প্রেমের রঙ পর্ব-২৩ এবং শেষ পর্ব

0
954

#প্রেমের_রঙ
#পর্ব_২৩
#মোহনা_হক

‘কেটে গিয়েছে বিয়ের চারটি বছর। পদ্ম ও এখন অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছে এতো বছরের ব্যবধানে। মেয়েটা এখন আর হ্যাংলামো করে না। যথেষ্ট জ্ঞান বুদ্ধি নিয়ে চলাফেরা করে, কথা বলে। ইজহানের তিন বছরের কষ্টের ফল, অবশেষে একজন কে মানুষের মতো মানুষ করতে পারলো। শুধু মেয়েটার কথা কমাতে পারেনি এই যা। বিয়ের প্রথম প্রথম যেমন বকবক করতো এখনো সেই আগের মতোই রয়েছে। আর ঝগড়ুটে হয়েছে ভীষণ।’
‘আজ ইজহান আর পদ্মের চতুর্থতম বিবাহবার্ষিকী। এইজন্য শেখ ভিলায় বেশ বড়সড় করে আয়োজন চলছে। সবাই খুব খুশি। ইজহান তাদের প্রত্যেক বিবাহবার্ষিকী তে এমন বড় করে আয়োজন করে। সবাই কাজ করছে যে যার মতো।’

‘শুভ্র রঙের পাঞ্জাবী পরিহিত লোকটার দিকে বার বার আড়চোখে তাকাচ্ছে পদ্ম। সদ্য গোসল করে এসেছে। যাদ কারণে চুলগুলো থেকে পানি পড়ছে। পদ্মের এসব কাহিনী ইজহান খেয়াল করেছে। কাছে এসে দেখবে তা না দূর থেকে দেখছে। মেয়েটা সেই বোকাই রয়ে গেলো।’

‘ইজহান পদ্মের দিকে ঝুঁকে আসলো। পদ্ম আধ শোয়া হয়ে শুয়েছিলো। পদ্মের দু পাশে হাত রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বললো-‘

“এভাবে দেখছিলে কেনো?”

‘ভড়কে গেলো পদ্ম। সে ভেবেছে ইজহান তাকে নিশ্চয়ই খেয়াল করেনি। কি একটা লজ্জা পেতে হচ্ছে এখন।’

“কোথায় দেখছিলাম?”

“মিথ্যে বলো না তুমি দেখছিলে আমায়। আমি আয়নায় দেখেছি সব। সবার চোখ কে ফাঁকি দিতে পারবে এই ইজহানের চোখ কে তুমি কখনো ফাঁকি দিতে পারবে না পদ্মফুল।”

‘পদ্ম মুখটা ফিরিয়ে নিলো।’
“হুহ আমার আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই আপনাকে দেখবো। আর আপনি ঝুঁকে আছেন কেনো? বয়স হয়েছে তবুও লজ্জা নেই।”

‘ইজহান পদ্মের মুখে তার আঙুল ছুঁয়ে দিলো। মুহুর্তেই চোখ বন্ধ হয়ে গেলো তার।’

“লজ্জা কোনদিনই হবে না পদ্মফুল।”

“সরুন তো। এভাবে ঘরে একা বসে থাকলে বাহিরের মানুষরা কি বলবে?”

“একটা চুমু দেই প্লিজ?”

‘পদ্ম চোখ রাঙালো।’

“এই না না এখন না।”

‘ইজহান পদ্মের কথা শুনলো না। টুপ করে পদ্মের ওষ্টে একটা চুমু একে দিলো। পদ্ম মুখ হাত দিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। ইজহান বে’ক্ক’লের মতো শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না।’
‘ওয়াশরুম থেকে কাশির শব্দ শোনা যাচ্ছে। চিন্তিত হয়ে ইজহান বললো-‘

“পদ্ম ঠিক আছো তুমি? দরজা খুলো আমি ঢুকবো।”

‘পদ্ম কোনো রকম উত্তর দিলো না। মুখ ধুয়ে বের হলো। ইজহান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। চোখ মুখে দুর্বলতার চাপ। চোখ টেনে তুলতে পারছে না এমন অবস্থা। ইজহান কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো পদ্ম। পদ্মের পিঠে হালকা করে হাত রাখলো। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে পদ্মের এই অবস্থা। আসলে বুঝছে না ঠিক কি হয়েছে।’

‘ইজহান নরম কন্ঠে বললো-‘
“ঠিক আছো তুমি?”

