প্রেম আমার পর্ব-৫৯+৬০

0
6048

#প্রেম_আমার♥
#পার্ট-৫৯♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥
.
🌺
.
এই নিয়ে বোধহয় একশত বার পাড় হয়ে গিয়েছে আমি রাত্রিকে টেনে বাড়ির বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে অতঃপর ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েছি। কি হলো মেয়েটার? কই ৪ দিন আগেই তো দিব্যি রুশো ভাইয়াকে অস্বীকার করে ড্যাংড্যাং করে ওই দিদারুল্লার সাথে চলে গিয়েছিলো। তবে আজ হঠাৎ হলো টা কি ওর?

কাল রাতে রাত্রিকে শান্ত করে রুশো ভাইয়া অবশেষে ক্ষান্ত হয়েছিলো। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলো আমার ঘরে। রুশো ভাইয়ার রেস্টের প্রয়োজন ছিলো বিধায় খালামুনি ভাইয়াকে নিজ হাতে তুলে ভাত খাইয়ে ঔষধ দিয়ে এসেছিলো। সারাদিনের ধকল সাথে এতো বড় একটা আকস্মিক ঘটনা সব মিলিয়ে বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো রুশো ভাইয়া। তাই খাওয়ার কিছুক্ষণ পরই ডুব দিয়েছিলো ঘুমের অতল গহীনে। সাথে আমার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছিলো আস্ত একটা পেত্নীকে। মেয়েটা সারারাত শান্তিতে ঘুমোতে দেয় নি আমায়। কিভাবে বিয়ে ভাঙলো, সে রুশো ভাইয়ার প্রেমে পড়লো এসব শুনিয়ে শুনিয়ে অর্ধেক রাত পাড় করে ফেলেছিলো রাত্রি। আমি খুব মন দিয়েই শুনছিলাম কিন্তু ঘড়িতে ঘন্টার কাটা ২ টো পাড় হতেই চোখে এত্তো বড়বড় ঘুম বাবাজির হামলা শুরু হয়েছিলো আমার। তবু রাত্রি ছিলো নিদ্রাহীন! ঘুমের ছিটেফোঁটাও আসছিলো তার চোখে। না সে নিজে ঘুমোচ্ছিলো আর না আমায় ঘুমোতে দিচ্ছিলো। চোখ ঘুমে টুই-টুম্বুর তুবুও ঘুমোবার জো ছিল না আমার। নীবিড় ভাইয়া আর নিত্য আপু রাতে চলে গিয়েছিলো বিধায় চিপায় পড়েছিলাম আমি। নিত্য আপু থাকলে বেশ হতো। আবারও একটা ঘুমের হুল থুক্কু আই মিন ইঞ্জেকশন ফুটিয়ে অচেতন করে রাখতাম রাত্রিকে।
.
বর্তমানে ওকে আমাদের বাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করার মূখ্য উদ্দেশ্য ওর মা। মেয়ে কাল বাড়ি ফিরেনি বলে বেশ চিন্তিত ছিলো আন্টি। খুব সকালেই টুস করে কল করে ঠুস করে আমার কাঁচা ঘুমটা ভাঙিয়ে সকাল সকাল রাত্রিকে বাড়ি পাঠিয়ে দেবার জন্য অনুরোধ করে আন্টি। আমিও বাধ্য মেয়ের বেস্টুর মতোই “যথা আজ্ঞা আন্টিজি!” বলেই ফোনের লাইন কেটে দিয়ে আবারও ঘুমের রাজ্যে ডুব দেই। আরোও ২ ঘন্টা ঘুমোনোর পর আড়মোড়া ভেঙে উঠে দেখি আমার পাশে বিছানা খালি! রাত্রি উধাও! ওকে খুঁজতে নিচে নামতেই দেখি কিচেনে ব্লাক কফি বানাচ্ছে সে। সে যে কফি খায় না তা খুব ভালো করেই জানি আমি। হঠাৎ সাত-সকালে কফি বানানোর উদ্দেশ্য না বুঝে তার কাছে গিয়ে প্রশ্ন করতেই সে হাসি মুখে উত্তর দেয়,
.
—- রুশোর জন্য বানাচ্ছি! ও তো প্রতিদিন সকালে ব্লাক কফি খায় তাই।
.
হঠাৎ এমন 5G স্পিডে রাত্রির পরিবর্তন হজম করতে বড্ড বেশি কষ্টকর বলে মনে হয় আমার। মেয়ে বলে কি? যাকে কথায় কথায় নাক ফাটাবার জন্য হাত তুলতো আর আজ সেই হাতেই তাকে কফি বানিয়ে খাওয়াচ্ছে রাত্রি!
.
আমার মতোই রুশো ভাইয়াও সকাল সকাল বড়সড় একটা ধামাকা টাইপ শক খেয়ে চোখ মুখ উল্টে তোলে। বিস্ময়ে বিষম খাওয়া শুরু করে ভাইয়া। বহু কষ্টে নিজেকে সামলে কফির কাপটা শেষ করে মিষ্টি হাসে সে। তবে রাত্রি না বুঝলেও আমি বেশ বুঝতে পারছি রাত্রির আচমকা এরকম স্বভাব পরিবর্তনের ঝাটকার সাথে কফি, দুটোর একটাও সহজে হজম করতে পারছে না রুশো ভাইয়া। দুটো বিক্রিয়কই বিক্রিয়া করে অদ্ভুৎ এক বিস্ফোরণ তৈরি করছে রুশো ভাইয়ার পেটে।
.
