#প্রেম_প্রয়াস
#মাশফিয়াত_সুইটি
পর্ব:০৫
‘তাশফা মা এভাবে কাঁদলে হবে? যে মেয়ে সারাক্ষণ বাড়ি মাতিয়ে রাখে দুষ্টুমি করে হাঁসি খুশি থাকে সে যদি বাচ্চাদের মতো কান্না করে তাহলে কেমন দেখায় বল তো?’
– আমার কান্নার জন্য তোমরাই দায়ী তোমরা আমাকে জোর করে অপছন্দের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছো, তোমাদের কখনো ক্ষমা করবো না আমি এমনকি কথাও বলবো না।'( ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে)
তাশফার মায়ের মুখে আঁধার নেমে এসেছে আর কোন কথা না বলে তাশফার ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন। সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারেনি তাশফা সারারাত কান্না করে পাড় করেছে বিশেষ করে রাদিফের এমন খাপছাড়া আচরণে।
তাশফা এখনো হাল ছাড়েনি তার মাথায় আবারো একটা বুদ্ধি আসলো এটাই শেষ প্রচেষ্টা। তাশফা তার বাবাকে খুঁজতে লাগলো একপর্যায়ে বাবাকে পেয়ে দ্রুত গিয়ে পাশে বসে,
– বাবা…
– কিছু বলবি?
– বাবা আমি এই বিয়ে করবো না আমার নিহানকে পছন্দ নয় আমি আম্মুকে অনেকবার বলেছি কিন্তু আম্মু শুনছে না তুমি কিছু করো বাবা।
তাশফার বাবা মুখে গাম্ভীর্য এনে,
– সব কিছু এরেঞ্জ হয়ে গেছে এখন আর বিয়ে আটকানো যাবে না নিহান কিন্তু ভালো বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে।
তাশফা আশাহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে,
– বাবা তুমিও!
– যাও ঘরে যাও তোমার মা যা বলবে শুনবে এদিকে অনেক লোকজন আমারও কাজ আছে।
তাশফা বুঝে গেল তার বাবা-মা আর কোন কথাই শুনবে না নিজেরা যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাই করবে।
রাকা আর তাশফা ক্লাস নাইন থেকে একসঙ্গে পড়াশোনা করে সেই থেকেই তাদের বন্ধুত্ব। প্রথম যখন রাকার সাথে তার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল তখন সে ক্লাস টেনে পড়তো আর তখনি রাদিফের সঙ্গে প্রথম দেখা।
বাড়িতে গিয়েই রাকার মায়ের সঙ্গে মূহুর্তেই ভাব জমিয়ে ফেলেছিল তাশফা,তার চঞ্চলতা এবং বাচ্চামো রাকার মায়ের খুব ভালো লেগে যায় যার কারণে তাশফা রাকা এবং রাদিফের মায়ের চোখের মণি হয়ে গেছে।
রাকাদের বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছিল তাশফা, রাদিফও তখন তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বের হচ্ছিল আর দু’জনের মধ্যে ধাক্কা লাগে। সামান্য এই ধাক্কা লাগার কারণে তাশফা রাদিফকে অন্ধ পর্যন্ত বলেছে আর তারপর এক ধমক খেয়েই রাদিফকে সে ভয় পায় তবে তখন থেকেই একটা ভালো লাগা সৃষ্টি হয় তাশফার,ধীরে ধীরে যা ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু রাদিফকে কখনো সামনাসামনি বলতে পারেনি ভয়ে কিন্তু আজ যেন কোত্থেকে সাহস সঞ্চয় করে সবকিছু বলে দিল।
রাদিফ ঘরে বসে ফাইল নিয়ে কাজ করছে আজ অফিসে যায়নি।তার মা ঘরে এসে তার পাশে বসলো। মা’কে দেখে রাদিফ জিজ্ঞেস করল,
– কিছু বলবে আম্মু?
– রাকার কাছ থেকে শুনলাম তাশফার নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে গতকাল রাতে নাকি মেহেদী অনুষ্ঠান গেল।
– হুম।
– মেয়েটা কিন্তু অনেক ভালো প্রথমদিন থেকেই আমার অনেক পছন্দ ওকে।
রাদিফ নিশ্চুপ।তার মা আবারো বলা শুরু করল,
– কি চঞ্চল সহজেই সবার সাথে মিশে যায় আমাদের বাড়িতে বউ হয়ে আসলে বাড়িটা হয়তো আবারো প্রাণ ফিরে পেত।
– কি হয়েছে তোমার? এসব কেন বলছো? তাশফার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে আম্মু আজ সন্ধ্যায় গায়ে হলুদ আর কাল বিয়ে।
– বলছি এর কারণ আছে কথাটা শুধু আমার মনে ছিল কিন্তু এখন আমি সব জানতে পেরেছি রাকা আমায় সব বলেছে,তাশফা তোকে পছন্দ করে ও এই বিয়েতে রাজি নয় আগে ভেবেছিলাম হয়তো দুষ্টুমি করে কিন্তু এখন তো জানলাম সবটা সত্য এছাড়া বিয়ে এখনো হয়নি।
– থামবে তুমি।
– কেন থামবো? নিজের কথা একবারও ভাবছিস না কেন? মানছি তোর বাবা মারা যাওয়ার আগে তোকে আমাদের দেখার দায়িত্ব দিয়ে গেছে তাই বলে নিজের ভালোকে গুরুত্ব দিবি না?