‘পদ্ম মাথা নাড়লো। কথা বলার শক্তি নেই। বমি করে সব শক্তি উধাও হয়ে গিয়েছে। পেটে যা ছিলো সব চলে গিয়েছে।’

‘ইজহান আবারও বললো-‘
“তোমার আসলে কি হয়েছে? এমন দুর্বল হয়ে গিয়েছো আমি বুঝছি না ঠিক।”

“আমিও জানি না কয়েকদিন ধরে বমি হয়। মাথা ঘুরায়। যা খাই সব বমির সাথে চলে যায়। এইজন্য বোধহয় দুর্বল দুর্বল লাগছে।”

‘ইজহান পদ্মকে কোলে করে বেডে শুইয়ে দিলো। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকুক তারপর নাহয় উঠে বাহিরে যাবে।’

‘পদ্ম বসতে নিয়েছিলো তখনই ইজহান ধমক দিলো।’

“সমস্যা কি তোমার? একটু আগে বমি করে এসেছো এখন আবার কোথায় যেতে চাচ্ছো? খবরদার রুমের বাহিরে পা রাখবে না। কিছু সময় রেস্ট নাও তারপর উঠে বাহিরে যাবে।”

‘পদ্ম দুর্বল গলায় বললো-‘
“না বাসায় কতো মেহমান সবাই কি ভাববে বলুন তো।”

‘ইজহান উঠে দাঁড়ালো। যদিও মানুষের কোনো কথাকে সে পাত্তা দেয় না কিন্তু এখন এভাবে পদ্মকে ঘরে আটকে রাখলে সত্যিই অনেকে অনেক কথাই বলবে। যার ইফেক্ট পড়বে পদ্মের উপর। কিন্তু এখন তো সে অসুস্থ কিভাবে বাহিরে যেতে বলবে? যদি আবার অসুস্থ হয়ে যায় তখন? এই অনুষ্ঠান শেষ হলেই পদ্মকে মেধার কাছে নিয়ে যাবে। যদিও এসব মেয়েলী ব্যাপার তাই সে এখানে থাকতে চাচ্ছে না। এরকম রোগের চিকিৎসা সে করে না।’

“তুমি শুয়ে থাকো আমি মা কে বলবো তুমি একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছো তাই এখন শুয়ে আছো।”

‘পদ্মের তাও মন মানলো না। বাসায় এতো মানুষ এখন এভাবে শুয়ে থাকাটার আসলেই মানে না। এই ইজহান কে বোঝাবে? আবার একদিক দিয়ে শুয়ে থাকতেও মন চাচ্ছে ১০ মিনিট ঘুমালে হয়তো ভালো লাগতো। মাথা প্রচুর ঘুরাচ্ছে।’

“কিন্তু!”

‘পদ্মের পুরো কথাটা শেষ করতে দিলো না ইজহান।’

“কোনো কিন্তু নয়। আমি মা কে পাঠাবো তোমার কাছে। আমি আসছি।”

‘ইজহান চলে গেলো। পদ্মের চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। তার যদি বড় কোনো অসুখ হয়ে থাকে তখন? ভেবেই চোখ দিয়ে নোনাপানি পড়তে লাগলো। ইজহান কে ছাড়া থাকতে পারবে না সে। মানুষটার প্রতি খুব মায়া জন্মেছে এই চারটি বছরে। বিয়ের পর পদ্ম খুবই কম সময়ের জন্য গ্রামে গিয়েছে। সে যেতে চাইতো না। অন্য মেয়েরা যেমন বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য পথ চেয়ে বসে থাকে আর সে জায়গায় মেয়ে হয়ে বাপের বাড়ি যেতে চায় না। মুনিরা শেখ জোর করিয়ে তারপর পাঠাতো। তাও আবার দু তিনদিন থেকে চলে আসতো। ইজহান কে ছাড়া কোথাও যেতে ভালো লাগত না। মন বসতো না। মানুষটা কে চোখের আড়াল করতে চায় না সে। আজ তাদের চতুর্থতম বিবাহবার্ষিকী আজই তাকে অসুস্থ হতে হলো? নিজের প্রতি একরাশ রাগ জমা হচ্ছে।’

