বঁধুয়া কেমনে বাঁধিবো হিয়া পর্ব-১০+১১

0
442

#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — দশ

গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট এন্ড গলফ ক্লাব সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলায় অবস্থিত। শ্রীমঙ্গলের সবুজ শ্যামল ও উঁচুনিচু পাহাড়ের কোল ঘেঁষে প্রায় তেরো দশমিক দুই একর জমির ওপর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে পাঁচ তারকা মানের এই আধুনিক রিসোর্টটি। সবুজের প্রান্তরে এমন একটা দৃষ্টিনন্দন জায়গা পর্যটকদের জন্য স্বস্তির ও শান্তির প্রধান মাধ্যম। এখানকার পরিবেশটা চোখ ধাঁধানো সুন্দর। চোখ মেললেই চারপাশে শুধু সবুজের সমারোহ দেখা যায়। এক ঝলকেই মন কেড়ে নেয় জায়গাটি। হানিমুন, ফ্যামিলি ট্যুর সহ সব ধরনের ট্যুর ও বিনোদনের অন্যতম এক আকর্ষণীয় জায়গা এটি। গ্রান্ড সুলতান-এ পা রেখে প্রথমেই হোটেল ম্যানেজারের কাছে গেল শাদাব। কিং ডিলাক্স-এর স্পেশাল রুমটাই বুকড করে রেখেছিল সে। একই রুমে দু’জন আরামসে থাকতে পারবে। এখানে সব ধরনের ব্যবস্থাই আছে। থাকা, খাওয়া, ঘুমানো, খেলাধুলা, বিনোদন, ব্যায়ামসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়েছে পর্যটকদের সুবিধার কথা ভেবে। সিলেটের অন্যতম পাঁচ তারকা হোটেলের মধ্যে গ্রান্ড সুলতান বহুল পরিচিত ও আধুনিক রেস্টুরেন্ট হওয়ার সুবাদে এখানে ভ্রমণ পিপাসু মানুষের যাতায়াত বেশি। রুম বুকিং যেহেতু আগেই করা হয়েছিল, তাই চাবি নিয়ে নির্দিষ্ট রুমে এসে পা রাখল দুইভাই। শিহাব রিল্যাক্স মুডে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। পুরো রুমে একবার চোখ বুলিয়ে বলল,

-‘জায়গাটা এত্ত সুন্দর। আমি জাস্ট বিস্ময়ে থ। তুমি আমাকে আগে নিয়ে আসোনি কেন? কতবার এখানে আসার আবদার করেছি।’

বিশ্রাম নিতে শাদাব বিনব্যাগের ওপর বসে রুমের এয়ারকন্ডিশন সিস্টেম চেক করে এখানকার চির অসহ্যকর কাহিনী ও দৃশ্য নিজে ভুলতে ও ভাইকে ভুলিয়ে দিতে বলল,

-‘আগের কথা ছাড়ো। এখন তো নিয়ে এসেছি। তুমি কি বিশ্রাম নিবে না-কি আগে ঘুরতে যাবে কোথাও?’

বার বার ঘড়ি দেখছে শাদাব। নূরুন্ নাহার জানিয়েছেন, মাহদিয়া ও হায়দার সাহেব রওনা দিয়েছেন। যেকোনো মুহূর্তে চলে আসবেন। রিসেপশনে বলে না রাখলে দেখা করা কিংবা কথা বলাটা মুশকিল হয়ে যাবে। ভাইকে একটু একা বসিয়ে রাখতে পারলে ভালো হোতো। কিন্তু ছেলেটা কি বসবে? যা উড়ন্ত মন। কখন যে তাকে না পেয়ে ছুট দেয় কে জানে! এজন্যই নিশ্চিত হতে প্রশ্ন করা। শিহাব অবশ্য ভাইয়ের মতিগতি বুঝতে পারছে না। সে উদারচিত্তে জবাব দিল,

-‘কাছেপিঠে কোথাও যাওয়া যায়? দুপুর হয়ে গেছে যেহেতু, আগে লাঞ্চ সেরে নিই। তারপর যাব। পেটে অসহ্য ক্ষিধে টের পাচ্ছি। তুমি পাচ্ছ না?’

বুদ্ধির অভাব নেই। এখনও যে দুপুরের খাওয়া হয়নি, সেটা দিব্যি মনে আছে। খাওয়ার জন্য হলেও সে গ্রাইড ফ্লোরে যাবেই। কিছুটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়ল শাদাব। তবে ভাইকে তা বুঝতে দিল না। হাসিমুখে বলল,

-‘ওকে। আমি রিসেপশনে আছি। তুমি ঝটপট ফ্রেশ হয়ে চলে আসো। রুম লক করে আসবে। খাওয়ার পর আমরা ঘুরতে বের হব।’

দ্রুতপায়ে নিচে আসলো শাদাব। প্রথমে খাবার অর্ডার দিল, তারপর ম্যানেজারকে হাতে রাখতে গেল। কে, কখন আসে, কোন রুম বুকিং করে, এসব এখানকার গোপনীয় খবর। এসব জানতে চাওয়া মাত্রই যে খবর পেয়ে যাবে, সেটা হাস্যকর ব্যাপার বৈ বাড়তি কিছু নয়। তবুও একগুঁয়ের মতোই সেটা জানবার আগ্রহ দেখাল। যখন মাহদিয়া আজাদ নামক টুরিস্টের আগমন সম্পর্কে জানতে চাইল, তখন তাকে কিছু বলা হলো না। উলটে ম্যানেজারসহ বাকি দু’জন স্টাপ তার দিকে রহস্যময় দৃষ্টি দিয়ে তাকাল। এদের তাকানোর ধরন দেখেই শাদাব মুখ লুকিয়ে হাসল। সবাই তাকে চোর-ডাকাত ভেবে বসছে। সে নিজের পারসোনাল কার্ড বের করে দেখাল। বলল,

-‘আহমাদ শাদাব। স্কিন স্পেশালিষ্ট সার্জন। এখানকার একটা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সপ্তাহে একবার আসা হয় আমার। আপনারা চাইলে, হসপিটালে খোঁজ নিয়ে দ্যাখতে পারেন। মাহদিয়া আজাদ আমার স্ত্রী। আমি ও’কে একটা সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম, আজ রাতে। তাই ওর রুম নম্বরটা জানতে চাওয়া। যদি অসুবিধা হয়, দরকার নেই। খাবারটা একটু দ্রুত সার্ভ করতে বলবেন, বাইরে যেতে হবে।’

ম্যানেজার মিসবাহ্ উদ্দীন সেটা বিশ্বাস করতে পারলেন না বোধহয়। শিওর হতে জানতে চাইলেন,

-‘উনি যে আপনার স্ত্রী, সেটা আমরা বিশ্বাস করব কীভাবে?’

