বঁধুয়া কেমনে বাঁধিবো হিয়া পর্ব-০৯

0
329

#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — নয়

কার্টেসিসহ কপি করা নিষেধ!

নিজের রুমের ইজিচেয়ারে বসে দোল খাচ্ছেন কায়ছার সাহেব। মাথার ভেতর অজস্র চিন্তা-দুঃশ্চিন্তা। ঘুম নেই। মনে শান্তি নেই। নেই একফোঁটা সুখও। তাঁর চারপাশটা এখন দুঃখের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। তিনিও তার অতলে তলিয়ে যাচ্ছেন রোজ। একটা সময় সংসার ছিল তার সুখের ঠিকানা। স্ত্রী, সন্তান ছিল তাঁর সারাদিনের ক্লান্তি দূর হওয়ার মাধ্যম। বেঁচে থাকার জন্য একটা মানুষের জীবনে যা কিছুর প্রয়োজন, সেসবও তাঁর ছিল। কিন্তু সম্মান জিনিসটাকে আঁকড়ে ধরে রাখার জেদ তাঁর সুখের সংসারে আগুন জ্বালিয়ে দিল। এই আগুনটা তিনি নিজেই জ্বালিয়েছেন, কিন্তু নেভাতে পারেননি। সায়রা করীমের ওপর রাগ, অত্যাচার, গালিগালাজ করে ভেবেছিলেন, গর্ভের বাচ্চাটাকে পৃথিবীর বুকে আসার আগেই পরপারে পাঠিয়ে দিবেন। অথচ সায়রা করীম ছিলেন নিজের সিদ্ধান্তে স্থির থাকা সাহসী এক নারী। যিনি মর‍তে মরতেও নিজের সন্তানকে বাঁচাতে ঘর-সংসার ছেড়ে অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে চিরদিনের মতো সমস্ত ভালোবাসার অবসান ঘটিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন। সেদিনের পর তিনি তো একা হলেনই, বিবেক-বুদ্ধির কাছে ছোটো হয়েও নিজের অহমিকাকে বাঁচিয়ে রাখতে কোনোদিন ওই দুটো মানুষের সন্ধান নিতে বের হোননি। উলটে হায়দার সাহেব বের হলে তাকে বলতেন,

-‘যার মনে স্বামীর সম্মান ও সিদ্ধান্তের প্রতি কিঞ্চিৎ শ্রদ্ধাবোধ নেই, তাকে ঘিরে এত হা-হুতাশ করা মানায় না।’

হায়দার সাহেব চোখ রাঙিয়ে তাকাতেন। ভাইয়ের সাথে তর্কে জড়িয়ে যেতেন। শত চেষ্টাও যখন জলে যেতে দেখলেন তখন তিনিও খোঁজাখুঁজি থামিয়ে দিলেন। দিনরাত ছুটে যখন ক্লান্ত শরীর নিয়ে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরতেন তখন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে উপহাসের হাসি হাসতেন কায়ছার সাহেব। তাচ্ছিল্যের স্বরে বলতেন,

-‘খামোখা দৌড়াচ্ছিস, লাভ নেই। ওরা এ বাড়িতে আসতে চাইলেও আমি ওদেরকে এই বাড়িতে জায়গা দিব না। স্ত্রী নাহয় পরের ঘরের মেয়ে, স্বামীকে নিয়ে তার মনে শ্রদ্ধা, সম্মান না-ই থাকতে পারে। কিন্তু যে সন্তান বাবার সিদ্ধান্ত ও কাজকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে প্রৌঢ়বয়সী নারীর গর্ভধারণকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিয়ে ঘর ছাড়তে পারে, সেই সন্তান আমার কাছে মৃত বৈ জীবিত নয়। আদর, ভালোবাসা কম ছিল ওর প্রতি? যাওয়ার বেলা কীভাবে পারল একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার এতদিনের ভালোবাসাকে তুচ্ছ করে দিতে?’