‘পদ্ম প্রায় ১ ঘন্টার মতো শুয়ে আছে ভালো লাগছে না। প্রচন্ড পরিমাণে অস্বস্থি লাগছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। মাথাটা ব্যাথা করছে অনেক। পদ্ম উঠে বসেছে। মাথা চেপে ধরলো। মন চাচ্ছে শরীর থেকে মাথা আলাদা করে দিতে। অসহ্যকর বেদনা। কেনো যে শরীরের এমন অবস্থা হয়েছে কিছুই বুঝছে না সে। কয়েকদিন আগেও তো ভালো ছিলো। কেনো যে এমন হচ্ছে তার। মাথা ব্যাথা বাড়তে লাগলো। এক প্রকার ছটফট করছে সে।’

‘মুনিরা শেখ আর ইজনিয়া রুমে এসেছে। ইজহান তখন বলেছিলো পদ্ম অসুস্থ তাই ঘুমাচ্ছে। কাজের চাপে আর পদ্মের সাথে দেখা করতে আসতে পারেনি। এখন তিনি আর ইজনিয়া এসেছেন। রুমে ঢুকেই বিচলিত হয়ে গেলেন পদ্মের ছটফটানি দেখে। তড়িঘড়ি করে পদ্মকে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।’

“কি হয়েছে? কি হয়েছে? এমন করছো কেনো?”

‘পদ্ম মাথাটা মুনিরা শেখের বুকে হেলিয়ে দিলো।’

“মা জানি না আমার কি হয়েছে। কয়েকদিন ধরে বমি, মাথা ঘুরায়, এখন মাথা ব্যাথা করছে ভিষণ। আমি সহ্য করতে পারছি না।”

‘মুনিরা শেখের কপালে ভাজ পড়লো। এগুলো প্রেগন্যান্ট হওয়ার লক্ষণ কোনোভাবে পদ্ম প্রেগন্যান্ট নয় তো? ইজনিয়া তো মনে মনে ধরেই নিয়েছে পদ্ম প্রেগন্যান্ট। তবে তার মায়ের ভয়ে মুখে কিছু প্রকাশ করলো না। মনটা যেনো আনন্দে দুলছে।’

“শুন ইজনিয়া দুটো প্রেগন্যান্সি কিট আনবি এখনই। যা নিয়ে আয়।”

‘ইজনিয়া লাফ দিয়ে চলে গেলো কিট আনতে। পদ্ম প্রেগন্যান্সি কিট এসব বুঝলো না। সে তো আর প্রেগন্যান্ট নয়। তাহলে তার শ্বাশুড়ি কেনো এটা বলছে?’

‘মুনিরা শেখ পদ্মের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো-‘

“তোমার পিরিয়ড ডেট কবে?”

‘পদ্মের কোনো রকম সংকোচ বোধ কাজ করলো না। সোজাসাপ্টা উত্তর দিলো।’

“এ মাসের ৫ তারিখ ছিলো।”

“এখন তো ১৬ তারিখ, তার মানে তোমার পিরিয়ড মিস হয়েছে তাই তো?”

“জ্বী মা।”

“আচ্ছা ইজনিয়া কিট গুলো নিয়ে আনুক তারপর সব ক্লিয়ার হবে।”

‘পদ্ম মাথা তুলে তাকালো মুনিরা শেখের দিকে। অবুঝ কন্ঠে বললো-‘

“কি ক্লিয়ার হবে মা?”

