#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_৫৮ [অন্তিম পর্ব]
#Esrat_Ety
[ ৫৮ পর্বের ১ম অংশ ]
[এটা অন্তিম পর্বের ১ম অংশ। ২য় অংশ এখনই পোস্ট করা হবে 🌼]
ক্যালেন্ডারের পাতায় টিক চিহ্ন এঁকে দিয়ে আরো একটি দিনের সমাপ্তি ঘটায় আলো। আজ উনত্রিশে এপ্রিল। ডেলিভারির তারিখ চৌঠা মে। মাত্র পাঁচদিন হাতে সময়। অভিজ্ঞদের মতানুযায়ী আলোর শারীরিক যন্ত্রণা একটু একটু করে শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু আলো তেমন কিছুই টের পাচ্ছে না। অবশ্য দিনে অসংখ্যবার একজন দুষ্টু প্রাণ নিয়ম করে ফুটবল খেলছে পেটের মধ্যে। মাকে জানাচ্ছে,”মা আমি আসছি। তুমি আর বাবা তৈরি তো?”
দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ হয়। খোলার আগে আয়নায় একবার নিজেকে দেখে নেয় আলো। তারপর দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
দরজা খুলে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে থাকে আলো। সামিন এদিক ওদিক তাকিয়ে আলোকে শুরুতেই একটা চু’মু খেয়ে ঘরে ঢুকে দরজা চাপিয়ে দেয়। আলো গম্ভীর হয়ে আছে। সামিন আলোর হাত ধরে টেনে নিয়ে নিজে বিছানায় বসে আলোকে কোলে বসায়। আলো রাগী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন আলোর পেটে হাত রেখে আদুরে কন্ঠে বলে,”জ্বা’লিয়েছে নাকি আজ খুব? মেজাজ এতো চ’টে আছে কেন?”
আলো সামিনের হাত সরিয়ে দিয়ে বলে,”আপনি আমাকে না জানিয়ে ডক্টর আফসানার সাথে কথা বলেছেন?”
সামিন আলোকে উঠিয়ে নিজেও উঠে দাঁড়ায়। হাত ঘড়ি খুলে টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে বলে,”হু।”
_কেন? আচ্ছা আপনি কেন বুঝতে চাইছেন না আমি একটা নরমাল ডেলিভারি চাই। আপনি এতো জে’দ করছেন কেন?
_জেদ তো তুমি করছো। যেখানে তোমার শরীর বুঝতে চাইছে না সেখানে আমি বুঝে কি করবো? বাড়াবাড়ি করবে না আলো একদম। বেবি সি-সেকশনের মাধ্যমেই হবে।
আলোর ইচ্ছে করছে রাগে নিজের চুল ছিঁ’ড়তে। কিন্তু তাকে উত্তেজিত হলে চলবে না। সামিন গাঁয়ের মুজিব কোট খুলে পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নেয়।
আলো তোয়ালে বের করে দাঁড়িয়ে আছে। পরী দরজার বাইরে এসে দাঁড়ায়। মৃদু আওয়াজে বলে,”আসবো ভাবী?”
_কেনো? কি কাজ?
কাটকাট বলে ওঠে আলো।
পরী চুপচাপ ঘরে ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকে । আলো তার দিকে শীতল দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। পরী আলোর দৃষ্টি দেখে ভ’য় পেয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে ওঠে,”ভাইয়া এসেছে?”
_ভাইয়ার জন্য এই ঘরে আসোনি। কেনো এসেছো ঝেড়ে কাশো। ইশমাম পাঠিয়েছে? কেনো ওর সাহস নেই? তোমাকে দিয়ে পথে শিশির কাটায়!
পরী নিচু স্বরে বলে ওঠে,”তোমার কাছে বলতে নাকি লজ্জা পায় উনি।”
আলো চুপ করে থেকে বলে ওঠে,”তিন তিনবার মানুষটাকে দুজন মিলে ফিরিয়ে দিয়েছো। এখন এতদিন পরে মনে হচ্ছে তোমরা দুজন দুজনকে পছন্দ করো। আমাদের বললে আর আমরা নাচতে নাচতে রাজি হয়ে যাবো? কি ভাবো কি আমাদের?”
পরী চুপ করে থাকে। কেনো যে লা’জ শরমের মাথা খেয়ে এখানে এলো!
আলো অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ঠোঁট টিপে হেসে নেয়। তারপর কন্ঠে গাম্ভীর্য ভাব এনে বলতে থাকে,”আমাকে বলেছো বলেছো। এই কথা ইয়াসার মির্জাকে বলতে যেও না। কাঁচা খেয়ে নেবে দুটোকে। আর একটা কথা, তোমার না সামনের মাসে এক্সাম? তুমি পড়াশোনা বাদ দিয়ে!”
_ভাবী,উনি চাইছিলেন আমেরিকা যাওয়ার আগে বিয়েটা….
_বিয়ে? সে আর হচ্ছে! যাও এখান থেকে।
পরী মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। সামিন ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”কে এসেছিলো?”
_পরী।
_আবার কি?
_সেই এক গান।
সামিন মৃদু হেসে ফেলে। আলো বলে ওঠে,”বলছিলাম কি! এবার একটু কঠোর হয়ে যাচ্ছি না আমরা ওদের প্রতি? ওরা তো ওদের যায়গায় ঠিক , দেখুন এটা ২০২৩ সাল, আমরা জোর করে দু’জনের বিয়ে দিয়ে দিলাম আর ওরা সংসার করতে শুরু করলো এটা তো আশা করলে চলবে না, তারচেয়ে দুজন নিজেরা নিজেরা ধীরে ধীরে একে অপরের প্রতি অনূভুতি জরো করেছে এটাই তো ভালো হয়েছে তাইনা? আর সবাই কি আলো নাকি যে জোর করে বিয়ে হলেই মানিয়ে নেবে!
শেষের লাইনটা সামিনকে খোঁ’চা মে’রে বলে আলো,সামিন আলোকে টেনে নিজের কাছে এনে বলে,”আচ্ছা! মানিয়ে নিয়ে খুব দুঃখ হচ্ছে দেখছি!”