হায়দার সাহেবও থেমে থাকতে পারতেন না। চুপ থাকতে থাকতে একসময় গলায় জোর এনে বলতেন,
-‘বেশ করেছে। যার কাছে স্ত্রী-সন্তানের চেয়ে সম্মান বড়ো হয়ে যায়, তার সাথে এমনটাই করা উচিত। ওসব ভালোবাসা শুধু লোকদেখানোই ছিল। ওখানে পর্যাপ্ত সাপোর্ট ও বিশ্বস্ততার অভাব ছিল। টোটোন সেটা বুঝতে পেরেছে, তাই মায়ের সিদ্ধান্তকে সম্মানের সাথে আগলে নিয়ে বাড়ি ছাড়তে পেরেছে। ওর জায়গায় আমি থাকলেও এই একই কাজটাই করতাম।’

অতীত ভালো হোক কি মন্দ, ভুল হোক কি শুদ্ধ, কায়ছার সাহেব চাননি, সেই অতীত তার সামনে আসুক আর। মাহদিয়া জেনে যাক পিছনের অধ্যায়। এই কারণেই তিনি চাননি মেয়েটা দেশেও আসুক কভু। সম্মানকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া দুটো মানুষের খোঁজ করুক। তাই চেয়েছেন, শায়লা সুলতানার মাধ্যমে মাহদিয়াকে জোরজবরদস্তি করে ইতালিতে আটকে রাখতে। ভদ্রমহিলা সেটা পারেননি। উপযুক্ত মেয়ে হওয়ার সুবাদে কারও সিদ্ধান্তের দিকে তাকায়নি মাহদিয়া। ছুটে চলে এসেছে দেশে। এরপরই নেমেছে তার কাজে। পাচ্ছে না দেখেই হতাশা ঘিরে ধরেছে মেয়েটাকে। সেই হতাশা ও রাগ, ক্ষোভে রূপ নিয়ে বয়সে বড়ো একটা মানুষের দিকে আঙুল উঠাতেও বাধ্য করেছে আজ! সবকিছুর পরও তারকাছে, একটা বিষয়ই দুঃশ্চিতার হয়ে দাঁড়াল! মাহদিয়া সবকিছু জেনে যায়নি তো? হায়দার সাহেব যেভাবে তাকে নিয়ে মাতামাতি করছেন, জানার তো কথা। হয়তো জেনেছে, যার কারণে এতগুলো মানুষের সামনে অতীতের দৃশ্যটাকে পরিপূর্ণভাবে তুলে আনতে না পারলেও ইনিয়েবিনিয়ে খোঁচাটা দিয়ে দিয়েছে। সেই খোঁচাটাই তাঁর হজম করতে কষ্ট হচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছেন তিনি। একা একাই বিড়বিড়াচ্ছেন,

-‘আমার সাথে পাঙ্গা নিতে এসেছ! ওইটুকুন একটা মেয়ে। তোমার সাহস দ্যাখে অবাক হচ্ছি আমি। আমার টাকায় এতদূর এগিয়ে আমাকেই চড়-থাপ্পড় মারা। মোটেও সহ্য করব না। যে আমি নিজের স্ত্রী-সন্তানকে বাড়িছাড়া করতে পারি, সেই আমি তোমার মতো পুচকো মেয়েকে দুনিয়া ছাড়াও করতে পারি। আমার সাথে লড়াইতে নেমে ভালো করোনি তুমি। খুব বেশি বাহাদুরি দ্যাখিয়ে ফেলেছ।’

তিনি সবসময়ই ভেবে এসেছেন, ওই বয়সে ছোট্ট প্রাণকে নিজের সন্তান হিসেবে পরিচয় দেয়া লজ্জারই। যেখানে শাদাবের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন, প্রথম সন্তান উপযুক্ত বয়সের পথে পা বাড়িয়েছে, সেখানে দ্বিতীয় সন্তান তো সম্মান নষ্ট করে দেয়ার জন্য যথেষ্টই। তাকে কোলে নিয়ে হাঁটতেন কী করে তিনি? স্কুল যেতেন কী করে? বলতেন কী করে, ওই সন্তানটা তার ঔরসজাত! লোকমুখে এসব বলা যেমন লজ্জার, তেমনি সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটাও লজ্জার। তিনি এখনও নিজের সিদ্ধান্তকে সঠিক হিসেবে মানেন। তাই এই নিয়ে কারও কাছে জবাবদিহি করা তো দূর, নিজে যে ভুল সেটা মানতেই চান না। আজ মাহদিয়া সেইসব দিনগুলোকে সামনে এনে চরম অন্যায় করেছে। এই অন্যায়ের শাস্তি তিনি তাকে দিবেন। খুব শীঘ্রই! আদর, যত্ন দিয়ে নিজের পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিয়ে, সম্পত্তির মালিকানা দিতে চেয়েছিলেন, অথচ মাহদিয়া সেই সম্পত্তির দিকে অদৃশ্য থুতু ছুঁড়ে মেরেছে। মেয়েটা যেন আজ কাগজ ছিঁড়েনি, তাকেই আঘাত করেছে। মানতে পারছেন না তিনি। সহ্য করতে পারছেন না। কিছু একটা যে সিদ্ধান্ত নিবেন সেই উপায়ও নেই। বিশ্বস্ত মানুষ পাশে কেউ-ই নেই। যে ছিল, তাকে তো তিনি নিজেই তাড়িয়ে দিয়েছেন। অবশ্য এই নিয়ে তিনি বিন্দুমাত্র লজ্জিত নোন। উলটে নিজের করা কাজ নিয়ে তিনি আজও শতভাগ শুদ্ধ। প্রয়োজনে অতীতের কাজ দ্বিতীয়বার করবেন, তবু নিজের সম্মানের দিকে ছুটে আসা একইঞ্চি আঘাতও মুখ বুঁজে হজম করবেন না।

