প্রেম আমার পর্ব-৬১+৬২

0
5928

#প্রেম_আমার♥
#পার্ট-৬১♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥
.
পদ্মার পাড়ে দুহাত মেলে হিমেল হাওয়া গায়ে মাখছি আমি। আমার দু হাত পেছনে ঘাসের ওপর বসে গালে হাত দিয়ে আমায় পর্যবেক্ষণ করে চলেছেন নীবিড় ভাইয়া। তবে আপাতত সেদিকে কোনো ধ্যান নেই আমার। প্রকৃতির মাঝেই যেনো ডুব দিয়েছি আমি দিন দুনিয়া ভুলে।
.
রিক্সায় বসে যখন রিক্সাওয়ালা মামা শপিং মলের উল্টো দিকে রিক্সা ঘুরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখনই হকচকিয়ে উঠি আমি। অথচ নীবিড় ভাইয়া ছিলেন ভাবলেশহীন! যেহেতু আমাদের গন্তব্য শপিং মল সেহেতু উল্টো দিকে নিয়ে যাওয়ায় মনে প্রশ্ন জাগাটা স্বাভাবিক। সেই হিসেবেই আমি চটজলদি চোখ বড় বড় করে আতংকিত কন্ঠস্বরে জিজ্ঞেস করি,
.
—- একি মামা, রিক্সা ওদিকে নিয়ে যাচ্ছেন কেনো?
.
রিক্সাওয়ালা মামা রিক্সা টানতে টানতেই জবাব দেন,
—- জে আম্মাজান, আব্বাজান তো এদিক দিয়েই নিয়ে যাবার বলছে, এদিক দিয়াই কাছে হয়!
.
রিক্সাওয়ালা মামার জবাবে ভ্রু কুঁচকালাম আমি। শপিং মল তো এদিক থেকেই আর একটু এগোলেই পাওয়া যাবে। আবার উল্টো কোন পথ দিয়ে নিয়ে যেতে বলেছেন নীবিড় ভাইয়া? প্রশ্নগুলো মাথায় ভোমরার মতো ভনভন করায় বিস্ময়ে উনার দিকে তাকাই আমি। কুঁচকে রাখা ভ্রু যুগল আগের তুলনায় আরো খানিকটা কুঁচকিয়ে জিজ্ঞেস করি,
—- কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমায় বলুন তো?
.
উনি ভাবলেশহীন ভাবেই গা এলিয়ে দিয়ে হাত দুটো ভাজ করে চুপটি করেই চোখ দুটো বুজে নেন। এতে যেনো আতংক আরো কমার বদলে বেড়েই চলে আমার। প্রশ্নের কোনো জবাব না আসায় চরম বিরক্ত হই আমি, অধৈর্য্য হয়ে উনার হাত ঝাঁকিয়ে অাবারও প্রশ্ন করি,
.
—- কি হলো বলুন কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমায়?
.
উনি চোখ দুটো বুজা অবস্থাতেই কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ ফেলেন। চোখ দুটো খুলে আমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে রহস্যময় কন্ঠে বলে উঠেন,
—- তোমায় কিডন্যাপ করতে নিয়ে যাচ্ছি,
এখন চুপচাপ বসে থাকো নয়তো রিক্সা থেকে ফেলে দেবো। স্টুপিড!
.
উনার ধমক খেয়ে মুখে আঙুল চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলি আমি। কি দরকার কথা বাড়ানোর? জানিই তো আমার বলা না বলায় উনি থামবেন না বরং বেশি টেরিবেরি করলে উনার ভাষ্যমতে রিক্সা থেকে আমায় ফেলে দেবেন নির্ঘাত!
.
রিক্সা এসে পদ্মার পাড়ে বেশখানিকটা দূরত্ব রেখে থামতেই অবাক চোখে নদীর পানি দেখতে লেগে পড়ি আমি। বর্ষায় নদী যেনো ভরে টুইটুম্বুর! কিনারা কিনারায় পানিতে ভর্তি হয়ে গিয়েছে। এর আগেও গ্রীষ্মে এসেছিলাম পদ্মার পাড়ে তবে এদিকটায় না, আরোও বেশ খানিকটা দূরে নদীর ওপাড়ে।
নদীতে আজ এতো পানি দেখে মনপ্রাণ জুড়িয়ে গেলেও সামান্য ভয়ও কাজ করতে লাগে আমার। সেবার ভার্সিটিতে পুলে পরে হাবুডুবু খাওয়ার কথা ভাবলেই এখনোও গায়ের কাটা শিউরে ওঠে। লোম দাঁড়িয়ে যায় ভয়ে। যেহেতু আমি সাঁতারে আস্ত একটা রসগোল্লা সেহেতু পানি দেখে ভয় পাওয়াটা নিতান্তই স্বাভাবিক ব্যাপার আমার ক্ষেত্রে।
.
উনি রিক্সার ভাড়া চুকিয়ে আমায় নামিয়ে দিয়ে নিজেও নেমে পড়েন। রিক্সাওয়ালা মামার সাথে কুশল বিনিময় করে আমার দিকে ফিরে তাকান উনি। আমায় হা করে নদীর দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠেন,
—- ওভাবে হা করে দেখার কিছুই নেই, এর থেকেই বেশি পানি মেইবি তুমি তোমার পেট নয় আস্ত একটা কূয়োতে প্রতিনিয়ত ধারণ করে থাকো!
.
উনার কথায় নদীর দিক থেকে নজর সরিয়ে চোখ ছোট ছোট করে উনার দিকে তাকিয়ে বলি,
—- কি বললেন আপনি? আমার পানি খাওয়া নিয়ে কি আপনার মজা করা আজীবনেও বন্ধ হবে না?
.
উনি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে কপালে পরে থাকা চুলগুলোয় হাত চালিয়ে ঝাঁকিয়ে ছোট্ট করে বলেন “নেভার!”
.
🍂
.
বর্তমানে আকাশের অবস্থা দেখে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। এই মেঘ করছে তো এই উধাও!
সাথে বইছে মন জুড়িয়ে যাওয়া ঠান্ডা হাওয়া! এদিকটায় মানুষের আনাগোনা খুব কম দেখে বেশ ভালো লাগছে আমার। নাহলে পদ্মার পাড়ে মানুষের ভীড়ে নিজেকে একটা ক্ষুদ্র পীপিলিকা বৈ কিছুই মনে হয়না আমার। এখন নদীর পাড়ের পাশে মানুষদের চলাচলের জন্য “ওয়াক ওয়ে” নির্মাণ করা হয়েছে তাই সহজে হেটে হেটে নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
.
