প্রেয়সী পর্ব-৪১ এবং শেষ পর্ব

0
1323

#প্রেয়সী ♥️🥀
#moumita_mehra
#পর্বঃ৪১ (অন্তিম পর্ব)

৮০.

—-” আঙ্কেল সম্পূর্ণ সুস্থই ছিলেন বলা যায়। মান সম্পন্ন ভালো ট্রিটমেন্টে আঙ্কেলের হার্ট অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছিলো। সেরকমই জানিয়েছিলো হিমাদ্র ভাই। যেদিন আঙ্কেলকে নিয়ে দেশে ফেরার কথা সেদিন পাবলিক ফ্লাইট ধরেই আসছিলো সবাই। তবে ডক্টর, আঙ্কেলকে আর কয়েকটা দিন অবজারভেশনে রাখার কথা বলাতে আঙ্কেল সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছিলো, রেস্ট নেওয়ার হলে এবার সে তার মেয়ের কাছে এসেই নিবে। মা-বাবা বা মেঝমনি কেউ আর বারন করল না আঙ্কেল কে। কারন তারাও বুঝেছিলো আঙ্কেলের ছোট্ট প্রাণভোমরাটা থেকে আর আলাদা রাখা উচিত হবেনা। তাই তারা আলাদা ভাবে ডক্টরের থেকে পারমিশন নিয়ে পেপার সাইন করে হসপিটাল থেকে ডিরেক্ট ফ্লাইট ধরে। সেদিন সেই ফ্ল্যাইটে কেশব তার কিছু লোক ঠিক করে। ওর প্ল্যান মাফিক তোমার বাবাকে আগে থেকেই ওর হাতের মুঠোয় রাখার একটা ছোট্ট প্রচেষ্টা। ওর লোকেরা মিলে আঙ্কেলকে সামান্য টাইট দিতে চেয়েছিলো আর কি। যেন, দেশে পা রাখতেই আঙ্কেল তোমার জন্য কেশবকে পছন্দ করে বিয়ের পর্ব সেরে ফেলে। ওদের বাড়ি থেকে আমরা আসার পর ও বুঝতে পেরেছিলো, তোমার প্রতি আমার দুর্বলতা। তাই ও তখনই আমার সাথে তোমার ব্যাপারে কথা বলতে আসে। আমাদের দু’জনের মনেই তুমি ছিলে। তবে আমাদের ভালোবাসার ধরন ভিন্ন ছিলো। আমি তোমায় চেয়েছিলাম পবিত্রতার সাথে আর কেশব চেয়েছিলো তোমায় জিততে। ওর কাছে ব্যাপারটা নিতান্তই হারজিতের খেলা ছিলো। খেলার নেশায় মত্ত হয়েই ও তোমাকেও আর পাঁচ টা মেয়ের মতো ভেবেছিলো। ওর জীবনের প্রায় অর্ধেকটা সময়ই ও দেশের বাইরে কাটিয়েছে! বিধায়, টাকার কাছে মেয়েরা স্ব-ইচ্ছায় নিজেদের ইজ্জত বিলিয়ে দিতে আসত৷ কিন্তু ওর ধারনায় ছিলো না যে, বাঙালি মেয়েরা নিজেদের ইজ্জতটা খুব কঠিন ভাবে আঁকড়ে ধরতে জানে। তাই কেশব খেলার গুটি অন্যভাবে সাজাতে চেয়েছিলো! তবে হয়তো কেশবেরও ভাবনায় ছিলো না আঙ্কেলের শেষ যাত্রা ঐটুকুই হবে।”

এটুকু বলেই থামলেন রাহিয়ান। গলাটা শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো উনার। শুঁকনো গলাতেই ঢোক গিললেন বার কয়েক। চোখ জোড়া বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অতঃপর আবারও আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলতে লাগলেন,