-‘এখন কি তার প্রমাণ দিতে ম্যারেজ সার্টিফিকেট সাথে নিয়ে ঘুরব? আশ্চর্য! জানতে চেয়েছি, দিলে দিবেন; না দিতে চাইলে না বলবেন। ব্যস। কথা শেষ। অযথা সন্দেহ করবেন কেন? একজন স্বামী তার স্ত্রীকে সারপ্রাইজ দিতে চাইছে, সেটার নিশ্চয়তা দিতে এখন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রমাণ জোগাড় করতে হবে। যত্তসব। ইলজিক্যাল বিহেভিয়ার।’

সামান্য একটা কথা নিয়ে যথেষ্ট রেগে যাচ্ছে শাদাব। একেই তো শিহাবকে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। তারমধ্যে মাহদিয়ার উপস্থিতি। সবটা একসাথে সামলানো বড্ড ঝাক্কির কাজ। না সামলেও উপায় নেই। তাকে নিজের দিকটা স্বচ্ছভাবে তুলে ধরতে হবে। কোনো প্রকার ভুল বোঝাবুঝি কিংবা দাঙ্গাহাঙ্গামা দিয়ে নয়, ঠাণ্ডা মাথায় পুরো ব্যাপারটা সামলে নিয়ে পিছনের সমস্ত সত্যতা মাহদিয়ার সামনে প্রকাশ করতে হবে। এরপর মেয়েটা কী সিদ্ধান্ত নেয়, সেটা একান্তই তার ব্যক্তিগত ও নিজস্ব চিন্তাভাবনা।

শাদাবের রাগটায় যথেষ্ট হতাশ হলেন ম্যানেজার সাহেব। তিনি টুরিস্টদের সাথে বাজে ব্যবহার করতেই চান না। কিন্তু যা হোটেলের নিয়ম, সিস্টেম তা তো উল্টাতে পারেন না, পাল্টাতেও পারেন না। সবার জন্য যেহেতু একই নিয়ম তৈরী করা হয়েছে, সেহেতু এই নিয়মনীতি মেনে নিয়েই এখানে থাকতে হবে। অযথা রাগারাগি কিংবা হুমকিদামকি কখনও কোনো কাজের সমাধান হতে পারে না। টুরিস্ট হাতছাড়া হয়ে যাক, এটাও তিনি চান না। তাই কিছুটা অনুতাপের সুরে বললেন,

-‘আপনি খামোখাই রেগে যাচ্ছেন স্যার। এটা আমাদের রুলস্। আমরা নিশ্চিত না হয়ে কারও ব্যক্তিগত নম্বর কিংবা তথ্য আপনাকে দিতে পারব না। এটা বে’আঈনী। এই নিয়ম সবার জন্য। শুধু আপনি একা নোন।’

-‘ঠিক আছে। ঘড়ি ধরে পনেরো মিনিট অপেক্ষা করুন। ও আসছে। তখন বিশ্বাস করবেন, কেমন?’

মিসবাহ্ উদ্দীন কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন। শাদাব একটা চেয়ারে বসে চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি রাখল। যেন ওই দু’জন মানুষ প্রবেশ করা মাত্রই নিজেকে গোছানোর জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ ও সময় সে পায়। বেশ কয়েক মিনিট কেটে যাওয়ার পর শিহাব নিচে আসলো। রুম লক করেই এসেছে সে। চেয়ারে বসে ভাইয়ের দিকে চাবি বাড়িয়ে দিল। টেবিলে সাজানো খাবার দেখে ক্ষিধে বেড়ে গেল তার। সে তড়িঘড়ি হাতে খাবার প্লেটে তুলল। হাত ধুয়ে খাওয়ার দরকার পড়ল না। শাদাব নিজেই কথাচ্ছলে ভাইয়ের মুখে ভাত তুলে দিল। সকালে সামান্য নুডলুস্ খেয়েছে শিহাব। ঘুরতে আসবে শুনলে, খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে বসে থাকে। যার কারণে তার গ্যাস্ট্রিকসহ নানা ধরনের অসুস্থতা দেখা দেয়। এই মুহূর্তে আশেপাশের চেয়ে ভাইকে খাওয়ানোটাই জরুরী তার কাছে। শিহাব খাচ্ছে আর বকবক করছে। কোথায় যাবে, এরমধ্যেই একটা জায়গা সিলেক্ট করে নিয়েছে সে। সেটারই বিস্তর বর্ণনা দিতে বসে গেল। টেনশনে নিজে কিছু খেতে পারল না শাদাব। ভাইকেই খাওয়াল। শিহাব সেটা খেয়াল করে বলল,

-‘তুমি খাচ্ছ না কেন? আমি খাইয়ে দেব?’

-‘ক্ষিধে নেই আমার। তুমি খেয়ে নাও।’

শিহাব আর জোর করল না। সুবোধ বালকের মতো খাবার গিলে নিল। খুব দ্রুতই খাওয়া শেষ হয়ে গেল তার। পানি খেয়ে সঙ্গে আনা ফুটবল নিয়ে দ্রুত বাইরে চলে গেল। চারপাশের পরিবেশটা তাকে মুগ্ধ করছে। এখানে বেশিক্ষণ বসে থাকলে প্রকৃতির সেই মুগ্ধতা ও সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত হবে। শিহাব যাওয়ার পরই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল শাদাব। এরমধ্যেই চোখ গেল রিসেপশনের দিকে। মাহদিয়া ততক্ষণে চাবি বুঝে নিয়ে উপরের দিকে পা বাড়িয়েছে। পাজি মেয়েটা কোন ফাঁক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল! ‘ধুত্তোর’ বলে তড়িঘড়ি খাবার ফেলে রেখে রিসেপশনিস্টের কাছে আসলো। সে ম্যানেজারের দিকে তাকাতেই বেচারাও লজ্জামাখা হাসি দিয়ে মুখ লুকিয়ে বাঁচতে চাইলেন। শাদাবের কথার সত্যতা টের পেয়েই এই লুকোচুরি তার। শাদাব অবশ্য এই নিয়ে কোনোপ্রকার আলোচনায় গেল না। সেখানে দাঁড়িয়ে থেকেই গভীর মনোযোগ দিয়ে হায়দার সাহেবকে দেখল। তার কথা শুনল। তিনি কীভাবে ম্যানেজ করছেন মাহদিয়ার দিকটা। মূলত টুরিস্ট গাইড নিয়েই আলোচনা করছিলেন। এখানে ঘুরাঘুরিতে কোনো অসুবিধা যেন না হয়, সেসব বিষয়ের নিশ্চয়তা নিচ্ছিলেন। সব আলাপ শেষ করে যখন সেখান থেকে কয়েক পা সরে বাইরে আসতে গেলেন তখনই পিছন থেকে আদরমাখা কণ্ঠে ভেসে এলো,

-‘চাচ্চু, আই হ্যাভ অলওয়েজ মিসড্ য়্যু। ডিড য়্যু মিস মি?’

হায়দার সাহেবের পা যেন থেমে থেমে গেল। তিনি টের পেলেন হাঁটার মধ্যেই হোঁচট খাচ্ছেন। কণ্ঠ শোনে নয়, চাচ্চু ডাক শোনেই তার হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠেছে। তিনি পিছনে ফিরতেই অচেনা একটা চেহারা দেখে ভরকে গেলেন। এই ছেলে শাদাব নয়। শাদাব অনেক গুলুমুলু, নাদুসনুদুস চেহারার একটা ছেলে। অচেনা এই ছেলে তাঁকে কেন চাচ্চু বলে সম্বোধন করবে? নিশ্চয়ই ভুল করছে। চেনা-পরিচিত কারও সাথে ঘুলিয়ে ফেলছে। তিনি সলজ্জ হাসিতে বললেন,

-‘তুমি বোধহয় ভুল করছ। আমি কি তোমার চাচ্চুর মতো দ্যাখতে?’

