প্রেমের সাতকাহন পর্ব-১৭

0
1792

#প্রেমের_সাতকাহন
#পর্ব_১৭
#সুমাইয়া_জাহান

টানা সাতদিন আশরাফ নীলাশা মানে সেই দিনের সেই মেয়েটার পিছনে ঘুরতেছে শুধু মাত্র বন্ধুর জন্য।কিন্তু নীলাশাকে কিছুতেই রাজি করাতে পারছে না।বরং উল্টো মুখ ঝামটা খেয়ে আসতে হচ্ছে। এবার হতাশ হয়ে নীলাশার সামনে ঘাসের উপর ক্লান্ত হয়ে বসে পরলো।খুব ক্লান্ত সুরে বললো,

—- আপু গো একবার রাজি হয়ে এই অদম ভাইটাকে একটু এই দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেও না!তোমার জন্য আমি সাতদিন ধরে কবিতা লেখতে পারছি না।আমার কবিতা গুলো আমার জন্য হাহাকার করছে।ওদের আর্তনাদ কি তুমি শুনতে পারছো না!ওরা বড্ড কষ্টে আছে গো আপু বড্ড কষ্টে!

আশরাফের এমন দারা কথা শুনে নীলাশার বেশ হাসি পেল।কিন্তু তাও মুখ চেপে হাসিটা আটকে নিলো। মুখে খুব গম্ভীর ভাব নিয়ে বললো,

—- তা ভাইয়া আপনার বন্ধু কি বোবা নাকি?

নীলাশার এই কথাটা শুনেই ধড়ফড়িয়ে উঠলো আশরাফ। খুব চমকে বললো,

—- নানানা আপু একদম না!আমার বন্ধু একদম সুস্থ সবল মানুষ।আপু তোমার কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।

—- তাহলে তার হয়ে আপনি কেন আমার পিছনে ঘুরেন?এটা তো তার কাজ ছিলো!

আশরাফ মনে মনে বললো,

—- তা ঠিকই বলেছো আপু!ওই ব্যাটা তো শুধু পারে আমার উপর রাগ দেখাতে।আর তোমার আশেপাশে আসলে তার কাঁপুনি শুরু হয়ে যায়।পুরো বোবা একটা!

কিন্তু মনে কথা মনেই রেখেে দিয়ে মুখে হাসি ভাব নিয়ে বললো,

—- আসলে আপু ও একটু লাজুক তো তাই তোমার সামনে এসে মনের কথা বলতে পারেনা।তাই আমাকেই ওর উকিল হিসেবে পাঠায় আরকি!

—- হুম বুঝলাম।আপনার বন্ধু কে বলে দিবেন উনি নিজে এসে যেদিন বলতে পারেন সেইদিন ভেবে দেখবো কি করা যায়।তার আগে নয়!

কথাটা বলেই দ্রুত পায়ে নীলাশা চলে গেলো।আর আশরাফ মাথায় হাত দিয়ে আবারও ঘাসের উপর বসে পরলো।আর নিজে নিজেই বিরবির করে বললো,

—- ওই ব্যাটা তো জিন্দেগীতে মেয়েটার সামনে এসে মনের কথা বলতে পারবে না।তাহলে কি আমাকে সারাটা জীবন এই উকিলি কাজই করতে হবে।না না নাহ কিছুতেই না!আমাকেই কিছু একটা কাজ করতে হবে।

তারপর থেকেই অনেক কষ্ট করে শেষমেশ আরমান কে নীলাশার সামনে আনতে পারলো আশরাফ।আরমান নিজের মনের কথা নীলাশাকে বলার সাথে সাথেই রাজি হয়নি ওকে আগে একটু নাকানিচুবানি খাইয়েছে তারপর রাজি হয়েছে।আরমানের বাড়ির লোকেদের কেও আশরাফ কে দিয়েই কথাটা বলিয়ে।আরমানের বাড়ির লোকেরাও আর অমত করেনি।ছেলের পছন্দে তারা রাজি হয়ে গেছে।একটা দিন তারিখ ঠিক করে খুব ধুমধাম করে বিয়ে হলো সিকদার বাড়ির একমাত্র ছেলে আরমান সিকদারের।

বিয়ের দুই বছরের মধ্যেই আরমান আর নীলাশার কোল জুড়ে তূর্য আসে।তূর্যের জন্মের পরদিন আশরাফ তূর্যকে দেখতে সিকদার বাড়িতে আসে।আগের দিন আসতে পারেনি একটা জরুরি কাজে আঁটকে গেছিলো তাই।আশরাফ সিকদার বাড়িতে ঢুকতেই দেখলো একটা অচেনা মেয়ে একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে আছে।আশরাফের মেয়েটাকে কেমন যেনো লাগলো।তাই মেয়েটার সামনে গিয়ে ভ্রু উঁচু করে সন্দেহের গলায় বললো,

—- এই মেয়ে কে? তুমি এখানে কি করছো?