—-” ফ্ল্যাইটে আঙ্কেলের জন্য আলাদা কেবিন বুক করা হয়েছিলো। বাসা থেকে এয়ারপোর্ট অব্দি জার্নি করার জন্য আঙ্কেলের অক্সিজেন প্রবলেম হচ্ছিল তাই ডক্টরের সাথে পরামর্শ করেই ভেতরে আঙ্কেলকে কয়েক ঘন্টার জন্য অবজারভেশনে রেখে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছিলো। যখন তাকে কিছুক্ষণের জন্য একা রাখা হয় তখনই কেশবের লোকেরা আঙ্কেলের কেবিনে যায়। ওরা আঙ্কেলের শারীরিক কন্ডিশন নিয়ে বেশি মাথাব্যথা না দেখিয়ে উল্টে আঙ্কেলের উপর হামলে পরে। তার মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্ক খুলে ফেলতেই আঙ্কেলের হার্ট মিসিং হচ্ছিল আর যখন ওরা তোমার ব্যাপারে কথা বলতে শুরু করল, লাইক “আপনি আপনার মেয়েকে কেশবের সাথে বিয়ে দিবেন অন্যথা তার লাশও কেউ খুঁজে পাবেনা। আপনাকেও আর খুঁজে পাওয়া যাবেনা। আপনার মেয়েকে শেয়াল,শকুনে খাবলে খাবে” এমন টাইপ কথা গুলো যখন উনাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলা হচ্ছিলো উনি নিতে পারেননি। একে তো উনার মুখ থেকে আগেই অক্সিজেন খুলে ফেলা হয় আর তার উপর এসব কথায় আঙ্কেলের প্রচন্ড বুকে ব্যাথা শুরু হয়ে যায়। আর তারপর সবটা ওখানেই শেষ হয়ে গেলো! আঙ্কেলকে আর নিঃশ্বাস নিতে না দেখে ওরাও ঘাবড়ে গেলো। ভয়ে একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাচ্ছিলো! কি বলবে ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলো! ওরা আঙ্কেলের মুখে মাস্কটা ঠেসে দিয়ে তৎক্ষনাৎ প্রস্থান করে ওখান থেকে। ওদিকে বাবা-মা, মেঝমনি,হিমাদ্র ভাই ওরা কেউ বুঝতেই পারলো না এদিকে ভেতরে কি হয়ে গেলো! ফ্ল্যাইট থেকে নামার সময় তারাও শুনতে পায় ‘হি ইজ নো মোর’।”

বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো। শরীরের ভার নিয়ে বেসামাল হয়ে উঠে বসলাম। উনার দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,

—-” আপনি এতোকিছু জানেন অথচ আমাকে কিছুই বললেন না? বরং কেশবের আসল মুখোশ সবার সামনে আনবেন বলে আমার থেকে দূরত্ব করে ফেললেন!”

উনি ঢোক গিলে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমার দু’গালে হাত রেখে অসহায় কন্ঠে বললেন,

—-” হ্যাঁ, এটা সত্যি যে আমি সবটাই জানতাম! কিন্তু আমার কাছে এর কোনো কিছুরই প্রমান ছিলো না! তবে, আজ আমার কাছে সব কিছুর প্রমান আছে। তাই আজ তোমার সামনে মুখ খোলার সাহস পেয়েছি নিধি। সেদিন যদি এতোকিছু বলতাম তাহলে তুমি আরও এক দফা ভুল বুঝতে আমায়। প্রমান চাইতে! কিন্তু তখন আমি কি করে এর প্রমান দিতাম বলো? তার তিনমাস আগে যখন সব কিছুর প্রমান আমি হাতেনাতে পেলাম তখন কেশব ওর বউকে অস্ত্র হিসেবে কাজে লাগাতপ শুরু করলো। মেয়েটাকে দিয়ে ও যা খুশি করিয়েছে। নিজেকে প্রটেক্ট করার জন্য ও ঐ অসহায় মেয়েটাকেও ছাড়েনি। তাই কেশবের হাত থেকে ঐ মেয়েটাকে বাঁচিয়ে বের করতে আরও তিনটা মাস এভাবেই কেটে গেলো। কিন্তু আজ আর কোনো ভয় নেই। আজ মেয়েটাও সেইফ আর কেশবও ওর উপযুক্ত শাস্তি পাচ্ছে। ওকে তিনদিনের রিমান্ডে দেওয়া হয়েছে। এবার আইন ওকে শাস্তি দিবে নিধি! তোমার থেকে তোমার বাবাকে কেঁড়ে নেওয়ার শাস্তি দিবে। শাস্তি তো ওকে পেতেই হতো। কেবল সময়ের অপেক্ষা ছিলো।”

