বাঁধনহীন সেই বাঁধন অকারণ পর্ব-৩০ এবং শেষ পর্ব

0
1003

#বাঁধনহীন_সেই_বাঁধন_অকারণ|৩০|
#শার্লিন_হাসান

তাঁদের রুমের সামনের বিশাল বেলকনি সাজাচ্ছে রুদ্র। এটাকে বেলকনি না বললেও চলে। বসার জন্য সোফা আছে সামনে জায়গা ও আছে। রুমের মতোই তবে ওত দরজা জানালা না থাকলেও রেলিং দেওয়া আছে। ফাঁকা জায়গা।

লাভ শেপের বেলুন দিয়ে সোফায় পেছনে লাভের মতো করে সাজিয়েছে রুদ্র। মেঘ হয়ত বাকীদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। দুইঘন্টার ভেতরে সাজানোর কাজ কমপ্লিট ওতোটা গর্জিয়াস না। কেকটা রেখে ভেতরে চলে যায় রুদ্র।

রাতের লান্স করে রুদ্র আগে,আগে রুমে চলে আসো।মেঘ সবটা সামনে রুমে আসতে একটু লেট হয়ে যায়। বিছানায়া হাত পা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে মেঘ। তখন রুদ্র একটা শপিং ব্যাগ এগিয়ে দেয় মেঘের দিকে।

-এই শাড়ীটা পড়ে তৈরী হয়ে নেও।

-এখন কেন?

-বাইরে বের হবো।

-এই রাতে?

-রাত বেশী না। যাও তো!

মেঘ মাথা নাড়িয়ে চলে যায় শাড়ী পরিধান করতে। রুদ্র বসো ওয়েট করে মেঘের জন্য। কিছুক্ষণ পর মেঘ শাড়ী পড়ে আসতে রুদ্র গাজরা হাতে আর খোঁপায় পড়িয়ে দেয়।

-বউ,বউ লাগছে কিন্তু।

-এতোদিন কী ছাত্রী লাগতো?

-শুরু থেকে ছাত্রী।

-ভুল! শুরু থেকে বেয়াইন আর বেয়াই তারপর প্রণয়।

হাসে রুদ্র। মেঘ হালকা গোছগাছ হয়ে নেয়। রুদ্র তাকে নিয়ে রুমের সামনের বেলকনি তে যায়। লাইট অন করতে মেঘ তাকায়। সুন্দর ভাবে সাজানো হয়েছে। রুদ্র ফুলের তোড়া সাথে একটা ঝুড়িতে করে এক ঝুড়ি চকলেট দেয় মেঘকে।

-আমার চকলেট লাভার বউ।

-ধন্যবাদ জামাই।

দু’জনে বসে কেক কাটে। সুন্দর একটা মূহুর্ত অনুভব করে। রুদ্র তাকায় মেঘের দিকে। মেয়েটার হাসিতে পূর্ণতা এবং প্রাপ্তি দু’টোই অনুভব করা হবে যাচ্ছে।

-অনেকগুলো দিন একসাথে কাটালাম। সামনের দিনগুলো ও কাটাতে চাই ছায়ামানব।

-এখন আর ছায়ামানব নেই আমি। বাঁচাল বউয়ের জন্য নিজেও বাঁচাল হয়ে গেলাম।

-হ্যাঁ এটাই তো আমি চেয়েছি।

-ভালোবাসি চঞ্চল মেয়ে।

-ভালোবাসি আমার বেয়াই টু ভাইয়া এন্ড ভাইয়া টু সাইয়্যা। আপনি জানেন কী? ভালোবাসাটাও কিন্তু বাধনহীন অদৃশ্য একটা বাধন।যেই ভালোবাসাটা অকারণে হয়ে যায়।

-হু জানি আমার মহারানী।

******

কেটে যায় আরো দুইটি মাস। রুদ্র কলেজ থেকে ফিরতে,ফিরতে বিকেল গড়িয়ে যায়। আফরোজা বেগম, রাখি এসেছে চৌধুরী অন্দরমহলে। রুদ্রর জানামতে আসার কথা না। হয়ত কোন কারণে এসেছে আর রাখি আসার আগে সবসময় তাকে বলে। রুদ্র ফ্রেশ হয়ে বসতে ফাইজা চৌধুরী তার খাবার বেড়ে দেয়। তথন কথাপ্রসঙ্গে মেঘের পড়াশোনার কথা উঠে৷ তখন রুদ্র বলে,

-আমি তো চেয়েছি ও পড়াশোনা কন্টিনিউ করুক। ও না করলে কে কী বলবে?