বাতাসে নদীতে আজ আনন্দের ঢেউ! নদীতে বেশ কয়েকটা ছোট্ট ছোট্ট নৌকো চলছে। নওগাঁর ওদিকে এগুলোকে ডিঙি নৌকা বলে, এদিকটায় ঠিক কি বলে জানা নেই আমার।
আমার ভাবনার মাঝেই কাধে নীবিড় ভাইয়ার উষ্ণ স্পর্শে কেঁপে উঠলাম আমি। মুখ ঘুরিয়ে তাকাতেই উনি মুচকি হেসে ভ্রু নাচিয়ে বললেন,
—- কি? এখন আর শরীর খারাপ লাগছে না তো?
.
বিনিময়ে ভাবতে লাগলাম আমি। আরে আসলেই তো আমার শরীর খারাপ লাগছে না আর! বিষন্নতার ছিটেফোঁটাও নেই, ক্লান্তি ভাবটাও একদম চলে গিয়েছে।
উত্তর খুঁজে পেয়ে অসম্মতিসূচক মাথা ডানে-বামে নাড়াতেই হাসলেন উনি। হাত দুটো প্যান্টের পকেটে গুঁজে নদীতে স্থির দৃষ্টি ফেলে বলতে শুরু করলেন,
.
—- ইউ নো হোয়াট বডি এন্ড মাইন্ড রিফ্লেক্টস ইচ অদার! যদি তোমার শরীর খারাপ থাকে দেন ডেফিনেটলি তোমার মনটাও খারাপ হয়ে আসবে। কোনোকিছুতেই ভালো লাগবে না। বরং এই মন খারাপ ভাব থেকে শরীর খারাপটা আরো ক্রমশ বেড়েই চলে! তাই যদি আমার কখনো শরীর খারাপ থাকে তবে আমি কখনোই মনমরা হয়ে বসে থাকি না। সেই ক্লান্ত অবসাদগ্রস্ত শরীরটাকে ভালো রাখতে শুইয়ে রাখার বদলে এখানে চলে আসি। নদীর পানিতে পা ভিজিয়ে জোড়ে শ্বাস টানি! দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনের যত আক্ষেপ, বিষন্নতা সব ছড়িয়ে দেই প্রকৃতিতে।
.
খুব মনোযোগ দিয়েই উনার কথাগুলো শুনলাম আমি তবে আমার দৃষ্টি উনার স্নিগ্ধ মুখখানাতেই স্থির! বাতাসে সিল্কি চুলগুলো ঢেউ খেলিয়ে উড়ছে উনার। সূর্যের উজ্জ্বল আভা সোজা এসে পড়ছে উনার মুখে। কি অদ্ভুৎ সৌন্দর্য! ছেলেরাও বুঝি এতো সুন্দর হয়? কিন্তু কেনো? ছেলেদের তো এতো সুন্দর হওয়া সাজে না। একেবারেই সাজে না, নয়তো মানুষ রূপি বহু শাঁকচুন্নির ভয় থাকে আমার মতো ছোট্ট ছোট্ট কলিজার অধিকারীদের।
.
উনি সম্মুখ পান থেকে নজর সরিয়ে আমার মুখ পানে ফিরে তাকালেন। আমায় নিজের দিকে এমন পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকালেন উনি। ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি ঝুঁলিয়ে নরম গলায় বললেন,
—- ওভাবে তাকিয়ো না, খুন হয়ে যাবো তো আমি!
.
উনার এমন লজ্জা ছুড়ে মারা কথায় চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলাম আমি। নিজের হ্যাবলামির জন্য বড্ড রাগ লাগছে চোখ দুটোর ওপর! কি দরকার এভাবে হ্যাংলার মতো চেয়ে চেয়ে উনাকে দেখা! সেই লজ্জায় পড়তে হলো তো? কিন্তু কিই বা করতে পারি আমি? এতো সুন্দর জামাই থাকলে চোখ তো অটোমেটিক্যালিই শুধু “সাদা বিলাই” “সাদা বিলাই” করতে করতে ছুটে চলে উনাতেই! এতে আমার তো কোনো দোষ নেই! দোষ তো উনার! এভাবে খোলামেলা হয়ে বেড়োন কেনো উনি? মাস্ক পড়ে বুঝি আসতে পারেন না?
.
🌸
.
ছাউনি যুক্ত ছোট্ট নৌকোয় উঠে পানিতে হাত ডুবিয়ে খেলছি আমি। পাশেই নীবিড় ভাইয়া মাঝির সাথে হেসে হেসে এটা ওটা নিয়ে কথা বলছেন। নদীর স্রোতে পানিগুলো হাতের কব্জি পাড় করে উপরে উঠে ভিজিয়ে দিচ্ছে হাতটা। পানির স্পর্শে ঠান্ডা গা হিম করা অনুভূতি নাড়া দিচ্ছে পুরো শরীর জুড়ে।
খড়স্রোতা নদীর বুক চিরে এগিয়ে যাওয়া নৌকোর দ্বারা সৃষ্ট পানির কলকল ধ্বনি সুমধুর ঠেকছে আমার কান দুটোয়।
.
নৌকা নদীর মাঝামাঝি চলে আসতেই কপালে দু-এক ফোটা জলের অস্তিত্ব অনুভব করলাম আমি। বিস্ময়ে আকাশ পানে তাকাতেই আরো কয়েক ফোটা জল আকাশের বুক চিরে টপটপ করে ঝড়ে আবারও চোখে-মুখে পড়লো আমার।
বৃষ্টি! এই অবেলায় সূর্যের উপস্থিতিতেই বৃষ্টি পড়ছে ব্যাপারটা অদ্ভুত! রোদ-বৃষ্টি একসাথে সচরাচর দেখা যায় না তবে দেখা গেলে মন্দ হয় না। রুশো ভাইয়া থাকলে আমায় কোলে বসিয়ে হেলেদুলে বলতো,

—- দেখ ছুটকি! রোদ হয়, বৃষ্টি হয় খেঁকশিয়ালের বিয়ে হয়।
.
