভাইয়া মাথা হেলে স্থির দৃষ্টি মেঝেতে রেখে একটুপর পর কেঁপে কেঁপে উঠছে। তারা যে হাসি কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে যাচ্ছে তা বুঝতে আর বাকি নেই আমার।
.
আম্মু আমার মাথা থেকে ঘোমটাটা তুলে দিয়ে মুখটা বের করে দিলো। আমার ইচ্ছে হচ্ছেনা সামনের দিকে তাকানোর। তাই মাথা নিচু করে আগের মতোই বসে রইলাম আমি।
কিচেন থেকে রুনা খালার (সার্ভেন্ট) ডাক আসায় আম্মু উনাদের আমার সাথে কথা বলতে বলে উঠে চলে গেলো।
.
এবার ভদ্র মহিলার আবারও আমার মুখ তুলে তাকাতে বলার আগেই আমি একরাশ বিরক্তি নিয়ে মুখ তুলে তাকালাম। ভদ্র মহিলা আমায় দেখে “মাশাল্লাহ!”৷ বলে উনার হাজবেন্ডকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
.
—- তোমার চয়েজ আছে বলতে হবে। এত্তো মিষ্টি একটা মেয়ে পছন্দ করেছো! এই নিহাম তুই চোখ নামিয়ে রেখেছিস কেনো? হবু বউকে দেখ!
.
ভদ্র মহিলার কথায় ছেলেটা লজ্জা লজ্জা ভাব করে আমার মুখ পানে একবার তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার আগেই যেনো আটকে গেলো। মুখটা পুরো “হা” শেইপ করে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইলো আমার দিকে।
আমি সরাসরি ছেলের দিকে না তাকিয়েও চোখের সীমানা যতদূর যায় তা থেকে এটা বেশ বুঝতে পারছি যে ছেলে হা করে আমার দিকে চেয়ে আছে।
কে এই ক্যাবলাকান্ত দেখার জন্য আমিও একবার ছেলের দিকে আড়চোখে তাকালাম। ছেলে সাদা পাঞ্জাবি পড়েছে, গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। পুরো ক্লিন সেইভ করায় মুখটা পুরো ছিলা মুলোর মতো লাগছে। চুলগুলো কোকড়া নাকি সিল্কি তা বোঝার অবকাশ নেই। কারণ ছেলে মনে হয় স্কুলে পড়াকালীন স্যারদের বলা সেই কঠিন নিষেধাজ্ঞা মেনে চুল কেটে এসেছে। নিষেধাজ্ঞা টা ছিলো কিছুটা এরকম, ” চুলের মাঝে আঙুল চালালে যদি চুল অাঙুল ভেদ করে উপরে উঠেছে তো তোদের ঠ্যাং একেবারে ভেঙে ফেলবো!”
.
এর থেকে আর বেশি আর কিছু দেখলাম না। জাস্ট ১ সেকেন্ডের দেখায় যেটুকু বুঝলাম ছেলে মায়ের আদরের দুলাল। কিছুটা মায়ের আঁচল ধরে ঘুরে বেড়ানো টাইপ। যেমন ধরা যায়, তার মা তাকে এখানে কান ধরে উঠবস করতে বললে এক কথায় রাজি হয়ে উঠবস করতে শুরু করতেও দুবার ভাববে না। এসব ছেলেরা সকলের কাছে ভালো, শিক্ষিত, নম্র-ভদ্র হলেও তাদের বউদের কাছে ভীষণ বিরক্তির এক একটা ডিব্বা হয়।
প্রতিটা কাজেই মায়ের পারমিশন গ্রহন করতে করতে একসময় বউ কিস করতে বললেও যেনো মায়ের কাছে পারমিশন নিতে যাবে এমন টাইপ। যার দরুন তারা তাদের বউদের কাছে মাত্রাতিরিক্ত প্যারাময় হয়ে থাকে।
.
ছেলের মা হঠাৎ আমায় মাথা থেকে কাপড় সরিয়ে চুল খুলে দিতে বলায় আমি কিছুটা আনইজি ফিল করতে লাগলাম। এভাবে কারো কথায় বাঁধা চুল খোলা যায় নাকি? আমি ভ্রু কুঁচকে নিত্য আপুর দিকে তাকাতেই কানে ভেসে আসতে লাগলো সেই চিরচেনা প্রাণ জুড়িয়ে যাওয়া কন্ঠ।
নীবিড় ভাইয়া কানে হেড ফোন গুঁজে ফোনের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকেই ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলেন,
.
—- কেন বে? তুই তোর বউকে দিয়ে হেয়ার ওয়েলের এডভারটাইসমেন্ট করাবি নাকি?
.
উনি যেভাবে ফোনের দিকে চেয়ে কথাগুলো বললেন তাতে সেটা স্পষ্ট উনি ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করেই কথাগুলো বলেছেন। কিন্তু এতোটা কাকতালীয় কি করে হতে পারে?
নীবিড় ভাইয়ার এমন কথা শুনে ভদ্র মহিলার সাথে তার হাজবেন্ড আর ছেলে দুজনেই ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলো।
এদিকে রুশো ভাইয়া আর অগ্নি ভাইয়ার তো কাশিই উঠে গেলো! কিন্তু নিত্য আপু ভাবলেশহীন! আপুকে এতোটা স্বাভাবিক দেখে মনে হচ্ছে আপু যেনো আগে থেকেই জানতো এমন কিছু একটা হবে।
.
পেট মোটা আংকেলটা গলা খাঁকারি দিয়ে উঠায় ভদ্র মহিলা ততক্ষণাত প্রসঙ্গ পাল্টে আবারও বলে উঠলেন,
—- আচ্ছা মা, তুমি রান্না করতে পারো?
.
ভদ্র মহিলার এই কথার জবাবে আমার ঠিক কি বলা উচিত এই মুহূর্তে তা একেবারেই বুঝে উঠতে পারছিনা আমি। এভাবে কি সত্যিটা মুখের ওপর বলে দেবো যে “আমি চা পর্যন্ত বানাতে পারিনা?”
আমি মুখফুটে কিছু বলবো তার আগেই আবারও নীবিড় ভাইয়া ফোনের ওপাশের ব্যক্তির সাথে কথা বলতে বলতে বলে উঠলেন,
.
—- ওহ বুঝেছি, তুই তোর বউকে মাস্টার শেফ ইন্ডিয়ায় পার্টিসিপেট করানোর জন্য রান্না শিখাচ্ছিস!
কত্তো সেয়ানা তুই বাপরে…!
.
এবার আমি ভাইয়াদের সাথে নিজেও কাশতে শুরু করে দিলাম। টেবিলে থাকা পানির গ্লাস হাতে নিয়ে কয়েক ঢোক খেয়ে নিয়ে গলাটাকে ভিজিয়ে নিলাম।
ভদ্র মহিলা এবার ভীষণ বাজেভাবে ভরকে গেছেন।
হঠাৎ উনার পাশে বসে থাকা উনার ছেলে মায়ের গা ঘেষে বসে নরম গলায় বলে উঠলো,
.
—- ওহ মা! বাসায় তো রান্না করার লোক রয়েছে। ওকে রান্না করতে হবে না তো!
.
ভদ্র মহিলা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলেন “হ্যা তো বাবা! রান্না বান্না করার কোনো দরকার নেই বৌ মার!”
এবার উনি আবারও আমার দিকে চেয়ে আহ্লাদী কন্ঠে প্রশ্ন করে উঠলেন,
.
—- আচ্ছা মা তুমি গান গাইতে পারো?
.
মহিলার প্রশ্ন শুনে কপাল কুঁচকে এলো আমার সাথে জমা হলো আরোও এক রাশ বিরক্তি!
গান গাইতে পারি কিনা সেটাও মেয়ে দেখতে এসে কেউ জিজ্ঞেস করে?
আমার ভাই এতো ভালো গান গায়। স্টেজ প্রোগ্রাম ও করে মাঝেমাঝে তার বোন হয়ে আমি গাইতে পারবো না এমনটাও তো না তাই দাঁতে দাঁত চেপে কেবল “হ্যাঁ” বলতে যাবো তার আগেই নীবিড় ভাইয়া আবারও হাসতে হাসতে ফোনের ওপাশের ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
.
—- ওহোহো! আচ্ছা আচ্ছা বুঝলাম। তুই তোর বউকে সারেগামাপায় অডিশন দেওয়াতে চাস! বাহ বউয়ের ট্যালেন্ট কে সোর্স বানিয়ে তো ভালোই ইনকাম করবি তাহলে!
.
ভদ্র মহিলা এবার পড়লেন মহাবিপদে! তার করা প্রতিটা প্রশ্নের সাথে নীবিড় ভাইয়ার ফোনের ভিডিও কলে কথা বলা ব্যক্তির কথার সাথে এতোটা মিলে যাচ্ছে কিভাবে! আর কি বাজে ভাবেই না উনাকে অপমানিত হতে হচ্ছে তা ভেবেই চরম বিরক্ত উনি।
.
তাই সিন্ধান্ত বদলে উনি চুপ করে রইলেন। এর মাঝে পেট মোটা আংকেল আমায় প্রশ্ন করলেন,
—- তুমি তো এবার রাজশাহী ভার্সিটিতে কেমেস্ট্রিতে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছো তাইনা?
.
আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতেই আবারও নীবিড় ভাইয়া গলা ছেড়ে দিয়ে হাসতে হাসতে ওপাশের ব্যক্তিকে বলে উঠলেন,
—- উফফ….! তুইও না আস্ত একটা বলদ! সব জেনে শুনে আবার কুয়েশ্চন করিস! ডাফার!
.
এবার পেট মোটা ভূরি ওয়ালা গোপ বিশিষ্ট আংকেল ও পুরো ঘেটে গেলেন। বলার মতো আর কিছুই খুঁজে পাচ্ছেন না যেনো। রুশো ভাইয়া আর অগ্নি ভাইয়া তো হাসি কন্ট্রোলে রাখার সব উপায়ই এপ্লাই করে ফেলেছে তবুও শেষমেশ হাসির কাছে পরাজিত হয়ে দুজনেই উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। অগ্নি ভাইয়া ঠোঁট চেপে ধরে বলে উঠলো,
“আংকেল আন্টি আপনারা কথা বলুন, আমরা একটু আসছি!”
বলেই এক ছুটে বেড়িয়ে গেলো দুজনে।
বুঝতে পারছি এখন ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে হাসির বন্যা বইয়ে দেবে দুটোয় মিলে।
.
আব্বু ফোনে কথা বলা হয়ে গেলে সোফায় এসে বসতে বসতে বলে উঠলো,
—- একি, আপনারা এখনো কিচ্ছু মুখে দেন নি কেনো? খান।
.