দু’ঠোঁট চেপে হাসবার চেষ্টা করল শাদাব। কতদিন পর তার রক্তের সম্পর্কের কাউকে দেখল। নিজেকে কি আর ধরে রাখা যায়? না চাইতেও চোখের কোণ ভরে উঠল তার। ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি বজায় রেখে থেমে থেমে বলল,

-‘ভুল নয়, আমি নিশ্চিত। তুমি আমার চাচ্চু। আর আমি…!’

দূরে থাকাতে রক্তের সবটুকু টান শেষ হয়ে গেছে। তার কণ্ঠস্বর পালটেছে। চেহারা পালটেছে। কিশোর থেকে সে পরিণত পুরুষে রূপান্তরিত হয়েছে। চেনা চেহারা, চেনা রূপ, চেনা কণ্ঠস্বর পালটে আজ সে অচেনাই। এতটাই অচেনা যে, কাছে দাঁড়িয়ে থেকেও হায়দার সাহেব তাকে চিনতে পারছেন না। বাবার কথা ভুলে যেতে চায় শাদাব। কিন্তু এই মানুষটার আদর, স্নেহ, মমতা ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। মায়ের হাতে মার, বকা খেয়ে সবটুকু ব্যথাবেদনা লুকোতে হায়দার সাহেবের কাছেই আশ্রয় নিত সে। আজ তার আশ্রয়স্থল সামনেই, অথচ মুখ পরিচয় নেই। নিজের পরিচয়টুকু দিতে গিয়েও জড়তার কারণে কথা বলতে পারল না সে। মুখের কথা মুখেই আটকে রইল। হায়দার সাহেব তখন চমকে চমকে তাকাচ্ছেন। এই ছেলে নিশ্চিত, তিনি তার চাচ্চু। তবে কি ও শাদাব? বুকের ভেতর আচমকাই কেমন কেমন করে উঠল তার। তিনি দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বললেন,

-‘কে তুমি বোলো? কী নাম তোমার? আমি কি সত্যিই তোমার চাচ্চু হই?’

দু’হাতে মুখ মুছে মাথা নাড়ল শাদাব। পরক্ষণেই দু’হাতের শক্ত বাঁধনে জড়িয়ে ধরল হায়দার সাহেবকে। দলা পাকানো কান্নার রেশ গলার কাছে আটকে রেখে বলল,

-‘আমি টোটোন চাচ্চু। তুমি আমাকে চিনতে পারছ না কেন? আমার চেহারা কি এতটাই পালটে গিয়েছে? কণ্ঠস্বর সেটাও অচেনা? তুমি কী করে আমাকে ভুলে গেলে চাচ্চু?’

কতগুলো বছর পর বুকের মাঝে শান্তির স্রোত বয়ে গেল তাঁর। তিনিও আবেগে আপ্লূত হলেন। ভাতিজাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

-‘তোকে ভুলব, তা-ও আমি! এটা কি সম্ভব? কত জায়গায় খুঁজেছি। দিনরাত এক করে ছুটেছি। দু’জনের মধ্যে কারও খোঁজ পাইনি আমি। একটা সময় হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছি।’

হায়দার সাহেব আনন্দে আত্মহারা। হুট করেই যেন কোনো অমূল্য রত্ন পেয়ে গেছেন তিনি। খুশির দরুন চোখে জমেছে আনন্দের অশ্রু। স্নেহের পরশে অনেকদিন পর ভাতিজাকে বুকে জড়িয়ে নিতে পেরে কলিজা ঠাণ্ডা হয়ে গেল তার। খোদার দরবারে জমা রাখা সবটুকু অভিযোগ মুছে গেল। বারংবার চুমু খেলেন শাদাবের পুরো মুখজুড়ে। সুখের আতিশয্যে কণ্ঠস্বর বসে যেতে লাগল তার। তা-ও তিনি বললেন,

-‘কত বড়ো হয়ে গিয়েছিস তুই! কত পালটে গিয়েছিস! চেহারা, কণ্ঠস্বর কিছুই আর আগের মতো নেই। এতটা পালটালি কীভাবে?’

শাদাব স্বাভাবিক হয়ে হাসল। সব কথা এড়িয়ে গিয়ে বলল,
-‘সময় অনেককিছুই পালটে দেয়। ওসব বাদ দাও, তোমরা কেমন আছো বলো? বাড়িতে সব ঠিক আছে?’

হায়দার সাহেবের চেহারার রং-রূপ পালটে গেল। মুহূর্তেই প্রকাশ পেল একরাশ রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা। শাদাব সেটা লক্ষ্য করেও কিছু বলল না। তিনি পুরনো কথা মনে করতেই সায়রা করীমের অসুস্থতার দিক তুলে আনলেন। বললেন,

-‘ভাবীর অবস্থা এখন কেমন? সুস্থ আছেন? যোগাযোগ একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে ভাবিনী। সেদিনের পর কী হলো, আর তো কোনো খোঁজ পেলাম না। জানতেও পারলাম না, বেবি…!’

কথা শেষ করার আগেই হায়দার সাহেবের হাত ধরে তাকে রিসোর্টের বাইরে নিয়ে আসলো শাদাব। সেখানেই একটা ফাঁকা জায়গায় ফুটবল নিয়ে ছোটাছুটি করছে শিহাব। এক দূরন্ত কিশোরের প্রাণোচ্ছল হাসির দিকে আঙুল রেখে বলল,

-‘ওই চেহারায় কি টোটোনের শৈশব দ্যাখতে পাচ্ছ?’

বলাবাহুল্য, শিহাবের চেহারাটা শাদাবের কৈশোর চেহারার সাথে অনেকটাই মিলে যায়। সেই গোলগাল চেহারা। নাদুসনুদুস শরীর। সেই চিরচেনা হাসি ও দুষ্টুমি। সবকিছুই যেন শাদাবের আচরণ স্মরণ করিয়ে দেয়। তিনি বিস্মিত চোখেই সেদিকে তাকালেন। স্থিরচোখে অনেকক্ষণ শিহাবের ছোটাছুটি, দৌড়, তার হাসি ও আনন্দকে দেখে বললেন,

-‘শুধু দ্যাখতেই পাচ্ছি তা নয়, আমার তো মনে হচ্ছে এটা তোরই কার্বনকপি।’

শাদাব হাসিমুখে বলল,
-‘টোটালি নয়, কিঞ্চিৎ পার্থক্য আছে। ও ফর্সা আর আমি শ্যাম বর্ণের। আমার হাতে যে কালো রঙের একটা স্পট আছে সেটা ওর নেই।’

-‘নাম কী?’

