প্রেয়সী পর্ব-১০+১১

0
313

#প্রেয়সী♥️🥀
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্বঃ১০

১৯.

আমার প্রশ্নে বিশেষ ভাবাবেগ হলোনা রাফিদ ভাইয়ার। তিনি তার খেয়ালে থেকেই ধপ করে বসলেন আমার পাশে। তার মনন চিত্ত কোনো একটা ভাবনাকেই বেশি প্রধান্য দিয়ে চলেছে। আশেপাশের ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো বেশিরভাগই তার মগজ এড়িয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন আমার বাবার অসুস্থতায় তার বেশি কষ্ট হচ্ছে। বাবাকে নিয়ে তিনি বেশি ভাবছেন!

—-” ভাইয়া,আপনি ঠিকাছেন তো?”

রাফিদ ভাইয়া চমকে উঠলেন। আমার দিকে তাকিয়ে শুঁকনো মুখে কিছু একটা বলতে নিয়েও বলতে পারলেন না। বোধকরি তার গলাটা শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। আমি আর বাক্য আওড়ালাম না। একপ্রকার দৌড়ে গিয়েই একটা পানির বোতল নিয়ে এলাম। উনার পাশে বসতে বসতে বোতলটা উনার দিকে এগিয়ে দিতেই উনি বলে উঠলেন,

—-” নিধি, অর্ণব ইজ নট পারফেক্ট ফর ইউ।”

—-” জ্বী?”

রাফিদ ভাইয়ার কথাটা রসকষহীন লাগলো। বুঝতে পারলাম না কি বুঝাতে চাইলেন তিনি। তাই বোকা গলায়ই প্রশ্ন করে উঠলাম। আমার প্রশ্নে উনি নড়লেন না। আমার হাত থেকে পানির বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিলেন খানিকটা। অতঃপর বোতলটা আবারও আমার হাতে ঠেসে দিয়ে বললেন,

—-” সবাই সবার জন্য পার্ফেক্ট হয় না। পার্ফেক্ট কাউকে খুঁজে নিতে হয়। প্রত্যেক টা মানুষের জন্য তার জীবন সঙ্গী হিসেবে অবশ্যই পার্ফেক্ট কাউকে বেছে নেওয়া উচিৎ। অন্তত একটা দিন ভালো কাটানোর লোভে পড়েও খোঁজা উচিৎ। তোমারও তাই করা উচিৎ।”

কথা গুলো বলেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি। আমি ফ্যাকাশে মুখে বললাম,

—-” অর্ণব নিধির জন্য এতোটাও অযোগ্য নয়।”

আমার কথার জবাবে উনি হাসলেন। বোধকরি তাচ্ছিল্যের হাসি। তিনি আর কোনো কথা পাড়লেন না। যেতে যেতে একবার পেছন ফিরে তাকালেন অবশ্য। উনার চোখ মুখ কিছু একটা বলতে চাচ্ছে কিন্তু বাঁধা হানছে উনার মন। যেন নিধিকে রাফিদ এক্ষনি কিছু বলে ফেললে পৃথিবীতে ধ্ব/স নামবে।

“নিধু!”

পাশ থেকে হৃদের ডাক পড়তেই রাফিদ ভাইয়ার থেকে দৃষ্টি সরে গেলো। হৃদ দাঁড়িয়ে আছে। আমি হৃদের দিকে তাকিয়ে আবারও রাফিদ ভাইয়ার দিকে তাকালাম। উনি চলে গিয়েছেন কয়েক সেকেন্ডের মাঝে। বুকের ভেতরটা হঠাৎই শূন্যতা বিরাজ করলো। উনার উপস্থিতি ক্ষনিকের চিন্তা দূর করলেও উনার অনুপস্থিতি আবারও ঢেলে দিলো একরাশ চিন্তক।

হৃদ পাশে বসতে বসতে আমার হাতটা উঠিয়ে নিলো তার হাতে। ভরাট কন্ঠে বলল,

—-” আঙ্কেলের এখন কি অবস্থা?”

—-” হু?”

—-” ডক্টর কি বলেছেন?”

—-” চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিয়েছেন। এর আগে কিছু বলা যাচ্ছেনা!”

—-” আঙ্কেলের হঠাৎ কি হলো বলোতো? এভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন!”

—-” জানি না!”

—-” মনটা খুব খারাপ তোমার তাইনা?”

—-” নাহ্ ঠিকাছি আমি। নিধি এতো সহজে ভে/ঙে পড়ার পাত্রী নয় বুঝেছো?”

হৃদ মুচকি হাসলো। আমার মাথাটা ধরে কাঁধের উপর রেখে বলল,

—” আমি জানি তো লক্ষী। আমার নিধি এতো সহজে ভে/ঙে পড়ার পাত্রীই নয়।”

হৃদের হাসি দেখেও তৃপ্তি পেলাম না আজ। মনটা আবারও ভীষণ ছটফট করছে। হৃদের উপস্থিতি ভীষণ অস্বস্তি দিচ্ছে আমায়। ওর উপস্থিতিতে শান্তি নয় বরং বিরক্ত হচ্ছি আমি। ইচ্ছে হচ্ছে দৌড়ে চলে যাই এখান থেকে। ওর মুখ আর কখনো যেন না দেখি। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে হচ্ছে হৃদকে আমি অকারণে এতো বড় শা/স্তি কেন দিতে চাচ্ছি? কি দোষ তার? সত্যিই তো! কি দোষ তার?