আমার ভাবনার মাঝেই হাত ঝাঁকিয়ে ব্যস্তস্বরে নীবিড় ভাইয়া বলে উঠেলেন,
—- অনন্যা, বৃষ্টি পড়ছে তো। ছাউনির নিচে চলো তাড়াতাড়ি।
.
আমি উনার চিন্তিত দৃষ্টিতে পলকহীন ভাবে পরম গভীরতায় চেয়ে বললাম,
—- থাকি না অারো কিচ্ছুক্ষণ! এইটুকুনি বৃষ্টিতে ভিজলে কিচ্ছু হবে না!
.
আমার কথায় নিজের আধভেজা শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে আমার পাশে বসে পড়লেন উনি। জল জমা চুলগুলোয় হাত চালিয়ে ছোট্ট করে বললেন “বেশ তো!”
বলেই আচমকা কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের কোলে বসিয়ে নিলেন আমায়। আমি বিস্ময়ে চোখ বড়বড় করে কিছু বলবো তার আগেই নিজের অাঙুল আমার ঠোঁটে চেপে ধরে শীতলস্বরে “হুউউউশশশশ…..! বলে থামিয়ে দিলেন অামায়। মিষ্টি হেসে উনি বললেন,
.
—- বৃষ্টি বিলাস করি চলো!
.
আমিও স্মিথ হেসে সম্মতি জানালাম। হাত দুটো মেলে বৃষ্টিতে গা ভিজাতে লেগে পড়লাম আমি। উনি কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে আমায় বৃষ্টি উপভোগ করতে দেখে প্রশান্তি মাখা হাসি হাসলেন। আমার ঘাড়ে নিজের থুতনি রেখে মৃদু স্বরে শীতল কন্ঠে বললেন,
—- ভালোবাসি!
.
উনার মুখে ” ভালোবাসি” শব্দটা শুনে বুকের ভেতর চিনচিন করে উঠলো আমার। পুরো শরীর জুড়ে শীতল শিহরণ বয়ে গেলো নিমিষেই! এই প্রথম বোধহয় মুখ ফুটে “ভালোবাসি” শব্দটা সরাসরি আমায় বললেন উনি। নিজের কর্ম দ্বারা প্রতিনিয়ত মনের মাঝের সুপ্ত অনুভুতি বুঝিয়ে দিলেও মুখ ফুটে বলেন নি এর আগে। তাই হঠাৎ এভাবে বলায় বড্ড লজ্জায় পড়লাম আমি। অস্বস্তিতে পড়ে আড়চোখে নদীর একূল-ওকূল চোখ বোলাতে লাগলাম।
এদিকে বৃষ্টি প্রায় থেমে এসেছে, বেগও ছিলো কম। দূর আকাশের সূর্যের ডুবি ডুবি ভাব।
নীবিড় ভাইয়া আমার অস্বস্তিকর অবস্থা বুঝতে পেরে মৃদু হাসলেন। ঘাড় থেকে থুতনি সরিয়ে মাঝিকে বললেন, “চাচা নৌকা কিনারায় নিয়ে গিয়ে থামাও!”
“আইচ্ছা বাবা” বলেই বৈঠা বইয়ে নদীর পাড়ের দিকে এগোতে লাগলেন মাঝি।
.
এতোক্ষণে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। পানির কলকল ধ্বনি হয়েছে ক্ষীণ! মাঝে দুজনের পিনপতন নীরবতা! শ্বাস-প্রশ্বাস আর হৃদপিন্ডের ডিবডিবে আওয়াজ দুটোই পানির ধ্বনিতে মিশ্রিত হয়ে শ্রবণের অগোচর! নীবিড় ভাইয়া আমার অস্বস্তি কাটাতে আকাশ পানে তাকালেন, হঠাৎ কিছু একটা চোখে পড়ায় উনি উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন,
.
—- অনন্যা, দেখো রংধনু….!
.
রংধনুর কথা কানে আসতেই চমকে উঠলাম আমি, তড়িঘড়ি করে আকাশের পানে দৃষ্টি ফেলতেই দৃশ্যমান হলো সাতরঙা রংধনুর মনোমুগ্ধকর চিত্র!
অবাক-খুশি হয়ে উত্তেজনায় উনার হাত চেপে ধরে বলে উঠলাম,
—- ওয়াও! কতো সুন্দর রামধনু!
.
আমায় খুশি হতে দেখে হাসলেন উনি। নৌকা পাড়ে গিয়ে ভিড়তেই হাল্কা ধাক্কা অনুভূত হলো নৌকোয়। মাঝি চাচা আমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন,
.
—- সাবধানে নাইমো তোমরা।
.
নীবিড় ভাইয়া আমায় কোল থেকে নামিয়ে বসিয়ে দিলেন। ছাউনির ভেতরে গিয়ে মানিব্যাগ আর ফোনটা হাতে নিয়ে কয়েকটা নোট বের করে চাচার দিকে এগিয়ে দিলেন উনি। ভাড়ার তুলনায় অতিরিক্ত টাকা দেখে চাচা কপাল কুঁচকালেন। নীবিড় ভাইয়া মিষ্টি হেসে বললেন,
—- ধন্যবাদ চাচা, এতো সুন্দর একটা দিন উপহার দেওয়ার জন্য! আর না করবেন না প্লিজ! নিজের ছেলে ভেবেই টাকাগুলো নিন।
.
মাঝি চাচার চোখদুটো যেনো ভরে এলো, উনি নীবিড় ভাইয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
—- সুখে থাহো! অনেক বড় হ বাবা! কিন্তু এতো টাকা তো নিবার পারুম না!
.
নীবিড় ভাইয়া আবারও হাসলেন। চাচার অগোচরে বাড়তি টাকা বিছিয়ে রাখা পাটির ওপরে রেখে দিয়ে বাকি টাকা চাচার হাতে দিয়ে “ভালো থাকবেন” বলেই আমার দিকে এগিয়ে এলেন। চট করে আমায় শূণ্যে তুলে নিয়ে সাবধানে নেমে পড়লেন নৌকা থেকে। হয়তো নৌকায় উঠার সময় আমার কাঁপাকাঁপি অবস্থা দৃশ্যমান হয়েছিলো উনার তাই দ্বিতীয় বার একই রিস্ক নিতে নারাজ উনি।
.
🌹
.