রাত্রি যখন রুশো ভাইয়ার যত্ন নেওয়ায় মত্ত ছিলো এমন সময় আবারও কল আসে আন্টির। আমায় আবারও তাড়া দেন তিনি রাত্রিকে পাঠাতে। কিন্তু তিনি তো আর জানেন না যে উনার মেয়ে আপাতত এই বাড়ি অর্থাৎ রুশো ভাইয়া কাছ থেকে দূরে যাবে না। সুপার গ্লুর মতো চিপকে চিপকে থাকবে সারাদিন। যার দরুন বহুবার রাত্রিকে বলার পরও সোজাসাপ্টাভাবে ভেংচি কেটে বাড়ি যাওয়ার কথাটা একেবারেই মাথায় তুলার আগেই ঝেড়ে ফেলে দেয় রাত্রি। আর এদিকে আমি পড়ি মহাবিপদে। রুশো ভাইয়াও রাত্রিকে অনেকবার বলে যে “এটম বোম্ব! আপাতত বাড়ি যাও পড়ে নাহয় এসো, নয়তো উডবি শাশু মা তোমার ওপর বোম্ব ফুটাবে!” কিন্তু না তাতেও কোনো কাজ হয় নি। রাত্রি আগের মতোই বাচ্চাদের মতো বায়না ধরে বসেইছিলো। যার দরুন এতো টানাটানি’কর একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি!
.
বর্তমানে আমি রুশো ভাইয়ার সাথে মাথায় হাত দিয়ে বসে রয়েছি। অগ্নি ভাইয়া আর আব্বু গিয়েছে অফিসে। বাসায় আম্মু-আন্টি রান্না করায় ব্যস্ত। আর আমরা দু ভাই-বোন আস্ত একটা পেত্নীকে নিয়ে টানাটানি করছি ব্যাপারটা নিতান্তই হাস্যকর।
খালু-খালামুনি আপাতত রুশো ভাইয়া আর রাত্রির মধ্যেকার ব্যাপার-স্যাপার খুব একটা ভালো করে জানে না। যা বুঝলাম একমাত্র তারাই পারবে এই সমস্যার সমাধান করতে তাই আমি রুশো ভাইয়াকে সোফায় বসে থাকতে বলে উঠে কিচেনের দিকে পা বারালাম। আমি উঠতেই রাত্রি টুপ করে রুশো ভাইয়ার পাশে বসে তার মিষ্টি করে দুষ্টু হাসি দিলো। যার দরুন রুশো ভাইয়া অসহায়ত্বের বেড়াজালে বন্দী হয়ে করুন চোখে তাকালো তার পাল্টে যাওয়া এটম বোম্বের দিকে।
.
পা টিপেটিপে খালামুনির কাছে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই চমকে উঠলো খালামুনি। অতঃপর এ আর কেউ নয় তার আদরের ভাগ্নী বুঝে হেসে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ালো। আমার মাথা হাত বুলিয়ে দিয়ে খালামুনি বললো,
.
—– কিরে অনন্যা, কিছু বলবি?
.
আমি মাথা চুলকোতে চুলকোতে আমতা-আমতা করে বললাম,
—- ইয়ে মানে না মানে…..

—- আরে কি ইয়ে মানে না মানে করছিস? বল কি বলবি?

আমি কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক তাকিয়ে পানির জগটা দেখতে পেয়েই গ্লাসে পানি ভর্তি করে ঢকঢক করে খেয়ে নিলাম। গলা ভিজিয়ে শান্ত হয়ে মিনমিন করে বললাম,
—- রুশো ভাইয়ার বিয়ে দেবে খালামুনি?
.
আমার এমন অদ্ভুত প্রশ্নে বেকুব বনে গেলো খালামুনি! ছেলেকে বিয়ে দেবে এ তো খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার কিন্তু এই স্বাভাবিক ব্যাপারটা কে এমন অস্বাভাবিক ভাবে তুলে ধরার কোনো মানে বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকে খালামুনি বললো,
.
—- বিয়ে দেবো না কেনো? বিয়ে তো দেবোই! কিন্তু রুশোকেই দেখনা। ছেলে আমার বিয়ের কথা শুনে ভেংচি কেটে দৌড় দেয় অথচ হঠাৎ এমন চুপচাপ হয়ে গেলো আবার এখন হাসছে। এই নিয়ে তোর সাথে কথা বলবো অবশ্য ভেবেছিলাম। এখন বলতো আসল ব্যাপারটা কি?
.
আমি আন্টির প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো উত্তর না দিয়ে দুহাতের নখ এক করে খোঁটাতে খোঁটাতে পাল্টা প্রশ্ন করলাম,
—- আচ্ছা খালামুনি, রাত্রি কে তোমার কেমন লাগে?
.
খালামুনি আবারও একদফা বেকুব সেজে রাত্রির দিকে এক পলক চেয়ে বলে উঠলো,
—- মেয়ে তো ভারী সুন্দরী সাথে লক্ষ্মীমন্তও! কিন্তু কেনো বলতো?
.
আমি এবার একটা শুকনো ঢোক গিলে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললাম,
—- তোমার ছেলে ওকেই ভালোবাসে খালামুনি। আর রাত্রিও, তাই আমি বলছিলাম কি……
.
আমায় পুরো কথাটা সেই করতে না দিয়েই খালামুনি বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠলো,
—- সত্যি…..! এই ওর বাড়ির এড্রেস বল, আমি আজই বিয়ের প্রোপোজাল নিয়ে যাবো! আমার ছেলের পছন্দ আছে, ও যে প্রেমে পড়বে আমি ভাবতেই পারিনি! কি শুনালি রে অনন্যা! তোর জন্য আজকে চকলেট কেক বানাবো….!
.
এবার ভ্যাবাচ্যাকা খাবার পালা আমার। খালামুনিকে রুশো ভাইয়ার সাথে রাত্রির বিয়ে কথা বলার আগেই খালামুনি টাট্টু ঘোড়ার মতো যে এভাবে রিয়াকশন দেবে তা আমার কল্পনারও বাহিরে ছিলো। এতো দেখি ঝাটকার পর ঝাটকা!
আমায় চুপ থাকতে দেখে খালামুনি আবারও উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো,
.
—- এই চুপ করে আছিস কেনো? আচ্ছা তোকে বলতে হবে না। আমি রাত্রির থেকেই শুনে নিয়ে যাবো, আজকেই যাবো…!