-‘মেহমাদ শিহাব।’

সেদিনের পর থেকে তাদের সাথে ঘটে যাওয়া একেকটা বিভীষিকাময় অধ্যায়কে সংক্ষেপে হায়দার সাহেবের সামনে তুলে ধরল শাদাব। সবকিছু বুঝিয়ে বলে, শিহাবের ছোটাছুটির মাঝেই তাকে গলা উঁচিয়ে ‘ছোটোন’ বলে ডাক দিল শাদাব। বল হাতে নিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকাল সে। আসবে কি-না ইশারা করল। শাদাব মাথা নাড়ল। এক মুহূর্তও দেরী করল না চঞ্চল কিশোরটা। ছুটে আসলো ভাইয়ের কাছে। আবদারের সুরে বলল,

-‘সন্ধ্যে হয়ে যাবে। কখন ঘুরতে যাচ্ছি আমরা?’

পাশে থাকা ভদ্রলোক যে তাকে কতটা গভীর চোখে দেখছেন সেটা টের পেল না শিহাব। সে ঘুরতে যাওয়ার গানই গাইল। শাদাব তাকে কাছে টেনে এনে হায়দার সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘ওনাকে সালাম কোরো। উনি সম্পর্কে আমাদের চাচ্চু হোন।’

কে, কী পরিচয়, কী সম্পর্ক, কীভাবে চাচ্চু হোন, রক্তের বন্ধন না-কি আত্মার, সেসব কিছুই জানতে চাইল না শিহাব। টুপ করে মুখ দিয়ে সালাম করে মুচকি হেসে বললেন,

-‘আপনি ভালো আছেন চাচ্চু?’

রক্ত যখন কথা বলে, কাছে টানে, তখন ভালো না থেকে উপায় আছে? তিনি হাত বাড়িয়েই শিহাবকে জড়িয়ে ধরলেন বুকের মাঝে। মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বললেন,

-‘এতদিন খুব খারাপ ছিলাম। এখন থেকে ভালো থাকব।’

প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষকে কাঁদতে দেখলে যে কারও মনেই প্রশ্ন জাগবে। শিহাবের চোখেমুখেও কৌতূহলের পাশাপাশি প্রশ্ন জেগে উঠল। সে মুখ ফুটে কিছু জানতে চাইল না, তবে হাতের স্পর্শে হায়দার সাহেবের চোখের পানি মুছে দিল। বলল,

-‘মাঝে মাঝে মাকেও এইভাবে কাঁদতে দ্যাখি। আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করেই একটানা কাঁদতে থাকেন। আমার খুব রাগ হয়, কষ্ট হয়। আপনি এখন কেন কাঁদছেন চাচ্চু? আমাকে জড়িয়ে ধরতেই কেন কান্না পেয়ে গেল আপনার?’

হায়দার সাহেব কান্না মুছতে চাইলেন না। বরং আরও শক্তভাবে শিহাবকে নিজের সাথে আগলে নিয়ে বললেন,

-‘এমন অবুঝ, আদুরে বাচ্চা দ্যাখলে যে কারও চোখে পানি আসবে। আমারও এসেছে। এটা এত বড়ো কোনো সমস্যা নয়। তবে অনেকগুলো বছর পর আমার মনের সবটুকু দুঃখ দূর হয়ে গেছে। তোমাকে দ্যাখেছি, ছুঁয়েছি, বুকে নিয়েছি, এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দঘন মুহূর্ত এখন। তাই আমি আনন্দে কাঁদছি।’

শিহাব পুরো ব্যাখ্যা বুঝল না। বোঝার চেষ্টা করল না। শুধু ঠোঁট উলটে তাকিয়ে রইল ভদ্রলোকের চোখের পানে। তিনি এবার অনুমতি চেয়ে বললেন,

-‘তুমি কি চাও, তোমার এই ট্যুরে আমি তোমার সাথে থাকি? আমার কিন্তু সেরকম ইচ্ছে জেগেছে মনে। যদি তুমি রাজি হও, আমি একটা রুম বুকিং করে নিই?’

শিহাবের চোখেমুখে আনন্দরেখা ফুটে উঠল। সে উৎফুল্ল মেজাজে চরম উৎসাহের সাথে জানতে চাইল,
-‘আপনি আমাদের সাথে এই ট্যুরে থাকবেন? প্রতিবার আমি আর ভাইয়া ট্যুর দেই। আপনি থাকলে জমে যাবে চাচ্চু।’

-‘শুধু আমি একা নই, আরও একজন তোমার সাথে এই ট্যুরে শামিল হবে। তুমি কি তাকে সঙ্গে নিতে আগ্রহী?’

শাদাব এই কথা শোনেও কানে জায়গা দিল না। শিহাবের আগ্রহ দেখায় মনোযোগ দিল। শিহাবও প্রবল উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল,
-‘রিয়্যালি! কে তিনি? জলদি ডাকুন। আমার তো এক্ষুণি তাকে দ্যাখতে ইচ্ছে করছে। দলবেঁধে ঘুরাঘুরি কত আনন্দ জানেন?’

হায়দার সাহেব অনুমতি পেয়ে শাদাবের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দিলেন। শাদাব সেই হাসির অর্থ বুঝলেও না বুঝার ভান ধরে দাঁড়িয়ে রইল। তিনি তড়িঘড়ি ফোন বের করে মাহদিয়াকে কল করতে গেলেন। তারমধ্যেই দূর থেকে মাহদিয়া তাকে ডাক দিল,

-‘ছোটো মামা, তুমি এখনও যাওনি? রুমে বসে থেকে বোর হয়ে যাচ্ছি। কাছেপিঠে কোথায় যাওয়া যায় বোলো তো?’

হায়দার সাহেবের মনোভাব এখন, কী করবে বাছাধন! সামলাও এবার। শাদাব এতক্ষণ তাঁকে সব কথা বলার ফাঁকে মাহদিয়াকে এড়িয়ে যাওয়ার কারণটাও বলেছে। এই মুহূর্তে মাহদিয়ার উপস্থিতি যে তার মনের ভেতর অস্বস্তি ভাব ফুটিয়ে তুলেছে সেটা নিশ্চিত হতে পেরেই তিনি আরও চওড়া হাসিতে ঠোঁট ভরিয়ে তুললেন। মাহদিয়া এক’পা, দু’পা করে এগিয়ে আসতেই বললেন,

-‘যাচ্ছি না। আগামী কয়েকটা দিন আমিও এখানেই থাকছি।’

মাহদিয়া অবাক হলো। ক্লাস। ব্যস্ততা। ছুটি নেই। বিরতি নেই। তাও তিনি থাকবেন! কেন? আসার পথে তো বললেন, তাকে নামিয়ে দিয়েই তিনি চলে যাবেন। হুট করে থাকার ভূত মাথায় চাপল কেন! সে আশ্চর্যান্বিত চেহারায় বলল,

-‘হঠাৎ দখিনা হাওয়া উত্তরে বইতে শুরু করল কেন? তোমার না ছুটি নেই? ক্লাস আছে, লেকচার আছে, সবকিছু ফেলে তুমি কেন এখানে থাকবে?’