ডক্টরের কথা অনুযায়ী চব্বিশ ঘণ্টা পেরোনোর আগেই বাবার সেন্স ফিরেছে। ডক্টর হাসি মুখেই বলেছেন, “পেশেন্ট ইজ অল রাইট। তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন।” বড় চাচা আর চাচী সন্ধ্যা হতেই বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। হিমেল ভাই আর নিতু আপু যায়নি। হৃদ বেরিয়ে গিয়েছে ঘন্টা খানিক হলো। রাফিদ ভাইয়াও যাননি। এক মুহুর্তের জন্যও বাবার কাছ ছেড়ে নড়েননি সে। তাকে সঙ্গ দিতেই আরফান ভাইয়া আর রূপ ভাইয়া এসেছেন। আজ আর কেউ আমার সাথে রূঢ়ভাবে কথা বলছেননা। সবার কন্ঠই খুব কোমল। যদিও এতে আমি মোটেই অবাক নই। কেননা, সবাই আমার বাবার কথা চিন্তা করেই আমার সাথে নরম সুরে কথা বলছেন। হিমেল ভাইয়ার জন্য শুধু আসতে পারেননি রাফিন ভাইয়া। তবুও আমায় কল করে অনেকক্ষণ কথা বলেছেন। বলেছেন “আমার বাবা একদম ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তার কোনো কারন নেই।”

বাবার কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি সবাই। রাফিদ ভাইয়া আর আরফান ভাইয়া ডক্টরের সাথে কথা বলছেন। রূপ ভাইয়া আর নিতু আপু আমার পাশে দাঁড়িয়ে। নিতু আপু বলল,

—-” রাফিদ সত্যি আজ বড্ড উপকার করলো আমাদের। ঠিক সময় চাচাকে নিয়ে হসপিটালে আসতে পেরেছে। আর নয়তো আজ কি যে হতো!”

আমার বুক চিঁড়ে তপ্ত নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসলো। রূপ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আমি কৃতজ্ঞতার সহিত বললাম,

—-” অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া। আজ আপনারা সবাই সত্যিই বড় উপকার করলেন আমার।”

রূপ ভাইয়া হাসলেন। মাথা নেড়ে বললেন,

—-” আমরা আবার কি করলাম হু? যা করলো সবই তো ঐ যে রাফিদ মহাশয় করলেন। ধন্যবাদ তো তারই প্রাপ্য!”

আমি হাসলাম ছোট্ট করে। রাফিদ ভাইয়ার দিকে তাকাতেই উনার ম্লান মুখটা নজর কাড়লো আমার। একদম পরিপাটি গোছালো ছেলেটা হঠাৎ ভীষণ অগোছালো হয়ে যাওয়ার কারন ঠিক ধরতে পারছিনা আমি। তার মন কাড়া চুল গুলোও আজ বড্ড ক্লান্ত হয়ে হেলে পড়েছে একজন আরেকজনকে আঁকড়ে। ক্লান্ত ভঙ্গিতেই দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। আরফান ভাইয়ার একটা হাত তার কাঁধে চেপে আছে। রাফিদ ভাইয়ার চিন্তাক্লেশ মুখের আড়ালে একরাশ ভয়। আরফান ভাইয়ারও একই মুখ ভঙ্গি। আমার মনের ভেতরটা হঠাৎই ধুক করে উঠলো! পাছে বাবাকে নিয়ে ডক্টর কোনো খারাপ সংবাদ দিচ্ছেন না তো? কথাটা মনে হতেই স্থীর থাকতে পারলাম না! ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম তাদের দিকে। রাফিদ ভাইয়ার পেছনে দাঁড়াতেই উনার ক্লান্তস্বর এসে বারি খেলো আমার কানে,

—-” দিস ইজ নট ডান মি. রেহমান! এটা মেডিকেল হসপিটাল! এখানে এই রোগের ট্রিটমেন্ট না হলে আর কোথায় হবে?”

ড. রেহমান গম্ভীর মুখে জবাব দিলেন,

—-” একটাই অপশন রাফিদ, পেশেন্ট কে বিদেশ নিয়ে যাও। ইন্ডিয়াতেই এর খুব ভালো ট্রিটমেন্ট আছে।”

আরফান ভাই বিস্মিত কন্ঠে বললেন,

—-” ইন্ডিয়া!”

—-” হ্যাঁ ইন্ডিয়া। দেখো আরফান-রাফিদ তোমরা আমার পরিচিত বলেই আমি কারোর সাথে আলোচনা না করে তোমাদের সাজেস্ট করলাম। অন্য কেউ হলে কিন্তু কখনোই বলতেননা। তারা চাইবেননা একটা পেশেন্ট কমে গিয়ে তাদের অর্থের লোকসান হয়ে যাক। আজকাল মানুষ জীবন নয় টাকা কে বেশি ভালোবাসে। তাই আমি বলছি এই রোগের যথাযথ ট্রিটমেন্ট করাতে হলো ইন্ডিয়া যাও। ওখানে আমার অনেক পরিচিত ডক্টর আছেন। দরকার পড়লে আমি তাদের সাথে কন্টাক্ট করে দিবো। শুধু শুধু পেসেন্টকে এভাবে ফেলে রেখে রি/স্ক বাড়িও না।”

রাফিদ ভাইয়া আরফান ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। আরফান ভাই চোখের ইশারায় তাকে শান্ত হতে বললেন। কিন্তু রাফিদ ভাই শান্ত হতে পারলেও আমি শান্ত হতে পারলাম না। আতংকে আমার সারা শরীর কাঁপছে। দরদর করে ঘামছি আমি। বাবার কি এমন রো/গ হয়েছে? যার জন্য বাবাকে ইন্ডিয়া নিয়ে ট্রিটমেন্ট করাতে হবে?