***

গতকাল থেকে মায়ের ওপর অভিমান জন্মেছে ভীষণ। এই কারণে মনের কোণে তীব্র ব্যথা ও অভিমান নিয়ে চুপচাপ বসে আছে মাহদিয়া। শায়লা সুলতানা চেয়েও মেয়ের সাথে কথা বলতে পারছেন না। ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে পারছেন না। অবশ্য তিনি ক্ষমা চাইতে চাইছেন না। তবে মেয়েটাকে বুঝাতে চাইছেন। মাহদিয়া বোঝ মানবে তো দূর, মায়ের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। চা খাচ্ছে, হাঁটছে, মান-অভিমান দেখিয়ে শাদাবের সেই কাঠের ঘরটায় এসে পা দুলিয়ে সিঁড়িতে বসে রয়েছে। কেউ তাকে ডাকছে, তার সাথে ভাব জমাতে চাইছে, সেদিকে তার দৃষ্টি নেই। তার মনে চলছে, ঠিকানা খুঁজে পাওয়ার ধান্ধা। কোথায় গেলে দুটো মানুষের দেখা পাবে এই এক চিন্তায় আধমরা সে। চায়ে চুমুক দেয়ার মাঝখানেই সুনামগঞ্জে থাকা শাদাবের সেই খালার কথা মনে পড়ল মাহদিয়ার। তড়িঘড়ি নেমে আসলো নিচে। ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়াতেই দেখল, হায়দার সাহেব তৈরী হয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য রওনা দিচ্ছেন। নিশ্চয়ই তিনি মাদরাসায় যাবেন এখন। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভদ্রলোক অমায়িক হেসে বললেন,

-‘নাশতা করিসনি এখনও? আমি তো বের হচ্ছি। কিছু দরকার হলে ফোন করিস। কেমন?’

মাহদিয়া মাথা নাড়ল। ম্লানমুখে বলল,
-‘সুনামগঞ্জের সেই ঠিকানাটা কি খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়?’

-‘আমার কাছে তো কোনো অপশন নেইরে মা। থাকলে কি আমি বসে থাকতাম এইভাবে?’

বড্ড মন খারাপ হলো মাহদিয়ার। একটা যে উপায় ছিল, তারও পথ বন্ধ। সে কাতর স্বরে বলল,
-‘তবুও আমরা একবার যাই না ওখানে! যদি পেয়ে যাই। হতেও তো পারে এরকম! পারে না?’

-‘মা রে! জীবনটাকে তুই যত সহজ ভাবছিস, জীবন এত সহজ নয়রে মা। এই জীবন যে কত কঠিন সেটা বাস্তবতার কষাঘাতে দুমড়েমুচড়ে যাবি যেদিন, সেদিন উপলব্ধি করবি। এখনও তোর বয়স অনেক কম। বুদ্ধি-বিবেচনাও কম। মনে যা আসছে, সেভাবেই এগোতে চাইছিস। কিন্তু মনের ভেতর এই দ্বিধাবোধ নিয়ে মরিচীকার পিছনে ছুটে যাওয়া কতটা ঠিক বল? ভাগ্য তোর সহায় হবে কি-না জানি না, তবে তোর এই পথচলায়, এই খোঁজাখুঁজির মিশনে আমি সবসময়ই তোকে সাপোর্ট দিয়ে পাশে থাকব। এখন বের হই? ফিরে এসে কথা হবে।’