.
বলেই খালামুনি কিচেন থেকে বের হতে নিলেই আমি তার পথ আটকে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলাম,
—- আরে আরে করছো টা কি খালামুনি? এতো তাড়াহুড়ো করার কিছুই নেই। রাত্রি তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। তাছাড়া ডক্টর রুশো ভাইয়াকে রেস্ট নিতে বলেছে। পায়ের ব্যথাটা কমে গেলে নাহয় যেয়ো!
.
আমার কথায় খানিক ভেবে নিয়ে খালামুনি বললো,
—- সেটাও ঠিক! আচ্ছা সমস্যা নেই, তোর খালু আসুক। ওর সাথে কথা বলে এই সপ্তাহের মধ্যেই যাবো আমি। আমার রুশোর বউ ঘরে আসবে! আর তড় ই সইছে না আমার।
.
বলেই খুশিতে আমায় ঝাপটে ধরে গাল টেনে দিয়ে আবারও রান্না মনোযোগ দিলো খালামুনি। এদিকে যে আমি শিহরিত হতে হতে শহীদ হয়ে যাচ্ছি তাতে কারো কোনো খেয়ালই নেই।

আপাতত এই আশ্বাস দিয়ে রাত্রিকে ওদের বাড়িতে পাঠাতে হবে। আন্টি-আংকেল, রিমি সবাই অনেক চিন্তায় আছে। এমনিতেই দিদার ভাইয়ার সাথে বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় মন খারাপ তাদের তারওপর রাত্রিকে নিয়ে টেনশন। সব মিলিয়ে বড্ড খারাপ সময় চলছে রাত্রিদের পরিবারে।
.
🌹
.
—– রাত্রি শুন তোর জন্য একটা গুড নিউজ আছে!
.
রাত্রি রুশো ভাইয়ার থেকে মুখ ঘুরিয়ে আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই হাসির রেখা বৃদ্ধি করলাম আমি। সোফায় বসতে বসতে একবার রুশো ভাইয়ার রিয়াকশন দেখে নিয়ে বলে উঠলাম,
.
—– গুড নিউজটা কিন্তু শুধু নিউজই হয়ে থাকবে, রিয়েল লাইফে আর এপ্লাইড হবে না।
.
রাত্রি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
—– গুড নিউজ টা কি সেটা তো বল…!
.
আমি জোড়ে একটা শ্বাস নিলাম। পায়ের ওপর পা তুলে আরাম করে বসে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বললাম,
—– এই সপ্তাহেই দু-এক দিনের মধ্যে খালামুনি তোদের বাড়িতে রুশো ভাইয়ার সাথে তোর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবে। কি দিলাম না মস্ত বড় একটা গুড নিউজ? বাট প্রবলেম হচ্ছে তুই যদি বাড়িতে না যাস, সেজেগুঁজে পাত্রপক্ষের আসার অপেক্ষা না করে এখানেই থাকিস তবে ব্যাপারটা কেমন যেনো গোলেমালে হয়ে যাবে না? মানে মেয়ে ছেলের বাড়িতে থাকলে মেয়ে দেখতে গিয়ে পাকা কথা বলবে কিভাবে খালামুনিরা?
.
আমার কথায় রুশো ভাইয়া আর রাত্রি বিস্ময়ে চোখ বড়বড় করে ফেললো। উত্তেজনায় দুজনে একসাথে চিৎকার করে বললো,
—- সিরিয়াসলি…?
.
বিনিময়ে আমি চোখের ইশারায় সম্মতি জানালাম। রাত্রি চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
—- আমি এক্ষুনি বাড়ি যাচ্ছি, ওতো দেড়ি না করে আজই বিকেলে আয় তোরা।
.
রাত্রির এমন সুপারফাস্ট বেগে বিয়ের জন্য লাফিয়ে ওঠা দেখে রীতিমতো থতমত খেয়ে গেলাম আমি সাথে রুশো ভাইয়াও। দুজন দুজনের দিকে এক পলক অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আবারও রাত্রির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। একটা শুকনো ঢোক গিলে আমি বললাম,
.
—- দেখ রুশো ভাইয়ার পায়ে তো চোট লেগেছে। মাথায়ও আঘাত পেয়েছে। এরকম অবস্থায় গেলে কেমন একটা দেখায় না?
.
রুশো ভাইয়া হ্যা কি না বলবে বুঝতে না পেরে ঠোঁট উল্টালো, রাত্রি খানিক ভেবে নিয়ে বলে উঠলো,
—- ঠিক আছে যতোদিন না ব্যথা সারছে ততোদিন আমিও কোথাও যাচ্ছিনা, আম্মুকে ফোন করে বল আমার মন ভালো নেই বিয়ে ভেঙে যাওয়ায়। তাই আমি কিছুদিন এখানে থেকে রিল্যাক্স করবো!
.
ব্যস হয়ে গেলো….! আবারও আমায় ফাঁসিয়ে ছাড়লো রাত্রি নামক পেত্নীটা। এবার ভীষণ কান্না পাচ্ছে আমার। হাত-পা ছাড়িয়ে ভ্যা ভ্যা করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে।
রুশো ভাইয়া অবাক চোখে রাত্রির করা কান্ড-কারখানা দেখে নিজের হাতে নিজেই একটা চিমটি কেটে “আউউউচ” বলে চেঁচিয়ে উঠলো। হয়তো ভাইয়া ভাবছিলো এটা বাস্তব নয় স্বপ্ন মাত্র। কিন্তু চিমটি কাটার পর ভাইয়ার এই স্বপ্নের ভাবনাটা পুরোপুরি মিথ্যে হয়ে গেলো। রুশো ভাইয়া আমার দিকে করুন চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো,
.
—– ছুটকিরে…! কি হলো আমার এটম বোম্বের???
.
🍂
.