পা দুটো কাঁপতে কাঁপতে এবার বুঝি ভেঙেই যাবে। সামলাতে পারছিনা নিজেকে! হাঁটু ভেঙে লুটিয়ে পড়তে চাচ্ছি বারবার। কিন্তু না, মনে জোড় রেখে ডক্টরের উদ্দেশ্যে মোটা স্বরে বলে উঠলাম,

—-” ডক্টর, কি হয়েছে আমার বাবার?”

মনে হলো পুরো রুম কাঁপিয়ে বলেছি কথাটা! কিন্তু আমার কথা রাফিদ ভাইয়া ছাড়া আর কেউই শুনতে পাননি। পেছন মুড়ে আমাকে দেখতেই উনি চমকে উঠলেন! দৌড়ে এসে আমাকে বাহুডোরে নিতে নিতে আমি শরীরের ভার ছেড়ে দিয়েছি। বোধকরি উনার বুকেই আমি জ্ঞান হারিয়েছি!

২০.

মাথার মধ্যে ধপধপ করছে খুব। অসহ্য ব্যাথা নিয়ে শুইয়ে থাকাও সম্ভব হলো না। দু’হাতে ভর দিয়েই উঠে বসলাম। মাথায় কিসের এতো ব্যারাম উঠেছে বুঝতে পারছিনা! দু’হাতে শক্ত করে চেপে ধরলাম মাথাটা। কখন ঘুমিয়েছি এভাবে তাও মনে আসছে না। ঘুমানোর আগেই হয়তো মাথা ব্যাথা ছিলো তাই এখনো ব্যাথা করছে। রানি কে বলতে হবে এক কাপ চা দিতে! আপাতত নিজের শক্তি দিয়ে নিজে আর চা বানানো সম্ভব না। বড় বড় করে দু’বার নিঃশ্বাস ছেড়ে সোজা হয়ে বসলাম। ক’টা বাজে?

আমার ঘরের হাতের ডান পাশটাতে বড় আকারের ঘড়িটা উধাও। কথাটা মনে হতেই কপাল কুঁচকে এলো আমার। এখান থেকে ঘড়ি কে নিলো? নিশ্চয়ই বাবা নিয়েছে। বাম পাশে তাকালাম ঘড়ির সন্ধানে। কিন্তু না, বাম পাশেও নেই। সামনে তাকিয়ে বিছানা ছেড়ে নামতে নিলেই আঁতকে উঠলাম আমি। চারপাশের সব কিছুই গোলকধাঁধার মতো ঘুরছে। আমার ঘরের একটা জিনিসও জায়গা মতো নেই! কে সরালো সব? চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে আসছে। বেডের পেছনের দিকটাতে দেওয়ালে বিশাল এক ছবি ঝুলছে। চোখ জোড়া ঘোলাটে হলেও দেয়ালের মানুষটার শারীরিক বর্ননা দিতে পারবো। ফর্সা লম্বা করে দেখতে। লাল টি-শার্ট পরে আছেন। চোখে কালো সানগ্লাস। মাথার সিল্ক চুল গুলো খুব সম্ভবত বাতাসের তোড়ে এলোমেলো হয়ে আছে। মুখ জুড়ে নিষ্পাপ মায়াবী হাসি। সাইড ভাবে পোজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। দু’হাতে চোখ কচলে আবারও তাকালাম ছবিটার দিকে। ছবিটার আকৃতি এতোটাই সুন্দর যে মানুষটার মুখ খানা দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না।

চোখ কচলাতে আপাতত সবটাই পরিষ্কার। চারপাশে তাকাতে তাকাতে ছবিটার দিকে তাকালাম। ছবির মানুষ টাকে দেখতেই তৎক্ষণাৎ বুকের ভেতরে কেউ ধমাধম ঢোল পেটালো মনে হলো। লাফিয়ে উঠে বিছানা ছাড়লাম। হা করে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করতেই আমার অবচেতন মন ছটফট করে বলে উঠলো,

—-” এটা রাফিদ ভাইয়ার রুম! কেম্নে কি? আমি তার রুমে কি করে?”

“” আরে উঠে গিয়েছো তুমি? দাঁড়িয়ে কি করছো হ্যাঁ? তোমার শরীর ঠিক নেই। বসো বসো। আমি তোমার জন্য একটু স্যুপ দিতে বলি। বসো।”

অল্প বয়সী সুন্দরী এক রমণী দাঁড়িয়ে আছেন আমার সামনে। তার রূপের আলোতে আমার মুখ আপনাআপনি হা হয়ে গিয়েছে। অবাক নয়নে তাকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে উনি বাইরে গিয়ে আবার ভেতরে প্রবেশ করলেন। আবারও আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি কন্ঠে বললেন,

—-” এই মেয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছো? বসছো না কেন?”

আমার মুখ থেকে কথা আসছেনা! বলতে পারছিনা রীতিমতো। শুধু হা করে উনাকেই দেখে চলেছি। উনি মুচকি হেসে এগিয়ে এলেন। আমার হাত ধরে বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসলেন। কোমল স্নিগ্ধ স্বরে বললেন,

—-” তোমার শরীর এখন কেমন? এখনো কি মাথা ঘুরছে? আচ্ছা তোমায় কি নামে ডাকি বলোতো?”

উনার কথা গুলো গুলিয়ে ফেলছি। ধরতে পারছিনা। রুমটা রাফিদ ভাইয়ার। আর এই সুন্দরী মেয়েটাও এই বাসারই। রাফিদ ভাইয়ার সাথে কি কোনো যোগসূত্র আছে তার?