_দুঃখ না! কষ্ট হচ্ছে! আমার পেটে কষ্ট হচ্ছে। লা’থি দিচ্ছে।
চাপা স্বরে চেঁচিয়ে বলে ওঠে আলো।
সামিন তৎক্ষণাৎ হাঁটু গেড়ে বসে পরে। পেটের ওপর থেকে শাড়ির অংশটা সরিয়ে উন্মুক্ত পেটে চু’মু খায়। পেটে কান পেতে উচ্ছসিত গলায় বলে,”ওয়েল ডান আম্মা! কিন্তু আম্মা,এখন যতো পারেন শা’য়েস্তা করে নিন মাকে। বাইরে এলে আর পারবেন না মায়ের সাথে। আমি যেমন পারিনা। সবাইকে লেজে*গোবরে করে রাখে এই মহিলা।”
আলো হাত দিয়ে মুখ চেপে হাসছে। সামিন মাথা তুলে আলোর দিকে তাকায়। উঠে দাঁড়িয়ে বলে,”ভূরিভূরি ম্যাটার্নিটি ড্রেস এনে দেওয়া হয়েছে। তারপরও শাড়ি কেনো পরো? একটু আরামদায়ক কিছু পরো।”
আলো ম্লান হেসে বলে,”মাত্র দশঘন্টা কাছে পাই আপনাকে,তার মধ্যে আটঘন্টা ঘুমান। বাকি থাকে দুঘন্টা,ঐ দুঘন্টা একটু সেজেগুজে আপনার সামনে থাকতে ভালো লাগে মেয়র সাহেব।”
সামিন আলোকে আগলে নিয়ে বলে,”তুমি আমাকে এখনও মেয়র সাহেব কেন ডাকো? তোমার স্বামী একজন সাংসদ সেটা ভুলে যাও নাকি? ”
_সে আপনি সাংসদ, মন্ত্রী, মিনিস্টার যাই হোন না কেনো। আমার কাছে আপনি বরাবর আমার মেয়র সাহেব থাকবেন।
সামিন মৃদু হেসে আলোর কপালে চু’মু খেয়ে বলে,”তুমি খুব রাগ করো আমি তোমাকে সময় দিতে পারিনা বলে? অথচ আমি কথা দিয়েছিলাম সবসময় তোমার পাশে থাকবো।”
আলো হেসে বলে,”মোটেও রা’গ করি না। আচ্ছা আজ খবরে দেখলাম কবীর আলমগীরকে কানাডার বাড়িতে ঢুকতে না দিতে ওখানকার বাংলাদেশী অভিবাসীরা এ্যাম্বাসিতে আন্দোলন করেছে। ও এখন কোথায় পালাবে?”
_কোথায় আবার, ইতালি। ওর ছোটো ভাইয়ের কাছে। জুঁইও তো সেখানে। ওখানকার একজন বিজনেস ম্যানকে বিয়ে করে নিয়েছে।
_আর জাবির? ওর তো সাজা এখনও শেষ হয়নি!
_হু,তবে ওর ফুপা ঢাকা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। চেষ্টা চালাচ্ছে।
আলো শুকনো গলায় বলে,”ওকে জামিন দিয়ে দেবে? এতো বড় একটা স্কা*উন্ড্রেলকে!”
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”ওকে স্কা*উন্ড্রেল বলছো,আমার গায়ে লাগছে।”
_ওমা ! তা কেনো?
_ওই তো। আমিও তো তোমাকে তুলে এনেছিলাম।
আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন হেসে ফেলে। তারপর
আলোর গালে একটা চু*মু খেয়ে বলে,”আমি খেতে যাচ্ছি। তুমি রেস্ট নাও।”
***
পেছন থেকে জাপ্টে ধরতেই ইশিতা লাফিয়ে ওঠে প্রথমে। তারপর নিজেকে ধা’তস্থ করে শান্তকে একটা ধ’ম’ক দিয়ে বলে,”কি হচ্ছে কি! সবসময় এমনভাবে জাপটে ধরো মনে হয় যেনো লাফিয়ে লাফিয়ে চোর ধরছো।”
শান্ত নিস্তেজ গলায় বলে,”বাপের বাড়ি আসলেই দেখছি গলার জোর বেড়ে যায় খুব। বাড়িতে তো খুব পতি’ভক্তি দেখাও।”
ইশিতা হেসে ফেলে। শান্তর গলা থেকে টাইয়ের নট খুলতে খুলতে বলতে থাকে,”এলে কেনো?”
_একা একা অত বড় বিছানায় ঘুমাতে পারি না। এমনিতে তোমার বাপের বাড়ি আসার আমার কোনো শখ নেই!
ইশিতা বলে,”হুম! সেটা খুব বোঝা হয়ে গিয়েছে আমার।”
শান্ত এগিয়ে গিয়ে ইশিতার কোমর জড়িয়ে ধরে ঘোর লাগা কন্ঠে বলে ওঠে,”কি ব্যাপার। আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে দেখছি!”
এমন সময় ইশমাম ঘরে ঢুকে পরে। শান্ত আর ইশিতা লাফিয়ে দুজন দুদিকে সরে দাঁড়ায়। ইশমাম বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। ইশিতা চেঁ’চিয়ে ওঠে,”নক করে ঢুকতে পারিস না স্টু’পিড! তুই কি বড় হবি না!”
শান্ত বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,”এইজন্য তোমার বাপের বাড়ি আমি আসতে চাইনা।”
_তো আসো কেন? নেমন্তন্ন ছাড়া শশুর বাড়িতে কোনো জামাই এতো ঘনঘন আসে এটা তোমায় না দেখলে জানতামই না। আমার ভাইদের দেখেছো কখনো ঘনঘন শশুর বাড়ি যেতে?
ইশমাম ঠান্ডা গলায় বলে।
_আমি তো আমার বৌয়ের প্রোপার্টি বুঝে নিতে আসি।
হাসতে হাসতে শান্ত বলে।
ইশিতা কপাল কুঁচকে ইশমামকে বলে,”তুমি তুমি কি বলছিস? দুলাভাই তোর। আপনি বল!”
_তুই আমার থেকে তিন মিনিটের বড় মাত্র। আমার আপু নোস!
শান্ত গা থেকে ব্লেজার খুলতে খুলতে বলে,”তো শা’লা! কি দরকারে এলে এই ঘরে?”
ইশমাম দরজা চাপিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে যায়। ইশিতা বলে,”কি? আবার সেই ঘ্যান ঘ্যানানি? আমার কাছে এসে কোনো লাভ নেই। আমি কিছু পারবো না।”
শান্ত দুই ভাই বোনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে,”কি? পরীর ব্যাপারে? তো ইয়াসার মির্জার সাথে কথা বললেই তো হয়। এতো ভ’য় পাওয়ার কি আছে!”