‘মুনিরা শেখ হেসে পদ্মের গালে হাত রাখলো।’

“তুমি প্রেগন্যান্ট কিনা সেটাই। তোমার যে লক্ষণ দেখছি মনে হয় তো প্রেগন্যান্ট। তাই কিট আনতে পাঠিয়েছি ইজনিয়া কে।”

‘প্রেগন্যান্ট’ কথাটা শুনে পদ্মের মনটা ধক করে উঠলো। চোখটা ভিজে আসছে বারবার। যখন মেধা আপু প্রেগন্যান্ট হয়েছিলো তখন তারও মা হওয়ার জন্য মনটা উতলা হয়ে উঠেছিলো। তার বয়স আঠারো হওয়ার পর ও ইজহান বার বার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কতোবার যে চেষ্টা করেছে কোনো ভাবেই হয় নি। এক পর্যায়ে হাল ছেড়ে দিয়েছিলো। কতো রাত কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়েছে। হাজারবার ঝগড়াও হয়ে গিয়েছিলো ইজহানের সাথে। তবে কখনো গায়ে হাত তুলেনি শান্ত হয়ে বোঝাতো নাহয় বকা দিতো। এই নিয়ে তাদের মধ্যে কতো কথা কাটাকাটি হয়েছে হিসেব নেই। কতবার ইজহান তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। ভাবতেই মনটা হুহু করে উঠলো। শুধু বলতো ‘বয়স হোক বড় হও তারপর বাচ্চা নেওয়ার কথা ভাববো।’ যদি ঘটনাটি সত্যি হয়ে যায়? তাহলে ইজহান ঠিক কিভাবে নিবে বিষয়টা? এখন তো তার বয়স ঊনিশ হয়েছে এটা মেনে নেওয়াই যায়।’

‘প্রায় আধ ঘন্টা পর ইজনিয়া এসেছে। বাসা থেকে ফার্মিসি দূরে তাই এতো সময় লেগেছিলো। নাহলে আরও তাড়াতাড়ি আসা যেতো। এই আধ ঘন্টায় পদ্ম দু’বার বমি করেছে। মুনিরা শেখ একটুও নড়লো না পদ্মের কাছ থেকে। পদ্মকে সব বুঝিয়ে দিয়েছে।’
‘পদ্ম রেজাল্ট দেখে বারবার চোখ মুছতে লাগলো। দুটো দাগ এসেছে তার মানে সে সত্যি সত্যিই প্রেগন্যান্ট। তার এতো বছরের সাধনা। পদ্ম না চাইতেও চোখ থেকে পানি পড়ছে। এটা হচ্ছে সুখের কান্না। সুন্দর অনুভূতি।’

‘পদ্ম কিটটা মুনিরা শেখের কাছে দিলেন। তিনি তো খুশিতে পাগল হয়ে যাবে প্রায়। বহু বছর পর শেখ বাড়িতে একটা বাচ্চা আসবে। বংশের প্রদীপ আসতে চলেছে। আর ইজনিয়া তো নাচছে খুশিতে। মুনিরা শেখ পদ্মের কপালে চুমু দিলেন। যতোই হোক তার মাধ্যমেই তো সব হয়েছে।’

——–

‘পদ্ম বলে দিয়েছে যেনো কাউকে কিছু না জানায়। আর মুনিরা শেখ ও চাননি ধরেই সব কিছু কাউকে জানাতে। চার পাঁচ মাস যাক তারপর জানাবে। ইজহান কে ও জানানো হয়নি। পদ্ম চেয়েছে সে নিজেই জানাবে তাকে। তাই কেউ কিছুই বলেনি।’

‘অবশেষে অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে। সবাই এক এক করে চলে গিয়েছে। সবাই চলে যাওয়ার পর পদ্ম রুমে চলে এসেছিলো। খারাপ লাগছিলো এতো মানুষের মাঝে থাকতে। মুনিরা শেখ কিছুটা পদ্মকে অল্প কিছুটা পোলাও খাইয়ে দিলেন। কিন্তু তাও পদ্মের পেটে সইলো না। তার অনাগত বাচ্চা তার অবস্থা নাজেহাল বানিয়ে ফেলছে একেবারে। পদ্ম রুমে এসে শুয়ে পড়েছে। বড্ড বেশি খারাপ লাগছে তার। ইজহান ও রুমে এসেছে কারণ ইজনিয়া বলেছিলো পদ্ম তাকে বলেছে রুমে যেতে।’