—-” ভাবি স্যুপ।”

ট্রে হাতে ঢুকে এলো রানির বয়সি একটা মেয়ে। আমার পাশে বসে থাকা রমণী মেয়েটা তার উদ্দেশ্যে বললেন,

—-” রাখ এখানে। আর রাফিদ কে গিয়ে বল তার গেস্টের সেন্স ফিরেছে।”

মেয়েটা খাবারের ট্রে-টা রেখে মাথা হেলিয়ে চলে গেলো। আমি উনার দিকে একই ভাবে চেয়ে আছি। ভাবছি কে উনি? মেয়েটা তাকে ভাবি ডাকলো? তবে কি রাফিদ ভাইয়ার বউ এটা?

—-” কি গো? নাম বলবে না তোমার?”

উনার ডাকে চমকে উঠে তাকালাম। মুখে জোরপূর্বক হাসির রেখা টেনে বললাম,

—-” জ..জ্বী নীলাদ্রিতা!”

উনি মিষ্টি হেসে বললেন,

—-” নীলাদ্রিতা? নাইস নেইম।”

আমি মাথা হেলিয়ে বললাম,

—-” হু নীলাদ্রিতা নিধি!”

—-” এতো সুন্দর নামটা কে রাখলো তোমার? ভারী মিষ্টি নাম কিন্তু। আচ্ছা আমি তোমায় কোন নামে ডাকি বলোতো? নীলাদ্রিতা নাকি নিধি?”

আমি শুঁকনো মুখে জবাব দিলাম,

—-” আপনার যেটা ভালো লাগে।”

উনি আবারও হাসলেন। স্যুপের বাটিটা হাতে তুলে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,

—-” আমি আদ্রিতা। তুমি আমায় ভাবি বা আপু বলে ডাকতে পারো। নাও এটা খেয়ে নাও।”

যখন থেকে মনে হলো উনি রাফিদ ভাইয়ার বউ তখন থেকেই উনাকে আর ভালো লাগছেনা। মনে হচ্ছে উনি একটু বেশিই সুন্দরী। যেটাকে বলে প্রয়োজনের অধিক। আমি খাবার টা উনার থেকে নিলাম না। ব্যস্ত ভঙ্গিতে আমার ফোনের তল্লাশি চালালাম। সময়টা দেখা আমার জন্য খুব বেশি প্রয়োজন। হঠাৎ মাথাটা এভাবে শূন্য হয়ে খা খা করছে কেন তাও বুঝতে পারছিনা!

—-” তোমার ফোনটা আামর কাছে। ডক্টর তোমাকে দু-তিন ঘন্টা রেস্ট নিতে বলেছেন। তাই আমি তোমার ফোনটা আমার কাছে রেখেছি!”

কথা গুলো বলতে বলতেই রাফিদ ভাইয়া ঢুকে এলেন ভেতরে। আমি অবাক কন্ঠে বললাম,

—-” আমি আপনার বাসায় কি করছি? কে নিয়ে এসেছে আমাকে? আর ডক্টর, রেস্ট… এসব কি হচ্ছে? আমি সত্যিই কিছু বুঝতে পারছিনা।”

উনি মাথা নীচু করেই এগিয়ে এলেন আমার দিকে। আমার সামনে এসে দাঁড়াতে আদ্রিতা আপু উঠে গেলেন। রাফিদ ভাইয়া সেই জায়গাতেই বসলেন চুপটি করে। স্যুপের বাটিটার দিকে তাকিয়ে শুঁকনো মুখে বললেন,

—-” স্যুপটা খেয়ে নাও নিধি। আধঘন্টার মধ্যে আমাদের হসপিটালে যেতে হবে।”

হঠাৎ ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো আমার। মনে হলো ভেতর থেকে ধাক্কা খেলাম! মাথার মধ্যে চিনচিনে ব্যাথা করতে শুরু করল। হাত তুলে মাথাটা চেপে ধরতে হঠাৎ-ই মনে পড়ে গেলো, “বাবা হসপিটালে!”

লাফিয়ে উঠে বিছানা ছাড়লাম। ভেতরটায় তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো হঠাৎ। বাবাকে ডক্টররা কোথাও একটা পাঠাতে চান!______হ্যাঁ! ইন্ডিয়া। বাবার বিরল কোনো রোগ হয়েছে নিশ্চিত। তাই ডক্টররাও উনাকে রাখতে চাচ্ছেন না এদেশে! আমাকে এক্ষনি বাবার কাছে যেতে হবে। দৌড়ে রুম থেকে বের হতে নিলেই রাফিদ ভাইয়া আঁটকে দেন আমায়। আমার হাতটা টেনে ধরে অসহায় কন্ঠে বলতে লাগলেন,

—-” কোথায় যাচ্ছো একা? নিধি তোমায় শরীর ঠিক নেই। অল্প কিছু খাওয়া তোমার জন্য খুবই জরুরি। প্লিজ এই খাবারটুকু খেয়ে নাও। তারপর সোজা আমরা হসপিটালে চলে যাবো।”

পাশ থেকে আদ্রিতা আপুও রাফিদ ভাইয়ার সুর ধরলেন। বারবার করে বলতে লাগলেন,

—-” নিধি বোন একটু কিছু মুখে দিয়ে পরে না হয় যাও। এভাবে না খেয়ে গেলে তুমি আরও অসুস্থ হয়ে যাবে।”

তাদের কারোর কথাতেই আমার মন গলছেনা। রাফিদ ভাইয়ার থেকে নিজের হাতটা ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছি। মনের অজান্তেই চোখ বেয়ে পানি ঝড়ছে। খুব করে বুঝতে পারছি, আমি বাবাকে হারাতে বসেছি।

রাফিদ ভাইয়া আস্তে করে আমার হাত ছেড়ে দিলেন। আমি আর এক মুহুর্তও দাঁড়িয়ে রইলাম না। এক দৌড়ে নীচে নেমে আসলাম। বাড়ির এরিয়াটা একটু বেশিই বড় যার দরুন আবারও মাথার মধ্যে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে আমার। পেছন থেকে গাড়ির হর্ন বাজতেই চমকে উঠলাম। পেছন মুড়ে অন্ধকার হাতড়ে গাড়ির হদিশ মিলতেই দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠলাম। রাফিদ ভাইয়া গাড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে কোমল স্বরে বললেন,

—-” তোমার বাবার কিচ্ছু হবেনা নিধি। তাকে সুস্থ করতে আমি সব কিছু করবো। প্লিজ নিজেকে সামলাও। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।”

#চলবে____________________

#প্রেয়সী♥️🥀
#লেখনীতেঃমুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্বঃ১১

২১.