বাসায় পৌঁছোতে পৌঁছোতে আধার ঘনিয়ে এলো। বৃষ্টি খুব কম সময় হবার কারণে একেবারে যে ভিজে চিপচিপে হয়ে গিয়েছি এমনটা নয়। আসার সময় হুড তোলা রিক্সায় নীবিড় ভাইয়া নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ রেখেই নিয়ে এসেছিলেন আমায়। যতটা সম্ভব আড়াল করেই রেখেছিলেন। তাই খুব একটা সমস্যা হয় নি।
তবে বাসায় এসে বাধলো বিপত্তি! তোয়ালা গায়ে জড়িয়ে দিয়ে দু-তিনটে বকা খেতে হয়েছে আম্মুর। আম্মুর আশংকা বিয়ের আগে জ্বর বাধালে জোয়ালা মুখি ফাটিয়ে দেবেন তিনি!
.
ঠোঁট উল্টে বিছানায় বসে পা দোলাচ্ছি আমি। এতোক্ষণ নিত্য আপু শপিং থেকে ফিরে আমাদের বাসাতেই ছিলো। নীবিড় ভাইয়া এসে শার্ট বদলে কিচ্ছুক্ষণ থেকেই চলে গিয়েছেন আপুকে নিয়ে। তাই বড্ড একা একা লাগছে আমার। দুদিন পরই বিয়ে তাও উনাকে ছাড়া একটা মুহুর্তেও থাকা কষ্টসাধ্য হয়ে আসছে খুব। মাত্র দুটো দিনো ধৈর্য্য ধরে থাকতে পারছিনা আমি। অথচ উনি আমার কাছে থাকলেই আবার অস্বস্তিতে পড়তে হয় আমায়। বুঝিনা আমি এতোসব উল্টো-পাল্টা অনুভূতির মানে। যখন উনি কাছে থেকে দূরে যান তখন ইচ্ছে হয় হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলি “থেকে যান না প্লিজ!” আবার উনি থেকে গেলে অস্বস্তিতে মরি! উফফফফ এত্তো ইরিটেটিং কেনো সময়ে সময়ে পাল্টি খাওয়া ফিলিংস গুলো?
.
ভাবনার মাঝেই দরজায় টোকা পড়লো ঘরের। রুশো ভাইয়া আর অগ্নি ভাইয়া মাথা বের করে উঁকি মেরে শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,
—- মে উই কাম ইন?
.
ভাইয়াদের ঢং দেখে মুখ বাঁকালাম আমি। ভেংচি কেটে বললাম,
—- পারমিশন নেওয়ার কি আছে?
.
ভাইয়ারা দুষ্টু হাসি দিয়ে ঘরে ঢুকে পেছনে কিছু একটা আড়াল করে এগিয়ে এলো। রুশো ভাইয়া ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—- ব্রোকে মিস করছিস ছুটকি?
.
আমি চোখ ছোট ছোট করে আবারও ভেংচি কেটে বললাম,
—- মোটেই না।
.
অগ্নি ভাইয়া দাঁত বের করে বললো,
—- আচ্ছা ঠিক আছে বলতে হবে না। আমরাও বুঝি! এখন শুন তোর জন্য দুটো সারপ্রাইজ আছে!
.
সারপ্রাইজের নাম শুনতেই চোখ চিকচিক করে উঠলো আমার। কারণ ভাইয়াদের সারপ্রাইজ মানেই দারুণ কিছু! অগ্নি ভাইয়া আমার খুশি হতে দেখে বললো,
—- সারপ্রাইজটা দেবো বাট তার আগে আমাদের একটা কনডিশন আছে।
.
সারপ্রাইজ দেবে তাতে আবার কনডিশন! ব্যাপারটায় ভ্রু কুঁচকে এলো আমার। চিন্তিত হয়ে কপালে ভাঁজ ফেলে পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম,
—- কি কনডিশন?
.
রুশো ভাইয়া দাঁত কেলিয়ে বললো,
—- বেশি কিছু না ছুটকি! শুধু কাল রাতে ছাদে যাওয়া যাবে না তোদের!
.
আমি কিছু না ভেবেই ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললাম,
—- আরে এ আর এমন কি? ছাদে তো রাতে যাইই না, এখন ফটাফট সারপ্রাইজ দাও!
.
আমার পজিটিভ উত্তর পেয়ে দুজনেই খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। পেছন থেকে দুটো প্যাকেট বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে দুজনেই ধারাবাহিক ভাবে বলতে লাগলো,
—- এটাতে তোর ফেভারিট ব্লাক শাড়ি! (অগ্নি)
.
—- আর এটাতে তোর ফেভারিট চকলেটস! কি সারপ্রাইজ পছন্দ হলো তো? (রুশো)
.
আমি শাড়ি আর চকলেটের বক্সটায় হাত বুলিয়ে “থ্যাংক ইউ সো মাচ ভাইয়া’স” বলেই অগ্নি ভাইয়া আর রুশো ভাইয়ার গলা জড়িয়ে ধরলাম। রুশো ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
—- আরে মেরে ছুটকি খুশ হো গেয়া!
.
অগ্নি ভাইয়া আমায় চকলেট খেতে খেতে সময় কাটাতে বলে দুষ্টু হাসলো। আমার নাক টেনে দিয়ে দুজনেই দরজা চাপিয়ে দিয়ে বেড়িয়ে গেলো নিঃশব্দে! ভাইয়ারা যেতেই আমি শাড়ি দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। যেকোনো ব্লাক প্রসাধনীই আমার কাছে অসম্ভব প্রিয়!
.
🍁
.
অনন্যার ঘর থেকে বেড়িয়ে অগ্নি আর রুশো উল্লাসিত হয়ে হাত উঠিয়ে হাই ফাইভ করলো। দুজনেই মিটিমিটি হেসে আড় চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিলো। অগ্নি রহস্যময় কন্ঠে রুশোকে বললো,
—- কাল কি হতে যাচ্ছে জানিস তো?
.
রুশো দাঁত কেলিয়ে বললো,
—- ওভিয়েসলি ব্রো!
.
বলেই দুজনেই এক সাথে গলা মিলিয়ে চাপা স্বরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
—- ব্যাচেলর পার্টি……..!

চলবে………………..💕

#প্রেম_আমার♥
#পার্ট-৬২♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥
.
🌺
.