‘পদ্ম চিত হয়ে শুয়ে আছে। এক হাত মাথার উপরে দেওয়া। আরেক হাত বালিশে রাখা। পদ্মের মুখটা দেখেই ইজহানের খারাপ লাগা শুরু করলো। মেয়েটার হঠাৎ যে কি হলো বুঝতে পারলো না।’

‘পদ্মের পাশে বসে হাতটা ধরলো। আর সাথে সাথে পদ্ম চোখ মেলে ইজহানের দিকে তাকালো।’

“বেশি খারাপ লাগছে তোমার?”

‘পদ্ম কিছু বললো না উঠে গিয়ে ইজহানের হাতে কিটটা ধরিয়ে দিলো। ইজহানের মন শীতল হয়ে আসছে। হাত মৃদু কাঁপছে। এটা কি সত্যি? পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে কিটটার দিকে।’
‘ইজহান পদ্মকে জড়িয়ে ধরলো খুব শক্ত করে। এমন হচ্ছে যেনো পদ্ম কোথাও চলে যাবে। পদ্ম শ্বাস নিতে পারছে না। জান বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম।’

‘পদ্ম তার কাধে পানি অনুভব করলো। আচ্ছা পানি আসলো কোথায় থেকে? ইজহান কি কাঁদছে নাকি? ইজহানের মুখটা তার সামনে আনলো। সে ইজহান কাঁদছে তার চোখের কার্নিশে বিন্দু বিন্দু পানি। কিন্তু কেনো?’

‘ইজহান ভাঙ্গা গলায় বললো-‘
“আমি কখনো তোমার অল্প বয়সে বাচ্চা চাইনি। কিন্তু আমার এখন এতো শান্তি লাগছে কেনো বলতে পারবে পদ্ম? এটা কি সত্যি?”

‘পদ্ম মাথা নাড়লো। ইজহানের চোখ থেকে চশমা খুলে চোখের পানিগুলো মুছে দিলো।’

“বাবা হওয়া এতো শান্তি আগে বুঝিনি কেনো?”

“কারণ আমি আগে প্রেগন্যান্ট হইনি তাই!”

‘ইজহান বুঝেছে পদ্ম মজা করছে। মনে হচ্ছে এইতো সেদিন মেয়েটাকে বিয়ে করে ঘরে তুললো। আর আজ তাকে বাবা হওয়ার আগাম সংবাদ জানাচ্ছে। কি যে পরিমাণ শান্তি লাগছে তার বলে বুঝাতে পারবে না। এই অনুভূতিটা এতো সুন্দর কেনো? ইজহান পদ্মের মুখে অনবরত চুমু একে দিলো।’

“ধন্যবাদ পদ্মফুল আমাকে বাবা হওয়ার সু সংবাদ দেওয়ার জন্য।”

‘পদ্ম হেসে ইজহান কে জড়িয়ে ধরলো। আজ যেনো খুশির শেষ নেই কারোর।’

—–

‘প্রেগন্যান্সির ছয় মাস চলছে পদ্মের। আগে থেকে শারীরিক গঠন বদলে গিয়েছে। প্রচুর মোটাও হয়েছে সে। এখন আপাতত খেতে পারে। যার কারণে খায় আর ঘুমায়। এই ছয় মাস যাবত তারা শেখ ভিলায় আছে। ইজহানের এখান থেকে হসপিটালে যাতায়াত করতে সমস্যা তাও পদ্ম ও তার বাচ্চার জন্য সব কথা ভুলে যায়। আর মুনিরা শেখ তার কথা আর কিইবা বলবে সে তো পদ্মকে একটা কাজও করতে দেয় না। উল্টো ইজহান বাসায় না থাকাকালীন সময়ে পদ্মের পাশে পাশে থাকে। সব সময় পদ্মকে তিনিই আগলে রাখেন। পদ্ম তাদের প্রতি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে।’

‘ইজহান তার শার্ট চেঞ্জ করছে আর বলছে-‘

“পদ্ম তোমার মনে হচ্ছে না তুমি আগের থেকে মোটা হচ্ছো?”