প্রথমে সামনের দুটো মানুষকে সে দেখল না। ফিরেও তাকাল না। কিন্তু পরমুহূর্তেই কথা শেষ করে হায়দার সাহেবের কোলের কাছে অচেনা একটা কিশোরকে লেপটে থাকতে দেখে চমকাল। থমকাল। গুলুমুলু, নাদুসনুদুস চেহারা দেখে স্মৃতিপটে ভেসে উঠল আরও একটা চেহারা। আরও একটা মুখবয়ব। তবে বেশিক্ষণ সেই স্মৃতিকে মনে স্থায়ী হতে দিল না। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল হায়দার সাহেবের দিকে। তিনি শিহাবের মাথায় হাত বুলিয়ে মাহদিয়াকে বললেন,

-‘বাচ্চাটা অনেক আদুরে। দ্যাখতে একদম আমাদের টোটোনের মতো। ভালো করে তাকিয়ে দ্যাখ তো দিয়া, এই চেহারায় টোটোনকে খুঁজে পাওয়া যায় কি-না!’

মাহদিয়া এবার কাছে ভীড়ে শিহাবের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। কতকিছু মনে পড়ল। কতকথা, কত দৃশ্য, কত ঝগড়াঝাটি। তার সব ছোটাছুটি যেন বৃথা হয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

-‘ঠিক বলেছ। অনেকটাই।’

শিহাবের পুরো চেহারা দেখে তার আদরমাখা মুখখানি আলতো স্পর্শে ছুঁয়ে দিল মাহদিয়া। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-‘নাম কী তোমার?’

-‘মেহমাদ শিহাব। সবাই আদর করে ছোটোন বলে ডাকে। আপনিও আমাকে ছোটোন বলে ডাকতে পারেন। চাচ্চু বললেন, আমরা একসাথে ট্যুর দিব। আপনি কি আমার সাথে ট্যুরে যেতে রাজি হবেন? জানেন, এখানে অনেক দর্শনীয় স্থান আছে। কী যে সুন্দর সব! দ্যাখলেই মনের ভেতর শান্তি নেমে আসে।’

মাহদিয়া হ্যাঁ না কিছু বলল না। মনে মনে বিড়বিড় করল,
-‘সত্যিই আমার শান্তির দরকার। খুব দরকার। এই অচেনা জায়গা আমাকে শান্তি দিবে তো?’

এমন উদাসীন চেহারা বেশিক্ষণ দেখার সাহস হলো না শাদাবের। সে পা চালিয়ে বিদায় নিল। যাওয়ার বেলা শিহাবকে বলল,
-‘গাড়িতে অপেক্ষা করছি। তাড়াতাড়ি এসো।’

***

চলবে…

#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — এগারো

পার্কিং স্পটে নিজের গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অনেককিছু ভেবে যাচ্ছিল শাদাব। মাহদিয়ার মুখোমুখি হলে কীভাবে নিজের পরিচয় দিবে, সেই নিয়েই দুঃশ্চিন্তায় ডুবে আছে সে! হায়দার সাহেব যেখানে তার চেহারা ও কণ্ঠস্বর ভুলে বসে আছেন, সেখানে মাহদিয়ার এত পুরনো স্মৃতি, স্বর, মনে রাখার কথা নয়। চেহারা মনে রাখলেও, তার আগের চেহারা ও এখনকার চেহারায় রাতদিন পার্থক্য। সে যদি মুখ ফুটে বলেও, সে শাদাব; তবুও মাহদিয়া সেসব বিশ্বাস করবে না। হুট করে এই সত্য বিশ্বাস করার কথাও না। এটা খুব কঠিন ও ধৈর্যের হয়ে দাঁড়াবে মাহদিয়ার জন্য। এমনসব জটিল কিছু চিন্তাভাবনার সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিল সে, তারমধ্যেই শিহাব ছুটে আসলো গাড়ির কাছে। পেরেশান হয়ে ভাইয়ের সামনে দাঁড়াল। বলল,

-‘কখন ঘুরতে যাব? তুমি তো দ্যাখি নিশ্চিন্তমনে দাঁড়িয়ে আছো! এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করছি কেন আমরা?’

শাদাব হুঁশে ফিরল। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দুঃশ্চিন্তা সরিয়ে তাকে গাড়িতে বসতে বলল। শিহাব সেটা শুনল না। বল হাতে নিয়ে সেটাকে উপরনিচ করে লুফতে লুফতে জানতে চাইল,

-‘ওই ভদ্রলোক আমাদের কেমন চাচ্চু ভাইয়া? তখন প্রশ্ন করতে চেয়েছিলাম কিন্তু ওনাকে দ্যাখে কেন জানি বলতে ইচ্ছে হয়নি! আমাকে ছুঁয়ে কাঁদবেন কেন তিনি? ওনার কোনো পরিচিত চেহারা কিংবা সম্পর্কের সাথে কি আমার কোনো মিল আছে? তাছাড়া ওই আপুটা। উনিও বোধহয় আমাকে দ্যাখে কিছুটা অশান্তিবোধ করছেন। ওনার চোখমুখ বিষণ্ণ ছিল খুব। তাই এইটুকু ধারণা হলো। আমাকে ঠিকঠাক উত্তর দাও তো, নয়তো এসবের চক্কর মাথায় চলতে থাকলে অন্যদিকে মনোযোগ পাব না।’

শিহাব এতকিছু নোটিশ করেছে! ভাইয়ের কথা শোনে চমকে গেল শাদাব। বুক কেঁপে উঠল। এ কোন কঠিন সত্যের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে সে! যে কঠিন সত্য তার ভাইকে জীবন মরনের সামনে দাঁড় করাবে। সে তো জানে, তার বাবা নেই। বেঁচে থাকা সত্ত্বেও তার নিকট মৃত থাকা ব্যক্তিটা যখন চোখের সামনে এসে দাঁড়াবে, তখন তা উপেক্ষা করে শিহাবকে কীভাবে সত্যিটা বলবে! কীভাবে জানিয়ে দিবে, তারই বাবার কারণে তারা দুইভাই আজ বাপদাদার ভিটে ছাড়া। ওই একটা মানুষের জন্য তাকে শুনতে হয়েছে, ছোটোলোক, ফকির-মিসকিন ছাড়াও আরও কত-শত গালি। সে নাহয় বুঝদার ছিল, তাই সব সত্য জেনে ও মেনে চুপ থেকে গালিগুলো হজম করে নিয়েছে। শত হলেও সেই কথাগুলো মিথ্যে ছিল না। এক সময় সে তো রাস্তার ফকিরই ছিল। শুধু থালাসমেত রাস্তায় বসা বাকি ছিল!

উত্তর না পেয়ে কৌতূহলী চাহনিতে তাকিয়ে রইল শিহাব। বলল,
-‘কী হলো? বললে না তো, উনি আমাদের কেমন চাচ্চু?’