রাত্রিদের বাড়ির ড্রয়িংরুমে বসে আছি আমি, নীবিড় ভাইয়া, নিত্য আপু, অগ্নি ভাইয়া, আম্মু-আব্বু, খালু-খালামুনি সাথে লাজুক লাজুক ভাব নিয়ে গুটিশুটি মেরে বসে রয়েছে রুশো ভাইয়া। আমাদের ঠিক সামনের সোফায় বসে আছে রাত্রির আম্মু-আব্বু!
রুশো ভাইয়া লজ্জা পাচ্ছে! লজ্জায় লাল টুকটুকে হয়ে গিয়েছে ভাইয়ার গাল দুটো। যা দেখে নীবিড় ভাইয়া আর অগ্নি ভাইয়া মুখ টিপে হেসে চলেছে। আর আমি হতবাক!
.
সেদিন অনেক বুঝিয়েও কোনো লাভ হয়নি। রাত্রিকে বাড়ি পাঠাতে পারিনি আমি। আবারও টাসটাস করে মিথ্যে বলতে হয়েছে আমায়। ভাজ্ঞিস আন্টি রাত্রি-দিদার ভাইয়ার বিয়ে ভাঙায় চিন্তিত ছিলো যার দরুন ভেবে নিয়েছিলো হয়তো রাত্রিরও মন খারাপ তাই আর মানা করে নি। কিন্তু আন্টি থোরি না জানতো আমাদের অন্দরমহলের কাহিনী! জানলে হার্ট ফেইলই করতো নির্ঘাত!
সবার জোরাজুরিতে ২ দিন পরই রাত্রিদের বাসায় প্রস্তাব নিয়ে আসতে হলো আমাদের । রশো ভাইয়ার চোটের ব্যাথাটাও কমেছে বেশ। তাই আজ সকালেই রাত্রিকে পাঠিয়ে দিয়ে বিকেল বেলা এসেছি আমরা।
.
বর্তমানে আম্মু, খালামুনি হাসিহাসি ভাব নিয়ে রয়েছে। আর রাত্রির আম্মু-আব্বু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়েছে আমাদের দিকে। আসলে হুট করে বাড়ি ভর্তি এতোগুলো মানুষ আসার কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছে না তারা। আমরা কখনোই দলবল বেধে রাত্রিদের বাসায় আসিনি যার দরুন এতোটা অবাক তারা। আংকেল-আন্টিকে জানিয়েও আসিনি আমরা, রাত্রি বলেছে হুট করেই একটা সারপ্রাইজ দিতে! কি অদ্ভুত! সারপ্রাইজ কেউ বলে বলে নেয় নাকি?
.
আম্মু আংকেল আন্টির বোকা বোকা চেহারা দেখে মিষ্টি হেসে খালু-খালামুনির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে এবার নড়েচড়ে বসলো। এর মধ্যেই মাথায় ইয়ায়া বড় ঘোমটা দিয়ে গুটিগুটি পায়ে হেটে ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো রাত্রি। ওকে দেখে আমি সহ সকলেই টাস্কি খেয়ে বিস্ময়ে চোখ ফুটবলের সমান বড়বড় করে ফেললাম। রাত্রি বড়দের সালাম করে লজ্জা-লজ্জা ভাব নিয়ে টুপ করে সোফায় বসে পড়লো। আন্টি রাত্রিকে শাড়ি পড়ে মাথায় এতো বড় ঘোমটা টেনে আসতে দেখে চমকে উঠে প্রশ্ন করলো,
.
—- কিরে তুই শাড়ি পড়ে তাও আবার এতো বড় ঘোমটা দিয়ে এলি কেনো?
.
রাত্রি ঘোমটার ভেতর থেকেই লাজুক লাজুক কন্ঠে বলে উঠলো,
—- ওমা নাহলে পাত্রপক্ষের লোক “ঘোমটাটা তুলো দেখি মা!” বলবে কি করে?
.
রাত্রি কথায় এবার আন্টি আগের থেকেও বড়সড় ঝাটকা খেয়ে চোখ মুখ উল্টে তুললেন। এদিকে রুশো ভাইয়া বিস্ময়ে বিষম খাওয়া শুরু করে দিলো। আমি চটজলদি পানির গ্লাসটা ভাইয়ার দিকে এগিয়ে দিতেই ঢকঢক করে পুরো গ্লাস শেষ করে শান্ত হলো ভাইয়া। রাত্রির এমন কান্ডে হতবাক সবাই! অগ্নি ভাইয়া আর নিত্য আপু দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে হাসছে, নীবিড় ভাইয়া হাসতে হাসতে হঠাৎ সিরিয়াল ভাব নিয়ে নিজের ডান হাতের বাহু দিয়ে আমায় হাল্কা ধাক্কা মেরে বললেন,
.
—– বেস্টুর থেকেও তো কিছু শিখতে পারো! ষ্টুপিড একটা!
.
বিনিময়ে মুখ বাঁকালাম আমি। উনি আমার মুখ বাঁকানোতে চোখ ছোট ছোট করে তাকালেন, খালামুনির কন্ঠস্বর কানে ভেসে আসতেই চোখ ঘুরিয়ে সেদিকে মনোযোগ দিলেন উনি।
খালামুনি আংকেল-আন্টির বিস্ময় কাটাতে বলে উঠলো,
.
—- আসলে ভাবি, আমরা এসেছিলাম আর কি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে, এইযে আমার ছেলে রুশো ওকে তো আপনারা আগেও হয়তো দেখেছেন। রুশো ইউএস থেকে স্টাডি করে বর্তমানে আমাদের কোম্পানির বিজনেস সামলাচ্ছে। এককথায় বিজনেস ম্যান!
.
খালামুনির কথার মাঝেই মাঝথেকে রুশো ভাইয়া বললো ” এন্ড অলসো আ গ্রেট রাইটার! 😎”
সাথেসাথেই ফিক করে হেসে ফেললাম আমরা। খালামুনি কথার মাঝে এভাবে ভরকে যাওয়ায় হাতের কুনুই দিয়ে ভাইয়াকে গুঁতো মেরে চুপ করতে বলা মাত্রই জিব কামড়ে চুপ করে গেলো রুশো ভাইয়া। খালামুনি আবারও বলতে শুরু করলো,
.