‘পদ্ম এতক্ষণ চকলেট খাচ্ছিল। আচমকা খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে বললো-‘

“কি বলতে চাচ্ছেন সরাসরি বলুন।”

‘ইজহান পদ্মকে রাগানোর জন্য বললো-‘
“তুমি আগের থেকে অনেক মোটা হচ্ছো, এতো বেশি খেও না। তোমাকে এখন কেমন লাগছে।”

‘পদ্মের চোখ দিয়ে পানি পড়ে গেলো। তার জিনিস খাচ্ছে বলে একেবারে এ কথা বলবে?’

“আমি কি একা খাচ্ছি নাকি? আপনার বাচ্চাও তো খাচ্ছে। আর খাবোই না আমি ধুর।”

‘পদ্ম চকলেটটা নিচে ফেলে দিলো। রুমের বাহিরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। কিন্তু ইজহান পদ্মকে পিছন থেকে আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরলো। পদ্মের পেটে হাত রাখলো। উফ মেয়েটা এতো রেগে যায়।’

‘ইজহান শান্ত কন্ঠে বললো-‘
“মজা করছিলাম তো জান। এমন করে না। আর কখনো এসব বলবো না। তুমি কি জানো তোমাকে কতো সুন্দর লাগছে ইদানীং?”

‘পদ্ম একেবারে মিইয়ে গেলো। মানুষটার উপর রাগ করে থাকতে পারে না সে।’

“উহু আগে সুন্দর ছিলাম না বুঝি?”

“আমার বাবুর আম্মু সব সময়ে সুন্দর ছিলো।”

(*)

‘পদ্ম ছটফট করছে। ঘুম আসছে না তার। পেট পিঠ ব্যাথা হয়ে আছে। এখনো তার ডেলিভারির এক মাস বাকি আছে। এখন বাজে রাত ১টা। পাশে তাকিয়ে দেখে ইজহান নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। পদ্ম ব্যাথায় ছটফট করছে। এক সময়ে তার ব্যাথা প্রচন্ড শুরু হলো। শরীর থেকে ঘাম ঝড়ছে ইচ্ছেমতো। ইজহান কে খুব কষ্ট করে ডাক দিলো। যদিও তাকে ডাক দেওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু সে তো কষ্ট সহ্য করতে পারছে না।’

‘ইজহান পাশ থেকে চশমাটা পড়লো। পদ্মের শুধু ঘাম ঝড়ছে। মুখটা লাল হয়ে আছে পুরো। হিতাহিত জ্ঞান শুণ্য হয়ে পড়লো ইজহান। তার আর বুঝতে বাকি রইলো না কেনো পদ্ম এমন করছে। পদ্মের ডেলিভারির সময় ঘনিয়ে এসেছে। পদ্মকে কোনো রকম পাঁজাকোলা করে কোলে করে নিচে নিয়ে আসলো। মেয়েটার কান্না ইজহানের হৃদয় ভীষণ পোড়াচ্ছে। ইজহান তার মা বাবা কে গলা উঁচু করে ডাক দিলো। তারাও এসে পড়েছে নিচে। তাড়াতাড়ি করে পদ্মকে গাড়িতে তোলা হলো। গাড়িতে থাকা অবস্থায় মেধা কে কল করলো। যেহেতু মেধাই প্রথম থেকে পদ্মের চেকআপ করে এসেছে সেহেতু ডেলিভারি মেধাই করবে। এখন একমাত্র ভরসা মেধা। পদ্মের অসহনীয় ব্যাথা দেখে কারোই মাথা ঠিক নেই।’