ছেলের মা বাবা সৌজন্যের হাসি দিয়ে মিষ্টি মুখে নিয়ে খেতে লাগলেন। এদিকে ছেলে শুধু আমার দিকেই চেয়ে আছে যেটা বড্ড বিরক্ত করছে আমায়। আজব! এভাবে কেউ ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকলে অস্বস্তি তো হবেই তা কি এই মাথা মোটা মেডিকেল পাশ ডাক্তার জানে না? ইচ্ছে তো করছে ব্যাটার মাথায় বারি মেরে দুভাগ করে ফেলি।
.
আম্মু আরোও কিছু নাস্তা এনে টেবিলে রেখে বসতে বসতে কিছু মনে পরায় বলে উঠলো,
—- এই রে জুসের গ্লাস গুলো তো আনাই হলো না।
.
নিত্য আপু আম্মুকে বসতে বলে “আমি নিয়ে আসছি মামনি, তুমি বোসো!” বলেই মুচকি হেসে কিচেনের দিকে পা বাড়ালো।
.
একটু পরই আপু জুসের গ্লাসগুলো ট্রে তে এনে রাখলো। সাথে রুশো ভাইয়া আর অগ্নি ভাইয়াও এসে হাজির হলো।
দুজনের মুখের লাল টকটকে ভাব। ভাবা যায় কতোটা হেসেছে বলে লাল হয়ে গেছে! উফফফ….! এরা পারেও! শুধু মাঝখান থেকে চিপায় পড়লাম আমি। সং সেজে এই বিরক্তিকর পরিবেশে বসে রয়েছি। একটু নড়বারও বিন্দু মাত্র অবকাশ নেই আমার। ওদিকে নীবিড় ভাইয়া তো মনের সুখে গেমস খেলায় আবারও ডুব দিয়েছেন। উনার মাথায় ঠিক কি চলছে তা উনার ভাব ভঙ্গি দেখে বোঝা বড় দায়।
.
🍂
.
এই পর্যন্ত আম্মু ছেলেকে নিয়ে যা যা প্রশ্ন করেছে তার প্রত্যেকটার জবাব ছেলের মা দিয়েছে। ছেলে একদম চুপচাপ, লজ্জায় লাল হয়ে বসে আছে। কতটা ইরিটেটিং ভাবলেই গা জ্বলে যাচ্ছে আমার। উনাদের খাওয়া শেষে নিত্য আপু একে একে সবার হাতে জুসের গ্লাস তুলে দেওয়ায় সময় ছেলে লজ্জামাখা কন্ঠে বলে উঠলো,
.
—- উনাকেও দেন আপু!
.
ছেলে উনাকে বলতে যে আমায় বুঝিয়েছে সেটা তো স্পষ্ট কিন্তু এখন কথা হচ্ছে আমার জুস খেতে না জুসের ট্যাংকিতে এই হ্যাবলাকান্ত টাকে চুবাতে ইচ্ছে করছে। নিত্য আপু মুচকি হেসে মাথা নাড়ালো।
ছেলের হাবভাব দেখে রুশো ভাইয়া আমায় আস্তে করে খোঁচা মেরে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
.
—- হেই ছুটকি, দেখ আমাদের উডবি কান্টুস দুলাভাই কত্তো কেয়ারিং। দুলাভাইয়ের গালগুলো দেখ, লজ্জায় পুরো আলুর মতো হয়ে গিয়েছে।
.
আমি চোখ ছোট ছোট করে বিরক্তিমাখা কন্ঠে বলে উঠলাম,
—- রুশো ভাইয়া, কেউ লজ্জা পেলে তার গাল আলুর মতো হয় না। টমেটোর মতো লাল হয়।
.
রুশো ভাইয়া মাথা চুলকে ধীর কন্ঠে বলে উঠলো,
—- ওহ তাই বুঝি! তবে মিষ্টি আলু তো দেখতে লাল! দেন দুলাভাইয়ের নতুন নাম “মিষ্টি আলু দুলাভাই!”
রুশো ভাইয়ার দেওয়া এমন অদ্ভুত নাম শুনে আমি সবার আড়ালে ফিক করে হেসে দিলাম।
অগ্নি ভাইয়া মুখ চেপে “আরে ভাই আর হাসাস না প্লিজ!”
বলে আবারও মুখ টিপে হেসে উঠলো।
.
🍁
.
—- মা! আমার না ইয়ে পেয়েছে! কি করবো?
.
ছেলের কথা শুনে ভদ্র মহিলা আম্মুর দিকে তাকিয়ে জোড়পূর্বক হেসে একটু ইতস্তত বোধ করে বলে উঠলেন,
—- বলছিলাম বেয়াইন, ওয়াশরুমটা কোনদিকে?
.
আম্মু কিছুটা অবাক হয়ে মুখে স্বাভাবিকতা ফুটিয়ে তুলেই হাতের ইশারায় দেখিয়ে বললো “ওইযে ওদিকটায়।”
ভদ্র মহিলা ছেলেকে সাথে নিয়ে উঠতে যাবে তার আগেই রুশো ভাইয়া উঠে দাঁড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে বলে উঠলো,
.
—- আরে আন্টি আপনি চাপ নেবেন না, আমি দুলা ব্রো কে নিয়ে যাচ্ছি! উপপস সরি দুলা ভাইকে নিয়ে যাচ্ছে।
.
বলেই ছেলের হাত ধরে বিভিন্ন কথায় ভুলিয়ে ভালিয়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো রুশো ভাইয়া।
.
৫ মিনিড় পার হওয়ার পরও ছেলে ওয়াশরুম থেকে বের না হওয়ায় ভদ্র মহিলা আর তার হাজবেন্ড তাদের চোদ্দগুষ্টির গল্প জুড়ে দিয়ে সময় কাটাতে উঠে পড়ে লাগলেন।
আর আমি এদিকে ভাবছি ছেলের প্রেস্টিজ বলে কিছু আছে না নেই! মেয়ে দেখতে এসে টয়লেটে ঢুকে বসে আছে! তবে যাই হোক আমার বেশ হাসি লাগছে এসব কান্ড কারখানায় তবুও অভাগা আমি হাসার বিন্দুমাত্রও সুযোগ পাচ্ছিনা।
.
🌸
.
১৫ মিনিট পাড় হয়ে গিয়েছে। রুশো ভাইয়া দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে এসে সোফায় বসে পড়লো। অগ্নি ভাইয়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই রুশো ভাইয়া দাঁত কেলিয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
.
—- মিষ্টি আলুর পেটে মেইবি “ভুটুর-ভাটুর” প্রসেস অন হয়ে গিয়েছে!
.
রুশো ভাইয়া আমার পাশেই বসে থাকায় কথাটা আমার কানের এসে পৌঁছোতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না। তবে তার কোনো অর্থ বুঝতে না পারায় আমি সরু চোখে তাকাতেই রুশো ভাইয়া গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলো,
.
—- ইয়ে মানে নিউ হুলাভাই থুক্কু দুলাভাইয়ের মেইবি লিকুইড পটি হচ্ছে!😅
.
রুশো ভাইয়ার কথা শেষ হতেই অগ্নি ভাইয়া ঠোঁট চেপে উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেললো। এদিকে আমি দাঁত দিয়ে ঠোঁট যথাসম্ভব চেপে ধরে হাসিটাকে নিয়ন্ত্রণ করার যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। শেষমেশ ব্যর্থ হয়ে মাথা থেকে শাড়ির আঁচলটা মুখের সামনে টেনে বড় করে ঘোমটা দিয়ে নিলাম। “লিকুইড পটি!” শব্দটা বারবার কানে বাজছে আমার। রুশো ভাইয়ার মুখে কি কিছুই আটকায় না? উফফফ……! মন খুলে হাসতে না পেরে কখন যে পেটে আটকে রাখা হাসির বোম্ব ফেটে যাবে ঠিক নেই।
.
পুরো ২০ মিনিট পর ছেলে পা টিপেটিপে এসে নিজের মায়ের পাশে টুপ করে বসে পড়লো। আমি একবার আড়চোখে নীবিড় ভাইয়ার দিকে তাকাতেই দেখলাম উনি বাম সাইডের ভ্রু উঁচু করে ঠোঁটে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে রেখে ল্যাপটপে কি যেনো করছেন! এর মধ্যে ফোন ছেড়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছেন উনি!
এদিকে যে এতো কান্ড হয়ে যাচ্ছে তাতে কোনো মাথা ব্যথাই যেনো নেই উনার।
নিহাম এসে মুখটা বাংলার পাচের মতো করে তার মায়ের কানে কিছু একটা বলতেই ভ্রু কুঁচকে এলো উনার। উনি নিহাম কে চুপ করে থাকতে বলে আম্মু আব্বুকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
.
—- আচ্ছা বলছিলাম বেইয়াইন মেয়ে তো আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে। আপনাদের নিহামকে পছন্দ তো?
.
বিনিময়ে আম্মুকের কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আব্বু হেসে বলে উঠলো,
—- ছেলে তো মাশাল্লাহ নম্র-ভদ্র, শিক্ষিত! আমাদের বেশ পছন্দ হয়েছে ওকে।
.
—- আচ্ছা তাহলে ছেলেমেয়েকে একসাথে একটু আলাদা কথা বলতে পাঠালে ভালো হতো! উনার অফিসের কাজ ও আছে তাড়াতাড়ি যেতে হবে আমাদের। (জোড়পূর্বক হেসে)
.
আব্বু আমায় নিহামকে নিয়ে আমার ঘরে যেতে বলবে তার আগেই নিহাম চট করে দাঁড়িয়ে চোখ মুখ খিঁচে “আমি একটু আসছি!” বলেই ছুট লাগালো ওয়াশরুমের দিকে। আমরা সবাই ছেলের এভাবে দৌড়ে টয়লেটে যাওয়া দেখে কিছুক্ষণ আহাম্মক বনে রইলাম। নিহামের বাবা-মা তো ছেলের কান্ডে চরম লজ্জিত। কি বলবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না।
.
এই ফাঁকে রুশো ভাইয়া আবারও ফিসফিসিয়ে আমায় বলে উঠলো,
—- ওহ নো! এর তো দেখি স্ক্রু বল্টু সব ঢিলা!
.
পরিপ্রেক্ষিতে অগ্নি ভাইয়া ঠোঁট চেপে বলে উঠলো,
—- ঠিকই বলেছিস রুশো! ব্যাটার লিকুইড পটিই হয়েছে!
.
আমি বিনিময়ে কিছু বললাম না রুশো ভাইয়ার হাতে একটা চিমটি কেটে চুপ করতে বললাম শুধু।
একটু পরই নিহাম ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এলো তাও হাঁপাতে হাঁপাতে! এসেই মায়ের আঁচল ধরে ইশারা করলো তাড়াতাড়ি বাড়ি যাওয়ার জন্য। কিন্তু মহিলা তো নাছড়-বান্ধা! উনি আজই সব ফাইনাল করে তবেই যাবেন। এদিকে আম্মু-আব্বু নিজেদের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে শুধু!