বেডরুমে গোল হয়ে গভীর ভাবনায় ডুব দিয়েছি আমি, রাত্রি আর নিত্য আপু। তিনজনেই মাথাতে একই চিন্তা কিলবিল করছে। শুধু পার্থক্য ভাবনা একটা কিন্তু মাথা তিনটে।
এভাবেই বেশকিছুক্ষণ ভাবার পরই আমি বাম সাইডের ভ্রু উঁচু করে ঠোঁট কামড়ে ধরে বললাম,
.
—- ব্যাচেলর পার্টি রাইট? বেশ তো! শুধুই ছেলেরাই কেনো পার্টি কর‍তে পারবে? আমরা মেয়েরা কি বানের জলে ভেসে এসেছি নাকি? আমরাও করবো ব্যাচেলর পার্টি!
.
আমার কথায় রাত্রির চোখে মুখে প্রথমে উত্তেজনা ভর করলেও তা নিমিষেই হতাশায় পরিণত হলো। কপালে ভাঁজ ফেলে ঠোঁট উল্টে রাত্রি বললো,
—- কিন্তু তুই তো ব্যাচেলর নস! বিবাহিত! একদম পিউর ম্যারিড!
.
রাত্রির কথায় মেজাজটা অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে বিগড়ে গেলো আমার। কেবল মুড নিয়ে বড়বড় ডায়ালগ মারছিলাম, বাস্তবে যতোটাই প্রয়োগ করা হোক কি না হোক জোশ আসা চাই এই ভেবে। বাট না আমার এই মাথা মোটা বেস্টু পুরো বিরিয়ানির মধ্যে বোরহানি ঢেলে ফেললো। আমি কোমড়ে দু হাত দিয়ে চোখ ছোট ছোট করে রাত্রির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,
.
—- এই শুন, বাসর ঘরে ঢুকার পূর্বে সবাই সিঙ্গেল। সো এখন চুপ থাক! পুরো মুডটাই নষ্ট করে দিলো শাঁকচুন্নি একটা!
.
আমার এমন যুক্তিহীন যুক্তি শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে ফেললো রাত্রি। আর নিত্য আপু তো শুনেই ঘর কাপিয়ে হু হা করে হাসতে শুরু করে দিলো। ওদের দুজনের রিয়াকশন দেখে আমি ঠোঁট উল্টালাম। কথা ঘোরানোর জন্য প্রসঙ্গ পাল্টে বলে উঠলাম,
—- ওসব কথা বাদ! এখন বল কি কি অর্ডার করবো? পিৎজা, বার্গার, স্যান্ডউইচ, কেক, কোল্ড ড্রিংকস! আর কিছু?
.
🍂
.
গতকাল অগ্নি ভাইয়া আর রুশো ভাইয়া যাবার পর আমি চুপিচুপি দরজার কাছে গিয়ে আড়ি পেতে তাদের খুশুর-ফুশুর সব শুনে ফেলেছিলাম অথচ আমার ভোলাভালা ভাইয়েরা তা আন্দাজই করতে পারে নি!
“ব্যাচেলর পার্টি” শব্দটা শুনেই চোখ ছোট ছোট হয়ে আসে আমার। এতোদিন বিয়ে করবে বলে দুটোয় লাফাতে লাফাতে ফ্লোর ভেঙে ফেলে এখন এসেছে ব্যাচেলর পার্টি করতে? না না এতো মানা যায় না। কিছু না কিছু তো করতেই হবে। শুধু ছেলেরাই পার্টি করবে আর আমরা মেয়েরা কি ঘাসে মুখ দিয়ে চলবো? অবশ্যই না।
তাই আমি মনে মনে প্যাচ কষতে বসি। ভেবে রাখি নিত্য আপু আর রাত্রি আসলেই ধামাকা টাইপ ধামাল করতে হবে।
.
যেহেতু তিন জুটির বিয়েই একসাথে হবে সেহেতু একই জায়গায় বিয়ের অনুষ্ঠান করা বাধ্যতামূলক, এমনটাই কথা আছে। সেই হিসেবেই আমাদের বাসায় বিয়ের আয়োজন করা হচ্ছে। কারণ রাত্রিদের বাড়িতে এতো স্পেস নেই, আবার নীবিড় ভাইয়াদের বাড়ি উল্টো দিকে। সেই দিক থেকে রাত্রি আর নীবিড় ভাইয়াদের বাড়ির মিডিলে পরে আমাদের বাড়ি। দু বাড়ি থেকে অল্প একটু এলেই সবাই একসাথে একত্রিত হতে পারবে। তবে গায়ে হলুদ যার যার বাড়িতেই হবে।
যেহেতু বিয়ে বাড়ি, কাজও সেরকম। পুরো বাড়িতেই বিয়ে বিয়ে ভাব। এক অন্যরকমের গন্ধে মো মো করছে পুরো বাড়ি জুড়ে। ডেকোরেশনের লোকেরা তোড়জোড় করে বাড়ি সাজাচ্ছে। তবে মজার ব্যাপার হলো সকলের বিদায় হলেও আমার বিদায় হবে না। অদ্ভুত হলেও এরকমটা বোধহয় প্রথম হচ্ছে যেখানে তিন ভাই-বোনের বিয়ে একই দিনে একই বাড়িতে হবে আবার রাতে বাসরও পাশাপাশি তিনটে ঘরে হবে!🙈
যার জন্য বিয়ের পরে বিদায়ের মুহুর্তে আর পাঁচটা মেয়ের মতো হাউমাউ করে কান্না করে চোখের জলে নাকের জলে এক করে ভাসাতে হবে না আমায়। তবে তার পরে অবশ্য কাঁদতে হতে পারে, বাট এটলিস্ট বিয়ের দিন তো হবে না এটা ভেবেই মনটা নেচে উঠছে আমার।
.
🌹
.
বর্তমানে আমরা রেস্টুরেন্ট থেকে নানান রকমের খাবারের অর্ডার দিয়ে ডেলিভারি আসার অপেক্ষায় প্রহর গুনছি। ভাইয়ারা চুপিচুপি তাদের পার্টির এরেঞ্জমেন্ট করে ফেলেছে। ছাদটাও যেহেতু ডেকোরেশন করা হয়ে গিয়েছে সেই হিসেবে তাদের বেশ সুবিধেই হবে পার্টির ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে। তবে মজার বিষয় হচ্ছে তারা একদম প্রাইভেসির সাথে তাদের ব্যাচেলর পার্টিটা করতে যাচ্ছে যার কারণ আপাতত না জানলেও রহস্য ঠিক সময় উদঘাটন করেই আমরা দম নেবো। তারা শুধু ছাদে কাউকে যেতেই মানা করে নি ইনফ্যাক্ট ছাদের দরজায় এত্তোবড় একটা পোস্টার ঝুলিয়ে সেটাতে লিখেও দিয়েছে, “DO NOT DISTURB”
যা আমাদের আটকানোর বদলে রহস্যভেদ এর কৌতূহল আগের তুলনায় আরো কয়েক গুণ বাড়িয়েই দিয়েছে।
.