_কে কথা বলবে? তুমি বলবে? ভাইয়া তিন তিনবার ওদের বিয়ের কথা উঠিয়েছে,ওরা তিন তিনবার ভাইয়াকে রি’জেক্ট করেছে। এখন আর ভাইয়া মানবে না। ইয়াসার মির্জার রা’গ সম্পর্কে তোমার কোনো আইডিয়া নেই।
ইশিতা শান্তর দিকে তাকিয়ে বলে।
শান্ত বলে,”শালাবাবু আমেরিকা যাওয়ার আগে অন্তত যদি আংটি বদল করে রাখা যেতো তাহলে বেশ হতো। ছয়মাস পরে আমেরিকা থেকে ফিরলে না হয় বিয়েটা দিয়ে দিতাম।”
ইশমাম চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। ইশিতা বিরস মুখে বলে,”সেটাই! কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টাটা বাঁধবে কে? হু উইল বেল দ্যা ক্যাট! আমি তো পারবো না বাবা! বড় ভাবীই যেখানে পারছে না সেখানে আমি তো দুধ ভাত।”
ইশমাম চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। করিডোর থেকে নিজের ঘরে যাওয়ার পথে পরীর সাথে দেখা। দুজন দুজনকে দেখে অন্যদিকে তাকিয়ে হাঁটতে থাকে। তারপর পাশ কাটিয়ে চলে যায়। ইশমামের প্র’জেক্টের ব্যস্ততা,পরীর লেখাপড়ার ব্যস্ততায় যেটুকু কথা হয় তা ফোনকল কিংবা মেসেজে। সামনাসামনি কখনই অনূভুতি ব্যক্ত করা হয়ে ওঠেনি কারো।
খাবার টেবিলে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছিল। ইলহাম ইরফানকে নিয়ে নিচতলার লিভিং রুমে পায়চারি করছে। ইরফানের এগারো মাস পূর্ন হতে চলেছে। বাবা তাকে ছড়া শোনাচ্ছে,সে হাসতে হাসতে কুটিকুটি হচ্ছে।
খাবার টেবিলে খেতে বসেছে সামিন,শান্ত,ইশমাম।
ইশিতা আর রিতু পরিবেশন করে দিচ্ছে। খেতে খেতে সামিন আড়চোখে ইশমামের দিকে একপলক তাকায়, কিছু সময় পরে ইশমামকে শুনিয়ে শুনিয়ে রিতুকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,”পোনা চাচা গ্রাম থেকে ফোন দিয়েছিলো। পরীর জন্য একটা ছেলে দেখেছে। ছেলে ডাক্তার। বয়স বেশি না। ভালো ঘরের, পরীর ছবি দেখেই বেশ পছন্দ করে ফেলেছে।”
ইশমাম খাওয়া থামিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকায়। সামিন ইশমামের দৃষ্টি উপেক্ষা করে বলতে থাকে,”ছেলের ঠিকানা দিয়েছে আমায়। ভাবছি কাল দেখা করবো। পোনা চাচা বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে তার অনেক ইমোশন। তাই বিয়েটা তাড়াতাড়ি দিয়ে দেই। কি বলো রিতু? তোমার ভাবীও সবসময় বলে।”
রিতুর ভাসুরের থেকে চোখ সরিয়ে ইশমামের দিকে তাকায়। শান্ত আর ইশিতাও খাওয়া থামিয়ে ইশমামের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইশমামের খাওয়া হয়ে গিয়েছে তাই জলদি জলদি হাত ধুয়ে উঠে পরে।
সামিন চুপচাপ খেতে থাকে। হঠাৎ করে ফোনের ভাইব্রেশনের শব্দে তাকিয়ে টেবিলের ওপর ইশমামের ফোনটা দেখতে পায়। ফোনটা ভুলে ফেলে রেখে গিয়েছে। সামিন হাত বাড়িয়ে ফোনটা তুলে নিয়ে স্ক্রিনে চোখ রেখে বলে,
“শান্তনা পুরস্কার! এটা আবার কেমন নাম? কে ফোন দিচ্ছে ইশমামকে!”
ইশমাম দ্রুত পায়ে ছুটে এসে ছো মে’রে সামিনের হাত থেকে ফোন কে’ড়ে নিয়ে চলে যায়। সামিন সবার মুখের দিকে তাকায়। শান্তনা পুরস্কার কে আবার! সে বুঝতে পারছে না!
ইশিতা আর শান্ত হাসি চাপিয়ে রেখে চুপচাপ খাচ্ছে।
***
ইরফানের পাশে ঘুমন্ত ইহানকে শুইয়ে দেয় ইলহাম । ইহান এতক্ষণ আলোর কাছে ঘুমিয়ে ছিলো। সেখান থেকেই তুলে আনা হয়েছে।
ইলহাম রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”আমাদের জন্য বিছানায় আর কোনো জায়গা রইলো না যে রিতু!”
_মেঝেতে বিছানা পাতবো?
_সেটাই করো। দু’জনে কিভাবে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে দেখো। ভাবটা এমন যেনো এই মুল্লুক আমার! দু’টোর মধ্যে একটা গু’ন্ডা গু’ন্ডা ভাব আছে, আমি খেয়াল করেছি। বড় বাবার মতো হবে দুজন সম্ভবত, পলি*টিশিয়ান।
_হ্যা, তেমনই হোক! বাবার মতো রে*পিস্ট না হলেই হলো!
ইলহাম থমথমে মুখ নিয়ে রিতুর দিকে তাকায়। রিতু হাসতে হাসতে বলে,”দুঃখিত! এই কান ধরলাম। আর বলবো না!”
ইলহাম কোনো কথা না বলে বড় আলমারি থেকে ম্যাট্রেস বের করে মেঝেতে বিছিয়ে দেয়। রিতু সুন্দর একটা বিছানার চাদর বিছিয়ে দেয়। ইলহাম একটা বালিশ এনে রাখে। রিতু ইলহামকে দেখে, হাতে হাতে সব কাজে রিতুকে সাহায্য করার চেষ্টা করে। ইরফানের দেখভাল করতে সবসময় সচেষ্ট থাকে। চেহারায় কেমন একটা মুরব্বি মুরব্বি ভাব এসেছে। পোশাক আশাকের স্টাইল নিয়ে অতটা ভাবে না আগের মতো। নয়টা-পাচটা অফিস করে বাড়িতে এসে একটা টিশার্ট আর ট্রাউজার পরে ইরফানকে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করে, ইহানকে পড়াতে বসায়। ফোন ঘাটে না আগের মতো, ক্লাবে যায়না।
রিতু কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ওয়াশ রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে আসে। ইলহাম রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”এটা কি পরেছো!”
রিতু নিজের দিকে তাকিয়ে ইলহামের দিকে তাকায়, তারপর বলে,”কেনো! নাইটড্রেস।”
ইলহাম তাকিয়ে থাকে,কয়েক মূহুর্ত পরে বলে,”শাড়ি পরো।”
_কেন? ভালোলাগছে না? জুঁই পরলে তো তখন নিশ্চয়ই মুগ্ধ হয়ে দেখতেন।
ইলহাম রিতুর দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে ঠান্ডা গলায় বলে,”জুঁইদের নাইট*ড্রেস পরতে হয় বয়*ফ্রেন্ডকে মুগ্ধ করতে। রিতুরা শাড়ি পরেই স্বামীদের মুগ্ধ করতে পারে।”
রিতু গিয়ে নাইট*ড্রেস পালটে একটা সুতির শাড়ি পরে আসে। ইলহাম কিছুক্ষণ তাকিয়ে রিতুকে দেখে বলে ওঠে,”ঘুম আসছে না। চলো বারান্দায় গিয়ে বসি।”
***
প্রায় ত্রিশ মিনিট যাবত কানের সাথে ফোনটা চেপে ধরে রেখেছে। গম্ভীর কন্ঠে শুধু হু হা করে যাচ্ছে।
আলো জানালার কাছে দাঁড়িয়ে জোৎস্না দেখছিলো। মাথা ঘুরিয়ে সামিনকে একপলক দেখে তারদিকে এগিয়ে আসে। পেটে হাত চেপে ধীরে ধীরে তার পাশে বসে তার কাঁধে মাথা রাখে। সামিন ফোনে কথা বলতে বলতে তাকে আগলে নেয়।
দীর্ঘসময় পরে ফোন কেটে আলোর দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে,”কি হয়েছে? শরীর খারাপ করেছে?”
_না। হাত পায়ে কেমন একটা করছে শুধু।
সামিন উঠে আলোকে বিছানায় উঠিয়ে তার হাত পায়ের তালুতে মাসাজ করে দিতে থাকে আলোর বারণ সত্তেও।
_কার সাথে এতক্ষণ কথা বলছিলেন আপনি? মোটে দুঘন্টা আপনার সাথে কথা বলার সময় পাই। তার ভেতর থেকেও আধাঘণ্টা আপনি যদি রাজ*নীতিকে দিয়ে দেন তাহলে তো সেটা মানা যায়না!