মেয়েটা এতোক্ষণ বাচ্চা টাকে নিয়ে খেলা করছিলো।কারো কন্ঠ পেয়ে মাথা উঁচু করে তাকালো মেয়েটা।একটু তাকিয়ে আবারও মাথা নিচু করে কোলে থাকা বাচ্চা টাকে নিয়ে খেলতে ব্যাস্ত হয়ে গেলো।এদিকে আশরাফ কে পাত্তা না দেওয়ায় বেশ রেগে গেলো।কড়া গলায় বললো,

—- এই মেয়ে আমাকে দেখতে পাচ্ছো না?তোমার কোনো ধারণা আছে আমি কে?কি করতে পারি?

মেয়েটা বাচ্চার সাথে খেলা করতে করতে বললো,

—- বলো তো তুর সোনা ওই পচা কাকু টা কে?তুর সোনা বলবে না? আমি বলে দিচ্ছি এই পচা আংকেল টা হলো আশরাফ চৌধুরী। আর তার কাজ হলো বন্ধুর হয়ে ওকালতি করা।তাই না তুর সোনা!

মেয়েটার কথায় অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আশরাফ।মেয়েটা ওকে চেনে কিভাবে আর এসবই বা জানলো কিভাবে?

—- এই মেয়ে সত্যি করে বলো কে তুমি?

আশরাফের প্রশ্নে জবাবে মেয়েটা কিছু বলতে যাওয়ার আগেই আরমানকে সিড়ি বেয়ে নামতে দেখে আর কিছু বললো না।আরমানও সিড়ি বয়ে নামতে নামতে বলতে লাগলো,

—- ও আমার বোন!

আশরাফ যেন এবার অবাকে শেষ সীমানায় পৌঁছে গেছে।চট করেই বললো উঠলো,

—- এই তুই আমারে পাগল বানাইস না দয়া করে এখন!

—- পাগল রে আর নতুন করে পাগল বানাতে যাবো কেন?

আরমান সিঁড়ি বয়ে নিচে নেমে দুই হাত ভাজ করে খুব শান্ত ভাবেই কথাটা বললো।আশরাফ বেশ রেগে গেছে।একে তো সেই তখন থেকে কনফিউজড করেই চলেছে।এখন আবার এই অচেনা অজানা মেয়েটার সামনে অপমান!দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

—- আরমান তুই কিন্তু এবার আমাকে ইনসাল্ট করছিস।

আরমান বেশ বুঝতে পারছে আশরাফ কে একটু বেশিই রাগিয়ে ফেলেছে তাই আর ফাজলামো না করে সোজাসুজিই বললো,

—- আরে রাগ করিস না। ও হচ্ছে নীলিমা। নীলাশার ছোট বোন।তবে শুধু নীলাশার বোন বললে ভুল হবে কারণ ওকে আমি আমার বোনের মতোই ভালোবেসে ফেলেছি।আমার তো কোনো বোন ছিলো না। কিন্তু যেদিন প্রথম নীলাশার সাথে দেখেছিলাম সেদিন থেকেই ও আমার বোন।

—- তা তোর এই পাতানো বোনকে তো এতোদিনে একবারও দেখালাম না।এমনকি তোর আর ভাবির বিয়ের সময়ও তো দেখলাম না।

আড়চোখে একবার নীলিমাকে দেখে কথা বললো আশরাফ। পাতানো বোন কথাটা নীলিমার গায়ে খুব লাগলো।তাই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে নীলিমা ছোট্ট তূর্য কে কোলে তুলে নিয়ে উঠে গিয়ে আশরাফের সামনে গিয়ে দাড়িয়ে চোখ মুখ খিঁচে বললো,

—- কি বললেন আপনি?আমি ভাইয়ার পাতানো বোন?আপনার সাহস তো কম না?