আমি পারলাম না আর সামলে থাকতে। হু হু করে কেঁদে উঠে ঝাপটে ধরলাম উনাকে। আজ বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো আমার দিনগুলো আরেকটু ভালো কাটত। বাবা না থাকার শূন্যতা হয়তো কখনও পূরন হওয়ার নয়! তাই না?

আকষ্মিক পেটের ভেতর অসহ্যরকম ব্যাথা শুরু হতেই কুঁকড়ে গেলাম উনাকে জড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই। উনি চমকে উঠলেন। আমাকে টেনে তোলার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে অস্থির গলায় বলে উঠলেন,

—-” নিধি কি হয়েছে? পেইন হচ্ছে?”

আমি যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলাম। উনাকে বারবার খামচে ধরতে লাগলাম। আমার নখের আচরে উনার বুক পিঠ চিঁড়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। উনিও আঘাত পাচ্ছেন বুঝতে পারছি কিন্তু নিজেকে কোনো ভাবেই যেন সামলাতে পারছিনা। না চাইতেও শুধু আর্তনাদ করতে লাগলাম। বিকট আওয়াজে চিৎকার করতে লাগলাম। সমস্ত শরীর খিঁচে যাচ্ছে বারবার। উনি উপায় অন্তর না দেখে আমায় জড়িয়ে রেখেই শুইয়ে দিলেন। বিছানায় শরীর লেগে পড়তেই ছেড়ে দিলাম উনাকে। উনি হাফ ছেড়ে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়লেন। গলা উঁচিয়ে খালামনি-খালুকে ডাকতে লাগলেন! আজ বাড়িতে উনি আর আমি ছাড়া বাকিরা কেউ নেই! উনি হয়তো টেনশনে ভুলে গিয়েছেন। আমিও ব্যাথার কাছে হার মেনে উনাকে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে পারলাম না। বিছানার চাঁদর আঁকড়ে ধরে চিৎকার করতে লাগলাম স্রেফ। এতোটা করুন অবস্থা সৃষ্টি হলো যে, মনে মনে আল্লাহকে ডেকে বলতে লাগলাম ‘আমি আর সহ্য করতে পারছিনা প্রভু, আমাকে এর থেকে মুক্তি দাও!’

উনি পাগলের মতো ছোটাছুটি করতে লাগলেন। বাড়ির সবাইকে ডাকছেন কেবল! অতঃপর যখন উনার মনে হলো বাড়িতে কেউ নেই উনি শুধু একটা শব্দ করলেন, ‘হে প্রভু! সহায় হও!’

আমায় পাঁজা কোলে তুলে সিঁড়ি ভেঙে নেমে এলেন নিচে। পুরো বাড়ি খা খা করছিলো নিরবতায়। আর এখন আমার চিৎকারের প্রতিধ্বনিতে আরও ভয়ংকর লাগছে চারিপাশ। উনি আমাকে গাড়ির পেছনের সিটে শুইয়ে দিলেন। গাড়ির দরজা কোনো রকম লাগিয়ে দৌড়ে গিয়ে বসলেন ড্রাইভিং সিটে। কোনো রকম সিটবেল্ট পড়ে গাড়ি চালিয়ে ছুটলেন হসপিটালের উদ্দেশ্যে। ভয়ে মানুষটার গলা জড়িয়ে ভেঙে এসেছে প্রায়। গাড়ি চালানোর ফাঁকে ফাঁকে কেবল বলেতেই থাকলেন,

—-” খুব কষ্ট হচ্ছে? আরেকটু সহ্য করে থাকো প্লিজ! এইতো হসপিটালে এসে গিয়েছি। আর একটু সময়!”