সামিন মৃদু হেসে বলে,”আজ ক্ষ*মা করে দাও । আসলে জেলা দল থেকে অনেককে ছাঁটাই বাছাই করতে হচ্ছে। নয়তো দলকে ডুবিয়ে ছাড়তো কবীর আলমগীরের মতো।”
_সভাপতি হতে না হতেই ক্ষমতা দেখাতে শুরু করে দিয়েছেন?
_না, জনগণের কল্যাণে করতে হচ্ছে। এরা হচ্ছে কাল কে*উটে। একসময় নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থে আমাকে দল থেকে বের করতে চেয়েছিলো।
আলো কিছুক্ষণ সামিনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,”আচ্ছা আপনি কখনো দুর্নীতি করেন না? রাজনীতিতে কেউই ১০০ % সৎ থাকতে পারে না।”
সামিন হেসে ফেলে,হাসতে হাসতে বলে,”ছোটো খাটো দূর্নীতি করা হয়। একেবারেই যে করি না এমন নয়।”
আলো শীতল চোখে সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন উচ্চশব্দে হাসছে। আলোর গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,”দূর্নীতি করলে আজ কানাডায় একটা বাড়ি থাকতো। বৌয়ের নামে চার পাঁচটা ব্যাংক একা*উন্ট থাকতো। অবশ্য সবে তো সব শুরু। দেখি কি হয়।”
_কানাডায় বাড়ি করার কি প্রয়োজন? আমাদের শান্তিনীড়ের বাড়িতে কি শান্তি কম পরেছে!
_এই দেখো! এখন তুমিই কিন্তু রাজ*নীতি নিয়ে পরে আছো।
আলো প্রসঙ্গ পালটে বলে ওঠে,”কাল কি আপনি ব্যস্ত থাকবেন?”
_হ্যা। কাল অপজিশন পার্টির সাথে বৈঠক আছে।
_কেন? কোন আনন্দে?
_প্রেসক্লাবে ভাঙচুরের ঝামেলা নিয়ে বসতে চাচ্ছি। একটা মধ্য*স্থতা করা দরকার।
_ফের ঐ সাগর নিজের গদিতে শক্ত পোক্ত হয়ে বসেছে।
_হুম। মাঝখানে যখন হজ্ব করতে গিয়েছিলো তখন বেশ অবাক হয়েছিলাম। ভাইয়ের মৃ*ত্যু, শমশের ভুঁইয়ার স্ট্রো*কের পরে বিছানা নেওয়া। ভেবেছি আর মাথা তুলে দাড়াতেই পারবে না।
_এখন তবে? ওকে নিয়ে যে আমার ভয়। সাংঘাতিক একটা লোক।
সামিন হেসে ফেলে, তারপর বলে,”আমি তো খুশি হয়েছি!”
_কেন?
আলো অবাক হয়ে জানতে চায়।
সামিন বলে,”রাজনীতির পথটা স্মুথ হলে মজা কোথায়? ওর মতো নির্লজ্জ বি’ষাক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী দরকার। হাড্ডাহাড্ডি ল*ড়াই না হলে ভালো লাগবে না।”
আলো তাকিয়ে আছে সামিনের কথা শুনে। সামিন বলতে থাকে,”তাছাড়া গল্প কি এখানে শেষ? গল্প চলতে থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। না ও ওর গদি ছাড়বে,না আমি আমার গদি ছাড়বো। আমাদের ছেলেমেয়েরাও ওর ছেলেমেয়ের সাথে ল’ড়বে।”
আলো বিরক্তিতে মুখ দিয়ে চ কারন্ত শব্দ করে বলে ওঠে,”কখনোই না। আমি ইহান,ইরফান, আমাদের মেয়ে, বা এই পরিবারের কোনো ছেলেমেয়েকে রাজ*নীতিতে জড়াতে দেবো না। ওরা ডাক্তার হবে,গবেষক হবে।”
_না,ওরা পলিটি*শিয়ানই হবে। ইহান ইরফান আমার প্রতিদ্বন্দ্বীদের মেয়েদের তুলে এনে বিয়ে করবে। ভাবা যায় কতটা থ্রি*লিং হবে ব্যাপারটা?
হাসতে হাসতে বলে সামিন।
আলো কপাল কুঁচকে, ক’ট’ম’ট দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে বলে,”হ্যা। খুব থ্রি*লিং। আর আপনার কন্যা যদি আপনার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীর ছেলের সাথে ভেগে যায় তাহলে ব্যাপারটা আরো থ্রি*লিং হবে!”
সামিন হেসে বলে,”সে দেখা যাবে। আগে আমাদের গল্প শেষ হোক। তারপর না হয় ওদের গল্প শুনবো!”
আলো একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”এসব বাদ দিন। আপনি ইশমাম আর পরীর বিয়েটা কেনো দিচ্ছেন না? অনেক তো নাটক করলেন! এবার বিয়ে দিয়ে দিন।”
আলোকে শুইয়ে দিয়ে সামিন পাশে কাত হয়ে শুয়ে আলোকে আগলে ধরে বলে,”পরীর এক্সাম শেষ হোক। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া আরো দৃঢ় করুক। ধৈর্য্যের পরিক্ষা কি সামিন ইয়াসার মির্জা একা দেবে? সবাই দিক!”
***
পুরো প্র*জেক্ট টা আরো একবার রিভিশন দিয়ে ইশমাম ফোন টা হাতে নেয়। রাত প্রায় বারোটা বেজে গিয়েছে।
“প্রেম মানুষের জীবনে কতবার আসে?”
পরী ফোনের নোটিফিকেশনের শব্দে হাতের একাডেমিক বইটা পাশে সরিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে ইশমামের মেসেজটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই লোকটার নিত্যদিনের কাজ হলো কথোপকথন কোনো অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন দিয়ে শুরু করা,যার উত্তর দেওয়া পরীর সাধ্য নয়।
সে কিছু একটা চিন্তা করে মেসেজটার উত্তর পাঠিয়ে দেয়,”যতবার মানুষের শান্তনা পুরস্কার পেতে ইচ্ছে করে। ততবারই জীবনে প্রেম আসে। প্রেম বড্ড স্বস্তা ব্যাপার ইশমাম মির্জা।”
ইশমাম পরীর উত্তর দেখে কিছুক্ষণ হাসে। তারপর বলে,”এজন্যই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
পরী কোনো উত্তর দেয়না। ইশমাম লেখে,”ঘুমাও। বেশী রাত জাগলে মারুফা চাচীর ভু’ত এসে আড্ডা দিতে চাইবে তোমার সাথে।”
_আসবে না। আয়াতুল কুরসি পড়েছি।
ইশমাম হেসে ফেলে,লিখতে থাকে,”বুদ্ধি সুদ্ধি আগের থেকে একটু বেড়েছে।”
***
হুট করে অসহ্য লাগতে শুরু করেছে। প্রচন্ড ঘামছে। মাথা ঘুরিয়ে দেখতে পায় সামিন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আলো ধীরে ধীরে উঠে বসে, খুবই অস্থির লাগতে শুরু করেছে তার। রেহেনার কাছে যেমনটা শুনেছে সেরকম অনূভুতি হচ্ছে। সামিনকে ডাকতে গিয়েও ডাকে না। লোকটা যদি ভ’য় পেয়ে হসপিটালে নিয়ে সি-সেকশন করিয়ে দেয়! ঐ মাথা খা’রাপ লোককে ডাকা যাবে না। হতে পারে এটা ফলস পেইন, আলো পেটে হাত চেপে ধীরপায়ে বিছানা থেকে নেমে ওয়াশ রুমে ঢোকে।
কিছুক্ষণ পরে বেরিয়ে এসে চাপা স্বরে চেঁচাতে থাকে। সামিনের কানে প্রথমে সে চিৎকার পৌঁছায় না। পর মুহুর্তে লাফিয়ে উঠে আলোর কাছে ছুটে গিয়ে আলোকে ধরে,”কি হয়েছে? কি হয়েছে?”