– আম্মু!
– আমি জানি তোরও তাশফাকে পছন্দ তাই সময় থাকতে নিজের করে নে পরে কিন্তু আফসোস ছাড়া আর কিছু করার থাকবে না।
কথাগুলো বলে চলে গেলেন রাদিফের মা। রাদিফের কাজ থেকে সব মন চলে গেছে মায়ের কথাগুলো শুনে নিজের মন যেন নিজেরই অবাধ্য হয়ে যাচ্ছে।
______________
হলুদের শাড়ি আর ফুলের অলঙ্কার দিয়ে হলদে পরী সাজানো হয়েছে তাশফাকে কিন্তু মুখ তার শুকনো চোখটা এখনো ফুলে আছে হারিয়ে গেছে সব চঞ্চলতা চুপ করে বসে আছে। সমবয়সী কাজিনরা কথা বলতে এসেও ব্যর্থ হয়েছে তাশফার মুখ থেকে কোন শব্দ বের করতে পারেনি। সবাইকে তার মা বলেছে,’আমাদের ছেড়ে এক অচেনা জায়গায় যাবে শুনেই এমন করছে।’
রাকা এসে তাশফার পাশে বসতেই করুন চোখে তাশফা তার দিকে তাকালো।তাশফার এমন দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পেরে রাকা মাথা নিচু করে,
– আশা ছেড়ে দে তাশু ভাইয়া আসবে না।
তাশফার ভেতরটা যেন শুকিয়ে গেল কিছু আর বলার রইল না চুপ করে সব সহ্য করতে লাগলো।একে একে সবাই এসে গায়ে হলুদ লাগিয়ে চলে গেল, রাকা আজ সবাইকে ভালো করে বলে এসেছে তাশফার বিয়ে পর্যন্ত সে তাশফার কাছেই থাকবে রাদিফ বোনের ইচ্ছেতে বাঁধা দিতে পারেনি।
হলুদ শেষে তাশফা ঘরে চলে এসেছে জানালার ধারে বসে আছে রাকা অনেক চেষ্টা করেও কথা বলতে পারলো না সে বুঝতে পারছে তাশফার ভেতরের কষ্টটা সাথে নিজের ভাইয়ের উপর অনেক রাগ ক্ষোভ জমা হচ্ছে।
রাত অনেক বেড়ে গেছে বারোটা ছুঁইছুঁই সবাই ঘুমে মগ্ন শুধু ঘুম নেই তাশফার দু’চোখে। নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে আকাশের দিকে দৃষ্টি রেখে মন বলছে রাদিফের সঙ্গে আরেকবার কথা বলতে যদি মন গলে,কিছুক্ষণ ভেবে রাকার মোবাইল নিয়ে ছাদে চলে গেল। আকাঙ্ক্ষিত নাম্বার খুঁজে কল দিল একটু রিং হতেই রিসিভ হয়ে গেল,তাশফা চুপ করে আছে অপরপাশ থেকে,
– হ্যালো রাকা! এতো রাতে কল দিলি কিছু হয়েছে?
-………
– হ্যালো……হ্যালো…কথা বলছিস না কেন?
– রাদিফ ভাই…
আকষ্মিক ভাবে তাশফার কন্ঠস্বর শুনে রাদিফ চমকে গেল।রাদিফের কোন উত্তর না পেয়ে তাশফার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে অধীর কষ্টে আবারো অসহায় কন্ঠে বলল,
-কেন বুঝছেন না রাদিফ ভাই আমি আপনাকে ভালোবাসি, আমি কি দেখতে খারাপ নাকি অন্য কোন সমস্যা আছে যার জন্য আপনি আমাকে পছন্দ করেন না প্লিজ বলুন। আমি এই বিয়েটা একদম করতে চাই না আপনাকে ছাড়া আমি কাউকে ভাবতে পারি না আপনি যদি এমন করেন তাহলে আমার কি হবে।
– এতো রাতে এসব বলার জন্য কল দিয়েছো? রাকা কোথায়?