মাঝখান থেকে যে চুপ থেকেই সবথেকে বেশি মজা নিচ্ছে সে হলো নিত্য আপু। হাসি চাপিয়ে রাখার অসম্ভব ধরণের ক্ষমতা আছে আপুর।
আপু পরিস্থিতি বুঝে রিয়াক্ট করতে পারে যেটা আমরা তিন ভাই বোন আজন্মেও পারবোনা!
.
মহিলার জোড়াজুড়িতে না চাইতেও মুখ কাচুমাচু করে নিহাম উঠে দাঁড়ালো। আম্মুর কাছে নিহামের হাবভাব স্বাভাবিক না ঠেকায় প্রশ্ন করে বসলো,
—- নিহাম বাবা, তুমি ঠিক আছো? কোনো সমস্যা হলে আমাদের বলতে পারো।
.
নিহাম জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলে উঠলো,
—- না আন্টি ঠিক আছি আমি! (আমার দিকে তাকিয়ে) জ্বি একটু তাড়াতাড়ি চলুন প্লিজ!
.
মুহূর্তেই আমার মেজাজ আগের থেকে আরো বেশি বিগড়ে গেলো। শুধু মাত্র ভদ্রতার খাতিরে আমি চুপ করে আছি। তা নাহলে এতোক্ষণে ব্যাটার মেইন পয়েন্টে হিট করে দিয়ে উল্টে ফেলে দিতাম। শালা বিয়ে করার খুব শখ তাইনা? আমার এতো সুন্দর সুইট কিউট এক্সিডেন্টলি বর থাকতে আবার বিয়ে করবো নাকি?অবশ্য তোকে টাইড দেওয়ার সুযোগ যখন পেয়েছি তখন আর হাতছাড়া করা যাবে না। চল একবার ঘরে, নারীশক্তি কাকে বলে দেখাচ্ছি!
কথাগুলো মনে মনে ভেবেই উঠে দাঁড়ালাম।
তবে বেশি দূর যেতে হলো না। সিঁড়ির কাছে পৌঁছোতেই ছেলের আবারও লিকুইড পটি পেয়ে গেলো। আমাকে একলা রেখে কিছু না বলেই এক দৌড়ে টয়লেটে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো নিহাম! আমার মনে মনে আফসোস হতে লাগলো এই ভেবে যে ইশশ…লাথিটা মারতে পারলাম না।
সবাই এবার রীতিমতো অবাক হয়ে গেলো! নিহাম কে তৃতীয়বার টয়লেট যেতে দেখে সবাই বিস্ময়ে একসাথে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।
.
—- ছেলের আমার কি হলো হঠাৎ? এই নিহামের বাবা গিয়ে দেখো না!
.
ভদ্র মহিলার কথায় নাহিন আংকেল এগিয়ে এসে বাথরুমের দরজায় নক করতে লাগলেন।
—- নিহাম, তুই ঠিক আছিস? কি হয়েছে? এতো ঘন ঘন বাথরুমে যাচ্ছিস কেনো?
.
রুশো ভাইয়া ঠোঁট উল্টে বললো,
—- আরে আংকেল এটা আবার বলা লাগে? লিকুইড পটি হচ্ছে! পেট খারাপ হয়েছে উডবি দুলাভাইয়ের!
.
রুশো ভাইয়ার কথায় আমি লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেললাম! বাড়ির বড়দের সামনেই এভাবে বললো ভাইয়া! ইশশশ…..! কে কি ভাবলো ভেবেই হাসির সাথে লজ্জার সংমিশ্রণ ঘটিত রিয়াকশন হচ্ছে আমার।
নিহাম ওয়াশরুমের দরজা খুলে এদিক ওদিক না তাকিয়েই সোজা তার মায়ের কাছে গিয়ে রেগেমেগে বললো,
.
—- মা….! দেখলে কি হলো? আজ আর তোমার কথা শুনবো না আমি! আমি গেলাম। তুমি থাকলে থাকো না থাকলে চলো। আমি বাসায় যাবো…..!
.
বলেই গটগট করে হেটে মেইন গেইট খুলে রাত্রিকে পাশ কাটিয়ে বেড়িয়ে গেলো নিহাম। নিহামের পেছন পেছন নাহিন আংকেলও ছুটলো! নিহামের মা আম্মুকে “প্লিজ কিছু মনে করবেন না! ছেলেটার হঠাৎ এমন হবে বুঝতে পারিনি আমরা! সো সরি!” বলেই দৌড় লাগালেন ছেলের পেছন পেছন! রাত্রি বাসায় ঢুকতে ঢুকতে অবাক হয়ে বলে উঠলো,
.
—– একি হলো? আমি আসতে না আসতেই পাত্রপক্ষ হুড়মুড় করে চলে গেলো কেনো?
.
রাত্রির কথার কেউই কোনো জবাব দিতে পারলাম না আমরা। কারণ এতোক্ষণ যা যা ঘটলো তার পরিপ্রেক্ষিতে কি রিয়াকশন দেওয়া উচিত তা জানা নেই আমাদের।
নীরবতা ভেঙে রুশো ভাইয়া বলে উঠলো,
.
—– আর বলো না এটম বোম্ব! এই কান্টুস উডবি হুলা ব্রোর পেট ভালো না। এতো ভালো ভালো খাবার খেয়ে কি না লিকুইড পটি শুরু হয়ে গেছে মিষ্টি আলুর! শেষমেশ আর সহ্য না করতে পেরে পালিয়ে গেলো বুঝলে!হুহ দ্যটস নট ফ্যায়ার!
আংকেল, মনি আমরা পেট পঁচা দুলাভাই নেবো না। নাহলে দেখা যাবে বিয়ের দিন একটু পোলাও মুখে দিতেই টয়লেটে গিয়ে বসে থাকবে। বিয়ে আর ২৪ ঘন্টায়ও হবে না।
.
রুশো ভাইয়ার কথা শেষ হতে না হতেই সাদা বিলাই ল্যাপটপটা আস্তে করে টেবিলের ওপর রেখে একটু নড়েচড়ে বসে হু হা করে ঘর কাঁপিয়ে হাসা শুরু করে দিলেন।
হাসতে হাসতে এক পর্যায়ে পেট চেপে ধরে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাওয়া শুরু করে দিলেন উনি।
এবার নীরবতার পর্দা ভেদ করে হাসতে হাসতে সোফায় ধপ করে বসে পড়লো নিত্য আপু!
দেখা গেলো একে একে সবাই হাসা শুরু করে দিলো শুধু আমি আর আব্বু বাদে। এমনকি আম্মুও হাসতে হাসতে কান্না করে ফেলছে!
এদিকে রুশো ভাইয়া অগ্নি ভাইয়া তো হাসতে হাসতে একে ওপরের ওপর উল্টে পড়ছে! আর আমি শুধু বোকার মতো চেয়ে চেয়ে সবার উল্টা উল্টি দেখছি! কতো বড় আহাম্মক আমি! হাহ!
.
চলবে…………….💕
#প্রেম_আমার♥
#পার্ট-৪০♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥
.
🌺
.
—- এতোক্ষণ যা যা হলো তার সবটাই আপনার প্লানিং অনুযায়ী হয়েছে তাইনা?
.
নীবিড় ভাইয়া এবারেও কপালে বিরক্তির ভাঁজ ফেলে নিঃসংকোচে অস্বীকার করে গেলেন। ভাবখানা এই যে যখন এসব ঘটছিলো তখন উনি বোধহয় মঙ্গল গ্রহে অবস্থান করছিলেন।
আমি আবারও হতাশ হয়ে এবার ভ্রু কুঁচকে অগ্নি ভাইয়ার দিকে তাকালাম। অগ্নি ভাইয়া সাথেসাথেই ঠোঁট উল্টে জানান দিলো এসবের সাথে বিন্দুমাত্রও যোগসূত্র নেই তার। আমি অগ্নি ভাইয়ার থেকে চোখ সরিয়ে রুশো ভাইয়ার দিকে তাকাতেই ভাইয়া মুখ বাকিয়ে “প্রশ্নই আসে না!” বলে চালিয়ে দিলো।
এবার বাকি থাকলো শুধু নিত্য আপু, কারণ রাত্রি তো সবে এলো। আমি নিত্য আপুকে কিছু জিজ্ঞেস করবো তার আগেই নিত্য আপু হাত উঠিয়ে বলে উঠলো,
.
—- হেই এটেনশন প্লিজ। এটা সম্পূর্ণ আমার প্লান। আচ্ছা তোমরাই বলো আমি কি করে ভাবি হয়ে নিজের ননদকে অন্য ঘরে পাঠানোর সুযোগ করে দেই?
.
নীবিড় ভাইয়া বাদে সবাই এক সুরে বলে উঠলো,
—- হুম, ঠিক।
.
নিত্য আপু আবারও বলতে শুরু করলো,
—- এক্সাক্টলি! তাই তো সুযোগ বুঝে একটা জুসের গ্লাসে ইচ্ছেমতো সোডা মিশিয়ে দিয়েছি। আর সেটাই গিয়ে ওই ভোলাভালা চাশমিশ টাকে খাইয়ে দিয়েছি! বেশ হয়েছে! আমার একমাত্র ননদ প্লাস ভাবীকে বিয়ে করতে আসা তাইনা? ইচ্ছে তো করছিলো সামনে রাখা কাটা চামচ দিয়ে চোখ দুটো ফুটো করে দেই! হুহ!
.
নিত্য আপুর মুখের এমন ধরণের কথায় হকচকিয়ে উঠলাম আমি। আমার মতে নিত্য আপু খুবই শান্তশিষ্ট নম্র ভদ্র! আপুও যে এসব ভাবনা মনে মনে পুষে রেখে বাইরে স্বাভাবিকতা ফুটিয়ে রাখে তা দেখে একেবারেই বোঝা যায় না। এবার নিত্য আপুকে নীবিড় ভাইয়ার বোন বলে মনে হচ্ছে আমার। দুজনই বাইরে ফিটফাট কিন্তু ভেতরে জট পেচিয়ে কুঁপোকাত!
আশেপাশে একবার আড় চোখে দেখে নিতেই অগ্নি ভাইয়া, রুশো ভাইয়া আর রাত্রির মুখটা চোখে ভেসে উঠলো। আমার মতো তাদেরও ঠিক একই অবস্থা! এতোকিছুর মাঝে শুধু নীবিড় ভাইয়া স্বাভাবিক! অবশ্য স্বাভাবিক থাকাটাও বড্ড স্বাভাবিক। কারণ নিজের বোনকে উনার থেকে বেশি আর কেই বা চিনে!
.
নীরবতা ভেঙে রুশো ভাইয়া দুহাতে তালি বাজিয়ে বিস্ময়ে বলে উঠলো,
—- ওত্তেরি! ভাবি দেখি গভীর জলের মাছ! যাই বলো ভাবি, তুমি কিন্তু জাস্ট ফাটিয়ে দিয়েছো! একদম লিকুইড পটি করে ছাড়িয়েছো কান্টুসটাকে! ওয়াহ!