বাবা কে ইন্ডিয়া নেওয়ার সকল কার্যক্রম শেষ। রাত এখন ৩ টা। বাবার কেবিনের সামনে সবাই জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু অপরিচিত মুখেরও দর্শন মিলছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। কিন্তু আমি চিনতে পারছিনা তাদের। অবাক চোখে সবার পানে তাকাচ্ছি থেকে থেকে।
হঠাৎ কোনো পরিচিত মুখ দেখে থমকে গেলাম। সেদিন রাস্তায় যে ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো তাকেও দেখা যাচ্ছে। আন্টি রাফিদ ভাইয়ার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। কপালে জমে আছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বারবার দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন। তার পাশেই দাঁড়িয়ে এক ভদ্রলোককে বারবার কিছু বলছেন। চিন্তার ভাজে তার ফর্সা মুখখানা র//ক্তশূণ্য হয়ে আছে। আমার পাশেই নিতু আপু দাঁড়িয়ে। তাই নিতু আপুকেই জিজ্ঞেস করে বসলাম,

—-” উনারা কারা? আর ঐ ভদ্রমহিলাকে তো আমি চিনি। উনি রাফিদ ভাইয়ার সাথে কি করছেন?”

নিতু আপু ভদ্রমহিলা আর ভদ্রলোককে দেখিয়ে বললেন,

—-” উনারা রাফিদের বাবা-মা। আর ঐ পাশে সুন্দর মতো যে ছেলেটা দাঁড়িয়ে উনি রাফিদের কাজিন। হিমাদ্র ভাই।”

আমি আবারও তাকালাম তাদের দিকে। আন্টিকে দেখে সেদিনের কথা গুলো মনে পড়ে গেলো। উনি উনার ছেলে রাহিয়ান বলতে রাফিদ ভাইয়াকেই বুঝিয়েছিলেন? আর উনার পাশের ভদ্রলোক উনার হাজবেন্ড?

হঠাৎ আন্টির চোখে চোখ পড়লো। আমি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে শুঁকনো হাসি দিলাম। উনি কিছুক্ষন টলমল চোখে তাকিয়ে থেকে বড় বড় ধাপ ফেলে এগিয়ে আসলেন আমার দিকে। আমি দাঁড়িয়ে গিয়ে মুখে শুঁকনো হাসি দিয়েই তাকালাম তার দিকে। কিছু বলতে যাবো তার মধ্যেই উনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। উনার ছোঁয়া পেয়ে সারা শরীর হঠাৎ শীতল হয়ে উঠলো আমার। মন যেন আত্নচিৎকার পেড়ে বলে উঠছে, এই ছোঁয়া কেবল আমার মায়েরই হতে পারে।” ভেতরটা ডুকরে উঠলো আমার। খুব ইচ্ছে হলো এই অপরিচিত আন্টিকে মা বলে ডাকতে। আমি মনে মনে ভাবলেও আন্টি মুখেই মা বলে ডেকে উঠলেন আমায়। হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি। আমি হতবিহ্বল হয়ে গেলাম আন্টির কার্যকলাপে। মনে মনে প্রশ্ন তৈরি করতে পারলেও মুখে আনতে পারলাম না সেসব। উনার কান্নাতে যেন আমার মনটাও ভেঙে যাচ্ছে। উনি শক্ত করে আগলে ধরলেন আমায়। কান্নাজড়িত কন্ঠেই বলতে লাগলেন,

—-“আমার নিধি। তুই আামর নিধি! হিসেব নেই কতগুলো বছর ধরে পা/গ/লে/র মতো খুঁজে বেড়িয়েছি তোদের। না জানি কোথায় কোথায় খুঁজেছি আমার অভিমানি বোনটাকে। সেই যে গেলো বাড়ি ছেড়ে আর কখনো এমুখো ফিরলোই না! বাবা মা কেমন করে পথ চেয়ে বসে থাকতো ওর।”

কথা গুলো বলে আবারও কাঁদতে লাগলেন তিনি। আমি উনার কথা গুলো ঠিক বুঝতে পারলাম না। শুধু শুনে যাচ্ছি। ভেবে যাচ্ছি কি বলছেন তিনি?

আমার ভাবনার মাঝে আবারও কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলেন তিনি,

—-” আজ যখন পেয়ে গিয়েছি তোদের আর কখনো কাছ ছাড়া করবো না দেখে নিস। তোকে আর তোর বাবাকে আমার কাছেই নিয়ে রাখবো। কখনো আর হারাতে দেবোনা রে মা। তাকে তো হারিয়েই ফেলেছি কিন্তু তোকে… তোকে আর কিছুতেই হারাতে দিবো না!”

আমি সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। উনার মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বললাম,

—-” আপনি এসব কি বলছেন আন্টি?”