ঘাড় নেড়ে অসহায় চোখমুখ নিয়ে ঘরের চারিদিকে চোখ বুলাল মাহদিয়া। এই ঘরে একদিন কত ছোটাছুটি করেছে সে, কত দৌড়ঝাঁপ দিয়েছে। তাকে মারার জন্য, ছোঁয়ার জন্য, শাদাবও পিছন পিছন ছুটেছে। পনেরো বছর আগে দুটো অবুঝ ছেলেমেয়ে এই ঘরকে প্রাণবন্ত ও উৎসবমুখর আঙিনার মতো হৈহৈ রবে মাতিয়ে রেখেছিল। পনেরো বছর পর, দু’চোখে শুধু শূণ্যতা আর শূণ্যতা। এই শূণ্যতা কবে দূর হবে? দিশেহারা মন নিয়ে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে মাহদিয়া। গুটিকয়েক পা ফেলে স্মৃতির পাতা হাতড়ে ঝলমলে দিনগুলোকে ফিরে পেতে চায়। তবুও সবকিছু শূণ্য, শান্ত, নীরব হয়ে পড়ে থাকে। কেউ নেই ডানে-বামে। কোনো মানুষ নেই। চেনা মুখ নেই, চেনা সুখ নেই, কিচ্ছু নেই। সব এত দ্রুত কেন পালটে গেল? নীরব মনের এই ভাবনাগুলো নীরবেই আটকে রেখে পানসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে চায়। বিতৃষ্ণায় চেহারা কুঞ্চিত হয়ে আসে। চায়ের কাপ রেখে দেয় টেবিলে। চেয়ারে বসে নাশতা খেতে মনোযোগ দেয়। খাবার গলা দিয়ে নামল না। পেটে ক্ষিধে থাকার পরও মনের শূণ্যতার কারণে ঠিকমতো খেতেও পারছে না। অসহায় পরিস্থিতি তাকে কাবু করে ফেলছে মুহূর্তেই। নিজেকে সামলে নিয়ে মন শক্ত করে খাবার গিলে নেয়। যেন খেতে হবে, এইজন্য খাওয়া। নয়তো এই খাবার তারজন্য অস্পৃশ্য হয়ে যেত সে-ই কবেই!

কাছে থেকে শায়লা সুলতানা মেয়েকে দেখছেন। এসব তাঁর মোটেও ভালো লাগছে না। সম্পর্ক নিয়ে এত মাতামাতির কি! তা-ও যে নেই, তাকে নিয়ে! যদি সামনে থাকত, তবে এতটা আপসেট হলে মানা যেত। শক্তপোক্ত মেয়েটাকে দিনদিন অসহায়ত্ব খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে। তিনি কাছে থেকেও মেয়েকে সামলাতে পারছেন না। সামান্য কিছু বলতেও পারছেন না। শুধু দেখছেন। আর আফসোস করছেন। এইযে অদৃশ্য এক বোবাকান্না হাসিখুশি মেয়ের ভেতরটাকে তছনছ করে দিচ্ছে, তিনি মা হয়ে তা দেখতে পাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু মেয়েকে পর্যাপ্ত আশার বাণী শোণাতে পারছেন না। এমন জঘন্য পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে জানলে, বিয়েটাই তখন দিতেন না। নিজেদের ভুলে, নিজেরাই হা-হুতাশ করছেন। মাঝখান থেকে একটা অবুঝ মেয়ে শাস্তি পাচ্ছে। এক মায়ের কাছে দিনের পর দিন এই দৃশ্যটা যন্ত্রণার। খেতে খেতে নীরবে মেয়েকে পর্যবেক্ষণ করে মুখ খুললেন শায়লা সুলতানা। ধীরস্থিরভাবে বললেন,