আশরাফ আকস্মিক এমন ঘটনায় ভ্যাবাচ্যাকা খেলে গেলো।ও ভাবতেও পারেনি মেয়েটা এমন ভাবে ওর উপর আক্রমণ করবে।নিজেকে একটু সামলে গলা খাকরি দিয়ে বললো,

—- ঠিক আছে মহাসয়া আপনি ওর পাতানো না বরং প্রানের বোন।এখন বলুন তো এতোদিন ছিলেন কই৷ আপনি?আপনাকে আগে কখনো দেখিনি কেন?

—- কারণ এতোদিন আমি দেশের বাইরে ছিলাম।আমি স্কলারশিপ পেয়ে আপুর বিয়ের কয়েকদিন আগেই বিদেশে পড়াশোনা করতে গিয়েছিলাম।তাইতো আপুর বিয়েটাও দেখতি পানি শুধু ভিডিও কলে ছাড়া।

শেষের কথাটা বেশ মন খারাপ করে বললো নীলিমা। হঠাৎ করেই নীলিমার মনমরা মুখটা দেখে আশরাফের মনে এক অজানা অনুভূতির সৃষ্টি হলো।তারপর আরো কিছুক্ষণ থেকে আশরাফ চলে গেলো।

রাতে নীলাশা নিজের রুমের বেলকনিতে তূর্য কে নিয়ে বসে আছে।পাশে আরমানও ছিলো।আরমান অনেকক্ষন ধরে কিছু একটা নিয়ে ভাবছিলো।নীলাশা তা দেখে আরমান কে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,

—- কি গো কি এতো ভাবছো বলো তো!

নীলাশার কথায় আরমান ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে বললো,

—- ওই ভাবছিলাম আশরাফের সাথে নীলিমাকে কিন্তু খুব ভালো মানাবে কি বলো?

—- আমারও তাই মনে হয়।

কয়েকমাস পরে নীলিমা আর আশরাফেরও ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে যায়।বিয়ের দুই বছরের মাথায় নীরের জন্ম হয়।খুব আনন্দে ছিলো দুই পরিবার। তাদের হাসি খুশি জীবনটা আরো হাসি খুশি হয়ে উঠলো তূবার জন্মের পর।কিন্তু যে জানতো ওদের এতো আনন্দ বেশিদিন টিকবে না।অন্য কারো রাগের শিকার হবে এই দুই পরিবার!তাদের হাসি খুশি জীবনটা সহ্য হচ্ছে না তার!

তূবার এখন চার বছর বয়স।এখন একটু আগটু ভালো ভাবে কথা বলতে পারে।তূর্যের কাছে কাছে তূবাকে পরীর মতো লাগে তাই ও তূবা পরী বলেই ডাকে।আজ চৌধুরী বাড়ীতে অনেক বড়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন হচ্ছে। নীরের সাত তম জন্মদিন বলে কথা।তারজনই আজ সকাল সকাল সিকদার বাড়ির সবাই চৌধুরী বাড়িতে এসেছে।তূবা ছোট্ট ছোট্ট পায়ে হাতে একটা লাল রঙের বেলুন নিয়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর ওর পিছন পিছন তূর্য আর নীর আছে।তূর্য আর নীর বারবার করে ওকে থামানোর চেষ্টা করছে আর ও খিলখিল করে হাসতে হাসতে আরো বেশি করে দৌড়াচ্ছে।

—- পরী থাম বলছি!থাম!দেখ ভাইয়ু কতো হাপিয়ে গেছি!একটু থাম না পরী!এখন খুব হাসি পাচ্ছে তাই না যখন পরে যাবি বুঝবি কতো মজা ভাইয়ুর কথার অবাধ হওয়া।

তূর্য খুব ক্লান্ত হয়ে বললো কথাটা।নীর দেখলো তূবার পিছনে দৌওড়িয়ে কোনো লাভই হচ্ছে না।তাই আস্তে আস্তে নিজেই পিছিয়ে গিয়ে একটা রুমের মধ্যে ঢুকলো।ওই রুম দিয়ে সামনে যাওয়া যায়।তাই আর দেড়ি না করে ওখান দিয়ে ঢুকে তূবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। এতে তূবা মুখ ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে দুই হাত ভাজ করে বললো,

—- তুমমি পতা নীর ভাইয়া।আমমাকে তিক ধরে ফেলো।তোমমার সাতে আরি!তুমমিও তো ভাইয়ুর মতো আমমার পিতনে পিতনে দৌড়াতে পারো হুম!

চলবে,,,,,,,