প্রায় ১০ মিনিট পর কলিং বেলের তীক্ষ্ণ আওয়াজ কানে আঘাত হানতেই প্রাপ্তির হাসি ফুটে উঠলো আমাদের মুখে। এক লাফে বিছানা থেকে নেমে দ্রুত পায়ে ছুটে চললাম আমি দরজা খুলতে। কিন্তু আফসোস আমি পৌঁছানোর আগেই সালমা আন্টি দরজা খুলে দিয়েছেন। সালমা আন্টিকে দেখে ডেলিভারি বয় এত্তোবড় একটা বক্স হাতে মুচকি হাসলো। বক্সটা আন্টির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “ইউর ডেলিভারি ম্যাম!”
ডেলিভারি বয়ের কথাটার উল্টো মানে ধরে নিয়ে বিস্ময়ে সালমা আন্টি বোকার মতো চোখ বড় বড় করে ফেললো। চোখ মুখ উল্টে আন্টি বলে উঠলো,
.
—- এই ছ্যামড়া, আমার ডেলিভারি হইবো মানে? আমারে দেইখা কি তোর পোয়াতি বইলা মনে হয়?
.
সালমা আন্টির সোজাসাপ্টা কথার এমন উদ্ভট জবাবে বেকুব সেজে ভ্রু কুঁচকে মুখ হা করে ফেললো ডেলিভারি বয়। পরিস্থিতি আরো বিগড়ে যাবে বুঝে এক ছুটে দরজার সামনের গিয়ে দাড়িয়ে পড়লাম আমি। বক্সটা চট করে হাতে নিয়ে জোড়পূর্বক হাসার চেষ্টা করে দাঁত বের করলাম। আমতা আমতা করে আন্টিকে বললাম,
.
—- আরে সালমা আন্টি তুমি ভুল বুঝচ্ছো! তু…তু…তুমি যাও আমি দেখছি!
.
বলেই বুঝিয়ে সুঝিয়ে আন্টিকে সরিয়ে আবারও জোড়পূর্বক হেসে ডেলিভারি বয়কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলাম,
—- ইয়ে মানে আপনি কিছু মনে করবেন না, দিন বিলের কাগজটা আমি পেমেন্ট করে দিচ্ছি।
.
ডেলিভারি বয় আর কথা বাড়ালো না, মাথা চুলকে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বিলের কাগজটা আমায় দিতেই আমি বিল পে করে মৃদু হাসলাম। এদিক ওদিক আড় চোখে তাকিয়ে নিয়ে সর্তকতার সাথে বক্সটা লুকিয়ে পা বাড়ালাম ঘরের উদ্দেশ্যে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাগান সাইডে গিয়ে প্যান্ডেল টাঙ্গিয়ে নিতে হবে আমাদের।
.
🌸
.
—- হেই ব্রো, আজ লুঙ্গি পড়ে থাকলে বেটার হতো তাইনা?
.
রুশোর প্রশ্নে ফিক করে হেসে ফেললো অগ্নি। রুশোর কাধ চাপড়ে সে বললো,
—- তা অবশ্য ঠিক বলেছিস! কিন্তু ভেবে দেখে সেবারের মতো লুঙ্গি কোমড় থেকে তোর হাতে না চলে যায়! 😂
.
সেবারের কথা মনে পড়তেই লজ্জায় পড়ে ঠোঁট উল্টালো রুশো। তার লজ্জামাখা গাল লাল হয়ে যাওয়া ফেইস দেখে হাসির বেগ বাড়িয়ে দিলো অগ্নি। এমন সময় নীবিড়ের ডাকে সচেতন চোখে উল্টো দিকে ফিরে তাকালো দুজনেই,
—- ওই শালা এগুলো কি? কোত্থেকে আসলো এখানে?
.
অগ্নি-রুশো নীবিড়ের কথার কোনো অর্থ খুঁজে না পেয়ে একে অপরের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। বড়বড় পায়ে টেবিলের দিকে এগিয়ে যেতেই নীবিড় আবারও চেঁচিয়ে উঠলো,
—- আমি তো এগুলো অর্ডার করি নি, এসব আসলো কোথায় থেকে?
.
অগ্নি-রুশো নীবিড়ের দেখানো টেবিলের ওপর কোল্ড ড্রিংকস এর বদলে অন্য দুটো বতল দেখে চোখ বড়বড় করে ফেললো। রুশো মুখ হা করে অবাক কন্ঠে বলে উঠলো,
—- ও মাই গড! Whiskey and Vodka! ইয়াক! এগুলো তো আমি অর্ডার করি নি!
.
রুশোর কথায় এবার সন্দেহের দৃষ্টি অগ্নির দিকে ফেললো নীবিড়। নীবিড়ের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে অগ্নিও রুশোর সাথে সহমত প্রকাশ করে ভ্রু কুঁচকে বললো,
—- তো কি আমি করেছি নাকি? আমিও এসব ছাইপাঁশ অর্ডার করিনি!
.
দুজনেরই নেগেটিভ এন্সার পেয়ে চিন্তায় পড়ে গেলো নীবিড়। এসব ড্রিংকস যদি কেউই অর্ডার না করে থাকে তবে এলো কোথায় থেকে? অর্ডারে কি তবে কোনো গড়বড় হলো?
নীবিড় কে ভাবতে দেখে রুশো আর অগ্নি চোখ ছোট ছোট করে তার দিকে তাকালো। অগ্নি ডিটেকটিভদের মতো মুড নিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো,

—- কিরে শালা, তুইই আনিয়ে আমাদের নামে চালিয়ে দিতে চাইছিস না তো?
.