-‘ঠিক এই কারণেই আমি চাইনি, তুই দেশে আসিস। কথা তো শুনলি না। এখন এত আপসেট হয়ে কাজ আছে! ভুলে যা ওসব। পুতুল পুতুল খেলা আর দুঃস্বপ্ন ভেবে মন থেকে মুছে ফেল সব। পনেরো বছর পর দ্যাখা হওয়া, উত্তর খুঁজে পাওয়া, এসব নাটক-সিনেমাতেই ভালো মানায়। বাস্তবে এসবকে ঘিরে কেউ কোনোদিন জীবন থামিয়ে রাখেনি। তুইও থামিয়ে রাখিস না, মা। এগো সামনের দিকে। কিছু একটা সিদ্ধান্ত নে।’

মাহদিয়া শক্তচোখে মায়ের দিকে তাকাল। কতকিছু বলার ইচ্ছে হলো, রাগ দেখাতে, বকা দিতে মন চাইল। কিন্তু কিছুই বলতে পারল না। শুধু ঠাণ্ডা মাথায় নিজের সিদ্ধান্তের ওপর দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থেকে বলল,

-‘রাখো তোমার যুক্তি। এসব শুনিয়ে আমাকে ফেরাবে ভাবছ? ওদের না খুঁজে আমি ইতালি ব্যাক করব, এটা চাইছ? তবে শোনে রাখো, গল্প-উপন্যাস, নাটক-সিনেমায় কী হয়, নাহয় এসব নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আমার মাথাব্যথা নিজের জীবন ও জীবনের সুখ-সাচ্ছন্দ্য নিয়ে। ওদের ফিরে পেলে কী সিদ্ধান্ত নিব, সেটা এখনও ডিপেন্ড করছে আমার মনের জোর ও ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। তাই আগেভাগে এই নিয়ে কোনো পজেটিভ নেগেটিভ সিদ্ধান্ত আমি তোমাকে জানাতে চাই না। এমনকি নিজের দুর্বলতা ও অসহায়ত্ব কারও সামনে প্রকাশ করতে চাই না। আর যদি ওদের না-ও পাই, তবুও দিনশেষে আমি একা বাঁচতে পারব। এরজন্য ওই কাগজটাকে দুঃস্বপ্ন কিংবা পুতুল পুতুল খেলা ভেবে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিতে পারব না।’

***

সকালের নাশতা শেষ করে দুইভাই একসাথেই বেরিয়েছে। উদ্দেশ্য, শিহাবকে স্কুলে নামিয়ে সে হসপিটালের দিকে যাবে। গাড়িতে বসে ট্যুরে যাওয়া নিয়ে অসংখ্য কথার ফুলঝুরি খুলে বসল শিহাব। ব্যাগপ্যাকে কী কী নিবে, কোথায় কোথায় ঘুরবে, সবকিছু আগ্রহচিত্তে বলে যাচ্ছে। শাদাব মন দিয়ে শুনছে, হাসছে, আবার মাথা নেড়ে সায় জানাচ্ছে। ভাইকে স্কুলের গেটে নামিয়ে দু’মিনিট রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইল শাদাব। শিহাব বিদায়ের আগে প্রতিদিনের অভ্যাস অনুযায়ী চুমু খেয়ে দৌড় দিল। শাদাব গাড়িতে বসে স্পেস পাওয়াতে নিজের ফোন বের করে নূরুন্ নাহারের নম্বরে ডায়াল করল। সেদিন ফোন একটা ভাঙলেও বাড়তি আরেকটা ফোন ছিল তার, তা-ই নতুন ফোন কেনার ঝামেলায় না গিয়ে এটাতেই সিম ঢুকিয়ে নিয়েছিল, কাজের সুবিধা-অসুবিধার কথা ভেবে। নূরুন্ নাহার ফোন রিসিভ করে নীচু গলায় কথা চালিয়ে গেলেন। গতকাল সে অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, শ্রীমঙ্গল যেহেতু যাবে, মাহদিয়ার সাথে দেখা করবে। এই ব্যাপারে নূরুন্ নাহারের সাহায্য তার দরকার। ভদ্রমহিলার গলার আওয়াজ শোনেই বুঝল, কাছেপিঠে কেউ আছে এজন্য তিনি ফিসফিস করে কথা বলছেন। কে আছে সেটা জানার আগ্রহ না দেখিয়ে নিজের দিক ক্লিয়ার করে বলল,