—- রাত্রি আর রুশো একে অপরকে পছন্দ করে, আর আমাদেরও রাত্রিকে পছন্দ। সেই হিসবেই প্রস্তাব নিয়ে এসেছি আমরা। শুধু আপনাদের সম্মতির অপেক্ষায়।
.
খালামুনির কথায় আংকেল-আন্টি একে অপরের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে একবার রাত্রির দিকে তাকালো। সে এখনো লম্বা ঘোমটাটা মুখের সামনে ধরে নিজের মুখ লুকিয়ে রেখেছে। আন্টি রাত্রিকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলো,
.
—- রাত্রি, তুই না দিদারের সাথে বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় মন খারাপ করে ছিলিস? তাহলে?
.
রাত্রি তৎক্ষণাৎ ঘোমটা সরিয়ে মাথা ডানে-বামে নাড়িয়ে মিষ্টি করে দাঁত কেলিয়ে বললো,
—- একদম না, আমি তো বিয়ে ঠিক হয়েছিলো সেইজন্য মন খারাপ করে ছিলাম, দিদার ভাইয়া বিয়ে ভেঙেছে জানতামই না!😁
.
এবার আমার চোখ কোটর থেকে বেড়িয়ে হাতে চলে আসবে বোধহয়! কি ডেঞ্জারাস মেয়ে মাইরি!
আংকেল আন্টি ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও নিজেদের সামলে নিলেন। আন্টি মুখে খুশি খুশি ভাব ফুটিয়ে রুশো ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত হয়ে বললেন,

—- এমন কিউট জামাই হবে আমার মেয়ের, এতে আবার আপত্তির কি থাকতে পারে? আমার তো রুশোকে খুব পছন্দ! আমার এরকমই কিউট একটা ছেলের খুব শখ ছিলো যাক অবশেষে শখটা পূরণ হবে।
.
বলেই উঠে দাঁড়িয়ে মিষ্টি হেসে রুশো ভাইয়ার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন আন্টি। দুহাতে রুশো ভাইয়ার দুগাল টানতে টানতে বলতে লাগলেন, ” ওলে লে মেরা বাচ্চা!”
এবার আমাদের সকলেরই চোখ ফুটো হয়ে যাবে যাবে ভাব। অগ্নি ভাইয়া এতোক্ষণ দিব্যি খিল্লি উড়িয়ে গেলেও এবার হতবাক! মাঝখান থেকে রুশো ভাইয়ার হাল বেহাল। বর্তমান তার রিয়াকশন কিছুটা এরকম,
.
—– বাঁচালে রে ছুটকি বাঁচালে মুঝে……!
.
চলবে……………💕

#প্রেম_আমার♥
#পার্ট-৬০♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥
.
🌺
.
মুখ কালো করে ঠোঁট উল্টে বসে আছে রুশো ভাইয়া। সামনেই অগ্নি ভাইয়া আর নীবিড় ভাইয়া হাসার প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হওয়ার তাগিদে ঘর কাঁপিয়ে হাসতে হাসতে একপ্রকার গড়াগড়ি খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। মাঝখান থেকে নিত্য আপু বেচারি! দেবরের পাশে যখন কেউ থাকে না তখন ভাবি নামক ছায়াটি সর্বদাই ঢাল হিসেবে সামনে থাকে। কিন্তু বর্তমানে নিত্য আপুর পক্ষে ব্যাপারটা বাস্তবে এপ্লাই করাটা কষ্টকর হলেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আপু। যার দরুন পেটে হাসির মস্ত বড় বড় বোম্ব ফুটলেও মুখ ফুটে হাসতে পারছে না সে। এদিকে রুশো ভাইয়ার সামনে হাসতে পারবো না বলে পিলারের পেছনে এসে চাপা শব্দে হেসে চলেছি আমি। চোখের সামনে বারবার শুধু একটা সিনই ভেসে উঠছে আমার!
.
রাত্রিদের বাসায় থাকাকালীন বিয়ের পাকা কথা সেরে ফেলে দু পরিবারেই! বাড়ির সকলেরই কথা একটাই, “জুটি যেহেতু তিনটে, একসাথে বিয়েও তিনটে হওয়া চাই!” সেই কথার রেশ ধরেই আগামী সপ্তাহে আমাদের বিয়ের ডেইটেই রাত্রি-রুশো ভাইয়ার বিয়ের ডেইট ফাইনাল করা হয়। রাত্রি তো পারে না সবার সামনে নেচে ফ্লোর ভেঙে ফেলে! মাঝখান থেকে খুশিতে লাফাতে চেয়েও নিজের মনের অদম্য কামনাটা দমিয়ে রেখেই রাত্রির দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে ছিল রুশো ভাইয়া। যেখানে তার নিজেরই খুশিতে আত্মহারা হবার কথা আর রাত্রির রুশো ভাইয়াকে দেখে খিল্লি উড়ানোর কথা সেখানে হচ্ছে তার উল্টো। যদিও রুশো ভাইয়া রাত্রির খিল্লি উড়ায় নি, অবাক চোখে তাকিয়েই থেকে স্রেফ!
.
যেহেতু ওদের বিয়েও আমাদের সাথেই সেহেতু আজই আংটি বদল করিয়ে ফেলে দু পরিবারই। খালামুনি অনেক আগেই রুশো ভাইয়ার বউয়ের জন্য ভবিষ্যতে পরাবার আহ্লাদ স্বরূপ আংটি বানিয়ে রেখেছিলো। আবার এদিকে রাত্রির বরের জন্যও যেহেতু আংটি আগে থেকেই রেডি ছিলো তাই সেই সময়েই রাত্রি-রুশো ভাইয়ার আংটিবদল করানো হয়। সবই স্বাভাবিক হলেও অদ্ভুতভাবে দুটো আংটিই দুজনের হাতে একদম ফিট হয়ে যায়, কোনো মাপ ছাড়াই শুধু আন্দাজে বানানো রিং এতো নিখুঁত ভাবে খাপ খেয়ে যাবে কেউ ভাবতেই পারে নি।
.