দু’হাতে ভাইয়ের গালে হাত রাখল শাদাব। গভীর করে শ্বাস টেনে বুকের ভেতর জমে থাকা সবটুকু দীর্ঘশ্বাসের যন্ত্রণাকে উগড়ে দিয়ে বলল,

-‘উনি আমাদের চাচ্চুই হোন। একদম আপন। রক্তের।’

শিহাব মারাত্মকভাবে চমকাল। এতগুলো বছরে সে বাবা, চাচা নামক শব্দ ও মানুষের সাথে পরিচিত হয়নি। বাবা নেই জানত, কিন্তু চাচা কিংবা ফুপু এসব সম্পর্ক নিয়ে মনে প্রশ্ন থাকলেও কখনও জিজ্ঞেস করতে পারেনি। সাহসে কুলোয়নি আর তার ব্রেইনও তাকে এত বেশি ঘাটাঘাটি করতে দেয়নি। ফলস্বরূপ, দিনরাত পরিবার, দুষ্টামি, হাসি-আনন্দ, একটু রাগারাগি, চিৎকার-চেঁচামেচি ও মান-অভিমানের সাথে পাল্লা দিয়ে জীবন চলছিল তার। সেই জীবনে এসব ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামিয়েছে খুব কমই। যার কারণে কখনও আজকের মতো এমন পরিস্থিতি তৈরী হয়নি। তার মনেও সন্দেহ কিংবা প্রশ্ন জাগেনি। অথচ আজ! আজ তার সামনে যা আসলো, সেটা গ্রহণ করে, মেনে নিতেই তার কষ্ট হলো। সে শুধু অভিমানী চোখে ভাইয়ের দিকে তাকাল। অভিযোগের স্বরে বলল,

-‘এতদিন বলোনি কেন আমাকে? খুব বেশি জ্বালাই আমি তোমায়?’

শিহাবের চেহারা এইটুকু হয়ে গেল। অভিমানে চোখের কোণ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়তে শুরু করল। শাদাব সে পানি মুছে দিয়ে ভাইয়ের কপালে চুমু আঁকল। তাকে পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে দিতে ধীরস্থিরভাবে বলল,

-‘প্রত্যেকটা মানুষের জীবনেই কোনা না কোনো অতীত কিংবা কঠিন সত্য লুকিয়ে থাকে! কিছু কারণে মানুষ সেসব সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পায় বলেই, কখনও চায় না সেই সত্য তার সামনে পূণরায় ফিরে আসুক। তেমনি তোমার ও আমার জীবনে ছোট্ট একটা ট্রাজেডি আছে। ছোটো বলছি এই কারণে, সেই সময়টায় আমি বুঝদার থাকলেও, তোমার জন্ম ছিল না, তাই ধাক্কাটা আমি সামলে নিয়েছি। সেটা তোমার ওপর খুব বেশি প্রভাব ফেলেনি। যতটা প্রভাব ফেলেছিল আমার মনের ওপর তাতে আমি চাইনি, সেইসব সত্যের মুখোমুখি তুমি হও। আমি যতদিন বেঁচে আছি, তোমাকে সেই কঠিন ধাক্কার হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখব। যেন কোনো পরিস্থিতিতেই তুমি নিজেকে দুর্বল কিংবা একা ভাবতে না পারো। এটা শুধু আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য নয়, ভালোবাসারও অংশ। এই জীবনে, তোমাকে ও মা’কে আমি যতটা ভালোবাসি, ততটা ভালো আমি কাউকে বাসি না। বাসবও না কোনোদিন। তাই তুমি নিশ্চিত থাকো, ভাইয়া যদি তোমার থেকে কোনোকিছু গোপন রেখে থাকে, সেটা তোমার ভালোর জন্যই রেখেছে। সঠিক সময়ে তোমাকে সব সত্যি আমি জানাব। এখনও তুমি পরিপক্ক নও, ম্যাচিওর নও। তোমার মন ও মস্তিষ্ক সেই সত্য গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত নয়। জেনে-বুঝে আমি তোমাকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারি না ছোটোন। প্রয়োজনে তোমাকে সুস্থ রাখতে, বাঁচিয়ে রাখতে পৃথিবীর সব সত্যি আমি ভুলে যাব। তবুও সেসব দিনকে পূণরায় ফিরে আসতে দেব না।’

অবুঝ মন ভাইয়ের কথাকেই যথার্থ হিসেবে মেনে নিল। সে হয়তো পুরোপুরি ম্যাচিউরড নয়, তবে শাদাবের কথাতে এইটুকু বুঝতে পেরেছে, একটা মানুষ শুধু তাকে সুস্থ জীবন দেয়ার জন্যই পিছনের অধ্যায়টাকে ভুলে যেতে চাইছে। তার অপরিপক্ক মস্তিষ্কে কত-শত প্রশ্ন এসে ভীড় জমাচ্ছে। কত কথা জানতে মন চাইছে। কিন্তু শাদাবের বলা, সঠিক সময়; এই একটা সময়ের অপেক্ষাতেই থাকতে হবে তাকে। সব কথা জানার মোক্ষম সময় এটা নয়। জানলেও সে হয়তো বুঝবে না। এখনও অনেক বিষয় তাকে হাতে-কলমে বুঝিয়ে দিতে হয়। তার মস্তিষ্ক নিজে থেকে কিছু বুঝতে সাহায্য করে না। যতটা করে, শুধু পড়াশোনার বিষয়ে। বাড়তি অন্যান্য বিষয়াদি, দাঙ্গাহাঙ্গামা, সাংসারিক নানাবিধ ঝামেলা, পারিবারিক দ্বন্দ, হিংসা-বিদ্বেষ এইসব সম্পর্কে জ্ঞান ও ধারণা তার বরাবরই কম। সময় যেটা বুঝতে শেখাবে, সেটা নিয়ে আগ বাড়িয়ে মস্তিষ্কে কোনো চাপ সৃষ্টি করে লাভ নেই। অস্থির মন তার এতটুকু বুঝে, ভেবে শান্ত হয়ে গেল। হাসিমুখে শাদাবকে বলল,

-‘আমার আর কিচ্ছু জানার নেই ভাইয়া। আমি শুধু মা ও তোমাকে জেনেই বাঁচতে চাই। তোমরা পাশে থাকলেই আমি ভালো থাকব। আমার আর কোনো সত্য জানার প্রয়োজন নেই। কোনোদিন জানতে চাইব না আমি। কিচ্ছু জানতে চাইব না আর। তুমি কেঁদো না প্লিজ। তোমার চোখে পানি দ্যাখলে আমার অশান্তি লাগে।’

মুখ ঘুরিয়ে চোখের কোণ পরিষ্কার করে নিল শাদাব। বেখেয়ালি থাকায় কখন যে ইমোশনাল হয়ে পড়েছে, টেরই পায়নি। জঘন্য ওই দিনগুলো মনে পড়লে এখনও বুকে তীব্র ব্যথা হয়। না জানি, মায়ের কী হয় তখন! সে পুরুষ ও প্রচণ্ড শক্তপোক্ত মেজাজের মানুষ হয়েও অতীতের কালো অধ্যায় মনে পড়লে মধ্যরাতে খোদার দরবারে হাত উঠিয়ে চোখের পানি ফেলে, সেখানে সায়রী করীম নারী হয়ে কতটা হৃদয় বিদারক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করেন, কে জানে! চিরদিনের মতো মায়ের এই কষ্টটা যদি মুছে দিতে পারত, তবে মনে এত অশান্তি থাকত না। এত না পাওয়া ও আহাজারি তাকে কাবু করতে পারত না। কিন্তু কী আর করার! নিয়তি তাদের সহায় ছিল না কোনোদিন। আজও হয়তো নয়। তাই তাদের দুই ভাইয়ের জীবনে সবকিছু থাকার পরও কোনো একদিক যেন এখনও অপরিপূর্ণ। তবুও তারা সুখী। আর সুখী বলেই এসব নিয়ে স্রষ্টার দরবারে কোনো অভিযোগ নেই তাদের। সে মুচকি হেসে শিহাবের গাল টেনে দিল। বলল,

-‘বড়ো হয়ে যাচ্ছ!’