উনি হঠাৎ-ই হেসে ফেললেন। বোধকরি সুখের হাসি হাসলেন। আমার দু’গালে হাত রেখে কপালে চুমু খেয়ে স্নেহভরা কণ্ঠে বললেন,

—-” আন্টি কি রে? বল বড় খালামনি! আমি তোর অভাগী মায়ের বড় বোন রে।”

বুকের ভেতরটা ধক করে কেঁপে উঠলো। স্ব জোরে আ/ঘা/ত হেনে গেলো মনে। উনার কথাটা আরেকবার মাথার মধ্যে বেজে উঠতেই আরও এক দফা ধাক্কা খেলাম যেন। হকচকিয়ে উনার হাত চেপে ধরলাম। একরাশ বিষ্ময় আর উত্তেজনায় প্রশ্নবিদ্ধ মুখ নিয়ে উনার দিকে তাকাতেই উনি আবারও হেসে ফেললেন। চোখ থেকে ঝড়ে যাওয়া জল গুলো মুছতে মুছতে হাসলেন। মাথা নেড়ে বললেন,

—-” তুই আমার কলিজার টুকরার একমাত্র স্মৃতি মা। কতকত জায়গায় খুঁজেছি তাকে তার সত্যিই যে কোনো হিসেব নেই।”

আমি এবার কান্নার বেগ চেপে রাখতে না পেরেই ঝাপটে ধরলাম বড় খালামনিকে। শব্দ করে কেঁদে উঠতেই আরেকজোড়া স্নেহের হাত পড়লো আমার মাথার উপর। মাথা তুলে তাকাতেই দেয়ালে টানানো মায়ের ছবিটার অনুরূপ আরেকজনকে আবিষ্কার করলাম। মনের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠতেই বড় খালা মনি বলে উঠলেন,

—-” এটা তোর মেঝ-খালামনি।”

আমার চোখ জোড়া আবারও ঝাপ্সা হয়ে এলো। আমার মা নেই কে বললো? এই তো পেয়ে গিয়েছি দু-দুটো মা। মেঝ-খালামনিও কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরলেন আমায়। ক্ষণিকের জন্য বাবার শোক ভুলে গেলাম। আস্তে আস্তে আরও অনেককে পেলাম। সবই আমার নানু বাড়ির মানুষ। জানতে পারলাম বড় খালামনির একজনই রাজপুত্র। রাহিয়ান রাফিদ। বাইরে তিনি রাফিদ নামে খ্যাত হলেও পরিবারের সবার কাছে তিনি রাহিয়ান নামেই খ্যাত। মেঝ-খালার দুই সন্তান। রিম্পি আপু আর ফাহিম ভাইয়া। ফাহিম ভাইয়া রাফিদ ভাইয়ার থেকে একবছর জুনিয়র আর রিম্পি আপু তিন বছরের। আমাদের মামুও আছেন নাকি তিন জন। কিন্তু কেউ কারোর সাথে যোগাযোগ রাখেননি। তিনজনেই নানা-নানুকে ছেড়ে তাদের বউ বাচ্চা নিয়ে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছেন। নানা নানু মা//রা গিয়েছেন বছর পাঁচেক আগে। নানু নাকি মায়ের শোকেই প্যারালাইজড ছিলেন বহুবছর। হঠাৎ একদিন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন। আর নানুর শোকে নানাও গত হলেন। মায়ের তার পরিবার থেকে আলাদা হওয়ার সঠিক কারন এখনো জানতে পারলাম না। মনে মনে ভাবলাম, এতো সুন্দর একটা পরিবার রেখে কেউ কি এভাবে চলে আসতে পারে? সেদিন হঠাৎ বড় খালামনির সাথে যখন দেখা হয়েছিলো, তখন তিনি কারোর একটা এনগেজমেন্টে যাচ্ছে বলেছিলেন সেটা রিম্পি আপুরই এনগেজমেন্টে ছিলো নাকি। হসপিটাল আপাতত আমাদের গুষ্ঠির মানুষ দিয়েই ভর্তি। বাবার সেন্স ফিরতে বড় খালামনি আর মেঝ-খালামনিকে দেখতেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। মা-যে আর বেঁচে নেই সেই কথা স্বরণ করে আবারও কাঁদলেন সবাই।

আমি পা/থ/র হয়ে এক কোনে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম সবটা। বাবার কাছে যেতে সাহস হচ্ছিলো না। বাবাকে জোড় গলায় বলতেও ইচ্ছে করছিলো না “বাবা জলদি ঠিক হয়ে উঠো!” কেননা মানুষ তখনই কাউকে হারায় যখন সে তাকে খুব বেশি করে চায়। যাকে অতিরিক্ত ভালোবাসা হয় সেই ফাঁকি দিয়ে চলে যায়। এই ভ/য়/টা/ই কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো আমায়। বাবার সাথে কথা বলে এক এক করে সবাই বেরিয়ে গেলেন। গেলেননা শুধু বড় খালামনি আর রাফিদ ভাইয়া। বুঝতে পারছিলাম না কি করবো? দাঁড়িয়ে থাকবো নাকি বাবার কাছে যাবো?