তখন মেঘ বলে,

-পড়ালেখা যা কঠিন সবাই জানে আমি টেনেটুনে পাশ করা পাবলিক। মান-সন্মান যেটুকু আছে সেইটুকু নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচবো।

তখন রাখি বলে,

-কেন আগে কী তুমি মাথা নিচু করে বাঁচতে।

-সবার সামনে উঁচু মাথা নিয়ে কথা বলতাম কিন্তু তোমার ভাই উঠতে বসতে রেজাল্ট নিয়ে অপমান্স দিতো।

মেঘের কথায় রাখি বলে,

-সে তোমার ভালো চেয়েই।

ফাইজা চৌধুরী হাসিখুশি মুখে পায়েশ নিয়ে আসে ট্রে-তে করে। রুদ্র ব্রু কুঁচকায়।

-হঠাৎ পায়েশ কেন দাদীন?

-সুখবর আছে সেজন্য মিষ্টি মুখ করিয়ে সুখবরটা দেবো।

রুদ্র ভাবছে বিজন্যাসে ভালো কিছু হয়েছে। রাখি নিজের ছেলেকে বসিয়ে পায়েস খাওয়াচ্ছে। বাকীরাও পায়েশ খাচ্ছে। রুদ্র একচামচ খেয়ে বলে,

-কী সুখবর দাদীন?

ফাইজা চৌধুরী আশেপাশে তাকায়। পরক্ষণে বলে,

-থাক মেঘ বলে দিও।

রুদ্র কিছু বলেনা। উঠে রুমে চলে যায়। মেঘ বাকীদের সাথে বসে কথা বলছে।

রুদ্র রুম জুড়ে পায়চারি করছে। কী এমন সুখবর?

সন্ধ্যায় মেঘ রুমে আসতে রুদ্র জিজ্ঞেস করে,
-কী সুখবর মেঘ?

-আপনি বাবা হবেন।

সাদাসিধা ভাবেই বলে মেঘ। রুদ্র মেঘের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।

-তো আমাকে কল করে বললে কী হতো? বেবির পাপা আমি অথচ আমিই সবার শেষে জানলাম সে আসছে।

-আসলেই ঠিক বলেছেন তখন বললেই পারতাম। এখন বলেও লাভ হলো না।

-কী লাভ?

-কোথায় আপনি আমায় জড়িয়ে ধরবেন। খুশিতে আত্মহারা হবেন। কোন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন না।

-আমি নাচবো এখন?

-অন্যরা হলে ঠিকই নাচতো।

-নাচলে তোমায় নিয়ে নাচবো কিন্তু এখন নাচা পসিবল না। তুমি ব্যথা পাইবা।

হাসে মেঘ। রুদ্র তার কপালে আলতো করে স্পর্শ করে। মেঘ রুদ্রকে জড়িয়ে ধরে।

*******

হসপিটালের করিডোরে পায়চারি করছে রুদ্র। মেঘকে ওটিতে নেওয়া হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। এর আগে যখন আলট্রা স্নো গ্রাফি করিয়েছে ডক্টর বলেছে টুইন বেবি হবে। প্রথম কয়মাস যেতেই কিছুটা আন্দাজ করেছে মেঘ। সাধারণের তুলনায় একটু বেশী বেড়ে গেছে। যেটা নিয়ে অনেক চিন্তিত ছিলো সে। পরবর্তীতে ডক্টর বলায় চিন্তামুক্ত হয়েছে সে।

কিছুক্ষণ পর দুজন নার্স আসে। সাদা কাপড় দিয়ে দুটো বাচ্চা পেঁচানো। বাবুদের দেখে রুদ্র আর ফাইজা চোধুরী কোলে নেয়। রুদ্রর দু’টো মেয়ে বাবু হয়েছে। রুদ্রর কোলে থাকা বাবুর দিকে একনজর তাকায়। চোখটা কারোর সাথে মিলছে। রুদ্র অবাক হয়। পরক্ষনে ধারণা বদলে নেয় ‘মাত্র জন্ম নিয়েছে। বড় হবে একেকসময় একেক রকম হবে চেহারা।’

বাবুকে আফরোজা বেগমের কোলে দিয়ে মেঘর কাছে ছুটে রুদ্র। সে চোখ বন্ধ করে আছে। রুদ্র কয়েকবার ডাক দিতে চোখ মেলে তাকায়। প্রথমে রুদ্রর হাস্যোজ্জ্বল মুখটা দেখতে পায় মেঘ। তাতে নিজেও মুচকি হাসে।