.
বলেই হাই ফাইভ করার জন্য রুশো ভাইয়া হাত উঠালো। নিত্য আপু হেসে দিয়ে রুশো ভাইয়ার সাথে হাই ফাইভ করে আরাম করে বিছানার ওপর ধপ করে বসে পড়লো।
আমি অবাক চোখে আপুর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,
.
—- আপুউউ…! তুসসি গ্রেট হো! কতো সুন্দর করে টুপ করে বিয়েটা ভেঙে দিলে আমার! আম জাস্ট স্পিচলেস!
.
অগ্নি ভাইয়া ঠোঁট উল্টে বলে উঠলো,
—- নিত্য! তুমি আমায় বললে না কেনো বলোতো? আমি নাহয় আরো একটু হেল্প করতাম। আর সব তোমরা দুটোয় মিলে করলে কেনো আমাদের শুধু সান্ত্বনা দিয়ে রেখে?
.
নিত্য আপু অগ্নি ভাইয়ার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার বদলে কাশতে শুরু করে দিলো। রাত্রি বেড টেবিলে থাকা পানির গ্লাস নিয়ে আপুকে দিতেই ঢকঢক করে পুরো গ্লাস শেষ করে ফেললো আপু।
গলা খাকারি দিয়ে আপু বললো,
.
—- আমি একাই সব করেছি অগ্নি। কারোর হেল্প লাগে নি আমার।
.
অগ্নি ভাইয়া জ্বিবে কামড় দিয়ে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলে উঠলো,
—- ও হ্যাঁ, তাইতো! একদম ভুলে গিয়েছিলাম।
.
নিত্য আপু অগ্নি ভাইয়াকে ভেংচি কেটে দিলো।
আর আমি শুধু বোকার মতো চেয়ে চেয়ে দেখছি সবার কার্যকলাপ।
একটু পরই আম্মু হন্তদন্ত হয়ে দরজায় নক করতে লাগলো।
আমি সবাইকে থামতে বলে দরজা খুলে দিতেই আম্মু তাড়াহুড়ো করে ঘরে ঢুকে পড়লো। আম্মুকে এতো সিরিয়াস দেখে সবাই বসা থেকে উঠে পড়লো।
.
—- মনি, হোয়াট হ্যাপেন্ড?
.
—- কি হয়েছে আম্মু? তোমাকে এমন দেখ
আম্মু হাঁপাতে হাঁপাতে একটু শান্ত হয়ে বললো,
.
—- তোদের দিদুন ফোন করেছিলো রে। হবু নাত বউ কে দেখতে চায়। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহেই যেতে বলেছে। আর তোরা তো জানিস তোদের দিদুনের মুখের ওপর কারোও কিছু বলার সাহস নেই। তাই যেতে হবে সবাইকে। না জানি নিত্য কে কতোভাবে পরীক্ষা করে এই ভয়ে আমার টনক নড়ে উঠছে। উনি যে কঠিন মানুষ!
.
অগ্নি ভাইয়ার দিদুনের নাম শুনেই অলরেডি হাটু কাঁপা শুরু হয়ে গিয়েছে। আর এদিকে আমার গলা শুকিয়ে আসছে। দিদুন আমাদের ভীষণ ভালোবাসলেও চূড়ান্ত স্ট্রিক্ট স্বভাবের একজন মানুষ। একটু চুন থেকে পান খসলেই পুরো এলাহি কান্ড বাঁধিয়ে ফেলে।
.
—- হেই মনি, ইনি তো সেই যিনি আমায় না বলে আম পারার জন্য লাঠি নিয়ে তাড়া করেছিলো তাইনা?
.
আম্মু মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলতেই রুশো ভাইয়ার কাশি উঠে গেলো। কাশতে কাশতে জগ থেকে গ্লাসে পানি ভরে নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো রুশো ভাইয়া।
.
—- ওহ নো মনি, শি ইজ ভেরী ডেঞ্জারাস! যাওয়াটা কি খুব জরুরী? আমি না গেলে হয় না?
.
ওমনি অগ্নি ভাইয়া রুশো ভাইয়ার মাথায় চাটি মেরে ঘাড়ে হাত দিয়ে বলে উঠলো,
—- ফাজিল, আমাদের একা বিপদে ফেলে তুই কোথায় পালাচ্ছিস! তুই ও যাচ্ছিস এটা ফাইনাল। আন্টি আংকেল কে আমি ম্যানেজ করে নেবো।
.
এবার নীবিড় ভাইয়া নড়েচড়ে বসে শান্ত গলায় বলে উঠলেন,
—- মামনি এতো চিন্তার কি আছে? দিদুন যখন যেতে বলেছে হবু নাত বউ কে দেখবেই তখন যাবো আমরা। আর নিত্য তুই একটু সাবধানে থাকবি। কোনো ভুল ত্রুটি যেনো না হয় তাহলেই হয়ে গেলো।
.
নিত্য আপুও নীবিড় ভাইয়ার কথায় শায় দিয়ে মাথা নাড়ালো। আর আমি ভাবছি রাত্রিকেও বেঁধে নিয়ে যাবো। ওখানে গেলে নিম্নে সপ্তাহখানেক এর আগে নিশ্চয় আসতে দেবে না দিদুন। আর এতোগুলো দিন রাত্রিকে ছাড়া থাকা জাস্ট ইম্পসিবল। তাই আমি রাত্রি কাছে গিয়ে ওর হাত টেনে ধরে বলে উঠলাম,
.
—- তুইও আমাদের সাথে যাবি কিন্তু। কোনো না শুনবো না আমি। তোর বাসায় আমার কথা একবার বললেই তোকে যেতে দেবে আন্টি। সেখানে তো আমাদের পুরো পরিবার যাচ্ছে। না করার কোনো প্রশ্নই আসে না।
আম্মুউউ আমরা রাত্রিকেও নিয়ে যাই প্লিজ!
.
আম্মু নিশ্চিত হয়ে বলে উঠলো,
—- এতে আবার জিজ্ঞেস করার কি আছে? রাত্রিও যাক। বগুড়ার পরিবেশ দেখুক ভালো লাগবে ওর।
.
রাত্রি আবারও না করবে তার আগেই আমি ওর পেটে চিমটি কেটে দিলাম। বেচারি শেষমেশ চিপায় পরে রাজি হয়ে গেলো।
.
🍂
.
আজ বগুড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছি আমরা সবাই৷ তবে আজ নিজস্ব কারে যাচ্ছিনা আমরা, ইভেন রাজশাহী থেকে বাসে যাওয়া গেলেও বাস নামক উল্টির উৎস কে আমি বা ভাইয়া কেউই চুজ করি নি। এক কথায় জার্নি নামক ভয়ংকর জিনিসটা আমরা দুই ভাই বোনের কেউই ঠিক নিতে পারিনা। সামান্য কারে বসে ২ ঘন্টার জার্নিতেই উল্টি প্রসেস অন হয়ে যায় আমার। অগ্নি ভাইয়াও বেশিক্ষণ বাস বা কারে জার্নি করতে পারে না। তাই মোস্ট অফ দ্য টাইম বাসায় প্রাইভেট কার থাকা সত্ত্বেও বাইক নিয়ে ঘুরে বেরায়! রুশো ভাইয়ারও আগে আমাদের মতোই উল্টা উল্টি হতো তবে ইউএস যাওয়ার পর থেকে এখানে সেখানে ফ্লাইটে, কারে করে যেতে যেতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। আর রইলো নিত্য আপু আর নীবিড় ভাইয়া, তারা তো আগে থেকেই স্ট্রং। যেকোনো পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিতে পারে খুব সহজেই তাই তাদের কোনো প্রবলেমই নেই। আবার রাত্রিও আমার থেকে এসব ব্যাপারে কয়েক ধাপ এগিয়ে। মাঝখান থেকে বিপত্তি ঘটলো শুধু আমায় আর অগ্নি ভাইয়াকে নিয়ে।
৪ ঘন্টার জার্নিতে কোনো ভাবেই আমরা কারে বা বাসে যেতে ইচ্ছুক নই। গেলে বোধহয় শহিদ হয়ে ফিরতে হবে আমাদের।
.
বগুড়ায় এয়ারপোর্ট না থাকায় ফ্লাইটে যাওয়ার প্লান ও মাঠে মারা গেলো সবার। এখন বাকি থাকলো শুধু ট্রেন নামক ফুরফুরে ভেহিকল। এক কথায় ট্রেন জার্নি কথাটা শুনা মাত্রই মনটা ময়ূরের ন্যায় নেচে ওঠে আমার। ট্রেনে আমাকে আর ভাইয়াকে ১০ ঘন্টা এক নাগারে জার্নি করালেও আমাদের কিচ্ছু হবে না। তাই অগত্যাই সবাইকে আমাদের দুই ভাই বোনের জন্য সব প্লান ক্যান্সেল করে শেষমেশ ট্রেন ধরেই যেতে হবে। রাজশাহী থেকে সোজা বগুড়া যাওয়া যাবে না তাই একেবারে সান্তাহার নেমে সেখান থেকে সিএনজি রিজাভ করে বগুড়া যেতে হবে এমনটাই কথা আছে।
.
🌸
.
আমাদের রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনে টোটাল ৫ টা প্লাটফর্ম। তার মধ্যে বর্তমানে ৩ টে প্লাটফর্মে ৩ টে ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে।
যেহেতু এটাই শেষ সীমানা, আব্দুলপুরের পরেই আমাদের রাজশাহী তবে তা বাঁকা পথে। আব্দুলপুর পার করে সোজা রেললাইন ধরে গেলে ভেরামারা। তাই এরপরে উত্তরবঙ্গের কোনো ট্রেন রাজশাহী পার করে যেতে পারে না। এখানেই শেষ হয়েছে রেলপথ তাই ট্রেন আসার জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। বরং ট্রেনই যাত্রীদের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকে। তবে সব জায়গার ট্রেনের মতো এখানে কোনোভাবেই সময়ের গরমিল হয় না। যদি ট্রেন ৩ টেয় ছাড়ার কথা থাকে তবে ঠিক ৩ টেতেই ছেড়ে দেবে। তাই সময় মেইনটেইন করেই বেরোতে হয় ২-৩ মিনিট এদিক ওদিক হওয়া মানেই ট্রেন হাওয়া। সেই হিসেবে আমরাও হাতে ১৫ মিনিট বেশি রেখে বেরিয়েছি!
.