আলো দাঁতে দাত চেপে বলতে থাকে,”রিতুকে ডাকুন! পরীকে ডাকুন, শিগগিরই!”
_ওদের কেনো? আমাকে বলো?
_আপনি কি মেয়ে? শিগগিরই ওদের ডাকুন পাগল লোক কোথাকার।
চেঁচিয়ে ওঠে আলো!
চলমান….
#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_৫৮_অন্তিম_পর্বের_২য়_অংশ
#Esrat_Ety
[৫৮ পর্বের ২য় অংশ]
শান্তকে দেখে ইশিতা কপাল কুঁ’চ’কে তার দিকে তাকিয়ে আছে। শান্ত ঘাবড়ে যাওয়া মুখ করে বলে,”কি? কি করলাম আমি?”
_তুমি আবার লুঙ্গি পরেছো?
দাঁত খিচিয়ে বলে ইশিতা।
_হ্যা পরেছি , তো? আচ্ছা তোমার এই লুঙ্গির সাথে কি সমস্যা একটু বলো তো!
_লুঙ্গি একটা অ’শ্লীল পোশাক। দেখলে আমার হাড় জ্বলে যায়।
_লুঙ্গি অ’শ্লীল পোশাক!?
শান্ত যারপরনাই অবাক হয়ে যায়। তারপর আবার বলে ওঠে,”এটা একটা ঐতিহ্যবাহী পোশাক বাঙালির। তুমি অ’শ্লীল বানিয়ে দিলে? তোমার পূর্বপুরুষ রা অ’শ্লীল পুরুষ?”
_আমার পূর্বপুরুষ রা লুঙ্গি পরতো না।
_কিন্তু আমার পূর্বপুরুষ পরতো। তাই আমিও পরবো। আর তাছাড়া আমি উঠে এসেছি গ্রাম থেকে। তোমার ভাইদের মতো সাহেব নই, সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মাইনি!
_এক্ষুনি এটা পাল্টে এসো বলছি। নয়তো আমি বিছানায় উঠতে দেবো না তোমাকে।
_কাম অন ইশু, এপ্রিলের গরম। তোমাদের এসিতে কাজ হয় না। এটা পরে ঘুমালে একটু আরাম লাগে,হাওয়া বাতাস ঢুকতে পারে।
_ছিঃ কি কথা বার্তার ছি’ড়ি!
কান চেপে ধরে ইশিতা শান্তকে ধ’মক দেয়।
বাইরে সামিনের চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যায়। ইশিতা শান্তর দিকে তাকায়। শান্ত বলে,”ঐ যে শুরু হয়ে গেলো! আমি আজ ভাবীকে খানিকটা অসুস্থ দেখেই বুঝেছি আজ কিছু হবে! চলো এবার, আমাদের হসপিটাল ছুটতে হবে। তার আগে লুঙ্গি টা পাল্টে আসি আমি!”
পরী সামিনের ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। সামিন এগিয়ে যায়, পরী বলে ,”আমাদের এক্ষুনি বেরোতে হবে ভাইয়া। চলুন।”
***
“তুমি কি পাগল হলে নাকি সামিন? বলেছি তো নরমাল ডেলিভারি পসিবল। তারপরেও সি-সেকশন নিয়ে পরে আছো। এটা কোন ধরনের শখ?”
_আপা ওর কষ্ট হবে।
নরম গলায় বলে ওঠে সামিন।
_আলে আলে! কি কথা! পৃথিবীতে ভূরিভূরি মেয়েরা মা হচ্ছে! তাদের তো আর কষ্ট হচ্ছে না! যাও, যাও গিয়ে বাইরে অপেক্ষা করো। আমাদেরকে আমাদের কাজ করতে দাও।
ডক্টর আফসানা ভেলিভারি রুমে আলোর প্রেশার চেক করতে করতে বলে। আলো চাপা আওয়াজে আর্তনাদ করে যাচ্ছে। পরী তার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সামিন করুণ দৃষ্টি দিয়ে তার বৌয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সামিনের চোখে আলোর চোখ পরতেই আলো চেঁচিয়ে উঠে ডক্টর আফসানাকে বলে,”আপা আপনার আল্লাহর দোহাই লাগে এই আ’হাম্মক লোকটাকে এখান থেকে সরান। উনি আমাকে টেনশন দিচ্ছে। ওনাকে প্লিজ বাইরে বের করে দিন।”
সামিন দাঁড়িয়ে থাকে । ডক্টর আফসানা ধ’ম’ক দিয়ে বলে,”যাও সামিন। বের হও।”
সামিন তবুও দাঁড়িয়ে থাকে। পরী প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে এসে সামিনের হাত ধরে টেনে ভেলিভারি রুম থেকে বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।
বিশাল ওয়েটিং রুমে মির্জা বাড়ির সব লোক এবং আতাউর আলমের পরিবার বসে আছে। রেহেনা একপাশে বসে দু’চোখ বন্ধ কর তাসবিহ পাঠ করছে। সামিন গিয়ে চূ্পচাপ তার পাশে মাথা নিচু করে বসে থাকে। রেহেনা মাথা ঘুরিয়ে একপলক তাকে দেখে বলে,”শান্ত থাকো। আল্লাহ সহায় হবেন।”
তারপর আবারও তাসবিহ পাঠ করতে থাকে। ভেলিভারি রুম থেকে মৃদু আওয়াজ ভেসে আসছে, যা খুবই অস্পষ্ট!
হঠাৎ কোনো পুরুষালি নাকি কান্নার আওয়াজ কানে যেতেই সামিন মাথা তুলে তাকায় । ওয়েটিং রুমে দূরেই তার মুখোমুখি বেঞ্চিতে বসে আছে আতাউর আলম। টিস্যু পেপার হাতে নিয়ে চোখ চেপে ধরে কেঁদে যাচ্ছেন তিনি। আর কিছুক্ষণ পরপর এক একটা দীর্ঘশ্বাস বের করে বলে যাচ্ছে,”আমার মা! আমার মা!”
আজান আয়াত বাবার দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ।
সামিন আতাউর আলমের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখে চ কারন্ত শব্দ করে বলে ওঠে,”এই কেউ ওনাকে এখান থেকে নিয়ে যাও তো! ওনাকে দেখে আমার টেনশন বেড়ে যাচ্ছে!”