এরপরে এলো খাওয়া দাওয়ার পালা। সবাই না করছিলাম যেহেতু দুপুরের খাবারের পর সবার পেটই ভরা ছিলো। কিন্তু আংকেল-আন্টি নাছোড়বান্দা। যেনো ভালো-মন্দ না খাওয়ালে মান-ইজ্জত সব ধুলোয় মিশে একাকার হয়ে যাবে। অবশেষে তাদের জেদের সামনে হার মেনে হরেক রকম খাবারের আইটেম পেশ করা হয় আমাদের সামনে। যা দেখেই ভরা পেট আরো ভরে যায় আমার! অর্থাৎ পাকস্থলীর ধারণ ক্ষমতার শুণ্যের কাছাকাছি চলে আসে।
খাবারের আইটেমের বেশির ভাগই ছিলো মিষ্টান্ন! যেহেতু রুশো ভাইয়ার সুইটস ভীষণ পছন্দ তা জানার দরুন রাত্রি আন্টিকে বলে,
.
—- আম্মুউউ তোমার হবু জামাইয়ের মিষ্টি খুব পছন্দ! একেবারে ২০ টার মতো মিষ্টিও খেয়ে নিতে পারে অনায়াসেই! দাও দাও বেশি করে দাও!
.
রাত্রির কথায় চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আন্টির। “এই জন্যেই এতো মিষ্টি দেখতে হয়েছে জামাই!” বলেই রুশো ভাইয়ার প্লেটটাকে মিষ্টির পাহাড় বানিয়ে ফেলেন আন্টি! এদিকে রুশো ভাইয়ার প্রাণ যায় যায় অবস্থা! হ্যা এটা ঠিক রুশো ভাইয়ার মিষ্টি খুব পছন্দ কিন্তু তার মানে এই না যে একসাথে কুড়ি পিস মিষ্টি সাবার করে ফেলতে পারবে। যেখানে হাইয়েস্ট ৫ পিসই রুশো ভাইয়ার কাছে একবারের জন্য খাওয়া কষ্টসাধ্য সেখানে তার সামনে এতোগুলো মিষ্টি দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলার মতো অবস্থা হয় রুশো ভাইয়ার।
.
এদিকে পুরোপুরি জামাই হবার পূর্বেই হবু জামাই হয়েই এতো আদর দেখে খাবার গলায় আটকে যায় অগ্নি ভাইয়া আর নীবিড় ভাইয়ার। পানি খেয়ে গলা ক্লিয়ার করে নিয়ে টেবিল কাঁপিয়ে যথাসম্ভব কম আওয়াজে হাসা শুরু করে তারা। রুশো ভাইয়া এতোগুলো খেতে পারবে না বলে বলে হাঁপিয়ে গেলেও, মিষ্টির পাহাড় বানাতে হাঁপিয়ে যান নি আন্টি।
অবশেষে আন্টিকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে রাত্রির দিকে করুন চোখে তাকায় রুশো ভাইয়া। রুশো ভাইয়াকে নিজের দিকে তাকাতে দেখে সেকেন্ডে ৩ বার করে পলক ফেলে লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে মিষ্টি হাসে রাত্রি! অন্য সময় রাত্রির এমন চাহনি দেখে খুন হয়ে গেলেও তখন রুশো ভাইয়ার মুখে এসে ভর করে আরো একফালি অসহায়ত্ব!
.
ভরা পেটে ৪ পিস মিষ্টি খেয়েই চোখ মুখ উল্টে তোলে রুশো ভাইয়া। আন্টি এই দেখে ভাবে হয়তো কালোজাম আর রসগোল্লা ভালো লাগছে না ভাইয়ার, যার দরুন ব্যস্ত হয়ে সন্দেশ এগিয়ে দেয় রুশো ভাইয়ার দিকে। আবারও চোখের সামনে আরো একপ্রকার মিষ্টান্ন আসায় কেঁদে বন্যা বইয়ে দেবার মতো অবস্থা হয় রুশো ভাইয়ার। “না না না না……! করতে করতে অবশেষে ব্যর্থ হয়েই আন্টির হাতের সন্দেশ মুখে পুরে নেয় সে।
এভাবে জোড় করে করে ৮ পিস মিষ্টি খাওয়ানোর পর ক্ষান্ত হয় আন্টি। তবুও তার মুখ ভার কারণ হবু জামাইকে গুনেগুনে ২০ পিস খাওয়াতে পারেন নি তিনি।

রুশো ভাইয়ার এমন করুন পরিস্থিতিতে পাশে থাকার বদলে হেসেই পাড় করে যায় সবাই। খাওয়া শেষে আন্টি-আংকেলের সাথে কুশল বিনিময় করে বাড়ি ফিরি সকলে। বাসায় এসে খাটে ধুপ করে চিটপটাং হয়ে শুয়ে পড়ে রুশো ভাইয়া। একটু পরপরই উল্টি উল্টি ভাব এলেও সম্পূর্ণভাবে উল্টি আসছে না যার দরুন চরম বিরক্ত সে। এদিকে রুশো ভাইয়ার এরকম অবস্থায় অগ্নি ভাইয়ার হাসি যেনো আগের তুলনায়ও কয়েকগুণ বেড়েই চলে। নীবিড় ভাইয়াও কম নন, সমান তালে তাল মিলিয়ে হেসে চলেছেন উনিও।
.
🍂
.
বর্তমানে রুশো ভাইয়া শুয়া থেকে উঠে গাল ফুলিয়ে বসে আছে। অগ্নি ভাইয়া-নীবিড় ভাইয়া হাসতে হাসতে হাঁপিয়ে পড়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছে।
রুশো ভাইয়ার এমন অসহায়ত্বে বড্ড খারাপ লাগছে আমার। তাই পিলারর পেছন থেকে বেড়িয়ে রুশো ভাইয়ার পাশে টুপ করে বসে পড়লাম আমি। আমায় দেখে ভ্রু যুগলে ঢেউ ফেলে ঠোঁট উল্টালো রুশো ভাইয়া। আমি মিষ্টি হেসে বললাম,
.