-‘খালা, একটা জরুরী প্রয়োজনে তোমাকে ফোন করেছি। আমি জানি না ভ্রমর কেন এসেছে! এতগুলো বছর পর সে কীসের আশায় ছুটে এসেছে এটাও নিশ্চিত নই। আমি ও’কে কেন এড়িয়ে যাচ্ছি, সেটা শুধু আমি জানি। অতীতের সব দৃশ্য, সব কথা আজও তোমরা জানো না। যা আমি জেনেছি, সেসব আমার মধ্যেই থাক। আমি চাইনি, কেউ আমার মতো পরিস্থিতিতে পড়ুক। কিন্তু, এতদিন পর ভ্রমর এসে সব এলোমেলো করে দিচ্ছে। আমি নিজের সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারছি না। মনে হচ্ছে সব সত্যের মুখোমুখি হওয়া উচিত। যা হয় হবে, আমি ওর সামনে দাঁড়াতে চাই। তুমি শুধু ও’কে একটু ম্যানেজ করে আগামী শুক্রবারে ‘গ্রান্ড সুলতান’-এ পাঠাও। বাকিটা আমি সামলে নিতে পারব।’

নূরুন্ নাহার এতে খুশি হলেন। মাহদিয়ার করুণ হৃদয়ের আর্তনাদ তিনি সহ্য করতে পারছেন না। শাদাব যতই মাহদিয়াকে এড়িয়ে যাওয়ার অজুহাত দেখাক, সম্পর্কটাকে সে-ও তুচ্ছ কিংবা ছেলেখেলা ভাবতে পারছে না আর। এতদিন মাহদিয়া সামনে ছিল না দেখে এড়িয়ে যেতে পেরেছে। কিন্তু এখন! এখন সব পরিস্থিতি পালটে গিয়ে নিয়তি দু’জনকেই কঠিন সময়ের সামনে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে। চাইলেও যা আর মিথ্যে বলে অস্বীকার করা যাচ্ছে না। শাদাবের এই সিদ্ধান্তে তিনি যতখানি খুশি হলেন, দ্বিগুণ ভয়ও পেলেন। ফিসফিস কণ্ঠে বললেন,

-‘কিন্তু ছোটোনকে কী করে ওই পরিস্থিতির সামনে দাঁড় করাবে?’

শাদাবের যত ভয়, যত দুঃশ্চিন্তা এক ভাইকে ঘিরেই। কিন্তু কিছু করার নেই। সত্যকে এড়িয়ে যাওয়ার মতো এতটাও কাপুরষ সে নয়! মাহদিয়ার সামনে নিজের বিবেক-বুদ্ধি ও সততাকে কোনোদিন ছোটো হতে দিবে না। সবদিক সামলে নিয়েই দেখা করতে হবে। অনেক ভেবেচিন্তে মনকে স্থির করে বলল,

-‘চিন্তা কোরো না। ঠিক পারব। তুমি ও’কে একা পাঠাবে না। চাচ্চুকে সাথে করে পাঠাবে। বলবে না যে, আমি ওর সাথে দ্যাখা করব।’

-‘এই বলছ দ্যাখা করবে, এই বলছ গোপন রাখতে!’

-‘খালা! তুমি এতটাও বোকা নও। আমি বলতে চাইছি, তোমার সাথে যে আমাদের যোগাযোগ আছে সেটা যেন কেউ না জানে। এখন তুমি ভ্রমরকে কীভাবে রাজি করাবে সেটা তুমি জানো। যা করার তোমাকেই করতে হবে। এখন রাখছি। সময়মতো পাঠাবে কিন্তু। না পাঠালে আমি কিন্তু অন্য অপশন দ্যাখতে বাধ্য হব।’

নূরুন্ নাহার শব্দ করে হেসে ফেললেন। ফোন রেখে মা-মেয়ের কথোপকথনের সামনে গিয়ে হাজির হলেন। শায়লা সুলতানা মেয়ের মুখ থেকে এমন কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না মোটেও। তাই তিক্ত এই বুলি তার সহ্য হলো না। তিনি চলে গেলেন। নূরুন্ নাহার পাশে বসে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বললেন,

-‘মন খারাপ?’

-‘একটুও না। আমি ঠিক আছি।’

জোর গলায় বলল মাহদিয়া। নূরুন্ নাহার হাসলেন। বললেন,
-‘কেমন ঠিক আছো, সেটা তোমার মুখ দ্যাখেই বুঝা যাচ্ছে।’

উত্তরটা গলার কাছে এসে আটকে গেল। বলতে পারল না, নিজের মা নারী ছেঁড়া ধনকে বুঝতে পারে না, সেখানে অন্য কেউ বুঝে ফেলবে, এটা আকাশচুম্বী ভাবনা ও অযৌক্তিকই বটে। কিন্তু সে নূরুন্ নাহারকে কষ্ট দিতে পারল না। চুপ হয়ে খেতে লাগল। নূরুন্ নাহার আমতা-আমতা গলায় বললেন,

-‘একটা কথা বলি?’