শেষমেশ নিজেকে সন্দেহ করায় ক্ষেপে গেলো নীবিড়। দাঁতে দাঁত চেপে ঝাঁঝালো কন্ঠে সে বলে উঠলো,
—- লাইক সিরিয়াসলি! আমি এসব আনিয়েছি? তুই জানিস না এসব আমার পছন্দ না? এসব আমি অর্ডার করবো ভাবলি কি করে?
শালা তুইও তোর বোনের মতো স্টুপিড হয়ে যাচ্ছিস কিভাবে বলতো?
.
নীবিড়ের ধমকে ঠোঁট উল্টালো অগ্নি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে বললো,
—- আচ্ছা কিভাবে এসেছে সেটা না ভেবে কোল্ড ড্রিংকস এর ব্যবস্থা করলে হয় না? এভাবে সময় চলে যাচ্ছে তো? হয়তো ওরা ভুল করে দিয়ে ফেলেছে।
.
অগ্নির কথার রেশ ধরেই রুশোও মাথা নাড়ালো। নীবিড় ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ ভেবে বলে উঠলো,
—- আচ্ছা আমি যাচ্ছি সামনের শপে, তোরা এখানেই থাক, পাহারা দিবি কেউ যেনো না আসে।
.
বলেই চটজলদি বেড়িয়ে গেলো নীবিড়। নীবিড় যেতেই অগ্নি-রুশো গালে হাত দিয়ে চেয়ারে বসে পড়লো। গানের ভলিউমটা বাড়িয়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো নীবিড়ের ফেরার।
.
🌹
.
—- সো আমাদের ডেকোরেশন কমপ্লিট! লেট দ্য পার্টি বিগেন।
.
—- বাট এতো রাতে যদি পেত্নী গাছ থেকে ঘাড়ের ওপর লাফ মারে? (রাত্রি)
.
রাত্রির এমন আহাম্মক মার্কা কথায় আবারও মেজাজ বিগড়ে গেল আমার। রেগেমেগে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
—- যেখনে তোর মতো একটা আস্ত পেত্নীর ঠাকুমা থাকে সেখানে অন্য কোনো পেত্নীর আসার সাহস থোরি না আছে!
.
আমার কথায় মুখ ফুলিয়ে সাপের মতো ফোণা তুললো রাত্রি। ফোসফাস করতে করতে সে বলে উঠলো,
—- কিইই আমি পেত্নী?
.
রাত্রির কথার ধাড় না ধেড়ে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ছোট্ট করে জবাব দিলাম “ওভিয়েসলি!” এতে যেনো রাত্রি আগের থেকেও বেশি ক্ষেপে উঠলো। রেগেমেগে আবারও কিছু বলবে তার আগেই নিত্য আপু দু হাত মেলে আমাদের থামতে ইশারা করে বলে উঠলো,

— থামো দুজনে, নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে সময় বরবাদ না করে ওদিকে দেখো, ভাইয়া বেড়িয়ে কোথায় যেনো গেলো তার মানে ওরা এখনও পার্টি স্টার্ট করেনি। এর মধ্যেই আমরা মজা করে নেই। আর যখন ওরা হইচই করতে শুরু করবে ঠিক তখনই আমরা আমাদের মিশন এট্যাক করবো, ওকে?
.
নিত্য আপুর কথায় বুক ফুলিয়ে জোড়ে শ্বাস টেনে দুজনেই একসাথে “ওকে” বলে সম্মতি জানালাম। নিত্য আপু হাসলো, অডিও স্পিকারে লুঙ্গি বিহীন লুঙ্গি ড্যান্স সং ছেড়ে দিয়ে স্কার্ট ধরেই উড়াধুড়া নাচতে শুরু করে দিলাম তিন জনই।
.
💃
.
—- ব্রো তুমি একটু থাকো আমি একটু ইয়ে করে আসছি।
.
রুশোর কথায় ভ্রু কুঁচকালো অগ্নি, ইয়ে করা বলতে কি করা বুঝতে না পেরে সে বলে উঠলো,
—- ইয়ে মানে আবার কি?
.
এতো সহজ একটা কথা অগ্নি বুঝতে না পারায় হতাশ হয়ে ঠোঁট উল্টালো রুশো, ফিসফিস করে সে বললো,
—- আরে ব্রো ইয়ে মানে বোঝো না? ইয়ে মানে তো ইয়েই, আই মিন সুসু সুসু।
.
অগ্নি এবার বুঝতে পেরে ফিক করে হেসে উঠলো। রুশোর চুলগুলো এলোমেল করে দিয়ে বলে উঠলো,
—- যা যা, ছাদ নষ্ট করিস না।
.
রুশো শব্দ করে “হেহে” বলে হাসলো, এলোমেলো করে দেওয়া চুলগুলো দুহাতে ঠিক করতে করতে দৌড় লাগালো ওয়াশরুমে উদ্দেশ্যে। রুশো যেতেই অগ্নি গালে হাত দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো। চোখে এসে হানা দিলো তার রাজ্যের ঘুম।
.
এর মাঝেই ছাদে প্রবেশ ঘটলো এক জোড়া পায়ের। এদিক-ওদিক চোখ বোলাতে বোলাতে ধীর পায়ে এগিয়ে চললো সে অগ্নির দিকে। কিন্তু আবারও হতাশা এসে ভর করলো তার মুখে। অগ্নি গভীর ঘুমে ডুব দিয়েছে চেয়ারে বসে গালে হাত রেখেই। তা দেখে মুখ ভার করে উল্টো দিকে ঘুরবে তার আগেই টেবিলের ওপর সফট ড্রিংকসের বোতল চোখে পড়ায় থেমে গেলো সে। পুরো বাড়িতে বোনকে খুঁজতে খুঁজতে বড্ড তৃষ্ণা পেয়ে গিয়েছে তার। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে টেবিলের কাছে গিয়ে বোতল থেকে গ্লাসে সফট ড্রিংস ঢেলে নিয়েই কিছু না ভেবে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো সে। কিন্তু খাওয়ার পরই সে বুঝলো সফট ড্রিংসের স্বাদটা অন্যরকম কেমন যেনো বিদঘুটে! কিছুক্ষণ টেস্টটা বুঝার চেষ্টা করে আবারও এক গ্লাস ঢেলে নিলো সে গ্লাসে। একটু মুখে দিতেই চোখ-মুখ কুঁচকালো সে। নাক বন্ধ করে আবারও পুরো গ্লাস খালি করে দিয়ে টলমল করতে লাগলো মেয়েটি! কেমন যেনো ঝিমঝিম করছে মাথাটা, শরীরটা আগের তুলনায় বেশ হাল্কা লাগছে তার, যেনো হাওয়ায় ভাসছে সে। কি অদ্ভুত ফুরফুরে ফিলিংস!