আম্মু আব্বু আমাদের সুবিধায় ২ টো কেবিনের টিকিট বুক করেছে।
তবে সিটগুলো এমন ভাবে পড়েছে যে আম্মু আব্বু আমাদের বাচ্চাপার্টির ঠিক উল্টো দিকের কেবিনে বসেছে। আর আমরা এদিকে সামনে-পেছনে মিলে পুরো কেবিনজুড়ে বসেছি। এদিকে ৩ টে সিট আবার সামনের ৩ টে সিট মিলে আরামে আমরা ৬ জন বসতে পারবো।
ভবনা ছিলো আমরা মেয়েরা এপাশে আর ছেলেরা ওপাশে বসবে কিন্তু আমাদের সকলের ভাবনায় এক ট্যাংকি জল ঢেলে দিয়ে অগ্নি ভাইয়া আর নিত্য আপু পাশাপাশি বসার বায়না ধরেছে। তবে আমার একটাই কথা, যে যেখানেই বসুক না কেনো আমি জানালার পাশের সিট ছাড়ছি না কোনোমতেই। এটা আমার ছোট্টবেলার অভ্যেস। জানালার পাশে না সিট পরলেও ছলে বলে কৌশলে যাত্রীদের উঠিয়ে তবে আমি ক্ষ্যান্ত হই। মাঝেমাঝে উল্টি করে দেবার ভয়ও দেখাই। নিজেদের গা বাঁচাতে প্রতিবারই সিট বদলে ফেলে প্যাসেঞ্জারেরা।
.
সিট নিয়ে যখন তুমুল গন্ডগোল তখন নীবিড় ভাইয়া সবাইকে এক ধমক মেরে চুপ করিয়ে দিলো। আমাদের সামনের সিটে অগ্নি ভাইয়া আর নিত্য আপুকে বসিয়ে নীবিড় ভাইয়া আমার পাশে এসে বসে গেলেন। উনার ঠিক অপর পাশেই বসা রাত্রি। বর্তমানে রাত্রি আর রুশো ভাইয়া পরগাছার মতো মুখ ফুলিয়ে রেখেছে। তাদের মতে কাপলদের ভীরে তারা নিতান্তই কাবাবের মাঝে হাড্ডির স্বরুপ। এদিকে রুশো ভাইয়া চাচ্ছে রাত্রির পাশে বসতে কিন্তু মুখ ফুটে আর বলে হয়ে উঠছে না ভাইয়ার।
নীবিড় ভাইয়া ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমায় দাঁড়িয়ে যেতে বললেন।
হঠাৎ আমায় দাঁড়াতে বলার কোনো কারণ বুঝে উঠতে না পারায় আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
.
—- দাঁড়াবো কেনো?
.
কথা না মানায় উনি আবারও ধমক দিয়ে উঠায় চটজলদি উঠে দাঁড়ালাম আমি।
উনি রুশো ভাইয়াকে নিজের জায়গায় এসে বসতে বলে আমার বসা জায়গায় ফুসসস করে সরে এসে বসে পড়লেন। আমি অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে হকচকিয়ে বলে উঠলাম,
.
—- আরে আরে একি করছেন? আমার উইন্ডো সিটে আপনি বসলেন কেনো?
.
উনি আমার কোনো প্রশ্নের জবাব না দিয়ে হেঁচকা টান মেরে নিজের কোলে বসিয়ে দিলেন। যা দেখে সবার মুখ অটোমেটিকালি হা হয়ে গেলো। রুশো ভাইয়ার চোখ তো মনে খুলে বেরিয়ে আসবে। অগ্নি ভাইয়া নীবিড় ভাইয়ার এমন কান্ডে মুখ ঘুরিয়ে কাশতে শুরু করে দিলো। এদিক রাত্রি অবাক হয়ে গালে হাত দিয়ে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রয়েছে আমাদের দিকে সাথে নিত্য আপু ঠোঁট চেপে হেসে চলেছে। রুশো ভাইয়া রাত্রির পাশে জায়গা ফাঁকা পেয়ে ততক্ষণাৎ এক লাফ মেরে এসে বসে পরলো।
.
—- আপনি আমায় কোলে নিলেন কেনো? ছাড়ুন বলছি। যান ভাইয়ার পাশে গিয়ে বসুন।
.
—- শাট আপ অনন্যা! ওদের মাঝে আমি গিয়ে বেকার কাবাব মে হাড্ডি হতে পারবোনা। চুপচাপ বসে থাকো। তোমার উইন্ড সিট চাইতো তাইনা? তাহলে ভদ্রভাবে বসে থাকো। একদম নড়াচড়া করবা না। নাহলে নিচে বসিয়ে রেখে দেবো।
.
নীবিড় ভাইয়ার কথার রেশ ধরে রুশো ভাইয়াও দাঁত কেলিয়ে বলে উঠলো,
—- ফ্রি ফ্রি এতো আরামদায়ক সিট পেয়েছিস ছুটকি! বাহ বাহ তোর কি লাক!
.
—- ভাইয়ায়ায়ায়া…….!😤
.
ওমনি রুশো ভাইয়া চুপ করে গেলো। আমাদের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাত্রির মুখপানে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে ভাইয়া বললো,
—- হ্যালো এটম বোম্ব!
.
রাত্রি রেগেমেগে হাত উঠাতে নিলেই রুশো ভাইয়া ততক্ষণাত নিজের নাক চেপে ধরে বলে উঠল,
—- ট্রাস্ট মি! আর একবার মারলে আমার নাকটা মারা যাবে!
.
রুশো ভাইয়ার কথায় না চাইতেও ফিক করে হেসে উঠলাম আমি। অগ্নি ভাইয়া হাসতে হাসতে বলে উঠলো,
—- আরে নাক আবার কিভাবে মরে রে ভাই?
.
রুশো ভাইয়া মাথা চুলকে বললো,
—- আই ডোন্ট নো বাট নাক ফাটানোর ভয়ে এবার নাক কেটেই ফেলবো আমি। যদি ওগি এন্ড দ্য ককরোচের ওগির মতো নাক খুলে রাখার সিস্টেম থাকতো দেন আমি নাক খুলে রেখে দুষ্টুমি করা হয়ে গেলে আমার টুপ করে লাগিয়ে নিতাম।
.
রুশো ভাইয়ার এমন বোকার মতো কথায় পুরো কেবিন জুড়ে হাসির রেশ উঠে গেলো। আমি নীবিড় ভাইয়ার কোলের মধ্যে বসে থেকে হু হা করে হাসতে লাগলাম। তবে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে আমার। এভাবে কারো কোলে বসে যাওয়া যায় নাকি? আমি একটু নড়েচড়ে উঠতে নিলেই দুহাতে আমার কোমড় চেপে ধরে ঝাঁঝালো কন্ঠে উনি বলে উঠলেন,
.
—- সমস্যা কি? চুপচাপ থাকা যায় না? দেখো আমার রাতে ঘুম হয়নি। আর সকাল বেলা তো গোছগাছ আর দৌড়াদৌড়ির ওপরই কেটে গেছে। একটু শান্তি মতো বসে রেস্ট নিতে দাও। আম রিয়েলি ভেরী টায়ার্ড!
.
উনার কথায় আর কিছু বললাম না। কারণ আমার নিজেরও একই অবস্থা! সারারাত উত্তেজনায় ঘুম হয়নি আমার। উনার কোলে বসে অস্বস্তি লাগলেও এক অদ্ভুত রকমের উষ্ণতা অনুভব করছি আমি। তার সাথে চলতি ট্রেনের জানালা দিয়ে আসা গা হিম করা হিমেল হাওয়া! যা মনটাকে ছুয়ে যাচ্ছে গভীর ভাবে।
সবাই যখন আড্ডায় মত্ত তখন আমার চোখে নেমে আসতে লাগলো রাজ্যের ঘুম। অনেক চেষ্টা করেও চোখজোড়া খুলে রাখতে পারলাম না আমি। শেষমেশ ঘুমের সাথে কঠিন যুদ্ধে পরাজিত হয়ে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে গেলাম অামি নীবিড় ভাইয়ার উষ্ণ বুকে মাথা রেখেই।
আমায় নিজের বুকে গা এলিয়ে দিতে দেখে নীবিড় ভাইয়া মুচকি হেসে আমার ললাটে নিজের ওষ্ঠদ্বয় দ্বারা গভীর চুম্বন এঁকে দিয়ে মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন।
ঘুমের ঘোরে উনার স্পর্শ অনুভব করলেও চোখ খুললাম না। এতো শান্তির ঘুম সহজে পাওয়া যায়না। তাই শুধু শুধু ঘুমটা বরবাদ করে পরে আফসোস করতে চাইনা আমি।
.
—- হেই ব্রো ছুটকি তো ঘুমিয়ে পড়লো!
.
—- হুশশশশ! ঘুমোক! শরীর ক্লান্ত অনেক। ওকে জাগিয়ো না।
.
🍁
.
পিটপিট করে চোখ খুলতেই অনুভব করলাম আমি হাওয়ায় ভাসছি। আচমকা এমন অনুভব হওয়ায় হকচকিয়ে উঠলাম আমি। চোখ মেলে তাকাতেই প্রথমে চোখে পড়লো নীবিড় ভাইয়ার ক্লান্তিমাখা মুখখানা। উনি আমায় কোলে নিয়ে হাটছেন। মাথা উঁচু করে আশেপাশে চোখ বোলাতেই বুঝলাম আমরা এখন শহর থেকে ভেতরে গ্রামের কাঁচা রাস্তায় অবস্থান করছি। আমাদের সামনে অগ্নি ভাইয়া, নিত্য আপু, আম্মু-আব্বু আর পাশে রুশো ভাইয়া আর রাত্রি। রাত্রি মুখ ফুলিয়ে গটগট করে হেটে যাচ্ছে আর রুশো ভাইয়া মুখ কাচুমাচু করে লাগেজ টানতে টানতে এগোচ্ছে।
গ্রামে পৌঁছে গিয়েছি আমরা। তার মানে গত ৪ ঘন্টা যাবৎ মরার মতো ঘুমিয়েছি আমি? এটাও সম্ভব!
.
—- ভাইয়া আমাকে নামিয়ে দিন আমি যেতে পারবো।
.
আমার কথায় কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলেন উনি। সামনে তাকিয়ে হাটতে হাটতেই বলে উঠলেন,
—- এতোক্ষণ যখন পারো নি আর এইটুকু রাস্তা পারতে হবে না। এইতো চলেই এসেছি।
.
বলেই আর ৩-৪ ধাপ এগিয়ে আমায় কোল থেকে নামিয়ে দিলেন উনি। আমি আশেপাশের পরিবেশ দেখে বোঝার চেষ্টা করতে লাগলাম এখন ঠিক কটা বাজে! আকাশে সূর্যের অবস্থান দেখে অনুমান করলাম এখন বিকেল ৪ টে বেজে এসেছে প্রায়। নীবিড় ভাইয়া বেশ ভালোই ঘেমে গিয়েছেন। গায়ে থাকা শার্ট লেগে গিয়েছে উনার শরীরের সাথে। উনার এই ক্লান্তিমাখা মুখটাও যেনো কতো স্নিগ্ধতায় ঘেরা।
উনি আমায় নামিয়ে দিয়ে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম গুলো মুছে নিয়ে বলে উঠলেন,
.
—- আমায় না দেখে সামনের দিকে তাকাও!
.