শিহাব ভুবনভুলানো হাসি দিয়ে গাড়িতে বল রেখে রিসোর্টের দিকে তাকাল। বলল,

-‘চাচ্চু এখনও আসছেন না কেন?’

-‘কী জানি! হয়তো ওই জংলী ভূত মেয়েটা কীসব ভুজুংভাজুং বুঝাচ্ছে।’

এক নিমিষেই রেগে গেল শিহাব। কোমরে হাত রেখে চোখদুটো বড়ো করে গম্ভীরস্বরে বলল,

-‘এমন কিউট একটা মেয়েকে তুমি জংলী ভূত বললে, কোন যুক্তিতে?’

-‘আরেহ্, তুমি এত হাইপার হচ্ছ কেন? ওই মেয়েটা কি তোমার কাছে রূপকথার রাজকন্যার মতো না-কি? এক দ্যাখাতেই মনের ভেতর জায়গা করে নিয়েছে!’

শিহাব ঝেড়ে কাশল। কনফিডেন্টের সাথে বলল,
-‘তোমার চোখে মেবি ছানি পড়েছে। নয়তো এমন একটা কিউট মেয়েকে তুমি জংলী ভূত বলতে পারতে না।’

শিহাবের ভাব দেখলেই বুঝে নেয়া যায়, সে মাহদিয়াকে পছন্দ করে বসে আছে। এক দেখাতেই মেয়েটাকে আপন ভাবতে শুরু করেছে। সহজে মিশে যাওয়া ছাড়াও, অচেনা মানুষকে খুব বেশি বিশ্বাস ও অত্যাধিক মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেলার মতো সৎ, সুন্দর, স্বচ্ছ মন-মানসিকতা আছে ওর। যার কারণে প্রতিবার ট্যুরে গেলে, দু’একজনকে সে আত্মার আত্মীয় বানিয়ে ফেলবে। ফোন নম্বর, বাসার ঠিকানাসহ যাবতীয় তথ্য নিয়ে বন্ধুত্বের সুতো টানিয়ে দিবে। ফলস্বরূপ এ পর্যন্ত ভিন্ন এলাকায়, ভিন্ন শহরে অসংখ্য বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে নিয়েছে সে। ওরাও বোধহয় তার মতো। তাদের সবাইও তাকে বিনাবাক্যে সানন্দে গ্রহণ করে নেয়। আগামী তিনদিনে মাহদিয়াকে যে কতটা আপনের তালিকায় ফেলবে সেটা হয়তো এখনই ঠিক করে বসে আছে। এই মুহূর্তে ভাইকে ক্ষ্যাপিয়ে, রাগিয়ে, কিছু বলবার আগ্রহ পেল না শাদাব। উল্টোপাশে সরে দাঁড়িয়ে বিড়বিড়াল,

-‘কিউট না ছাঁই। মাথাভর্তি পাখির বাসা। কতবার বলেছি, চুল স্ট্রেইট কোরো! উনি শুনবেন না। সারাক্ষণ ভূতের মতো থাকবেন। ভূতকে ভূত বলব না তো, ডানাকাটা পরী বলব না-কি!’

***

মাহদিয়া তখনও দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। ফোন টিপানোর ফাঁকে ফাঁকে একটু-আধটু পায়চারী করছে। তবে কারও সাথে কথা বলছে না, কারও দিকে তাকাচ্ছেও না। তার ভাবনায় ভীড় জমিয়েছে ফেলে আসা দিনগুলো। হায়দার সাহেব এরমধ্যেই বাড়তি একটা রুম বুকিংয়ের কাজ কমপ্লিট করে নিয়েছেন। ভেতরের কাজ শেষে বাইরে এসে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন,

-‘কীরে মা, এখনও দাঁড়িয়ে আছিস যে! যাবি না ওদের সাথে?’

মাহদিয়া মুচকি হাসল। বলল,
-‘কাদের সাথে যাব? টুরিস্ট গাইড? ছেলে না-কি মেয়ে?’

বড়ো হওয়ার পর থেকে একটা ব্যাপার খুব করে খেয়াল করেছে মাহদিয়া। যখন সে রাস্তায় বের হয়, কিছু অপরিচিত দৃষ্টি তার মাঝে মুগ্ধতা খুঁজে নেয়। কেউ কেউ খুঁজে লালসা। কেউ কেউ রুম ডেটের প্রস্তাবও দিয়ে বসে। কিশোরী বয়স থেকেই এমন সব পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল সে। তখন থেকেই বিবেক, জ্ঞান, বুদ্ধি তাকে বুঝিয়ে দিত, সে বিবাহিতা। অন্য কারও স্ত্রী। দেশের কোনো এক প্রান্তে পড়ে থাকা, এক অপেক্ষাকৃত পুরুষের বৈধ স্ত্রী। শুধু তার মন নয়, পুরো সত্ত্বা তাকে স্মরণ করিয়ে দিত, ‘ওই পথটা ভুলেগড়া। ভুলেগড়া পথে কখনও পা ডুবাতে নেই।’ এই সত্যিটা উপলব্ধি হওয়ার পর থেকে রাস্তায় বেরোলে ডানে-বামে খুব কমই তাকাত সে। যদি কখনও পরপুরুষের দিকে নজর চলে যায়, এই ভয়ে! যদি কখনও কারও মায়ায় আটকে যায়! তবে দেশে ফিরে, শাদাবকে কী জবাব দিবে সে! তার সামনে কোনো পুরুষ চলে আসলেও খুব সাবধানতার সাথে তাকে এড়িয়ে চলত মাহদিয়া। ভালো-মন্দ কোনো প্রস্তাব রাখলে চট করে বলত, ‘স্যরি। আ’ম এ্যানগেজড।’ ওই কথাটা বলার সাথে সাথে নিজেকে তার নির্ভার মনে হোতো।

মাহদিয়ার এসব আচরণের সাথে হায়দার সাহেব পরিচিত নোন। সামনে থাকলেও যুবকদের দৃষ্টি ও চেহারা যে সে এড়িয়ে যায়, তিনি সেটা আন্দাজ করতে পারেননি। এতক্ষণ সময়ে মাহদিয়া শুধু দু’বারই কিশোর শিহাবকে দেখেছে, এরপর আর তাকায়নি। কারণ তাকালেই আরও একটা চেহারা মনে পড়ে যাচ্ছিল তার। তখন অবচেতন মন বার বার অচেনা ওই চেহারা দেখেই সুখ খুঁজে নিতে চাইত। ওই মুহূর্তে শাদাব ছিল তার থেকে কয়েক হাত দূরে, যার কারণে সে ইচ্ছাকৃতভাবেই চোখ নামিয়ে কথা বলেছে। পাশে একটা পুরুষ অবয়ব দেখেও তাকানোর আগ্রহ পায়নি দেখেই নিজেকে অন্য কাজে ডুবিয়ে রেখেছে। এর মানে এই না যে, সে পারফেক্ট মুসলিমাহ্। সে শুধু নিজের বিবেক, মন ও সম্পর্কের কাছে স্বচ্ছ, পবিত্র। তার ভাবনা ও কাজগুলোও যৌক্তিক। ওদের সাথে যাওয়া বলতে হায়দার সাহেব যে এখানে দাঁড়িয়ে থাকা দুটো মানুষকে বুঝিয়েছেন, সেটা না বুঝেই প্রশ্ন করেছিল মাহদিয়া। তিনি এমন প্রশ্ন শোনে হতাশ চোখে তাকালেন। বললেন,

-‘এখানে কারা ছিল কিছুক্ষণ আগে?’