—- তোমার এটম বোম্বের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে, এতে তো তোমার খুশি হওয়ার কথা, এমন স্যাড মুড করে বসে আছো কেনো রুশো ভাইয়া?
.
রুশো ভাইয়ার নিজের উল্টে রাখা ঠোঁটটা আরো একটু উল্টে ভাইয়াদের দিকে চোখের ইশারায় তাকাতে বললো আমায়। যার অর্থ অগ্নি ভাইয়া আর নীবিড় ভাইয়ার নিজেকে নিয়ে খিল্লি উড়ানোটা মোটেও পছন্দ হচ্ছে না তার। আমি আবারও মিষ্টি হেসে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললাম,
—- আরে ছাড়ো তো ওদের। লাফিং গ্যাস খেয়ে এসেছে বোধহয়। চলো তুমি আর আমি ডিস্কো ডিস্কো নাচি!
.
আমার প্রস্তাবটা বেশ পছন্দ হলো রুশো ভাইয়ার। চট করে দাঁড়িয়ে পড়ে দাঁত বের করে ভাইয়া বললো,
—- চাল মেরে ছুটকি, টিক টিক টিক…..!
.
🍂
.
দেখতে দেখতে কেটে গেলো আরো দু দুটো দিন। আমাদের বিয়ের শপিং ইতিমধ্যে প্রায় হয়ে যাওয়ায় গা ছাড়া দিয়ে রয়েছি আমি। তবে তোড়জোড় চলছে রাত্রি-রুশো ভাইয়ার বিয়ের কেনাকাটা নিয়ে। বাড়ির সকলেই শপিং মলে গিয়েছেন, যেহেতু নিত্য আপুর সামান্য কেনাকাটা বাদ পড়েছিলো বিধায় কথা ছিলো নীবিড় ভাইয়া আর নিত্য আপুও নিজেদের বাড়ি থেকে শপিং মলে গিয়ে সবার সাথে মিলিত হবেন।
কিন্তু মাঝখান থেকে বাধ সাজলো আমার হ্যাংলা পাতলা শরীরটা। কেনো যেনো বড্ড বেশি ক্লান্ত লাগছে আমার। যার ফলশ্রুতিতে আমায় বাসায় রেখেই সবাই বেড়িয়ে পড়েছে কেনাকাটার উদ্দেশ্যে। অবশ্য আমি যে একা রয়েছি তা নয় সাথে সালমা আন্টিও (সার্ভেন্ট) রয়েছেন।
.
মনটাও আজ কেমন যেনো আনচান আনচান করছে। অগ্নি ভাইয়া আর রুশো ভাইয়ার বিয়ের এক্সাইটমেন্টে লাফালাফি করেই পাড় করে দিয়েছি দিনগুলো। একটু রিল্যাক্স করে শরীরটাকে রেস্ট দেওয়াও হয়ে ওঠে নি। অথচ এদিকে যে আমারও বিয়ে হবে সে কথা মাথাতেই নেই আমার। দিব্যি ভাইয়াদের বিয়ের এক্সাটমেন্টেই মত্ত আমি।
.
আজ আকাশের বুক একদম নীল! সচরাচর আকাশ এতোটা নীল হয় না, হাল্কা আসমানী যাকে বলে ঠিক সেধরনের বর্ণ ধারণ করেই দিব্যি মাথার ওপর বিচরণ করে ওই আকাশ।
নীল আকাশের দূর সীমানায় সাদাটে মেঘমালা জমাট বেধে অনেকটা আইসক্রিমের রূপ ধারণ করেছে। ছোটতে যখন আব্বু কোলে করে মাঠে হাটতে নিয়ে যেতো তখন আমি আব্বুকে বলতাম,
.
—- আব্বু দেখো, আকাশে ওটা আইসক্রিম না?
.
আব্বু হেসে বলতো,
—- হুম আমার ছোট্ট পরী, তুমি তাকে যেভাবেই দেখতে চাইবে তা ঠিক সেরকমই আকৃতিতে দৃশ্যমান হবে।
.
ছোটতে আব্বুর ভারী অর্থবহ কথাটার মানে বুঝতামনা আমি। অগ্নি ভাইয়া যখন বলতো “আরে অনু, ওটা আইসক্রিম না ওটা তো ডাইনোসরের মতো লাগছে!” তখন সেই মেঘের আইসক্রিমটাকে ডাগরডাগর চোখে ডাইনোসরের রূপে দেখবার চেষ্টা চালাতাম আমি। কিন্তু আফসোস তখন ডাইনোসর কেমন দেখতে হয় তার আনুমানিক চিত্রটাও আমার স্মৃতির পাতায় ঘোলাটে ছিল।
ঠিক তখনই পাশ থেকে রুশো ভাইয়া মেঘপুঞ্জটাকে খুঁটিয়ে খু্ঁটিয়ে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলতো,
.
—- ওহ নো ব্রো, ওটা তো হাতি! তুমি ডাইনোসর পেলে কোথায়?
.
অতঃপর আম্মু আব্বুর খিলখিল করে হেসে ওঠার শব্দ মিলেমিশে সুমধুর ধ্বনির রূপ নিয়ে ভেসে আসতো আমার ছোট্ট ছোট্ট কানদুটোয়।
রুশো ভাইয়া আব্বুর কোল থেকে আমায় নামিয়ে নিজের কোলে বসিয়ে গালদুটো টেনে দিয়ে বলতো,
.
—- “তুই কি সব জায়গাতেই আইসক্রিমই দেখতে পাস রে ছুটকি?”
.
🍁
.