ঘাড় নেড়ে অনুমতি দিল মাহদিয়া। তিনি স্বাভাবিকভাবেই বললেন,
-‘তোমার মনের ওপর চাপ যাচ্ছে, এটা আর কেউ না বুঝলেও আমি বুঝতে পারছি। তাই একটা বুদ্ধি দিতে এসেছি। যদি নিতে চাও, অনেক উপকার হবে।’

-‘যেমন?’

মাহদিয়ার চোখেমুখে কৌতূহল ফুটে উঠল। নূরুন্ নাহার সাহস সঞ্চয় করলেন। রাজি না হলে আরেক ঝামেলা। শাদাব স্বেচ্ছায় ফোন করবে না, কথা বলবে না, কিন্তু অন্য উপায় অবলম্বন করবে। যে করেই হোক মেয়েটাকে রাজি করাতে হবে। সমস্ত জড়তা কাটিয়ে তিনি আদেশের সাথে বললেন,

-‘কোথাও গিয়ে ঘুরে আসো। মন-মেজাজ ভালো হলে, দুটো মানুষকে খোঁজার মতো ধৈর্য্যশক্তি পাবে।’

অসহায় চোখে তাকাল মাহদিয়া। বলল,
-‘আমি এখানকার কিচ্ছু চিনি না। একদিন একা বেরিয়েই মাথাটাথা ফাটিয়ে এসেছি। আবার বের হলে, নির্ঘাত লা শ হয়ে যাব। দরকার নেই শখ করে যমের দুয়ারে যাওয়ার।’

-‘আহা। এত দুঃশ্চিতার কী আছে? তুমি তো একা যাবে না। ছোটো ভাইজানকে সাথে নিয়ে যাও। ঘুরেটুরে মন ফ্রেশ করে, এরপর ওদেরকে খুঁজতে নামো। যেহেতু সময় নিয়ে এসেছ। তাড়াহুড়ো করে খুঁজতে গিয়ে নিজেকে অসুস্থ কোরো না। ধৈর্য নিয়ে ধীরেসুস্থে খোঁজো। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সহায় হবেন।’

-‘কিন্তু যাব কোথায়?’

-‘কেন? ঘোরাঘুরির জন্য কত জায়গা আছে এখানে।’

-‘একা পারব না। ছোটো মামার ক্লাস থাকবে প্রতিদিন। আমাকে নিয়ে ট্যুর দেয়ার মতো সময় রোজ পাবেন না তিনি। টুরিস্ট গাইড হলে ঘোরাঘুরি করা যাবে।’

-‘ওসব নিয়ে টেনশনের কিচ্ছু নেই। আগে একটা ফাইভ স্টার রেস্টুরেন্ট বুকড করে নাও, তারপর টুরিস্ট গাইড চাইলে ওরাই দিয়ে দিবে। অবশ্য ব্যক্তিগত গার্ডিয়ান থাকলে ওসব গাইড-পাইড লাগে না।’

শেষটুকু তিনি বড্ড মিনমিন করে বললেন, মাহদিয়া সে কথা শুনল কি-না বোঝা গেল না। সে ততক্ষণে রেস্টুরেন্ট বুকড করার জন্য ভালো ভালো ফাইভ স্টার রেস্টুরেন্টের নাম খুঁজতে লাগল। একসময় পেয়েও গেল। কাছেপিঠে থাকা সেই ‘গ্রান্ড সুলতান’ নামক হোটেল। ঝটপট রুম বুকিংয়ের কাজ শেষ করে বলল,

-‘ট্যুর দেয়ার পরও যদি মনের জোর পরিপূর্ণভাবে ফিরে না আসে, ভাগ্য যদি আমার সহায় না হয়, তাহলে তোমাকে ধরেবেঁধে ওই দু’জনকে খুঁজতে মাঠে নামব। তখন বাহানা দ্যাখালে কিন্তু কিচ্ছু শুনব না খালা।’

***

চলবে…