বাবা টলমল চোখে আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলো। বড় খালামনি কিছু একটা বলছেন বাবাকে। বাবা শুনছে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। রাফিদ ভাইয়া মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে শুনছে মায়ের কথা। তাদের আলাপন আমার কান অব্দি এসে পৌঁছচ্ছে না অবশ্য। বাবা নিঃশ্বাস টেনে আবারও ছেড়ে দিলো। মুখে স্নিগ্ধ কোমল হাসি এঁটে আমাকে হাত ইশারায় কাছে ডাকলো। আমি ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। কেন জানিনা আমার পা আমার সঙ্গ দিচ্ছে না! আমায় বাবার কাছ অব্দি এগিয়ে যেতে সাহায্য করছেনা। রাফিদ ভাইয়া হইতো আমার অবস্থা বুঝে এগিয়ে এলেন। আমার হাত ধরে বাবার কাছে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললেন,

—-” বাবার সাথে কথা বলো। কিছুক্ষণ বাবার সাথে থাকো।”

কথাগুলো আমায় বলেই তৎক্ষনাৎ বড় খালামনির উদ্দেশ্যে বললেন,

—-” মা চলো আমরা বাইরে অপেক্ষা করি।”

বড় খালামনি উঠে দাঁড়ালেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে নরম স্বরে বললেন,

—-” বাবার সাথে কথা বল মা। এভাবে গুমড়ে থাকিস না।”

কথাটা বলেই চলে গেলেন তারা। তাদের যাওয়ার পানে একবার তাকিয়ে বাবার দিকে তাকালাম আমি। বাবার চোখ মুখ শুঁকিয়ে আছে। মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যতিরেকে বাবার শুঁকনো মুখটা দেখতে ক/ষ্ট হচ্ছে আমার। খুব ক/ষ্ট হচ্ছে। বড় খালামনির বসে থাকা জায়গাটায় বসে বাবার হাতের উপর হাত রাখলাম। কান্নার বেগ চেপে অভিযোগের সুরে বললাম,

—-” ভালোই তো পারো নিধিকে ভ/য় দেখাতে। মাঝেমধ্যে যে দশ বারো সেকেন্ডের জন্য চোখ বুঁজে বলতে নিধি তোর বাবা হারিয়ে গেছে! সে অব্দিই তো ঠিক ছিলো! তাহলে আজ হঠাৎ এতো গুলো ঘন্টা পার হওয়ার পরও কেন চোখ খুললেনা? কি ভেবেছিলে? সত্যিই হারিয়ে যাবে? নিধিকে একা নিঃসঙ্গ করে মিসেস খানের সঙ্গী হবে? শুনো মি. খান আমি তোমায় সাফ সাফ বলে দিচ্ছি, নিধিকে একা নিঃসঙ্গ করে হারিয়ে যাওয়ার চিন্তা এবার বাদ দাও। তোমায় ছাড়া নিধির খুব ক/ষ্ট হয়। সে-কথা হয়তো নিধি কখনো মুখ ফুটে বলবে না তোমায় কিন্তু তোমাকে বুঝতে হবে। বাবাকে ছাড়া নিধি একদিনও বাঁচতে পারবেনা মি. খান। এই কথাটা একদম মগজে ঢুকিয়ে নিবে। তুমি হয়তো জানো না মি. খান, তোমার ঐ দশ বারো সেকেন্ড চোখ বুঁজে থাকা সময়টাও নিধিকে কতটা নিঃসঙ্গ করে তুলতো? কি করে অসহায় করে তুলতো? খেলাটা হয়তো তোমার কাছে মজার ছিলো কিন্তু নিধির কাছে কখনোই মজার ছিলো না। খুবই
য/ন্ত্র/ণা/দা/য়/ক ছিলো। আজও বড্ড য/ন্ত্র/ণা/দা/য়/ক তোমার এই চোখ বুঁজে থাকার খেলাটা। আমি কিন্তু মিসেস খান কে অভিযোগ করবো। তুমি বড্ড বেশি করছো নিধির সাথ! ব..বড্ড বেশি…”

শেষ কথাগুলো খুব বিশ্রি ভাবে দলা পাকিয়ে গেলো গলায়। ঢোক গিলেও আর কিছু বলা সম্ভব হলোনা। বাবা হু হু করে কেঁদে উঠলো। বাবার কান্না দেখে এবার আর আমার পক্ষেও সম্ভব হলোনা নিজেকে সামলে রাখা। আমিও শব্দ করে কেঁদে উঠে বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম। নিধি কখনো কাঁদে না! কিন্তু আজ কেন জানি না কান্না না করে থাকতে পারছিনা! মনে হচ্ছে কান্না না করলে একবুক ক/ষ্ট নিয়েই ম/রে যাবো আমি। কিছুতেই এতো ক/ষ্ট নিয়ে বাঁচা সম্ভব হবেনা। কিছুতেই না!

২২.

—-” আমি বাবাকে ছাড়া থাকতে পারবোনা প্লিজ! আমাকেও নিয়ে চলো সাথে।”

আমার কথা শুনে সবাই এক দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে। বাবাকে নিয়ে এক্ষনি বের হচ্ছেন বড় খালু আর বড় খালামনি। সঙ্গে মেঝ-খালামনিও যাবেন বলছেন। কিন্তু আমাকে কেউ যাওয়ার কথা বলছেনা! কেন বলছেনা? আমাকে কেউ নিবেনা বলেই মনে হচ্ছে! কিন্তু বাবাকে ছাড়া আমি একা কি করে থাকবো?

বড় খালামনি আমার দিকে এগিয়ে এলেন। স্নেহময় কন্ঠে বললেন,

—-” নিধি! তুই ওখানে গিয়ে কি করবি মা? এই দেখ আমি তো যাচ্ছি। তোর বড় খালুও যাচ্ছেন,হিমাদ্রও যাচ্ছে! আমরা কি তোর বাবার ঠিকঠাক ট্রিটমেন্ট করাতে পারবো না? নাকি ঠিকঠাক যত্ন নিতে পারবো না? আমাদের উপর কি তোর একটুও ভরসা নেই বলতো?”

—-” না গো খালামনি! তুমি প্লিজ এভাবে বলো না! তোমরা হয়তো আমার থেকেও ভালো যত্ন নিতে পারবে বাবার। কিন্তু আমি… আ..আমি তো এর আগে কখনো বাবাকে ছেড়ে থাকিনি!! আমি বাবাকে ছেড়ে থাকতেও পারবোনা প্লিজ… আমায় প্লিজ নিয়ে চলো খালামনি!”