আমি পারলাম না কষ্ট করে সহ্য করতে। আমার ভেতরটা নিগড়ে নিচ্ছে যন্ত্রনায়। শুধু কাতর কন্ঠে আর্তনাদ করে গেলাম পুরোটা সময়। আর মনে মনে আল্লাহকে বলছিলাম, ‘সহায় হও প্রভু! সহায় হও।’

কয়েক মুহুর্তের জন্য ভেবে ফেলেছিলাম এই বুঝি আমার শেষ সময়! কিন্তু না! এবারও আমার শেষ সময় এলো না। এ যাত্রাও উপর ওয়ালার উছিলায় বেঁচে গেলাম। ডক্টরটা স্ট্রেচারে করে যখন আমায় অটিতে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন উনি আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বললেন,

—-” আমার সন্তান চাই না নিধি! যে তোমায় এতোটা কষ্ট দেয় সে নিশ্চয়ই তোমার জন্য মঙ্গলকর নয়! আমার শুধু তোমাকে চাই।”

আমি আহত গলায় বললাম,

—-” যাকে ৮ মাস ২৩ দিন গর্ভে রেখেছি তাকে এতো সহজে কি করে হারিয়ে যেতে দেই বলুন? তাকেও যে এই আপনার মতোই খুব বেশি প্রয়োজন!”

উনি জড়ানো গলায় বললেন,

—-” একবার আসুক সে! খুব করে বকব তখন। কেন মাকে এতো যন্ত্রনা দিলো?”

আমি চোখ জোড়া বন্ধ করে নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,

—-” মনে হচ্ছে না আমি বাঁচব!”

উনি আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালেন আমার কপালে। গালে হাত রেখে বললেন,

—-” কিচ্ছু হবে না তোমার। আমি বাইরে এখানটায় তোমাদের অপেক্ষা করছি। জলদি ফিরে এসো।”

আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ডক্টর আর নার্সরা মিলে স্ট্রেচারে টেনে অটিতে প্রবেশ করলেন। ঠান্ডা এসি প্রবাহিত এমন জায়গায় নিজেকে আবিষ্কার করে মা’য়ের কথা ভীষণ মনে পড়ে গেলো। আমাকে জন্ম দিতে গিয়েই যে মা হারিয়ে গিয়েছিল। আমার সাথেও এমন কিছু ঘটবে না তো?

৮১.

কানের পাশে একাধারে বাচ্চার কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো আমার। ক্লান্ত শরীরের ভার নিয়ে শুইয়ে আছি হসপিটালের বেডে। পাশেই ছোট্ট দোলনাটার ভেতর থেকে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। নিজেকে সবল বলে দাবি করতে পারছিনা! প্রচন্ড দুর্বল লাগছে শরীরটা। ঘাড় ফিরিয়ে যে তাকে একটা-বার দেখবো তারও উপায় নেই। বাবুটা পৃথিবীর আলো দেখতে দেখতে আমিও চোখ বুঁজে নিয়েছিলাম। আমি অজ্ঞান আছি বোধকরি ঘন্টা পাঁচেক হলো! চারপাশের আবহাওয়া বলছে এখন গভীর রাত। বাবু কাঁদতে কাঁদতে থেমে গেলো এক পর্যায়ে। তখনও ঘাড় ফিরিয়ে দেখতে পারলাম না। তবে বাবুর পাশেই রাহিয়ানের অস্তিত্ব ঠিক আবিষ্কার করে ফেললাম। তার পায়ের শব্দ ক্রমশ কাছে আসছে আমার।

—-” আমাদের ছেলে হয়ে হয়েছে নিধি। দেখো, দেখতে ঠিক আঙ্কেলের মতো হয়েছে।”

আমি ক্লান্ত মুখে মৃদু হাসলাম। দুর্বল চাহনিতে বাবা ছেলেকে একবার দেখে নিয়ে বললাম,

—-” প্রভু আমার প্রার্থনা শুনেছেন তবে?”