আতাউর আলম কান্না থামিয়ে সামিনের দিকে একপলক তাকায়। তারপর আবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলে,”আমার মা । মা রে!”
সামিন ঘার ঘুরিয়ে রেহেনার দিকে তাকিয়ে বলে,”ওনাকে আপনি বিয়ে করেছিলেন কি দেখে মা?”
রেহেনা সামিনের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলে,”তখন আমার বাবাকে বোঝানোর জন্য যদি তুমি থাকতে!”
***
ইশিতার হাতে পরীর ফোন। ইশমাম ফোন দিচ্ছে। ইশিতা ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ইশমাম বলে ওঠে,”হ্যা হ্যালো! তোমরা কোন ফ্লোরে একটু বলবে? আমি তো ভুল করে শিশু ওয়ার্ডে চলে গিয়েছিলাম!”
_আমরা সেকেন্ড ফ্লোরে ইশমাম। ওখানের রিসিপশনিস্ট কে বললেই দেখিয়ে দেবে।
ইশমাম ইশিতার গলার আওয়াজ পেয়ে চুপ হয়ে যায়। ইশিতা বলতে থাকে,”পরী ছাড়াও আমরা এখানে আছি। আমাদেরকেও ফোন দিয়ে প্রশ্নটা করা যায়। আমার বড় ভাই দু’টো না হয় এখন বৌ পাগল হয়েছে। তুই তো বিয়ের আগেই দেখিয়ে দিচ্ছিস! বৌ ছাড়া চোখে কিছু দেখিস না।”
ইশিতার কথা শুনে ইশমাম ফোনটা কেটে দেয়।
***
“আপা আর কতক্ষন লাগবে! আমার দম বেরিয়ে যাচ্ছে!”
আলোর আর্তনাদে রুম ভারি হয়ে যাচ্ছে। দুজন নার্স আলোর হাতে পায়ে মাসাজ করে দিচ্ছে।
আফসানা খুবই ধৈর্য্য ধরে তার কাজটা করে যাচ্ছে। ঘড়ি ধরা একঘন্টা তের মিনিটের চেষ্টার পরে সামিন ইয়াসার মির্জার কন্যা তার মায়ের কষ্ট আর না বাড়িয়ে অবশেষে ভূমিষ্ঠ হয়েছেন।
পৃথিবীতে এসেই তিনি সবার কানের পর্দা ফাটিয়ে দিয়ে চিৎকার করে যাচ্ছে। গলার আওয়াজ টা তার একেবারেই মায়ের মতো উঁচু। হম্বিতম্বি একেবারেই বাবার মতো।
নার্স এসে কাপড়ের পুঁটলিতে মোড়ানো ছোট্টো পুতুলটাকে তার বাবার কোলে দিয়ে বলে,”অভিনন্দন। আপনার ওয়াইফ ঠিক আছে।”
কাঁপা কাঁপা হাতে সামিন তার কন্যাকে কোলে তুলে নেয়। চারপাশ থেকে মৌমাছির মতো ছুটে আসে সবাই সামিন ইয়াসারের কন্যাকে দেখবে বলে।
সামিন কতটা আবেগী হয়ে গিয়েছে তা কেবল পৃথিবীতে যে প্রানীগুলো বাবা হয়েছে তারাই বুঝতে পারবে। অন্য কেউ বুঝতে পারবে না। কাউকে কন্যার মুখ দেখতে না দিয়ে হেঁটে একটা নিড়িবিলি স্থানে গিয়ে দাঁড়িয়ে কন্যার মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। চোখের কোণে পুরুষালি অনূভুতি জমা হয়েছে,যা অন্য কেউ দেখে ফেলে হেসে ফেলবে।
আতাউর আলম পেছন থেকে বলে ওঠে,”আমাকে দাও।”
সামিন ঘুরে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,”আপনাকে কেন দেবো?”
_আমার নাতনি! আমি আজান দেবো ওর কানে।
_আমার মেয়ে। আমি আজান দিতে জানি। আপনি আপনার মেয়ের কাছে যান।
আতাউর আলম কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলে ওঠে,”ও তুমি আজান দিতে জানো? আমি তো জানতাম তুমি শুধু ভাষণ দিতেই জানো।”
সামিন শশুরের দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে। আতাউর আলম চলে যায়। সামিন মাথা ঘুরিয়ে আবারও মেয়ের দিকে তাকিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পরে। মাথা নিচু করে কানের কাছে মুখ নিয়ে আজান দিয়ে মেয়ের কপালে চু’মু খায়।
দু’চোখের কোণে দুফোঁটা পিতৃত্বের অনূভুতি নিয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে,ধরা গলায় বলে ওঠে,”আমার আম্মা তুমি। তুমি ইনশিরাহ বিনতে সামিন। তুমি কষ্টের পরে স্বস্তি।”
ইনশিরাহ চোখ দুটো পিটপিট করছে। হাত দুটো মুঠি করে রেখেছে। সামিন আবেগতাড়িত হয়ে বলে ওঠে,”নাকটা একেবারে মায়ের মতো পেয়েছো।”
দু’চোখ বন্ধ করে আবারও চু’মু খায় মেয়ের কপালে। তারপর হাত দিয়ে ভেজা চোখের কোণ মুছে ইনশিরাহকে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,”আমার দুর্বলতা শুধু তোমাকেই দেখালাম। তুমি ছাড়া পৃথিবীতে কেউ কখনও সামিনের চোখে পানি দেখেনি। তুমি কাউকে বলে দিওনা লজ্জার কথা! ঠিকাছে আম্মা?”
***
পরী রুম থেকে বেরিয়ে একপলক ইশমামের দিকে তাকিয়ে ইশিতার কাছে এসে ফোনটা হাতে নেয়।
ইশিতা বলে ওঠে,”তোকে না বলে তোর ফোনের কল রিসিভ করেছি। আসলে কলটা আমার ভাইয়ের নাম্বার থেকে ছিলো তাই ভাবলাম আমার রিসিভ করার অধিকার আছে।”
পরী লাজুক মুখটা নামিয়ে রাখে। ইশিতা বলতে থাকে,”প্রথমে কে আগে প্রস্তাব দিয়েছে? তুই না ও?”
_উনি।
_হু। জানতাম। ছেলেরা একটু এগিয়ে থাকবে স্বাভাবিক। তা তুই রাজি হলি কেনো?
পরী একপলক ইশমামের দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে ইশিতাকে বলে ওঠে,”কেউ আশ্রয় চাইলে, ফিরিয়ে দিতে নেই।”
***
সামিনকে দেখে নার্স দুজন কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। আলো একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে সামিনের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েকে কোলে নিয়ে সামিন এগিয়ে এসে বেডের একপাশে বসে পরে। আলোর ক্লান্ত দুটি চোখে জড়ো হচ্ছে বাবা মেয়ের প্রতি মুগ্ধতা!