নিচ থেকে কলিং বেলের চিনচিনে আওয়াজ কানে আঘাত করতেই ভাবনার মধ্যে ব্যাঘাত সৃষ্টি হলো আমার। এই সময় আবার কে এলো? সবাই তো আধঘন্টাও হয়নি বেড়িয়েছে, এতো জলদি তো ফেরার কথা নয়। তাই কৌতুহলের দৃষ্টিতে ঘর থেকে বেড়িয়ে সদর দরজা বরাবর তাকালাম আমি। সালমা আন্টি দরজা খুলে দিতেই চমকে উঠলাম আমি। নীবিড় ভাইয়া! উনার তো সবার সাথে শপিং মলেই থাকার কথা ছিলো! তাহলে বাসায় কেউ নেই জানা সত্ত্বেও এলেন কেনো উনি?
.
নীবিড় ভাইয়া সালমা আন্টিকে সালাম দিয়ে আন্টি সরে দাঁড়িয়ে ভেতরে আসতে বলতেই হাল্কা হেসে দরজার ওপার থেকে ধাপ ফেলে প্রবেশ করলেন উনি। দোতলায় আমায় বিস্মিত চোখে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বাম গালে টোল ফেলে মিষ্টি হেসে চোখ থেকে সানগ্লাসটা খুললেন। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে ভাইয়ার ঘরে যেতে যেতে আমায় উদ্দেশ্য করে বললেন,
.
—- চটপট রেডি হয়ে নাও! সময় মাত্র ৫ মিনিট!
.
উনার কথায় বোকা বনে গেলাম আমি। উনি কি জানেন না আমার শরীরটা ভালো লাগছে না তাই আমি শপিং এ যাই নি? নাকি জেনে শুনেই শরীরটা আরোও খারাপ করবার জন্য লেগে পড়েছেন উনি?
.
—- কি হলো? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি ভাবছো? গো ফাস্ট…!
.
উনার ধমক খেয়ে ভাবনায় ছেদ ঘটলো আমার, চোখে মুখে বিরক্তির রেশ ফুটিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লাম আমি। আমি যেতেই মুচকি হেসে উঠলেন উনি।
.

পাঁচ মিনিটের জায়গায় চার মিনিটেই ঠোঁট উল্টে ঘর থেকে বেড়িয়ে এলাম আমি। যেহেতু রাত্রির মতো সাজগোজ তো দূরে থাক সামান্য পাউডার দেওয়াতেও এলার্জি আমার! তাই শুধু জামা পাল্টে একটা শার্ট-ফ্রক আর গলায় ওড়না জড়িয়ে চুলগুলো উঁচু করে বেধে রেডি হয়ে নিয়েছি স্রেফ।
আমায় দেখে হাত ঘড়ির দিকে একবার নজর ফেলে আবারও আমার দিকে তাকালেন উনি। “গুড” বলেই বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত গুঁজে বড় বড় পায়ে এগোতে এগোতে বলে উঠলেন,
.
—- ফলো মি…..!
.
আমিও উনার অগোচরে ভেংচি কেটে মুখ বাঁকালাম। গাল ফুলিয়ে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে উনার পেছন পেছন যেতে লাগলাম নিঃশব্দে।
.
সাথে করে আনা বাইকে উঠার বদলে মেইন রোডের উদ্দেশ্যে উনাকে হেটে যেতে দেখে ভ্রু কুঁচকালাম আমি। পেছন থেকে দৌড়ে উনার পাশাপাশি গিয়ে দাঁড়িয়ে হাটতে হাটতে জিজ্ঞেস করলাম,
—- একি বাইক নিলেন না যে? কিসে করে যাবো?
.
উনি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ছোট্ট করে বললেন,
—- রিক্সায়!
.
উনি রিক্সায় উঠবেন শুনে চোখ বড়বড় হয়ে এলো আমার। এই একটা বছরে কোনোদিনই বাইক বা কার ব্যতীত অন্য কোনো ভেহিকল এ উনাকে চড়তে দেখি নি আমি। অবশ্য বগুড়া যাওয়ার পথে ট্রেন আর সিএনজি তে উঠেছিলেন বাধ্য হয়েই। তবে উনার মুখে বিরক্তি রেশ থাকবে ভেবে পরে বোকা বনেছিলাম আমি। দিব্যি স্বাভাবিক অঙ্গ-ভঙ্গিতেই যাওয়া-আসা করেছিলেন উনি। কিন্তু এবার তো বাধ্য হয়ে রিক্সায় ওঠার মতো কোনো পরিস্থিতি হয় নি, তবে?
প্রশ্নটা করতে ইচ্ছে হলো না আর। যদি অাবার প্রশ্ন করায় রেগে গিয়ে আবারও বাইকে উঠতে বলেন উনি! তাই মুখে তালা মেরেই চুপ করে রইলাম আমি।এতোদিন পর রিক্সায় উঠবো ভেবেই মনটা ভালো হয়ে গেলো আমার।
.
রোডের সামনে আগে থেকেই একটা রিক্সা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হলাম আমি।
যেখানে ১৫ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকেও রিক্সার টিকিটিরও দেখা মেলে না সেখানে আজ আগে থেকেই রিক্সা দাঁড়িয়ে আছে, যা নিতান্তই ৭৬ বছর পর পর হ্যালীর ধূমকেতু দেখার মতোই নগন্য। আজ সূর্য ঠিক কোন দিকে উঠেছে ভাবতে ভাবতেই রিক্সা আরো একটু এগিয়ে আমদের সামনে এসে দাঁড়ালো। সাথে সাথেই টুপ করে উঠে পড়লাম আমি। উনি আমার এক্সাটমেন্ট দেখে ভ্রু কুঁচকালেন। অতঃপর মুচকি হেসে আমার পাশে রিক্সায় চড়ে “মামা চলেন” বলতেই রিক্সা ওয়ালা মামা সম্মতি পেয়ে প্যাডেল চালাতে শুরু করলেন।
আর আমি মত্ত হলাম প্রকৃতির হিমেল হাওয়ায় গা ভাসাতে।
.
চলবে……………💕