‘পদ্মকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেলো। মেধা যথাসম্ভব দ্রুত হসপিটালে চলে এসেছিলো। যার কারণে এতোবেশি ওয়েট করা লাগেনি ।
ইজহান ও অপারেশন থিয়েটারে ও যেহেতু ডক্টর তাই হসপিটালের কতৃপক্ষ কোনো রকম কথাই বলেনি। পারমিশন নিয়েই সে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকেছে।’

‘পদ্মের নরমাল ডেলিভারি করা হবে। তাই সব কিছুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। মাঝ বরাবর মেধা দাঁড়িয়ে আছে তার পাশে দু’জন নার্স আর ইজহান। পদ্ম কেঁদেই চলেছে। ইজহানের হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে। এই প্রথম ইজহান কোনো মহিলার ডেলিভারিতে এসেছে যার কারণে তার হাত পা ও কাঁপছে। মাথা যেনো ঠিকঠাক কাজ করছে না। মনে মনে একটাই দোয়া করছে যেনো পদ্ম এবং তার বাচ্চা ঠিক থাকে।’

‘পদ্মের ডেলিভারি শেষ হলো। পদ্ম এখন অচেতন হয়ে শুয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেই ব্যাথায় জ্ঞান হারিয়েছে। ইজহান তার একমাত্র ছেলে কে রক্তমাখা অবস্থায় কোলে নিলো। হ্যাঁ সে একটা পুএ সন্তানের বাবা হয়েছে। চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে তার। বাচ্চাটিকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। ‘

‘মেধা হেসে ইজহানের কাঁধে হাত দিলো।’
“কংগ্রাচুলেশনস সুদর্শন পুরুষ। তুই ও বাবা হয়ে গেলি।”

‘ইজহান হাসছে কিন্তু তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। নার্সের হাতে বাবুকে দিয়ে দিলো। কারণ তাকে এখন ক্লিন করা হবে। ইজহান নিজের শার্টের দিকে তাকালো পুরো রক্ত ছেয়ে গিয়েছে। এটা সে ক্লিন করবে না তার বাবা হিসেবে প্রথম স্মৃতি রেখে দিবে।’

‘পদ্মকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে। জ্ঞান ও ফিরেছে এবং সে এখন অনেকটাই সুস্থ। ইজহান নিজের শার্ট চেঞ্জ করতে গিয়েছে। পদ্ম তার পাশে শুয়ে থাকা ছোট্ট দেহ টাকে দেখছে। এতোদিন সে তার পেটের মধ্যে লুকিয়ে ছিলো। এখন তার চোখের সামনে। পদ্ম তার এক হাত আলতো করে বাচ্চাটাকে ছুঁয়ে দিলো।’

‘ইজহান কেবিনে এসে মা আর ছেলের কান্ড দেখছে। মুচকি হেসে পদ্মের পাশের চেয়ারে বসলো।’

“কেমন আছো পদ্মফুল?”

‘পদ্মের দৃষ্টি তার ছেলের দিকে। আনমনে উত্তর দিলো।’

“ভালো।”

‘ইজহান হুট করে পদ্মের বক্ষে ওষ্ট ছুঁয়ে ছিলো।’

“পৃথিবীর সবচেয়ে দামি সুখ দিয়েছো তুমি পদ্ম। ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না।”

‘পদ্ম চমকে তাকালো ইজহানের দিকে।’

“ছেলের নাম ঠিক করেছেন?”

“তার নাম হবে ইয়াজ শেখ প্রাণ। সুন্দর না?”