উনিও হাসলেন ছোট্ট করে। কিছু বলতে নিলেই বাবু আবারও কেঁদে উঠল। উনি চমকে উঠলেন। গাল ফুলিয়ে বললেন,

—-” পাপার কোলে কি একটুও থাকা যায় না হু? মায়ের কাছে যাওয়ার এতো তাড়া!”

আশ্চর্যজনক ভাবে ও আরও চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগল। পাশেই দু’জন নার্স দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারা হাসতে হাসতে বললেন,

—-” ওর কিন্তু ভীষণ তাড়া মাকে কাছে পাওয়ার। দিন আমি শুইয়ে দিচ্ছি ওকে ওর মায়ের পাশে।”

উনি নার্সের কথা শুনে কিছুক্ষন ওর দিকে গাল ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু সে তার কান্না এক বিন্দুও কমালো না। বরং আরও বাড়িয়ে যাচ্ছে। আমি মুচকি হাসলাম। নার্স এসে ওকে শুইয়ে দিলো আমার পাশে। আমার পাশেই শুতেই তারও কান্নার ইতি ঘটল আর আমার শারিরীক দুর্বলতাও যেন অর্ধেকটা উধাও হয়ে গেলো। অবাক হয়েছি আমরা প্রত্যেকেই। বাবুও আর কাঁদছে না। রাহিয়ান তার কান্ড দেখে হতবিহ্বল হয়ে বলল,

—-” দেখেছ কত পাকা হয়েছে। এখনই পাপার সাথে অভিনয় করছে! ও গড! একবার বাড়িতে চলো তারপর হচ্ছে তোমার।”

আমি হেসে ফেললাম। হেসে উঠলো নার্স দুজনও।

তাদের মধ্যে একজন বললেন,

—-” বাচ্চাকে একটু খাওয়ানো প্রয়োজন। আর ম্যাম আপনার নিজেরও কিছু খেতে হবে। কিছু মেডিসিন আছে। স্যার, এই মেডিসিন গুলো কাইন্ডলি নীচ থেকে একটু আনিয়ে দিবেন।”

নার্স রাহিয়ানের হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিতে রাহিয়ান মাথা নেড়ে বললেন,

—-” ওকে ওকে। আমি নিয়ে আসছি। নিধি, তুমি ওকে খাওয়ায়। আমি যাচ্ছি আর আসছি।”

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। উনি কেবিন থেকে বের হতে নিলেই হুড়মুড় করে ঢুকে এলো আমাদের হল্লাপাটি। ফাহিম ভাইয়া, রিম্মি আপু, আসিফ ভাইয়া, রাই, নিতু আপু, হিমেল ভাই, আরফান ভাই, চাচা-চাচি, খালামনিরা সবাই। তাদের আগমনে গমগম করে উঠল পুরো কেবিন। আমি ঠোঁটের কোনে তৃপ্তির হাসি দিয়ে তাকালাম সবার পানে। খুশিতে ঝলমলে করছে সবার উজ্জ্বল চোখ। আনন্দে আত্নহারা প্রত্যেকেই হামলে পড়ল আমাদের মা-ছেলের উপর। ছেলেকে নিয়ে টানাটানি লেগে গেলো সবার মধ্যে। রাহিয়ান সবার অবস্থা দেখে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল। তার ভয় হচ্ছে কখন কে ফেলে দেয় ওকে। তাই মেকি রাগ দেখিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো সে,

—-” আরে ভাই আস্তে ধরনা! ব্যথা পাবে তো! এই রিম্মি ছাড় ওকে। আমাকে দে, তুই এভাবে কেন ধরছিস! মা….(চেঁচিয়ে) প্লিজ ওদের বারন করো না। বাবু কিন্তু পরে যাবে মা!”