-আমাদের দু’টো রাজকুমারী এ চৌধুরী এসেছেন বাবুদের দেখতে। সাথে তার বড় দুই ভাই, বউয়েরাও এসেছে। রুম জুড়ে চৌধুরীদের সদস্য। সবাই বাবুদের দেখছে। কতবছর পর তাঁদের পরিবারে নতুন সদস্য এসেছে।

হসপিটালে বসেই রুদ্র তার এক মেয়ের নাম রেখেও ফেলে। শুধু সংক্ষিপ্ত একটা নাম। বালী নাম পরে ভেবে রাখবে। যাকে প্রথমে কোলে নিয়েছে তার ডাক নাম ‘রুশা’ রাখে। বাইরে এসে অর্ণব বলে,

-উহুম এতো নাম থাকতে রুশা কেন?

-কেনো নামটা খারাপ?

-খারাপ না। কারোর সাথে মিলছে।

-তার কপালের সাথে আমার মেয়ের কপালটাও কিছু মিলে।

-কই আমি তো মিল পেলাম না।

-তুই কী করে পাবি? তুই কী সামনাসামনি ওকে দেখেছিস?

-তাই বলে প্রাক্তনের নামের সাথে?

-উঁহু! আমি নব্বই দশকের প্রেমিক ছিলাম তার মতে।

-হাহ! ভালোবাসা।

মলিনহাসে রুদ্র। অর্ণবকে চাপড় মেরে বলে,

-এখন মেঘ আমার সব।

-তো আলিশার নাম কেনো টানছো?

-নব্বই দশকের প্রেম যতটুকুই ছিলো এখন এটা মিসিং থাকে। সব পরিপূর্ণতা দিয়ে দিলাম।

হাসে অর্ণব। রুদ্র আড়চোখে মেঘকে দেখে। মেয়েটা হাসছে আর বাবুদের দেখছে। মেঘের দিকে তাকিয়ে রুদ্র নিজেও হাসে।

তিনদিন পর বাবুদের বাড়ীতে আনা হয়। সাতদিন পর আকিকা দিবে। সবাই এখন অন্দরমহলে আছে। রুদ্রর দুই মেয়েকে নিয়ে কাড়াকাড়ি। কে আগে কোলে নিবে,কে আগে আদর করবে। সাদবি! সে তো রুদ্রর দুই কন্যা বলতে আজকাল পাগল।
রুদ্রর দুই মেয়ের নাম রাখা হয়,
‘নীলাদ্রিতা চৌধুরী রাফা’
‘নওশাবা চৌধুরী রুশা’

বাবুরা ঘুমোতে সাদবি আর ফাইজা চৌধুরী দিয়ে গেছে। মেঘ বসে,বসে ফ্রুটস খাচ্ছে। রুদ্রর কড়া আদেশ গুলো তাকে অক্ষরে, অক্ষরে মানতে হয়।

রুদ্র আসতে মেঘ রুদ্রকে বলে,

-মেয়েদের এখন আর খোঁজ রাখেন না আপনি।

-তুমি না আছো। তুমি থাকতে আর কী লাগে?

-বাপ লাগে না? কী এক কলেজ পেয়েছেন। দু’টো দিন তো ছুটি নিতে পারেন।

-লাভ কী? সে তো কাকী মা,সাদবি,বাবা,দাদীন ওঁদের কাছেই বাবুরা থাকে।

-তারপর ও চোখের সামনে থাকবেন তাহলে না চিনবে।

-থাকবো আগামী এক সপ্তাহ। ছুটি নিয়ে নিয়েছি।

-ধন্যবাদ।

ঘুমন্ত মেয়েদেরকে কিছুক্ষণ আদর করে রুদ্র। মেঘ রুদ্রকে আর তার মেয়েদেরকে দেখছে।

-মানুষ যে কারোর প্রতি ভালোবাসা নামক বাধনহীন অদৃশ্য বাঁধনে, অকারণে জড়িয়ে যায় এবং এই ভালোবাসার বাঁধনহীন বাঁধনে অকারণে মেঘ ও আটকা পড়েছে। রুদ্রর ভালোবাসার অদৃশ্য বাঁধনে নিজেকে মুড়িয়ে নিয়েছে।

ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল ভালোবাসার মানুষগুলো। কিছু অনভূতি,কিছু চাওয়া-পাওয়া পূর্ণতা পাক সবার গল্পেই। কাউকে ভালোবেসে ফেললে সে যাতে তার ভালোবাসার বাঁধনে আটকে থাকে এবং তাঁদের ভালোবাসাটাও পূর্ণতা পাক। ঠিক মেঘাদ্র আর আনিরবাস জুটির মতো।

সমাপ্ত