মেঝ-খালামনি আমায় তার কাছে নিয়ে কোমল স্বরে বললেন,

—-” দেখ মা! আমিও যাচ্ছি বড় আপাদের সাথে! এতদূরের পথ আর তারউপর তোর শরীরটাও কিন্তু ঠিক নেই। তুই থাক এখানে। এই দেখ এই যে তোর রিম্পি আপু, রাহিয়ান ভাইয়া,ফাহিম ভাইয়া এরা সবাই আছে। তুই ওদের সাথেই থাকবি। সারাক্ষণ ওরা তোর সঙ্গে থাকবে মা। দেখবি একদমই তোর একা লাগবে না। বাড়িতে কিন্তু আরও লোক আছে। আদ্রিতা আছে। খুবই মিষ্টি মেয়ে ও। এতো গুলো মানুষের মাঝে দেখবি তোর বাবার কথা সেভাবে মনেই পড়বেনা। শোন মা, পাগলামি করিসনা লক্ষিটি। ওখানে তো বাবার ট্রিটমেন্ট হবে বল? এখন যদি তোকেও নিয়ে যাই তবে আমরা কতদিকে দেখবো? বাবাকে দেখবো নাকি তোকে দেখবো?”

রিম্পি আপু আর নিতু আপু আমায় বোঝাতে লাগল একই কথা। রিম্পি আপু বলল,

—-” এই নিধি যাস না বোন। ছোট খালু একদম ফিট হয়ে খুব জলদিই ফিরে আসবে রে। আমরা আছি তো তোর সাথে। প্লিজ যাস না তুই।”

নিতু আপু বলল,

—-” হ্যাঁ রে নিধি। চাচাকে ট্রিটমেন্ট করিয়ে তো খুব জলদিই নিয়ে আসবে তাই না? তুই থেকে যা বোন। যাস না। তোর যদি ঐ বাড়িতে বেশি খারাপ লাগে তবে সব্বাইকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে আসবি। আমরা খুব মজা করে কাটাবো। দেখবি বাবা কাছে নেই বলে তোর একদমই মন খারাপ হবেনা।”

সবার বলার মাঝে রাফিদ ভাইয়াও গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন,

—-” সবাই যখন বলছে তখন থেকে যাওনা নিধি। হয়তো সময়টা তোমার ততটাও খারাপ কাটবেনা যতটা তুমি ভাবছো।”

বাবার কথা মনে পড়লেই কারোর বারন কান অব্দি আসছেনা। কিন্তু পারলাম না নিজের জেদ ধরে রেখে বাবার পিছু পিছু যেতে। সবার অনুরোধের ভারে রাজি হয়ে গেলাম তাদের সাথে থাকতে।

ঘন্টা খানিকের মধ্যে বড় খালামনিরা ইমারজেন্সি টিকেটে চলে গেলেন বাবাকে নিয়ে। এদিকে বাবাকে চলে যেতে দেখে আমি আবারও কাঁদতে লাগলাম। মনটা মানছে না বাবাকে একা ছেড়ে দিতে। মন বলছে বাবার কিছু একটা হয়ে গেলেও আফসোস হবেনা এই ভেবে বাবা যে আমার কাছেই আছে। আমার চোখের সামনে আছে। কিন্তু এখন যে তাও নেই। বাবার কিছু একটা হয়ে গেলে নিধি আর বাঁচবে না। একদমই বাঁচবে না।

দশ মিনিট হলো বড় খালামনিদের বাড়িতে এলাম। ওদিক থেকে হিমেল ভাইয়া আর নিতু আপু চলে গেলো বাসায়। আর এদিকে রিম্পি আপু আর ফাহিম ভাইয়া আমাদের সাথেই এলো। আমাকে পাঁচ জনে একসাথে থাকার মতো একটা রুম দিলো। এ-মাথা থেকে ও-মাথায় যেতেও আমার কয়েকমিনিট অতিক্রম হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। তখনকার মতোই চারিপাশ গোলকধাঁধার মতো লাগছে। বাসায় ফিরে রাফিদ ভাইয়াকে আর দেখা গেলো না। আদ্রিতা আপু আর রিমলি আপু আমাকে এই রুমে দিয়ে গেলো। আমার হাতে কয়েক সেট ড্রেস তুলে দিয়ে বলল, এখান থেকে একটা ড্রেস পড়ে জলদি ফ্রেশ হয়ে নিতে। আমিও সেই মোতাবেক জলপাই রঙের স্কার্টটা নিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। ফ্রেশ হতে হতে ফজরের আজানের ধ্বনিতে বুক ফুলে উঠলো আমার। ফ্রেশ হয়েই জলদি ওজু করে বের হয়ে আসলাম। ভেবেছিলাম আদ্রিতা আপুর থেকে একটা জায়নামাজ চেয়ে নিবো। কিন্তু সেই কষ্ট আর করতে হলো না। হাতের ডানেই একটা জায়নামাজ ভাজ করা দেখে মনে শান্তি এসে গেলো যেন। আর সাত পাঁচ না ভেবেই জায়নামাজ বিছিয়ে ফজরের নামাজের সাথে সাথে বাবার সুস্থতা কামনায় আরও চার রাকা’ত নফল নামাজ পড়ে ফেললাম। আল্লাহর দরবারে হাত তুলতেই দুনিয়ার সমস্ত দুঃখ কষ্ট যেন জড়ো হলো মনে। যত পারলাম সেজদা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহ কে বললাম। দিন শেষে নিধি কিছুই চায়না কেবল তার বাবাকে ছাড়া।

#চলবে____________________

[ ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ]