প্রেয়সী পর্ব-৩৯

0
1060

#প্রেয়সী 🧡🥀
#moumita_mehra
#পর্বঃ৩৯

৭৬.

ভার্সিটির ক্যানটিনে যখন অজ্ঞান হয়ে নীচে পড়ে গেলাম তখন মনে হচ্ছিলো ওখানকার বেশিরভাগ মানুষই আমাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে। কেউ এগিয়ে আসছে না, অথচ দেখে দেখে মজা নিচ্ছে। তারা কে কি ভাবল জানা নেই। যখন চোখটা বুঁজে যাচ্ছিল তখন হয়ত হৈচৈ লেগেছিলো। কেশব হয়তো ছুটে পালিয়ে ছিলো। রাহিয়ানও যে কোথা থেকে ছুটে এলো জানা হলো না। যখন চোখ মেলে সবাইকে নির্লিপ্ত চোখে দেখছিলাম, তখন হঠাৎই আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ল রাই। ওর পেছনেই আরফান ভাই দাঁড়িয়ে। আমি চমকে উঠলাম ওর আচরনে। ওকে দু’হাতে ধরতে ধরতে আশেপাশে নজরে এলো বাড়ির সবাইকে। চাচা-চাচিও আছেন দেখছি। কি হচ্ছে কিছুই মাথায় ধারন করতে পারছিনা। রাই আমোদিত গলায় বলতে লাগল,

—-” কংগ্রাচুলেশনস সোনা।”

রাইয়ের কথায় অবাকের শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েও বিভ্রান্ত হলাম। আমার ডান পাশে বাড়ির ডক্টর আশফাক আলীও আছেন দেখছি। আমার দৃষ্টি সবাইকে ছাপিয়ে রাহিয়ানের পানে ছুটলো। গম্ভীর মুখে হাজ ভাজ করে ডক্টরের সাথে আলাপচারিতা করছেন উনি। আলাপচারিতার মধ্যমনি হয়তো আমিই! আমার দৃষ্টিকে সম্পূর্ন উপেক্ষা করে গেলেন তিনি। তাই ছোট্ট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খালামনি আর চাচির দিকে তাকালাম। দু’জনের মুখ জুড়েই তৃপ্তির হাসি! আমার ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকা দৃষ্টি তাদের তৃপ্তি বাড়ালো বৈ কমালো না। বউ মনি,রিম্মি আপু,ফাহিম ভাইয়া সবাই আনন্দে মিটমিট করে হাসছে। ফাহিম ভাইয়া হয়তো আমাকে একবার বুকে জড়িয়ে নেওয়ার অদম্য ইচ্ছেয় ছটফট করছে। ছটফট করছেন রাহিয়ানও কিন্তু খুশিতে নয় অজানা এক ভয়ে। ডক্টর প্রেসক্রিপশন তুলে রাহিয়ানের হাতে ধরিয়ে দিলেন। রাহিয়ান খুব সাবধানতার সহিত হাতে নিলো সেটা। ভাবলাম এবার হয়তো উনার গাম্ভীর্য মুখের পরিসমাপ্তি ঘটে হাসির রেখা ফুটে উঠবে। কিন্তু তার কিছুই হলো না। উনি ভুলক্রমেও আমায় দেখলেন না। ডক্টর ব্যাগ তুলে উঠ দাঁড়াতেই আরফান ভাই হাসি মুখে এগিয়ে এসে “আমাকে দিন” বলে ব্যাগটা নিজের হাতে তুলে নিলো। ডক্টর আরফান ভাইয়ের দিকে একবার কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফের আমার দিকে তাকালেন। আমার মাথা হাত রেখে বললেন,

—-” তোমার প্রেগন্যান্সির আড়াই মাস চলে! অনেকে খুব সহজেই ব্যাপারটা ধরতে পারলেও হাতে গোনা মাত্র কিছু সংখ্যক মানুষেরই একটু সময় লাগে। তোমার ক্ষেত্রেও তেমনই হয়েছে। নিজের প্রতি আরেকটু যত্নশীল হতে হবে। তোমার খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে কিন্তু সবার কমপ্লেন শুনলাম! বেবি কনসিভ করলে মাকে ভীষণ সচেতন হতে হয় বিশেষ করে নিজের যত্নের ব্যাপারে। যদিও বাড়ির সবাই তোমার প্রতি খুবই যত্নশীল তবুও ভয় তোমাকে নিয়ে। প্রেগন্যান্সির এই সময়টাতে কিন্তু খাবারের প্রতি অনিহা, খাবার থেকে গন্ধ লাগতেই বমি হওয়া এমন আরও কিছু সমস্যা হবে। তাতে তোমার শারীরিক কন্ডিশন একটু দুর্বল থাকবে। তাই বলে কিন্তু ভাবা যাবে না খাবার না খেলেই তো আর সমস্যা নেই! এটা ভাবলে তুমি ভুল করবে। বেবির যাতে কোনো রকম অসুবিধা না হয় তার জন্য তোমাকে খাবার-দাবারের প্রতি আরও সিরিয়াস হতে হবে! সম্ভব তো?”

ডক্টরের কথা গুলো শুনে যেন না চাইতেও আপনাআপনি আমার হাতটা পেটের উপর উঠে এলো। উনার থেকে আমার ড্যাবড্যাব চাহনি তুলে পেটের দিকে দৃষ্টি রাখলাম। আমার ভেতরে কারোর অংশ দিন দিন বেড়ে চলেছে আর আমি টেরই পায়নি! এটা কি করে সম্ভব?

—-” অবশ্যই সম্ভব। ও নিজে নিজের যত্ন না নিলেও বা কি আমরা তো আছি। ঠিকই ওর যত্ন করব। এই ক’টা দিন আর কোথাও বের হওয়া চলবেনা। যা করবে সব আমাদের চোখের সামনে থেকে করবে। বাইরে গেলে এমনিতেই তুমি খাওয়া দাওয়া সব মাথায় তুলো। আর এই সময় এমন কিছু হলে মাও ঝুঁকিতে থাকবে বাচ্চাও ঝুঁকিতে থাকবে।”

খালামনির কথায় ভরসা পেলেন ডক্টর। মুচকি হেসে আমার মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে চলে গেলেন। উনার পেছন পেছন গেলেন রাহিয়ান আর আরফান ভাই। তারা বের হতেই সবাই যেন লাফিয়ে পড়ল আমার উপর। ফাহিম ভাইয়া আনন্দে আত্মহারা হয়ে আমায় ঠিক আধাঘন্টাই বুকে আগল রাখল। রিম্মি আপু,বউ মনি,রাই তারাও কিছু কম যায়না। সবার আনন্দে আমার মনটাও যেন ভরে গেলো। ইশশ, বাড়িতে কোনো বাচ্চার আগমনের বার্তায় বুঝি এতো আনন্দ হয়।

—-” আমার সংসারটা আজ পরিপূর্ণ করলি রে মা। আজ তুই আমাদের যে কতটা আনন্দ তা দিলি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।”

খালামনির ছলছল করা চোখ থেকে টুপ করে গড়িয়ে দু’ফোটা জল পড়তেই হাতের পিঠে মুছে ফেলল তৎক্ষনাৎ। আনন্দের জল মাটিতে পড়তে নেই। হাতের মুঠোয়ই থাক। আমি দুর্বল চাহনি দিয়ে ছোট্ট করে হাসলাম। সময়টা খুব আনন্দের হলেও যেন হঠাৎ মেনে নিতে পারছিনা আমি! কেশবের ভাস্যমতে রাহিয়ান প্রমান করতে ব্যর্থ হলে আমি উনার থেকে পর হয়ে যাবো। আমরা দু’জন আলাদা হয়ে গেলে আমাদের সন্তানের কি হবে? যখন সবাই জানতে পারবে আমাদের ভাঙ্গন নিশ্চিত তখন আমাদের অনাগত বাচ্চার জন্য তাদের যে এই আনন্দ সেটা কি তখনও থাকবে? নাকি কোনো এক ঝড়ো হাওয়ায় ধুলোর সাথে মিলিয়ে যাবে তাদের এই আনন্দ, উল্লাস। তখন যে ওর কপালে জুটবে সবার অবহেলা! আজ যেখানে সবার চোখে খুশির ঝলমলে আলো সেদিনতো থাকবে কেবল ক্ষোভ আর হিংস্রতায়ে ঘেরা অন্ধকার! সেটা আমি কি করে মেনে নিবো? কি করে মেনে নিবো আমার সন্তানের প্রতি সবার অবহেলা,অনাচার, ক্ষোভ আর হিংস্রতা? তবে কি ওর পৃথিবীতে পদার্পণ ঘটার আগে ওর শেষ চিহ্ন নিশ্চিহ্ন করে দেওয়াটাই উত্তম হবে?পৃথিবীর এই জঘন্য পরিবেশে আসার আগেই ও চলে যাক বাবার কাছে। সেখানে তো মা-ও আছে। আমার বাবা-মা নিশ্চয়ই আমার সন্তানকে অবহেলা করতে পারবেনা! ও নিধির সন্তান জানলেই তো একদম আকড়ে ধরে রাখবে তারা। হ্যাঁ তবে তাই হবে। আমিও রাখব না তোকে। এই পৃথিবীতে এনে তোকে কিছুতেই অনিশ্চয়তার মাঝে ফেলে তোর জীবনটা আমি নষ্ট করতে পারব না। যদি তুই কখনও আমার দিকে আঙ্গুল তুলে প্রশ্ন করিস, “এতো অনিশ্চয়তা,একাকিত্বতা আর বিষন্নতার মাঝে আমাকে কেন একা ফেলে চলে গেলে?” তখন আমি কি জবার দেবো ওকে? কোনো জবাব নেই তো আমার কাছে! আর আমার কোনো অধিকারও নেই একটা মানুষকে এভাবে কষ্ট দেওয়ার। বেটার হোক তুই আসবিই না এই দুনিয়াতে। আমি এব্রেশন করে ফেলব! হ্যাঁ তাই করবো।

—-” কিরে কি ভাবছিস এতো?”

রাইয়ের হাতে ধাক্কা লাগতেই হকচকিয়ে তাকালাম আমি। সব মুখগুলো প্রশ্ন সুচক হয়ে আমাকেই দেখছে! আমার ভাবনার তাল ঘেঁটে যেতেই আমি বোবা চোখে সবার দৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম।

খালামনি বলল,

—-” এই হয়েছে, অনেক হয়েছে মেয়েটাকে নিয়ে দলাইমলাই করা। এবার ওকে একা ছাড়তো। ও একটু রেস্ট নিক। এই আদ্রিতা?”

খালামনির ডাকে রিম্মি আপুকে পাশ কাটিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো বউমনি। বলল,

—-” হ্যাঁ কাকিয়া বলো?”

—-” বলছি কি রে মা, ওকে একটু ফ্রেশ হতে হেল্প কর! আমি বরং ওর জন্য হাল্কা কিছু খাবার পাঠিয়ে দেই। তুই একটু কষ্ট করে খাইয়ে দিস মা।”

—-” হ্যাঁ হ্যাঁ আমি সব করে দিচ্ছি তুমি একদম চিন্তা করো।”( মাথা নেড়ে)

—-” আ,,বার এখনি খেতে হবে? একটু পরে খাইনা প্লিজ!”

আমার বানী কারোর মোটে পছন্দ হলো না। সবাই চোখ পাকিয়ে আমার দিকে তাকালো। খালামনি রাগি গলায় বলল,

—-” আবার শুরু হয়ে গেলো বাহানা? যা পাঠাবো লক্ষি মেয়ের মতো খেয়ে নিবে! বেয়ান, বেয়াই আপনারা আমার সাথে আসুন। আপনারা সেই কখন এলেন আপনাদের কিছু খেতেও দিলাম না! এই রিম্মি, ফাহিম তোরাও আয়। আমায় হাতে হাতে হেল্প করে দিবি।”

খালামনি সবাইকে নিয়ে চলে গেলো। বাকি রইলাম আমরা তিনজন। বউমনি উঠে আলমারি খুলে ড্রেস বের করে আনল। রাই আমাকে উঠে বসতে সাহায্য করলো। আমি বসতে বসতে বললাম,

—-” বউমনি তোমাদের কষ্ট করতে হবেনা প্লিজ! দেখো আমি একাই পারব সবটা করতে।”

বউমনি বুঝি গায়ে লাগালো না আমার কথা। ওয়াসরুমে গিয়ে আমার ড্রেস গুলো রেখে বের হয়ে এলো। আমার পাশে এসে বসতে বসতে বলল,

—-” কোনো বিষয় নিয়ে আপসেট? সেই তখন থেকে দেখছি মুখে এক ফোঁটাও হাসি নেই!”

বউমনির কথার সুর টেনে রাই বলে উঠলো,

—-” ঠিক বলেছো বউমনি। হ্যাঁ রে নিধু? কিছু নিয়ে ভাবছিস নাকি? কি হয়েছে সোনা? বেবি আসার খবরে কি তুই খুশি নস?”

বুকের ভেতর ছ্যাঁত করে উঠল। কেঁপে উঠলাম আকস্মিক! অসহায় কন্ঠে বললাম,

—-” সন্তান আসার খবরে কোন মা কি কখনও অখুশি হতে পারে?”

রাই মলিন হাসল। আমার গালে হাত রেখে বলল,

—-” সরি রে! আমি কিন্তু কথাটা ওভাবে বলতে চাইনি!”

—-” আচ্ছা তোরা এতো খুশি কেন বলতো?”

আমার প্রশ্নে রাই ফিক করে হেসে দিলো। বউমনির দিকে ফিরে বলল,

—-” বউমনি, শুনো মেয়ের কথা। আমাদের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার কোল আলো করে কেউ আসতে চলেছে। আর সেই খবরে আমরা নাকি খুশি হবো না? এও কি সম্ভব?”

বউমনিও হাসল। ওদের দু’জনের হাসি দেখে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে এই হাসির পেছনেই লুকিয়ে আছে একরাশ ঘৃনা। এক সমুদ্র অবহেলা। সবটাই আমার সন্তানের জন্য! সবটাই ঐ নিষ্পাপ বাচ্চাটার জন্য।

৭৭.

রাত ১০টা। বিছানায় গা লাগিয়ে শুইয়ে ছিলাম। হঠাৎই গা গুলিয়ে উঠল। মাথাটা ভনভন করে ঘুরতে আরম্ভ করল। লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে দৌড়ে গেলাম ওয়াসরুমে। ভেতরে পা রাখতে না রাখতেই দুনিয়া আঁধার করে বমি শুরু হয়ে গেলো। উনি কোথায় ছিলেন জানিনা। আকস্মিক পেছনে থেকে এসে ধরলেন আমায়। দু’হাত দিয়ে মাথার এপাশ ওপাশ চেপে ধরলেন বমি থামানোর জন্য। কিন্তু বমি থামলো না। যতটুকু হওয়ার প্রয়োজন ছিলো হয়ে গিয়েছে! শরীরে আর কুলচ্ছে না যেন। বমি করেও শান্তি নেই। হাত-পা শীতল হয়ে যাচ্ছে ক্রমশো। পাশে উনাকে আবিষ্কার করতে কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করল। কিন্তু যখনই ভাবি মানুষটার সঙ্গে দু’টো কথা বলব তখনই মনে পড়ে কেশবের কথা গুলো। উনি আমার মনের বার্তা বুঝে নিলেন কি না জানিনা! আমায় দুই হাতে শক্ত করে আগলে ধরলেন। যেন বৈশাখী ঝড়ো হাওয়াতেও এই বাঁধন ছুটবে না। উনি আমার চাহনিকে এড়িয়ে গিয়ে পাঁজা কোলে তুলে নিলেন আমায়। বিছানা অব্দি আসতে আসতে উনার থেকে এক মিনিটের জন্যও চোখ সরেনি আমার। যখন বিছানায় শুইয়ে দিয়ে উঠে যাচ্ছিলেন আমিও কি ভেবে উনার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলাম। উনি কিছু বললেন না। ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা টানলেন। পাশের টেবিলে উনার অফিসের কাগজ পত্রের দিকে ইশারা করে বললেন,

—-” আর একটু কাজ আছে!”

আমি অভিমানী সুরে বললাম,

—-” আমায় রেখে কাজ বেশি ইম্পরট্যান্ট হলো?”

—-” প্রশ্নই আসেনা এমন কিছুর। হিমাদ্র ভাইকে এই ফাইলটা আর দশ মিনিটের মধ্যে সেন্ড করতে হবে। ঐদিকে ক্লায়েন্টরা বসে আছে এই প্রজেক্টের জন্য। তাই একটু তাড়াহুড়ো করছিলাম। কাজটা শেষ করতে পাঁচ মিনিটও লাগবেনা তাই ভাবলাম সেরে এসে একবারেই তোমার পাশে বসি। কিন্তু এখন আর সেটাও ইচ্ছে করছেনা। আমি ফাহিমকে বলে ভাইয়ার রুমে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ভাইয়া করে নিবে।”

আমি হাত ছেড়ে দিলাম উনার। অভিমান চেপে সাফ গলায় বললাম,

—-” কাজটা কমপ্লিট করে নিন।”

উনি মানলেন না। ঘুরে এসে আমার পাশে শুইয়ে পড়লেন। পাশ ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে এক হাত দিয়ে কাছে টেনে নিলেন আমায়। গালে নাক ঘষে বললেন,

—-” তুমি আড়াই মাসের প্রেগন্যান্ট অথচ বুঝতেই পারলেনা। ব্যাপারটা কিরকম অদ্ভুত লাগছেনা বলো?”

—-” অদ্ভুত লাগবে কেন? আজকাল বড় বড় ভয়ংকর ব্যাপারও স্বাভাবিক ভাবে সামনে এসে দাড়াচ্ছে! এ আর এমন কি?”

—-” আর কিছুদিন পেরোতেই আমরা প্যারেন্টস্ হয়ে যাবো। ভাবতেই কেমন ভয়ংকর অনুভূতি হচ্ছে! মনে হচ্ছে না এই তো সেদিনই আমি প্রথম দেখলাম তোমায়। হাতে গোনা দু’দিন হলো! আর তারপর টানা দু’টো বছর পাগলের মতো খুঁজলাম তোমায়। অতঃপর পেয়েও গেলাম। দেন, কয়টা দিন লুকিয়ে ভালোবাসলাম তোমায়। আর তারপর বিয়ে। সবটা কেমন একসাথে মিলিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না?”

—-” হু।”

—-” আর আজকে বিশেষ খবর হলো সেই পুঁচকে মেয়েটা প্রেগন্যান্ট। আমার বাচ্চার মা হতে যাচ্ছে সে। আর আমি তার বাচ্চার বাবা হবো।”

—-” কেশবের সাথে এমন একটা ডিল কেন করলেন?”

প্রশ্নটা আমার মতে ভীষণ ভয়ংকর! হয়তো উনার জায়গায় অন্যকেউ হলে এতক্ষণে অনেক রিয়াকশন লেনদেন হয়ে যেতো। কিন্তু উনি শান্ত। তাই আমিও নির্বিকার। উনি আমার প্রশ্নের সঠিক জবাব না দিয়ে অন্য প্রসঙ্গ টানলেন। উনার হাতটা আলতো করে আমার পেটের উপর রেখে বললেন,

—-” তোমার ছেলে পছন্দ নাকি মেয়ে?”

—-” বাবা খুন হয়েছে কেশবের হাতে অথচ আপনি আমাকে কখনো জানানোরই প্রয়োজন মনে করলেন না!”

—-” জানানোর কিছু ছিলো না! হয়তো তোমার কষ্টটা আরও দু’গুন বেশি হতো। বাবার খুনিকে খুঁজে বের করার জন্য তুমি হয়রান হয়ে থাকতে, বলতে গেলে তুমি পাগলই হয়ে যেতে তাই তোমায় কিছু জানাইনি!”

—-” তো আপনার কি মনে হচ্ছে আজ আমি ভীষণ ভালো আছি? আজ আমার মোটেও কষ্ট হচ্ছে না?”

—-” কেশব তোমায় কেন এসব কথা নিজের থেকে জানিয়েছে বলোতো?”

—-” জানিনা! আর জানতেও চাই না! শুধু এটুকু জানি আপনার জন্য আমার সন্তানের ভবিষ্যত অন্ধকারে ঢেকে যাবে। ওর জীবনটা শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যাবে। ওর বর্তমান,ভবিষ্যত সবটা লন্ডভন্ড হয়ে যাবে আর এ-সব কিছু হওয়ার পেছনে একমাত্র দায়ী থাকবেন আপনি।”

—-” ভুল বুঝছো?”

—-” এতোদিন হয়তো ভুলই বুঝেছি আপনাকে! আজ হয়তো ঠিক বুঝতে পারছি! আপনি বাবার খুনের কোনো প্রমান দিতে না পারলে আপনি আমায় কেশবের কাছে পাঠিয়ে দিবেন? আমার ভাবতেই ঘৃনা হচ্ছে নিজের উপর! আজকাল আমায় নিয়ে আমার স্বামী ডিলও করে আসে। তাও এমন একজন মানুষের সাথে যে কি না আমার বাবার খুনি!”

আমায় ছেড়ে উঠে বসলেন উনি। আমার একেকটা অপবাদ মুখ বুঝে মেনে নিলেন স্রেফ। জবাবে কিছুই বললেন না! তার মানে কি দাঁড়ায়? আমার দেয়া অপবাদ গুলো একটাও ভুল নয়! সবই ঠিক। যা ঘটেছে সবটাই ঠিক। ঘৃনায় উনার মুখটাও দেখতে ইচ্ছে করলো না। কান্না গুলো গলার কাছে এমন ভাবে দলা পাকাতে লাগল যে ইচ্ছে করছে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদি! কেন মানুষটা আমায় এভাবে পর করে দিতে রাজি হলো! কেন হলো? তবে কি উনার জীবনে আমার আর কোনো মূল্য নেই! সবটা শেষ হয়ে গেলো? পর হয়ে গেলাম আমি? তবে কি আমাদের সন্তানও মূল্যহীন? উনার চুপ করে থাকা যে মেনে নিতে পারছিনা আমি! কান্না চেপে বসেতেই পাশে ফিরে গেলাম। দুহাতে মুখটা চেপে ধরেই গিলতে লাগলাম কান্না গুলো। কেন উনি কিছু বলছেন না? কেন জোর দিয়ে বলছেন না, নীলাদ্রিতা? কেশব যা বলেছে সবটা মিথ্যে! সবটা বানোয়াট। আমার প্রিয় মানুষটাকে নিয়ে আমি কিভাবে ডিল করতে পারি বলো? এই মানুষটার মাঝেই তো আমার প্রাণভোমরা থাকে। কি করে পারি তোমায় অন্যকারোর হাতে তুলে দিতে? এমন কথা তুমি ভাবলেই বা কি করে?

উনি কিছুই বলছেন না! উনার চুপ থাকাই যে বলে দিচ্ছে কেশবের একেকটা সিঙ্গেল ওয়ার্ডও সত্যি। সব সত্যি!

#চলবে____________________