উনার কথায় লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলাম আমি। রুশো ভাইয়া লাগেজ টানতে টানতে পেছনে এসে বলে উঠলো,
—- ম্যায় তো মার গেয়া রে ছুটকি! তুই তো কত্তো আরাম করে এলি! কি লাক রে ভাই তোদের! শালার আমার কপালই ফুট্টা! 😩
.
আমি রুশো ভাইয়ার দিকে মুখ ফিরিয়ে কিছু বলবো তার আগেই সদর দরজা খুলে গেলো। আম্মু ততক্ষণাত আমাদের ইশারা করলো মাথায় কাপড় দিতে! আমি, নিত্য আপু আর রাত্রি চটজলদি মাথায় ওড়না টেনে দিলাম।
ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো এক হাস্যজ্বল প্রতিমা! ইনি হলেন আমার চাচিমনি! আমার আব্বুরা তিন ভাই তার মধ্যে ইনি ছোট চাচ্চুর ওয়াইফ! দরজা খুলে আমাদের সকলকে দেখেই খুশিতে চোখ চিকচিক করে উঠলো চাচিমনির। আমাদের সবাইকে ভেতরে প্রবেশ করতে বলে বাড়ির সবাইকে ডাকতে লাগলেন উনি।
.
আমরা সবাই ধীর পায়ে বাড়িতে প্রবেশ করলাম। দুতলা পাকা বাড়ি। নিচে বিশাল এক উঠান। বাড়িটা আকারে আসলেই অনেক বড়। যৌথ পরিবার থাকার জন্য পারফেক্ট। শোনা যায় এক সময় দাদুভাই গ্রামের মোড়ল ছিলেন সাথে ছিলেন বেশ সম্পদশালীও। দাদুবাড়ি আসিনি ২ বছর হবে। এউ দুবছরে তেমন কোনো পরিবর্তন না হলেও বাড়ির উঠানটা খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে। উঠানটা আগে কাঁচা ছিলো এখন পাকা করা হয়েছে।
.
ক্ষণিকের মধ্যেই ধীর পায়ে উঠানে এসে উপস্থিত হলেন দিদুন। দিদুনের বয়স এক্সাক্টলি কতো তা জানা নেই আমার তবে এখনো নিরদ্বিধায় হাটা চলা করতে পারে দিদুন। মাথার চুলগুলো সব লালচে, যেমনটা পাকা চুলে মেহেদী লাগালে হয় ঠিক তেমন। চেহারায় বয়সের ছাপের সাথে কুঁচকে যাওয়া চামড়াও দিদুনের সৌন্দর্য বিন্দুমাত্র কমাতে পারে নি বলে আমার ধারণা। বরং আরোও অদ্ভুত রকমের সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে দিদুনের চেহারায়। তবে দিদুন আর আগের মতো হাসি-খুশি মাখা মুখে থাকে না। ১০ বছর আগে দাদুভাই গত হওয়ার পর থেকেই এমন গম্ভীরতা ছেয়ে গেছে দিদুনের রন্দ্রে রন্দ্রে।
.
দিদুনকে আসতে দেখেই রুশো ভাইয়া একটা ঢোক গিলে দু ধাপ পিছিয়ে গেলো।
পরমুহূর্তে দিদুনের হাতে লাঠি না থাকায় একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো রুশো ভাইয়া।
.
দিদুনকে দেখেই আম্মু আব্বু গিয়ে সালাম করলো। আমরাও একে একে এগিয়ে গিয়ে দিদুনকে সালাম করলাম। দিদুন সবাইকেই তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,
.
—- হবু নাত বউ কোনটা?
.
আম্মু নিত্য আপুকে দেখিয়ে দিয়ে বললো,
—- এই যে মা, ওর নাম….
.
আর কিছু বলার আগেই দিদুন হাত মেলে আম্মুকে থামিয়ে দিয়ে নিত্য আপুকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
—- নাম কি?
.
নিত্য আপু কিছুটা ভরকে গিয়ে তাও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে উঠলো,
—- নিত্য!
.
দিদুন কপাল কুচিকে আরোও গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,
—- নাম জিজ্ঞেস করলে পুরো নামটা বলতে হয় জানো না?
.
নিত্য আপু আগের থেকেও নারভাস ফিল করে বলে উঠলো,
—- দুঃখিত! আমার নাম সানজানা সাবরিন নিত্য!
.
দিদুন এবার কিছুটা আস্বস্ত হয়ে বলে উঠলেন,
—- তোমরা সবাই গিয়ে গোসল করে পরিষ্কার হয়ে এসো আগে। তারপর কথা বলছি।
সালমা…! ওদের নিয়ে যাও তার মামুনকে বলো ছেলেদের পুকুরে নিয়ে যেতে।
.
পুকুরের নাম শুনতেই রুশো ভাইয়া একপ্রকার চেঁচিয়েই “হোয়াট!” বলে উঠলো। সাথেসাথেই অগ্নি ভাইয়া আর নীবিড় ভাইয়া রুশো ভাইয়ার ঠোঁট চেপে ধরে জোড়পূর্বক হেসে দিয়ে বলে উঠলো,
.
—- ও কিছু না দিদুন৷ ওকে পিঁপড়ে কামড়েছে মাত্র!
.
দিদুন চোখের দৃষ্টি আরো তীক্ষ্ণ করে রুশো ভাইয়াকে নিচ থেকে উপরে একবার দেখে নিয়ে বলে উঠলো,
—- এটা ওই আমচোর টা না?
.
দিদুনের ৫ বছর আগের কথাও মনে আছে দেখে আমার আর ভাইয়ার কাশি উঠে গেলো। আর রুশো ভাইয়া তো পারছে না মাটি দু ফাঁক করে ভেতরে ঢুকে যেতে। রুশো ভাইয়ার চেহারা বর্তমানে একদম দেখার মতো হয়েছে।
মাঝখান থেকে রাত্রি রুশো ভাইয়াকে এমন অসহায় পরিস্থিতিতে দেখে সবার আড়ালে মিটিমিটি হেসে চলেছে।
.
চলবে………………💕
#প্রেম_আমার♥
#পার্ট-৪১♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥
.
🌺
.
—- এটা একটা পুকুর? লাইক সিরিয়াসলি!
.
রুশোর প্রশ্নে মামুন হাল্কা হেসে বলে উঠলো,
—- এটা পুকুরও না আবার দীঘিও না। আবার যদি পুকুর বলো তো পুকুর অথবা দীঘি বলো তো দীঘি।
.
নীবিড় কপাল কুঁচকে ঠোঁটের এক সাইডে কামড়ে ধরে জিজ্ঞেস করলো,
—- পুকুরও না আবার দীঘিও না। তবে কি এর মাঝামাঝি কিছু?
.
—- হুম ঠিক তাই! কেউ বলে দীঘি তো কেউ বলে পুকুর। এক কথায় ছোট দীঘিও বলতে পারেন। একসময় আরোও বড় ছিলো দীঘিটা তবে এর পাশে মাটি দিয়ে ভরাট করে ঘর-বাড়ী তোলায় আকারে বেশ খানিকটা ছোট হয়ে গিয়েছে। ওদিকটায় দেখো! একটা ডিঙি নৌকো বাঁধা। বর্ষায় দীঘি ভরে উঠলে ছেলেপেলেরা নৌকো অথবা ভ্যালা বানিয়ে এপার থেকে ওপারে ঘুরে বেড়ায়।
.
—- সত্যিই মনোমুগ্ধকর! আচ্ছা এখানে আসার পথে আরো কয়েকটা ছোট ছোট পুকুর দেখলাম। ওগুলো ছেড়ে এখানে গোসল করতে আসো কেনো?
.
—- ওহ হ্যাঁ! তোমাদের বলা হয় নি।
ওগুলোতে আসলে মাছ চাষ করা হয়। আর তাছাড়া পুকুরের পানি ভীষণ ঘোলাটে ধরনের হয়। এখানকার পানি অনেক স্বচ্ছ!
আমাদের আদমদিঘী উপজেলার প্রধান উৎসই হলো মৎস ব্যবসা। এখানে রেনু পোনা বিক্রয়ের জন্য নামকরা। এখানে সব মিলে ৭-৮ টা মৎস খামার আছে। আর পুকুরগুলো মৎস ব্যবসায়ীদের নিজস্ব তত্ত্বাবধানেই থাকে। সেখান থেকে ডিম ওয়ালা মাছ ধরে কৃত্রিম উপায়ে বিভিন্ন মাছের রেনু পোনা উৎপাদন করা হয়।
একটু থেমে মামুন আবারও বলতে শুরু করলো,
—- এখানকার প্রায় ৭৫% মানুষই মাছের ব্যবসার সাথে সংযুক্ত। এমন কি আমরাও।
আর বাকি ২৫% মানুষ কৃষি কাজ, চাকুরী অথবা অন্যান্য পেশায় নিযুক্ত।
.
অগ্নি চিন্তিত হয়ে বলে উঠলো,
—- সবি বুঝলাম তবে দিদুন এমন একটা পদ্ধতি চালু করলো কেনো যে ছেলেরা এখানে এসে গোসল করবে, আর মেয়েরা বাড়ির বাথরুমে?
.
মামুন হাসলো। আবারও মুচকি হেসে বলে উঠলো,
—- আগে থেকেই এমন পদ্ধতি চালু ছিলো। কিন্তু তোমরা তো দাদুবাড়ি বেশি আসোই নি। বছর খানিক পরপর এসেছো তাও দু-তিন দিনের জন্য।
তাছাড়া আগে বাড়িতে মেয়েদের জনসংখ্যা কম ছিলো। তাই তোমরা এলে বাড়ির বাথরুমই ব্যবহার করতে দিতো। অবশ্য চাচা-চাচি আসে বছরে ২ বার করে। তোমরা তো আবার নানুবাড়ি বলতে পাগল৷ নওগাঁ আমাদের পার্শ্ববর্তী জেলা হবার পরও বগুড়া আসতে চাওনা তোমরা। এইতো মাত্র দু ঘন্টার রাস্তা, সান্তাহার এর পরেই নওগাঁ!
.
অগ্নি মুখটা মলিন করে বললো,
—- আসলে ছোটবেলা থেকেই নানুবাড়িতে বেশি থাকা হয়েছে তাই আর এদিকটায় বেশি আসা হয়নি।
.
হঠাৎ ওদের কথা বলার মাঝেই নীবিড় খেয়াল করলো পাশে রুশো নেই।
—- আরে রুশো গেলো কই?
.
নীবিড়ের কথায় অগ্নি আর মামুনও ঘাড় ঘুরিয়ে রুশোকে খুঁজতে লাগলো। নীবিড় পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলো রুশো ওদের থেকে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
.
—- হেই ড্রিমার ওখানে কি করছো? বিকেল গড়িয়ে পড়ছে তো। কাম ফাস্ট।
.
নীবিড়ের ডাক সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে রুশো আরো দুধাপ পিছিয়ে কাঁপাকাঁপা গলায় বললো,
—- নো নো নো…..! আ…আমি ওই পুচকু হোক আর বড় হোক। কোনো দীঘি ফিগি তে গোসল করতে পারবো না। তোমরা করো আমি গেলাম বাবা!
.
বলেই রুশো উল্টো দিকে ঘুরে পালাতে উদ্যত হওয়া মাত্রই অগ্নি নীবিড়কে ইশারায় “ধর ওটাকে!” বলেই দৌড় লাগালো সাথে নীবিড়ও ছুটলো রুশোকে ধরে আনতে। এদিকে মামুন হাতে তিনটে গামছা ধরে বোকার মতো চেয়ে রইলো ওদের ছোটাছুটির দিকে।
.
অগ্নি দৌড়ে গিয়ে রুশোর শার্টের কলার পেছন থেকে ধরে ফেলায় রুশো আর এগোতে পারলো না। কিন্তু তার দৌড়ানো এখনোও চালুই রয়েছে। দৌড়ানো সত্ত্বেও এগোতে না পারায় রুশো বিস্ময়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই দাঁত কেলিয়ে ভ্রু নাচানো অগ্নিকে দেখে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো।
.
—- কোথায় পালাচ্ছিস? গোসল না করে গেলে দিদুন বাড়িতে ঢুকতে দেবে না ভুলে যাস না।
.
রুশো ঠোঁট উল্টে কপাল কুঁচকে করুন চোখে বলে উঠলো,
—- ব্রো প্লিজ! আমি পারবোনা। কোথায় সুইমিংপুল আর কোথায় এই মিনি দীঘি না পিগি! এটা মিনি হলে বিগার কেমন হবে ভাবলেই ভয় করছে আমার। আমি ডুবে যাবো ব্রো, ডুবে যাবো আমি।
.
নীবিড় এসে রুশোর কাঁধে হাত রেখে বললো,
—- আরে কিচ্ছু হবে না। আমরা আছি তো।
.
অগ্নি বুঝলো রুশোকে কিছু বলে কোনো লাভ হবে না তাই চোখের ইশারায় নীবিড়কে রুশোর বাম দিক ধরে উঠাতে বললো৷ নীবিড় চোখের পলক ঝাপটিয়ে সম্মতি জানিয়ে রুশোর বা হাত ধরলো। এদিকে অগ্নি রুশোর ডান দিকে ধরে দুজনে মিলে ওকে শূন্যে তুলে এগোতে লাগলো।
.
—– হেই ব্রোস প্লিজ লিভ মি! আ…আমি মরে যাবো! আমার স্টোরি গুলো ইনকামপ্লিট থেকে যাবে, আমার বউ বিয়ের আগেই বিধবা হয়ে বসে থাকবে, আমার বেবি আর্থে আসার আগেই পাপ্পাকে হারাবে।
.
—- শাট আপ রুশো! সামান্য দীঘিতে গোসল করলে কেউ মরে যায় না। ডাফার।
.
অগ্নি রুশোকে ধমকাতে ধমকাতে আনতে লাগলো কিন্তু রুশো অগ্নির একটা কথাও কানে নিচ্ছেনা। বাচ্চাদের মতো হাত-পা ছোটাছুটি করেই যাচ্ছে।
.
নীবিড় আর অগ্নি মিলে রুশোকে বহুকষ্টে দীঘির পাড়ে নিয়ে এসে থামলো, তবে এখনো ছেড়ে দেয় নি ওকে৷ শূণ্যে ভাসিয়েই রেখেছে।
অগ্নি দীঘির পানে চেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীবিড় কে ইশারা করে কিছু একটা বলতেই নীবিড় ঠোঁট কামড়িয়ে একটু চিন্তা করে সম্মতি জানালো।
.
—- থ্রি…..! (অগ্নি)
—- টু…..! (নীবিড়)
—- ওয়ান……..! (দুজনে একসাথে)
.
বলেই দুজনে একসাথে রুশোকে দীঘির পানিতে ছুড়ে ফেলে দিলো।
“ইয়ায়ায়ায়া আমি মরে গেলাম!” বলে চেঁচিয়ে ঝপাৎ করে পানিতে গিয়ে পড়লো রুশো৷ সাথেসাথেই রুশোর কর্তৃক দীঘিতে ঘনত্বের ফলে অপসারিকৃত পানি এসে ছিটকে পড়লো অগ্নি আর নীবিড়ের গায়ে।
.
—– আ…আ…আ….হেই ব্রো আমাকে বাঁচাও! আমি ডুবে যাচ্ছি বলেই পানিতে হাত পা ছাড়িয়ে ছোটাছুটি করতে লাগলো রুশো। আর এদিকে অগ্নি আর নীবিড় ভ্রু কুঁচকে একে ওপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। মামুন এতোক্ষণে এতোসব কান্ড-কারখানা দেখে ধপ করে মাটিতে বসে মাথায় হাত চেপে ধরেছে।
.
এভাবে অনেক্ষণ ছোটাছুটির পর যখন রুশো বুঝলো ও ডুবে যাচ্ছে না তখনই অনুভব করলো পায়ের গোড়ালি পাড় করে উপরে ওঠা কাদার স্পর্শ!
রুশো খুশি হয়ে পানিতে থেকেই লাফাতে লাফাতে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
—- হেই ব্রোস! আম ফাইন! এই দীঘি তো আমার হাইটের থেকেও কম গভীর! হাহাহা!
.
অগ্নি কপাল কুঁচকে চোখ ছোটছোট করে হাত উঠিয়ে বলে উঠলো,
—- এতো লাফাস না! আর একটু পাছালেই তলিয়ে যাবি। ওখান থেকেই গভীরতা শুরু হয়েছে বলা যায়। সাঁতরে এগিয়ে আয় ফাস্ট।
.
রুশো অগ্নির কথায় অনেকটা ভয় পেয়ে চটজলদি সাঁতরে এগিয়ে আসলো।
রুশো এগিয়ে আসতেই অগ্নি আর নীবিড় দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে “চল শালা!” বলেই গা থেকে প্যান্ট আর শার্ট খুলে ঝাঁপ দিলো পানিতে। সাথেসাথেই দীঘির পাড়ে আছড়ে পড়লো ছিটকে আসা জলগুলো।
.
🍂
.
বিরক্তির চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে আমি, রাত্রি আর নিতু আপু দাঁতে দাঁত চেপে মেঝেতে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বসে অাছি।
বিরক্তি আমাদের পুরোপুরি গ্রাস করে চলেছে। তাও এমনি এমনি নয় তার উল্লেখযোগ্য কারণও রয়েছে।
আর তার কারণ খানা এই যে আমাদের গোসলের আগে চুলে তেল দিতে বসানো হয়েছে। চাচিমনি, বড় চাচি আর মাসুম ভাইয়ের বউ মিলে আমাদের তিনজনের মাথাকে ফসলের মাঠ ভেবে চাষ করে যাচ্ছে।
.
আমার এখন ইচ্ছে করছে হাত-পা ছেড়ে দিয়ে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে! কালকেই শ্যাম্পু করে চুলগুলোকে কতো সুন্দর করে ওয়াশ করিয়েছিলাম। আর আজই আমার ওয়াশ করা স্মুথ এন্ড সিল্কি চুলগুলোকে তেলে চুবিয়ে লুটুপুটু করে ছাডলো এরা।
দিদুনের ভয়ে কিছু বলতেও পারছিনা। চুপচাপ এই নির্মম অত্যাচার সহ্য করে যেতে হচ্ছে আমাদের।
.
প্রায় ১৫ মিনিট পর আমাদের তিনজনকে ছেড়ে দিয়ে বড় চাচি বললো,
—- এখন গিয়ে গোসল করে এসো।
.
বড় চাচির কথাটা বলতে দেরি হলেও আমাদের বসা থেকে লাফিয়ে উঠতে দেরি হয় নি। আমি মুখে জোড়পূর্বক হাসি ফুটিয়ে “আচ্ছা!” বলেই রাত্রি আর নিত্য আপুকে নিয়ে এক ছুটে বাথরুমে গিয়ে ঢুকে পড়লাম। যেহেতু এক এক করে গোসল করলে সন্ধ্যে নেমে আসতো তাই সবাই একসাথে গোসল সেরে ফেলাই ভালো। যেহেতু বাথরুমও বেশ বড়।
.
বাথরুমে ঢুকতেই রাত্রি আর নিত্য আপুর চুপসে যাওয়া মুখটা আগের থেকেও আরোও বেশি চুপসে গেলো। কারণ এতো বড় গোসলখানায় না আছে কোনো ট্যাপ আর না আছে কোনো ঝড়না। যা আছে তা শুধুমাত্র টিউবওয়েল। আগে গোসল করতে এসে এই টিউবওয়েল ঝাঁকিয়ে বালতি ভরতেই আমার আধা ঘন্টা লেগে যেতো। তাই আমার গোসলের সময় আম্মু সবসময় পানি ভরিয়ে দিয়ে যেতো।
.
—- অনু…রে…! বাড়িতে মোটর লাগানো নেই?
.
আমি ঠোঁট উল্টে দু কাধ উঁচু করে বলে উঠলাম,
—- আছে তবে সেটা সেচ দেওয়ার জন্য শুধু। বাথরুমে পানির লাইন দেওয়া হয় নি। টিউবওয়েল চেপে বালতি ভরিয়ে গোসল করা ছাড়া উপায় নেই আর।
.
আমার জবাবে নিত্য আপু আর রাত্রি দুজন দুজনের দিকে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আবারও আমার দিকে তাকালো। ততক্ষণে আমি সাথে করে আনা কাপড় আর গামছা তারে রেখে আবারো ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
.
—- শুনো আমি বলি কি! এক এক করে তিন জনই একবার একবার করে বালতি ভরিয়ে নেই। তাহলেই হয়ে যাচ্ছে!
.
আমার আইডিয়াটা বোধহয় নিত্য আপু আর রাত্রির পছন্দ হলো। তাই কেউ আর কথা না বাড়িয়ে সম্মতি জানালো।
প্রথমে আমি এক বালতি পানি ভরিয়ে নিলাম। ৩ জনই ৩ টে মগে পানি নিয়ে গায়ে ঢেলে গোসল করতে লাগলাম। পানি শেষ হলে এরপর নিত্য আপু পানি ভরিয়ে নিলো। এভাবেই এক এক করে তিনজনই টিউবওয়েল চেপে পানি ভরিয়ে গোসল সারতে লাগলাম।
.
🍁
.
অগ্নি, নীবিড় আর রুশো পানি ছিটাছিটি করে হাসতে হাসতে গোসল করছে। অগ্নি আর নীবিড় একটু পর পর পানিতে ডুব দিয়ে আবারও মাথা বের করে হেসে চলেছে। শুধুমাত্র রুশো এখন পর্যন্ত একবারও সাহস করে ডুব দেয় নি।
.
—- ওই তুই ডুব দিচ্ছিস না কেনো?