-‘একটা কিশোর! নাম কী বলে গেল যেন! ও হ্যাঁ, শিহাব।’

-‘আরও একজন ছিল।’

-‘টুরিস্ট গাইড?’

আবার সেই একই প্রশ্ন। মাহদিয়ার এরূপ আচরণে হায়দার সাহেব কিছুটা বিরক্ত হলেন। বললেন,
-‘হ্যাঁ। টুরিস্ট গাইড। এখন চল, একটু ঘুরে আসি। আমার আবার শপিং করতে হবে। বাসা থেকে প্রয়োজনীয় কিছুই নিয়ে আসিনি।’

ঘুরতে যাওয়া নিয়ে কোনো প্রশ্ন করল না মাহদিয়া। তবে শিহাবের কথা মনে হওয়াতেই বলল,
-‘ওই ছেলেটা তখন তোমাকে চাচ্চু বলে ডেকেছিল! তুমি ওর চাচ্চু হও কী করে?’

দাম্পত্য সম্পর্কে অস্বীকার করতে পারছে না শাদাব। মিথ্যে বলেও চালিয়ে দিতে পারছে না। কঠিন সত্যের মুখোমুখি হতে সে নিজেই সবটা মাহদিয়ার সামনে প্রকাশ করতে চায়। তাছাড়া, শাদাব যা বলল, তা যদি এখন তিনি মাহদিয়ার সামনে বলেনও, তাহলেই মেয়েটা শাদাবকে ভুল বুঝতে শুরু করবে। যাচাই-বাছাইয়ের আগেই অভিযোগ, অপরাধ ও মিথ্যেবাদীর আঙুল তুলবে তার দিকে। সম্পর্ককে ভুল ভাবতে শুরু করবে। যে সম্পর্কে এখনও বিশ্বাসই তৈরী হয়নি, সেখানে আগ বাড়িয়ে কোনো অবিশ্বাস কিংবা সন্দেহকে ঢুকিয় দেয়া যুক্তিযুক্ত হবে না। আপাতত তাঁকে চুপ থেকে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। দুটো মানুষকে চিরতরে বিচ্ছেদের মুখে ঠেলে দেয়ার জন্য, পরিপূর্ণভাবে কে দায়ী সেটা আগে খুঁজে বের করতে হবে। তারপর সব সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। এরজন্য মাহদিয়ার মনে সাহস ও মনোবল বাড়িয়ে দেয়া দরকার। কোনোপ্রকার সন্দেহ মনে দানা বাঁধবার আগেই সবদিক স্পষ্ট করা দরকার। এই মুহূর্তে নিজে ও শাদাবকে সেইফ করতেই তিনি কিছুটা থেমে থেমে বললেন,

-‘তখন বললাম না, ওই ছেলেটা দ্যাখতে টোটোনের মতো?‘

-‘হ্যাঁ। খানিকটা ওরকমই।’

-‘এই কারণেই আমি ও’কে বলেছি, আমাকে যেন চাচ্চু বলে ডাকে। তখন রিসেপশনে টুরিস্ট গাইড চাইলাম, একজনকে পেলাম। তার সঙ্গে আবার এই শিহাবও। ও এখানে ঘুরতে এসেছে। ভাই সাথে থাকে সবসময়। তাই আরকি, তোর সঙ্গেও ভাব জমাতে চাইল।’

‘ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে আর কত কী কাহিনী বানাতে হবে’ এইটুকু বিড়বিড় করলেন হায়দার সাহেব। মাহদিয়া শুনল না। বলল,
-‘গাইড কি ছেলে?’

-‘হ্যাঁ। এখানেই তো ছিল, দ্যাখিসনি?’

কী যেন ভাবল মাহদিয়া। বলল,
-‘কোনো ফিমেইল গাইড পাওয়া যাবে না?’

-‘আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে কেউ রিসোর্টে নেই।’

-‘তাহলে থাক, দরকার নেই। আমি রুমে যাচ্ছি।’

-‘আশ্চর্য! তুই ঘুরতে যাবি বলে, আমি ওদেরকে এতক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে রেখেছি। এখন বাহানা করলে তো শুনব না দিয়া!‘

মাহদিয়াও বেঁকে বসল। ঘাড়ত্যাড়ামি করে বলল,
-‘আমিও কোনো অচেনা পুরুষ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে পারব না।’

হায়দার সাহেব কপাল চুলকালেন। কাকে এই মেয়ে অচেনা বলছে! যার জন্য ছুটে এসেছে, তাকে? যাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য শহরের অলি-গলিতে খুঁজতে নামা, তাকে? সামনে পেয়েও চোখ তুলে তাকাল না, চিনতে পারল না, কথা বলতে পারল না, তবে পরিচয় হবেটা কী করে এদের! ভেবে ভেবে অস্থির হোন তিনি। মাহদিয়াকে মানাতে অসহায় গলায় বললেন,

-‘ও টুরিস্ট গাইড হলেও হ্যাংলামি ওর স্বভাবে নেই। ও যথেষ্ট নম্র-ভদ্র ছেলে। তোর থেকে মেপে মেপে চার হাত দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটবে। যেন তুই বিরক্ত না হোস। এখন আয়। ছোটোন অপেক্ষা করছে!’

-‘সত্যিই দূরে দূরে থাকবে তো? গা ঘেঁষে হাঁটলে কিন্তু উপর থেকে নিচে ধা ক্কা মে রে ফেলে দেব। কোনো গাইড পাইড মানব না।’

হায়দার সাহেব জবাব না দিয়ে হাঁটা ধরলেন। মাহদিয়া বুঝল, তিনি রেগে গেছেন। সে-ও পিছন পিছন এগিয়ে এসে ভদ্রলোকের হাত ধরে বলল,

-‘সব পুরুষের নজর আমার কাছে ঠিক মনে হয় না ছোটো মামা। তোমাদের সবাইকে যেভাবে বিশ্বাস করতে পারি, অন্যদের সেভাবে পারি না। তাই চলতে পথে ভয়কে সঙ্গে নিয়ে বাঁচি।’

মাহদিয়ার মনের অবস্থা বুঝতে পারলেন তিনি। উত্তরে আর কিছু বললেন না। তবে রাগ করেও থাকতে পারলেন না। হাঁটতে হাঁটতেই গেটের কাছাকাছি আসলেন। শিহাব তাদের একসাথে দেখেই দূর থেকে চিৎকার দিয়ে বলল,

-‘হেই বিউটিফুল গার্ল, য়্যু আর অলরেডি টু লেট।’

***

চলবে…