‘পদ্ম সম্মতি জানালো। নামটা তার পছন্দ হয়েছে। বাবা মায়ের নামের প্রথম দু’টো অক্ষর মিল পেয়েছে। তারা এখন দু’জন থেকে তিনজন হয়ে গেলো। সুখি পরিবার।’

(*)

‘ইয়াজের তিন মাস চলছে। মায়ের অবস্থা নাজেহাল করে ছাড়ছে। একদিকে তার বাবা জ্বালায় আরেদিকে সে জ্বালায়। মাঝে মাঝে পদ্মের কান্না চলে আসে। আর পারে না এ দু’জন কে নিয়ে। ছেলেটাও কেমন বাবার মতো হয়েছে। পদ্মের কষ্ট কেউ বুঝতে চায় না।’

‘অনেক্ষন যাবত ইয়াজ কান্না করছে। পদ্ম ইয়াজ কে কোলে নিয়ে রুমে হাঁটছে। ছেলের তাও মন ভরছে না। কান্নাও কমলো না। ইজহান হসপিটাল থেকে ফিরেছে মাএ। ফ্রেশ হয়ে পদ্মের কোল থেকে ইয়াজ কে নিলো।’

“এতো কান্নাকাটি করছে কেনো আমার বাবাটা?”

‘পদ্মও এবার কান্না করে দিলো।’

“আপনার ছেলে কোন সময় কান্না করে না বলুন? আমার অবস্থা নাজেহাল করে দিয়েছে এই টুকুন এক বাচ্চা। ঠিক আপনার মতোই হয়েছে আপনার ছেলে।”

‘ইজহান শুনেও শুনলো না এমন একটা ভাব করলো। পদ্ম রেগেমেগে আগুন হয়ে গিয়েছে। ইজহানের কলার ধরে একটা ঝাঁকুনি দিলো।’

“কথা বলছেন না কেনো?”

“আহা আস্তে কথা বলো ইয়াজ ঘুমাচ্ছে তো।”

‘পদ্ম তার ছেলের দিকে তাকালো। আসলেই ঘুমাচ্ছে। বাবার কোলে যেতে না যেতেই ঘুম। আর সে যে এতোক্ষণ ধরে হাঁটলো তার কোনো দাম নেই। ছেলেও পল্টি নিয়ে ফেললো।’

‘ইজহান আস্তে করে ইয়াজ কে শুইয়ে দিলো। এখন তার মায়ের সেবা করার পালা। পদ্মকে কোলে করে ব্যালকনিতে নিয়ে গেলো। পদ্ম হাত পা ছোটাছুটি করছে।’

‘ইজহান চেয়ারে বসলো। পদ্মকেও তার কোলে বসালো। পদ্মের ঘাড়ে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিলো।’

“পদ্ম আকাশের দিকে তাকাও কতো সুন্দর চাঁদ উঠেছে দেখো।”

‘পদ্ম তাকালো। সত্যিই সুন্দর একটা চাঁদ উঠেছে। আর হালকা বাতাস বইছে। পদ্ম চোখ বন্ধ করে অনুভব করলো।’

“আচ্ছা ডাক্তার সাহেব চাঁদ বেশি সুন্দর নাকি আমি বেশি সুন্দর?”

‘ইজহান মুচকি হেসে বললো-‘
“অবশ্যই তুমি।”

‘পদ্মের মনে একটা কৌতুহল জাগলো। ইজহানের দিকে ফিরে প্রশ্ন করলো।’

“আমাদের প্রেমের_রঙ কি ডাক্তার সাহেব?”

“শুভ্র।”

‘পদ্ম অবাক হলো ইজহানের কথায়।’

“শুভ্র কেনো?”

“শুভ্র রঙ সব সময় পবিত্র।”

‘পদ্ম স্মিত হাসলো। এই চাঁদের আলো, মৃদু বাতাস, রোমাঞ্চকর পরিবেশ ইজহানের মন কে বার বার ধাক্কাচ্ছে। ইজহান আর কন্ট্রোল করতে পারলো না। পদ্মের ওষ্ঠে ওষ্ট ছুঁয়ে দিলো। পদ্ম আর কোনো বাঁধা দিলো না। ইজহানের চুলগুলো কে আকড়ে ধরেছে সে। দু’জনের গাঢ় নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে।’

“পদ্ম তোমাকে আরও একটা বাবু গিফট করতে চাই।”

‘পদ্ম সাথে সাথে বলে দিলো।’

“আর বাবু চাই না ডাক্তার সাহেব।”

#সমাপ্ত