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে বলে ওঠে,”মেয়ে একেবারে তোমার গায়ের রং পেয়েছে আছিয়া। আমার মতো সাদা মুলা হয়নি।”
আলো হাসতে থাকে। সামিন এক হাত বাড়িয়ে আলোর মাথায় বুলিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,”তুমি অসম্ভব স্ট্রং একটা মেয়ে। আমার এতো মানসিক শক্তি নেই। মেয়েটা তোমার মতোই হোক।”
***
অক্টোবর শেষ হতে না হতেই বেশ শীত পরতে শুরু করেছে। সামিন মেয়ের যত্নে আগে ভাগেই শীতকে মোকাবেলা করার সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।
নরম,গরম পোশাক পরিয়ে মাথায় খুব সন্তর্পনে একটা টুপি পরিয়ে দিতে দিতে আলোর দিকে তাকায়। আলো বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। পরক্ষনেই বলে ওঠে,”এভাবে প্যাকেট করছেন কেন ওকে? ও কি আপনাকে বলেছে ওর শীত লাগছে?”
সামিন ইনশিরাহকে কোলে তুলে নিতে নিতে বলে,”বলতে হবে না। আমি বুঝি।”
আলো রোদ থেকে তুলে আনা কাপড় গুলো ভাজ করে আলমারিতে তুলে রেখে দিতে দিতে বলে,”এখন আপনার ব্যস্ততা কোথায়? সারাদিন বাড়িতে মেয়ের কাছে বসে থাকেন। এখন সব ব্যস্ততা কোথায় গেলো?”
সামিন আলোর কথায় কোনো জবাব না দিয়ে ইনশিরাহকে নিয়ে ইশমামের ঘরে যায়। ইশমাম জরুরি কাগজ পত্র সব গুছিয়ে নিচ্ছিলো। সামিনকে দেখে বলে,”কিছু বলবে?”
_তোর ফ্লাইট কখন?
_সকাল সাড়ে আটটায়।
সামিন চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলে ওঠে,”পরীর এক্সাম আজ শেষ হয়েছে। ভনিতা না করে বলি, যদি আংটি পরিয়ে রেখে যেতে চাস তাহলে আংটির অর্ডার দিচ্ছি আমি। যদি রেজিস্ট্রি করে রেখে যেতে চাস তাহলে কাজী ডাকবো। তোকে পাচ মিনিট সময় দিলাম ভাববার জন্য। ভেবে আমাকে জানা।”
ইশমাম বোকার মতো ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন ইনশিরাহর দিকে তাকিয়ে হাসছে। ইশমাম বলে ওঠে,”তুমি কি আমার সাথে মজা করছো?”
_অবশ্যই না।
ঠান্ডা গলায় বলে সামিন। তারপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে ইশমামকে বলতে থাকে,”সিদ্ধান্ত জানা। আমার হাতে সময় কম। তোর হাতেও সময় কম। আংটি না রেজিস্ট্রি? কোনটা?”
ইশমাম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অস্পষ্ট ভাবে বিরবির করে বলে ওঠে,”রেজিস্ট্রি করলেই তো ভালো হয়,নয়তো আবার দেখা যাবে অন্য কেউ এসে এটাকেও তুলে নিয়ে বিয়ে করে ফেললো।”
সামিন মেয়ের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে ছিলো,ইশমামকে বলে,”কিছু বললি?”
_না না, না ভাইয়া, না। কিছুই বলিনি।
সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”কাজী ডাকবো?”
_তোমার ইচ্ছা।
সামিন চুপচাপ ইনশিরাহকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। রিতু আর আলো দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো। চাপা স্বরে রিতু বলে ওঠে,”কি বললো?”
সামিন রিতুর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে ওঠে,”পরীকে সাজাও।”
তারপর আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”পাঞ্জাবি বের করে দাও আমার। কাজী আনতে যাচ্ছি!”
***
সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ কাজী ডেকে ইশমাম আর পরীর রেজিস্ট্রি সেরে ফেলেছে সামিন ইয়াসার মির্জা।
পরী বোকার মতো সবার মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে সাইন করে দিয়েছে পেপারে। বিয়ের ঠিক পাঁচ মিনিট আগে রিতু একটা শাড়ি নিয়ে পরীর ঘরে ঢুকে বলে,”এটা পরো।”
পরী কিছু বুঝতে না পেরে বলে ওঠে,”শাড়ি কেনো?”
_কারন তোমার বিয়ে।
_কার সাথে?
_যার সাথে হলে খুশি হবে তারই সাথে। চটজলদি পরে নিচে এসো,কাজী এসেছে নিচে।
গায়ের শাড়ীটা ভারি খসখসে। পরীর ইচ্ছে করছে এক টানে খুলে ফেলে সালোয়ার কামিজ পরতে। কিন্তু সে ভদ্র মেয়েটির মতো গুটিসুটি মেরে ইশমামের বিছানায় বসে আছে। বিছানার পাশের একটা টেবিলে রিতু একটা দুধের গ্লাস রেখে গিয়েছে। পরী গ্লাসটি থেকে চোখ সরিয়ে পুরো ঘরে চোখ বোলাতে থাকে। এই ঘরে সে কখনো আসেনি এর আগে। এখন থেকে এটা তার স্বামীর ঘর। কথাটা ভাবতেই পরীর অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে।
যেমন অগোছালো লোক,যার যেমন অগোছালো জীবন,তার ঠিক তেমন অগোছালো ঘর।
ইশমাম এসে দরজার বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভেতরে ঢোকে।তখন রাত প্রায় বারোটা।
পরী ইশমামের পায়ের আওয়াজ পেয়ে মাথা তুলে তাকায়। ইশমাম ম্লান হেসে বলে ওঠে,”ভাইয়া অমন পাগল। আমি নিজেও জানতাম না এমনভাবে বিয়ে হবে আমাদের! সবকিছু মাথার ওপর দিয়ে গিয়েছে।”
পরী হেসে ফেলে। তারপর বলে,”আপনার ঘরটা এতো অগোছালো কেন? কি বিশ্রী!”
ইশমাম হাত থেকে হাতঘড়ি খুলতে খুলতে বলে ওঠে,”আমার সবকিছুই অগোছালো হয়ে পরে আছে। তুমি গুছিয়ে দাও।”
মাথামোটা পরী ভেবেছে ইশমাম তার ঘর গোছানোর কথাই বলেছে, সে বিছানা থেকে নেমে,মাথার ঘোমটা সরিয়ে আচল কোমরে গুজে ঘর গোছাতে শুরু করে। ইশমাম মাথা ঘুরিয়ে পরীর কান্ড দেখে হা করে পরীর দিকে তাকিয়ে থাকে।
***
আলোর শুরুতে বড্ড ঘুম পাচ্ছিলো। কিন্তু বাবা মেয়ের কান্ড দেখে ঘুম কে’টে গিয়েছে তার। সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সামিন আর ইনশিরাহকে দেখছে।
মেয়েকে কোলে নিয়ে সামিন ঘুম পা’ড়ানি গান গাওয়ার চেষ্টা করছে। আলোর কাছে সে দৃশ্য বড় মধুর লাগছে।
“খুকু ঘুমালো,পাড়া জুড়ালো,বর্গী এলো দেশে।
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেবো কিসে?”
এতো টুকু গেয়ে সামিন থামে। তারপর আহ্লাদী গলায় মেয়েকে বলে ওঠে,”বাংলাদেশ একটি গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র আম্মা! এখানে ধান বেঁচে খাজনা দিতে হয়না।”
ইনশিরাহ চোখ পিটপিট করে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। আলো
শাড়ির আঁচল মুখে চেপে হাসছে সামিনের দিকে তাকিয়ে। এই লোকটা এতো পাগল কেনো!