.
কোল্ড ড্রিংকস এর দুটো বোতল কিনে দ্রুত পায়ে ছাদে পৌঁছেই থমকে গেলো নীবিড়! ডান হাত থেকে বোতলটা ফ্লোরে রেখে চোখটা ডলে নিয়ে আবারও সামনে তাকাতেই একই দৃশ্য ফুটে উঠলো তার চোখে।
.
বক্সে Chennai Express এর “1234 Get on the Dance floor” সংটা বাজছে। তাতে কোনো হুশ নেই অগ্নির। সে তো আপন মনে চেয়ারে বসে টেবিলে ভর দিয়ে ঘুমিয়ে কাত হয়ে রয়েছে।
ছাদের মিডল পয়েন্টেই একটা মেয়ে ওড়না দিয়ে মস্ত বড় ঘোমটা টেনে নাচতে নাচতে রুশোকে কেন্দ্র করে ঘুরে চলেছে। মাঝখান থেকে মেয়েটাকে থামানোর ব্যার্থ প্রচেষ্টা চালাতে চালাতে করুন স্বরে আকুতি করে রুশো বলে চলেছে,
.
—- আরে রুক যা মেরি মা! বাচ্চেকা জান লেগা কেয়া? তোরে ২০ ডজন চকলেট দিমু তাও তো থাম!
.
কিন্তু এতেও মেয়েটার কোনো প্রতিক্রিয়াই দৃশ্যমান হলো না। আগের মতোই রুশোকে কেন্দ্রবিন্দু বানিয়ে নাচতে নাচতে গোল গোল করে ঘুরে চলেছে মেয়েটি। নীবিড় বুঝলো এ কোনো দুঃস্বপ্ন নয় বরং কঠিন সত্য। তাই আর দেড়ি না করে হাতে থাকা আরেকটা বোতল ফ্লোরে রেখে দিয়ে একছুটে রুশোর কাছে গিয়ে ব্যস্ত স্বরে বলে উঠলো,

—- রুশো কে ও? এখানে কি করে এলো? আর এভাবে নাচছেই বা কেনো? আর এই শালা অগ্নি এভাবে মরার মতো ঘুমোচ্ছে কোন আক্কেলে?
.
রুশো নীবিড়কে দেখে এক লাফ মেরে এগিয়ে গিয়ে চেপে ধরলো। ভয়ার্ত কন্ঠে সে বললো,
—- আই ডোন্ট নো ব্রো! আমি তো জাস্ট সুসু করতে গিয়েছিলাম। এসে দেখি অগ্নি ব্রো ঘুম আর এই মেয়েটা ঘোমটা টেনে ধিতাং ধিতাং! আমি অনেক চেষ্টা করেছি বাট থামাতেই পারিনি। তুমি ওকে থামাও ব্রো! প্লিজ ডু সামথিং!
.
কি করবে ভেবে না পেয়ে আশেপাশে পানি খুঁজতে লেগে পড়লো নীবিড়। কিন্তু পানি না থাকায় বেশ বিরক্ত হয়ে অাবশেষে কোনো উপায় না খুঁজে পেয়ে চেয়ারে সজোরে একটা লাথি মেরে দিলো সে। চেয়ার বেঁকে যাওয়ায় ধপাস করে ফ্লোরে পড়ে গেলো অগ্নি। ঘুম ছুটে গিয়ে ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠে অগ্নি চিৎকার করে বললো,
.
—- ও বাবা রে গেছি রে!
.
নীবিড় এবার আরোও ক্ষেপে গেলো। অগ্নিকে টেনে তুলে সামনে তাকাতে ইশারা করে ঝাঁঝালো কন্ঠে সে বলে উঠলো,
—- আমি একা তোদের কি ঘুমিয়ে থাকার জন্য রেখে গিয়েছি? ব্যাটা বলদ! কে এটা? আর ড্রিংক করলো কোন ফাঁকে?
.
অগ্নি কিছুক্ষণ টলমল করতে থাকা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থেকে পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ঠোঁট উল্টালো। মিনমিন করে সে বললো,
—- আমি ঘুমিয়ে গেছিলাম? তার মানে এতোক্ষণ বিয়ের স্বপ্ন দেখছিলাম? ইয়া আল্লাহ.……!
.
🍁
.
টানা কুড়ি মিনিট উড়াধুড়া নাচার পর ক্লান্ত হয়ে বসে পরলাম তিনজনই। একটু জিড়িয়ে নিয়ে পিৎজা সাবাড় করে কোল্ড ড্রিংকস পান করে ঢেকুর তুললাম আমি, রাত্রি সাথে নিত্য আপুও। আহ মনটা বড়ই খুশি খুশি লাগছে! হোয়াট আ ব্যাচেলর পার্টি! বিয়ের পর থোরি না সাদা বিলাই রাত-বিরেতে এভাবে নাচতে দেবে!
তাই বিয়ের আগে অন্তত লাফিয়ে নিয়ে ইচ্ছেটা পূর্ণ করে নিলাম।
.
কিছুক্ষণ রেস্ট করে নিত্য আপু বললো,
—- চলো মিশন হামলা এট্যাক শুরু করা যাক।
.
আমি আর রাত্রি দাঁত কেলিয়ে “যথা আজ্ঞা ভাবিজী!” বলেই উঠে দাঁড়ালাম। পা টিপেটিপে এগিয়ে চললাম ছাদের উদ্দেশ্যে।
.
ছাদের চাপিয়ে রাখা দরজা হাল্কা ধাক্কা দিয়ে ফাঁক করে চোখ লাগাতেই মাথাটা ৩৬০° এংগেলে চক্কর দিয়ে উঠলো আমার। একি দেখলাম আমি? আ..আমাদের হবু জামাইয়েরা মাঝ রাত্তিরে কোনো অপরিচিত মেয়ের সাথে নাচ করছে? এই জন্যেই কি আমাদের মানা করা হয়েছিলো ছাদে আসার জন্য? এটার নামই বুঝি ব্যাচেলর পার্টি!
.
.
.
.
চলবে……………..💕