– ঘুমাচ্ছে।
– তুমিও গিয়ে ঘুমাও কাল বিয়ে সারাদিন অনেক প্রেসার যাবে।
– এটা আমার উওর না।
– তোমাকে কোন উওর দেওয়ার ইচ্ছে নেই আমার আর কল দিবে না বাই।
সাথে সাথে কলটা কেটে গেল তাশফা তারপরও কানে ফোনটা ধরে বসে ছিল। একপর্যায়ে ঘরে গিয়ে ফোনটা রাকার কাছে রেখে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লো।
________________
সকাল হয়ে গেছে বিয়ের তোরজোর চলছে তাশফার মা আর রাকা অনেক চেষ্টা করেও তাশফাকে খাওয়াতে পারলো না। পার্লার থেকে লোক এসেছে তাশফাকে সাজাতে তাশফা গোসল সেরে বিছানায় এসে বসেছে, চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে বারবার কাজল লেপ্টে যাচ্ছে আর মেয়ে গুলো বিরক্ত হচ্ছে। তাশফাকে কান্না থামাতে বলছে কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না এবার বিরক্ত হয়ে তাশফার মা’কে ডেকে,
– আন্টি ও তো কেঁদেই যাচ্ছে এভাবে কাঁদলে তো সাজানো সম্ভব না কাজল লেপ্টে যাচ্ছে।
মেয়ের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে,
– থাক আর কাজল দেওয়ার দরকার নেই বাকি গুলো করে আমায় ডাক দিও।
– আচ্ছা।
তাশফাকে বধূ বেশে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে,রাকা তার পাশে বসে আছে মাথায় হাত বুলিয়ে,
– এভাবে কাঁদলে হবে না নিজের জীবনকে নিজের গুছিয়ে নিতে হবে যা হবে ভালোর জন্যই হবে।
তাশফার মা তাশফাকে নিতে চলে আসলো।তাশফা মায়ের দিকে তাকিয়ে,
– তাহলে সত্যি সত্যি তোমাদের কথাই রাখলে মৃ’ত্যু’র মুখে ঠেলে দিচ্ছো আমায়।
– এ কেমন কথা?
তাশফা মুচকি হাসলো যা তাশফার মায়ের স্বাভাবিক মনে হলো না।
তাশফাকে নিয়ে বরের সোজাসুজি বসানো হয়েছে দু’জনের মাঝখানে একটা পাতলা পর্দা টানানো।তাশফার ঠোঁট পর্যন্ত গুমটা দেওয়া নিচের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চোখে এখনো পানি। কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করলো তাশফাকে কবুল বলতে বলা হলো কিন্তু সে নিশ্চুপ রাকা ঘাড়ে হাত রাখলো তাশফার মা এসে কানের কাছে মুখ নিয়ে,
– যা বলা হচ্ছে বল মা।
আবছা চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে ভারি গলায় তিনবার কবুল বলে দিল তাশফা,সবাই খুশি হলো।
তাশফা কোন দিকে তাকায়নি নিজের বরের দিকেও তাকালো না। একপর্যায়ে বিদায়ের সময় চলে এসেছে তাশফাকে গাড়িতে উঠানো হয়েছে তার মা একবার তাকে ধরতে গেল কিন্তু সে হাত সরিয়ে দিয়ে গাড়িতে উঠে গেছে। তাশফার বাবা-মা বরের উদ্দেশ্যে,
– ওকে একটু দেখে রেখো বাবা।
বরও প্রতিশ্রুতি দিল দেখে রাখবে তাশফাকে। তারপর গাড়িতে উঠে তাশফার পাশে বসে পড়লো কিছুটা দূরত্ব রেখে।
গাড়ি চলতে শুরু করলো তাশফা জানালার দিকে তাকিয়ে আছে কিছুক্ষণ চলার পর গাড়ি থামলো একটা বাড়ির সামনে তাশফাকে নামতে বলা হলো সেও নামলো কিন্তু কোনদিকে খেয়াল নেই তার চোখ দিয়ে নিঃশব্দে পানি পড়ে যাচ্ছে আর চারিদিক ঝাপসা লাগছে। নতুন বউকে বাড়িতে বরণ করে স্বামীর ঘরে বসিয়ে রেখে এসেছে সবাই। ঘর খালি হতেই তাশফার কান্না বেড়ে গেছে জোরে জোরে কেঁদে যাচ্ছে। হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজ হলো সামনে থাকা লোকটি ভেতরে প্রবেশ করেই কিছুটা শব্দ করে দরজা আটকে দিল। দরজা আটকানোর শব্দে কেঁপে উঠল তাশফা।
সামনের লোকটি তাশফার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য একটা কাশি দিল এতে তাশফার কান্নার বেগ বেড়ে গেছে। তাশফার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পেরে এবার লোকটি একরাশ বিরক্তি নিয়ে,
– আরে পিচ্চি কাঁদছো কেন?
তাশফা এবার সামনে তাকাতেই চমকে গেল আরো জোরে কেঁদে
চলবে……..