সামিন আবারো গাইতে শুরু করে,
“খুকু ঘুমালো পাড়া জুড়ালো, বর্গী তো নেই দেশে…..”
_আপনি খুব বাজে গান করেন মেয়র সাহেব।
আলো মৃদু আওয়াজে বলে। সামিন মেয়েকে মৃদু দোলাতে দোলাতে জবাব দেয়,”জানি। তবে আমি খুব সুন্দর আদর জানি। মেয়ে ঘুমিয়ে গেলে দেখাচ্ছি!”
***
“আমরা বোধ হয় পৃথিবীর প্রথম স্বামী স্ত্রী যারা বাসর ঘরে ঘর গোছাচ্ছি।”
ইশমামের বইয়ের তাক গোছাতে গোছাতে বলে ওঠে পরী। ইশমাম নিজের অগোছালো জামাকাপড় সরিয়ে নিয়ে একটা আলমারি ফাঁকা করে পরীকে বলে,”এটা তোমার। তোমার জামাকাপড় এটাতে রাখবে।”
পরী এসে ইশমামের ব্যাগ গুছিয়ে দিতে দিতে বলে,”আপনার ফ্লাইট কয়টায়?”
_সকাল সাড়ে আটটায়।
_আপনার তো ঘুম প্রয়োজন। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি আপনার সবকিছু গুছিয়ে দিচ্ছি।
ইশমাম পরীর দিকে তাকিয়ে বলে,”সবকিছু গুছিয়ে দেবে?”
পরী ইশমামের ব্যাগে তার শার্ট গুলো সাজিয়ে রাখতে রাখতে বলে,”হ্যা! সব। কি কি গোছাতে হবে বলুন।”
ইশমাম পরীর দিকে তাকিয়ে আছে। অসম্ভব রূপবতী নারীর পরনে একটা কফি কালারের বেনারসী। খুবই মোহনীয় লাগছে তাকে।
পরী মাথা তুলে ইশমামের দিকে তাকায়। তারপর বলে,”কি হলো! বলুন কি কি গোছাতে হবে,ব্যাগ ছাড়া?”
_জীবন।
ইশমাম অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে। পরী ইশমামের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইশমাম বলতে থাকে,”একটা জীবন গোছাতে হবে।”
***
রাত দেড়টার কাছাকাছি। ইনশিরাহ বাবার কোলে ঘুমিয়ে গিয়েছে। সামিন খুবই সন্তর্পনে মেয়েকে দোলনায় শুইয়ে দিয়ে আলোর দিকে তাকায়। আলো সামিনের দৃষ্টি দেখে লজ্জা পেয়ে যায়। সবসময় মেয়েকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে ঘুমায় মানুষটা, কিছু কিছু রাত শুধু আলো থাকে তার বুকে। আজ সম্ভবত সেই রাত ।
আলো বিছানা থেকে নেমে নিচু স্বরে বলে,”কমলা রঙের শাড়ি পরতে হবে?”
সামিন চুপ করে থাকে। আলো শাড়ি পাল্টে চুলে খোঁপা করে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। সামিন এক দৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে থেকে এগিয়ে যায়, পেছন থেকে আলোর কোমর জড়িয়ে ধরে আলোর কাঁধে থুতনি ঠেকায়। আলো ধীরে ধীরে সামিনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলে ওঠে,”শরীরে মেদ জমছে আমার।”
_এতোটুকু জরুরী। নয়তো কৃত্রিম লাগে সে সৌন্দর্য। এখন আমি তোমার দুধরনের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হই। একজন স্ত্রীর সৌন্দর্য, আমার সন্তানের মায়ের সৌন্দর্য।
আলো চুপ করে থাকে। সামিন বলে ওঠে,”আমারও তো ভুড়ি বেড়ে যাচ্ছে। মাথার চুল উঠে যাচ্ছে।”
আলোও নিচু স্বরে বলে ওঠে,”এতো টুকু জরুরী। নয়তো কৃত্রিম লাগে। এখন আমি আপনার অসংখ্য সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হই। একজন অসাধারণ স্বামীর সৌন্দর্য,স্নেহপরায়ন বাবার সৌন্দর্য, একজন দায়িত্বশীল বড় ভাইয়ের সৌন্দর্য,একজন ন্যায়পরায়ণ নেতার সৌন্দর্য।”
সামিন মৃদু হেসে আলোকে কোলে তুলে নেয়। আলোর দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে ওঠে,”মেদ বেরেছে,সাথে ওজনও।”
আলো হেসে ফেলে। সামিনের কাছে সে হাসি বড় মধুর লাগে। আলোকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে কপালে চু*মু খায়। তারপর ঘোর লাগা দুটো চোখে আলোর মুখের দিকে একপলক তাকায়। বরাবরের মতো লজ্জায় লাল হয়ে আছে মুখটা। বাতি নিভিয়ে স্ত্রীকে কাছে টেনে নিয়ে ভালোবাসতে চায় তাকে, অনুমতি চায় বরাবরের মতো। দু’জনের অনূভুতি যখন একে অপরকে সম্মতি দিলো , ঠিক সেই আবেগী মুহুর্তে ইনশিরাহ গলা ফাটিয়ে কাঁদতে শুরু করে দেয়।
সামিন উঠে বাতি জ্বেলে আলোর দিকে তাকায়। আলো তার দিকেই তাকিয়ে আছে, সামিন বলে ওঠে,”এটা আমার মেয়ে না শ’ত্রু। এর থেকে তো বিরোধী দল আমাকে বেশি মায়া করে।”
আলো মুখে শাড়ির আঁচল চেপে হাসছে। সামিন উঠে গিয়ে ইনশিরাহকে আবারও কোলে তুলে নিয়ে কান্না থামায়। আলো শুয়ে শুয়ে বাবা মেয়েকে দেখতে থাকে।
সামিন মৃদু দুলতে থাকে মেয়েকে কোলে নিয়ে,
“খুকু ঘুমালো,পাড়া জুড়ালো, বর্গী এলো দেশে……”
থেমে আবারও বলতে থাকে,”মা একটা নতুন গান বাঁধতে হবে বুঝলে। এখন দেশে বর্গী নেই। বাংলাদেশ একটি গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র।”
মেয়ের সাথে যতরাজ্যের গল্প জুড়ে দেয় সামিন ইয়াসার মির্জা। তবে কোন রূপকথার গল্প নয়! রাজ*নীতির গল্প। ইনশিরাহ চোখ ছোট ছোট করে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। আলো দেখছে তাদের দুজনকে।
ইনশিরাহ ঘুমিয়ে যায়, ঘুমিয়ে গিয়েছে আলোও। সামিন ইনশিরাহকে আলোর পাশে শুইয়ে দিয়ে দু’জনের দিকে তাকিয়ে থাকে চোখে এক সমুদ্র মুগ্ধতা নিয়ে।
তার চোখে চকচক করছে পবিত্র কোনো আলো। যে আলো লেগেছিল তার বধূকে দেখে।
~~~~~~~~~সমাপ্ত~~~~~~~