খালামনি হেসে উঠলো শব্দ করে। সাথে হাসতে লাগল বাকি সবাই। কিছুক্ষনের জন্য ক্ষান্ত হলেও আবারও হৈ হুল্লোড় লেগে গেলো বাবু কে নিয়ে।

—-” আচ্ছা বাবুর নাম কি রাখা হবে?”

প্রশ্নটা হলো রাইয়ের। রাইয়ের প্রশ্নে বাবুকে নিয়ে সবার গবেষণা কয়েক সেকেন্ডের জন্য থেমে গেলো।

—-” এতো ভাবার কি আছে গাইস? আমাদের সবার প্রিয় রাজপুত্রের নাম হবে রেজওয়ান তানিম। নাম তো আমি আগেই ভেবে রেখেছিলাম। ছেলে হলে, এই নাম আর মেয়ে হলে, অন্য নাম। সেটাও অবশ্য ঠিক করা আছে। পরের বার যখন নিধি আবার মা হবে, মানে মেয়ের মা হবে তখন না হয় ঐ নামটা রাখা যাবে। আপাতত আমরা তানিমকে নিয়ে মজা করি?”

ফাহিম ভাইয়ার দেওয়া নামে সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ও নাম কবে ঠিক করল কেউই জানে না। বা ভাইয়া কাউকেই জানালো না। যদিও সেই রাগ আর কেউ পুষে রাখল না। আবারও হুল্লোড় লেগে গেলো। আমাদের একমাত্র ছেলের নাম এটাই ঠিক হলো “রেজওয়ান তানিম”।

রাহিয়ান মেডিসিন আনার কথা ভুলে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে সবার উৎফুল্লতা দেখছে। আরফান ভাই এগিয়ে গেলেন তার দিকে। বললেন,

—-” কিরে হ্যাং মারলি কেন এখানে? কোথাও যাচ্ছিলিস?”

—-” দেখনা, ওরা কেমন করছে তানিমকে নিয়ে। একটু বলনা আস্তে ধরতে! ব্যথা পাবে তো!”

আমি আর পারলাম না চুপ থাকতে। হেসে উঠে বললাম,

—-” তানিম এতো দুর্বল নয় যে এই হল্লাপাটির অত্যাচার অতিষ্ঠ হয়ে পড়বে। নিশ্চিন্তে থাকুন! সে কিন্তু তার পাপার মতোই স্ট্রং হয়েছে।”

উনি ভরসা পাচ্ছেন না যেন আমার কথায়। হাতের কাগজটা আরফান ভাইয়ের হাতে ঠেসে দিয়ে তেড়ে এলেন এদিকে। ফাহিম ভাইয়ার হাত থেকে তানিমকে কেঁড়ে নিয়ে কড়া গলায় বললেন,

—-” একশ হাত দূরে থাক সব গুলো। মায়াদয়াহীন মানুষ সব। এমন করছিস কেন ওকে নিয়ে? একদম ছুবি না। দূরে যা। আর যদি ওকে কোলে নিতে হয় তবে ভদ্র মানুষের মতো এসে আলতো হাতে তুলে নিবি। বুঝেছিস?”

উনার বাচ্চাসুলভ আচরণে সবাই হেসে উঠলো একসাথে। অতঃপর মাথা নেড়ে সবাই একসাথেই বলে উঠলো,

—-” বুঝেছি।”

রাহিয়ানের বারন করা কথা বেশিক্ষণ টিকল না। আমাদের ছোট্ট রাজকুমারকে পেয়ে সবাই যেন আসমান সমান খুশি। আমি বেডে আধশোয়া হয়ে দেখছি সবার কান্ড। আর মনে মনে ভাবছি,

—-” ভুল ভেবেছিলাম। কে বলেছে, বাবার শূন্যতা কখনও পূরন হওয়ার নয়? আমাদের ছোট্ট রাজপুত্রই তো দূর করবে আমার বাবার শূন্যতা।”

_____________________সমাপ্ত__________________