.
—- আ..আরে ব্রো! ভ..ভ.. ভয় করছে! যদি ডুবে যাই।
.
অগ্নি রুশোর ভয় পাওয়া দেখে ভিলেনি হাসি দিয়ে নীবিড়কে ইশারা করলো রুশোর কাধে হাত রাখতে। নীবিড় অগ্নির ইশারা বুঝতে পেরে দাঁত কেলিয়ে রুশোর কাধে হাত রাখলো। এবার অগ্নি রুশোর গাল টেনে দিয়ে দুজনে মিলে একসাথে রুশোকে পানির ভেতরে চুবানি খাইয়ে ছাড়লো। রুশো একডুব দিয়ে ধরফড়িয়ে উঠে মাথা বের করতেই অগ্নি আর নীবিড়ের চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। রুশো কাশতে কাশতে অগ্নি আর নীবিড়কে নিজের দিকে এভাবে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকতে দেখে চোখ ছোট ছোট করে বলে উঠলো,
.
—- হোয়াট হ্যাপেন্ড ব্রোস? তোমরা আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো? হুয়াই?
.
অগ্নি আর নীবিড় দুজন দুজনের দিকে একবার তাকিয়েই পর মুহূর্তে আবারও রুশোর দিকে তাকিয়ে হু হা করে হাসতে শুরু করলো!
অগ্নি হাসতে হাসতে রুশোর মাথার দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে হাসার বেগ আরোও বাড়িয়ে দিলো।
রুশো কিছু বুঝতে না পেরে মাথা ঝাঁকাতেই ওর মাথা থেকে টুস ওরে একটা ব্যাঙের বাচ্চা অর্থাৎ ব্যাঙাচি লাফ মেরে পানিতে পড়ে গেলো। যা দেখে নীবিড় আর অগ্নি আরোও তুমুল বেগে হাসতে শুরু করলো। রুশো ব্যাঙটাকে ওর মাথা থেকে লাফিয়ে পানিতে পড়লো দেখে চোখ বড়বড় করে চেঁচিয়ে উঠলো,
.
—– ওহ নো…..! মেনডাক!😵
.
চেঁচিয়েই তাড়াহুড়ো করে সাঁতরে পাড়ে উঠে গেলো রুশো। অগ্নি আর নীবিড় রুশোর সামান্য ব্যাঙ দেখে ভয় পাওয়া নিয়ে আরোও জোড়ে হাসতে হাসতে দীঘির পাড়ে এসে উঠলো।
.
—- হুহ তোমরা হাসছো? ওই মেনডাকটা আমার মাথাটাকে খেলার মাঠ বানিয়ে দিলো, কোথায় তোমরা মেনডাকটাকে বোকবে তানা হাসছো! দ্যটস নট ফ্যায়ার ব্রোস।
.
অগ্নি হাসতে হাসতে রুশোর গাল টেনে ওর ঘাড়ে হাত রেখে বললো,
—- আস্ত জোঁকার একটা! বাড়ি চল নাহলে ঠান্ডা লেগে যাবে।
.
মামুন এগিয়ে এসে ওদের হাতে ৩ টে গামছা ধরিয়ে দিয়ে বললো,
—- গা মুছে নাও। বাড়িতে গিয়ে কাপড় দেওয়া হবে!
.
—- ওয়েট ওয়েট কাপড় দেওয়া হবে মানে? আমরা তো কাপড় এনেছি!
.
মামুন হাসলো। আবারও বললো,
—- বাড়িতে গেলেই বুঝতে পারবে।
.
বলেই হাটা ধরলো। নীবিড়, অগ্নি আর রুশোও যা হবে পরে দেখা যাবে ভেবে আর কিছু না বলে গামছা দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে মামুনকে ফলো করে এগোতে লাগলো।
.
🌹
.
কোনোরকমে গা-মাথা ভিজিয়ে কাপড় বদলে বের হলাম আমি, নিত্য আপু আর রাত্রি। নিজেকে কেমন ক্ষ্যাত ক্ষ্যাত লাগছে ভেবেই কান্না পাচ্ছে আমার। চুলগুলোর হাল বেহাল। কেনো যেনো তেল দিলে শুধু চুলই না হাত পা মুখ চোখ সবকিছুই কালো কালো লাগে। নিজেকে এখন তৈলাক্ত ভূতের মতো লাগছে আমার। যেটুকু পানি দিয়ে গোসল সারলাম তাতে তেলের ছিটেফোঁটাও ওঠে নি বরং তেলগুলো পুরো গা জুড়ে লেপ্টে গেছে আমাদের৷
তাই কারো মুখেই হাসি নেই। তিনজনই মুখ ফুলিয়ে রেখেছি আমরা।
.
গোসল থেকে বেরোতেই সামনে পড়লো দিদুন। আমাদের নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে গম্ভীর গলায় দিদুন বললো,
—- ভালো করে চুল মুছে খেতে এসো। দুপুরে নিশ্চয় খাওনি।
.
আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতেই দিদুন আমাদের পাশ কাটিয়ে গটগট করে চলে গেলেন। দিদুন যেতে আমরা তিনজনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
.
—- আচ্ছা অনন্যা, দিদুন কি সব সময়ই এমন গোমড়ামুখে থাকেন?
.
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়িয়ে বলে উঠালাম,
—- ১০ বছর আগে যখন থেকে দাদুভাই গত হয়েছে তখন থেকেই দিদুন এমন গম্ভীর ও চুপচাপ! এই ১০ বছরে কখনোও হাসতে দেখি নি আমি দিদুন কে।
.
—- তারমানে তোর দাদুভাইকে দিদুন অনেক ভালোবাসতো তাইনা রে?
.
রাত্রির প্রশ্নে আমি আবারও হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ালাম।
কেউ আর কিছু বললো না। নিশ্চুপ হয়ে মাথা মুছায় মনোযোগ দিলো নিত্য আপু আর রাত্রি।
.
🌷
.
—- হোয়ায়ায়ায়াটট……..!
.
অগ্নি, নীবিড় আর রুশোর একসাথে হোয়াট বলে চেঁচানোয় দু হাতে কান চেপে ধরলো মামুন! আস্তে আস্তে কান থেকে হাত সরিয়ে একবার গলা খাঁকারি দিয়ে মামুন বললো,
.
—- কিচ্ছু করার নেই। এটা পড়তে হবেই সন্ধ্যের পর। এ বাড়ির নিয়ম এটা।
.
—- তাই বলে লুঙ্গি……..! (অগ্নি)
.
—- হুম! বড় হয়ে পড়াশুনার বাহানায় রাতে তো থাকতে না তাই জানো না। চাচ্চুকে জিজ্ঞেস করে দেখো, এখন বাড়ির সব পুরুষেরাই লুঙ্গি পড়বে।
.
—- এটা আবার কেমন নিয়ম রে ভাই? ম্যায় তো বখলা গেয়া রে বাবা! (রুশো)
.
—- আচ্ছা লুঙ্গি পড়াটা কি খুব বেশি জরুরী? না পড়লে কি খুব খারাপ হয়ে যাবে? (নীবিড়)
.
মামুন মুখটা অসহায়ের মতো করে বলে উঠলো,
—- শুধু খারাপ না, বহুত খারাপ হয়ে যাবে!
তোমরা পরে নিয়ে নিচে এসো আমি গেলাম।
.
বলেই মামুন ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। রুশো মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে গেলো। নীবিড় ভ্রু কুঁচকে লুঙ্গির দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ঠোঁট উল্টে বলে উঠলো,
.
—- আচ্ছা এটাকে কিভাবে পরে রে অগ্নি?
.
নীবিড়ের প্রশ্ন শুনে এবার অগ্নিও মাথায় হাত দিয়ে ধপাস করে বিছানায় বসে পড়লো।
হঠাৎ রুশো মাথা চুলকে বলে উঠলো,
.
—- হেই ব্রোস আই হ্যাভ এন আইডিয়া। ইউটিউব মামু তো আছেই। টিউটোরিয়াল দেখে নাও!
.
—- হায়রে শেষমেশ লুঙ্গি পড়ার টিউটোরিয়াল দেখতে হবে?
বলেই আর কোনো উপায় না পেয়ে ইউটিউব দেখে কোনোমতে পেঁচিয়ে পুঁচিয়ে লুঙ্গি পড়ে নিলো রুশো, অগ্নি আর নীবিড়।
.
🌸
.
উঠানে পাটি বিছিয়ে খেতে বসিয়েছে দিদুন আমাদের। যেহেতু শুধু আমরাই দুপুর থেকে না খেয়ে রয়েছি তাই আমরা বাদে বাড়ির বাকিরা বসেনি খেতে। আম্মু আব্বু আমাদের সামনে পাটি বিছিয়ে বসেছে এদিকে আমরা তিন জন আরেকটা পাটি বিছিয়ে বসে আছি৷ অপেক্ষা শুধু ভাইয়াদের। ওরা এখনো আসছে না কেনো ভেবে পাচ্ছি না আমি। দিদুন আমাদের সামনের চেয়ারে বসে রয়েছে। ভাইয়াদের এখনো না আসায় দিদুনের কপালে বিরক্তির ভাঁজ ফুটে উঠেছে।
.
দিদুন মাসুম ভাইয়াকে ডেকে বললো “ছেলেরা এখনো আসছে না কেনো দেখতো!”
মাসুম ভাইয়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতেই কারো পায়ের আওয়াজে মাথা উঁচু করে আড়চোখে আওয়াজটার উৎস বরাবর তাকালাম আমি।
.
অগ্নি ভাইয়া, রুশো ভাইয়া আর নীবিড় ভাইয়া ওপরে টি-শার্ট আর নিচে লুঙ্গি পড়ে, লুঙ্গির গিট চেপে ধরে লজ্জায় মাথা নিচু করে ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে। তাদের ভাবখানা এমন যেনো গিট থেকে হাত ছুটে গেলেই ফুসসস করে লুঙ্গিটা খুলে পরে যাবে।
ভাইয়াদের এক নজর দেখেই কাশি উঠে গেলো আমার। আমি কাশতে কাশতে জগ থেকে পানি ঢেলে খেয়ে নিলাম।
আমায় কাশতে দেখে নিত্য আপু আর রাত্রিও ভাইয়াদের দিকে তাকালো। নিত্য আপু ততক্ষণাৎ মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ওরনাটা আরো একটু টেনে মুখ ঢেকে ঠোঁট চেপে ধরলো। আপুর উদ্দেশ্য যে করেই হোক হাসা যাবে না। হাসলেই মরণ নিশ্চিত। কিন্তু রাত্রি হাসি কন্ট্রোল করতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে একহাত দিয়ে মুখ চেপে ধরেছে ও। এদিকে আমার অবস্থা এখন এমন যে না হাসতে পারলে পেট ফেটে শহীদ ই হয়ে যাবো অামি।😣
.
.
.
.
চলবে………….💖